এই শীতে অন্ধকার বারান্দায় মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিলু। গলি থেকে চোখ তুলে দৃশ্যটা দেখে দীপ। নিঃঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিলু, যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে না, কিছু শুনতে পাচ্ছে না। ঘর থেকে আবছা আলোর আভাস এসে পড়েছে ওর গায়ে। আবছা দেখাচ্ছে মূর্তিটা। দোতলার ওই বারান্দায় উত্তরের বাতাস হুঁ হু করে বয়ে আসে। বিলুর শীতবোধও কমে গেছে বুঝি।

বিলু গলির আবছা আলোতেও দীপকে দেখতে পেয়েছিল ঠিকই। দীপ দোতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসতেই দরজা খুলে পরদা সরিয়ে দেয় বিলু।

আজকাল বিলুর কথা কমে এসেছে খুব। দরজা খুলে একবার ক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চলে যাচ্ছিল ভিতরের দিকে। দীপ বাইরের ঘরের সোফায় বসে জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে খুব সাবধানে মৃদু স্বরে বলল, এখন খুব হিম পড়ে। বাচ্চাটাকে নিয়ে বারান্দায় যাস কেন?

বিলুর সঙ্গে সবাই আজকাল সতর্কভাবে কথা বলে। কখন বোমা ফাটবে তার কিছু ঠিক নেই। সামান্য কথাতেই কখনও খুব রেগে যায়, কখনও ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

বিলুর চুল রুক্ষ, ম্যাড়ম্যাড়ে হলুদ রঙের শাড়িটা রং-চটা ময়লা। গায়ের চামড়ায় খড়ি উড়ছে, ঠোঁট দুটো ভীষণ শুকিয়ে মামড়ি দেখা যাচ্ছে। দীপের কথার জবাব না দিয়ে ভিতরের ঘরে চলে গেল।

দীপ একটা ঠোঙায় মহার্ঘ কাঠ-বাদাম, কিছু মুসুম্বি আর আপেল এনেছে। কাঠবাদাম খুব ভালবাসে প্রীতম।

জুতো খুলে মেঝেয় দাঁড়াতেই মোজার ভিতর দিয়ে ডিসেম্বরের ঠান্ডা উঠে এল শরীরে। এই কয়েকটা দিনই যা একটু শীত কলকাতায়। শীতের শিহরনটুকু শরীরে স্রোতের মতো বয়ে যেতেই মনের মধ্যে একটি দৃশ্যান্তর ঘটে গেল। মনে পড়ল, হাকিমপাড়ার মস্ত কাঁচা ড্রেনের পাশে দীপের হাতে অকারণে মার খেয়ে মাটিতে গড়াচ্ছে আর প্রাণপণে চেঁচিয়ে কাঁদছে। দীপের সমান গায়েব জোর ছিল না প্রীতমের, বয়সেও অনেকটা ছোট। রাগে দুঃখে অপমানে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ ভরা জল আর শরীর-ফেটে-পড়া রাগ নিয়ে প্রীতম চিৎকার করে দীপকে বলেছিল, আমার বাঁ হাতটা খা। আমার বাঁ পাটা খা। তখন খুব হেসেছিল দীপ। আজকাল যতবার মনে পড়ে ততবার হাসির বদলে চোখে জল আসতে চায়।

দীপ ভিতরের ঘরের পরদা সরাতেই দেখল, প্রীতম প্রাণপণ চেষ্টায় একা একাই উঠে লেপটা সরিয়ে পাজামা পরা পা দুটো খাট থেকে নামানোর চেষ্টা করছে। কাঠির মতো শুকিয়ে এসেছে পা, হাত দুটোও কমজোরি হয়ে আসছে ক্রমে। শরীরটা এখন ভারী বে-টপ দেখায়। আচমকা দেখলে লোকে ভাববে, মানুষটা বেঁচে আছে কী করে?

শুধু মুখটাতে এখনও অসুস্থতা স্পর্শ করেনি প্রীতমকে। চোখের দৃষ্টি এখনও সজীব। পা ঝুলিয়ে স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতো বসবার চেষ্টা করতে করতে প্রীতম তার ব্যথা-ভরা সুন্দর মুখ-টেপা হাসিটা হাসে।

টিনের চেয়ার বিছানার ধারটিতে টেনে নিয়ে বসে দীপ জিজ্ঞেস করে, আকুপাংচারের তারিখ কবে ছিল?

আজই। এই তো ঘণ্টা দুয়েক আগেই ফিরেছি আমরা।

ডাক্তার কী বলল?

ভাল। অনেক ইমপ্রুভমেন্ট হয়েছে। আজ ছ’টা কি সাতটা ছুঁচ দিয়েছিল। তাই না বিলু? বলে বিলুর দিকে একবার ফিরে তাকানোর চেষ্টা করল প্রীতম। বিলু পিছন দিকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খুব দ্রুত তার রুক্ষ চুলে চিরুনি চালাচ্ছিল। কিন্তু জটধরা চুলে চিরুনি চলতে চাইছে না। বিলুর রাগের হাত জটসুদ্ধ চুল ছিড়ে আনছে মাথা থেকে। প্রীতমের কথার জবাব দিল না বিলু।

প্রীতমের বালিশের পাশে ফলের ঠোঙাটা রেখে দিয়েছিল দীপ। প্রীতম তার সরু একখানা হাত বাড়িয়ে ঠোঙাটা ছুঁল, তৃপ্তির চোখে চেয়ে দেখল একটু। তারপর লাজুক গলায় বলে, এসব এনেছ কেন? আমি কি এখন আর আগের মতো খেতে পারি, বলো? আজ অরুণবাবুও ডাক্তারের কাছ থেকে আসার সময় একগাদা ফল কিনে আনলেন। কত বারণ করলাম।

বিলু ঘর থেকে চলে গেল রান্নাঘর আর ডাইনিং স্পেসের দিকে। খুব সতর্ক নিচু গলায় দীপ জিজ্ঞেস করল, আজ কি তুই অরুণের সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলি? বিলু সঙ্গে যায়নি?

প্রীতম মাথা নাড়ে। যায়নি। মুখে সেই অসম্ভব ভালমানুষের হাসি। দুটো হাতের পাতা কোলের ওপর জড়ো করা। হাড়ের ওপর চামড়া বসে যাচ্ছে খাঁজে খাঁজে। আঙুলের গিঁট জেগে উঠেছে, কংকালসার হয়ে যাচ্ছে হাতের পাতা। সেদিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে প্রীতম। নিজের কররেখা দেখে। তারপর মুখ তুলে বলে, অরুণ বড় ভাল ছেলে। ও এলে বাড়িটা জমজম করে। বিলুরও মনটা ভাল থাকে।

এ কথায় দীপ খুব কুট চোখে প্রীতমের মুখখানা দেখে! না, প্রীতমের মুখে কোনও ছায়া নেই। দরজার ওপরে সাঁইবাবার একটা ছবি টাঙানো, সেই দিকে চেয়ে আছে।

অরুণ হয়তো ভালই। তবে একটু আবেগহীন, বাস্তববাদী। প্রীতমের এই অসুখটা আজ পর্যন্ত কোনও ডাক্তার ধরতে পারেনি ঠিকমতো। প্রথমদিকে একজন বড় ডাক্তার ভুল চিকিৎসা করে রোগটাকে আরও গাঢ়িয়ে তোলে। পরে অন্যান্য ডাক্তার বিস্তর কসরত করার পর হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছে, এক ধরনের ইন্টারন্যাল ইনফেকশন। এ রোগের পরিণতি কী হতে পারে তা তারা কেউ স্পষ্ট করে বলেনি। তবে বুঝে নেওয়া যায় সবার আগে সেটা বুঝেছিল অরুণ। সে উপযাচকের মতোই প্রীতমকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কোম্পানি থেকে ভলান্টারি রিটায়ার করাল। তাতে এক কাঁড়ি টাকা পেয়ে গেল প্রীতম। এল আই সি-র একজন চেনা এজেন্টকে ধরে করে অরুণ প্রীতমের একটা সত্তর হাজার টাকার পলিসি করিয়ে দিয়েছে। ব্যাংকে প্রীতমের অ্যাকাউন্টকে বিলুর সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করিয়েছে। আত্মীয়-স্বজন যখন রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে তখন ঠান্ডা মাথায় এই জরুরি কাজগুলি সেরে রেখেছে অরুণ। সে তোক ভাল হতে পারে, তবে তার মনে কোনও ভাবাবেগ নেই। পরোক্ষে সে কি প্রীতমকে তার পরিণতিটা জানিয়ে দিতে সাহায্য করেনি?

দীপ অন্য একটা কথাও মাঝে মাঝে ভাবে, অরুণ কি এসব প্রীতমের জন্যই করেছে? না কি বিলুর জন্য? এখনও বিলু অরুণকে ডাকনামে বুধু বলে ডাকে। বিলুর পোশাকি নাম অনন্যা। অরুণ ওকে ডাকে অন্যা বলে। এই বুধু ও অন্যার রহস্য লুির দাদা হয়ে ভেদ করতে চায় না দীপ।

দীপ ভাবে, প্রীতমের মনে যখন পাপ নেই তখন তার মনেই বা থাকবে কেন?

পাশের ডাইনিং স্পেসে অনেকক্ষণ ধরে সরু গলায় লাবু ঝিয়ের কাছে কী একটা বায়না করছিল। মেয়েটা এমনিতে মিষ্টি, ভিতু, ঠান্ডা, কিন্তু কখনও-সখনও খুব ঘ্যানায়। আর যখনই ঘ্যানায় তখনই ধৈর্যহীন বিলু নির্মম হাতে মেরে মেয়েটাকে পাট পাট করে দেয়। বিলুর ভয়ে মেয়েটা সবসময়ে কেমন বিবর্ণ হয়ে থাকে। লাবুর সবচেয়ে বড় আশ্ৰয়টা সরে গেছে। শরীরের কারণেই বাবার কাছে আসা তার বারণ।

প্রীতম খুব উৎকর্ণ হয়ে মেয়ের গলার স্বর শোনে আর কীসের জন্য যেন অপেক্ষা করে। আচমকাই পরবার ওপাশে বিলুর চাপা গর্জন শোনা যায়, চুপ করলি অলক্ষ্মী মেয়ে? গর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই চটাস পটাস চড়-চাপড়ের শব্দ হতে থাকে। বিলুর শ্রান্ত গলা শোনা যায়, আমাকে শেষ না। করে ছাড়বি না তোরা! প্রীতম কেমন কুঁজো হয়ে চোখ বুজে সিঁটিয়ে থাকে। যেন মারটা তার পিঠেই পড়ছে।

আরও মারের ভয়ে লাবু কাঁদতে পারে না। কাঁদা বারণ, বারণ না মানলে বিলু আরও মারবে। তাহ প্রাণপণে কান্না চেপে রাখার চেষ্টায় ক্রমান্বয়ে হেঁচকি উঠছে লাবুর। পরদার ওপাশ থেকে সেই হেঁচকির শব্দ এসে এ ঘরে হাতুড়ির ঘা মারে। প্রীতম বিবর্ণ মুখে চেয়ে থাকে দীপের দিকে। খুব চেষ্টা করে একটু হাসে। মাথা নেড়ে বলে, বিলুর দোষ নেই। ও পেরে উঠছে না। সারাদিন ঘরে আটকে থাকে, ওর মেজাজ খারাপ তো হতেই পারে।

অজুহাতের দরকার ছিল না। দীপ সবই জানে। এও জানে লাবু হচ্ছে প্রীতমের প্রাণের প্রাণ। সেই লাবু পাশের ঘরে মার খেয়ে কাদছে এটা শরীর বা মন দিয়ে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না প্রীতম। কিন্তু এই একটা জায়গা ছাড়া প্রীতমেব আশ্চর্য সহনশীলতার কোনও তুলনা নেই। নিজের বোন হলেও বিলুকে কোনওদিন তেমন পছন্দ করে না দীপ। ওর ধৈর্য বলতে কিছু নেই, অল্প কারণেই ভয়ংকর রেগে যায়, তাছাড়া অলস, অগোছালো এবং বেশ কিছুটা স্বার্থপর। অরুণের সঙ্গে ও বহুকাল ধরে একটা ব্যাখ্যাহীন রহস্যময় সম্পর্ক রেখে চলেছে। এসব মিলিয়ে প্রীতমের বিবাহিত জীবনটা খুব সুখের নয় নিশ্চয়ই। তবু প্রীতমকে কদাচিৎ দুঃখিত বা বিষণ্ণ দেখেছে দাপ।

বিলু ঘরে নেই, তাই ফাঁক বুঝে দীপ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে, শিলিগুড়িতে যাবি প্রীতম?

প্রীতম উদাস চোখে তাকিয়ে বলে, গিয়ে কী হবে?

তোর ইচ্ছে করে না যেতে?

আগে করত। এখন হচ্ছে-টিচ্ছে কিছু নেই।

বিলু বলে, কলকাতা ছাড়া চিকিৎসা ভাল হবে না।

আমি আসার আগে শতমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

ও।

বলে চুপ করে থাকে প্রীতম। দীপের কথায় ওর মন নেই। পরদার ওপাশ থেকে এখনও লাবুর হেঁচকি তোলার শব্দ আসছে। কান খাড়া করে সেই শব্দ শুনছে প্রীতম। যেন কিছুক্ষণ চুপ করে শুনে প্রীতম আস্তে করে বলা, আমি যে ভাল হয়ে উঠব এটা ওরা বিশ্বাস করে না।

কারা?-দীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

আমার বাড়ির সবাই। ওদের ধারণা আমি শিগগিরই মরে যাব। তাই আমাকে শিলিগুড়িতে নিয়ে যেতে চায়। বিলুকে এরকম ধরনের চিঠিও লিখেছিল বাবা। আবার তুমিও শিলিগুড়ি যাওয়ার কথা বলছ!

দীপ একটু মুশকিলে সড়ে গিয়ে বলে, দুব বোকা! তোর অসুখ সাববে না বলে শিলিগুড়ি য, ওয়ার কথা বলেছি নাকি? আসলে ওখানকার জলহাওয়া তো ভাল, আত্মীয়স্বজনদের কাছে মনটা ভাল থাকে।

খুব যে অভিমনিভরে মাছ না শ্রী তম বলে, ওসব কথার কথা। আসলে তোমরা বিশ্বাসই করে না যে, আমি আর বেশিদিন বাঁচব।

প্রীতমকে এ ধরনের কথা কোনওদিন বলতে শোনেনি দীপ। তাই অবাক হয়ে কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে থাকে। বিলু নিঃশব্দে ঘরে এসে দীপের হাতে এক কাপ চা দিয়ে চলে যায়।

ধীরে ধীরে প্রীতম শুয়ে চোখ বুজল।

দীপ চায়ে চুমুক দিয়েই হরিণঘাটার স্ট্যান্ডার্ড দুধের বোটকা গন্ধ পায় এবং মুখ বিকৃত করে। সে প্রাণপণে প্রীতমের অসহায়তা, তার রোগভোগের যন্ত্রণা, মৃত্যুচিন্তা এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছের অহর্নিশ লড়াই, লাবুর প্রতি তার প্রগাঢ় ভালবাসা ইত্যাদি বুঝবার চেষ্টা করতে থাকে। ভাবতে গেলে প্রীতমের সমস্যার শেষ নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, মরবার আগে প্রীতম কিছুতেই নিশ্চিন্তে জেনে যেতে পারবে না যে, বিলু শেষ পর্যন্ত বিধবা থাকবে, না কি অরুণকে বিয়ে করে বসবে। যদি তাই হয় তবে লাবুর দশা কী হবে! ভেবেচিন্তে প্রীতমের জন্য এক বুক দুঃখ উথলে উঠছিল দীপের। তাই সে চায়ে দুধের বোঁটকা গন্ধটা আর তেমন টের পেল না।

পরদা সরিয়ে মেয়ে কোলে বেরিয়ে এসে বিলু বলল, তুমি একটু বোসো মেজদা। আমি পাশের ফ্ল্যাট থেকে ঘুরে আসছি।

বিলু চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ বাদে প্রীতম চোখ খুলে বলে, মেজদা, আমি খুব বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি।

দীপ আত্মবিশ্বাসহীন গলায় বলে, তুই বাঁচবি নাই বা কেন?

খুব কষ্টে প্রীতম উঠে বালিশে ঠেস দিয়ে বসে। বলে, এগুলো খুব বাজে ব্যাপার। এই অসুখ-টসুখ মোটেই ভাল জিনিস নয়। মন দুর্বল হয়ে যায়, মাথার ঠিক থাকে না। এই সময়ে তোমরা আমার কাছে এসে এমন কোনও কথা বোলো না যাতে মরবার কথা মনে হয়। আমি দিনের মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টা বেঁচে থাকার চিন্তা করি। কাজটা সোজা নয়, তবু করি।

দীপ একটা ঢোক গিলে বলে, আমি তোর অনেক ইমপ্রুভমেন্ট দেখছি প্রীতম।

প্রীতম বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, ইচ্ছাশক্তিকে খুব কম জিনিস বলে মনে কোরো না। উইল পাওয়ার অনেক অঘটন ঘটাতে পারে।

নিশ্চয়ই।—দীপ তেমনি আস্থাহীন গলায় বলে।

আমি কখনও কাউকে বলিনি যে, আমি মরে গেলে লাবু আর বিলুকে দেখো। কেন বলব? ওসব তো হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা! আমার তো মনে হয় না কখনও যে, আমি মরে যাব!

সে কথা কেউই ভাবছে না। তুই অকারণে সবাইকে সন্দেহ করিস।

তবে বাড়ির লোক আমাকে শিলিগুড়ি নিয়ে যেতে চায় কেন? ওরা কি জানে না, সেখানে কলকাতার মতো চিকিৎসা হবে না?

এ কথাটা প্রীতম খুব আস্তে করে গাঢ় স্বরে বলল। কোনও রাগ বা অভিমান নিয়ে নয়। নিষ্পলক কয়েক সেকেন্ড দীপের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ কয়েক পরদা নিচু স্বরে বলে, শোনো মেজদা, আমি শিলিগুড়ি গেলেও বিলু কিছুতেই যাবে না। শ্বশুরবাড়ির কাউকেই ও দু’চোখে দেখতে পারে না। জানো তো?

জানি।

কিন্তু আমি বিলুকে কলকাতায় একা রেখে যেতে ভয় পাই।

দীপু জুয়াড়ির মতো মুখের ভাব ঢেকে রাখার চেষ্টা করে বলে, কেন?

কেন তা আর বলল না প্রীতম। সামান্য একটু বিচিত্র সুন্দর হাসি হাসল মাত্র। দীপ জানে, মরে গেলেও কথাটা আর প্রীতমের মুখ দিয়ে বেরোবে না। ও কেবল সুন্দর করে হাসবে।

দীপ তাই চাপাচাপি না করে বলল, ইচ্ছে না হলে যাবি না। কেউ তো জোর করছে না!

তা ঠিক। তবে জোর করছে আমার ভিতরের একটা ইচ্ছে। মাঝে মাঝে আমি ডানপাশের ওই জানালাটা দিয়ে শিলিগুড়ির পাহাড় দেখতে পাই। প্রায় ডাকঘরের অমলের অবস্থা। কিন্তু জানি শিলিগুড়িতে গেলে আমি আর বাঁচব না। চিকিৎসার অভাবে নয়, শিলিগুড়িতে গেলেই আমার মন নরম হয়ে গলে যাবে, ইচ্ছার শক্তি যাবে কমে।

দূর পাগল!

প্রীতম হাসছেই। এতটুকু সিরিয়াস ভাব নেই মুখে, বিষণ্ণতাও নেই। যেন ঠাট্টা-ইয়ারকি করছে এমনিভাবে বলে, ওখানে গেলেই সেই ছেলেবেলায় সব কথা এসে ঘিরে ধরবে। সে ভারী সুখের ব্যাপার, কিন্তু ওগুলো মনকে দুর্বল করে দেয়। তার ওপর সকলে বুক বুক করে যত্ন-আত্তি শুরু করবে, সিমপ্যাথি দেখাবে। ব্যস অমনি আমার লড়াইয়ের মনটাই যাবে নষ্ট হয়ে। এখানে তো তা নয়। এখানে প্রতি মুহূর্তেই রুক্ষ বাস্তবতার সঙ্গে লড়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এটাই আমার পক্ষে ভাল কেন জানো? আমাকে প্রতি মুহূর্তে জাগিয়ে রাখছে, সাবধান রাখছে, হাল ছাড়তে দিচ্ছে না, জেদ ধরিয়ে দিচ্ছে। যদি আমাকে বাঁচাতে চাও, মেজদা, কখনও শিলিগুড়ির কথা বোলো না।

দীপের স্বভাব হল যখনই কেউ কোনও কথা আন্তরিকভাবে বলে তখনই সে তা গভীরভাবে বিশ্বাস করে ফেলে। শিলিগুড়িতে গেলে প্রীতম কেন মরে যাবে তার যুক্তিসিদ্ধ কারণ থাক বা না-থাক দীপ তা বিশ্বাস করল এবং শিউরে উঠে বলল, না না, ওসব আর বলব না প্রীতম। তোর যাওয়ার দরকার নেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে দু’জন। প্রীতম তার দুর্বল হাত চোখের সামনে ধরে চেয়ে থাকে, যেন আয়নায় নিজের মুখ দেখছে। অনেকক্ষণ বাদে বলে, তুমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছ না মেজদা?

দীপ একটু অবাক হয়ে বলে, হ্যাঁ। অনেকদিন।

বেশিদিন নয়। মাত্র দু’-তিন মাস বোধহয়।

তাই হবে। দীপ বলে, কেন বল তো!

আগে তুমি অনেক সিগারেট খেতে। দিনে অন্তত চল্লিশটা।

হুঁ।–দীপ বুঝতে পারে না প্রীতম কী বলতে চায়।

অত সাংঘাতিক নেশা ছাড়লে কী করে?

দীপ উদাস হয়ে বলে, ছেড়ে দিলাম।

কষ্ট হয়নি?

খুব। ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। পাগলের মতো লাগত।

প্রীতম তার সুন্দর হাসিটা মুখে মেখে বলে, তোমার ভীষণ রোখ আছে মেজদা। সাংঘাতিক রোখ।

দীপ ম্লান একটু হাসে। ছিল, কোনওদিন তার মধ্যে একটু ইস্পাতের মিশেল ছিল। একটু ছিল হয়তো বিলুর মধ্যেও। ছিল বড়দা মল্লিনাথেরও। কিন্তু দীপের ভিতরকার সেই ইস্পাত জীর্ণ হয়ে গেছে আজকাল। বিকেলেই মিসেস বোস তাকে বলেছিলেন, আপনার আত্মমর্যাদাবোধ নেই কেন?

প্রশ্নটা এখনও পাথরের মতো বুকের ভিতরে ঝুলে আছে।

দীপ ছটফট করে উঠে বলে, বিলু কোথায় গেল বল তো!

পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাটার আজ জন্মদিন। এক্ষুনি এসে পড়বে। বোসো।

দীপ ঘড়ি দেখে। সাতটা। তার কোথাও যাওয়ার নেই। এখান থেকে সে সোজা মেসবাড়িতে ফিরে যাবে। কারও সঙ্গেই কোনও কথা বলবে না। চুপচাপ খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়বে সিঙ্গল বেডের বিছানায়। জীবনে অনেককাল কিছু ঘটেনি।

সে উঠে দাঁড়ায়। বলে, না রে, অনেক রাত হয়ে গেল।

প্রীতম করুণ মুখ করে চেয়ে বলে, চলে যাবে? রাতে খেয়ে যাও না! মেসে তো বিচ্ছিরি খাবার খাও রোজ।

দীপ মাথা নেড়ে বলে, আজ নয়।

তুমি মাঝে মাঝে এসে আমাকে একটু জোর দিয়ে যেয়ো। তোমার মনের জোরটা আমাকে দিতে পারো না?

দীপ খুব গম্ভীর মুখে বলে, তোর মনের জোর আমার চেয়ে কিছু কম নয় রে প্রীতম।

প্রীতম মুখ তুলে বলে, শোনো, শতম কলকাতায় এলে যেন আমার সঙ্গে দেখা না করে। ওকে দেখলেই সেইসব পুরনো কথা, মায়াটায়া এসে পড়ে। আমার পক্ষে ওগুলো ভাল নয়। ও যেন ভুল না বোঝে। ওকে বারণ করে দিয়ে।

দীপ মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা।

প্রীতম এমন কাঙালের মতো চেয়ে আছে যে, দীপ চট করে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে পারছিল না। তার বড় মায়া, তার বড় ভালবাসা এই ছেলেটির প্রতি।

দীপ তাই নিঃশব্দে আবার বসে, মেজদা বা সোমনাথ তোকে দেখতে আসে?

প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, না। সোমনাথ একবার এসেছিল বহুদিন আগে। শ্রীনাথদা আসেনি।

দীপ গম্ভীর হয়ে বলে, আসা উচিত ছিল।

প্রীতম ক্লান্ত স্বরে বলে, তুমি মাঝে মাঝে এসো, তা হলেই হবে। আর কেউ না এলেও ক্ষতি নেই। বরং আত্মীয়দের আহা-উহু শুনলে আমার খারাপ রি-অ্যাকশন হয়। সিমপ্যাথি দেখানোর লোক আমি চাই না।

দীপ একটু হেসে বলে, তবে কী চাস? সেই পুরু রাজার মতো বীরের প্রতি বীরের ব্যবহার?

প্রীতম ক্ষীণ হাসে। বলে, ঠিক তাই।

দীপ শ্বাস ছেড়ে বলে, আমার রোখের কথা বলছিলি প্রীতম, কিন্তু তুই রোখা কিছু কম নোস। তুই পারবি মনের জোরে এসব কাটিয়ে উঠতে।

প্রীতম চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, শিলিগুড়িতে নয়, কিন্তু অন্য কোথাও গাছপালার মধ্যে, নদীর ধারে আমাকে কিছুদিন নিয়ে যেতে পারো না? বিলুকে বলেছি, কিন্তু ও তেমন গা করে না। বলে, বাইরে চিকিৎসা হবে না।

দীপ গম্ভীর হয়ে বলে, মেজদার ওখানে গিয়েই তো অনায়াসে থাকতে পারিস।

শ্রীনাথদা? ও বাবা, শ্রীনাথদার বউ ভারী কড়া লোক শুনি। সোমনাথ বিলুকে বলেছিল, বউদিই নাকি গুন্ডা ভাড়া করে ওকে মার দিয়েছে।

বাজে কথা। বউদি তেমন লোক নয়। বরং মেজদাই কিছু কাছাছাড়া লোক, তাই বউদি সম্পত্তি আগলে রাখে। তুই গেলে কত যত্ন করবে দেখিস।

তুমি কখনও গেছ ওখানে?

অনেকবার। বড়দা তখন বেঁচে। আমি গেলেই মুরগি কাটা হত। শ্রীনাথদার আমলেও গেছি। আরও সম্পত্তি বেড়েছে। ওরা বেশ ভাল আছে। তুই যাবি?

প্রীতম ম্লান মুখে বলে, কিন্তু ওরা না ডাকলে যাই কী করে? বিলু চিঠি লিখেছিল, শ্রীনাথদা জবাব দেয়নি। এখানেই তো রোজ চাকরি করতে আসে, একবার দেখাও তো করতে আসতে পারত। সেধে যেচে যাওয়াটা কি ভাল দেখাবে?

দীপ গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভাই কত পর হয়ে যায়! রক্তের সম্পর্ক কথাটাই কি তা হলে এক বিকট ভুল?

মনটা খারাপ ছিলই তার। আরও একটু খারাপ হল মাত্র।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়