৪৬.

ওই দেখুন, ভারতসুন্দরী মিস ইন্ডিয়া দাঁড়িয়ে আছে এক মোহিনী বিভঙ্গে। কাধ থেকে কোমর অবধি লম্বমান সোনালি ম্যাশ, তাতে সমুদ্রনীল রঙের অক্ষরে লেখা মিস ইন্ডিয়া…। ভারী রূপবতী মেয়ে। দীর্ঘকায়া, নির্মেদ। চোখে বৌদ্ধিক আলো আর কলঙ্কহীন দাতে শ্বেতশুভ্র হাসি।

কী বললেন! ভোগ্যপণ্য? আপনি দোষদৃষ্টিপরায়ণ বলেই কি একথা বলছেন না? আপনার সৌন্দর্য দেখার চোখই নেই। শুনুন মশাই, সৌন্দর্যের সবটুকুই শুধু শরীরী নয়, শরীরের অতিরিক্ত কিছুও নিশ্চয়ই আছে। সেইটে উপভোগ করুন। মেয়েটিকে ভাল করে লক্ষ করুন, ওকে ঘিরে কি এক আশ্চর্য চৌম্বক বলয় রচিত হয়নি?

একজন রসিক বিচারক ওকে প্রশ্ন করেছিল, হে সম্ভাব্য ভারত সুন্দরী, আপনি ভূত ও আরশোলার মধ্যে কাকে বেশি ভয় পান?

সুন্দরী সহাস্যে বলেছিল, আরশোলাকে।

আর একজন বিচারক প্রশ্ন করে, দুজন পুরুষ মানুষের মধ্যে একজন খুব একটা সুন্দর নয়, খুব একটা চালাক-চতুর বা চটপটে নয়, খুব মানিয়ে-গুছিয়ে চটকদার কথা বা জোক্স বলতে পারে না, কিন্তু সে খুব সৎ, সত্যবাদী, চরিত্রবান। আর একজন চৌখশ, চালাক, বেশ স্মার্ট, মাচো হ্যান্ডসাম চেহারা, কথায়বার্তায় খই ফুটছে, কিন্তু সে ঘুষখোর, মিথ্যেবাদী এবং লম্পট। এ দুজনের মধ্যে যদি একজনকে বেছে নিতে হয় তবে আপনি কাকে নেবেন?

একটু মিষ্টি হেসে সুন্দরী বলেছিল, দুজনের মধ্যে যার টাকা বেশি আমি তাকেই বেছে নেব।

কী বিপুল হাততালি পড়েছিল শুনেছেন? কী চোখধাঁধানো জবাব বলুন তো! জবাবটা কি আপনার পছন্দ হল না? না! টাকা জিনিসটাকে কি আপনি পুরুষের সর্বোত্তম গুণ বলে মনে করেন না? আশ্চর্য মশাই, আপনি নিতান্তই সেকেলে তোক দেখছি! এরপর আবার বর্ণাশ্রমের কথাও তুলবেন নাকি? বস্তাপচা সব ধারণা নিয়ে বসে থাকলে এই শৃঙ্খলমুক্ত মানসিকতার যুগকে আপনি বুঝবেন কী করে? মেয়েটা কী ভীষণ প্র্যাকটিক্যাল, স্মার্ট এবং ডাউন টু আর্থ বলুন তো!

কী বললেন! এই শরীর-দেখানো, কটাক্ষ-মদির সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা একধরনের বিপণন! তার মানে কী মশাই? বিপণন কথাটা আসছে কোথা থেকে? মার্কেটিং-এর বঙ্গানুবাদ নাকি? তার মানে আপনি কী ইঙ্গিত করছেন বলুন তো! ঝেড়ে কাশুন তো মশাই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কি বলতে চাইছেন এটা একধরনের সূক্ষ্ম বেশ্যাবৃত্তি? শুনুন মশাই, এখন যৌনকর্মীরাও মেইনস্ট্রিমে চলে আসছে। তারাও এখন আর আলাদা কিছু নয়। তাদের এখন এক ধরনের শ্রমজীবী বলেই ধরা হয়। সুতরাং আপনার ওরকম কটাক্ষ করাটা মোটেই যুগোপযোগী হচ্ছে না।

আপনি একটা অদ্ভুত লোক মশাই, এঁড়ে তর্কের ওস্তাদ। যৌনকর্মী কথাটার তাৎপর্য স্বীকার করতে চাইছেন না তো! বলতে চাইছেন নাম বা অভিধা পালটে দিলেই বিষয়বস্তুটা পালটে যায় না? আপনার মতে বারাঙ্গনা বা বারবধূ যৌনকর্মীর চেয়ে অনেক ভাল শব্দ! এই প্রসঙ্গে আপনি হরিজন শব্দটিও লক্ষ করতে বলছেন আমাকে! অন্ত্যজ শ্রেণীকে মর্যাদা দিতে গান্ধীজি যে হরিজন শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন তাতে মোটেই তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়নি!

কী বললেন? বেশ্যাদের যৌনকর্মী আখ্যা দিয়ে আদিখ্যেতার চেয়ে তাদের নিয়মিত ডাক্তারি পরীক্ষা, চিকিৎসা, মাসি ও গুণ্ডা তোলাবাজদের হাত থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করা অনেক বেশি জরুরি? আহা, আস্তে আস্তে হবে, সব হবে। আগে মর্যাদা দিতে শিখুন তো, তারপর চিকিৎসা ইত্যাদিও হতে থাকবে! দেশে এখন একটা নবজাগরণ শুরু হয়েছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে। ভাল-মন্দের নতুন বিন্যাস শুরু হয়েছে।

আচ্ছা মশাই, আচ্ছা, আমি মেনে নিচ্ছি যে নবজাগরণ কথাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। তবে এটা তো মানবেন যে পুরনো মূল্যবোধগুলি ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে। যেমন ধরুন, পৃথিবীতে নাস্তিকের সংখ্যা বাড়ছে। ধরুন, জাতপাত বর্ণাশ্রম এসব আজকাল আর তেমন মানতে চাইছে না কেউ। মেয়েরা আবদ্ধ থাকতে চাইছে না সতীত্বের সংজ্ঞায়। পাপ বা বিকৃতি বলে ধরা হচ্ছে না সমকামিতাকে। আপনি মানতে না চাইলেও এসব তো ঘটছে। এগুলো কি প্রগতির লক্ষণ নয়?

নয়? জানতাম আপনি এসব বুঝতে চাইবেন না। তর্ক থাক, আসুন আমরা ওই সুন্দরী নারীটির সৌন্দর্য কিছুক্ষণ অবলোকন করি। আমাদের ভাটিয়ে-যাওয়া যৌবনের জন্য একটু শোক হবে হয়তো। তা হোক। শরীর বুড়ো হয় বটে, কিন্তু মন তো হয় না। ওই সৌন্দর্য আমাদেরও স্পর্শ করে।

কী বললেন? একজন নরখাদক বাঘের কাছে ভারতসুন্দরীর সৌন্দর্যের কোনও আবেদন নেই? শুধু রক্তমাংসের লোভ আছে। কী বীভৎস চিন্তা আপনার! ধন্যি মশাই, এমন চমৎকার এক সন্ধ্যায় হঠাৎ আপনার নরখাদকদের কথা মনে হল কেন? আপনি দর্শকদের মধ্যে সেই নরখাদকদেরই দেখতে পাচ্ছেন বলে? না মশাই, সত্যিই আপনাকে নিয়ে পারা যায় না…

পাশের ঘরে একটা খুটখাট শব্দ হচ্ছিল। কে যেন তালা খুলে ঘরে ঢুকল। একটু গলাখাঁকারির শব্দ। মেয়েলি গলা। ঘরটা বন্ধই থাকে। তবে কি কাজের মেয়েটা ঘর পরিষ্কার করতে ঢুকেছে?

চিন্তার সূত্রটা ছিঁড়ে যাওয়ায় অমল কলমটা রেখে দিয়ে চেয়ারে বসেই আড়মোড়া ভাঙল। শরীর দুর্বল লাগছে। সকালে দুবার চা খেয়েছিল সে, আর কিছু খায়নি। টেবিলের একপাশে এখনও জলখাবারের প্লেটটা পড়ে আছে যা স্পর্শও করেনি সে। দুটো মাখন মাখানো টোস্ট, ডিম সেদ্ধ আর দুটো কলা। খেতে ইচ্ছে হয়নি, তারপর ভুলেও গেছে। এখন খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। তার।

ঘড়ি দেখে একটু অবাক হল অমল। বেলা পৌনে একটা। এখনই বউদি খেতে ডাকবে নীচে। কয়েকটা মাছি উড়ে উড়ে বসছে টোস্ট আর ডিমের ওপর। সে প্লেটটা তুলে নিয়ে পিছনের বারান্দায় এসে নীচে আগাছার জঙ্গলে খাবারগুলো ফেলে দিল। ভূতভুজিতে লাগুক। কাক কুকুরেরা সন্ধান করে ঠিক খেয়ে নেবে।

গায়ে বহুকাল তেল মাখে না সে। ছেড়েই দিয়েছে ওসব। বড়জোর স্নানের পর একটু ক্রিম জাতীয় কিছু মেখে নেয় হাতে, পায়ে, মুখে। তার বড় শুষ্ক শরীর, সহজেই খড়ি ওঠে গায়ে, ঠোঁট ফাটে। শরীরে স্নেহজাতীয় পদার্থের অভাবই হবে হয়তো। শরীরে আরও অনেক অভাব নিশ্চয়ই রয়েছে তার। কে সেসবের খবর রাখে? এখানে ক্রিম-ট্রিম নেই বলে তার শরীরে প্রায় বিভূতির মতো খড়ি উঠেছে। ঠোঁট ফেটে প্রায়ই রক্তের স্বাদ পায় জিভে। চুল ছাঁটতে খেয়াল থাকে না বলে লম্বা চুল ঘাড় অবধি নেমেছে। মাথা চুলকোয়ও খুব। উকুন হয়ে থাকতে পারে। বা খুসকি। কে জানে কী। নিজের দিকে বহুকাল নজর দেওয়া হয়নি।

পিছনের বারান্দার কোণে ত্রিভুজের মতো এক টুকরো রোদে দাঁড়িয়ে থাকে অমল। স্নান করতে হবে। বড্ড শীত। ঠান্ডা জল গায়ে ঢালতে হবে ভাবলেই যেন শরীর সিরসির করে।

একটা শব্দ পেয়ে আনমনা চোখ ঘুরিয়ে লম্বা বারান্দায় অন্য প্রান্তে সে একজন ফর্সা মহিলাকে দেখতে পেল। নীল শাড়ি, তার ওপর কাশ্মীরি শাল। দেখতে বেশ সুন্দরীই মনে হল।

কেমন আছ?

প্রশ্ন শুনে বেশ কুঁকড়ে গেল অমল। কী লজ্জা! এ তো মোনা!

 আমাকে দেখে কি ভয় পেলে নাকি?

অপরাধবোধ, লজ্জা, ভয় সব একসঙ্গে চেপে ধরল অমলকে। হঠাৎ বড্ড ঘাবড়ে গেছে সে। একটু ক্যাবলা হাসি হাসতে গিয়ে ফাটা ঠোঁট চড়াক করে আরও একটু ফেটে গেল। এক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে নামল ঠোঁট থেকে থুতনি বেয়ে। আলোয়ানটা তুলে ঠোঁট চেপে ধরল সে।

এমনভাবে চেয়ে আছ যেন চিনতেই পারনি!

 ভারী অপ্রস্তুত অমল বলে, আরে না না, চশমাটা চোখে নেই বলেই বোধহয়

চশমা তো তোমার চোখেই রয়েছে।

ওঃ হ্যাঁ। তাও বটে। কী আশ্চর্য! কখন এলে?

এই মাত্র।

কেউ বলেনি তো আমাকে!

বললে কী করতে? আহ্লাদে নেচে উঠতে?

তা নয়। আসলে আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম হয়তো!

 সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কার কথা ভাবছিলে?

আরও ঘাবড়ে ভয় খেয়ে অমল বলে, না তো! কারও কথাই ভাবছিলাম না তো! একটু লেখালেখি করছিলাম তো! তাই বোধহয়–

তুমি কি সাহিত্যিক হওয়ার চেষ্টা করছ?

পাগল নাকি! ওসব নয়। এটা একধরনের ক্যাথারসিস। ওই যে কী বলে যেন, মোক্ষণ না কী যেন।

আমি আজই চলে যাব। তোমার সাহিত্য সাধনায় বাধা দিতে আসিনি।

কী বলবে ভেবে না পেয়ে অমল বলল, ও, আচ্ছা।

আমি তোমাকে খুঁজতেও আসিনি, ফিরিয়ে নিয়ে যেতেও আসিনি।

 বিপন্ন অমল তার ভীত চোখে চেয়ে থাকে মোনর দিকে। তার গালে কয়েক দিনের দাড়ি, প্রায় জটবাঁধা চুল, আধময়লা পোশাকে মোনার সামনে নিজেকে খুব নিম্নস্তরের জীব বলে মনে হচ্ছে তার। বড় অপরাধবোধও হতে থাকে।

তুমি আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাও?

অমল আবার ঘাবড়ে গিয়ে বলে, না না, কে বলেছে ওসব?

কেউ বলেনি, তোমার আচরণই বলছে।

অমল কথা খুঁজে না পেয়ে মাথা নিচু করে।

পালিয়ে আসার দরকার ছিল না।

অমল দ্রুত ভাববার চেষ্টা করছে। এই আকস্মিক আক্রমণের বিরুদ্ধে তার কোনও পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। তাই কথা আসছে না মুখে। নিজের অস্বাভাবিক আচরণের সপক্ষে কোনও যুক্তিও খুঁজে পাচ্ছে না সে। তার মাথা আজকাল কাজ করে না। তার রিফ্লেক্স বলে কিছু নেই।

সে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসহীন গলায় বলার চেষ্টা করল, না ঠিক পালিয়ে নয়। কী যে একটা ব্যাপার হল, আমি ঠিক জানি না।

তুমি না জানলেও আমি জানি। তুমি আমার হাত থেকে মুক্তি চাইছ! তাই তো!

না না, তা বলিনি।

তুমি কী বলবে তা তুমিই জান। আমিও তোমার হাত থেকে রেহাই চাইছি।

অ্যাঁ? বলে অমল হাঁ করে চেয়ে থাকে।

তুমি কবি-সাহিত্যিক হবে না দার্শনিক হবে তা নিয়ে আমার একটুও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তোমার ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভেবেছ?

ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাববে তা কেউ প্রম্পট করে দিলে সুবিধে হত অমলের। সে ভেবেই পেল না ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে এই শীতের দুপুরে তাকে মাথা ঘামাতে হবে কেন?

সে নির্বোধের মতো চেয়ে রইল।

এর পর যখন-তখন তোমার উধাও হয়ে গেলে তো চলবে না। কারণ আমি তোমার ঘরদোর সংসার আগলে পড়ে থাকতে পারছি না। আমাকে আমার পথ দেখতে হচ্ছে। ছেলে-মেয়ের ভার তোমাকেই নিতে হবে। তুমি সক্রেটিস হবে না শেকসপিয়র হবে তা জানি না, কিন্তু ওদের দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। আই অ্যাম লিভিং ফর এভার।

অপমানিত নয়, বরং ভারী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল অমল। কিছুক্ষণ মোনার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

সেটা ইররেলেভেন্ট। আমার যাওয়ার অনেক জায়গা আছে।

অমল সঙ্গে সঙ্গে একমত হয়ে বলল, সে তো বটেই।

তুমি কয়েক বছর আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলে বলে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি ছাড়াও আমার যে আশ্রয় আছে এটা তোমার জানা দরকার।

অমল মাথা নেড়ে জানাল যে এ ব্যাপারেও সে একমত।

আমি উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে এসেছি। মিউচুয়াল ডিভোর্সের কাগজপত্রও সব তৈরি হয়েছে। তুমি কলকাতায় ফিরে গিয়ে সইসাবুদ করে দিয়ে এসো।

ডিভোর্স! বলে আবার হাঁ হল অমল। মাথার ভিতরে একটা বজ্রপতনের মতো শব্দ হল। তার ফুলকিও যেন দেখতে পেল সে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে তার। টলে উঠে হাত বাড়িয়ে রেলিং চেপে ধরল অমল।

হ্যাঁ, ডিভোর্স। অবাক হওয়ার তো কিছু নেই! তুমি তো মনে মনে দূরে সরেই গেছ। আইনের সেপারেশন তো তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। তোমার মন যা চাইছে সেটাকেই লিগালাইজ করে নেওয়া।

অমল যে বুঝতে পারছে না তা নয়। আবার বুঝতে পারছে বললেও ভুল হবে। ধারালো তলোয়ারের মতো সামনে লকলক করছে মোনা। তার সর্বাঙ্গে ধার, চোখে ধার, মনে ধার, কথায় ধার। কতখানি ক্ষতবিক্ষত হল তা নিজেও বুঝতে পারছে না অমল। শুধু ঠোঁট থেকে রক্ত মুছতে গিয়ে জিবে নোতা স্বাদ পায় সে।

ক্লিষ্ট, মার-খাওয়া জন্তুর মতো সে বোধহীন চোখে চেয়ে থেকে অনেকক্ষণ বাদে বলে, ডিভোর্স।

হ্যাঁ। কথাটা কি নতুন শুনলে!

 এইবার অমল অদ্ভুতভাবে বলে উঠল, একটু নতুন লাগছে।

সে কী! নতুন লাগার মতো কথা তো নয়!

 অমল নিজেকে সামলাতে রেলিং ছেড়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। তার হাঁফ ধরছে কেন কে জানে। বলল, নতুন নয়, বড্ড আকস্মিক।

কাব্য করে লাভ নেই। তুমিও তো এটাই চাইছিলে!

 অমল নেতিবাচক মাথা নাড়ল, কিন্তু জবাব দিল না।

 ডিভোর্স পেলেই বা তোমার কী সুবিধে হবে তা জানি না। যে বিদ্যাধরীর জন্য তুমি সংসার ছেড়ে এখানে পালিয়ে এসেছ সেও তো দুটো বাচ্চার মা, সে কি স্বামী ছেড়ে তোমাকে নিয়ে থাকতে রাজি হয়েছে?

অবাক অমল বলে, কে? কার কথা বলছ?

আকাশ থেকে পড়লে নাকি? জান না কে?

মোনার পিছনে বউদি এসে দাঁড়িয়েছে। হাত বাড়িয়ে পিছন থেকে মোনার কাঁধটা ধরে বলল, ওসব কথা পরে হবে ভাই। এখন এসো তো আমার সঙ্গে।

মোনা একটু ঝাঁঝের গলায় বলে, কোথায় যাব?

এতটা রাস্তা এসেছ, পরিশ্রম তো কম হয়নি। একটু জিরিয়ে নাও আগে। কথা তো পরেও হতে পারবে। ধুলো-পায়ে ওসব এখন বলতে হবে না।

বউদির বলাটার মধ্যে একটা দীন ভাব ছিল। ভারী নরম গলায় বলা। মোনা কী ভাবল কে জানে, একবার অমলের দিকে চোখ হেনে চলে গেল।

শরীরটাকে সামলাতে একটু সময় নিল অমল। আজকাল তার কী হয়েছে কে জানে, একটু উত্তেজনার ব্যাপার হলেই শরীর কাঁপতে থাকে, মাথা টাল খায় এবং দুর্বল লাগতে থাকে।

একরকম টাল খেতে খেতেই সে ঘরের লাগোয়া বাথরুমে এসে ঢুকল। স্বলিত হাতে আলোয়ানটা খুলে রডে রাখতে গেল সে, পারল না। আলোয়ানটা পড়ে গেল মেঝের ওপর। সেটা আর তুলল না

সে। একইভাবে গায়ের সোয়েটার, জামা আর পায়জামা ছেড়ে রডে ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করল। পায়জামাটা ঝুলে রইল বটে, জামা আর সোয়েটার খসে পড়ল নীচে। পড়েই রইল।

শীতকালে শাওয়ারে চান করতে বড় কষ্ট। শরীরে যেন লক্ষ ছুঁচ ফোঁটার যন্ত্রণা হয়। কিন্তু মগে করে গায়ে জল ঢালার সাধ্যই নেই অমলের। মগ জলে ডুবিয়ে তোলাও যেন অগাধ পরিশ্রমের কাজ। সে শাওয়ার ছেড়ে ঝরনা জলের নীচে দাঁড়াল। প্রচণ্ড ঠান্ডা জলে তার শরীর শিহরিত হতে লাগল। অবশ হয়ে যেতে লাগল।

জলের ঝরোখার নীচে দাঁড়িয়ে সে আবছায়া বাথরুমটা দেখতে পাচ্ছিল। গ্রামদেশে কেউ এত মহার্ঘ্য বাথরুম করে না। ছেলেবেলায় তারা কতবার মাঠঘাটে মলত্যাগ করতে গেছে, স্নান করেছে পুকুরে বা খালে। শখ করে দোতলায় এই অ্যাটাচড বাথ তৈরি করিয়েছে সে নিজের খরচে। ডিজেল পাম্প বসিয়েছে, ওভারহেড ট্যাঙ্কও। সব বড্ড অর্থহীন মনে হচ্ছে তার কাছে।

সে কি এরকমই চেয়েছিল? তাও এই দুর্বল মাথায় বুঝতে পারছে না অমল? মানুষের অবচেতনে অনেক বাসনা থাকে। হয়তো অমলেরও ছিল। ঝগড়ার সময় কতবার তারা ডিভোর্সের কথা বলেছে, কতবার। কিন্তু এরকম কঠিন, প্রস্তুত হয়ে তো কখনও শেষ সিদ্ধান্ত জারি করা হয়নি। ঝগড়ার পর আবার ডিভোর্সের কথা ভুলে গেছে তারা। এ তো তা নয়। মোনা সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে।

অনেকক্ষণ ঠান্ডা জলের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে অমল। তার হয়তো সর্দি হবে, জ্বর হবে, নিউমোনিয়া হবে। হোক। তার এখন নিজের জন্য কোনও ভাবনা হচ্ছে না। তার যা খুশি তোক।

কতক্ষণ গেল কে জানে। হঠাৎ দরজায় ধাক্কার শব্দ হল।

মেজদা! এই মেজদা!

সচকিত অমল বলল, কে?

 আমি সন্ধ্যা। কতক্ষণ ধরে চান করছিস?

মাথাটা গরম লাগছে।

 ঠান্ডা লাগবে যে! বেরিয়ে আয় এবার।

যাচ্ছি।

কলটা বন্ধ কর।

করছি।

অমল কল বন্ধ করল। তোয়ালে দিয়ে মাথা, গা মুছল। পায়জামা পরে জামা আলোয়ান কুড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখল সেগুলো একদম ভিজে গেছে।

বাথরুম থেকে বেরোতেই বড় বড় চোখ করে সন্ধ্যা বলল, তুই কী রে মেজদা? এতক্ষণ ধরে কী করছিলি?

অমল কাঁপছিল শীতে। কঁপতে কাঁপতেই বলল, মাথাটা বড্ড গরম লাগছিল বলে–

ইস! জলে সাদা হয়ে গেছিস। শিগগির গায়ে জামা দে। তারপর রোদে গিয়ে দাঁড়া।

পরিশ্রান্ত অমল জামা গায়ে দিতে দিতে যেন প্রচণ্ড পরিশ্রমে হাঁফিয়ে পড়ছিল। বলল, তোর বউদি চলে গেছে?

মুখটা বিকৃত করে বলল, কোথায় আর যাবে। বউদির ঘরে গুজগুজ ফুসফুস হচ্ছে। আমি তো খেয়ালও করিনি, হঠাৎ বাবা ডেকে বলল, যা তো সন্ধ্যা, দেখে আয় তো অমলের বাথরুমে এতক্ষণ ধরে শাওয়ারে জল পড়ে যাচ্ছে কেন! শুনে আমি দৌড়ে এলাম। ভয় পাচ্ছিলাম, অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিস নাকি।

অনেকক্ষণ চান করেছি নাকি?

 অনেকক্ষণ নয়! চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো হবেই।

অবাক হয়ে অমল বলে, কই, টের পাইনি তো!

কী যে হয়েছে তোর কে জানে। ওই রাক্ষুসীই তোকে খাবে। কেন যে পারুলদিকে বিয়ে করলি না কে জানে বাবা। এখন যা তো রোদে গিয়ে বোস। আমি চেয়ার পেতে দিচ্ছি।

আর কেউ আসেনি রে?

কার কথা বলছিস?

 সোহাগ বা বুডঢা!

বুডঢা আসেনি। সোহাগ এসেছে।

একটু উদ্দীপ্ত হয়ে অমল বলে, এসেছে?

হ্যাঁ, মন খুব খারাপ।

 কোথায় বল তো!

আমার সঙ্গে একবার চুপটি করে দেখা করে এসে বোধহয় দাদুর ঘরে বসে আছে।

 কী বলল তোকে?

তেমন কিছু নয়। শুধু বলল, মন খারাপ। পরে কথা হবে পিসি।

সন্ধ্যার পিছু পিছু উঠোনে নেমে রোদে চেয়ারে বসল অমল। দুপুরের ঝাঝালো রোদ যেন বন্ধুর মতো বুকে টেনে নিল তাকে। আরামে ঘুম এসে যাচ্ছিল তার। মাথাটা ব্যথা করছে স্নানের পর থেকেই। তার কি জ্বর আসবে?

ঘুম আর জাগরণের মাঝখানে বসে রইল সে। কতক্ষণ গেল কে জানে।

ভাইঝি চটপটি এসে ডাকল, কাকা, খাবে এসো।

অমল উঠল। খাবার ঘরে গিয়ে ভাতের থালার সামনে বসলও। কিন্তু খিদে মরে গিয়ে পেটের ভিতরে কেমন একটা ঘোলানো ভাব। টক জল উঠে আসছে গলায়।

কিছু খেয়ে, কিছু ফেলে উঠে এল অমল।

ফের রোদে এসে বসল।

সামনেই সন্ধ্যা তার বিষয়সম্পত্তি ছড়িয়ে নিয়ে বসেছে। আচার, কাসুন্দি, আমলকি রোদে দিচ্ছে। বসে। ওই সবই ওর ধ্যানজ্ঞান।

মেয়েটা কোথায় রে?

দেখছি না তো। কোথাও গেছে বোধহয়।

আমার শরীরটা খারাপ লাগছে, বুঝলি!

যাও না, লেপচাপা দিয়ে শুয়ে থাকো গিয়ে। সোহাগ এলে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবোখন।

অমল ফের উঠে এল দোতলায়। মাথার ভিতরে যেন একটা কলকারখানা চলার শব্দ হচ্ছে। শরীর টালমাটাল। ঘরে এসেই সে বিছানায় শুয়ে পড়ল লেপমুড়ি দিয়ে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ল না। ঘুম এলই না তার। অবসন্ন শরীর শুধু ঝিমঝিম করছে।

একথা ঠিক যে, মোনার প্রতি আর সে কোনও আকর্ষণই বোধ করে না। যৌন আকর্ষণ দূরে থাক, মোনার মুখোমুখি হতে সে আজকাল অস্বস্তি বোধ করে, ভয় পায়। এও ঠিক তাদের ভিতরে কোনও সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি। একসময়ে যা-ও একটু বোঝাপড়ার চেষ্টা ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে কবে। অভ্যাসবশে দুজনে একসঙ্গে থাকে মাত্র। তবু মোনা চলে যাবে ভাবতেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে কেন? কেন ভয় খামচে ধরে বুক!

তবে কি ভালবাসা নয়, মানুষ দাস হয়ে থাকে তার অভ্যাসের কাছে? এ যেন দাবার ছক-এ সাজানো গুটির মতো ব্যাপার। একটা খোপ ফাঁকা হয়ে গেলে, গুটিটা উধাও হলে হঠাৎ যে ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হয় সেটাই যেন অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয় তাকে। সাহেবদের এসমস্যা নেই। তারা ছক পালটে ফেলে, শূন্যতা পূরণ করে নেয় নতুন গুটি বসিয়ে। সে কেন পারে না? তার মধ্যে নেই কেন কোনও অ্যাডভেঞ্চার? খাত বদলের আগ্রহ?

চোখ খোলা রেখে, চালি করা নীল মশারির পর্দায় সে নানা দৃশ্যের প্রক্ষেপ ঘটাতে থাকে। নানা সম্ভব অসম্ভব কথা। নানা সম্ভাবনা। নানা উদ্বেগ। অনেক দিন বাদে উদ্বেগ। তার জরাগ্রস্ত মন থেকে উদ্বেগও উধাও হয়ে গিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে। মোন চলে যাবে। নতুন করে শুরু করতে হবে জীবন। সে কি পারবে?

মোনার সন্দেহ, পারুলের টানেই তার এই পালিয়ে আসা। কিন্তু পারুলের কাছে সে তো যায়ও না। কতদিন দেখা হয়নি। পারুলের শরীর লুট করেছিল এক দুপুরে বিশ বছর আগে। কৃতকর্মের জন্য কত গুনোগার দিতে হল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ঘনিয়ে উঠল বুকের মধ্যে। অনেকক্ষণ ধরে শ্বাসটা বেরোল।

চোখ বুজে সে টের পাচ্ছিল তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে কি কাঁদছে? হয়তো। কিন্তু বুঝতে পারছে না কেন কাঁদছে।

তুমি কি ঘুমোচ্ছ?

চোখ খুলে ঘরের দরজায় মোনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল অমল। তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গিয়ে মাথাটা ঝিম করে উঠল।

না না, ঘুমোচ্ছি না। কিছু বলবে?

 আমরা যাচ্ছি। আজই যেতে হবে?

আমি তো থাকব বলে আসিনি। কথাটা তোমাকে জানিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। জানিয়ে গেলাম।

আমাকে কী করতে হবে যেন!

যদি দয়া করে কলকাতায় আসতে পারো তা হলে আমার উকিল তোমাকে সব বলে দেবে। তোমাকে কোর্টে অ্যাপিয়ার হতে হবে না।

তুমি কোথায় চলে যাবে মোনা?

সেটা জেনে কী হবে?

 এমনি জানতে চাইছি।

জেনে তো লাভ নেই।

 তুমি চলে যাবে, ধরো আমিও হারিয়ে গেলাম। তারপর কী হবে?

 সে তো আমার জানা নেই।

 বড় মুশকিল হল।

 মুশকিল! তোমার আবার মুশকিল কীসের?

আমি তো আজকাল কিছুই পারি না।

তোমার কোনও মুশকিল নেই, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, প্রেমিকার পিছনে ছুটছ, তোমার তো খুশির প্রাণ গড়ের মাঠ। শুধু বলে যাই, বুডঢা আর সোহাগকে ভাসিয়ে দিও না।

কিছুক্ষণ আবার বোকা চোখে মোনার দিকে চেয়ে থাকে অমল। তারপর বলে, কোথায় একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। বুঝলে! কোথাও একটা ভীষণ ভুল হচ্ছে।

সেটা তুমি বসে বসে ভেবে বের করো। আমার অত সময় নেই। আমাকে নতুন করে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে হবে। কাজেই আমার এখন সময় নেই।

মোনা।

বলো।

 একটা কথা যদি জানতে চাই?

 কী কথা?

তুমি কি আর কাউকে বিয়ে করবে?

 মোনার ফর্সা রং হঠাৎ টকটকে লাল হয়ে উঠল। কঠিন চোখে অমলের দিকে চেয়ে বলল, সেটা জেনে তোমার লাভ কী? তুমি তো আর আমার জন্য ডুয়েল লড়তে যাবে না!

তা বলিনি তো!

আমার বয়স ত্রিশের কোঠায়। মেয়েদের পক্ষে অনেক বয়স। আর সবাই তো তোমার মতো নয় যে একটা ছেড়ে আর একটা ধরে বেড়াবে।

মার খেয়ে বিবর্ণ মুখে বসে রইল অমল। এর চেয়ে থাপ্পড় ভাল ছিল। শুধু মিনমিন করে আবার বলল, ভুল হচ্ছে, কোথাও বড্ড ভুল হচ্ছে।

আমার কোনও প্রেমিক নেই। জুটলে তোমাকে জানিয়ে দেব। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলি।

দরজাটা ফাঁকা হয়ে গেল। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল ফের। ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে তার হৃৎপিণ্ডে।

খোলা দরজা দিয়ে একটা ভারী সুন্দর গেরুয়া আর খয়েরি রঙের প্রজাপতি এসে ঘর জুড়ে ঘুরতে লাগল।

আবার চোখ বুজতেই জলে ভেসে যেতে লাগল চোখ।

 কী গো, শরীর খারাপ?

চোখ চাইল অমল, এসো ঠাকরোন।

 কাঁদছিলে নাকি?

না না, এমনি চোখে জল এল হঠাৎ।

 এতকালের সম্পর্ক কাটান-ছাড়ান হলে কান্না তো পাবেই ভাই।

অমল চেয়ে রইল। অঝোর ধারায় জল পড়ছে চোখ দিয়ে।

এই জন্যই তোমাকে বলেছিলাম পাগলামি না করে কলকাতা ফিরে যাও। কথা তো শুনলে না!

আমি যে ওদের ভয় পাই।

ওসব অলক্ষুণে কথা বোলো না তো! শুনলে রাগ হয়।

 মোনা তোমাকে কী বলল ঠাকরোন?

কী আবার বলবে। মেয়েমানুষের কি দুঃখের শেষ আছে? তোমরা তো মনেও রাখো না, ওই মেয়েমানুষই ঘরদোর সন্তান সংসার আগলে থাকে বলে তোমরা ভেসে যাও না। ঘরের মহিলাটি ঘাঁটি আগলে না থাকলে এত পাগলামি, বাউণ্ডুলেপনা করে বেড়াতে পারতে বুঝি? অত সোজা নয়, বুঝলে?

বউদির সঙ্গে একমত হয়ে মাথা নাড়ল অমল। বিড়বিড় করে বলল, ভুল হচ্ছে, কোথাও বড় ভুল হচ্ছে আমাদের।

.

৪৭.

বিশু চলে গেল কলকাতায়, আর বাড়িটা কী ফাঁকাই না হয়ে গেল। সব যেন ঝিমিয়ে পড়ল। চারদিকটা কেমন মলিন লাগছে। পান্নার সঙ্গে তার দাদা বিশুর যেমন ভাব, তেমনই ঝগড়া, তেমনই খুনসুটি। বালিশ নিয়ে মারপিটও কত হত আগে। বালিশ ফেটে তুলো উড়ত আর মা বকে বকে হয়রান হত। এবার আর সেই আগের মতো হল না। বিশুর এখন পড়ার চাপ বাড়ছে, গম্ভীর হয়েছে, বড় হয়েছে। আর পান্নাও সংসার নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। মায়ের বকুনিও আছে সঙ্গে। এটা ঠিকমতো হল না, ও কাজটা পড়ে রইল। ওর মধ্যে মধ্যেই প্রিয় দাদাটির সঙ্গে যা-একটু ইয়ার্কি ঠাট্টা গল্প। সেটাও কি কম? দাদাটাকে আর সহজে পাওয়াও যাবে না। পাস-টাস করে যদি চাকরি পায় বা বিদেশে চলে যায় তাহলে তো হয়েই গেল। আর তা করতে এদিকে তো পান্নার বয়সও বসে থাকবে না। হয়তো বাবা পাত্র জুটিয়ে এনে বিয়ে দিয়ে দেবে। ঘোরো সংসারের ঘানিতে। সংসার কেমন তা মায়ের অসুখ হওয়ার পর কয়েক দিনেই বুঝে গেছে পান্না। এমন সংসারে তার দরকার নেই বাপু। কিন্তু সে জানে, তার জন্য এই হড়িকুড়িই অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে।

আজ সকালেই চলে গেল দাদা। সেই থেকে মনটা খারাপ। আর বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পারুলদির কাছে যখন-তখন যাওয়া যেত। তা পারুলদিকে আজই নিতে আসছে তার বর। পান্নার কিছুদিন এসব সয়ে নিতে হবে। সয়েও যায় সব কিছু।

মায়ের নাকি হার্টের দোষ ধরা পড়েছে। খুব ভয়ের কিছু নয়। তবে সাবধানে থাকতে হবে। সংসার যুদ্ধ থেকে একটু আলগোছ হতে হবে।

বাবা তাই কদিন ধরে রান্নার জন্য বামুনঠাকুর বা বামনি খুঁজে বেড়াচ্ছে। অবশেষে পাওয়া গেছে একজনকে। বড়মার বাড়ির বামুনঠাকুরের সম্পর্কে ভাই। সে আজ কাজে আসবে। এলে বাঁচে পান্না। একটু হাঁফ ছাড়তে পারে। কদিন হারমোনিয়াম নিয়ে বসেনি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা নেই। লেখাপড়ায় ফাঁক পড়ছে। মুখ তুলে চারদিকটা দেখারও যেন ফুরসত ছিল না।

ছেলে চলে যাওয়ার পর মা ছেলের ঘরে ঢুকে সব দেখে-টেখে বলল, ওই দেখ, কত করে বললুম, ফুলহাতা সোয়েটারটা নিয়ে যাস। ভুলে ঠিক ফেলে গেছে। দাড়ি কামানোর খুর পড়ে আছে, নতুন মোজা, তিনটে গেঞ্জি, খুঁজলে আরও বেরোবে। আমি যেটা না গুছিয়ে দেব সেটাই ঠিক ফেলে যাবে। বলি ও পান্না, দাদার জিনিসগুলো গুছিয়ে দিবি তো! কী যে করিস তোরা।

সব দোষ এখন পান্নার।

আচ্ছা মা, আমি আবার কবে দাদার জিনিস গুছিয়ে দিই? ওটা তো বরাবর তুমিই করো!

আহা কী কথার ছিরি। আমি করতে পারলে কি আর তোদের ঠ্যাঙের তলায় যাই? আমি গুছিয়ে দিইনি বলেই ছেলেটা এত সব ফেলে গেল, তোরা একটু দেখবি না? সোয়েটারটা নিল না, কলকাতায় গিয়ে শীতে কষ্ট পাবে।

পান্নার চোখে জল এল। ভগবান বলে কিছু নেই। থাকলে এত অবিচার সইতেন কি? দাদার প্রতি মায়ের পক্ষপাত এত প্রকট যে কোনও চক্ষুলজ্জা অবধি নেই। দাদার যে নিজেরই সব গুছিয়ে নেওয়া উচিত ছিল এই সত্যটা মা স্বীকারই করবে না। ছেলেদের প্রতি এই আসকারা মায়েদের চিরকাল চলে আসছে। দাদাকে পান্না ভালবাসে বটে, ভীষণ ভালবাসে, কিন্তু সে একচোখো হতে পারে না।

পান্না মৃদুস্বরে সাহস করে বলেই ফেলল, দাদা নিজে কেন গুছিয়ে নেয়নি বলবে?

মা এমন অবাক হয়ে তাকাল যেন এরকম অদ্ভুত কথা জন্মে শোনেনি। বলল, বিশু গুছিয়ে নেবে? তার কত মাথার কাজ জানিস? আনমনা আলাভোলা ছেলে, তার কি অত সংসারবুদ্ধি আছে? নিজেরা চোখে ঠুলি পরে থাকিস আর অন্যের দোষ খুঁজিস।

ছেলের পক্ষ নিয়ে কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে মা। আনমনা, আলাভোলা ছেলে, সংসারবুদ্ধি নেই! পান্নার বেলায় এই দরদটা মার কেন যে উবে যায় কে জানে! গত পরশু পান্নার হাতে গরম ভাতের ফেন পড়ে গিয়েছিল, মায়ের কোনও উদ্বেগই দেখা গেল না। শুনে বলল, এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে ভাতের মাড়টা পর্যন্ত গালতে শিখল না এখনও।

দাদাকে ভীষণ ভালবাসে ঠিকই পান্না, কিন্তু মায়ের এই একচোখোমি দেখলে দাদার ওপরেও রাগ হতে থাকে।

ব্যাপারটা দাদাও জানে। পোড়া হাতে কী সব ওষুধ-টষুধ লাগাতে লাগাতে দাদা বলল, কাঁদছিস কেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।

মায়ের ব্যাপারটা দেখলি দাদা?

বিশু হেসে বলল, আরে, মা তো ওরকমই। তা বলে তোকে যে কম ভালবাসে তা কিন্তু নয়। সব সময়ে কাছে থাকিস বলে চোখে-হারাই ভাবটা নেই। কিন্তু বিয়ে হয়ে যখন শ্বশুরবাড়ি যাবি দেখিস তখন কীরকম আপলা- চাপলা খাবে।

অবাক হয়ে পান্না বলল, ও দাদা! ওটা কী বললি রে? আপলা-চাপলা না কী যেন।

হ্যাঁ তো! আপলা-চাপলা মানে হল আছাড়ি-পিছাড়ি না কী যেন বলে!

এমা! ও তো বাঙাল কথা! কোত্থেকে শিখলি?

বিশু হেসে ফেলে বলে, আরে হয়েছে কী জানিস, আমার রুমমেট বীরভদ্র বলে একটা ছেলে আছে। সে হল কাঠ বাঙাল। সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডও বটে। তার সঙ্গে মিশতে মিশতে অনেক টার্ম শিখে গেছি। এখন মুখে এসে যায়।

খুব হেসেছিল দুজনে।

সেদিন রসিক বাঙাল বড়মার কাছে কার্টসি ভিজিটে এসেছিল। অনেক ফল-টল মিষ্টি সব নিয়ে এসেছিল। এসেই বলল, ঠাইরেন, আমারে পোলার লাহান দ্যাখবেন। যখন যা মনে লয়, যা খাইতে ইচ্ছা করে একবার আমারে কইয়া পাঠাইয়েন। বুড়া কর্তার কর্জ তো আমি জীবনেও শোধ দিতে পারুম না। এইসব হাউমাউ করে বলছে আর বড়মা হাঁ করে চেয়ে আছে। পরে রসিক বাঙাল চলে যাওয়ার পর আমাকে বলল, বাঙালের সব কথা বোঝা যায় না বটে কিন্তু লোকটা বড় ভাল।

বাঃ! তুই তো বেশ বাঙাল কথা বলতে পারিস। উইথ কারেক্ট অ্যাকসেন্ট!

পান্না হেসে গড়িয়ে পড়ে বলে, মোটে পারি না। আমি আসলে অন্যকে খুব ভাল নকল করতে পারি।

তাই দেখছি।

তারপর শোন না, বড়মা যেই বলেছে বাঙাল খুব ভাল লোক অমনই আমি বড়মার সঙ্গে ঝগড়া লাগালুম। বললুম, ও বড়মা, যারা দুটো বিয়ে করে তারা আবার ভাল লোক হয় কী করে? বড়মা বলল, দুর পোড়ারমুখি, দুটো বিয়ে করেছে বলে কি পচে গেছে? বড়মা কিছুতেই মানবে না, আমিও ছাড়ব না। তখন বড়মা হার মেনে বলে, কী জানি বাপু, একালের ছেলেমেয়েরাও তো দুটো-তিনটে করে বিয়ে বসছে শুনি। একটাকে ছেড়ে আর একটাকে ধরে। তোর জ্যাঠা সেইজন্য ডিভোর্সের মামলা নিতে চাইত না। ডিভোর্স করে ফের বিয়ে করাও তো বাপু, বহু বিবাহই, তোরা যার নিন্দে করিস। বরং ডিভোর্স আরও খারাপ, একটাকে তাড়িয়ে আর একটাকে আনে।

ইস, তুই তো বড়মার কাছে গো-হারা হেরে গেছিস তাহলে। হারারই কথা, বড়মা কত বড় উকিলের বউ জানিস? তুই গেছিস তার সঙ্গে লাগতে!

ইল্লি! মোটেই হারিনি। আমি তখন বড়মাকে বলেছি, ও বড়মা, বড় জ্যাঠা যদি আর একটা বিয়ে করে বউ আনত তাহলে কী করতে? তখন বড়মা বলল, ও বাবা, সে আমার সহ্য হত না। গলায় দড়ি দিতুম তাহলে। ব্যস, বড়মা সারেন্ডার করে ফেলল।

এইভাবে হাসিঠাট্টায় সেদিনকার মন-খারাপটা উড়িয়ে দিয়েছিল দাদা। কিন্তু নিজের অনাদরটা আজ বড় টের পাচ্ছে পান্না।

আজ আবার মনটা মেঘলা হয়ে আছে। দাদা চলে গেল, আজ আবার পারুলদিও চলে যাবে। ভাল খবরের মধ্যে একটাই। আজ রান্নার লোক আসবে। যদি আসে তাহলে বেঁচে যায় পান্না। একটু আপনমনে থাকতে পারে। মা অবশ্য বলে দিয়েছে, ছেলেছোকরা বামুন হলে চলবে না, বাড়িতে বয়স্কা মেয়ে রয়েছে। বাবুবাবু চেহারা হলেও রাখা যাবে না। মায়ের কি বায়নাক্কার শেষ আছে? রান্না করতে তো আর রাজপুত্তুর আসবে না! আর আজকালকার মেয়েরা আগের দিনের মতো বোকা নয় যে, কাজের লোকের সঙ্গে পালিয়ে যাবে। কিন্তু মাকে কে বোঝাবে সে কথা! মা সেই গত শতাব্দীর চৌকাঠে আটকে আছে। হ্যাঁন্যাতা পুরুষ দেখলেও সোথ মেয়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

আগে চড়াতে হয় ডাল। এ বাড়ির নিয়ম। পরিমাণও বড় কম নয়। এ-বাড়ির চারজন আর কতটুকুই। বা খায়? কাজের লোক তো কম নয়। তিনজন কাজের মেয়ে, দুটো মুনিশ, একটা রাখাল। সকালে ডাল ভাত সবার বরাদ্দ। কলাইয়ের ডাল হলে তিন হাতার জায়গায় পাঁচ হাতা নেবে। আজ কলাইয়ের ডালেরই হুকুম হয়েছে। চারপোয়া ডাল মেপে দিয়েছে মা, কাজের মেয়ে ধুয়ে দিয়েছে। পান্না গ্যাসের উনুনে ডাল চাপিয়ে মৌরির কৌটোটা খুঁজছিল, এমন সময়ে বাইরে থেকে কে যেন বলল, হাই!

ভারী চমকে উঠল পান্না। তারপর অবাক হয়ে বলল, ও মা! সোহাগ! কবে এলে?

মুখখানায় হাসি আছে বটে সোহাগের, কিন্তু ভারী শুকনো দেখাচ্ছে। পোশাক ঠিক আগের মতোই, বাড়তি শুধু একটা চমৎকার রংদার ঢিলা ফিটিং-এর পুলওভার। বোধহয় বিদেশি জিনিস। সোহাগ বলল, কাল এসেছি। তুমি কি রান্না করো আজকাল?

আর বোলো না। মায়ের অসুখ, এ-বাড়িতে আবার খুব শুচিবায়ু। বামুন ছাড়া হেঁসেল ছুঁতে দেওয়া হয় না। তাই খুব খাটুনি যাচ্ছে। চলো, ঘরে বসবে। ডাল সেদ্ধ হতে সময় লাগবে।

দরকার কী ঘরে যাওয়ার। ওই ছোট টুলটা দাও না, এখানেই বসি। ভাল কথা, আমি বসলে আবার তোমাদের কোনও পাপ-টাপ হবে না তো! যদি ছোঁয়া-টোয়া লাগে। ৩৪০

ধ্যাত। তুমি একটা কী বলল তো! তোমরাও তো বামুন।

ভারী অবাক হয়ে সোহাগ বলে, ও হ্যাঁ, তাই তো! আসলে আমার ওসব একদম খেয়াল থাকে না। ঠিকই তো, আমিও তো শুনেছি যে, আমরা ব্রাহ্মণ। তবে ভাই, আমি কিন্তু গোরুর মাংস, শুয়োরের মাংস সব খেয়েছি। তাতে দোষ হবে না তো!

চোখ বড় করে পান্না বলে, খেয়েছ?

 অনেক। বিদেশে তো ওসবই রোজ খেতাম।

 তোমার মা?

 সবাই। দোষ হচ্ছে না তো এখানে বসলে?

আরে না। মা তো আর জানে না যে তুমি ওসব খাও। না জানলে কিছু নয়। কেমন লাগে বলো তো গোরুর মাংস! খুব শক্ত হয়, না? তেতো নাকি?

না না, খেতে খুব ভাল। ভেরি প্যালেটেবল।

ঘেন্না করত না খেতে?

অবাক হয়ে সোহাগ বলে, না তো! ঘেন্না করবে কেন? মিট ইজ মিট, গোরুরই হোক, পাঁঠারই হোক।

আমি বাবা মরে গেলেও খেতে পারব না। আগে তো শুনতাম গোরুর মাংস নাকি ভীষণ শক্ত, তেতো আর এমন গরম যে খেলে গায়ে ফোঁসকা বেরোয়।

সোহাগ হেসে ফেলে বলে, যাঃ, ওসব কিছু হয় না।

তুমি হঠাৎ এলে যে! একা নাকি?

না। মায়ের সঙ্গে এসেছি। বাবা চার-পাঁচ দিন আগে কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ চলে এসেছে এখানে।

ওমা! কেন?

ঠোঁট উলটে সোহাগ বলে, গড নোজ।

তাই হঠাৎ সেদিন অমলদার মতো কাকে যেন দেখলাম জানালা দিয়ে। একবার ভাবলাম, অমলদা। তারপর ভাবলাম আর কেউ হবে।

সোহাগ একটু উদাস হয়ে গিয়ে বলল, আমার মা আর বাবা সেপারেট হয়ে যাচ্ছে।

অবাক হয়ে পান্না বলে, সে কী! ডিভোর্স নাকি?

হ্যাঁ।

ওমা! কেন?

 মা আর বাবার আন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে না।

পাংশু মুখে পান্না বলল, কী হবে তাহলে সোহাগ?

 উই আর ইন এ জ্যাম নাউ।

 এ বাবা! ডিভোর্স তো বিচ্ছিরি ব্যাপার!

সোহাগ মলিন মুখেও একটু হাসল, বিচ্ছিরি কেন বলো তো!

 মা আর বাবা আলাদা হয়ে যাওয়া কি ভাল? কী হবে তাহলে?

জানোই তো, আমাদের ফ্যামিলিতে কোনও আঠা নেই। যে যার নিজের মতো থাকে। কেউ কারও পরোয়া করে না। কেউ কাউকে ভাল-টালও বাসে না। তবু যদি ডিভোর্স হয় তাহলে আমাদের লাইফ প্যাটার্নটা ভীষণ আপসেট হয়ে যাবে।

তাই তো! কিন্তু হঠাৎ কী হল বলো তো! হঠাৎ ডিভোর্স হচ্ছে কেন?

হঠাৎ হচ্ছে না। অনেকদিন ধরেই ব্যাপারটা তৈরি হচ্ছিল। আমরা আন্দাজ করছিলাম এরকম একটা কিছু হতেই পারে।

দুজনের ঝগড়া হয়েছিল বুঝি?

না। ঝগড়া আজকাল হয় না। তোমাকে তো বলেইছি আমাদের মধ্যে কেমন যেন একটা ঘেন্নার সম্পর্ক। কেউ যেন জোর করে আমাদের একটা কৌটোয় পুরে রেখেছে। আমাদের মধ্যে আসলে কোনও রিলেশনই যেন তৈরি হয়নি। মাঝে মাঝে আমার তো মনে হয় আমরা চারজনই যেন চারজনের কাছে টোটাল স্ট্রেঞ্জার। কেউ কাউকে যেন চিনিই না। তোমার খুব অদ্ভুত লাগছে, না?

হ্যাঁ। আমরা তো কেউ কাউকে ছাড়া থাকতেই পারি না। এই তো আমার দাদা আজ কলকাতায় চলে গেল বলে সকাল থেকে কী ভীষণ মন খারাপ লাগছে।

তোমরা খুব ভাল আছ, তাই না?

পান্না করুণ মুখেও ফিক করে হেসে ফেলে বলল, ঠিক তাও নয়। এই তো একটু আগে মায়ের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। কেঁদেছিও একটু। মা তো ভীষণ পার্শিয়ালটি করে দাদার জন্য। তাই খুব রাগ হয়। কিন্তু ধরো, মাকে ছাড়াও তো আমার চলে না। অসুখ-টসুখ হলে আবার ওই মা-ই তো এসে রাত জেগে পাশে বসে থাকে। আবার দেখ মা আর বাবার মধ্যেও তো মাঝে মাঝে খিটিমিটি হয়, তবু মায়ের হাতের রান্না ছাড়া বাবার মুখে রোচে না। কদিন ধরে আমি যে এত যত্ন করে রাঁধছি তা বাবার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি মনের মতো হচ্ছে না।

উই আর লাইক অ্যালিয়েনস। আমি আজকাল খুব আমাদের নিয়ে ভাবছি। আগে ভাবতাম না, কিন্তু এখানে এসে যখন কিছুদিন ছিলাম তখন আমার জ্যাঠামশাই, জেঠিমা, তোমার মা বাবা, তারপর পারুলদের বাড়ির সবাইকে দেখে ভারী অদ্ভুত লাগত। কই, এরা তো আমাদের মতো নয়। দে আর কোয়াইট ডিফারেন্ট পিপল! সেই থেকে ভাবি।

সোহাগ, তুমি কিছু করতে পারো না?

ঠোঁট উলটে সোহাগ হতাশ গলায় বলল, কী করার আছে বলো তো? ফাদার উইল নট চেঞ্জ, মাদার উইল নট চেঞ্জ। তাহলে কী করে কী হবে! আমার বাবাকে রিসেন্টলি দেখেছ?

ভাল করে লক্ষ করিনি। কেন বলো তো!

কেমন যেন পাগলামিতে পেয়ে বসেছে।

কিন্তু অমলদা কত ভাল ছাত্র ছিল বল। স্কুল ফাইন্যালে স্ট্যান্ড করেছিল।

সেসব বাবা ভুলে গেছে। একদিন মায়ের সঙ্গে কী নিয়ে কথা হচ্ছিল, বাবা কাউকে কিছু না বলে নীচে নেমে গাড়িতে উঠে চুপচাপ ঘুমিয়ে রইল। আর আমরা চারদিকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। শেষে রাত দুটো নাগাদ বাবাকে লক করা গাড়ি থেকে বের করা হয়। সাফোকেশনে হয়তোবা মরেই যেত।

ও বাবা!

 বাবার ভিতরে একটা সেলফ ডেস্ট্রাকশনের টেন্ডেন্সি দেখতে পাচ্ছি।

পান্নার চোখ ছলছল করছিল। বলল, ডিভোর্স হলে তো তাহলে অমলদা সত্যিই সুইসাইড করে বসবে।

সেসব কথাও ভাবি। আমার মনে হয় আমাদের পরিবারে একটা ডেথ-টেথ কিছু হবে। ইট ইজ ইমিনেন্ট।

যাঃ, ও কথা বোলো না। শুনলেই ভয় করে।

মলিন মুখে একটু হাসল সোহাগ। বলল, ওরকম কিছু না হলে কি আমাদের ফ্যামিলিটা বদলাবে?

যাঃ, কেউ মরলেই বুঝি সবাই বদলে যায়?

কোনও কোনও সিচুয়েশনে বোধহয় যায়।

ওসব বোলো না তো, আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়।

সোহাগ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ইট মাস্ট এন্ড সামহোয়ার। ইট হ্যাজ টু। আমি দাদুকেও কথাটা বলেছিলাম।

মহিম জ্যাঠাকে!

 হ্যাঁ।

জ্যাঠা কী বলল?

দাদুর মনটা খুব খারাপ। শুধু বলল, দিদিভাই, আমি তো ওল্ড টাইমার, এ-যুগের মানুষের কাছে। আমাদের দাম নেই।

শুধু এই কথা! 

হ্যাঁ। অ্যান্ড দাদু ওয়াজ রাইট। আমি দেখেছি, দাদুকে কেউ বেশি মানে-টানে না। কিন্তু দাদু ইজ এ নাইস কুল হেডেড ম্যান।

তাহলে কী হবে সোহাগ?

মা ভীষণ অ্যাডামেন্ট। মা সন্দেহ করে বাবা এখনও ভেরি মাচ ইন লাভ উইথ পারুল। পারুল এখন এখানেই আছে। আর সেই জন্যই বাবা পালিয়ে এসেছে এখানে। মায়ের এমনও ধারণা হয়েছিল যে, দুজনে হয়তো একটা ষড়যন্ত্র করেছে।

পান্না সবেগে মাথা নেড়ে বলে, এ মাঃ! না না, একদম বাজে কথা সোহাগ। পারুলদি ওরকম মেয়েই নয়। তার ওপর পারুলদি এখন প্রেগন্যান্ট।

মাই গড! আর ইউ সিওর?

হ্যাঁ। পারুলদি আজই ফিরে যাচ্ছে জামশেদপুরে। আমি তো রোজ ওবাড়িতে যাই। আমি জানি অমলদার সঙ্গে পারুলদির দেখা-সাক্ষাৎও হয় না।

সোহাগ ম্লান মুখে বলল, কিন্তু মা কি আর ওসব বিশ্বাস করবে? এখন মায়ের হচ্ছে ওয়ান ট্র্যাক মাইন্ড। আমার কী মনে হয় জান?

কী?

শী উইল ডেস্ট্রয় হিম অ্যান্ড হি উইল ডেস্ট্রয় হার। দুজনেই দুজনকে ধ্বংস করবে। তারপর জুড়োবে।

ফের ওরকমভাবে কথা বলছ! ওসব শুনতে আমার ভাল লাগে না।

 দেন লেট আস টক অ্যাবাউট সুইট থিংস। বলে হাসল সোহাগ।

পান্নাও হেসে ফেলল, বলল, আচ্ছা, আমরা কিছু করতে পারি না, না?

 তুমি! তুমি কী করবে?

আমার কী ইচ্ছে হয় জান? খুব ইচ্ছে হয় পৃথিবীর সকলের সব দুঃখ দূর করে দিই।

সোহাগ হেসে বলে, তোমার শত্রুরও?

হ্যাঁ তো। তবে আমার কোনও শত্রু নেই যে!

সোহাগ বলল, এবার এসে কী দেখলাম জানো?

কী?

বাবার গলায় পৈতে। আর বাবা নাকি আজকাল গায়ত্ৰীমন্ত্র জপ করে দুবেলা।

ওমা! সে তো বামুনরা করেই। বাবা করে, জ্যাঠারা করে, এমনকী বিজুদা যে নাস্তিক, সেও কিন্তু করে। অমলদার পৈতে ছিল না বুঝি!

না। কখনও দেখিনি।

সেইজন্যই তোমাদের এমন হচ্ছে। গায়ত্রীমন্ত্রের জোর জান? গায়ত্রী জপ করলে ভূতপ্রেত সব পালিয়ে যায়। আরও অনেক কিছু হয়।

সোহাগ হেসে বলে, তাই বুঝি? আমার মা-বাবার রিলেশান খুব স্ট্রেইন্ড হলেও এতদিন সম্পর্কটা টিকে ছিল। গায়ত্রী জপ করার পর তো ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। সেটাও কি মন্ত্রের জন্যই?

না বাবা, তা নয়।

 তাহলে?

 হতাশ হয়ে পান্না মাথা নেড়ে বলে, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এ মা, ডালটা পোড়া লাগল নাকি? গন্ধ বেরোচ্ছে যে!

বলে ছুটে গেল পান্না। ডালটার তলার দিকটা একটুখানি ধরেছে মনে হয়। তাড়াতাড়ি ঘটি উপুড় করে জল ঢেলে হাতা দিয়ে তলাটা ভাল করে নেড়ে দিল সে। জল শুকিয়ে চড়চড় করছিল এতক্ষণ।

এই সোহাগ, পোড়া গন্ধ পাচ্ছ?

 সোহাগ বাতাস শুঁকে বলল, একটু একটু অ্যাক্রিড স্মেল পাচ্ছি।

এমা! তাহলে আজ মায়ের কাছে আবার বকুনি খেতে হবে। আমার কপালটাই বকুনি খাওয়ার।

 একটু ভিনিগার দিয়ে দেখ না!

ভিনিগার! ও বাবা, ওসব মা হেঁসেলে ঢুকতে দেয় না। ভিনিগার নাকি মদ থেকে তৈরি হয়।

রান্নায় মাঝে মাঝে ওয়াইন দিলে তো খেতে চমৎকার হয়।

সে তোমাদের হয়, আমাদের হয় না।

মল্টেড ভিনিগারে অ্যালকোহল থাকতে পারে, সিনথেটিক ভিনিগারে তা থাকে না।

কাঁদো কাঁদো হয়ে পান্না বলে, কিন্তু ভিনিগার তো নেই, কী করি বল তো! বেশি করে হিং দিয়ে ফোড়ন দিলে হবে না?

মাথা নেড়ে সোহাগ বলে, আই নো নাথিং অ্যাবাউট কুকিং। আমি ওমলেট বা চাওমিন বানাতে পারি, আর বার-বি-কিউ। হিং আমাদের বাড়িতে কেউ পছন্দ করে না।

একটু পরে ডাল ফোটার যে গন্ধটা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল সেটা কলাই ডালের মিষ্টি গন্ধই বটে।

সোহাগ বলল, না, এখন আর অ্যাক্রিড স্মেলটা নেই তো।

বাঁচা গেল বাবা! যা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

আমি এসে তোমার কাজ নষ্ট করছি পান্না। আজ বরং আমি যাই।

আহা, বোসো না। রান্নাঘরে আমি যে বড্ড একলাটি হয়ে থাকি।

আচ্ছা, পরে আসব। আজ আমরা কলকাতা যাচ্ছি না। হয়তো কাল যাব।

বিকেলে আসবে?

আমার তো সবসময়ে তোমার কাছে আসতে ইচ্ছে করে।

 এসো কিন্তু বিকেলে।

আচ্ছা।

সোহাগ চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ভাবল পান্না। ভেবে ভেবে চোখে জল এল। ইস, মা-বাবা আলাদা হয়ে গেলে কী করে থাকবে ওরা? কেন যে ডিভোর্স জিনিসটা উঠে যাচ্ছে না পৃথিবী থেকে? কেন যে মা-বাবারা চিরকালের মতো মিলেমিশে যাচ্ছে না?

লোকটা এল এগারোটা নাগাদ। রোগা, লম্বাপানা, রংটা ফর্সার দিকেই, বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে। পরনে হাঁটু অবধি ধুতি, গায়ে একটা ফতুয়া, গলায় খুব মোটা সুতোর পৈতে। মুখখানা লম্বা মতো, তাতে একটু বোকা বোকা ভাব আছে। বামুন বলে বাইরের ঘরে বসতে একটা জলচৌকি দেওয়া হয়েছে। নিচুতে বসায় লম্বা হাঁটু দুটো উঠে আছে জোড়া উটের মতো। পাশে একখানা মলিন পুঁটুলি রাখা। নাম সুদর্শন মিশ্র।

মা বাবা দুজনেই বসল তার ইন্টারভিউ নিতে।

 পান্নার বাবা তেমন বলিয়ে কইয়ে মানুষ নয়। যা বলার মা-ই বলছিল, তা হ্যাঁ বাপু, বামুন তো বলছ, গায়ত্ৰীমন্ত্রটা জান তো!

হ্যাঁ মা, সে আর বলতে! ওঁ ভূর্ভুবঃ স…

সঙ্গে সঙ্গে কানে হাত চাপা দিয়ে মা ককিয়ে উঠল, থাক থাক। ও মন্তর মেয়েমানুষের শুনতে নেই। কেমন বামুন তুমি, মেয়েমানুষের সামনে গায়ত্রী উচ্চারণ করো!

কী করব মা! যারা ব্রাহ্মণ চায় তারা তো যাচাই করেই নেবে।

 বলি রান্না বান্না কী জান?

গেরস্তঘরের রান্না জানি মা, বিরিয়ানি-টিরিয়ানি পেরে উঠব না। সাহেবি কেতার রান্নাও শিখিনি।

আগে কোথায় কাজ করেছ?

রান্নার কাজ নয় মা। এক পাথর ভাঙা কলে ছিলাম, তা সেখানে থেকে অসুখ বাধিয়ে বসলাম।

 সে কী গো! টি-বি নাকি?

না। পেটের রোগে ধরেছিল।

 দ্যাখ বাপু, রোগ-টোগ থাকলে তা গোপন করে কাজে ঢুকে পোড়ো না আবার।

গরিবের কথা কেউ বিশ্বাস করে না মা, তবে খারাপ লোগ কিছু হয়নি। আমাশা হয়েছিল। খাদানের কাজ তো, শরীর চুঁইয়ে দিতে হয়। ব্রাহ্মণের ধাত তো শক্ত ধাত নয়, সইবে কেন?

আমাদের বাপু, একটু পরিষ্কার বাতিক আছে। হেগো, বাসি কাপড়-চোপড় ছাড়তে হয়। ঠিকমতো হাতমাটি করতে হয়। পেচ্ছাব করে জল নিতে হয়।

ওসব বলতে হবে না মা। আমাদের বাড়িতে রোজ নারায়ণসেবা হত। আজও শরিকদের ভাগে হয়।

তোমাদের ভাগে হয় না বুঝি?

আমাদের আর ভাগ-টাগ নেই মা। বেচেবুচে পেটায় নমঃ করতে হয়েছে।

বউ-টউ সব কোথায়?

বিয়ে আর করা হল কই? নিজেরই জোটে না।

বিয়ে করনি, সেও তো এক চিন্তার কথা।

চিন্তা কীসের মা? বিয়ে করিনি বলে পিছুটানও নেই। ঘরের ছেলের মতো যদি রাখেন তাহলে থেকে যাব।

থাকবে তো বাছা, কিন্তু মাইনে কত নেবে?

এ বাজারে কি কমে কিছু হয়? পাঁচশোটি টাকা দেবেন।

 বল কী? পাঁচশো টাকায় তো কেরানি রাখা যায়।

সে যুগ আর নেই মা। এই বর্ধমান জেলাতেই এখন পাঁচ-ছ টাকার নীচে মোটা চালটাও পাবেন না। তাও পাইকারি দরে। সর্ষের তেলের কেজি কত জানা আছে তো মা!

তিনশো টাকা দেব। ভেবে দ্যাখ।

 মাথা নেড়ে লোকটা বলল, আমারও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। আখেরে টাকা ছাড়া কে আমাকে দেখবে বলুন!

বিস্তর ঝোলাঝুলির পর লোকটা চারশো টাকায় রাজি হল।

 সখেদে বলল, কলকাতায় হলে হাজার টাকা হাঁকতাম। এ গ্রামদেশ বলে মাথা নোয়াতে হল।

পুষিয়ে দেব গো সুদর্শন। বছরে একবার ধুতি-জামা পার্বণী তো পাবেই।

ও সবাই দেয় মা, নতুন কথা কী?

রান্না-বান্না বুঝেশুনে কোরো বাপু। আবার আমার জন্য আঝালি মশলা ছাড়া রাঁধতে হবে। ডাক্তার পোড়ামুখোরা বলছে আমার রক্তে চকলেট না কী যেন বেড়েছে।

রামহরি বলে উঠল, কী যে ছাই বল। চকলেট হবে কেন, ও হল কোলেস্টোরাল।

ওই হল বাপু। তা আজ থেকেই লেগে পড়। আমার মেয়েটার রাঁধতে গিয়ে পড়ায় ফাঁক পড়ছে।

পুকুর থেকে হাত-পা ধুয়ে মুড়ি খেয়ে সুদর্শন কাজে লাগবার পর ছুটি পেয়ে হাঁফ ছাড়ল পান্না। এবার তার ছুটি।

মাকে গিয়ে বলল, একটু বড়মার বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি মা।

যে-ই রান্নার লোক এল অমনি পাখা মেললে!

অমন করছ কেন? আজ পারুলদি চলে যাচ্ছে না!

মা তবু একটু গজগজ করতেই থাকে। ওসব কানে তুললে বেঁচে থাকাই মুশকিল। পান্না আর দাঁড়াল না, এক ছুটে হাজির হয়ে গেল বড়মার বাড়িতে।

ঢুকতেই থমকাতে হল তাকে। কী সুন্দর ঝকঝকে একখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সদরের সামনে। রং-টা স্টিল গ্রে। চ্যাপটা, লম্বাটে কী যে সুন্দর ডৌল গাড়িটার। কাঁচগুলো ভোলা। ভিতরে নরম, নিচু গদির ওপর টারকিশ ভোয়ালের ঢাকনা। একজন অল্পবয়সি ড্রাইভার পালকের ঝাড়ন দিয়ে যত্ন করে বনেট পরিষ্কার করছে। নাঃ, সত্যিই পারুলদিদের অনেক টাকা। যেমন সুন্দরী, তেমনই ভাগ্যবতী। ভগবান যেন ওকে ঢেলে দিয়েছেন। সাধে কি আর সোহাগ ওকে গডেস বলে! পারুলদিকে আজকাল তারও যেন ঈশ্বরী ভাবতে ইচ্ছে করে।

গাড়ির পিছনে রূপালি অক্ষরে টয়োটা নামটা একবার দেখে নিল পান্না। জাপানি গাড়ি। তার তত হবে না এসব কখনও। তবু পারুলদির তো হয়েছে।

পারুলের চোখে জল দেখে অবাক হল না পান্না। বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতে কোন মেয়ের না কষ্ট হয়! পাশের ঘরে জামাইবাবু আর ছেলেমেয়েদের গলা পাওয়া যাচ্ছিল। অনেকদিন পর বাবাকে পেয়ে ছেলেমেয়েদের কথা শেষ হচ্ছে না। এ-ঘরে একলাটি পারুল।

তাকে দেখে হেসে স্নিগ্ধস্বরে বলল, আয়, কাছে বোস এসে।

গাড়িটা নতুন কিনলে বুঝি তোমরা! কী সুন্দর গাড়ি।

তোর জামাইবাবু কিনেছে। বেশি শখশৌখিনতা তো নেই, তাই বেশি আপত্তি করিনি। এককাড়ি টাকা অবশ্য বেরিয়ে গেল।

তা যাক পারুলদি। তোমার তো অভাব নেই।

পারুলের চোখে জল, মুখে মিটি মিটি হাসি। একটু চুপ করে থেকে বলল, কাউকে বলতে নেই, কিন্তু কথাটা চেপে রাখতে পারছি না।

কী কথা গো?

পারুল এক অপরূপ চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, কাল রাতে কী স্বপ্ন দেখলাম জানিস?

 কী গো?

বাবা আমার পেটে এসেছে।

.

৪৮.

সিগারেট ছেড়ে কি শেষে নস্যি ধরলে নাকি হে বাঙাল?

আর কইয়েন না খুড়া। মাঝখানে কাশের লগে ছিটা ছিটা রক্ত পড়ছিল। ডাক্তার দেইখ্যাই সিগারেট বন্ধ কইরা দিল। ত্রিশ বচ্ছরের নেশা ছাড়ন কি সোজা? ধুয়া বন্ধ হইতেই কেবল ঘুমে ধরে, মাথা কাম করে না।

ওঃ, বিড়ি সিগারেটে নেশা বড় জব্বর। আমাকেও খুব জ্বালিয়েছে। তা নস্যি কেমন জিনিস বলল

সিগারেটের কাছে লাগে না। কিছুদিন খইনিও খাইছিলাম। জুইত হইল না, বোঝলেন! মেলা ডলাডলি করতে হয়।

দাও দেখি এক টিপ, নিয়ে দেখি।

 লন, লন। দুই একটা হাইচ্চো মারলে মাথা পরিষ্কার হইয়া যাইবো। •

ধীরেন কাষ্ঠ এক টিপ নিল দু আঙুলে চেপে। তার সবই চলে। এই দেহ যে কী চায় সব সময়ে তার দিশা পাওয়া যায় না। সব রকম রসই শরীরকে দিয়ে দেখে ধীরেন। তার সবই সয়। কাটোয়ায় কিছুদিন সাধুসঙ্গ হয়েছিল। তখন গাঁজাও চাপান দিয়েছে। জিনিস খারাপ নয়। শরীর গরম হয়, খিদে বাড়ে, দুনিয়াটাকে ভারী ভাল লাগে। একসময়ে গাঁয়ের বড়লোক ছিল পীতাম্বর। বাপের সুদের কারবার ছিল, দোহাত্তা পয়সা। বাপ লোপাট হওয়ার পর কদিন খুব ফুর্তি লুটেছিল বটে। তখন তার মোসাহেবি করে কয়েকদিন খুব হুইস্কি ব্র্যান্ডি চলেছিল ধীরেনের। কিছু খারাপ লাগত না। সঙ্গে ছোলার চাট থাকত, কঁচা পেঁয়াজ, মাংসের বড়া। সে একটা দিনই গেছে। তবে বেশি দিন নয়। বছর না ঘুরতেই পীতাম্বরের বাবার পয়সা উবে গেল, তখন তার হা-ভাত জো-ভাত। ধীরেন দেখল মদ সে খেয়েছে বটে, কিন্তু নেশায় ধরেনি। মদের উৎস বন্ধ হতেই সে আবার যেমন-ধীরেন তেমন-ধীরেন হয়ে গেল।

গোটা চারেক হাঁচি হল ধীরেনের। মাথায় বেশ একটা ঝাঁকুনি লাগল। আর একেবারে ব্রহ্মরন্ধ পর্যন্ত একটা ঝিলিক তুলে দিয়ে গেল এক টিপ নস্যি।

নাকের জলটা ঝেড়ে নিয়ে ধরা লগায় ধীরেন বলল, বেশ জিনিস বাপু। কখনও পরখ করা হয়নি বটে। বেশ ঝাঁঝ আছে কিন্তু, ওঃ, এক টিপেই একেবারে নাকের জলে চোখের জলে অবস্থা।

ওই প্রথম প্রথম একটু ঝাঁকি দেয়। তারপর দেখবেন ম্যান্দামারা জিনিস। ভুসিমাল। তবু লগে লগে রাখি। তামুকপাতা তো, একটু সাইকোলজিক্যাল এফেক্ট হয় বোঝলেন?

ধীরেন বুঝেছে। মাথা নাড়ল। ভিতরের যন্ত্রপাতি একটু ঝাঁকুনি খেয়েছে। প্রায় আশি বছরের পুরনো কলকবজা, কখন কোনটা বিগড়োয় তার ঠিক কী? মানুষ বেশি বুড়ো হলে প্রাণবায়ু যখন-তখন বেরিয়ে যেতে পারে। এই যে চারটে পেল্লায় হাঁচি হল এর যে-কোনও একটা হাঁচির সঙ্গেও তো বেরিয়ে যেতে পারত। দুঃখকষ্টের জীবন, প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলে একরকম বোধহয় ভালই। তবু কে জানে কেন, ধীরেনের মরতে ইচ্ছে যায় না। জীবনে আর কিছু হওয়ার নেই, জানে। কিছু করার নেই, তাও জানে। কিছু দেখার নেই, উপভোগ করার নেই, সব জানে। তবুমরতে ইচ্ছে যায় না। এ একটা অদ্ভুত ব্যাপারই বটে। আলায়-বালায় অকাজে ঘুরে বেড়ায় সে, কত কী চোখে পড়ে। পোকাটা, মাকড়টা, গাছটা, ফুলটা, পাখিটা, সবই দেখে ধীরেন। বেলা শেষের ঢলানে আলো, কি মাঠের ওপর মেঘের ছায়া, ছেলেদের ফুটবল খেলা সব কিছুই ভারী উপভোগের ব্যাপার তার কাছে। শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ কত রকমই তো সবসময়ে তৈরি হচ্ছে চারধারে। এইসব ছোটখাটো ব্যাপারই আজকাল ভারী গুরুতর হয়ে ওঠে তার কাছে। ঘরে কুলুঙ্গির ওপরে চড়াই পাখি বাসা করছে, তাই দেখতে দেখতে চৌপর দিন কেটে যায় তার। পৃথিবীতে নিঃশব্দে যে কত ঘটনা ঘটে যায় মানুষ তা টেরই পায় না।

কই খুড়া, আপনের জোগাইল্যা তো অখনও আইল না?

বর্ধমান থেকে আসবে তো, তাই দেরি হচ্ছে।

কিছু মনে কইরেন না খুড়া, গ্রামের মাইনষের কিন্তু টাইমের ঠিক নাই। ঘটি মাইনষের গায়েগতরে বড় আইলসামি। হেইর লিগ্যাই তো আমি কইলকাতা থিক্যা মিস্তরি আনতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার বিদ্যাধরী বউ কয়, না পাম্পের কাম খুড়া করব। আমি কই, খুড়া তো বুড়া হইছে, হায়-হয়রানের কাম কি পারব? কিন্তু হ্যায় শোনে না। তা খুড়া, আপনের বয়স কেমন হইল?

এক গাল হেসে ধীরেন বলে, তা বাপু, বয়সের হিসেব কে আর রাখে! তবে আশির কাছাকাছি হবে বলে মনে হয়। মহিমদারই বিরাশি চলছে। আমার চেয়ে ধরো তিন চার বছরের বড়।

বাপ রে! আশি তো মেলা বয়স খুড়া! এই বয়সে অসুইরা খাটনি কি পারবেন?

খুব হাসল ধীরেন, ও বাঙাল, আমি কি ফুলবাবুটি নাকি? খেটেপিটে টনকো শরীর। তবে চোখটাই যা ঝাপসা। ছানি কাটানোর তারিখটাও দিচ্ছে না ব্যাটারা। কবে থেকে নাম লিখিয়ে বসে আছি।

অন্যের লেঙ্গুর ধইরা পইড়া থাকলে তো ওই রকমই হয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরেন বলে, যা বলেছ।

আমার বউ কয়, ধীরেন খুড়া কলকবজা খুব ভাল চিনে। খুড়া হাত লাগাইলেই কল কথা কয়। তা হইলে খুড়া, আপনে তো মেলা পয়সা করতে পারতেন!

মাথা নেড়ে ধীরেন বলে, না হে বাপু, গাঁ-দেশে কলকবজার কাজ কোথায়? এই গাঁয়ে তো ওভারহেড ট্যাঙ্কের বালাই ছিল না। পুকুর আর টিউবওয়েল। ইদানীং চার-পাঁচজন করেছে বটে। আমি বোকা তোক তো, তাই যা পারি শিখেছি। কিন্তু কোনওটাই কাজ দেয়নি। কলকবজা বরাবর খুব ভাল লাগত আমার। ইলেকট্রনিক ব্যাপারটা বুঝতে পারি না বটে, কিন্তু সাবেক যন্ত্রপাতি, কলকবজা খানিকটা চিনি। গাঁ-দেশে ও বিদ্যের কদর নেই।

.

সকাল সাড়ে আটটা বাজে। পড়ার ঘর থেকে মরণ বারবার উঁকি মেরে দেখছিল মিস্তিরিরা এসেছে কিনা। মিস্তিরিরা এলে তার সুবিধে হয়। সবাই হুড়োহুড়ি করে পাম্পসেট নিয়ে পড়বে। গোলে হরিবোল দিয়ে সেও উঠে পড়তে পারবে। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠছে না। মিস্তিরিরা আসতে যে কেন এত দেরি করছে কে জানে! বাবা আর ধীরেনদাদু কখন থেকে উঠোনে বসে কথা কয়ে যাচ্ছে।

ওই দিদি নামছে সিঁড়ি দিয়ে। চোখে এখনও ঘুম। দাদা আর দিদি দুজনেই বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। কালও অনেক রাত অবধি টিভি দেখেছে সবাই মিলে। শুধু মরণকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। মরণের নাকি টিভি দেখতে নেই। মরণের কপালটাই এরকম। বাড়িতে একটা নতুন জিনিস এল, অমনি মরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেল। মরণের অবশ্য দুঃখ নেই। এবাড়ি সে বাড়ি ঘুরে সে ইচ্ছে করলে টিভি দেখতেই পারে। তবে কিনা তার টিভি দেখার বেশি নেশা নেই। তার চেয়ে মাঠঘাট, উধাও আকাশ, পাঁই-পাঁই করে ছুট, তার বেশি ভাল লাগে।

.

নামতে নামতে দিদি একটা হাই তুলল। ঘুম-চোখে চারদিকটা দেখল। ইস্, এখন যদি দিদির মরণের কথা মনে পড়ে তবে বড্ড ভাল হয়। একবার ডাকলেই সে এক লাফে গিয়ে দিদির সঙ্গে জুটে যেতে পারে। তাহলে বাবা আর কিছু বলবে না। মরণ দেখেছে, তার বাঙাল বাবার দিদির ওপরেই একটু বেশি টান। এই যেমন এ-বাড়িতেও বাবা হাম্মিকেই বেশি ভালবাসে, তাকে দুর-ছাই করে।

কিন্তু দিদিও ডাকল না তাকে। কিছুক্ষণ উঠোনে দাঁড়িয়ে চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। গায়ে ফুলহাতা সোয়েটার। তার ওপর গরম চাদর। দিদি বলে, ইস, তোদের এখানে এত ঠান্ডা কেন রে? সবই যেন তোদের বেশি-বেশি।

মরণ খুব হি হি করে হাসে। বলে, তোমার বড্ড শীত, না? তাহলে তুমি শীতকাতুরে আছ।

আহা, আর বীরত্ব দেখাতে হবে না। তুই যে চানের সময় রোজ গাঁইগুই করিস!

 সেটা ঠান্ডা জলের ভয়ে নয় গো। পুকুরে পড়ে কতক্ষণ দাপাই জান না?

তাহলে গাঁইগুঁই করিস কেন?

তোমরা আছে বলে রোজ মা আমাকে সাবান মাখায় যে!

ওমা! আমরা না থাকলে তুই বুঝি সাবান মাখিস না?

না তো! সাবান মাখতে বিচ্ছিরি লাগে।

আর তেল মাখতে লাগে না বুঝি? রোজ তো দেখি চানের আগে কলুর মতো জ্যাবজ্যাবে করে সর্ষের তেল মাখিস! মা গো, সর্ষের তেল যা বিচ্ছিরি জিনিস

মরণের মুখ শুকিয়ে গেল। সর্ষের তেল কি খারাপ জিনিস দিদি?

খারাপই তো! বিচ্ছিরি গন্ধ। সর্ষের তেল মাখলে রংও কালো হয়ে যায়!

মরণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়ে বলে, ঠিক তো! তাই আমি কালো, না দিদি?

পুঁটি টেরছা চোখে তার দিকে একটু চেয়ে বলল, তুই অবশ্য তেমন কালো নোস। সাবান মাখছিস বলে বেঁচে গেছিস। হ্যাঁ রে, তুই তো সাঁতার জানিস!

হ্যাঁ তো।

কী করে শেখে রে?

আমি তো বাবার কাছে শিখেছি। বাবা একদিন ধরে মাঝপুকুরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল। হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে হাত-পা দাপিয়ে কোনওরকমে পাড়ে আসতেই বাবা বলল, এই তো সাঁতার শিখে গেছিস। ব্যস, সেই শিখে গেলাম।

ও বাবা! আমি পারব না। ডুবে যাবো।

গাঁয়ের মেয়েরা কেমন করে শেখে জানো?

কেমন করে?

 বুকে কলসি নিয়ে।

দুর! ওটাও আমি পারব না। বুকে কলসি চেপে জলে নামলে লোকে হাসবে।

সব মেয়েই তো তাই করে।

তোদের গাঁয়ের মেয়েগুলো যা বোকা!

 কেন, আমাদের পান্নাদি আছে।

পুঁটি হেসে ফেলে বলল, আহা, কথা উঠলেই কেবল পান্নাদি! পান্নাদি তোর মাথাটা খেয়েছে। নিয়ে আসিস, দেখবখন তোর পান্নাদিকে।

পান্নাদি কী সুন্দর নাচে, গায়।

জানি তো কেমন নাচ আর গান! রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে নাচে ত! ও সবাই পারে। আর নিশ্চয়ই নাকি সুরে প্যানপ্যান করে গায়!

দিদির ভঙ্গি দেখে ফের হি হি করে হাসল মরণ। বলল, তবে দাদা পুজোর ফাংশনে পান্নাদির গান শুনে বলেছিল, পান্নাদি নাকি ভাল গায়।

নাক সিঁটকে পুঁটি বলে, ও গানের কিছু বোঝে?

বাঃ, দাদা যে গায়! সবাই প্রশংসা করে।

পুঁটি হেসে ফেলে বলে, তবেই হয়েছে। ওই যদি তোদের কাছে ভাল গান হয় তবে পান্নাদি তো এখানকার লতা মঙ্গেশকরই হবে।

হ্যাঁ দিদি, তুমি বুঝি আরও ভাল গাও?

পুঁটি মাথা নেড়ে বলে, না রে, আমি গান জানিই না। তবে শুনতে ভালবাসি। আমার কাছে গাদা গাদা গানের ক্যাসেট আছে।

গাও না কেন?

আমি পারি না।

নাচ জানো?

না তো! ওসব আমার আসেই না।

.

দিদিটা যে একটু পাগলি মতো আছে তা আগেই বুঝে গিয়েছিল মরণ। নাচ-গান না জানলেও দিদি দৌড়ঝাপে ভারী ভাল। দুদিনে গাছে-টাছে উঠতে শুরু করে দিল। এই কুল পাড়ছে, এই পেয়ারা পাড়ছে, কদবেলের গাছেও উঠে গেল একদিন। মরণ ভয়ে মরে।

ও দিদি, পড়ে যাবে যে!

অত সোজা নয়।

 তুমি বেশ ডানপিটে আছ কিন্তু।

সবাই তাই বলে। তুই কি ভাবিস তুই একাই ডানপিটে?

 দিদিটাকে তাই মরণের বড্ড ভাল লেগে গেছে। মাত্র দু-তিন দিনেই সে দিদির খুব কাছ-ঘেঁষা হয়ে গেছে।

খানিকক্ষণ দিদি উঠোনে ঘোরাফেরা করল। কয়েকটা কুকুরছানা এ ওর গায়ে উঠে খেলছিল, সেগুলোকে আদর করল খানিক। তারপর বোধহয় হঠাৎ মরণের কথা মনে পড়ল।

জানালার কাছে এসে বলল, অ্যাই!

মরণ একগাল হেসে বলল, কী দিদি?

এতক্ষণ হা করে জানালার দিকে চেয়ে বসেছিলি কেন রে? তোর পড়া নেই?

হয়ে গেছে তো!

পুঁটি হেসে ফেলে বলে, হয়ে গেছে না হাতি! পড়া ধরলেই তো এখন মুখ শুকিয়ে যাবে।

কোন ভোর থেকে পড়ছি যে!

কেমন পড়ছিস খুব জানি। ওই বুড়োটা কে রে? বাবার সঙ্গে বসে গল্প করছে।

ও হচ্ছে কাষ্ঠদাদু।

কাষ্ঠদাদু! সে আবার কী! কাষ্ঠ মানে তো কাঠ।

 দাদুর পদবি কাষ্ঠ যে!

যাঃ!

সত্যি!

হি হি করে হেসে পুঁটি বলে, তোদের গ্রামটাই ভারী মজার। জন্মে কখনও কাষ্ঠদাদু শুনিনি বাপু। লোকটা কী করে?

কিছু করে না। ঘুরে বেড়ায়।

বাঃ, বেশ তো! শুধু ঘুরে বেড়ায়?

কাষ্ঠদাদুই তো আজ আমাদের পাম্পসেট সারাবে। কাষ্ঠদাদুর লোকেরা আসবে বলে বসে আছে।

তাই বল, মিস্তিরি।

না, কাষ্ঠদাদু মিস্তিরিও নয়।

তাহলে মেশিন সারাবে কী করে?

কাষ্ঠদাদু সব জানে। কিন্তু কিছু করে না।

 পুঁটি হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে বলল, আচ্ছা আমার নাম যদি সুমনা কাষ্ঠ হত তাহলে কেমন হত বল তো!

বিচ্ছিরি।

সাহার চেয়ে ভালই হত। ইন্টারেস্টিং সারনেম। তুই হতি মরণ কাষ্ঠ।

যাঃ!

অনেক পড়ার ভান হয়েছে। এখন বেরিয়ে আয় তো। চল একটু ঘুরে আসি।

এই ডাকটুকুর অপেক্ষাতেই ছিল মরণ। বইখাতা বন্ধ করে দুটো লাফ মেরে বেরিয়ে এল।

 চলো।

কোথায় যাব বল তো! চল আজ তোর পান্নাদিকে দেখে আসি।

 চলো তাহলে।

এই যে দিদিটাকে সে এত ভালবাসে, এটা ঠিক হচ্ছে কিনা এ নিয়ে তার একটা ধন্ধ আছে। জিজিবুড়ি মাঝে মাঝে ঘরের পিছন দিয়ে তার জানালায় উঁকি মারে। সেদিন এসে বলল, ওরে মুখপোড়া, অত গাল ভরে ভরে দাদা দিদি বলে যে ডাকিস, ওরা কি সত্যিই তোর কেউ হয়? জন্মে তোদের মতো আহাম্মক দেখিনি বাপু৷ বলি ওদের সঙ্গে অমন নেই-আঁকড়েপনা করতে আছে? মতলব তো জানিস না!

অবাক হয়ে মরণ বলেছিল, মতলব! কীসের মতলব?

পেটের কথা সব টেনে বের করতে এয়েচে। তুই তো তোর মায়ের মতোই বোকা। কত বোঝালুম বাসন্তীকে, ওলো, সতীনপো, সতীন-ঝিকে নিয়ে অমন মেতে থাকিনা। একটু রাশ টেনে চল। তা কান দিচ্ছে কথায়? জান চুঁইয়ে ওদের খুশি করতে লেগেছে। বলি দুনিয়ার নিয়ম কি তুই উলটে দিতে পারবি রে আহাম্মক। সতীনের ছায়েরা কখনও আপনা হয়? বরং তোর ভালমানুষি দেখে ঘাড়ে চেপে বসবে।

মৃদু প্রতিবাদ করে মরণ বলল, কী বলছ জিজিবুড়ি! দিদিটা তো ভীষণ ভাল।

 ওরে, অমন সেজে থাকে। চোখ দুটো দেখিস, মিটমিটে শয়তানি ঘাপটি মেরে আছে ভিতরে। শুনলুম তো একরাত্তির থেকে চলে যাবে। গেল? আজ তিন দিন গ্যাঁট হয়ে বসে আছে।

মা-ই তো যেতে দেয়নি। বলেছে, এই প্রথম এলে, এখনই যাবে কী? তোমাকে তো ভাল করে দেখলুমই না।

ওই তো, নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে বসে রইল। সাধে কি বলি আহাম্মকের গু তিন জায়গায়? ঘটে বুদ্ধি থাকলে প্রথম থেকেই শক্ত হয়ে কোমর বেঁধে রুখে দাঁড়ালে এবাড়িতে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসতে পারত না।

দাদা দিদিকে খারাপ বলছ কেন জিজিবুড়ি? ওরা তো কিছু করেনি!

তুই তো আর একটা হাঁদা গঙ্গারাম। বুঝবি কী করে? ওপর ওপর ভালমানুষি দেখাচ্ছে, তলায় তলায় কাজ সারছে। এই যে আসা-যাওয়া শুরু হল, এ কি ভাল হচ্ছে? খাল বেয়ে কুমির আসছে বই তো নয়। এই যে ঢুকল এই কিন্তু ঢুকে পড়ল। আর বেরোবে ভেবেছিস? ছুতোয়নাতায় এসে হাজির হবে। এখন তো ছানাপোনা পাঠাচ্ছে, এর পর রাঘব-বোয়ালটাও এসে ঢুকবে, বুঝলি? তোর আহাম্মক মাকে দিয়ে পা টেপাবে, দাসীগিরি করাবে। আর তোরা হবি সব চাকরবাকর।

ভয় খেয়ে মরণ বলে, ধ্যাত, কী যে বল না!

দুর মুখপোড়া, ঘটে বুদ্ধি থাকলে ঠিক বুঝতে পারতিস। বাঙালরা সব বশীকরণ বিদ্যে নিয়েই জন্মায়, বুঝলি! ওসব বিদ্যেধর বিদ্যেধরী, এমন ভাবখানা করবে যেন চোখে হারাচ্ছে। দাঁত নখ সব লুকিয়ে রাখছে এখন, বুঝলি? যখন হালুম করে ঘাড়ে এসে পড়বে তখন তোদের আক্কেল হবে।

মরণ কঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ওরা মোটেই ওরকম নয়। দিদি তো আমাকে কত ভালবাসে!

আহা আবার গাল ভরে দিদি ডাকা হচ্ছে! তা হ্যাঁ রে, তোর কি দিদির অভাব? তা যা না কুসুমদির কাছে, টগরদির কাছে। তারা দেখিস কত ভাল। মামাতো দিদি সব, এক গাঁয়ে মানুষ, মায়ের পেটের দিদির মতোই তো!

এ কথায় মরণ একটু ভয় খায়। তার মামাতো দিদিদের সে খুব চেনে। এমন ঝগড়ুটে যে বলার নয়। লেখাপড়ার বালাই নেই তাদের। দেখা-সাক্ষাৎ হলে বাঁকা বাঁকা কথা শোনায় খুব। তোরা তো বড়লোক। তোর মা তো বাবুর রাখা-মেয়েমানুষ। বাঙালদের পূর্বপুরুষেরা সব রাক্ষস ছিল… এমনি সব কথা।

মরণ টপ করে বলল, না, আমার দিদির দরকার নেই তো! 

আহা, ও কি কথা! দরকার আবার কারও হয় নাকি?

 কুসুমদি, টগরদির সঙ্গে মিশতে মা বারণ করেছে।

ওই তো ওর দোষ। আপনার জন ছেড়ে শত্তুরের ভজনা করতে লেগেছে। বলি কী, ওই শ্যাওড়াগাছের পেত্নীটাকে একবার ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আয় না মামাবাড়িতে। টগর আর কুসুমের মুখে ফেলে দে। দেখবি বিষ একেবারে ঝেড়ে দেবে। গাঁ ছেড়ে পালানোর পথ পাবে না। তোদের ভালর জন্যই বলছি। নিজেরা না পারিস, আমরা সব আপনজনেরা তো আছি, দে না আমাদের হাতে ছেড়ে।

জিজিবুড়ি, বাবা যদি জানতে পারে, তুমি এসব কথা বলেছ, তাহলে কিন্তু কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।

ওই দেখ, কী এমন খারাপ কথা বললুম বল তো! তোদের ভালর জন্যই তো বলা, নাকি! বাঙালের কানে কথাটা তুলবি কেন রে বোকা? সেই তো নষ্টের গোড়া। তোদের আর এজন্মে আক্কেল হবে না।

দিদি মোটেই শ্যাওড়াগাছের পেত্নী নয়।

আহা, তবে কি রম্ভা মেনকা নাকি? হাড়গিলে চেহারা, কেলে কুষ্টি, গেছো মেয়েছেলে। এই তো শুনলুম বেলগাছে উঠে নাকি বেল পাড়ছিল। শুনেছিস কখনও মেয়েছেলে বেলগাছে ওঠে? ও হল বামুন গাছ। যে মেয়েছেলে বেলগাছে ওঠে সে হল ডাকিনী-যোগিনী। বুঝলি? কালও তো সন্ধেবেলায় দেখলুম, এলোচুলে ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্ধেবেলা এলোচুলে কারা ঘুরে বেড়ায় জানিস? ডাইনিরা। কোন মন্তরে তোকে বশ করেছে কে জানে। এর পর কোনওদিন দেখব, ভেড়া হয়ে পাছু পাছু ঘুরে বেড়াচ্ছিস।

চোখ ফেটে জল আসছিল মরণের। দিদিটাকে সে সত্যিই খুব ভালবাসে। সে বলল, এখন তুমি যাও জিজিবুড়ি।

যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। মেয়েটাকে বাঙালের ঘরে দিয়ে যে কী পাপই করেছি বাবা, দিনরাত বুকটা ধড়াস ধড়াস করে। বিয়ের ভড়ং করে মেয়েটার মাথা চিবিয়ে খেল। বোকা মেয়ে বুঝতেও পারছে না, দোরগোড়ায় সর্বনাশ এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখন শক্ত না হলে কি জোতজমি, বিষয়-আশয় কিছু থাকবে? সব ফক্কা হয়ে যাবে একদিন দেখিস। তখন বাবা, আমে-দুধে মিশে যাবে আর তোরা আঁটি চুষবি। আমি হলে কবে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করতুম। হরেন কাঁপালিককে ধরেছি, এখন দেখি সে কী করে। তোর মায়ের বটুয়া থেকে পঁচিশটা টাকা সরিয়ে এনে চুপটি করে আমাকে দিবি ভাই?

টাকা! টাকা দেব কেন?

হরেন চেয়েছে।

শঙ্কিত মরণ জিজ্ঞেস করে, হরেন ঠাকুর কী করবে জিজিবুড়ি?

জিজিবুড়ি ঝেঁঝে উঠে বলল, ওই আঁটকুড়ির ব্যাটার কি আর সাধন-ভজন আছে, নাকি ভক্তি আছে! দিনরাত দিশি মদ চাপান দিয়ে পড়ে থাকে, গাঁজা, চরস, গুলি কোন গুণটা নেই? তার কি আর বাণ-বশীকরণের তেমন ক্ষ্যামতা আছে? তবু জোর ধরে পড়েছি, যদি লেগে যায়। পঁচিশ টাকায় কি আর রাজি হয়! তার খাই অনেক। তবু ঘাড় কাত তো করেছে। এখন দেখা যাক। কাজ না হলে আমিও তো সোজা পাত্রী নই, ঝেড়ে কাপড় পরাব। যা দাদা, টক করে নিয়ে আয়।

ও আমি পারব না জিজিবুড়ি।

ওরে তোদের ভালর জন্যই তো করছি।

বাণ মারা বুঝি ভাল?

যেমন কুকুর তার তেমন মুগুর তো চাই রে ভাই। ওরা কি সোজা ত্যাঁদড়?

না, জিজিবুড়ি, আমি টাকা আনতে পারব না।

তোদের কপালে কী লেখা আছে জানিস? তোবড়ানো বাটি হাতে নিয়ে দোরে দোরে ঘুরে ভিক্ষে করবি। নিজের ভাল যে বোঝে না তাকে কে বোঝাবে বাবা?

তুমি যে হরেন ঠাকুরকে বাণ মারতে বলেছ, তা বাবাকে বলে দেব।

দুর হ গু-খেগোর ব্যাটা। ছিঃ দাদা, ওসব কি বলতে আছে? আচ্ছা না হয় থাকগে। বলিসনি যেন।

.

৪৯.

লম্বা বাঁশের ডগায় পায়রার মাচান। বাঁশটাকে চিরে তাতে আটকানো হয়েছে কঞ্চির চৌখুপি। পায়রারা এমনই উঁচু জায়গায় বসতে ভালবাসে। দুদিন ধরে খেটেখুটে পায়রাদের বসবার জন্য জিনিসটা বানিয়েছে সুদর্শন। তাদের বাড়িতে নাকি ছিল। একটু মাথা-পাগলা আছে বটে লোকটা। কাক, কুকুর, বেড়াল, পায়রা, চড়াইপাখি সবার ওপর খুব দরদ। এসেছে তো মাত্র কয়েকদিন, এর মধ্যেই বাড়ির আর পাড়ার রাজ্যের বেড়াল-কুকুর তার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে, রান্নাঘরের সামনে উঠোনে এসে বসে থাকে খাপ পেতে। সুদর্শন তাদের রুটি, বিস্কুট, মুড়ি, চালভাজা যা হোক খাওয়ায়। নিজের বরাদ্দের খাবার থেকেই দেয় বেশির ভাগ।

মা রাগ করে বলে, এ তোমার বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে বাপু। নিজের ভাতটুকুর আধা-আধিই তো দেখছি রোজ কাক-কুকুরকে খাওয়াচ্ছ! বলি অত লাই দেওয়া কি ভাল। লোভ দেখালে রাজ্যের নেড়ি কুকুর এসে আড্ডা গাড়বে।

তা মা, ভূতভুজ্যি বলেও তো একটা জিনিস আছে।

 জন্মে শুনিনি বাপু।

চারদিকে উপোসি আত্মা থাকা কি ভাল মা? দিয়ে-থুয়ে খেতে হয়। আজকাল বাবুদের বাড়িতে দানধ্যান উঠে যাচ্ছে, ভূতভুজি নেই, ব্রাহ্মণভোজন নেই, কাঙালিরা একমুঠো ভাত পায় না, ভিখিরিকে ভিক্ষে দেয় না।

মা গজ গজ করে। তার কারণও আছে। এ বাড়িতে দানধ্যানের পাট নেই তেমন। ভিখিরিরা গাঁয়ের বা আশেপাশের মানুষ, তারা বাড়ি চেনে। এবাড়িমুখো বড় একটা হয় না। মা একটু আছে ওইরকম। ব্যাপারটা ভাল না মন্দ তা পান্না কখনও ভেবে দেখেনি। জন্ম থেকেই দেখে আসছে, তারও ওরকমই অভ্যেস হয়ে গেছে, কিন্তু এখন এই উটকো লোকটা এসে কিছু গণ্ডগোল পাকিয়ে তুলেছে। কথাগুলো একটু ক্যাটক্যাটে বটে, কিন্তু বেশ উচিত কথা বলেই পান্নার মনে হয়।

মার ভয় ছিল, লোকটা হয়তো বেশি খাবে। রোগাপানা লোকেরাই নাকি বেশি খায়। কিন্তু দেখা গেল, খাওয়ার চেয়ে খাওয়ানোতেই সুদর্শনের আনন্দ বেশি। তার পাতের ভাত অধিকাংশই যায় কুকুর বেড়ালের পেটে।

রান্নাটা খারাপ করে না। আহামরি না হলেও খাওয়া যায়। একটু দুখে রান্না। তেল-মশলা হাত টেনে দেয়। সেটা এ-বাড়ির হিসেবি মানুষদের পছন্দই।

একদিন মাকে বলল, হ্যাঁ মা, আমরা বীরভূমের লোক, খুব পোস্ত হয় ওদিকে। তা বর্ধমানের লোকে কি পোস্ত খায় না?

মা মুখটা গোঁজ করে বলল, তা খাবে না কেন? আগে খুব হত। এখন পোস্তর যা দাম।

সুদর্শন এক গাল হেসে বলে, কাঁড়ি পোস্ত তো লাগে না। একটু হলেই হয়। রাইসর্ষে মিশিয়ে দিলে দিব্যি পোস্তর মতোই লাগবে খন।

না বাপু, সর্ষেবাটা পেটের পক্ষে ভাল নয়। ও যা হচ্ছে তাই হোক। শীতকালে তো সবজির অভাব নেই। মাছও তো হচ্ছে। পোস্ত না হয় গ্রীষ্মে বর্ষায় করা যাবে।

সুদর্শন বেশ মুখের ওপরেই বলে দিল, আপনারা একটু হিসেবি মানুষ, না?

সুদর্শন আলাপি মানুষ। দু-চারদিনের মধ্যেই দেখা গেল পাড়ার লোকের সঙ্গে দিব্যি ভাবসাব জমে গেছে তার। দুপুরের দিকে খাওয়ার পর পশ্চিমের ঘরের নির্জন বারান্দায় আশপাশের কয়েকজনা আসে বেশ। কথাটথা কয়।

মা বলে, ও সুদর্শন, বলি অত আড্ডা কীসের? এবাড়ি ও-বাড়ি কথা চালাচালি কিন্তু ভাল নয় বাপু।

ধর্মের কথা কি খারাপ কিছু মা?

কী জানি বাপু কী কথা। অত কথায় কাজ কী?

 কথা নইলে কি কাজ হয় মা? মানুষের কথাই তো সম্বল।

সুদর্শনকে নানা কারণেই পছন্দ হচ্ছে না মায়ের। ঠিক যেন মাইনে করা কাজের লোকের মতো নয়। একটু ব্যক্তিত্ব আছে, নিজের মতামত আছে, যা-তা বললেই মেনে নেয় না। আবার ঝগড়াও করে না। আসল কথা লোকটা একটু জানেশোনে, একটু যাকে বলে আপারহ্যান্ডও নেয়। ওইটে মায়ের সহ্য হচ্ছে না।

কিন্তু এই ক্ষ্যাপাটে গোছের লোকটাকে পান্নার ভারী পছন্দ। ধারেকাছে এরকম একটা লোক থাকলে মাঝে মাঝে নিজেদের একটু দীন লাগে বটে, কিন্তু ভালও লাগে। একদিন মা একটু বড়মার কাছে বেড়াতে গিয়েছিল। তখন চুপ করে সুদর্শন একজন ভিখিরিকে পাছদুয়ারের কাছে বসিয়ে ভাত দিয়েছিল চাট্টি। পান্না দেখে ফেলেছিল।

ও সুদর্শনদা, ওকে কার ভাগের ভাত দিলে? তোমার ভাগের নাকি? নিজের ভাগটুকু অতজনকে দিলে তুমি যে উপোস করে মরবে!

সুদর্শন এক গাল হেসে বলল, না দিদি, নিজের ভাগেরটা দিইনি। দুজন মুনিশ আজ কাজে আসেনি। তাদেরটাই দিচ্ছি। ভাল করিনি?

পান্না একটু হেসে বলল, ভালই তো। কিন্তু বকুনি খেও না যেন!

সুদর্শনের শাস্ত্রজ্ঞান আছে। রামায়ণ-মহাভারত ভাল পড়া। কে কার মা, কে কার বাপ, কে কার ছেলে এসব তার ভুল হয় না কখনও। সে এ-বাড়িতে আসার পর এ-পাড়ায় একটা রটনা হয়েছে, সুদর্শন লোকটা সাধারণ মানুষ নয়। ওর ভিতরে বিভূতি-টিভূতি কিছু আছে।

কথাটা বলতে এসে একদিন পাড়ার পালগিন্নি মায়ের কাছে খুব ঠোনা খেল। মা বলল, তোমাদের যত অলক্ষুণে কথা। বলি যার বিভূতি থাকে তার কি পেটের রোগ হয়? নাকি পরের বাড়িতে গতর খাটিয়ে খায়?

পালগিন্নি মিনমিন করে বলল, ওঁরা অমন সেজে থাকেন কিনা!

তোমার মুন্ডু। দু-চার পাতা বই পড়েনি তা বলছি না। তা বলে বিদ্যেসাগরও তো নয়। টক করে গাছে তুলে দাও ওই তোমাদের দোষ।

পাড়াটা এখন ফাঁকা। পারুলদি তার নতুন এসি গাড়ি করে চলে গেল জামশেদপুর। সোহাগ আর তার মা ফিরে গেছে কলকাতায়। পান্নার এখন পড়াশুনোর চাপ। হায়ার সেকেন্ডারির সিলেবাস তো কম না। স্কুলেও যেতে হচ্ছে।

সকালবেলায় লেপমুড়ি দিয়ে বিছানায় বসেই পড়ছিল পান্না। এত ভোরে লেপের ওম ছেড়ে উঠতে ইচ্ছেও হয় না। চোখেমুখে জল দেওয়া হয়নি, বাথরুমে যাওয়া হয়নি, দাঁত মাজা হয়নি। আজ একটা ক্লাস পরীক্ষা আছে ইংরিজির। এই একটা বিষয়েই সে বেশি নম্বর পায়। গত মাসে চিরশ্রী তাকে টপকে গিয়েছিল। এবার চিরশ্রীকে টপকানোর জন্য সে প্রাণপণ করছে। পাশেই শুয়ে ঘুমোচ্ছে হীরা। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। মা ওকে কিছু বলে না। পান্না জানে এ-বাড়িতে তারই আদর সবচেয়ে কম। সে বেলা পর্যন্ত ঘুমোলে মা কটকট করে কত কথা শোনাত!

আলো আসার জন্য সুমুখের জানালাটা অল্প ফাঁক করে রেখেছিল সে। ওই ফঁকটুকু দিয়ে একটু আগে ডালে লঙ্কা ফোড়নের গন্ধ পেয়েছে সে। সেই ফঁকটুকু দিয়েই হঠাৎ চোখ তুলে সে দেখতে পেল, তাদের রান্নাঘরের দাওয়ায় উসকো-খুসকো চুল, খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা একটা লোক বসে আছে। এখনও রোদ ওঠেনি বলে উঠোনের কমজোরি আলোয় মুখখানা চিনতে পারল না পান্না। এত সকালে কে এল রে বাবা? তাও রান্নাঘরের দাওয়ায় বসা! পাগল-টাগল ঢুকে পড়ল নাকি? পাগলকে তার ভীষণ ভয়।

জানালাটা একটু ফাঁক করে পান্না চেঁচিয়ে ডাকল, সুদর্শনদা! ও সুদর্শনদা! দেখ তো কে এসেছে।

কেউ সাড়া দিল না। লোকটা যেমনকে তেমন বসে রয়েছে।

 হীরা বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে বলল, সকালবেলাতে অমন করে চেঁচাচ্ছিস কেন? ঘুমটা ভেঙে গেল।

 চেঁচাব না! কে একটা উটকো লোক ঢুকে পড়েছে বাড়িতে।

 কে আবার ঢুকবে! ভিখিরি-টিকিরি হবে বোধহয়। সুদর্শনদার তো অনেক পুষ্যি।

 মনে হচ্ছে পাগল।

যাঃ!

হ্যাঁ রে, কেমন যেন চেহারা।

 হীরা আবার ঘুমোল।

পান্নার পড়া মাথায় উঠল। সে লেপ ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে চমকে উঠল। অমলদা না! এত সকালে অমলদা এসে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে আছে কেন? এ মা! ছিঃ ছিঃ! কত বড় মানুষ!

গরম চাদরটা টেনে গায়ে জড়িয়ে চটি পায়ে গলিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল পান্না।

অমলদা! আপনি দাওয়ায় বসে আছেন কেন?

অমল তার দিকে তাকাল। সে তাকানোর মধ্যে কোনও স্মৃতি নেই। ভ্যাবলা চোখ। তাকে চিনতে পারছে না।

অবাক হয়ে অমল বলল, তুমি কে বলো তো!

ও মা! আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি পান্না। রামহরি চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে।

অমল চারদিকে চেয়ে যেন সংবিৎ ফিরে পেল। ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলল, এটা তোদের বাড়ি বুঝি!

হ্যাঁ তো! আপনি চিনতে পারেননি?

অমল একটু হেসে বলল, আসলে আমি পথ-টথগুলো কেমন গুলিয়ে ফেলেছিলাম।

 পথ গুলিয়ে ফেলেছিলেন! সে কী!

অমল একটু লজ্জা পেয়ে হেসে বলল, আজকাল খুব অন্যমনস্ক থাকি তো। খুব ভোরে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পথ-টথ সব এলোমেলো হয়ে গেল। তারপর একটা লোক ডেকে এনে এখানে বসাল। বলল, চা খাওয়াবে।

লোকটা কে বলুন তো?

ঠোঁট উলটে অমল বলল, চিনি না। ঢ্যাঙা, রোগামতো। বলল, বাবু, আমি আপনাকে চিনি। আপনি অনেক লেখাপড়া জানেন বলে শুনেছি, আজ আপনার কাছে কয়েকটা কথা শুনব। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা আমার খুব ভাল লাগে। এই বলে নিয়ে এল।

পান্না হেসে ফেলে বলল, ও তো সুদর্শনদা, আমাদের রাঁধুনি।

তাই হবে। লোকটা খুব বকবক করে, তাই না?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে বসিয়ে রেখে সে গেল কোথায়?

বলল, গিন্নিমা এখনও ওঠেননি বাবু, দাঁড়ান, দোকান থেকে আপনার জন্য ভাল বিস্কুট নিয়ে আসি।

আপনি উঠুন তো, বৈঠকখানায় এসে বসুন। আমি চা করে দিচ্ছি।

 অমল লজ্জা পেয়ে বলে, তুই দিবি।

হ্যাঁ, আসুন। ইস, আমার যে কী ভীষণ লজ্জা করছে! আপনি দাওয়ায় বসে আছেন! ছিঃ ছিঃ!

তাতে কী হয়েছে। তোদের বাড়ির দাওয়ায় বসলে কি আমার মান যায়? এ-গাঁয়ের ধুলো মেখে বড় হয়েছি। হ্যাঁ রে, রামহরিকাকা, কাকিমা সব ভাল তো?

হ্যাঁ।

কতকাল দেখাসাক্ষাৎ নেই। তোর সঙ্গে সোহাগের খুব ভাব, তাই না?

 হ্যাঁ। সোহাগ খুব ভাল মেয়ে।

ভারী আনমনা হয়ে খানিকক্ষণ ভ্যাবলা চোখে চেয়ে থেকে অমল বলল, সবাই ভাল। কিন্তু আমার সঙ্গেই কারও বনল না।

অমল উঠল। বৈঠকখানায় এসে বসল।

 আপনি ভীষণ রোগা হয়ে গেছেন অমলদা!

 বয়স হচ্ছে। এখন ফ্যাট ঝরে গেলেই তো ভাল।

এই শীতে শুধু একটা সোয়েটার পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! শীত লাগে না আপনার! আমি তো সকালে লেপ ছেড়ে উঠতেই পারি না।

হাঁটলে গা গরম হয়ে যায় তো, তাই আর চাদর-টাদর নিইনি।

বসুন, আমি চা করে আনছি।  

রান্নাঘরে এসে পান্না দেখল, সুদর্শন ঠোঙায় বিস্কুট এনে চায়ের জল চাপিয়েছে।

সুদর্শনদা! তুমি কী লোক বলো তো! কাকে এনে দাওয়ায় বসিয়ে রেখেছিলে জানো?

সুদর্শন এক গাল হেসে বলে, তা জানি দিদি। সবাই বাবুকে জানে। মাথা-পাগলা আছেন বটে, কিন্তু পেটে মেলা বিদ্যে। তাই তো রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এলুম। বেভুল ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।

তোমার আক্কেল যে কবে হবে। বৈঠকখানায় তো বসাতে পারতে! অত বড় মান্যিগন্যি লোককে কি দাওয়ায় বসায়? আমার ঘরের বারান্দায় চেয়ারও তো ছিল?

কী জানি দিদি, ওসব করতে গেলে গিন্নিমা যদি চটে যায়। তাই সাহস করিনি। চা খাওয়াতেও দোনোমোনো করছিলাম। হিসেবের বাড়ি তো!

চিমটিকাটা কথা। তবে গায়ে মাখল না পান্না। বলল, একটা প্লেট দাও, বিস্কুটটা সাজিয়ে নিয়ে যাই।

সুদর্শন একটু দুঃখ করে বলল, ঘরে নিয়ে বসালে দিদি, তা হলে আর বাবুর সঙ্গে কথাটথা হল না। আজকে। দাওয়ায় বসলে দিব্যি কথা হত দুজনে। নাগালের বাইরে নিয়ে ফেললে তো।

থামো তো! উনি হেঁজিপেঁজি লোক নাকি?

ওই তো হয়েছে মুশকিল। এসব লোককে হাতের নাগালে পাওয়া চাঁদ পাওয়ার শামিল। আজ জুতমতো পেয়েছিলুম দিদি, দিলে তুমি সব ভণ্ডুল করে।

তোমার কী কথা বলো তো অমলদার সঙ্গে।

সুদর্শন একটু লজ্জার হাসি হেসে বলে, এই নানা রকম কথাই তো মনে আসে। দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করে নিতুম আর কী। এই ধরো নমঃশূদ্রের মেয়ের সঙ্গে পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়ের ছেলের বিয়ে হলে সেটা অনুলোম না প্রতিলোম হচ্ছে। তারপর ধরো বলরামের মা বাবার একটু গোলমেলে বিয়ে ছিল, তা হলে বলরামের বর্ণটা আসলে কী হবে। তারপর ধরো…

দুর! তোমার যত আজগুবি কথা। ওসব কি অমলদা জানে নাকি? অমলদা বিলেত আমেরিকায় ছিল, সাহেব মানুষ, সায়েন্টিস্ট। ওসব জাতপাতের খবর রাখার কথাই নয় তার।

কিন্তু দিদি, এও তো সায়েন্স।

তোমার মুণ্ডু। এবার চা-টা ভাল করে বানাও। গুচ্ছের চিনি দিও না যেন, আর লিকার বেশি ঘন করবে না। পাতলামতো হবে।

অ্যাঁ। বলে অবাক হয়ে সুদর্শন কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলে, ওই কি তোমাদের ভাল চা?

হ্যাঁ তো!

আমরা তো ভাল চা বলতে বুঝি কড়া লিকার, কড়া মিষ্টি, ঘন দুধের গন্ধ।

 সে হল গরিবদের চা। বড় মানুষরা কি ওরকম চা খায়?

 তুমি তো বলেই খালাস। ওদিকে বাবু কী বলেছে জানো?

কী?

 যখন চা খাওয়াবো বলে ধরে আনছিলাম তখন বাবু নিজে থেকেই বলল পানসে চা খেতে পারি না বাপু, চা হবে কড়া লিকার আর খুব মিষ্টি। ওপরে সরের টুকরো ভাসবে। আর মুড়ি ছড়িয়ে দিয়ে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে খাবো।

বলল ও কথা?

হ্যাঁ গো।

 তবে তাই করো। কী জানি বাবা, অমলদার হয়তো অন্য রকম রুচি।

পান্না ফিরে এসে দেখল, অমল সোফায় বসে ঘাড় কাত করে ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর ঘুম। চোখের কোলে কালি পড়েছে লোকটার। গালের হনু দুটো উঁচু। কী মলিন বেশবাস। এ লোক যে ওরকম সাংঘাতিক স্কলার ছিল কে বলবে এখন দেখে? বয়সও তো খুব বেশি নয়। চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে বোধহয়। কিন্তু এর মধ্যেই যেন কেমন শরীরে যৌবনের টান চলে গেছে, জবুথবু ভাব।

পাশের ঘরে মায়ের ঘুম ভেঙেছে।

ও ঘরে কে রে?

 আমি মা!

ও ঘরে কী করছিস?

পান্না দরজার কাছে গিয়ে চাপা গলায় বলল, অমলদা এসেছে।

 অমলদা আবার কে?

আহা, অমলদাকে চেনো না?

মহিম ভাসুরঠাকুরের ছেলে?

হ্যাঁ।

ও মা! এত সকালে কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে নাকি?

না, না, কিছু হয়নি। এমনি এসেছে।

এত সকালে!

চা খেয়ে চলে যাবে।

বউয়ের সঙ্গে কী যেন গোলমাল শুনছিলুম।

আস্তে মা। শুনতে পাবে।

দরজাটা আবজে দে না। কাছে আয়।

 দরজাটা সাবধানে ভেজিয়ে আধো-অন্ধকার ঘরে ঢুকল পান্না। মশারির ভিতর থেকে মা বলল, মাথাটা নাকি একটু খারাপ হয়েছে?

না তো! গাঁয়ের লোকে একটা ছুতো পেলেই রটায়।

তা নয় বাপু। অনেক টাকার চাকরিটাও নাকি ছেড়ে দিয়েছে। গাঁয়ে এসে থানা গেড়ে বসে আছে। এ তো ভাল লক্ষণ নয়। লোকে পুরনো কথা তুলছে।

কী কথা?

ওই যে পারুলকে নিয়ে। পারুলের জন্যেই নাকি পাগল। ওর বউ নাকি সন্দেহ করে এখনও দুজনের সম্পর্ক আছে।

বাজে কথা। পারুলদি কি সেরকম মেয়ে?

কে জানে বাবা কী। তোর অত সাউকারি করতে হবে না। সংসারের মারপ্যাঁচ বোঝার মতো বুদ্ধি কি তোর হয়েছে? নাপতেবুড়ি বলে গেল, পারুলের যে ছেলে হবে তার পিছনে নাকি ওই অমল।

ছিঃ মা, ওসব মনে করাও পাপ।

 তা বাপু, বললেই দোষ? কীর্তিটা কি দোষের নয়?

 কী করে ভাবলে বলো তো!

ভাবতে আমার বয়েই গেছে। ও আবর্জনা না ঘাঁটাই ভাল। লোকের মুখ তো তা বলে বন্ধ থাকছে না। ওসব লোককে বাড়িতে বেশি ঢুকতে দিতে নেই।

তুমি বড্ড সেকেলে মা। কিছু বোঝো না। কেবল কানে শুনে সব বিশ্বাস করো। পারুলদি কি তেমন মেয়ে বলে তোমার মনে হয়?

সকালবেলাটায় আর মুখ নাড়তে হবে না। ঠাকুর দেবতার নাম এখনও উচ্চারণ করিনি। তোর বাবা এসময়ে গেল কোথায়?

বাবা তো রোজ সকালে মর্নিং ওয়াক করতে বেরোয়।

মর্নিং ওয়াক না ছাই। চাষের মাঠে গিয়ে বসে আছে দেখ গে। খেজুর রস সাঁটছে। কিন্তু এখন অমলের সঙ্গে কথা বলে কে?

আমিই বলছি। সুদর্শনদা চা করছে।

বেশি গলাগলির দরকার নেই। ও মানুষ কিন্তু ভাল নয়। চরিত্রের দোষ আছে।

পান্না একটু রাগ করেই এ-ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। অমল এখনও নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। মাথাটা আরও ঝুলে পড়েছে বাঁ ধারে।

সুদর্শন চা নিয়ে আসার পর পান্না ডাকল।

 অমল ঘুম ভেঙে ভারী লজ্জিত হয়ে বলল, ইস, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

আপনি খুব টায়ার্ড, না?

হ্যাঁ। খুব টায়ার্ড। রাতে ঘুম হয় না তো। সেই রাত দুটোয় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি।

রাত দুটো!

হ্যাঁ। ঘুম না এলে ঘরে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।

বেরিয়ে কোথায় যান?

কোনও ঠিক থাকে না। বেরিয়ে পড়ি।

কলকাতায় যাবেন না?

যেতে ভয় হয়।

ভয় কেন অমলদা?

 কলকাতাকে ভয় পাই না। ওদের পাই।

কাদের ভয় পান অমলদা?

অমল একটু হেসে বলল, সবাইকে ভয় পাই রে। আমার আত্মবিশ্বাস বড্ড কমে গেছে।

 সোহাগ কিন্তু আপনাকে খুব ভালবাসে।

হুঁ।

সোহাগ বলছিল, ওর মন খুব খারাপ।

কেন?

 আপনার আর বউদির নাকি সেপারেশন হয়ে যাচ্ছে?

অমল চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ স্থির হয়ে। তারপর বলল, তোরাও শুনেছিস বুঝি?

হ্যাঁ। সেইজন্যই তো আপনি

 কথাটা শেষ করল না পান্না। আসলে এতটাও তার বলার কথা নয়। তার হঠাৎ মনে হল সে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

অমলের অবশ্য তেমন ভাবান্তর হল না।

মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, মনটা ভাল নেই রে। আমার যে কী হয়েছে তা বুঝতে পারি না। পাগল হয়ে যাচ্ছি কি না কে জানে। গেলে একরকম ভালই। পাগলের তো স্মৃতি থাকে না। মাথার মধ্যে সব উলটোপালটা হয়ে যায়।

কেন পাগল হবেন অমলদা? ওসব ভাববেন না। কলকাতায় ফিরে যান। সব ঠিক হয়ে যাবে।

অমল ভারী সরল চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, বলছিস?

 হ্যাঁ।

যাব?

হ্যাঁ অমলদা, প্লিজ।

অমল মাথা নেড়ে বলল, বেশ, তুই যখন বললি যাব। অনেক সময়ে ভগবান ছোট ছোট মানুষের ভিতর দিয়ে কথা বলে ওঠেন, জানিস?

.

৫০.

মায়া-দরজায় অকস্মাৎ মৃদু করাঘাত, শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি নন্দিন। কী চাও এই অসময়ে?

 অসময় কেন হবে? শুনতে পাই তুমি চিরজাগ্রত, চির তৎপর। তোমার কি বিশ্রামের প্রয়োজন হয়?

না নন্দিন। আমার সময় নেই। এখন বিরক্ত কোরো না।

আমি এলে বুঝি তোমার সময় নষ্ট হয়? এই আমি বসে রইলুম তোমার দোরগোড়ায়। এখানে বসে আমি বারবার তোমার দরজায় করাঘাত করব। চেঁচিয়ে গান গাইব, আপন মনে কথা কইব, যতক্ষণ তুমি দরজা না খোলো।

তোমার বুঝি কাজ নেই। কিন্তু আমার যে অনেক কাজ। মাটির অতল থেকে উঠে আসছে সোনা, থরে বিথরে সেসব আমি সাজিয়ে তুলছি। এই বিপুল সম্পদের দায় তো কম নয়! এখন কি আমার অকাজের কথা বলার অবকাশ আছে? তোমার রঞ্জন আসছে, সে তোমার অবকাশ ভরিয়ে দেবে। আমাকে কাজ করতে দাও।

শোনো রাজা, আমার রঞ্জন আসবে বলে কি তোমার হিংসে হয়?

না নন্দিন। আমার তুচ্ছ কোনও হৃদয়দৌর্বল্য নেই। আমি কাজের লোক।

আজ তোমাকে একটা কথা বলব।

আজ নয়। অন্য দিন এসো।

আজ না বললে যদি আর বলার সময় না হয়?

 তা হলে বাইরে থেকে বলো, আমি শুনছি।

 আমার রঞ্জন আসবে, তবু আমি বারবার তোমার কাছে কেন ছুটে আসি তা বুঝতে পারো না রাজা?

বুঝবার দরকার কী নন্দিন? বাইরে দখিনা বাতাস বয়ে যায়, পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, ফুলের গন্ধে বাতাস মাতাল হয়, আমি সব টের পাই, কিন্তু আমার যে আনমনা হতে নেই।

শুধু কাজ? শুধু সঞ্চয়? শুধু সোনার গারদে আত্মনির্বাসন?

রাষ্ট্রযন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি হল তার সম্পদ। বস্তুগত সম্পদ হল পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুতর বিষয়। তুমি কি ভুলে যাও নন্দিন, যে আমি দেশের রাজা? অনেক কিছু থেকে মনকে প্রত্যাহার করে নিই আমি।

আগে বলো, রঞ্জনকে তোমার হিংসে হয় না? একটুও না?

হয়তো হয়। আমার হৃদয়বৃত্তি এতই সামান্য যে ঠিক বুঝতে পারি না।

আমি কতবার মালা গেঁথে এনেছি, তুমি পরোনি। শুধু বলেছ, নিজে পরো। আমার মালা ফিরিয়ে দাও তুমি, তবু আমি তোমার কাছে ছুটে ছুটে আসি। মনে আছে তোমার? একদিন তুমি বলেছিলে, আমার সবটুকু দিয়ে যদি তোমাকে ধরতে চাই, ধরা দেবে কি নন্দিন? বলোনি?

বলেছি।

তুমি কি জানো সেই কথা শুনে আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়েছিল? মন নেচে উঠেছিল তিতিরের মতো। সেদিন সারা বেলা আমি যেন মেঘ হয়ে আকাশে ভেসে বেড়ালুম। কিন্তু জানি, ও তোমার মনের কথা নয়।

হয়তো তখনকার মতো ও আমার মনের কথাই ছিল!

ছিল? সত্যি বলো, ছিল?

বললে তুমি খুশি হবে?

হব না! বলো কী? আমার আধখানা মন যে সবসময়ে তোমার কাছে পড়ে থাকে। বলে দেখ, আমি ফের মেঘের মতো ভেসে বেড়াব।

কথাটা তখন সত্য ছিল। কিন্তু এখন যদি সত্য না থেকে থাকে?

সত্য কি বদলে যায়?

 যায় নন্দিন। সংসারে সব সত্যই তো আপেক্ষিক, শর্তনির্ভর। এমনকী প্রেম ভালবাসা এসবও।

ওরকম বোলো না তো। ওরকম নিষ্ঠুর কেন তুমি? ভাল করে নিজের মনের ভিতরে খুঁজে দেখ, কথাটা সত্যিই মিথ্যে ছিল কিনা।

আমার যে সময় নেই নন্দিন। আমার অনেক কাজ। ধ্বজাপুজোর সময় এগিয়ে আসছে।

আমি তো তোমার কাছে দিনে শতেকবার ছুটে আসি একটু কথা কইবার জন্যই। একটু মায়া হয় না তোমার?

মায়া হয় নন্দিন। এ রাজ্যে একমাত্র তুমিই আমাকে একটু দুর্বল করে ফেলেছ। কিন্তু এই দুর্বলতা আমাকে ঝেড়ে ফেলতেই হবে। তুমি যাও নন্দিন।

কথাটা আর একবার বলো।

কোন কথাটা?

ওই যে বললে এ রাজ্যে একমাত্র আমিই তোমাকে দুর্বল করে ফেলেছি। সত্যি? বলো না!

হ্যাঁ নন্দিন। আমি জানি এ-রাজ্যের কোনও মানুষই আমাকে দু চোখে দেখতে পারে না। শ্রমিকরা আমাকে ঘৃণা করে, প্রজারা আমার মুণ্ডপাত করে। কেউ আমার সঙ্গে কথা কইবার স্পর্ধা অবধি দেখায় না। একমাত্র তোমারই কোনও ভয় নেই, সংকোচ নেই, কুণ্ঠা নেই।

কেন নেই তা কি জানো?

না নন্দিনী, জানি না। ওসব নিয়ে ভাববার সময় নেই। তুমি যাও।

বলেছি তো, আজ আমি সারাদিন তোমার দোরগোড়ায় বসে থাকব।

তা হলে যে আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটবে। শ্রমিকেরা তাল তাল সোনা বয়ে আনছে আমার ঘরে। সেসব সাজিয়ে-গুছিয়ে তোলা, হিসেব রাখা, সব যে গণ্ডগোল হয়ে যাবে।

যাক। আমি আজ মান করেছি।

অভিমান তার কাছেই করা ভাল যে তার দাম দিতে পারে।

আমার অভিমানের দাম তুমি কেন দিতে পারো না?

আমি, আমি তো তোমার রঞ্জন নই নন্দিনী!

আমার অর্ধেক মন জুড়ে যদি রঞ্জন, তো বাকি অর্ধেক মন জুড়ে যে তুমি!

ভুল হচ্ছে নন্দিনী। আমি জানি যে হৃদয় রঞ্জনকে ভালবাসে সেই হৃদয় কখনও এই অন্ধকার গর্ভগৃহের অধিপতিকে ভালবাসতে পারে না।

ভালবাসার তুমি কী জানো?

ভালবাসার আমি কিছুই জানি না নন্দিনী। আমার সব ভালবাসা গিয়ে শেষ হয় আমার চারদিকে তিল তিল করে জমে ওঠা এই সোনার পাহাড়ে। আমি অন্ধকার ভালবাসি, একাকিত্ব ভালবাসি, শক্তিমত্তা ভালবাসি। সংগীতের চেয়েও চাবুকের শব্দ আমার অধিক প্রিয়।

না না, ওরকমভাবে বোলো না। তুমি ওরকম নও কিছুতেই।

 আমি কীরকম নন্দিনী?

আমাকে মুখোমুখি পেয়ে একদিন আমার অরণ্যের মতো চুলে দুটো শক্তিমান হাত ডুবিয়ে কী গভীরভাবে চেয়ে ছিলে তুমি আমার চোখের দিকে। সেই দৃষ্টি যে আমি ভুলতে পারি না রাজা। হ্যাঁ, তুমি মস্ত মানুষ, নিষ্ঠুর রাজা, তুমি ভয়ংকর। কিন্তু সেদিন তো আমার একটুও ভয় করেনি!

ভয় পাওনি বলেই ভেবে নিও না যে, আমি ভয়ংকর নই।

তোমাকে যে আমার এক নিষ্পাপ শিশুর মতো লেগেছিল সেদিন। তোমার দুটি চোখের ভিতরে আমি যেন স্নান করে উঠলাম। কী আশ্চর্য গভীর তোমার চোখ, যেন সমুদ্র। তোমার চোখের দিকে চেয়ে আমি সমুদ্রের গভীর কল্লোল শুনতে পেয়েছি, যেন অনেক শঙ্খ বেজে উঠেছিল একসঙ্গে। মনে হয়েছিল তোমার মতো বিশাল পুরুষ আমি কখনও দেখিনি! আর কী ভীষণ একা তুমি!

তুমি আমাকে ভয় পাও না নন্দিনী?

না। তোমাকে যে চেষ্টা করেও ভয় করতে পারিনি। ভয় করলে কি ছুটে ছুটে আসতুম তোমার কাছে?

তোমাকে নিয়েই তো আমার বিপদ নন্দিনী।

কীসের বিপদ?

আমাকে এতকাল সকলেই ভয় পেত। কেউ কখনও আমার দিকে মুখ তুলে তাকানোর সাহসটুকুও দেখায়নি। ওই ভয় থেকেই এসেছে শৃঙ্খলা, ওই ভয় থেকেই এসেছে বিনা প্রশ্নে আদেশ-পালন করা, ওই ভয়ই মাটির গভীর থেকে তুলে আনে তাল তাল সোনা। এ রাজ্যে কখনও বিদ্রোহ হয়নি। কিন্তু নন্দিনী, তুমি যে চারদিকে ভয় ভাঙানিয়া হাওয়া বইয়ে দিচ্ছ!

লোকে তোমাকে ভয় পেলে বুঝি তোমার ভাল লাগে?

 লাগে নন্দিনী। আমার সামনে এলে মানুষ কুঁকড়ে যায়, পাঁশুটে হয়ে যায়, বাকরোধ হয়, চোখ বুজে ফেলে–আমি তখন বুঝতে পারি যে, সব ঠিক আছে। আমার কোনও বিপদ নেই। কিন্তু একবার ওদের ভয় ভেঙে গেলেই আমার বিপদ। এক মহা বিস্ফোরণে খানখান হয়ে যাবে আমার যতেক নির্মাণ। উবে যাবে সোনা, অন্তর্হিত হবে সিংহাসন, লোপ পাবে আমার সীমাহীন ক্ষমতা। নন্দিনী, আমি তোমাকে শাসন করার আগেই তুমি আত্মসংবরণ করো। ভয় ভাঙানিয়া হাওয়া বইতে দিও না।

শোনো, শোনো। তুমি ওরকম নও! তুমি কিছুতেই ওরকম নও। তোমাকে যে আমি আমার মনের ভিতরে চিনতে পেরেছি।

কী চিনতে পেরেছ নন্দিনী?

তুমি ওরকম নও।

 আমি কীরকম?

তুমি এক বিশাল পুরুষ। তুমি মহা শক্তিমান। তোমার শাসনে জড় হয়ে থাকে মানুষ। তোমার অতুল ঐশ্বর্য। তবু আমার কেবলই মনে হয় ও তুমি নও। এসবই তোমার খেলনাপাতি। তুমি যেন এক দুরন্ত বালক, খেলায় মেতে আছ। ভুলিয়ে রাখছ নিজেকে। কিন্তু তুমি আবার এক লহমায় সব খেলনা হুটপাট করে দিয়ে উধাও হয়ে যেতে পার। তোমার চোখের ভিতর দিয়ে তোমার গভীর মনের ভিতরে সেই বৈরাগ্যকেও যে আমি দেখেছি।

ওসব তোমার কল্পনা নন্দিন। তুমি আমাকে তোমার মন দিয়ে গড়ে নিয়েছ মাত্র। ও আমি নই। আমার বেলা বইয়ে দিও না। কাজের সময়ে ফাঁক পড়ছে, আমার সময় নেই। তুমি যাও নন্দিনী।

আমি তো বলেইছি তোমার দোরগোড়ায় আজ আমি সারাদিন বসে থাকব। তোমাকে জ্বালাব, কাজ ভণ্ডুল করব, আনমনা করে দেব তোমাকে।

কেন নন্দিন?

তুমি কেন অন্ধকারের রাজা হয়ে থাকবে? তুমি আলোর কেউ নও, আনন্দের কেউ নও? তোমার বন্ধ দরজায় ঘা দিয়ে দিয়ে ফিরে যায় পৃথিবীর আলো, গান, গন্ধ, কেন এই নির্বাসন তোমার?

আমি যা, আমি ঠিক তা-ই।

আচ্ছা, কী করে তোমাকে দেখাই বলো তো!

 কী দেখাতে চাও?

আমার মনের মধ্যে যে-তুমিটা বসে আছ তাকে।

 সে অলীক, সে মিথ্যে।

একবার যদি তোমার সামনে তাকে আনতে পারতাম।

বৃথা কথায় সময় নষ্ট হচ্ছে। এবার তুমি যাও নন্দিন। গুপ্তচরেরা আমাকে গোপন তথ্য দেবে বলে অপেক্ষা করছে। সেনাপতি দাঁড়িয়ে রয়েছেন আদেশের অপেক্ষায়। কোটাল এসেছেন পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতে।

তোমার সারাদিন শুধু ভারী ভারী কাজ।

আমি যে কাজের লোক নন্দিন। আমি তোমার রঞ্জন নই।

 তুমি কি রঞ্জনকে কটাক্ষ করলে?

না নন্দিন। আমি তোমাকে বলছি, তোমার রঞ্জন আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর জীব। শঙ্কায়, উদ্বেগে, অনিশ্চয়তায় আমার সময় কাটে। অবসরহীন এই জীবনে মাঝেমধ্যে মনে হয় বটে, অন্য রকম হলেও বোধহয় মন্দ হত না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায়, আমার বিপুল সম্পদ, অমিত শক্তি ও দুর্বার শাসনের কথা। নন্দিন, তোমাদের কত ছুটি, কত অবকাশ, কত গান, কত কথা। কেন আমার কাছে আসো নন্দিন? তোমার জগতে আমার কোনও স্থান নেই। বড্ড বেমানান।

তাই বুঝি?

রঞ্জনকে নিয়ে স্বপ্নের স্রোতে ভেসে যাও নন্দিন। আমাকে ভুলে যাও।

 শোনো, শোনো। শ্রবণের কপাট বন্ধ করে দিও না এখনই। আমার কথা যে শেষ হয়নি!

 তোমার মনে বুদ্বুদের মতো কথার জন্ম হয়। আমি কি অত কথা কইতে পারি!

 পারতেই হবে। শোনো, তোমাকে আজ আমার একটা কথা বলতেই হবে।

তবে তাড়াতাড়ি বলে ফেল।

তাড়াতাড়ি বলার মতো কথা নয় যে! এক একটা কথা আছে যা খুব ধীরে ধীরে ফুলের পাপড়ির মতো ফুটে ওঠে। তাড়া দিলে হবে না।

আমার সামনে তুলাদণ্ডে সোনার ওজন হচ্ছে। আমার যে এক মুহূর্তও অন্যমনস্ক হওয়ার উপায় নেই।

আজ তোমাকে শুনতেই হবে।

বলো, শুনছি।

না, শুনছ না। এক মুহূর্ত তোমার কাজ ফেলে রেখে আমার কাছাকাছি এসো। চুপটি করে বসো। রাজকার্য অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু আমার কথার যে তর সয় না। একটা কথা মাথা খুঁড়ে মরছে আমার ভিতরে। কতক্ষণ তাকে আটকে রাখতে পারি বলো!

এই কাছে এলুম। এবার বলো।

আমাকে দেখতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি নন্দিন। আমি সবাইকে দেখতে পাই, কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে পায় না।

বলো তো আমি আজ কোন সাজে সেজেছি!

বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছ। এলোকেশে আলতো একটি মালা জড়িয়ে রয়েছে। কপালে একটি শ্বেতচন্দনের ফোঁটা। মেয়েদের সাজের কোনও মর্মই আমি জানি না। তবু বলি, তোমাকে আজ অপরূপ দেখাচ্ছে। এ সাজ কার জন্য নন্দিন? রঞ্জন আসবে বলে?

কেউ বুঝি তোমার জন্য কখনও সাজেনি?

রাজ-অবরোধে নারীর অভাব নেই। নৃত্য-গীত পটীয়সীরাও আমার মনোরঞ্জন করতে সর্বদাই তৎপর। তবু তোমাকেই বলি নন্দিন, তারা কেউ আমার জন্য সাজেনি কখনও। সাজতে হয় বলে সাজে মাত্র।

তুমি কি জানো আজ রঞ্জনের জন্য নয়, আমি সেজেছি তোমারই জন্য!

বৃথাই সেজেছ। এই অন্ধকূপ থেকে তোমাকে যে আমার কিছুই দেওয়ার নেই।

 আমার আছে।

আমি কৃপণ, সঞ্চয়কারী, লোভী, নৃশংস, মদমত্ত এক যন্ত্র মাত্র। নন্দিন, কী দেবে তুমি আমাকে? এই দুই লোভী হাত শুধু পৃথিবীর সম্পদ কেড়ে নিতে চায়! তুমি আমাকে কী দেবে?

কেন বুঝতে পারো না তুমি, আমার অর্ধেক হৃদয় যদি রঞ্জন জয় করে থাকে, বাকি অর্ধেক আমি তো কবেই তোমার দরজার চৌকাঠে রেখে দিয়ে গেছি।

অর্ধেক! অর্ধেক নন্দিন? আমি কখনও অর্ধেক গ্রহণ করিনি। আমি চাই সবটুকু। সবটুকু চাই, নইলে সবটুকুই প্রত্যাখ্যান করি। নন্দিন, তুমি রঞ্জনের জন্য তোমার সবটুকু হৃদয় তুলে রাখো। মরুভূমিতে সিঞ্চন করার মতো বোকা তুমি নও।

আমার প্রগলভতা ক্ষমা করো। দ্বিধাদীর্ণ এই অসহায় নারীর দিকে একবার ভাল করে তাকাও। আমার সবটুকু তো রঞ্জনেরই ছিল। এই নন্দিনী তো রঞ্জনেরই রচনা। জানতুম রঞ্জনই আমার সব। সে আমার গান, আমার আলো, আমার মুক্তি। রঞ্জন যেখানে যায় সেখানেই চারদিক ফুল্ল হয়ে ওঠে।

জানি নন্দিন। রঞ্জনের কথা তুমি অনেক বলেছ।

তবু দেখ, যেদিন তোমাকে দেখলুম, তরাসে কেঁপে উঠেছিল বুক। কী ভয়ংকর বিপরীত তুমি! কী নিষ্ঠুর! কী কঞ্জুষ! কী স্বার্থপর, আত্মসর্বস্ব! আবার দেখলুম, কী প্রবল তোমার শক্তি! ঐরাবতের মতো সামর্থ্য তোমার!রঞ্জন সুন্দর বটে, কিন্তু কবির মতো সুন্দর। আর তুমি! তোমার সৌন্দর্য যেন অন্ধকার কুঁদে তৈরি করা। কী বিশাল, কী স্থির, কী একাগ্র!

আর বোলা না নন্দিন।

আজ আমাকে বলতেই হবে। রঞ্জন সুন্দর বটে, কিন্তু সে যেন ময়ূরের পালকের মতো পলকা, উড়ে যায়। সে এক বিবাগী পুরুষ, তার কোনও স্থণ্ডিল নেই। পৃথিবীর আনন্দের সঙ্গেই যেন তার সম্পর্ক। কিন্তু তুমি তো তা নও।

জানি নন্দিন।

পৃথিবীর গভীর দুঃখ, গভীর বিষাদ, গূঢ় অভ্যন্তরের ভিতরে তোমার অবস্থান। এ জীবনকে তুমি মন্থন করেছ ঢের বেশি। মন্থনের হলাহলে জর্জরিত তুমি এক বিষণ্ণ পুরুষ। নন্দিনীকে বিদীর্ণ করেছ তুমি, দ্বিখণ্ডিত করেছ। রঞ্জনকে কী করে আমার সবটুকু দেব আর? বলে দাও।

ক্ষমা করো নন্দিন। এ আমার অজানিত অপরাধ।

 তুমি তো লুণ্ঠন করোনি আমাকে। তবে ক্ষমাভিক্ষা কেন?

একদিন কুঁদ ফুলের মালা গেঁথে পদ্মপাতায় ঢেকে এনেছিলে। মনে পড়ে কি নন্দিন?

 পড়ে। তুমি বলেছিলে, নিজে পরো। কী অপমান!

আজ বলি, এই সত্যটিও ঢাকা দিয়ে রাখো। ঢাকা থাক, সব বেদনাবহ সত্য আজ ঢাকা থাক।

রঞ্জন আমার চোখের দিকে একপলক তাকালেই বুঝতে পারবে, আমি আর সবটুকু তার নেই। ওগো, রঞ্জনের কাছে যে আমি কিছুই লুকোতে পারি না। আমার বড় ভয় হয়।

কীসের ভয় নন্দিনী?

ভয় হয় যদি আমাকে নিয়ে তোমার আর রঞ্জনের মধ্যে লড়াই বাঁধে।

রঞ্জনের সঙ্গে আমার কোনও লড়াই নেই নন্দিনী। আমি রাজ্য জয় করতে ভালবাসি, আমি খনির গভীর থেকে তুলে আনতে ভালবাসি সোনা, আমি ভালবাসি সম্পদ ও আধিপত্য। তোমাদের মিহিন প্রেমের তৃতীয় কোণ তো আমি নই। যদি তোমাকে লুণ্ঠন করতে চাইতুম তবে সে প্রলয়ঝড়ের মুখে কবেই উড়ে যেত রঞ্জন। আমার লড়াই কার সঙ্গে জানো? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মল্লবীর, ক্ষ্যাপা ষাঁড়, ক্ষুধার্ত বাঘ, ক্রুদ্ধ সিংহ, মত্ত হাতি কতবার লুটিয়ে পড়েছে আমার পায়ের তলায়। এই সূক্ষ্ম মায়া-দরজার অন্তরাল থেকে তাদের গর্জন আর আর্তনাদ শোনোনি কখনও?

শুনেছি।

কতবার তুমিই বলেছ তোমার রঞ্জন আসবে ভোরের আলোর মতো, বসন্ত সমাগমের মতো, ফুলের সুগন্ধের মতো। রঞ্জন যেখানে যায় সেখানে সবাই জেগে ওঠে, শুরু হয় উৎসব, গান। সে কি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে নন্দিন?

তবু ভয় হয়। কেন জানো?

কেন?

আমার রঞ্জনের সঙ্গে তোমার এক জায়গায় বড্ড মিল।

কীসের মিল?

আমার রঞ্জনের বুকে যে একটুও ভয় নেই। ভয়ের ছায়াটুকু কখনও তাকে স্পর্শ করে না। সে কাউকে ভয় পায় না বলেই তার বিপদ বেশি। শুধু ভাবি, দুজন ভয়হীন মানুষ যখন মুখোমুখি হবে–তুমি আর রঞ্জন–তখন কি প্রলয় হবে!

এই পৃথিবীতে আমি একমাত্র নিজেকেই ভয় পাই। কেন জানো?

কেন?

এই যে আমার বিপুল শক্তি ভিতর থেকে কেবলই ফুঁসে উঠছে, ওই অন্ধ শক্তি সবসময়ে চারদিকটাকে তছনছ করে দিতে চায়। সুন্দর, স্বচ্ছ, শুভ্র, পবিত্র কাউকেই রেয়াত করতে চায় না সে। এই অন্ধ, কাণ্ডজ্ঞানহীন বিপুল শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। তোমার রঞ্জন যখন আসবে তখন আমাকে সতর্ক করে দিও।

শুনে আরও ভয় করছে আমার।

রঞ্জনের আগমনের আগাম বার্তা তোমার কাছে তো পৌঁছে যাবেই। তুমি আমার দরজায় করাঘাত করে বলে যেও সে কোন পথ দিয়ে আসবে। আমি সে পথ থেকে প্রহরা তুলে নেব, মসৃণ ও নিরাপদ করে দেব তার আবির্ভাব। বিষাণ বাজবে, প্রতিহারীর ঘোষণা শোনা যাবে। তোমার ভয় নেই নন্দিন। এখন যাও। আমাকে কাজ করতে দাও।

.

এটা কি ইমপ্রুভমেন্ট অন রবীন্দ্রনাথ? নাকি রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তার? নাকি বিকল্প রক্তকরবী? সে নিজের লেখাটা পড়ে কিছুতেই বুঝতে পারল না কেন লিখল, কেন লিখতে গেল। লেখাটা বারবার পড়ল সে। এর ভিতরে কে আছে? কেউ কি আছে তার চেনা? মোনা, পারুল, কিংবা আর কেউ? সে নিজে? যাই হোক এই ভুসিমাল নিয়ে তো কেউ আর রিসার্চ করবে না।

এখন কবোষ্ণ দুপুর। তার ভীষণ খিদে পেয়েছে। এই একটা জিনিস সে ভীষণ টের পায়। খিদে, একটা আগ্রাসী খিদে তার শরীরে, পাকস্থলীতে মন্থনদণ্ডের মতো পাক দিয়ে ওঠে। তখন বড্ড মাথা গরম হয়ে যায়। কেন কেউ তাকে খেতে দিচ্ছে না বলে একরকম অবোধ অভিমান হতে থাকে।

ব্লাড সুগার হয়নি তো? সে শুনেছে ব্লাড সুগারের একটা লক্ষণ ঘন ঘন ভীষণ খিদে পাওয়া। শরীরের খবর সে তো রাখে না। কত জট পাকিয়ে আছে ভিতরে কে জানে।

কিছুক্ষণ বিছানায় চিৎপাত হয়ে পড়ে রইল অমল। সে কি আজ সকালে কিছু খায়নি? খিদেটা পেটের মধ্যে বেড়ালের মতো হাঁচোড়-পাঁচোড় করছে কেন? একটু ভাবতেই অবশ্য মনে পড়ল, আজ সকালে সে রুটি আর আলুভাজা খেয়েছিল। ঘড়িতে এখন মোটে সাড়ে এগারোটা। এত তাড়াতাড়ি খিদে পাওয়ার কথা নয়। পেটের খোঁদলটায় হাত রেখে সে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল।

অমলদা! ডাক শুনে কেঁপে উঠল অমল। এ নিশ্চয়ই বিভ্রম। চোখ চাইলেই এই মধুর বিভ্রম ভেঙে যাবে।

অমলদা, তুমি কি ঘুমোচ্ছ?

অমল চোখ মেলল। মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল তার।

না। কী চেহারা হয়েছে তোমার বলো তো! কতকাল দাড়ি কামাওনি? চুল আঁচড়াওনি!

অমল উঠে বসল, বোসো পারুল।

বসবার জন্য আসিনি। ঝগড়া করার জন্য এসেছি।

ঝগড়া! বলে অমল স্মিতমুখে মাথা নেড়ে বলল, আমি কি ঝগড়া করতে জানি? কীসের ঝগড়া পারুল?

কী শুনছি বলো তো!

অমল চোখ নত করে বলল, কী শুনছ?

তুমি আর মোনা নাকি ডিভোর্সের মামলা লড়ছ?

 আমি তো মামলা লড়ছি না। মোনা লড়ছে।

কেন?

 তা জানি না। মোন আমাকে সহ্য করতে পারছে না আর।

সেই দোষটা কি মোনার? তোমার নয়?

 আমারই তো দোষ।

 যদি জানো তোমার দোষ, তবে শোধরাও না কেন?

অমল মাথা নেড়ে বলল, পারি না।

কেন পারো না?

আর নতুন করে কিছু হওয়ার নেই আমার।

ওসব বোলো না। তোমার মেয়ে এসে পান্নার কাছে অনেক দুঃখ করে গেছে তোমাদের সেপারেশন হয়ে যাচ্ছে বলে। ছেলেমেয়ে দুটোর কথা ভেবেও তো নিজেকে একটু বদলাতে পারো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অমল বলে, ওরাই বা আমার কে বলো! আমাদের যে সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি তেমন করে। সবাই কেমন ছাড়া-ছাড়া, আলাদা-আলাদা। যে যার নিজের শেল-এর মধ্যে গুটিপোকার, মতো আটকে আছি।

তোমাদের কি ইগো প্রবলেম?

কে জানে পারুল! তাই হয়তো হবে।

 ঘেন্নার কথা কী জানো? মোনা নাকি বলে গেছে সে তোমাকে আমার জন্যই সন্দেহ করে।

 মাথা নেড়ে অমল বলে, হ্যাঁ।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সবচেয়ে বড় শত্রু হল সন্দেহ। যদি ওটা এখনই উপড়ে ফেলতে না পারো তা হলে নিউরোসিসে দাঁড়িয়ে যাবে।

তার কি আর কোনও প্রয়োজন আছে পারুল? মোনা তো ডিভোর্সের মামলার জন্য তৈরি হচ্ছে।

শোনো, একজন বাঙালি সাদামাটা গৃহস্থঘরের বউ কি সহজে ডিভোর্সের মামলা করে? এদেশে ডিভোর্সি মহিলার ভবিষৎ বলে কিছু কি আছে?

তা তো আমি জানি না।

জানতে তো কেউ বারণ করেনি। তোমার বিয়ে কেন ভেঙে যাচ্ছে তা জানার চেষ্টা না করে তুমি গাঁয়ে এসে পড়ে আছ কেন?

আজ কি আমাকে বকতে এসেছ পারুল?

হ্যাঁ। তোমার দুঃখের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে থাকলে কি আমার ভাল লাগার কথা?

সেটা মোনার ভুল।

সবটাই ভুল? যদি তাই হয় তা হলে ঠুনকো ভুলটা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করোনি কেন? সাধারণ একটা ঘটনাকে জটিল করে তুলছ অমলদা।

আমি কি জট ছাড়াতে পারি?

কেন পারছ না? কেন চেষ্টা করছ না?

কী করব পারুল?

তুমি কলকাতায় ফিরে যাও।

গিয়ে?

চাকরিটা আছে না গেছে?

সহজে যাবে না। বেতন কাটবে হয়তো।

তা হলে আগে চাকরিতে জয়েন করো। লিভ অর ট্রাই টু লিভ নর্মালি।

আমি আর নর্মাল নেই পারুল। আমার মাথা কাজ করে না, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, বিড়বিড় করে কথা কই, হঠাৎ হঠাৎ আচমকা অদ্ভুত সব কথা বলে ফেলি, অদ্ভুত সব আচরণ করি। না পারুল, আমি আর স্বাভাবিক নেই।

পারুল থমকাল, ডাক্তার দেখিয়েছ?

হ্যাঁ। একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে মাঝে মাঝে কাউনসেলিং নিতে যেতাম।

 কিছু হয়নি তাতে?

হয়। তারপর ফের যেন সব গোলমাল হয়ে যেতে থাকে। না পারুল, এই গহ্বর থেকে আমার আর ওপরে উঠে আসার উপায় নেই।

তুমি কি বাস্তব থেকে পালাতে চাইছ?

মাথা নেড়ে অমল বলে, জানি না।

তবু কলকাতায় ফিরে যাও অমলদা। এখানে পড়ে থাকলে মোনা আরও ক্ষেপে যাবে। এত অবহেলা ওর প্রাপ্য নয়।

তুমি বললে যাব।

আজই যাও।

যাব। তারপর কী করব?

সেটা ঠিক করে নাও এখন থেকে।

মাথা নেড়ে অমল বলে, ওটা পারি না। আমাকে কেউ যদি চালিয়ে নিয়ে যেতে রাজি থাকে একমাত্র তা হলেই আমি চলতে পারি। সে খেতে বললে খাব, শুতে বললে শোব, চলতে বললে চলব, বলতে বললে বলব, চুপ করে থাকতে বললে চুপ থাকব। আমার এখন ঠিক এরকমই একজনকে চাই।

পারুল হাসল, তা হলে তো তুমি লক্ষ্মী ছেলে!

হ্যাঁ পারুল। আমি যা করতে চাই সব ভণ্ডুল হয়ে যায়। পদে পদে ভুল করে বসি। তাই আই ওয়ান্ট টু বি ডোমিনেটেড বাই সামওয়ান।

সেই সামওয়ান যদি মোনাই হয়!

নয় কেন? কিন্তু মোনা কি হবে? মোনা তো আমাকে চায় না।  বরং বলো, তুমিই তোমাকে চাও না।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়