বিয়ের পর যখন অরুণ এ বাড়িতে আসত তখন প্রীতম ওর সঙ্গে বিলুর সঠিক সম্পর্কটা জানত না। আজও জানে কী? আসলে মানুষে মানুষে সঠিক সম্পর্ক বলে তো কিছু নেই। সম্পর্ক পালটে যায়।

সাহস করে একদিন তবু প্রীতম জিজ্ঞেস করেছিল বিলুকে, অরুণের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বটা কেমন ছিল? খুব গাঢ়?

বিলু খুব একটা সংকোচ বা লজ্জা বোধ করেনি প্রশ্ন শুনে। তবে চোখের পাতাটা একটু নত করেছিল। কয়েক সেকেন্ডের দুর্বলতা মাত্র। তারপর বলল, আমরা একসঙ্গে স্কটিশ চার্চে পড়তুম বলিনি তোমাকে?

বলেছ।

অরুণ ছিল আমার দু’ বছরের সিনিয়র। এমন পাজি না, একদিন ওর পোষা বেজিটাকে এনে ছেড়ে দিয়েছিল করিডোরে। মেয়েদের মধ্যে সে কী চেঁচামেচি আর আতঙ্ক! আমি তো একটা জানালায় উঠে বসে রইলুম।

সেই থেকে তোমাদের ভাব?

সেই থেকেই। তবে আরও অনেক কাণ্ড আছে। শুধু যে ইয়ারকি করে বেড়াত তা নয়। ইয়ারকিটা ওর মুখোশ। ভিতরে ভিতরে ভীষণ সিরিয়াস।

অরুণ তোমার চেয়ে বয়সে বড়, ছাত্র হিসেবেও সিনিয়র। তবু ওকে তুমি-তুমি করে ডাকো কেন?

ঠোঁট উলটে বিলু বলল, ওকে আপনি বলতে যাবে কে? মেয়েরা সবাই ওকে নাম ধরে তুমি-তুমি করে বলত। তুমি কি অরুণ সম্পর্কে জেলাস ফিল করো প্রীতম?

না, না, তা নয়।লজ্জা পেয়ে প্রীতম বলেছিল, আসলে আমি মানুষের সম্পর্কে জানতে ভালবাসি।

বিলু মৃদু হেসে বলল, তুমি কী জানতে চাও জানি। তুমি খুব শান্ত, ভালমানুষ। কিছু মনে করবে তো?

না, কী মনে করব? মনে করার কিছু থাকলে কবেই তা বলে ফেলতাম।

বিলু একটু যেন আধোগলায় বলল, ওর সঙ্গে আমার ভাব ছিল। খুব ভাব। হয়তো বিয়েও করতুম। করলে না কেন?

একটা কথা ভেবে।

কী কথা?

ও ভীষণ মেয়েদের সঙ্গে মিশত। বাছবিচার ছিল না। ওরকম পুরুষ একটু আনফেইথফুল হয়। জানো তো, পুরুষরা প্রকৃতির নিয়মেই পলিগেমাস। তারা কখনও একজন মহিলাকে নিয়ে খুশি নয়। তার ওপর অরুণ আবার ভীষণ ফ্রি-ওয়ার্লড তত্ত্বে বিশ্বাসী। ও বিয়ে, বন্ধন, সংসার, সন্তান ইত্যাদি রেসপনসিবিলিটি একদম জানে না। আমি বাপু অতটা আধুনিক নই। তাই ভেবেচিন্তেই ওকে বিয়ে করিনি, তোমাকে করেছি।

সেজন্য আজ তোমার দুঃখ হয় না বিলু?

ধুস, দুঃখ কিসের? আমার অত সেন্টিমেন্ট নেই। যা করেছি তা হিসেব করেই করেছি।

আমার সঙ্গে অরুণকে কখনও তুলনা করতে ইচ্ছে হয় না তোমার?

যাঃ! নেভার। তুলনা করব কেন? ও একরকম তুমি অন্যরকম।

প্রীতম হাসিঠাট্টার হালকা চালটা বজায় রেখেই বলল, ধরো আমি তো বেশ রোগা, আর অরুণ কত স্বাস্থ্যবান। অরুণ আমার চেয়ে অনেক ফর্সা। ও প্রচণ্ড বড়লোক আর দুর্দান্ত স্মার্ট—যে গুণগুলো আমার নেই।

তেমনি তুমি আবার শান্ত, দায়িত্বশীল, গভীর মনের মানুষ। সকলের ততো সব গুণ থাকে না। শোনো তুমি কি অরুণ সম্পর্কে সত্যিই জেলাস নও?

প্রীতম হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলল, না, নই বিলু। বরং অরুণকে আমার বেশ পছন্দ।

বিলু খুব গভীর মনের মেয়ে নয়, প্রীতম জানে। তবু সেদিন বিলু খুব গভীর অতল এক চোখে প্রীতমের মুখখানা মন দিয়ে অনেকক্ষণ দেখল। তারপর শুকনো গলায় বলল, অরুণের এ বাড়িতে আসা যদি তোমার পছন্দ না হয় তবে বলে দিয়ে, আমি ওকে বারণ করে দেব। তাতে ও কিছু মনেও করবে না।

ছিঃ বিলু!

বিলু নতমুখ হয়ে বলল, তুমি অত করে জানতে চাইছিলে বলে আমার মনে হচ্ছিল, তুমি বোধহয় ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখছ না।

প্রীতম খুব স্পোর্টসম্যানের মতো কলার উঁচু করা গলায় বলে, আমার কাছে ব্যাপারটা নিতান্তই মজার। মফস্সলের ছেলে তো, আমরা জানি, প্রাক্তন প্রেমিকরা তাদের হাতছাড়া প্রেমিকাদের মুখোমুখি বড় একটা হয় না। তা হলে আর জীবনে ট্র্যাজেডি বলতে কিছু থাকে, বলো?

এ কথায় বিলু হেসে ফেলল। বলল, দেব-দানবের যুগ তো এখন আর নেই।

ফলে এ বাড়িতে অরুণের যাতায়াত বহাল থাকল। ঢাকা চাপার কিছু রইল না।

 

এখন বিলুর ধমক খেয়ে এই যে অরুণ উঠে গেল বাইরের ঘরে, জুতো ছেড়ে আসতে, তার মধ্যেও যেন অরুণের ওপর বিলুর গভীর অধিকারবোধ ফুটে উঠল। বুকের মধ্যে সামান্য চিনচিন করে ওঠে প্রীতমের। এত অধিকারবোধ নিয়ে আর এত জোরের সঙ্গে বিলু কোনওদিন তাকে কোনও হুকুম করেনি।

কিন্তু মানুষে মানুষে স্থায়ী সম্পর্ক বলেও তো কিছু নেই। প্রেমিকা চিরকাল প্রেমিকা থাকে না, স্ত্রীও থাকে না স্ত্রী। এইসব সম্পর্ক ভাঙচুর করতে করতে পৃথিবী খুব দ্রুত এগোচ্ছে।

মোজা পায়ে অরুণ ফিরে এসে বসে এবং বলে, তোমার বড় নিচু নজর বিলু, আজ আমি এত সুন্দর পোশাক পরে এসেছি, তবু তুমি আমার জুতোজোড়াই দেখলে?

বিলু একটু কঠিন গলায় বলে, এটা রুগির ঘর মনে রেখো।

সেকথা ঠিক। ভুলে যাই।বলে একটু লজ্জার হাসি হাসে অরুণ।

প্রীতম লক্ষ করে, সবকিছু অরুণকে মানাল। ওর ওঠা, হাঁটা, হাসি, লজ্জা এ সবকিছুই যেন বহুকাল ধরে রিহার্সাল দিয়ে যত্নে রপ্ত করা।

আবার একটু চিনচিন করে প্রীতমের।

বিলু কথার ফাঁকেই গিয়ে মেয়েকে বাথরুমে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে অরুণকে বলে, সবকিছুই তো আজকাল তুমি ভুলে যাও। একটা হুইল চেয়ারের কথা বলেছিলাম, মনে আছে?

ভুলিনি, কিন্তু প্রীতমবাবুর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, উনি হুইল চেয়ার পছন্দ করেন না।

বিলুর মুখ থমথমে হয়ে যায়। প্রীতমের দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে বলে, হুইল চেয়ার হলে তোমার একা থাকতে তেমন কষ্ট হবে না।

বলতে নেই, আগের তুলনায় তার ধৈর্য ও স্থৈর্য বেশ কমে আসছে। যেমন বিলুর এই হুইল চেয়ারের ব্যাপারটায় এখন হল। অত্যন্ত তেতো স্বরে সে বলল, না না, ওসব আমি পছন্দ করি না। ঘরে একটা জবরজং জিনিস ঢুকিয়ে জঙ্গল বানাতে হবে না।

যদি এরকম স্বরে অরুণ কিছু বলত তা হলে বিলু ওকে তেড়ে মারতে যেত। কিন্তু প্রীতমের সঙ্গে বিলুর ব্যবহার অন্যরকম। কথাটা শুনে বিলু নিজের নখের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, তুমি না চাইলে অন্য কথা। হলে তোমার সুবিধেই হত।

আমার কোনও সুবিধে হবে না বিলু। কেন কথা বাড়াচ্ছ?

বালিশে এলিয়ে চোখ বোজে প্রীতম। চোখের পাতাটা পুরো বন্ধ হওয়ার আগেই এক পলকের দৃশ্যটা চোখে পড়ল। অরুণ হাতের ইশারায় বিলুকে সরে যেতে বলছে।

বাথরুম থেকে লাবুও ডাকছিল। বিলু নিঃশব্দে চলে যায়।

অরুণ চেয়ারটা বিছানার আরও একটু কাছে টেনে এনে বসে। নরম গলায় বলে, ঘরে বসে থেকে থেকে তো পচে গেলেন মশাই! একটা কথা বলব? একদিন চলুন দিল্লি বা বম্বে রোড ধরে খানিকটা বেড়িয়ে আসি। এ বছর ওয়েদারটাও ভাল।

ইচ্ছে করে না যে! শরীরে অত শক্তিও নেই।

দূর মশাই! এই মনোবল নিয়ে আপনি লড়ছেন! শক্তি কারও শরীরে, কারও মনে। মনটা শক্ত করুন, ঠিক পারবেন।

ভাল লাগে না।

তবে কী ভাল লাগে? ঘরে বসে থাকতে?

প্রীতম ক্ষীণ হেসে বলে, ঘর আমার খারাপ লাগে না। বাইরেই তো যত গোলমাল।

বিলু ঠিকই বলে, আপনি ভীষণ ঘরকুনো এবং ঘোর সংসারী। সেইজন্যই কি বউকে চাকরি করতে দিতেও চান না?

মেয়েদের চাকরি করা আমাদের পরিবারে কেউ পছন্দ করে না।

সে তো বুঝলাম। বলে হঠাৎ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অরুণ আবার বলল, কিন্তু এখন বিলুর চাকরি করা একটু দরকারও যে।

কেন?–বুলেটের মতো প্রশ্নটা বেরোয় প্রীতমের মুখ থেকে।

অরুণ মৃদু স্বরে বলে, আপনি নিজে অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আপনাকে আমি আর কী বোঝাব?

প্রীতমের চিন্তার স্রোত খুব ধীরে ধীরে খাত বদল করে। সে আবার চোখ বুজে নিঃঝুম হয়ে শুয়ে মনে মনে খুব দ্রুত হিসেব করে দেখে নেয়। ভলান্টারি রিটায়ারমেন্টের দরুন সে এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকার মতো পেয়েছিল। সেই টাকার ওপরেই এতদিন সংসার চলছে। বসে খেলে রাজার ভাঁড়ারও শেষ হয়।

অরুণ মৃদু স্বরে বলে, খরচও তত কম নয়। মেয়েদের চাকরি করা হয়তো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ভাল না হতে পারে আপনার কাছে। কিন্তু জরুরি প্রয়োজন হলে নিশ্চয়ই তাতে আপনার আপত্তি হবে না?

বিলু তো আমাকে কিছু বলেনি।

বিলু আপনাকে বলতে তেমন জোর পাচ্ছে না।

প্রীতম দাঁতে ঠোঁট কামড়ায়। বিলু তাকে বলতে জোর পাচ্ছে না, তবে অরুণকে বলছে কিসের জোরে? প্রীতম বিরক্তির গলায় বলে, বলতে জোরের দরকার কী?

অরুণ আরও একটু কাছে এগিয়ে আসে এবং খুবই নিচু গলায় বলে, আপনি যতটা শান্তশিষ্ট দেখতে, ঠিক ততটাই কি ডেনজারাস নন? বিলু বলে, প্রীতমের মুখোমুখি হলে ওর ঠান্ডা গভীর চোখের দিকে চেয়ে আমার বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে।

কথাটার মধ্যে খুশি হওয়ার মতো কিছু একটা ছিল বোধহয়, নইলে প্রীতমের ভিতরে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল কেন? চোখ খুলে সে বলল, আমি ডেনজারাস হতে যাব কেন? বিলু ওসব বলে

বুঝি!

অরুণ হাসিমুখে চেয়ে থাকে। তার চোখে সপ্রশংস দৃষ্টি। চাপা গলাতেই বলে, ডেনজারাস বলতেই তো আর মারদাঙ্গাবাজ লোক নয়। আপনার বিপজ্জনকতার উৎস হচ্ছে স্ট্রং লাইকস অ্যান্ড ডিসলাইকস। আপনি মুখে কিছু তেমন বলেন না, কিন্তু একটু নাকের কুঞ্চন বা ঠোঁট ওল্টানো কিংবা চোখের এক ঝলক দৃষ্টি দিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেন। যারা কম কথা বলে এবং যারা চাপা স্বভাবের, তাদের সবাই ভয় পায়।

প্রীতম নিজের এত গুণের কথা জানত না। কথাগুলো যে সত্যি নয় তাও সে একটা মন দিয়ে বুঝতে পারে। সে জানে তুখোড় বুদ্ধিমান অরণ তাকে তেল দিচ্ছে। একটা উদ্দেশ্য নিয়েই দিচ্ছে। তবু অন্য একটা অবুঝ মন এই এত সব মিথ্যে গুণের কথা হাঁ করে গিলল। নিজের খুশির ভাবটা চাপা দেওয়ার জন্য সে একটা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমাকে কারও ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

প্রীতমকে এক মোহময় সম্মোহনে আচ্ছন্ন করে দিতে দিতে বড় আন্তরিকভাবে অরুণ বলে, আছে। আপনি তা হয়তো টের পান না। বিল পায়।

প্রীতম একটু অন্যমনস্ক থেকে বলে, ব্যাংকের টাকা কি ফুরিয়ে এসেছে?

তা নয়। এখনও অনেক আছে। হয়তো দু-চার বছর চলে যাবে। কিন্তু তারপর একদিন ফুরোবে।

কত আছে?

বিলু বলছিল কত যেন!

আমাকে বললে পারত।

প্রীতম আবার চোখ বাজে। গোঁ আঁকড়ে ধরে থেকে লাভ নেই সে জানে। চোখ খুলে আবার তাকায় এবং বলে, লাবুর কী হবে? বিলু চাকরি করতে গেলে ওকে দেখবে কে?

আয়া থাকবে। আপনিও তো রয়েছেন। লাবুর জন্য চিন্তা নেই। যেসব বাড়ির স্বামী স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করে তাদের ছেলেমেয়েও তো মানুষ হচ্ছে।

প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, ঠিক মানুষ হচ্ছে বলা যায় না। মায়ের সঙ্গ না পেলে বাচ্চারা ভীষণ রাগী, অভিমানী, জেদি আর হিংসুটে হয়ে ওঠে।

কথাটা স্বীকার করে অরুণ মাথা নাড়ে। সাদা একটা হাসিতে প্রীতমের মাথা গুলিয়ে দিয়ে বলে, লাবু তার বাবাকে তো পাবে। লাবু তো বাবা ছাড়া কিছু বোঝে না।

প্রীতম স্নিগ্ধ হয়ে গেল। দুর্বল হয়ে গেল। মোহাচ্ছন্ন হল। আনমনা গলায় বলল, বিলু কি কোথাও চাকরি পেয়েছে?

একটা ব্যাংকে অ্যাপ্লাই করেছিল। পেয়ে গেছে।

আমাকে বলেনি।–দুঃখের সঙ্গে বলে প্রীতম।

অরুণ কথাটার জবাব দেয় না। শুধু হাসে।

 

অরুণ চলে যাওয়ার পর প্রীতম বিলুকে ডেকে বলে, তুমি চাকরি পেয়েছ, আমাকে বলোনি কেন?

বিলু প্রীতমের দিকে খুব সহজ চোখে তাকাল, আর সেই দৃষ্টি দেখেই প্রীতম বুঝল, বিলু কস্মিনকালেও তাকে ভয় খায় না। অরুণ এমন সুন্দর সাজিয়ে বানিয়ে মিছে কথা বলে!

বিলু জবাব দেয়, বললে তো তুমি খুশি হবে না। কিন্তু চাকরির এখন দরকার।

অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রীতম টাকার হিসেব জানে। তাই রোগা দুর্বল হাতে মাথার লম্বা চুল একটু পাট করতে করতে বলে, সেটা বুঝি। কিন্তু লাবু আর-একটু বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে না বিলু?

ততদিন কি আমারই চাকরির বয়স থাকবে? না কি ইচ্ছে করলেই এই বাজারে চাকরি পাওয়া যাবে?

চাকরি নেওয়ার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করলে না একবার?

বিলু ভ্রু কুঁচকে বলে, এখনও নিইনি। তোমার অসুবিধে হলে না হয় নেব না।

কথাটায় ঝাঁঝ ছিল। প্রীতম কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ভাবাবেগ আসছিল। সেটা সামলে নিতে পারল। বলল, রাগ কোরো না। টাকার হিসেব আমি কারও চেয়ে কম বুঝি না। আমার জন্যও অনেক খরচ হচ্ছে। জমানো টাকা আর কত আছে?

খুব বেশি নেই।–বিলু অন্যদিকে চেয়ে বলল, যা আছে তা দিয়ে একটা ছোটখাটো বাড়ি একটু শহরের বাইরের দিকে হয়ে যেতে পারে।

তুমি বাড়ি করার কথা ভাবছ?

তুমি বারণ করলে ভাবব না। কিন্তু এইবেলা কিছু না করলে টাকাটা খরচ হয়ে যাবে।

বাড়ি করার কথা আমি কখনও ভাবিনি।

কেন ভাবোনি? সবাই তো এসব ভাবে।

শিলিগুড়িতে আমাদের একটা বাড়ি তো আছে।

বিলু কথাটার জবাব দিল না। কিন্তু মুখে একটা কঠিন ভাব ফুটে উঠল।

প্রীতম সবই জানে। বিলু কোনওদিন শিলিগুড়ি যাবে না। ও বাড়িটাকে সে নিজের বাড়ি বলে ভাবতেও পারে না। প্রীতম একটা সত্যিকারের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, জমিটমি দেখেছ?

দেখিনি। তবে দু-একটা খবর পেয়েছি। অরুণের ছুটির দিন দেখে তোমাকে নিয়ে একসঙ্গে সবক’টা দেখে আসব ভেবে বেখেছি।

আমি জমির কিছু বুঝি না। তোমরা থাকবে, তোমাদের পছন্দ হলেই হল।

কেন, সেই বাড়িতে তুমিও তো থাকবে।

প্রীতম এই কথায় বিলুর দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখে। হঠাৎ মনে হয়, তাকে ভুলিয়ে রাখার জন্য বিলু আর অরুণ আড়ালে কোনও ষড়যন্ত্র করছে না তো! প্রীতমের ঠোঁটে জবাবটা ঝুলছিল, যদি ততদিন পৃথিবীতে থাকি। কিন্তু অত সহজ ভাবপ্রবণতার কথা বলল না প্রীতম। ভাবের ঘোরে ভেসে গিয়ে লাভ নেই। তার বড় শক্ত লড়াই।

তাই প্রীতম স্বাভাবিকভাবে বলে, ঠিক আছে। যাব।

বিলু একটু যেন সংকোচের সঙ্গে বলে, এসব টাকা-পয়সা বা বাড়ির কথা বলতে আমার খারাপ লাগে। তুমিও হয়তো খুশি হও না। কিন্তু ভাল না লাগলেও তো ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়।

এত তাড়াতাড়ি ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে তা কখনও চিন্তা করিনি।

বিলু কঠিন মুখে চুপ করে থাকে।

প্রীতম হাসে একটু। আশপাশ থেকে রেডিয়োতে দূরাগত একটা ক্রিকেট খেলার ধারাবিবরণীর শব্দ আসছে। প্রীতম নিজের পাজামায় ঢাকা পা দু’খানা দেখতে থাকে। ইডেনে টেস্ট খেলা দেখে দু’বছর আগেও সে হেঁটে ভবানীপুর ফিরেছে।

বিলু মৃদু স্বরে বলল, আমি লাবুকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরোচ্ছি। বিন্দু রইল।

প্রীতম চোখ বন্ধ করে হুঁ দিল।

ভালবাসা থাক বা না থাক, বিলু বাড়িতে না থাকলে প্রীতমের বড় ফাঁকা আর নিরর্থক লাগে।

বিলু চলে গেলে প্রীতম বিন্দুকে ডেকে খবরের কাগজটা চাইল। কাগজ মুখের সামনে মেলে ধরে শূন্য চোখে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। কিছুতেই মন দিতে পারল না।

পা দুটো ঝিন ঝিন করছিল। আজকাল প্রায়ই এটা হয়। অনেকক্ষণ ধরে কুঁচকি থেকে পাতা পর্যন্ত পা দুটোয় ঝিঝি ছাড়তে থাকে। প্রীতম তার অস্ত্রশস্ত্রের জন্য হাত বাড়ায়। নিরন্তর শরীরের সঙ্গে তার লড়াই। তাকে তো বাঁচতেই হবে। অসহনীয় ঝিনঝিন অনুভূতিটাকে সহনীয় করতে সে প্রাণপণে চোখ বুজে সেতারের বাজনার শব্দ মনে আনতে থাকে। বহুক্ষণের চেষ্টায় শরীরের ঝিনঝিনকে সে সেতারের ঝালার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে। তাতে অস্বস্তি কমে যায় না, কিন্তু খানিকটা সহনীয় হয়। সেতার হয়ে যাওয়ার একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতাও হতে থাকে তার।

এ বাড়িতে কেউ গানের তেমন ভক্ত নয় বলে রেকর্ড প্লেযাব কেনা হয়নি। প্রীতম ভাবল বিলুকে একটা সস্তার রেকর্ড প্লেয়ার কিনতে বলবে। আর অনেক সেতার-সরোদের রেকর্ড। তার

অস্ত্র চাই।

বিলু তার জন্য হুইল চেয়ার কেনার কথা ভাবছে, চাকরি করার কথা ভাবছে, ভবিষ্যৎ চিন্তা করছে। আসলে এসবের পিছনে প্রীতমের অনস্তিত্বের কথাই কি ভাবা হচ্ছে না? বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা ভয় হঠাৎ চিনচিন করে ব্যথিয়ে ওঠে, ককিয়ে ওঠে। মরে যাব নাকি?

বে-খেয়ালে হাত মুঠো পাকায় প্রীতম, চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে প্রাণপণে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ভাল আছি। ভাল আছি। ভাল আছি। ভাল আছি। এবার থেকে যখনই কেউ জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছেন? তক্ষুনি খুব হোঃ হোঃ করে হেসে আনন্দে ভেসে যেতে যেতে প্রীতম বলবে, ভাল আছি।

 

রাস্তা পার হওয়ার জন্য ফুটপাথের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছোট্ট লাবু মুখ তুলে মায়ের দিকে চাইল। সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু ভরসা পায় না। মা মারবে।

বিলু আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রূ কোঁচকানো। ভাবছে’ লাবু আবার মুখ তুলে মায়ের মুখটা দেখে। তারপর ডাকে, মা!

উঁ!

লাল আলো জ্বলে গেছে। পেরোবে না?

হুঁ। চলো।–বিলু শক্ত মুঠিতে মেয়ের হাত ধরে রাস্তা পার হয়।

আনমনে হাঁটছিল বিলু। লাবু হঠাৎ হাত টেনে ধরে বলে, মা! জল!

বিলু বিরক্ত হয়। দেখে মাংসের দোকান থেকে অঢেল রক্তমাখা জল ফুটপাথ বেয়ে বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ায় পিছন থেকে একটা লোক বিলুব ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে কোনওরকমে সামলে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। বিলু মেয়ের চুল টেনে দিয়ে বলে, কতবার বলেছি না, রাস্তায় সভ্য হয়ে চলবে। জল তো কী হয়েছে?

লাবু মায়ের দিকে চেয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। আস্তে করে বলে, জুতোয় লাগবে তো!

জুতোয় নোংরা লাগেই, তাতে কী?

লাবু আর জবাব দেয় না। টুকটুক করে মায়ের পাশে পাশে হাঁটে। আবার হঠাৎ ডাকে, মা।

আবার কী?

ফিতে।

তোমার অনেক ফিতে আছে। আর নয়।

চশমা?

তাও নয়। বায়না করবে না একদম।

লাবু ঘাড় হেলিয়ে রাজি হয়ে গেল।

তাড়াতাড়ি হাঁটো লাবু। বাবা একা রয়েছে।

পায়ে লাগছে।

কী হয়েছে পায়ে?

লাবু থামে এবং হেঁট হয়ে নিজের পায়ের জুতো খুলতে চেষ্টা করে। পারে না। অসহায় মুখে মার দিকে চেয়ে থাকে।

উবু হয়ে স্ট্র্যাপটা খুলে বিলু জুতোর ভিতর থেকে একটা কমলালেবুর বিচি বের করে ফেলে দেয়। বলে, কতবার শিখিয়েছি জুতো পরার আগে ঝেড়ে নিয়ে পরবে! মনে থাকে না কেন?

বিলু দোকান থেকে গুঁড়ো সাবানের প্যাকেট, মাখন, বিস্কুট ইত্যাদি কেনে। তারপর লাবুকে বলে, তুমি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াও তো লাবু। বেশি দূরে যেয়ো না। সিঁড়িতে রোদ আছে, ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখো।

লাবু বাধ্য মেয়ের মতো সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে। মা যতক্ষণ টেলিফোনে কথা বলবে ততক্ষণ তাকে দুরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সে জানে।

বিলু ফোনে অরুণকে পেয়ে বলে, ওর অ্যাটিচুড কেমন দেখলে?

খারাপ কিছু নয়। মেনে নেবে।

তুমি চলে আসার পর ও চাকরি নিয়ে আবার কথা তুলেছিল। ভারী অবুঝপানা করে। বলে, লাবু বড় হলে চাকরি কোরো। তাই কি হয়?

তুমি রাগ-টাগ দেখাওনি তো!

আমি বুঝি শুধু রাগই দেখাই? তোমরা আমাকে কী ভাবো বলো তো?

এই তো আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছ।

তোমার কথা আলাদা।

আলাদা কেন? আমি রিঅ্যাক্ট করি না বলে?

ঠিক তাই। তোমার মতো কম রিঅ্যাকশনারি আমি বেশি দেখিনি।

অরুণ হাসল। বলল, তা হলে আমি তোমার রাগের জিম্মাদার রইলাম। প্রীতমবাবুকে অনুরাগটুকুই দিয়ো।

ছি ছি।

হঠাৎ ছিছিক্কার কেন?

এত বাজে অনুপ্রাস বহুকাল শুনিনি। তুমি না স্মাট ছিলে? রাগের সঙ্গে অনুরাগ মেলানো কি তোমাকে মানায়? শোনো, ও জমি দেখতে রাজি হয়েছে। তুমি কবে ফ্রি হবে বলো তো! গাড়ি নিয়ে সব কটা জমি একদিনে ঘুরে দেখতে হবে।

বিলু, জমি কেনার ডিসিশনটা পাল্টাও আবার বলছি। কে তোমার বাড়ি তৈরির খবরদারি করবে? তার চেয়ে ফ্ল্যাট কেনো।

ফ্ল্যাটেই যদি থাকব তবে তা কিনতে যাব কেন? ভাড়া দিয়েই তো থাকতে পারি।

ফ্ল্যাট কিনলে ভাল পাড়ায় যে মেটিরিয়ালের তৈরি বাড়িতে থাকতে পারবে, জমি কিনে বাড়ি করলে সেটা তো পাবে না। খরচ বেশি, ঝামেলা বেশি।

তবু আলাদা বাড়িই আমার পছন্দ।

তোমার যে এস্টিমেট তাতে জমি কেনার পর দু’খানা ঘর তৈরির টাকাও থাকবে না।

চাকরি করলে টাকা হবে। ধীরে ধীরে করব।

অরুণ একটু চুপ করে থেকে বলে, তুমি হয়তো পারবে। তুমি চিরকালই অন্যরকম ছিলে।

ছাড়ছি।

ফোন রেখে বিলু দেখে, লাবু হাটুর কাছে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চেয়ে আছে। তাকাতেই বলল, একটা পাগল আমাকে ডাকছিল। বিলু সামান্য একটু লজ্জা পেল কি?

 

লাবু ঘরে ঢুকেই থমকে গেল। বাবা কাত হয়ে শুয়ে আছে। বালিশ থেকে মাথাটা নীচে পড়ে গেছে। বাবার শরীরের ওপর মস্ত পাতা খোলা খবরের কাগজটা পড়ে আছে।

মা বাথরুমে ঢুকে যেতেই খুব আস্তে আস্তে হেঁটে বাবার বিছানার কাছে আসে লাবু। সে জানে, মানুষ মরে গেলে শ্বাস ফেলে না।

লাবু বাবার নাকের কাছে ছোট্ট হাতটা বাড়িয়ে দিল। খুব জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে বাবার। সন্তর্পণে খবরের কাগজটা টেনে আনে লাবু। ছোট হাতে অত বড় বড় পাতা ভাজ করতে পারে না। কোনও রকমে ঘুচুমুচু করে দলা পাকিয়ে টেবিলে সরিয়ে রেখে দেয়।

একটু ছোঁবে বাবাকে? ভয় করে। কত রোগা না লোকটা! এত রোগা কেন? এত অসুখ কেন?

প্রীতমের একটা রোগা হাত খাট থেকে বেরিয়ে ঝুলে আছে। লাবু খুব ভয়ে ভয়ে একবার হাতটা ছোয়। ভয় করে। হাতটা ঠান্ডা। কত বড় বড় নখ বাবার হাতে! ভয় করে।

বাবা চুল কাটে না কেন মা?–ভাত খেতে বসে লাবু মাকে জিজ্ঞেস করে।

বিলুর খেয়াল হয়, তাই তো। অনেকদিন প্রীতমের চুল ছাঁটানো হয়নি। সে লাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, ও মেয়ে। বাবার দিকে তো খুব নজর তোমার!

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়