ধনীর বাড়িতে শোকের তেমন উচ্ছ্বাস থাকে না। অর্থ, আরাম, বিলাস ও ব্যসন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে একটা দূরত্ব রচনা করে। আত্মীয়তার বন্ধন সেখানে শিথিল হতে বাধ্য। কোকাবাবুর বাড়িতে শোকের একটা সৌজন্যসূচক স্তব্ধতা বিরাজ করছে বটে, কিন্তু প্রকৃত শোক যে এ নয় তা বারবাড়ি পার হয়ে গাড়িবারান্দা অতিক্রম করে বৈঠকখানায় ঢুকতে ঢুকতেই অনুভব করলেন হেমকান্ত।

কোকাবাবুর এস্টেটের কর্মচারীরা অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত হয়েই ছিল। প্রৌঢ় নায়েব বিশ্বেশ্বর এগিয়ে এসে জোড়হাতে বলল, আসুন, আসুন।

হেমকান্তর বুকে এক প্রগাঢ় যন্ত্রণা থাবা গেড়ে আছে। না, কোনও ব্যথা বা বেদনা নয়, জ্বালা নয়। যেন একসেরি একটা লোহা তাঁর হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে লেগে ঝুলে আছে। বৈঠকখানায় অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি সময়োচিত গাম্ভীর্য মুখে মেখে বসে আছেন। প্রায় সকলকেই হেমকান্ত চেনেন। নীরবে দু-একজন হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন তাঁকে। দু-একজন হতাশাভরে মাথা নাড়লেন। মোক্তার রাজেনবাবু উঠে এসে হেমকান্তর সঙ্গে ভিতরবাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, কোকাবাবুর বিষয়-সম্পত্তির অবস্থা খুবই খারাপ।

হেমকান্তকে খবরটা স্পর্শ করল না। নির্বিকার মুখে বললেন, তাই নাকি?

কেন, আপনি জানেন না?

তো। ইদানীং প্রায় সবই গোপনে বিক্রি করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু নগদ টাকাও কিছু দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ছেলেতে-ছেলেতে তুমুল হচ্ছে।

হেমকান্ত আর-একটু বিবর্ণ হয়ে গেলেন। রাজেনবাবু ফের বৈঠকখানায় ফিরে গেলেন। বিশ্বের আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে হেমকান্তকে কোকাবাবুর ঘরে হাজির করে দিল।

আশ্চর্য, আজও কোকাবাবুর ঘরের এক কোণে বসে ক্লান্ত এক কীর্তনীয়া তারকব্রহ্ম নাম করে যাচ্ছে, মৃদু করতালের সঙ্গে। ডাক্তার সূর্যকান্ত সেন একটি চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আর একটি চেয়ারে কোকাবাবুর বড় ছেলে মাথায় হাত দিয়ে বসা। দু-একজন দাসী ও চাকর উদ্দেশ্যহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কোকাবাবুর শ্বাস উঠেছে। জ্ঞান নেই। গলায় আজ একটা নতুন জিনিস দেখতে পেলেন হেমকান্ত। সোনার একটা চেন ছিল। সেটি নেই। তার জায়গায় একটা কাঠির মালা পরানো।

কী একা, কী আত্মীয়-পরিজনহীন আজ কোকাবাবু! মৃত্যু মানেই কি একাকীত্ব ও পরিজনহীনতা? মুমূর্ষ ওই মানুষটি কি এই মুহূর্তে টের পাচ্ছেন যে, তার স্ত্রী আছে, পুত্রকন্যা আছে, বিষয়-সম্পত্তি আছে? এমনকী দেহ বা অস্তিত্বই কি অনুভব করছেন? সেই ফরসা ও সুন্দর চেহারাটির আজ কী দশা! এই দেহটি একটু পরেই অগ্নিতে সমর্পিত হবে। তখন কোকাবাবু কোথায়?

কে একজন একটি চেয়ার এগিয়ে দিল। কিন্তু হেমকান্ত বসলেন না। তাঁর মনে হল বসতে গেলেই তিনি মূৰ্জিত হয়ে পড়ে যাবেন।

তিনি সূর্য ডাক্তারের চেয়ারের হাতলটি ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। সূর্য ডাক্তার ধীরে ধীরে উঠে তার কানে কানে বললেন, আর কয়েক মিনিট। হয়ে এসেছে।

হেমকান্ত জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু জিভটাও শুকনো এবং খড়খড়ে। মানুষ এত নিষ্ঠুরভাবে আর-একজন মানুষের মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে কী করে? নিজের মৃত্যুর অমোঘতার কথা তার মনে পড়ে না?

কোকাবাবুর অস্বাভাবিক শ্বাসের শব্দ ক্রমেই ঘরখানা ভরে তুলছিল। এত বিশাল ও বিষণ্ণ শব্দ হেমকান্ত আর কখনও শোনেননি। তার পায়ের নীচে মৃদু একটা ভূমিকম্প টের পাচ্ছিলেন তিনি। আসল ভূমিকম্প নয়, তার নিজেরই শরীরের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন। তার শিথিল হাত থেকে কুয়োর বালতির দড়ি অন্তহীন নেমে যাচ্ছে। তিনি ঠেকাতে পারছেন না সেই নিম্নগতি।

হেমকান্ত যে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবেন সেই শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। তিনি স্থবির ও প্রস্তরীভূত হয়ে গেছেন। কোকাবাবুর জড়বৎ দেহটি এক প্রবল সম্মোহনে তাকে আটকে রেখেছে। তিনি দৃশ্যটি দেখতে চাইছেন না, কিন্তু না দেখেও যেন উপায় নেই।

সূর্যকান্ত গিয়ে কোকাবাবুর হাতখানা তুলে নাড়ি দেখলেন। কিছু কুঞ্চিত, মুখে যথাযথ উদ্বেগ। কোকাবাবুর গলায় একটা ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছিল, সেটা আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এল। একটা হেঁচকি ওঠার মতো শব্দ হল কি? কিন্তু ঘরটা অকস্মাৎ শব্দহীন হয়ে গেল। সূর্যকান্ত কোকাবাবুর হাতখানা নামিয়ে রাখলেন। গগন মুখ তুলে তাকাল। সূর্যকান্ত ডাইনে বাঁয়ে মৃদু মাথা নাড়লেন।

এ সবই বুঝতে পারছেন হেমকান্ত। ইঙ্গিত স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। নিস্তব্ধ ঘরে ক্লান্ত কীর্তনীয়া হঠাৎ তার নামগান চৌদুনে তুলে দিল। একজন দাসী সরু স্বরে কেঁদে উঠে ভিতরবাড়িতে ছুটে গেল।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন তা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলেন হেমকান্ত। ঘরখানা যখন আত্মীয়-পরিজন ও অতিথিতে ভরে উঠল তখন খুব আস্তে আস্তে তিনি বেরিয়ে এলেন।

ঘোড়ার গাড়িতে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে রঙ্গময়ি। অপলক চোখে চেয়ে আছে হেমকান্তর আসা-পথের দিকে। হেমকান্ত গাড়ির কাছে আসতেই কোচোয়ান দবজা খুলে দেয় এবং রঙ্গময়ি হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে।

হেমকান্ত তার দুদিকের জানালা তুলে দিলেন। গাড়ির ভিতরটা গভীর অন্ধকারে ড়ুবে গেল।

রঙ্গময়ি কোনও কথা বলল না। কিন্তু এই নিভৃত অন্ধকারে লোকচক্ষুর অগোচরে সে নির্লজ্জের মতো হেমকান্তর একখানা হাত ধরে রইল।

হেমকান্তর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছিল না। হাত থরথর করে কাঁপছে। গা বড় বেশি ঠান্ডা। স্বরভঙ্গ ঘটেছে। ভাঙা গলায় হেমকান্ত হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, মনু, তুমি আছ তো?

থাকব না তো কোথায় যাব? বড় অন্ধকার। জানালা খুলে দিই?

না, জানালা খুলো না। আমার বড় শীত করছে। কাঁপছি।

বীজমন্ত্র জপ করো। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

হেমকান্ত ফিস ফিস করে বললেন, সুনয়নীকে আমি চোখের সামনে মরতে দেখিনি। তুমি দেখেছ, না?

সে কথা হঠাৎ আজ কেন?

আজ প্রথম একজন মানুষকে আমি নিজের চোখে মরতে দেখলাম।

তাতে কী হয়েছে? ডাক্তাররা তো অনবরত মানুষকে মরতে দেখছে। প্রথম-প্রথম হয়তো খারাপ লাগে, তারপর আর অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না।

তুমি সুনয়নীকে মারা যেতে দেখেছ, মনু?

দেখেছি। আমি আরও মৃত্যু দেখেছি।

তোমার খারাপ লাগে না?

মৃত্যু মাত্রই খারাপ।

ওঃ মনু!-বলে হঠাৎ হেমকান্ত রঙ্গময়ির হাত চেপে ধরেন। তারপর আস্তে আস্তে বলেন, আমি কেন আজ এত একা, মনু? কেন আমার এত একা লাগছে? তোমরা কেউ কি নেই আমার কাছে?

রঙ্গময়ি এক হাত বাড়িয়ে জানালা খুলে দেয়। ব্রহ্মপুত্রের হিমশীতল বাতাস আসে হু-হু করে। সঙ্গে পচা মুলি বাঁশ আর পাটের গন্ধ।

হেমকান্ত আস্তে হাতটা টেনে নেন। তারপর বলেন, কাজটা তুমি ঠিক করোনি।

কোন কাজটা?

এই কোকাবাবুর কাছে আমাকে নিয়ে আসাটা।

তুমি পুরুষমানুষ, এত ভয় পেলে চলে?

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বলেন, ভয় নয়। এ অন্য একরকম অনুভূতি। তুমি ঠিক বুঝবে না। শৈশব গেছে, কৈশোর গেছে, যৌবন গেছে, এখন এল বার্ধক্য। এই বার্ধক্যকে আমি সইতে পারছি না।

তোমার বার্ধক্য?–রঙ্গময়ি অবাক হয়।

তুমি জানো না। তুমি জানো না। রঙ্গময়ি চুপ করে থাকে।

গাড়ি একটা বাঁক ফেরে। তারপর খানিকটা ঢালু বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকে দেউড়ি পেরিয়ে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে।

হেমকান্ত নামেন। বাড়ির সব ঘরে আজকাল আলো জ্বলে না। এক বৃহৎ অন্ধকারে ড়ুবে আছে তার পিতৃপুরুষের এই বাসস্থানটি। তিনি সেই অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। মৃত্যু তার কাছে নতুন নয়। এ বাড়িতে তার মায়ের মৃত্যু ঘটেছে, বাবার মৃত্যু ঘটেছে। ব্রহ্মপুত্রের জলে ভেসে গেছে নলিনীর মৃতদেহ। সুনয়নী গেল এই তো সেদিন। কিন্তু সেদিনের হেমকান্ত আজ আর নেই।

রঙ্গময়ি নেমে হেমকান্তব পাশে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল, তুমি ঘরে যাও। আমি একটু বাদে আসব।

হেমকান্ত মাথা নাড়লেন। একজন চাকর লণ্ঠন হাতে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে সসম্রমে। হেমকান্ত আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে উঠলেন। ঢুকবার মুখেই বাঁ ধারের ঘরখানায় কৃষ্ণকান্ত তার গৃহশিক্ষক প্রতুলের কাছে পড়াশুনো করছে। হেমকান্ত কদাচিৎ এই ঘরে ঢোকেন। আজও ঢুকলেন না। দরজায় কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকান্তর দিকে চেয়ে রইলেন।

কৃষ্ণকান্ত বালক মাত্র। ভারী সুদর্শন। তার ছেলেদের মধ্যে এই কৃষ্ণকান্তর আদল কিছু আলাদা। অন্যদের চেহারায় জৌলুস আছে কিন্তু বুদ্ধির এত দীপ্তি নেই। দশ-এগারো বছর বয়সেই কৃষ্ণকান্তর মুখে ধারালো বুদ্ধি ও দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। বলাবাহুল্য, কৃষ্ণকান্তর প্রতি হেমকান্তর দুর্বলতা কিছু বেশি। আর সেইজন্যই অন্যান্য ছেলের নামে কান্তি যোগ করলেও কৃষ্ণকান্তর কান্তি ঘেঁটে দিয়ে নিজের নামের কান্তটুকু তিনি যোগ করেছেন।

কৃষ্ণকান্ত তাঁর উপস্থিতি টের পেয়ে তাকাল এবং উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে প্রতুল। প্রতুল খুব মেধাবী এবং দরিদ্র। সে বি এ পড়ে। হেমকান্তর সাহায্য না পেলে সেটুকুও পারত না। কৃষ্ণকান্ত ও প্রতুল দুজনেই জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। হেমকান্ত একটু লজ্জা পান। মাথা নেড়ে বলেন, কিছু নয়। পড়ো তোমরা, পড়ো।

ধীরে ধীরে চাকরের লণ্ঠনের আলোয় পথ দেখে দেখে তিনি নিজের ঘরে আসেন। সেখানে অবশ্য উজ্জ্বল সেজবাতি জ্বলছে।

আর-একজন চাকর তার পোশাক ছাড়িয়ে দেয়। ধুতি, মোজা ও বালাপোষের কোট পরে তিনি মস্ত খাটের বিছানায় একটা শাল জড়িয়ে বসেন। আজ তার মনে হয় একটা কোনও নেশা থাকলে বেশ হত। এখন একটু বেশি মাত্রায় হুইস্কি বা ব্র্যান্ডি খেয়ে শুয়ে পড়লে গাঢ় ঘুম হত তার।

এ কী? তুমি ঘরে যে!—-রঙ্গময়ি হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে বলে।

কেন, কী হয়েছে?

মড়ার ঘরে ঢুকেছিলে। চানটান করোনি! আগুন ছোওনি! কী অশুচি কাণ্ড! ওঠো, ওঠো! বিছানাপত্তর সব ফেলতে হবে। মশারিশুদ্ধ। ঘরে গঙ্গাজল দিক। ওঠো শিগগির।

হেমকান্ত ওঠেন। কিছু তটস্থ, কিছু অপ্রতিভ।

“কত আদরের এই দেহ। তবু যখন দেহ মরে তখন তাহা অশুচি হইয়া যায়। প্রিয়জন যতক্ষণ জীবিত থাকে, ততক্ষণ কত সমাদর, কত আদর ও সোহাগ। সেই প্রিয়জন যখন মৃতদেহে পর্যবসিত হইল তখনই তাহা অস্পৃশ্য। দেহ পোড়াও, গোর দাও, যত শীঘ্র পারো তাহা বিনাশ করিয়া ফেলল। তাহার সংস্পর্শে যত কিছু ছিল তাহা কাচিয়া, গঙ্গাজল, গোবরছড়া দিয়া শুদ্ধ করিয়া লও। এরূপ নিয়ম আমার ভাল লাগে না, কিন্তু বুঝি ইহার কিছু প্রয়োজন আছে। মৃতদেহ রোগজীর্ণ, জীবাণুযুক্ত, পচনশীল। কিন্তু যতক্ষণ প্রাণ থাকে ততক্ষণ তাহার আদর।

“এই চিন্তা হইতে আমি প্রাণের প্রশ্নে উদ্বেলিত হইলাম। প্রাণ কী? আত্মা কী? দেহের সঙ্গে প্রাণ বা আত্মার যোগসূত্রই বা কী? দেহমুক্ত আত্মার অবলম্বনই বা কী?

“আমি এইসব প্রশ্ন লইয়া একজন জানবুঝওয়ালা লোকের সঙ্গে আলোচনা করিবার ফিকির খুঁজিতেছিলাম। তুমি কাছে নাই। বিজ্ঞ বয়স্যের একান্তই অভাব। অগত্যা আমাদের কুলপুরোহিত বিনোদচন্দ্রের শরণ লইতে হইল। বিনোদচন্দ্র পুরোহিত হিসাবে কেমন তাহা কখনও খোঁজ করি নাই। তিনি আবার বাবার নিযুক্ত পুরোহিত। কিন্তু হা হতোস্মি! বিনোদচন্দ্র আমাকে যাহা বুঝাইবার চেষ্টা করিল তাহা বাসাংসি জীর্ণানির অধিক কিছু নহে। আমি তাহাকে বলিলাম, জীর্ণ বাস পরিত্যাগ করে যে শরীর তাহা তো একটি বস্তু। কিন্তু শরীর ছাড়িয়া যে বাহির হয়, যাহাকে প্রাণ আখ্যা দেওয়া হইয়া থাকে তাহা কোন বস্তুতে নির্মিত? আত্মার পদার্থই বা কীরূপ? উনি বলিলেন, বায়ু জাতীয় পদার্থ।

“আমি তাঁহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি আত্মাকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন কি না। উনি জবাবে বলিলেন, বহু আত্মা দেখিয়াছি। পরিষ্কার জলে ক্ষুদ্র মাছেরা যেরূপ সন্তরণ করে আমাদের চতুর্দিকে সেরূপ বহু আত্মা সন্তরণ করিতেছে। তবে দেখিবার জন্য চক্ষু ও মনকে প্রস্তুত করিতে হয়।

“আমি চক্ষু ও মনকে প্রস্তুত করিতে রাজি। বিনোদচন্দ্র তখন ফাঁপরে পড়িলেন। বলিলেন, এখন কিছুদিন শুদ্ধাচারে জপতপ করুন, পরে পদ্ধতি শিখাইব। কিন্তু তাহার হাবভাব দেখিয়া মনে হইল, পদ্ধতি তিনিও বড় একটা জানেন না।

“কোকাবাবু গত হইলেন। তাঁহার দেহ পঞ্চভূতে মিশিয়াছে। আমার দেহও মিশিবে। সেইজন্য বড় একটা চিন্তিত নহি। আমি মৃত্যুর স্বরূপকে জানিতে চাই। এই আকাঙ্ক্ষা নিতান্ত তত্ত্বগত নহে। এই আকাঙ্ক্ষা আমার অন্তরে নিরন্তর রক্তক্ষরণ ঘটাইতেছে।

“মানুষের সহিত এই পৃথিবীর একটা সম্পর্ক তাহার জীবৎকালে রচিত হয়। আমাদের আয়ুষ্কাল মহাকালের তুলনায় পদ্মপত্রে নীরবৎ ক্ষণস্থায়ি। এত জানি বুঝি, তথাপি এই পৃথিবীর সহিত নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিবার আয়োজন বড় কম করি না। কিন্তু এই দৃশ্যমান জগৎ ও জীবনের অতিরিক্ত আর একটি নীরব প্রবাহ আছে। তাহার কথা কি কখনও তোমার মনে হয়?

“আমার প্রিয় কুঞ্জবনটির কথা তুমি নিশ্চয়ই ভুলিয়া যাও নাই। আজকাল রোজ অপরাহে, সেইখানে বসিয়া কত কথা ভাবি। সেই যে একদিন স্খলিত হাত হইতে কুয়ার বালতি পড়িয়া গেল সেই হইতেই এই আন্দোলনের সূত্রপাত। তোমার মতো আমি কাজের মানুষ নহি। বলিতে কী, সারাটি জীবন আমি নিজেকে লইয়াই আছি। বড় জোর নিজের কাজটুকু নিজে করিয়া লই। কিন্তু বৃহৎ জগৎ ও জীবনের সহিত আমার সম্পর্ক নাই। তাই বোধ হয় আমার মনটিও কিছু নিষ্কর্মা। এইসব চিন্তা করিবার অবকাশ পাই।

“কিন্তু ভায়া সচ্চিদানন্দ, চিন্তা বড় সুখের নহে। আমার দাদা কেন সংসারত্যাগী হইয়াছিল তাহা আমার সঠিক জানা নাই। সংসার ছাড়িয়া সে কোন পরমার্থ লাভ করিয়াছে তাহারও সংবাদ পাই নাই। আমার তো সন্ন্যাস গ্রহণেরও দরকার নাই। সংসারে আমি তো সন্ন্যাসীর মতোই বসবাস করিতেছি। আজকাল সেই বৈরাগ্য তীব্রতর হইয়াছে। কিন্তু ভাই, আমি সংসার ছাড়িয়া বনেজঙ্গলে যাইতে পারিব না। আমার সেই সাহস নাই।

“আমার এই অসময়ে তোমাকেই আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তুমি কাছে থাকিলে হয়তো। দু-একটি কথার ফুঙ্কারে আমার অন্তরের জ্বালা নিবারণ করিতে পারিতে। তোমার সাহচর্যই হয়তো আমার বহু জটিল প্রশ্নের মীমাংসা করিয়া দিত। কিন্তু তুমি ব্যস্ত মানুষ, আমার পূর্ব পত্রের জবাবটাই এখনও দিয়া উঠিতে পারো নাই।

“আজকাল নিজেকে বড়ই স্বজনহীন মনে হয়।…”

কোকাবাবুর শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ রক্ষা করে এসে হেমকান্ত সচ্চিদানন্দকে এই চিঠি লিখলেন।

বাড়ির মধ্যেই বাঁধানো পুকুর। চারধারে মস্ত মস্ত পাম গাছ। ৩ার ছায়া জলে এত দীর্ঘ হয়ে পড়ে যে, পুকুরটিকে অতল গভীর বলে মনে হয়। বাস্তবিক পুকুরটি গভীরও। জলে ঘোর গভীরতার একটি কৃষ্ণ রং আভাসিত হয়। বাঁধানো সিঁড়ির ধাপ বহু দূর নেমে সেই কালো জলে কোথায় হারিয়ে গেছে।

পুকুরের ধারেই বাঁধা থাকে দুটি হরিণ। অনেকখানি দড়ির ছাড় দেওয়া থাকে। তারা ইচ্ছেমতো চরে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে জল খায়। কখনও গাছের তলায় বিশ্রাম করে।

এ বাড়ির বড় বউয়ের বাবা মস্ত শিকারী। মেয়ের বিয়ের সময় কথা দিয়েছিলেন, একজোড়া হরিণ আর হরিণী কোনও সময় উপহার পাঠাবেন। অবশেষে কিছুকাল আগে এই দুটি চিত্রল হরিণ আর হরিণী এসে পৌঁছেছে।

বিশাখা এই দুটি অবোধ জীবকে বড় ভালবাসে! প্রথমে ওরা ভয় পেত তাকে। আজকাল পায়। বিশাখা তাদের কমলালেবুর খোসা ও রেয়া, লেবু গাতা, ভেজানো আতপচাল, ছোলা খাওয়ায়। হরিণের চেহারা যত সুন্দর, ডাক এত সুন্দর নয়। কিন্তু পৃথিবীতে সব তো একসঙ্গে পাওয়া যায় না। হরিণ দুটিকে দেখেই বিশাখার চোখ জুড়িয়ে যায়। আর-একটা ব্যাপারও হয়। তার গা কেমন করে।

কেমন করে?

রাজেন মোক্তারের মেয়ে সুফলাকে সে একদিন জিজ্ঞেস করল, হরিণ দুটো দেখে তোর কেমন মনে হয় রে?

খুব সুন্দর। কী সরু সরু পা! অথচ কোন দৌড়োয়!

সে তো জানি। কিন্তু আর কিছু মনে হয় না?

সুফলা অবাক হয়ে বলে, আর কী মনে হবে?

তোর গা কেমন করে না?

কেমন করবে?

কেমন যেন শিরশির শিরশির। আমার করে কিন্তু।

না বাবা, আমার সাপ দেখলে গা শিরশির করে। আর কেঁচো।

সে তো আমারও করে। এ তা নয়। অন্যরকম শিরশির।

কীরকম শিরশির?

তোর কেবল প্রশ্ন। তাকিয়ে তাকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখ, তোরও করবে।

দোতলার বারান্দা থেকে পুকুরের পাড়ে বাঁধা হরিণদুটোকে অনেকক্ষণ ধরে দেখল সুফলা। তারপর বলল, যাঃ।

কিন্তু বিশাখা অন্যরকম জানে। দিঘল চেহারার ছিমছাম দুটি হরিণ তার ভিতরে এক অনুভূতির কম্পন তোলে। একটা অস্ফুট কিছু যেন তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।

বিশাখা লেখাপড়া করেছে সামান্য। খানিকটা বিনোদচন্দ্রের কাছে, আর খানিকটা রঙ্গময়ির কাছে। ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন অপেক্ষা বিয়ের।

এই বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়িতে চলে যেতে বিশাখার যে খুব কষ্ট হবে, তা নয়। এ বাড়িতে তার সত্যিকারের আপনজন কেউ নেই।

দুপুরে বিশাখা স্নান করতে এসেছিল ঘাটে। সঙ্গে তেল, গামছা, শাড়ি নিয়ে দাসী। স্নানে কোনও বাধা নেই। উঁচু দেয়াল দিয়ে চারদিক ঘেরা। ঘাটের পাটায় বসে কিশোরী বিশাখা তেল মাখল। গায়ে ঝঝঅলা সর্ষের তেল। মাথায় ফুলেল।

বিশাখার রূপ সাংঘাতিক! রং যেমন দুধে আলতায়, তেমনই তার লম্বা ডৌলের চমৎকার প্রতিমার মতো মুখ। মাথায় চুলের বন্যা। তবে কেঁকড়ানো বলে চুল খুব দীর্ঘ হয়ে পড়েনি। কোমর অবধি মেঘের মতো ঘনিয়ে থাকে। হেমকান্তর সন্তানদের মধ্যে বিশাখারই রূপ সবচেয়ে বেশি।

চুনী দাসী হলেও সখীর মতোই। বিশাখার কাছাকাছি বয়স। তেরো বা চোদ্দো। দুজনে একসঙ্গেই পুতুল খেলে, লুডো খেলে। একটু দূরত্ব থাকে মাত্র। অর্থাৎ বিশাখার সব কথাতেই চুনীকে সায় দিতে হয়। তার মাও এ বাড়ির দাসী। সেই মেয়েকে শিখিয়ে দিয়েছে, মনিবের মেয়ের মুখে মুখে কখনও জবাব দিবি না।

দুজনেরই পরনে ড়ুরে শাড়ি। বিশাখারটা কিছু দামি। চুনীরটা আটপৌরে। চুনী কিছু স্বাস্থ্যবতী। বিশাখা রোগার পর্যায়ে।

বিশাখা কালো জলে পাম গাছের লম্ববান প্রতিবিম্ব দেখছিল। গভীর নীল আকাশ। জল প্রায় নিথর। মাঝে মাঝে একটু হাওয়া এসে কাপিয়ে দেয় ছায়া। কখনও বড় বড় মাছ ঘাই দেয়। সেটুকু ছাড়া জল বড় স্তব্ধ ও গম্ভীর। পুকুরের বিপরীত ঘাটের কাছে কামিনী ঝোপের নীচে বসে আছে একটা হরিণ। আর-একটা চরছে একটু দূরে।

কী সুন্দর!–বিশাখা বিমুগ্ধভাবে বলো।

কী সুন্দর? কীসের কথা বলছ?—চুনী তার শাড়ির পাড়ে বাঁধা খোঁপা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল।

বিশাখা বলল, দেখছিস না, জলে কেমন ছায়া! আকাশটা! আর হরিণ!

হ্যাঁ গো, সত্যি ভারী সুন্দর। জল যা ঠান্ডা না! স্নান করলে বুঝবে। আজ আমার খুব কাঁপুনি হবে।

তোর এত কাঁপুনি হয় কেন আজকাল?

চুনী একটা লজ্জার হাসি হেসে বলে, সেই যে সেদিন স্নানের সময় ঢিল পড়েছিল সেই থেকে।

বিশাখা একটু ভ্রু কোঁচকায়। ঢিল পড়েছিল ঠিকই। সে বলল, কে ছুঁড়েছিল জানিস?

না, কী করে জানব? দেয়ালের ওপিঠ থেকে এসেছিল। কী বড় ঢিল!

লক্ষ্মণকে বলেছিলাম। সে খোঁজ করেছিল। কাউকে পায়নি।

দুপুরবেলা যারা ঢেলা ছেড়ে তারা তো আর মানুষ নয়।

তবে কি ভূত?

তা নয় তো কী?

বিশাখার বয়স এমন নয় যে, ভূতে বিশ্বাস করবে না। ভূতে তার অবিচল বিশ্বাস। তবু তার কেন যেন মনে হয় সেদিনকার সেই ঢিলটা কোনও ভূত ঘেঁড়েনি।

বিশাখা কিছু বলল না। তেল মাখা হয়ে গেছে। উদাস চোখে সে সামনের দিকে চেয়ে ছিল। ঠিক উদাসও নয়। তার চোখে মায়ার এক অঞ্জন মাখা। আজকাল সে যা দেখে তাই সুন্দর বলে প্রতিভাত হয়।

হঠাৎ চুনী চাপা গলায় বলে উঠল, ওই দেখ! ওই দেখ ছোড়দি! দেয়ালের ওপর ও কার মুণ্ডু!

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়