৩১.

কথা ছিল না। তবু হয়ে গেল। পারুলের শরীর জুড়ে তৃতীয় সন্তানের আগমনবার্তা ছড়িয়ে পড়ছে। শরীরের মধ্যে আর একটা শরীর ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। গর্ভের অঙ্কুর। পারুলের শরীরে নানা অসোয়াস্তির সঞ্চার ঘটছে। মধ্যরাতে উঠে বেসিনে বমি করার পর হাফ ধরা গলায় সে তার পেটে হাত রেখে মায়াভরে বলে, দুষ্টু ছেলে, মাকে বুঝি এরকম কষ্ট দিতে হয়?

ছেলে! মেয়েদের অন্ধ সংস্কারবশে সেও ছেলেই চায় নাকি? না বাবা, না। মেয়ে হোক, পারুলের একটুও আপত্তি নেই। পেটে হাত রেখে সে ফিস ফিস করে বলে, মেয়ে নাকি তুই! লক্ষ্মী হয়ে থাক।

এখনও আকার নেয়নি, চোখ মুখ কিছু তৈরি হয়নি, গর্ভের অন্ধকারে একটি রক্তাক্ত পিণ্ড মাত্র, তবু কত মায়ায় যে ভরে ওঠে বুক!

কথা ছিল না, তবু হল। কিন্তু তৃতীয় সন্তান মোটেই অ্যাকসিডেন্ট নয়। বললে লোকের অদ্ভুত লাগবে, এই সন্তান চেয়েছিল পারুল নিজেই। চল্লিশের কাছাকাছি বিপজ্জনক এই বয়সে কেউ কি মা হতে চায়? ডাক্তারও ভ্রূ কুঁচকেছিল। কিন্তু পারুল চেয়েছিল ঠিকই। চিন্তিত জ্যোতিপ্রকাশ বলেছিল, পারুল, ব্যাপারটা সেফ হবে কি? এক ছেলে এক মেয়ে তো আছেই আমাদের, আর কী দরকার?

দরকার কথাটার নানারকম ব্যাখ্যা হতে পারে। হিসেবি মানুষের দরকার একরকম, বেহিসেবির অন্যরকম। পারুল হেসে বলেছিল, সেই পুতুলখেলার বয়স থেকে আমার শখ ঘরভরা ছেলেপুলের।

জ্যোতিপ্রকাশ শান্ত হেসে বলেছিল, আশ্চর্য! আজকাল কেউ ওরকম ভাবে না।

আমার শখ যে! কী করব বলো!

সমস্যা কী জানো? এ বয়সে মেয়েদের শরীরে স্টিফনেস দেখা দেয়। কোনও কমপ্লিকেশন হলে কী হবে?

কিছু হবে না। অত ভেবো না।

তাদের ছেলেমেয়ে দুটিই খুব ভাল। তারা কেউ দুষ্ট নয়, দুজনেই মেধাবী, শান্ত, বাধ্য। দুজনের চোখের দৃষ্টিই স্নিগ্ধ। দেখতেও তারা সুন্দর। বিয়ের পর তারা দীর্ঘ দিন সন্তানের কথা ভাবেনি। তখন জ্যোতিপ্রকাশ আর পারুল লড়াই করছে ব্যবসা নিয়ে। ব্যবসা তখনও অস্থিরতায় ভুগছে। পারুলের বয়স তখন নিতান্তই কম। আঠেরো পূর্ণ হয়নি। বিয়ের ছয় বছর বাদে তাদের সময় হয়েছিল। ছক কষেই তারা এনেছিল প্রথম সন্তান। ঠিক তিন বছর বাদে দ্বিতীয় এল। সব কিছুই প্ল্যানমাফিক করা উচিত এটা তারা দুজনেই বিশ্বাস করত। আত্রেয়ীর বয়স এখন পনেরো, শুভমের বারো।

সবই ঠিকঠাক ছিল। সংসার বেঁধে নিয়েছিল নিজেদের ছকে। গত বছরই ঘটল একটা ঘটনা। সেটাও শীতেরই এক রাত। জামশেদপুরে সাংঘাতিক শীত পড়েছিল সেই রাতে। একটা বা দেড়টা হবে বোধহয়। পারুল লেপের গরমের ভিতরে গভীর ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চমকে জেগে উঠল। কে ‘মা’ বলে ডাল হঠাৎ? খুব কচি গলার ডাক। কিন্তু তার ঘুমের মধ্যে সেই ডাক যেন তার শরীরে ঝংকার দিয়ে গেল।

দুরুদুরু বুকে লেপ সরিয়ে উঠে বসল সে। আত্রেয়ী বা শুভম ডাকছে না তো! কিন্তু ওরা তো অত ছোট নয়! তবু আলো জ্বেলে সে গিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে দেখল, দুটো সিংগল খাটে ভাইবোন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তবে ডাকল কে?

শব্দটা বাইরে থেকেও আসার কথা নয়। কাছাকাছি বাড়ি নেই এবং এই নির্জন পাড়ায় নিশুত রাতে মা ডাকার মতো কেউ থাকবে–এটাও ভাবা যায় না। তবু নিঃশব্দে টর্চ জ্বেলে জ্বেলে বাড়ির ভিতরটা ভাল করে দেখে নিল পারুল। তারপর চুপচাপ বসে খানিকক্ষণ ভাবল। ভেবে ভেবে তার মনে হল, বাইরে থেকে নয়, এ ডাক এসেছে তার ভিতর থেকে। ভিতর থেকেই। কিন্তু তাও কি হয়? তার ভিতর থেকে কে তাকে মা বলে ডাকবে?

নিশ্চিত হওয়ার জন্য সকালে সে তার ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করল, রাতে ভয়ের স্বপ্ন দেখে তারা কেউ মাকে ডেকেছিল কিনা।

তারা দুজনেই অবাক হয়ে বলল, না তো!

অথচ পারুল শুনেছে, স্পষ্ট শুনেছে, খুব কচি গলায় কে যেন আর্তরবে ডেকেছিল মা! সেই ডাক তার সমস্ত শরীরে ঝংকার দিয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে সে শিউরে কেঁপে উঠেছিল।

পারুল ভাবের মানুষ নয়। স্বামীর ব্যবসায় তাকে মাথা খাটাতে হয়, সংসার সামলাতে হয়, ছেলেমেয়ের দিকে নজর দিতে হয়। অলস সময় বলতে তার কিছু নেই। তবু ওই নিশুত রাতের একটা ডাক তাকে নিশির মতো পেয়ে বসল। প্রতিদিন ঘুমোবার আগে তার মনে হত, আজও যদি ডাকে! ইস, আর একবার যদি ডাকে!

আর ডাকল না বটে, কিন্তু সারাদিন নানা কাজকর্ম ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে ওই স্মৃতি এসে বারবার হানা দেয়। আর কোমল এক আলোয় ভরে যায় পারুলের অভ্যন্তর। নরম হয়ে আসে মন, শরীর। কেউ কি তার শরীরে ভর করে কোল জুড়ে আসতে চায়? কোনও নিরাশ্রয় অনিকেত আত্মা?

ওই চিন্তা ভূতের মতো পেয়ে বসল তাকে। বারবার নিজের বয়সের হিসেব করল। শরীরের কথা ভাবল। রিস্ক ফ্যাকটরের কথা ভাবল। তার দুটি ছেলেমেয়েই নরমাল ডেলিভারি। শরীরে কাঁটাছেঁড়া হয়নি কখনও। গড়ানে বয়সে যদি একটু কাটাকুটি হয় তো হোক না।

দ্বিধা ছিল, বাধা ছিল, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা ছিল। তবু সব যেন ভেসে যেতে লাগল। একটা অচেনা কচি গলার একটা মাত্র ডাক তাকে উন্মনা করে দিল বড়। পাগল করল। বেহিসেবি করে দিল।

ওই ডাকটার কথা সে কাউকেই বলেনি। শুনলে সবাই হাসবে। জ্যোতিপ্রকাশ গম্ভীর কাজের মানুষ, সব ব্যাপারটাকেই খুব সিরিয়াসলি নেয়, কিছুই উড়িয়ে দেয় না। তবু তাকেও বলল না পারুল। তার মনে হয়েছিল, তার ভাবী সন্তান শুধু তাকেই ডেকেছে, আর কাউকে তো নয়। ওই গোপন তীব্র আকাঙ্ক্ষার ডাকটিকে সে পাঁচ কানে ছড়াবে কেন?

তবু বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করার পর অবশেষে সে তার স্বামীকে বলল। লজ্জা, দ্বিধা তো ছিলই, ভয়ও কি ছিল না একটু? এই বয়সে সন্তান হতে গিয়ে সে যদি মরেটরে যায় তাহলে তার বাচ্চা দুটোর কী হবে? জ্যোতিপ্রকাশও কি ভেঙে পড়বে না!

কিন্তু যে আসতে চায় তার পথ অবারিত না করেও যে পারুলের উপায় ছিল না! কী করবে পারুল তাকে না এনে? পাপ হবে না? অপরাধ হবে না?

.

আজকাল বলাকার রাতে ভাল ঘুম হয় না। শরীরে ঘুমের প্রয়োজনটাই তৈরি হয় না বোধহয়। একটু আধটু চটকামতো আসে, বিনা কারণেই ভেঙে যায়। তখন কেবল এপাশ ওপাশ। ঘুম ছিল কম বয়সে। কী ঘুম বাবা! বিছানা যেন চুম্বকের মতো টানত। বিছানা না হলেও চলত তখন। বিয়ের পর সেই বালিকা বয়সে স্বামীর গায়ে পা তুলে কি কম দিয়েছে ঘুমের ঘোরে? সকালে উঠে অবশ্য প্রণাম করত রোজ।

আজ রাতে পাতলা ঘুমের মধ্যে দরদালানে বমি করার শব্দ পেয়ে চটকাটা ভাঙল বলাকার। দিন দুই হল লক্ষণটা শুরু হয়েছে। এ বয়সে কেন যে আবার ছেলেপুলে হচ্ছে তা বুঝতে পারে না বলাকা। এ যুগের রেওয়াজ তো এটা নয়। আজকাল তো একটা করেই হয় বেশির ভাগ।

বলাকা উঠে মশারি তুলে বাইরে এল। রাতে প্রায় কিছুই খায়নি মেয়েটা। এক পিস মাছ আর একখানা রুটি। একটু দুধ সাধাসাধি করেছিল বলাকা, খায়নি। ওই সামান্য খাবারটাও পেটে থাকল না। তাহলে প্রসবের ধাক্কা সামলাবে কী করে? রক্ত হবে না শরীরে। আগের দুবারও একই অবস্থা হয়েছিল। বলাকা ভেবে মরে। তবু যা হোক, বয়স কম ছিল তখন, কিন্তু এখন তো তা নয়।

দরদালানে পা দিয়ে বলাকা দেখল, বেসিনের কাছে তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে পারুল।

কী রে? আরও হবে?

না মা। ঠিক আছে।

চোখে মুখে একটু জল দে। দিয়েছি।

পেট তো খালি হয়ে গেল, রাত কাটবে কী করে তোর? একটু দুধ গরম করে দিই, খা।

না মা, গা গুলোচ্ছে এখনও।

কী যে করি তোকে নিয়ে! আয়, আমার খাটে এসে শুয়ে থাক।

মা, তোমার যেটুকু ঘুম হয় আমি শুলে সেটুকুও হবে না। তুমি শুয়ে পড় গে, আমি এখন ঠিক আছি।

তোর ঠিক আমার ধাত! চারটে ছেলেমেয়ের প্রত্যেকটা হতে গিয়ে আমি অর্ধেক হয়ে গেছি। মনে আছে গাদাল পাতা খুব ভাল লাগত। তোকেও কাল গাদালের ঝোল করে দেবোখন।

মৃদু লাজুক হাসি হেসে ঘাড় নাড়ল পারুল, দিও।

আজকাল একটু লজ্জা হয়েছে পারুলের। তার যে আবার ছেলেপুলে হবে এটা বোধহয় কারও কাছেই প্রত্যাশিত ছিল না। সব চেয়ে বড় লজ্জা ছেলেমেয়ের কাছে। আতু অর্থাৎ তার মেয়ে কালও জিজ্ঞেস করেছিল, মা, তোমার কী হয়েছে?

পারুল বলেছিল, অম্বল।

কিন্তু রোজ তো আর অম্বল বললে হবে না। তবু যা হোক মেয়ের কাছে ব্যাপারটা কবুল করা যাবে। কিন্তু শুভ? তার কাছে যে ভারী লজ্জায় পড়তে হবে পারুলকে। বড্ড অবাক হবে যে ছেলেটা! ভারী অস্বস্তি তাই পারুলের।

পারুল আর জ্যোতিপ্রকাশ কারওরই তেমন অবসর নেই বলে আতু আর শুভ বড় হয়েছে আয়া আর ঝি-এর হেফাজতে। ভালই থাকত তারা, কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু অন্য সমস্যা না হলেও মা বাবার সঙ্গে খুব সামান্য একটু দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাদের–এটা খুব টের পায় পারুল। সে বা জ্যোতিপ্রকাশ কখনও হামলে দামলে ওদের আদর করেনি, বুকে নিয়ে শোয়ওনি বড় একটা। নজর রেখেছে, রক্ষণাবেক্ষণ করেছে, কিন্তু সময় দিতে পারেনি। সময়ের ওই টানাটানিই তাদের একটু তফাতে রেখেছে আজও। এই ফাঁকটুকু অতিক্রম করা আজ বড় কঠিন।

তিন নম্বরের বেলায় সেটা পুষিয়ে নেবে পারুল। কক্ষনো ঝি বা আয়ার হাতে ছেড়ে দেবে না। বুকে বেঁধে নিজের হাতে সেটাকে নাওয়াবে খাওয়াবে ছোঁচাবে। এর সঙ্গে দূরত্ব থাকবে না তার।

বলাকা বলে, এখন রাত দুটো। সারা রাত খালি পেটে কাটাবি কী করে? খালি পেটে আবার বায়ু অম্বল হবে।

কিছু খেতে পারব না মা। মুখে রুচি নেই।

শুকনো আমলকী খাবি? সন্ধ্যা বেশ বানায়। নানারকম নুন-টুন দিয়ে। খুব সোয়াদ। এক প্যাকেট দিয়ে গিয়েছিল। আয়, দুটো মুখে দিয়ে দেখ দেখি।

সন্ধ্যার আমলকী মুখে দিয়ে পারুল নিজের ঘরে এল। পাশের ঘরে আতু আর শুভ ঘুমে ঢলাঢল। একা কিছুক্ষণ বসে থাকে পারুল। শরীরটা ঝিমঝিম করছে বটে, কিন্তু তার ভিতরটা আলোয় ভরে আছে। সে যেন মৃদু গোলাপি একটা আলো। মায়ায়, ভালবাসায় ভরে আছে মন। খুব মৃদু একটা আঙুলে কে যেন তার শরীরে সেতারের ঝংকার তুলছে।

খুব দুষ্টু হবি নাকি তুই? দামাল, দস্যি, পাজি? দুষ্টু দুষ্টু চোখে তাকাবি, মিষ্টি মিষ্টি হাসবি আর দৌড়ে বেড়াবি বাড়িময়? আর আমি তোকে ধরতে ছুটে ছুটে হয়রান হব?

হোক, তার তিন নম্বরটা একটু দুষ্ট হোক, দামাল হোক, ডাকাবুকো থোক। বড় দুজন শান্ত, সভ্য, সুন্দর। তাদের নিয়ে কোনও ঝামেলা পোয়াতে হয়নি তাকে। তিন নম্বরটা হোক অন্যরকম।

মধ্যরাতে নিজের নির্ভজ পেটে হাত রেখে মৃদু মৃদু হাসছিল পারুল। এখনও অনেক দেরি। অত দেরি যেন সইছে না পারুলের।

কী সুন্দর যে ভোর হল আজ! আকাশে একটা অন্যরকম ময়ূরকণ্ঠী আলো পেখম মেলে দিল। কুয়াশা মাখানো সেই আলো-আঁধারিতে পারুল খুব ধীর পায়ে বাগানে পায়চারি করছিল। ভাল ঘুম হয়নি রাতে। শরীর দুর্বল, মাথায় ঝিমঝিম। কিন্তু মনটা বড্ড ভাল লাগছে তার।

একা নই, আর আমি একা নই। এখন নয় মাস তুই আর আমি সবসময়ে একসঙ্গে। সবসময়।

 পারুল!

পারুল একটু চমকে উঠল।

 কে?

 ফটকের পাশেই শিউলি গাছ। তার আড়াল থেকে আবছা আলোয় মেয়েটা এগিয়ে এল।

 আমি সোহাগ।

হঠাৎ এই সুন্দর ভোরবেলার ময়ূরকণ্ঠী অপরূপ আবছায়া যেন ছাইবর্ণ হয়ে গেল পারুলের কাছে। বিস্বাদে ভরে গেল মন। শরীরে যেন অশুচিতার স্পর্শ। যেন গু মাড়িয়েছে এমনভাবে থমকে গেল পারুল।

কণ্ঠস্বর আপনা থেকেই কঠিন হয়ে গেল, তুমি! কী চাও বলো তো!

সোহাগ ভারী অবাক হয়ে বলে, কিছু চাই না তো!

মুখ ফিরিয়ে নিল পারুল, বিরাগে। বলল, ও, এত সকালে?

মাঝে মাঝে আমি খুব ভোরে উঠে পড়ি, তখন ঘরে থাকতে একটুও ভাল লাগে না। বেরিয়ে পড়ি।

সোহাগকে যে কেন এত অপছন্দ করে? একটাই কারণ। এ মেয়েটা জানে, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ওর বাবার সঙ্গে তার দেহগত সম্পর্ক হয়েছিল। হতে পারে সেটা জবরদস্তি, হতে পারে অবলার ওপর প্রবলের অত্যাচার, তবু হয়েছিল। আর সে কথা মনে পড়লেই সমস্ত শরীরে যেন এক অপবিত্রতার স্পর্শদোষ ঘটে যায়। যতই সোহাগ তাকে গডেস বলুক, ওকে দেখলেই তার ভিতরটা কুঁকড়ে যেতে চায়। মেয়েটা জানে, সব জানে বলেই পারুলের বড় ছোট মনে হয় নিজেকে।

অথচ সে জানে, সোহাগ ভাল মেয়ে। বলাকা ওর প্রশংসা করে, পান্না করে। মেয়েটা একটু পাগলাটে হলেও ব্যক্তিত্ব আছে, খারাপ নয়। তবু ওর একটাই অপরাধ, ও জানে। ও পারুলের গোপন পাপস্পর্শের কথা জানে।

ময়ূরকণ্ঠী থেকে ছাইরঙা হয়ে যাওয়া এই ভোরে আচমকা পারুলের বড় ভয় হল। কুড়ি বছর আগের শরীরী অপবিত্রতা কি তার আতু বা শুভকেও স্পর্শ করবে? স্পর্শ করবে তার পেটে সদ্য অঙ্কুরিত দুষ্টুটাকে?

আমি যদি এখন একটু একা থাকতে চাই, তাহলে কি তুমি কিছু মনে করবে?

গালে থাপ্পড় মারার মতোই অপমান। কিন্তু সোহাগ মৃদু হেসে বলল, না না, কিছু মনে করব না। আই অ্যাম লিভিং।

ফটকের দিকে যখন পা বাড়িয়েছে মেয়েটা তখন হঠাৎ পারুলের একটু মায়া হল। মেয়েটার মুখ এই ভোরের আবছা আলোতেও বড় করুণ দেখাচ্ছিল।

সোহাগ।

বলুন।

আসলে কী জানো, কাল রাত থেকে আমার শরীরটা ভাল নেই। তাই কিছু ভাল লাগছে না। কিছু মনে করনি তো!

মেয়েটা একটুও রাগ প্রকাশ করল না। সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে খুব নরম গলায় বলল, কী হয়েছে আপনার?

তেমন কিছু নয়। হয়তো বদহজম।

বদহজম মানে স্টমাক আপসেট?

 অনেকটা তাই।

কিন্তু আপনাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।

 তাই?

 নট সিকলি।

কিছু বলবে আমাকে?

 না তো! আমি এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আপনাকে দেখে এত ভাল লাগল।

আমাকে দেখে কেন যে তোমার এত ভাল লাগে, বুঝি না বাবা।

আমি তো তা জানি না। আপনাকে দেখেই আমার মন ভাল হয়ে গেল। ভাবলাম আপনার সঙ্গে একটুক্ষণ থাকি। কিন্তু আপনি তো আমাকে পছন্দ করেন না।

লজ্জা পেয়ে পারুল হেসে ফেলে, কে বলল পছন্দ করি না?

আমি জানি।

তুমি ভুল জান। তোমাকে অপছন্দ করব কেন? তুমি তো একটা ভাল মেয়ে।

 মাথা নেড়ে সোহাগ বলে, সবাই কেবল ভাল আর খারাপ নিয়ে কথা বলে। ভাল না খারাপ তা যে কী করে বোঝা যায় সেটাই আমি বুঝতে পারি না। আমাকে আমার মা বলে খারাপ, বাবা বলে খারাপ। আমি খুব ভাবি আমি কেন খারাপ। কিন্তু কিছু বুঝতে পারি না।

তুমি খারাপ নও তো।

তাহলে আমাকে অপছন্দ করেন কেন? অথচ আমি আপনাকে কী ভীষণ অ্যাডোর করি! ভাবি আমি পারুলের মেয়ে হয়ে কেন যে জন্মাইনি!

কথাটা সে আগেও শুনেছে। শুনে আহ্লাদিত হয়নি একটুও। কিন্তু এখন একটু মায়া হল। বলল, এসো, দুজনে পায়চারি করি একটু।

আপনার খারাপ লাগবে না তো! একা থাকতে চাইছিলেন।

না, খারাপ লাগবে না।

আজ আমার মন ভাল নেই।

 কেন বল তো! আজই মা বাবা কলকাতায় ফিরে যাবে। আমাকেও যাওয়ার জন্য ইনসিস্ট করছে।

তুমি কলকাতায় যেতে চাও না?

না। ওমা! কেন? এই গাঁ-গঞ্জে ভাল লাগে বুঝি তোমার? ওঃ, তোমার তো বোধহয় একটা পলিউশন অ্যালার্জি আছে, তাই না?

হ্যাঁ আছে। এমনিতেও শহর আমার ভাল লাগে না।

কিন্তু পড়াশুনো?

সেটাই প্রবলেম। কলকাতায় ফিরে গিয়েই আমাকে ক্লাসে যেতে হবে, মিউজিক লেসন নিতে হবে, কম্পিউটার, ব্যায়াম এসব নিয়ে এনগেজড থাকতে হবে। কোয়াইট সাফোকেটিং। আমি কি একটু বেশি কথা বলছি?

না তো!

আপনি একা থাকতে চাইছিলেন। এসব কথায় হয়তো আপনি বিরক্ত হচ্ছেন।

 না। বিরক্ত হচ্ছি না।

 দুজনে নীরবে পাশাপাশি ধীর পায়ে খানিকক্ষণ হাঁটল।

আপনাদের এই জায়গাটা বেশ।

তোমার ভাল লাগে আমাদের গ্রাম?

শুনেছি এটা আমারও গ্রাম। আমাদের রুটস এইখানে।

 হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই তো। শুধু আমাদের নয়, এটা তোমাদেরও গ্রাম।

সেটা আমি আগে ফিল করতাম না।

এখন কর?

একটু একটু।

পারুল মৃদু হাসল। কিছু বলল না।

আচ্ছা পারুল, আমি যদি আপনার কাছে থাকি?

অবাক পারুল চোখ বড় বড় করে বলল, আমার কাছে? ও মা? কেন বল তো!

আমার মায়ের সঙ্গে তো আপনার ভাব আছে!

পারুল এই ছেলেমানুষি প্রস্তাবে হেসে ফেলে বলে, তা একটু আছে। দু দিনের তো আলাপ।

 আপনি মাকে বলুন না, সোহাগ আমার কাছে কয়েকদিন থাক।

যাঃ। তোমার মা সে কথা শুনবেন কেন?

আপনি বললে হয়তো শুনবে।

 কেন, আমার কথা উনি কেন শুনবেন?

 আমি জানি মা আপনাকে অন্য চোখে দেখে।

কী চোখে বল তো!

 শি ওলসো অ্যাডোরস ইউ।

 ওসব তোমার ভুল ধারণা। আমার মধ্যে কিছু নেই সোহাগ। আমি খুব সাধারণ একটা মেয়ে।

বলুন না একবার মাকে।

সেটা খুব খারাপ দেখাবে সোহাগ। তা কি হয়? আর আমার কাছেই কেন থাকবে তুমি?

আমি জানি আপনি আমাকে একটুও পছন্দ করেন না। কিন্তু আপনাকে যে আমার কী ভাল লাগে!

শুধু চেহারাটা ছাড়া আমার কী আছে বল তো!

 ইউ আর এ গডেস। আমার মনে হয়, আপনি হঠাৎ একদিন আকাশ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে ঝুপ করে এখানে নেমে পড়েছেন।

পারুল প্রমাদ গুণে বলল, সাধে কি তোমাকে লোকে পাগল বলে? আমার কি পাখা আছে যে উড়ব! মাথা ঠান্ডা করো, মা-বাবার সঙ্গে কলকাতায় যাও।

ইজ ইট এ সারমন?

 না সোহাগ, আমার সম্পর্কে ওটা তোমার ভুল ধারণা। ধারণাটা এবার পালটে ফেল।

আমার আপনাকে আরও কাছে থেকে দেখতে ইচ্ছে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আপনার দিকে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

যাঃ।

 ইফ ইউ আর নট এ গডেস, আই শ্যাল ক্রিয়েট ওয়ান ইন ইউ।

তাই কি হয়? কাছ থেকে দেখলে তোমার ধারণা দু দিনেই ভেঙে যাবে।

মানুষ তো চিরকাল এভাবেই তার ভাগবানকে তৈরি করে নিয়েছে তাই না?

তাই বুঝি?

আমার তো তাই মনে হয়। আজ ভোরবেলা আমি কোথায় যাচ্ছিলাম জানেন?

কোথায়?

 পালিয়ে যাচ্ছিলাম।

সে কী?

আপনাকে হঠাৎ দেখে দাঁড়িয়ে না পড়লে এখন আমি কোথায় যে চলে যেতাম তার ঠিক নেই।

কেন সোহাগ, পালিয়ে যাচ্ছিলে কেন?

আমি মা-বাবার সঙ্গে কলকাতায় যেতে চাই না যে!

পারুল ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবল। তারপর হঠাৎ ভোরের মতো একটু হেসে বলল, তুমি আমাকে গডেস বলে মনে কর তো?

করিই তো।

 গডেসের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয় জান?

জানি না।

গডেস যা বলে তা শুনতে হয়।

সোহাগ একটু হেসে বলল, আমি জানি আপনি আমাকে কলকাতায় যেতে বলবেন, তাই না?

শুনবে না তো!

শুনব।

শুনবে?

 হ্যাঁ।

তাহলে চলো আমরা রাস্তায় গিয়ে একটু হাঁটি। তারপর আলো ভাল করে ফুটলে তোমাকে আমি নিজে গিয়ে তোমাদের বাড়িতে রেখে আসব।

সোহাগ খুব সরলভাবে হেসে বলল, ইন এক্সচেঞ্জ অফ হোয়াট?

পাকা মেয়ে, গডেসের সঙ্গে ব্যবসা করতে চাও বুঝি?

তাহলে বলুন, আমাকে আর অপছন্দ করবেন না?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পারুল বলে, তোমাকে আমার অপছন্দ হচ্ছে না তো! শুধু একটা জিনিস একটু অপছন্দ।

কী সেটা?

আমাকে তুমি নাম ধরে পারুল বলে ডাক কেন?

তাহলে কী বলে ডাকব?

পিসি মাসি যাই হোক।

এঃমা, তাহলে যে আমার গডেস পিসি মাসিই হয়ে যাবে। গডেস আর গডেস থাকবে না।

পারুল হেসে ফেলল। তারপর বলল, আচ্ছা থাক বাবা। পারুল বলেই ডেকো। আমার বোধহয় আর খারাপ লাগবে না।

.

৩২.

টাইম শ্যাফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বৈজ্ঞানিক। কুঞ্চিত, দুশ্চিন্তার বলিরেখা কপালে, পিছনে জড়ো করা দুটি হাত বারবার মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে এবং খুলে যাচ্ছে। কাঁচতন্তুর সুড়ঙ্গপথটির দিকে চেয়ে আছেন তিনি। চোখে অনিশ্চয়তা, ভয়, সম্ভাব্য ব্যর্থতার গ্লানি। গত কয়েক বছর চুল কাটেননি, দাড়ি কাটেননি। তাঁর চেহারা হয়েছে পাগলের মতো। নিয়মিত আহার করেননি বলে শরীর রুণ ও দুর্বল। তার গবেষণা শেষ হয়েছে, শুধু ফলাফলের অপেক্ষা। দিনের পর দিন তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন। সময়ের সরণি বেয়ে আজ অবধি কেউ আসেনি অতীত বা ভবিষ্যৎ থেকে। হয়তো আর আসবেও না। হয়তো টাইম-ট্র্যাভেল বাস্তবিকই অলীক কল্পনা। সময়কে কি অতিক্রম করা যায়?

বৈজ্ঞানিক অবশ্য মনে করেন সময় এক অবাস্তব ধারণা। সময় বলেই কিছু নেই। আছে গতি, আছে অবস্থানগত পরিবর্তন, আর মানুষ তাই থেকেই সময়কে কল্পনা করে নিয়েছে। যেখানে পরিবর্তন নেই, গতি নেই বা বস্তু নেই, বস্তুর জন্ম ও বিনাশ নেই সেখানে সময়ের ধারণাও অসম্ভব। গতি এবং পরিবর্তনই সময় নামক তৃতীয় ধারণার জন্ম দিয়েছে। একটি শিশু জন্মাল, বড় হল, বুড়ো হল, মরে গেল, এ সবই হল সেই শিশুটির গতি ও পরিবর্তন মাত্র। শরীরের হ্রাস, বৃদ্ধি, ক্ষয়। বৈজ্ঞানিকের দৃঢ় বিশ্বাস অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আসলে একই সঙ্গে বিরাজমান। চলন্ত ট্রেন থেকে যেমন বাইরের দৃশ্য প্রতীয়মান হয় তেমনই। বাইরের দৃশ্যগুলি ফলিত হয়েই আছে, চলন্ত ট্রেন থেকে শুধু পর্যায়ক্রমে তাদের দেখা যায়। সুতরাং ভবিষ্যৎও বর্তমান, অতীতও বর্তমান শুধু একটু টিউনিং-এর প্রয়োজন। তা হলেই ভবিষ্যৎও বর্তমানের মতোই প্রতীয়মান হবে। অতীতও তাই।

কিন্তু সময়-সুড়ঙ্গে এখনও কেউ আবির্ভূত হল না। অতীত বা ভবিষ্যতের কোনও কল্পনা না, কোনও সাড়া না।

হতাশায় বৈজ্ঞানিক মাথা নাড়লেন। নিজের লম্বা চুল হাত দিয়ে সটান করলেন, দাড়ি আঁচড়ালেন আঙুল দিয়ে। তারপর ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন। তার অস্থির চটিজুতোর শব্দ চারদিকে প্রতিধ্বনি তুলছিল।

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে উদাস চক্ষে বৈজ্ঞানিক কিছুক্ষণ তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন। ওই যে নক্ষত্রমণ্ডলী, ওইসব বস্তুপুঞ্জ যদি সরিয়ে নেওয়া যায় তা হলে এই অসীম অন্ধকার শূন্যতায় সময় বলে কিছু কল্পনা করা যায় কি? না, সেটা অসম্ভব। ওই স্থির পরিবর্তনশীল অন্ধকার পরিসরের কাছে সব ধারণাই মিথ্যে হয়ে যায়। দূরত্ব, সময়, গতি, বিবর্তন সব কিছু।

একটা শব্দ শুনে বৈজ্ঞানিক ফিরে দাঁড়ালেন। ঘরের মাঝখানে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। বৃদ্ধ মানুষ, তার খালি গা, গলায় শুভ্র উপবীত, পরনে পরিষ্কার এক থান ধুতি, মস্তক মুণ্ডিত।

অবাক বৈজ্ঞানিক বললেন, আপনি কে? কী করে এ-ঘরে ঢুকলেন?

লোকটি সাষ্টাঙ্গে তাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে করজোড়ে বললেন, পিতা, আমার এবং আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করুন।

বৈজ্ঞানিক অপ্রস্তুত। প্রণাম-টনাম নেওয়ার অভ্যাস নেই তার। তার ওপর লোকটি যথেষ্ট বৃদ্ধ। তার চেয়েও অন্তত বিশ-পঁচিশ বছরের বড়। বাবার বয়সি মানুষের প্রণাম অস্বস্তিকর বইকী!

বৈজ্ঞানিক বললেন, প্রণাম করছেন কেন? আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, আমারই তো আপনাকে প্রণাম করার কথা। তবে আমি প্রণামে বিশ্বাস করি না।

লোকটি শশব্যস্তে বলল, ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন! আপনি আমাদের পরম প্রণম্য। পরম শ্রদ্ধার পাত্র। পিতা, আপনার দর্শনলাভে আমি ধন্য।

বৈজ্ঞানিক বিরক্ত ও বিস্মিত। বললেন, আপনি আমাকে পিতা সম্বোধন করেছেন! আশ্চর্য! আপনিই তো আমার বাবার বয়সি!

লোকটি জিভ কেটে বলে, হিসাবমতো আপনি আমার চেয়ে একশো আশি বছরের বড়।

বৈজ্ঞানিকের বিস্ময়ে কথা সরল না। অনেকক্ষণ বাদে বললেন, একশো আশি বছর! আপনি কি পাগল?

লোকটি মাথা নেড়ে বলে, না পিতা, আমি পাগল নই। আমি আপনার অধস্তন সপ্তম পুরুষ।

বৈজ্ঞানিক হাঁ করে চেয়ে রইলেন। ব্যাপারটা তাঁর বোধগম্য হচ্ছিল না। কিন্তু তিনি বৈজ্ঞানিক। বৈজ্ঞানিকের মন সর্বদাই যুক্তিযুক্ত পথ ধরে চলে। তার মস্তিষ্কে হঠাৎ একটা উদ্ভাস ঘটল। তবে কি লোকটা তার আবিষ্কৃত ওই সময়-সুড়ঙ্গ ধরে এসে হাজির হয়েছে? তিনি কি তা হলে গবেষণায় সাফল্য লাভ করেছেন? আনন্দে বৈজ্ঞানিক নিজের লম্বা চুল মুঠোয় চেপে ধরে বললেন, তা হলে কি আপনি আমার যন্ত্রের ভিতর দিয়ে এলেন?

পিতা, আমাকে আপনি-আজ্ঞে করে বলবেন না। আমি আপনার প্রপৌত্রের পৌত্র।

ও হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো বটেই বাছা, তুমি তো দুধের শিশু আমার কাছে। আমার গবেষণা তা হলে সফল!

লোকটির মুখ একটু ম্লান হল। হাতজোড় করে বলল, আপনার গবেষণা শতকরা একশো ভাগ সফল বলতে পারলে আমি খুশিই হতাম। কিন্তু পিতা, ঘটনাটা তা নয়।

নয়?

না পিতা। আপনার গবেষণা সম্পূর্ণ সফল না হলেও ব্যর্থ হয়েছে এমন কথা বলা যায় না।

 তার মানে কী বাছা?

আপনার গবেষণা সফল না হলেও চেষ্টা বৃথা যায়নি। অতীত বা ভবিষ্যৎকে বর্তমানে ফলিত করতে পারলেও আপনার বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছেছে।

সেটা কী রকম?

আমাদের গবেষণাগারে সময় পাড়ি দেওয়ার যন্ত্রে আপনার নিরলস চেষ্টার একটা সংকেত পৌঁছেছে। আমরা বুঝতে পেরেছি অতীতের কেউ আমাদের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছে।

তারপর?

আমরা–অর্থাৎ ভবিষ্যতের বিজ্ঞানকর্মীরা সময় নামক বাধা বা প্রাচীর অতিক্রম করার কৌশল জানতে পেরেছি। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে–অর্থাৎ অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে আমরা কখনওই সময়কে অতিক্রম করার চেষ্টা করি না।

কেন করো না?

কাজটা বিপজ্জনক পিতা। অতীত বিপজ্জনক। পৃথিবীর অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একটি অতি সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর পরিকল্পিত হয়ে আছে। তার সামান্য একটুখানি বিচ্যুতি ঘটালেই পুরো ছকটা ভীষণভাবে ওলটপালট হয়ে যাবে। সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে লহমায়। ইতিহাস মুছে যাবে।

বলো কী হে?

 পিতা, আপনার অনুমান মিথ্যা নয়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবই গতি ও পরিবর্তন মাত্র। গীতার শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করুণ। মুখ ব্যাদান করে অর্জুনকে শ্রীভগবান বিশ্বরূপ প্রদর্শন করে বলেছিলেন, যা ঘটার তা ঘটেই আছে, তুমি কেবল নিমিত্তমাত্র হও, অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের মুখের গহ্বরে ভবিষ্যৎকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অর্থাৎ ভবিষ্যৎও বর্তমানই, ঠিক তো? বর্তমান না হলে অর্জুন তা প্রত্যক্ষ করতে পারতেন না!

হ্যাঁ, বোধহয় ঠিক।

আপনার প্রজ্ঞা আমাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আপনার এই গবেষণা সম্পূর্ণ সফল না হলেও তা আমাদের গবেষণায় বিশেষ ইন্ধন সরবরাহ করেছে। বলতে গেলে এ ব্যাপারে আপনি আমাদের পথিকৃৎ।

বাপু হে, আদত কথাটা বলো। আমার টাইম মেশিন যদি সফল না হয়ে থাকে তা হলে তুমি এলে কী করে?

পিতা, ক্রুদ্ধ হবেন না। আপনার মৃদু সংকেত আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়ার পর আমরা অনেক পরামর্শ করে অবশেষে আমাদের যন্ত্রের সাহায্যে আপনার কাছে একজন প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিই। আমি আপনার বংশধর বলে বিশেষজ্ঞরা আমাকেই আপনার কাছে পাঠিয়েছে।

ভ্রূ কুঁচকে বৈজ্ঞানিক ঘৃণাভরে বললেন, বংশধর! আমার বংশধর! কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব? আমি তো বিয়েই করিনি! এবং করার কোনও ইচ্ছেও নেই। চিন্তাশীল এবং কর্মব্যস্ত লোকের পক্ষে মেয়েমানুষ এক মস্ত ঝঞ্জাট।

কাঁচুমাচু হয়ে বৃদ্ধ লোকটি বলল, আপনি বিবাহ না করলে আমার জন্ম সম্ভব হত না।

বৈজ্ঞানিক খিঁচিয়ে উঠে বললেন, সম্ভব না হলে হবে না। তাতে আমার কী যায় আসে বাপু? মেয়েমানুষ হল ঝগড়ুটে, হিংসুটে, ন্যাকা, মিথ্যেবাদী, লোভী, চিন্তাশক্তিশূন্য, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক এবং সর্বনাশা। মেয়েমানুষের ছায়া মাড়ানোও পাপ। সুতরাং আমার বিয়ে করার কোনও সম্ভাবনা নেই এবং বংশধরও কেউ হবে না।

বৃদ্ধ মানুষটি বিবর্ণ মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর স্খলিত কণ্ঠে বলল, পিতা, ঠিক এই কারণেই আমরা সময়-ভ্রমণ পারতপক্ষে করি না। যা কিছু ঘটে আছে, ঘটনার যেসব নকশা তৈরি হয়ে আছে তা এই সর্বনাশা সময়-ভ্রমণের ফলে যদি সামান্যতম বিচ্যুত হয় তা হলেই প্রলয় কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। সমস্ত সৃষ্টির ভারসাম্যই কেন্দ্রচ্যুত হয়ে পড়বে। সেই পরিণতির কথা ভাবলেও শরীর শিহরিত হয়। আপনি বিবাহ না করলে

ক্রুদ্ধ বৈজ্ঞানিক তীব্র স্বরে বললেন, তাই বলে কি অস্পৃশ্য মেয়েমানুষকে ঘরে তুলে আনব? নিমকহারাম, বেইমান, পাপিষ্ঠা মেয়েমানুষের কাছে আত্মবিক্রয় করব? সুন্দর মুখের ছলনায় তারা পৃথিবীকে কতবার ছারখার করেছে তুমি জানো? ইতিহাস, পুরাণ, মহাকাব্যাদি পড়নি? মেয়েমানুষের ইতিহাস মানুষের জীবনে কল্পনাস্বরূপ। তারা স্বভাবতই বিশ্বাসঘাতক এবং অকৃতজ্ঞ। ছলাকলা এবং চাতুর্যে পুরুষকে বশীভূত করে তার জীবনীশক্তি শোষণ করে নেয়। মেয়েমানুষ হল পরগাছা এবং মস্ত জঞ্জাল। মেয়েমানুষ না থাকলে পৃথিবী অনেক বেশি বাসযোগ্য হত।

বৃদ্ধ মানুষটি ভয়ে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে করজোড়ে বলল, হে শ্রদ্ধাস্পদ মহাবোধ, হে জ্যেষ্ঠ পিতা, আপনি ক্রোধ সংবরণ করুন। আপনি ক্রুদ্ধ হলে সৃষ্টির অঙ্ক মিলবে না।

তাতে আমার বয়েই গেল। মেয়েমানুষের কথা শুনলেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে যায়।

 লোকটি বিনীত কণ্ঠে বলল, জানি প্রভু।

বৈজ্ঞানিক হুংকার দিয়ে বললেন, কী জানো?

আপনার বয়স তখন আঠেরো বছর দুই মাস। সদ্য শ্মশ্রুগুফের উদগম ঘটেছে। আপনি ক্ষীণকায়, গৌরবর্ণ ও অতীব সুপুরুষ ছিলেন। তখনও আপনি ছিলেন চিন্তাশীল, অন্যমনস্ক, বাস্তববোধ বর্জিত, মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান। আপনার চিন্তার বিষয় ছিল মহাশূন্য, সময় সৃষ্টিতত্ত্ব ইত্যাদি। বয়সোচিত চিত্তচাঞ্চল্য আপনার ছিল না, নারীর রূপ সম্পর্কে আপনি তখনও সচেতন ছিলেন না। আপনার বিচরণ ছিল মহান এক চিন্তারাজ্যে।

তুমি এই কথা জানলে কী করে?

আমরা সময়-ভ্রমণ করি না বটে, কিন্তু বিশেষ প্রয়োজন হলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের জন্য আমরা যন্ত্রদূত পাঠাই। এই যন্ত্রদূতগুলি কখনও কবুতর, কখনও বেড়াল, কখনও বা নেড়ি কুকুরের রূপ ধরে আসে। এদের নিজস্ব ইচ্ছা বা চিন্তাশক্তি না থাকায় এরা ঘটনার ওপর কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। শুধু তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। আপনার পক্ষে এদের চিহ্নিত বা শনাক্ত করা অসম্ভব।

তোমরা তো বেশ সেয়ানা দেখছি। আমার পিছনে কাকে লেলিয়েছিলে? কুকুর না বেড়াল?

একটি নেড়ি কুকুর। আপনার আঠেরো বছর বয়সে একটি নেড়ি কুকুর আপনাকে সর্বদাই অনুসরণ করত।

বৈজ্ঞানিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, হ্যাঁ, তার নাম ছিল ভুলু। আমি ভাবতাম কোনও রহস্যময় কারণে সে আমার প্রতি আসক্ত। তাই সর্বদাই পিছু পিছু ঘুরত। রাতে আমাদের বাইরের বারান্দায় শুয়েও থাকত। তবে তাকে কিছু খেতে দিলে খেত না।

সেই ভুলুই আমাদের যন্ত্রদূত।

বৈজ্ঞানিক হঠাৎ একটু লাল হলেন। যেন হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। ক্রোধের বদলে তার একটু একটু লজ্জা করতে লাগল।

বৃদ্ধ মানুষটি করজোড়েই দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করতে করতে বললেন, পিতঃ, দুশ্চিন্তা করবেন না। আমরা বিস্তারিত বিবরণে যাব না। আপনি একজন মহান বৈজ্ঞানিক ও মহৎ মানুষ। তবু রক্তমাংসের মানুষ তো, প্রকৃতির নিয়মে, বয়োধর্মে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটতেই পারে।

থামো, ডেঁপো ছোকরা। আমার মোটেই চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেনি। ঘটেছিল বেতসীরই।

বৃদ্ধ মানুষটি বিনীতভাবে চুপ করে রইল।

বৈজ্ঞানিক ফের সলজ্জ মুখে বললেন, কথাটা বিশ্বাস হল না বুঝি?

 আপনার সম্পর্কে আমাদের তথ্য অনুমাননির্ভর নয় পিতঃ, তথ্যনির্ভর।

 বৈজ্ঞানিক খিঁচিয়ে উঠে বললেন, একটা নেড়ি কুকুরের সাক্ষ্যেই বুঝি কিছু প্রমাণ হয়?

 পিতঃ, ক্রুদ্ধ হবেন না। আপনি আদেশ করলে আমি রসনা সংযত করব।

ওহে বাপু, তোমরা হলে হাড়বজ্জাত, বাইরে ভিজেবেড়ালটি সেজে আছ, আর মনে মনে হাসছ সে আমি জানি।

জিব কেটে লোকটা বলে, না না পিতঃ, আমি হাসছি না।

লজ্জিত মুখে বৈজ্ঞানিক বললেন, ওই একবারই আমার পদস্খলন হয়েছিল।

 ব্যথিত মুখে বৃদ্ধ লোকটি বলল, পদস্খলন বলছেন কেন পিতঃ?

বৈজ্ঞানিক দৃপ্ত স্বরে বললেন, পদস্খলন নয়! আমার মতো একজন চিন্তাশীল মানুষ কী করে যে মস্তিষ্কহীন নির্বোধ একটি কিশোরীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল আজও তা ভেবে পাই না।

মহাশয়, আমার স্পর্ধা ক্ষমা করবেন। বেতসী রায় অসহনীয় রূপসী ছিলেন। সেই রূপ অপ্সরাদের থাকে, দেবীদের থাকে। ওই রূপ অনেক বর্ম বেদ করতে পারে, নিরস্ত্র করতে পারে দুর্ধর্ষ বীরকে, তপোভঙ্গ করতে পারে ঋষিরও।

থামো, থামো, অকালপক্ক ছোকরা। রূপ! রূপের গভীরতা তত গাত্ৰচর্মের চেয়ে গভীর নয়। রূপের স্তাবকতা করে মূর্খেরা। সেই বয়সে আমি যে কেন রূপের ফঁদে পড়লাম কে জানে। আজও ভাবলে মনে বৃশ্চিক দংশন হয়।

প্রভু, রাগ করবেন না। আত্মগ্লানির কোনও কারণ ঘটেনি।

ঘটেনি! বলো কী! সেই আত্মগ্লানি যে আজও আমাকে তাড়া করে।

 জানি প্রভু। তাই আজও আপনার কানন কুসুমহীন।

কাব্য কোরো না, ওসব আমার ভাল লাগে না। মেয়েদের সঙ্গে ফুলের তুলনা করা ফুলের পক্ষে অপমান।

বৃদ্ধ পিতা, বেতসী রায় কিন্তু নির্দোষ।

বৈজ্ঞানিক হুংকার দিলেন, নির্দোষ!

চোদ্দো বছরের সেই কিশোরী আপনার বাড়ির সামনে দিয়েই রোজ স্কুলে যেত। আপনি তখন আপনার সামনের বারান্দায় গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বসে থাকতেন। আপনি ভুলে যাবেন না যে, আপনিও তখন ছিলেন অতি সুদর্শন যুবা। বেতসী তাই প্রতিদিন আপনাকে লক্ষ করত। আপনি করতেন না। চিন্তায় কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল আপনার চোখ, মগ্নতায় আবিষ্ট ছিল আপনার মস্তিষ্ক, সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্য আপনাকে বাস্তব থেকে সুদূর করে রেখেছিল। সব ঠিক, কিন্তু বেতসীর অসহনীয় রূপ প্রতিদিন আপনার হৃদয়ের বন্ধ দরজায় মৃদু ও ভীরু করাঘাত করে যেত।

ফের কাব্য?

মহাশয়, কাব্যোচিত ঘটনার বিবরণে একটু কাব্যের স্পর্শ না থাকলে গ্রহণযোগ্য হয় না। বাড়াবাড়ি মানেই বুঝি কাব্য?

যথার্থই বলেছেন। কাব্য মানেই বাহুল্য, কাব্য মানেই হল অতিশয়োক্তি, কাব্য মানেই উপচে পড়া হৃদয়াবেগ।

তাই হবে। সেই জন্যই কাব্য আমি পছন্দ করি না।

প্রভু, কঠিন গবেষণা, জটিল অঙ্ক এবং প্রবল বিদ্যা আপনার অন্তরকে খানিকটা শুষ্ক করে তুলেছে বটে, কিন্তু একদা আপনা হৃদয়ের অর্গল ভগ্ন হয়েছিল।

বৈজ্ঞানিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, হ্যাঁ।

দিনের পর দিন বেতসীর দুই অপরূপ চক্ষু আপনাকে লেহন করে যেত, তার রূপের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত আপনার দুর্গের পরিখায়, তার হৃদয় নীরবে নিবেদিত হত আপনার চরণে। হতে হতে একদিন আপনার বর্ম ভেদ হল।

বৈজ্ঞানিক বিরক্ত হয়ে বলেন, ওরে বাপু, অত কাব্য করে বলার কিছু নেই। সোজা কথায় বলে ফেল, পচা শামুকে আমার পা কেটেছিল।

না পিতা, ওরকমভাবে বলবেন না। বেতসী রায়ের রূপ তো দোষের ছিল না, সেও তো ঈশ্বরের দান।

ঈশ্বর! ওহে, তোমরা ঈশ্বর-টিশ্বর মানো নাকি? আমি কিন্তু মানি না।

যারা নিজেদের ঈশ্বরের সমতুল ভাবে তারা ঈশ্বরকে মানতে চায় না। যেখানে অহং প্রবল সেখানে ঈশ্বর বাস করেন না।

ভাল জ্বালা হল রে বাপু! তোমরা ঈশ্বর মানো কেন?

তার কারণ আমরা জ্ঞানমার্গে আপনাদের চেয়ে অনেকটা অগ্রসর জাতি। বিজ্ঞানও এখন অগ্রসর। যতই মানুষ জ্ঞানার্জন করবে ততই অহং বিলীন হবে, এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব ততই অনুভূত হবে।

তোমরাও তা হলে ওই হাওয়ার নাড়ু খেয়ে বসে আছ? তাই তো তোমার গলায় পৈতে দেখছি। আমি তো পৈতে-টৈতে কবে ফেলে দিয়েছি। যত সব কুসংস্কার।

আপনি ফেলে দিয়েছেন বলেই আপনার উত্তরপুরুষদের তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে। এমন কাজ করা আমাদের উচিত নয় যার জন্য উত্তরপুরুষদের দায়ভাগ বহন করতে হয়।

বামুনদের ইতিহাস জানো? সমাজের শোষক, চতুর প্রতারক, অত্যাচারী, হৃদয়হীন, খল, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং ঘৃণ্য একটা শ্রেণী।

প্রকৃত ব্রাহ্মণ তো তা নয়।

 আমি ওসব জানতে চাই না। আমি নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে কখনও বোধ করিনি।

 বিতর্ক থাক প্রভু। আমরা বেতসীর কথায় ফিরে আসি। অবশেষে একদিন আপনি বেতসীকে অকস্মাৎ লক্ষ করলেন। আপনার কাননে হঠাৎ মর্মরধ্বনি উঠল, পরভৃৎ শিষ দিতে লাগল। আপনি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন।

হ্যাঁ মনে হয়েছিল আমার মাথায় বাজ পড়েছে।

পিতা, উপমাটি অযথার্থ নয়। বজ্রাঘাতের সঙ্গে এই মুগ্ধতার কিছু সাদৃশ্য আছে।

 বড্ড ধানাই-পানাই করছ হে। সোজা কথাটা বললেই তো হয়।

যে আজ্ঞে। আপনার সমস্যা হল প্রেম কাকে বলে আপনি তা জানতেন না। আপনি যে প্রেমে পড়েছেন তাও আপনি বুঝতে পারছিলেন না। শুধু অস্থির, উচাটন, উদ্বেগ আপনাকে গ্রাস করেছিল। সঙ্গে ভয়ও। কারণ নিজের ভিতরকার পরিবর্তনগুলিকে আপনি অনুধাবন করতে পারছিলেন না।

বাঃ, বেশ বলছ তো। ওরকমই হয়েছিল বটে। আমার চিন্তারাজ্যে যেন বাজপাখির ছায়া।

 প্রভু, ওরকম কঠিন বাক্য বলবেন না। বিষয়টি পেলব।

ছাই পেলব।

আপনাদের চক্ষু রোজ মিলিত হতে লাগল। আপনি আরও উন্মন হলেন, আরও চঞ্চল, আরও উদ্বিগ্ন, আরও ভীত। আপনার হৃৎপিণ্ড দামামা বাজাত।

বেঁধে! বেঁধে! অতটা বলার দরকার নেই।

যে আজ্ঞে! রেখেঢেকেই বলছি তা হলে। আদত কথাটা হল আপনারা দুজনেই দুজনকে ভালবেসে ফেলেছিলেন।

মূর্খ! ওকে ভালবাসা বলে না। রূপতৃষ্ণা কি ভালবাসা? কামনা কি ভালবাসা?

তা নয় পিতা, তবে ভালবাসার মধ্যে ওসবও একটু-আধটু থাকে।

 ওসবই থাকে। নারীপ্রেম আসলে কাম আর রূপতৃষ্ণা।

আপনি বড় কঠোর সমালোচক।

আমি মধুর মিথ্যেবাদী নই তোমার মতো।

আপনাদের ওই প্রেম আপনাকে এতটাই চঞ্চল করেছিল যে, আপনি একদিন সোজা রাস্তায় নেমে মেয়েটির পথ আটকে দাঁড়ান।

হ্যাঁ। ভ্যানতারা আমি পছন্দ করি না।

 কিন্তু প্রভু, প্রেমেরও একটা রচনা আছে। প্রথম দৃষ্টি বিনিময়, তারপর কটাক্ষ, তারপর মৃদু হাস্য, তারপর সন্তর্পণ বাক্যালাপ, তারপর প্রস্তাবনা।

তাই বুঝি! প্রেম করতে সময়ের এত অপব্যবহার এবং শক্তিক্ষয়।

 নইলে যে ব্যাপারটা মোহমুদগরের মতো হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক যেমনটি আপনার ক্ষেত্রে হয়েছিল।

 বৈজ্ঞানিক লজ্জিত হয়ে বললেন, কাজটা যে ঠিক হয়নি তা অবশ্য স্বীকার করতে হবে।

না প্রভু, কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি। আপনি দুহাতে বেতসীর দুই কাঁধ চেপে ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলেছিলেন, তোমাকে আমার দরকার… তোমাকে আমার দরকার… তোমাকে আমার দরকার…

কুণ্ঠিত বৈজ্ঞানিক বললেন, অ্যাপ্রোচটা একটু রাফ ছিল বটে, কিন্তু সোজা কথাটা তো ওটাই।

হ্যাঁ প্রভু। তবু মোদ্দা কথাটা এসব ক্ষেত্রে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলতে হয়। বেতসী ঝাঁকুনি খেয়ে ভয়ে আর ব্যথায় কেঁদে ফেলেছিল এবং দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আপনি কিছুতেই বুঝতে পারলেন না যে, আপনার প্রস্তাবটায় খারাপ কী ছিল।

বাস্তবিক তাই।

এরপর ওই মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য আপনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সম্ভব অসম্ভব নানা পন্থা নিতে শুরু করেন। আপনি মেয়েটির বাড়িতে হানা দিয়ে তার বাবার কাছে বেতসীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। আপনার দুর্বিনীত কথাবার্তায় বেতসীর বাবা চটে যান এবং প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর আপনি লোক লাগিয়ে বেতসীকে চুরি করার মতলব আঁটেন। অথচ সামান্য কূটকৌশল ও একটু ধৈর্য অবলম্বন করলে ব্যাপারটা কত সহজেই ঘটে যেত।

ওসব নিষ্কর্মারা পারে। আমার অত ধৈর্য নেই।

তবু আপনি কিন্তু তখন বেতসী-পাগল। যত প্রত্যাখ্যান আসে তত আপনি ক্ষিপ্ত থেকে ক্ষিপ্ততর হয়ে ওঠেন। বেতসীকে সর্বত্র আপনি অনুসরণ করতেন। এক বিয়েবাড়িতে ভিড়ের মধ্যে আপনি তার হাতও চেপে ধরেছিলেন।

আহা, আবার অত ডিটেলসে যাচ্ছ কেন?

আচ্ছা প্রভু, এটুকুই থাক।

বৈজ্ঞানিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মেয়েরা নির্বোধ। তাই ওই মেয়েটি আমার হৃদয়ের বার্তা বুঝতেই পারল না।

যথার্থই প্রভু। হৃদয়ের বার্তা বোঝার সাধ্য কজনেরই বা থাকে, তাই মেয়েটি আপনার কাছ থেকে পালাতে থাকে। এবং বোধহয় রাহুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যই মাত্র পনেরো বছর বয়সেই মেয়েটি পাত্রস্থ হতে রাজি হয়ে যায়। আপনি উন্মাদের মতো সেই বিয়ের আসর ভাঙচুর করতে গিয়ে প্রহৃত হন। আপনার কিছুদিন হাজতবাসও হয়েছিল।

ইয়ে, ওসব পুরনো কথা থাক। বিয়ে-টিয়ে আমি আর করছি না বাপু।

তাই কি হয় প্রভু? আপনি বিয়ে না করেন তা হলে সৃষ্টি স্থিতি লোপ পাবে। তাই আমার ওপর হুকুম হয়েছে আপনি রাজি না হলে আপনাকে কালের সরণি বেয়ে সেই আঠারো বছর বয়সে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

বলো কী?

আপনি রাজি হবেন?

বৈজ্ঞানিক হঠাৎ মৃদু একটু হাসলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, না। একবার ঘটে-যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।

তা হলে কী বার্তা নিয়ে ফিরে যাব প্রভু?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৈজ্ঞানিক বললেন, কী একটা কথা আছে যেন, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা, না?

হ্যাঁ প্রভু।

তাই হবে বাপু। ঘিনপিত ঝেড়ে ফেলে, তোমাদের মুখ চেয়ে বরং বরণমালায় ফাঁসিই হোক আমার।

 প্রণাম, প্রভু, প্রণাম।

.

রাতে ঘুম হয়নি। ভোররাত অবধি ডায়েরিতে কাহিনীটা লিখে অমল কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবল। কী লিখছে সে এসব? কেন লিখছে?

ভোরের আলো ভাল করে ফোটার আগেই সে র‍্যাপার মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আজ কলকাতায় ফিরে যাবে তারা। একটু ঘুরেফিরে গ্রামটা দেখে নিতে হয়। কলকাতায় এমন অঢেল সময় আর পরিসর নেই। কলকাতা তার ভালও লাগে না আর। প্রচুর টাকা মাইনের চাকরিও তাকে আকর্ষণ করে না। কেন যে এসব হচ্ছে!

অনেকটা হাঁটল অমল। হেঁটে হেঁটে বাসরাস্তা অবধি চলে গেল। দোকানে বসে ভঁড়ে চা খেল দুবার। লোকজনের যাতায়াত দেখল। অর্থহীন সময় বয়ে যাচ্ছে। কর্মহীন সময়। আসলে সময় বলে তো কিছু নেই। আছে গতি ও অবস্থান। আছে অবস্থানগত পরিবর্তন। সব ঘটে আছে, পর্যায়ক্রমে সেগুলি সামনে আসে বা পিছনে সরে যায়।

সে যখন পারুলকে ভালবাসত, কিংবা পারুল তাকে, সেটা কি অতীত? নাকি সেটাও বর্তমান, কিন্তু পরিদৃশ্যমান নয়। ঘটনাটা এখনও ঘটছে, শুধু তা দৃশ্যমান নয়। পৃথিবীর জন্ম ও মৃত্যু, মহাজগতের জন্ম ও মৃত্যু সবই একই সঙ্গে ঘটে আছে। শুধু তা খণ্ড খণ্ড করে দেখা যাচ্ছে–এই যা।

গভীর অন্যমনস্কতায় ফিরে আসছিল অমল। চেনা রাস্তায় পা তাকে নিয়ে যাচ্ছে মাত্র, সে কিছু দেখছে না। চলছে।

অমলদা।

চোখ তুলে অমল হঠাৎ দেখল কুড়ি বছর আগে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনে পারুল।

.

৩৩.

পারুল! বলে থমকে গেল অমল। শুধু পানয়, থমকাল তার হৃৎপিণ্ড, তার সত্তা, তার স্মৃতি, তার সময়।

না, পৃথিবীর বহুবার আবর্তন, বহু সূর্য প্রদক্ষিণ, ঘড়ির কাঁটায় ঘুরে যাওয়া বা ক্যালেন্ডার পালটে গেলেও সেই বিশ বছর আগেকার জায়গাতেই থেমে আছে তারা। সময় বলে তো কিছু নেই, তাই বয়স বলেও কিছু হয় না।

পারুল একটু হেসে বলল, এত সকালে কোথায় বেরিয়েছ?

অমলের বিভ্রম কাটেনি এখনও। সে এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বিশ বছর আগেকার সেইসব দিনকে প্রত্যক্ষ করছে। সামনে কিশোরী পারুল।

খুব থতমত খাওয়া মুখে অমল চারদিকে চেয়ে একবার দেখে নিল। তারপর বলল, এই একটু বেরিয়েছিলাম।

মর্নিং ওয়াক?

 তাই হবে বোধহয়।

আমি তো তোমাদের বাড়ি থেকেই আসছি।

 অবাক অমল বলে, আমাদের বাড়ি থেকে?

হ্যাঁ।

ও।

পারুল ফের একটু হেসে বলে, জিজ্ঞেস করলে না কেন?

অমল এখনও প্রকৃতিস্থ নয়। কিছু বলতে পারছে না যেন। বলল, কেন?

তোমার পাগল মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়ে এলাম।

 সোহাগ! সোহাগের কী হয়েছে?

পারুল মাথা নেড়ে বলল, কিছু হয়নি। ও আসলে কলকাতা যেতে চাইছে না।

হ্যাঁ জানি।

কেন যেতে চায় না বলো তো?

 ও কলকাতা পছন্দ করে না।

শুধু তাই?

ও আমাদেরও পছন্দ করে না। সোহাগ ইজ এ প্রবলেম চাইল্ড।

তোমরা ওকে বুঝতে পারো না, না?

না।

সেটা শুধু তোমাদের প্রবলেম বলে ভাবছ কেন? এটা তো আজকাল সব বাবা-মা আর তাদের সন্তানের প্রবলেম।

জেনারেশন গ্যাপের কথা বলছ?

তা ছাড়া আর কী?

সোহাগের বোধহয় আরও কিছু জটিলতা আছে যেটা আমি বুঝতে পারি না।

ওকে একটু ছেড়ে দাও, দড়ি আলগা করো, দেখবে প্রবলেম হবে না।

আমি তো সংসারের মালিক নই পারুল। আমার কথায় সব তো হয় না। সংসার মানেই নিরন্তর বোঝাপড়া, কনফ্রনটেশন, আপসরফা, বিতর্ক, মতান্তর, সম্পর্কের নানা সরল ও জটিল অঙ্ক কষে যাওয়া। সিদ্ধান্ত নেওয়া তো সোজা নয়!

অত শক্ত কথা বুঝতে পারি না।

সুখী মানুষের বুঝবার কথাও নয়।

আমি সুখী কি না কী করে বুঝলে?

 তোমার সুখী হওয়ারই তো কথা পারুল!

 তাই বা কেন?

তোমার মুখশ্রী দেখলেই বোঝা যায় তোমাকে দিনরাত খারাপ খারাপ চিন্তা করতে হয় না।

তুমি বুঝি খারাপ চিন্তা করো?

হ্যাঁ পারুল। মাথাটা আজকাল আমার বশে নেই। খারাপ চিন্তা, বিটকেল চিন্তা, অদ্ভুত চিন্তা, পাগলাটে চিন্তায় মাথা সবসময়ে গরম হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয়, পাগল হয়ে যাব।

যাঃ, ও সব ভাবতে নেই, এসো, আমাদের বাড়িতে এক কাপ চা খেয়ে যাও।

সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে অমল বলে, চলো।

পারুল আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে বলল, তোমার কি পুরনো দিনের কথা মনে করে খারাপ লাগে অমলদা?

অমল একটু ভেবে বলে, পুরনো দিন! মানে সেইসব দিনের কথা যখন তুমি আর আমি?

 হ্যাঁ।

খুব মনে পড়ে।

সেইজন্যই কি ওরকম হয়?

 তা তো জানি না।

আমি তোমাকে বিয়ে করিনি বলে তোমার ইগোতে খুব লেগেছিল নিশ্চয়ই।

হ্যাঁ পারুল, লেগেছিল।

তুমি আমাকে ভুলতে তাড়াহুড়ো করে বিয়েও করেছিলে?

হ্যাঁ পারুল।

 আমিই কি তোমার অশান্তির কারণ অমলদা?

 না পারুল, আমার তা মনে হয় না।

আমার ওই একটা ভয় আছে। তোমাদের সম্পর্কের মধ্যে যদি আমি কাঁটা হয়ে থাকি তা হলে দুঃখের ব্যাপার হবে।

তোমাকে মোনা কিছু বলেনি তো পারুল?

পারুল মাথা নেড়ে বলল, না।

আশ্চর্যের বিষয় পারুল মোনর ভিতরে কোনও বিদ্বেষ বা ঘেন্না লক্ষ করেনি আজ অবধি। পরিচয় অবশ্য বেশি দিনের নয়। মেলামেশাও যৎসামান্য। তবু তার মধ্যেও কি কিছু বোঝা যেত না?

একটু আগেই সোহাগকে নিয়ে মোনার ঘরে পৌঁছে দিচ্ছিল পারুল।

দরজা খুলে তাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে মোনা বলল, আরে! আসুন, আসুন। এত ভোরে যে!

এসে অসুবিধে করলাম না তো!

না, না, কী যে বলেন! ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম।

কথার মধ্যে একটুও কৃত্রিমতা নেই, চোখে ছুরিছেরা ঝলসে উঠল না, গলায় কোনও কাঠিন্য প্রকাশ পেল না। অথচ মহিলা জানেন, পারুলের সঙ্গে তার স্বামীর অ্যাফেয়ার ছিল।

তাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজের মেয়ের দিকে একবার চেয়ে মোনা বলল, ও আপনাকে ধরে এনেছে বুঝি?

পারুল মৃদু হেসে বলল, কে কাকে ধরে এনেছে তা বলা যাবে না। দুজনেই দুজনকে ধরে এনেছি।

এসে ভাল করেছেন। আজ আমরা কলকাতা ফিরে যাচ্ছি।

শুনেছি।

কবে যে আপনার সঙ্গে ফের দেখা হবে কে জানে। আপনি কি এখন এখানে থাকবেন?

পাগল? জামশেদপুরে আমার অনেক কাজ। খুব বেশি হলে আর হয়তো দিন পনেরো। মা বড় একা, হয়ে পড়েছেন, তাই থাকা। ছেলেমেয়েদের স্কুল খুলে যাবে, আমার স্বামীও একা রয়েছেন।

সকলেরই এক সমস্যা। সোহাগ তো কিছুতেই কলকাতায় যেতে রাজি নয়। এ জায়গাটা ওর ভাল লাগে। শহরের পলিউশনে ওর প্রবলেমও হয়। কিন্তু তা বলে তো আর অনন্তকাল এখানে পড়ে থাকতে পারে না।

পারুল মৃদু একটু হেসে বলল, সোহাগ একটু অন্য ধরনের।

মোনা মেয়ের দিকে ফের তাকাল একবার। বলল, শুধু অন্যরকম বললে কিছুই বলা হয় না। একদম পাগল একটা। সব সময়ে ওকে নিয়ে চিন্তা হয় আমার।

সকলের কি একরকম হওয়া ভাল? আমরা সবাই এক এক রকমের পাগলই তো!

একটু-আধটু হলে চিন্তা ছিল না। কিন্তু ও বড্ড ডাকাবুকো। ভয়ডরও কম। আর আনপ্রেডিক্টেবল।

 সেটা কয়েকদিনে টের পেয়েছি।

একটু চা করে আনি?

চায়ের কথায় নাক কোঁচকাল পারুল। চায়ের গন্ধ তার আজকাল সহ্য হয় না। মাথা নেড়ে বলে, চা থাক।

আপনার কি শরীরটা খারাপ? খুব রুখু দেখাচ্ছে আপনাকে। অ্যান্ড স্টিল ইউ আর বিউটিফুল।

আপনারা আমাকে যে কী চোখে দেখেন কে জানে। আমি তত সুন্দরী নই কিন্তু।

মোনা তার দিকে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে একটু চেয়ে থেকে বলল, আমার ছেলে মেয়ে সবাই আপনার ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমিও, কী জানি কেন, আমাদের ওপর হয়তো আপনার একটা হিপনোটিক স্পেল কাজ করে।

সেটাই তো আমার পক্ষে লজ্জার ব্যাপার।

 তা কেন? এতে লজ্জা পাওয়ার তো কিছু নেই। সোহাগ, তুমি একটু বাইরে যাবে?

যাচ্ছি। বলে সোহাগ নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

মোনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি সব জানি, জেনেও আপনাকে কখনও হিংসে করতে পারিনি, আপনার ওপর রাগও হয়নি কখনও।

পারুল লজ্জায় একটু লাল হল। তারপর বলল, সেটা এত অস্বাভাবিক যে বিশ্বাস হতে চায় না। আপনি বড্ড ভাল।

আমাকে কেউ ভাল বলে না।

 কেন বলে না?

তা তো জানি না। অন্যের চোখে ভাল হতে গেলে নিজেকে যতটা বদলাতে হয় ততটা কি বদলাতে পারি, বলুন? আর নিজেকে বদলাবই বা কেন? সোহাগের বাবাকে তো দেখছেন! কী মনে হয় আপনার?

মাথা নাড়ে পারুল, কিছু খারাপ তো দেখছি না।

বাইরে থেকে বুঝবেন না। ভীষণ ফ্রাস্ট্রেটেড, ডিপ্রেসড। হয়তো মনে মনে ওর সব কিছুর জন্য আমাকেই দায়ি করে। কারও কারও কপাল থাকে ওরকম, ভিকটিম অফ সারকামস্ট্যান্সেস। আমি হলাম তাই। অনেক কথা বলে ফেললাম আপনাকে। কিছু মনে করবেন না।

পারুলের একটা অপরাধবোধ হচ্ছিল। এদের অশান্তির জন্য কোনও না কোনওভাবে সে দায়ি নয় তো!

মোনা বিষণ্ণ গলায় বলে, আমাদের কোনও প্রবলেম নেই, অথচ কত প্রবলেম যে রোজ অকারণে তৈরি হয় কে জানে।

পারুল একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে উঠল। বলল, সোহাগ সকালে আমার কাছে গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল জানেন?

না তো!

সেটা খুব মজার ব্যাপার। ওর খুব ইচ্ছে দিনকতক আমার কাছে থাকবে। শুনে আমার খুব মায়া হয়েছিল। কেন যে আমাকে ওর এত পছন্দ কে জানে! যাই হোক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কলকাতায় যেতে রাজি করিয়েছি।

থ্যাংক ইউ। ওকে কলকাতায় ফেরত নিয়ে যেতে আমরা হিমসিম খাচ্ছি। কিছুতেই যেতে চায় না। আজও ভাবছিলাম অনেক বকাঝকা করতে হবে বোধহয়।

না, বকবার দরকার নেই। ও যাবে।

 কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব।

 সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল মোনার চোখে।

ফিরে আসতে আসতে সে ভাবছিল, মোনা সব জানে। তাদের প্রেম, দেহগত সম্পর্ক–এত সব জেনেও কী করে তাকে অপছন্দ না করে পারে? খুব সূক্ষ্মভাবে হয়তো আরও একটা ব্যাপার মোনার মধ্যে কাজ করে। সে যে এক কামুক পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তার ভিতরে হয়তো মেয়ে হিসেবে মোনা একটা জয়ের আনন্দ খুঁজে পায়। কিংবা এসব নাও হতে পারে। হয়তো অন্য কিছু, যার মাথামুন্ডু পারুল জানে না। তবে ভারী অসহায় লাগে তার।

পারুলদের বাড়ি এখন ফাঁকা। তার বাবা জেদ করে ভাইয়েদের অংশ কিনে নিয়ে যে বিশাল বাড়িতে তার মাকে অধিষ্ঠিত রেখে গেছে তাতে থাকার মতো যথেষ্ট লোক কখনওই ছিল না। এখন তো আরও নেই। মা কীভাবে যে এ বাড়িতে একা দিনের পর দিন কাটায় তা ভাবতেই পারে না পারুল।

মাঝের দালানের মস্ত বৈঠকখানায় এনে অমলকে বসাল সে। এ ঘরে খুব দামি মোটা গদির সোফা সেট সাজিয়ে রাখা। আগেকার দিনের সব বাঘ আর হরিণের মুণ্ডু দেয়ালে মাউন্ট করা। কাশ্মীরি জালি কাজের কাঠের পার্টিশন। খুব আধুনিক রুচিসম্মত ছিমছাম ব্যাপার নয়, একটু যেন লোক-দেখানো জাদুঘর-জাদুঘর ভাব। তা হোক, এ-ঘরটায় তার বাবার গন্ধ আর স্পর্শ আছে।

এক ধরনের বিষণ্ণ উদাসীন চাউনি নিয়ে বসে আছে অমল। কথা নেই, কৌতূহল নেই, পারুলের দিকেও চাইছে না।

কিছু খাবে অমলদা?

অমল ঘোর অন্যমনস্ক চোখ তুলে বলে, উঁ?

কিছু খাবে? সকালে তো জলখাবার খাওনি!

অমল হঠাৎ একটু হেসে বলল, খাব! হ্যাঁ, আমার তো খুব খিদে পেয়েছে! টের পাইনি এতক্ষণ।

সে কী! খিদে টের পায় না নাকি মানুষ?

 মানে, একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কী একটা যেন খুব দরকার। কী যেন ভাবছিলাম বলে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

আচ্ছা মানুষ যা হোক, বোসো একটু। সকালে আমাদের বাড়িতে লুচি-টুচি হয়। বলে আসি।

অমল ঘাড় কাত করে বলে হ্যাঁ। লুচি আর বেগুনভাজা।

তাই হবে।

পারুল বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সেই কৈশোরকালে সে এ লোকটিকে ভালবেসেছিল। আজ যেন সেটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। কী করে যে ভালবেসেছিল সেটাই আজ বুঝতে কষ্ট হয়।

আসলে মানুষ কখনওই আর একটা মানুষের সবটুকু ভালবাসতে পারে না। অমলের মেধা, স্মার্টনেস ইত্যাদিই হয়তো সম্মোহনের কাজ করেছিল তার কাঁচা মনে। আজ তার চিহ্নমাত্র নেই। শুধু একটু

অনুকম্পা আছে, করুণা আছে, মায়াও থাকতে পারে।

তোর সঙ্গে ও কে এল রে, অমল নাকি?

 রান্নাঘরের বারান্দায় মা।

হ্যাঁ। অমন ঝড়ো কাকের মতো চেহারা কেন ওর? কী হয়েছে? মাথার চুল তো কাকের বাসা।

অমলদা আজকাল ওরকমই হয়ে গেছে। কী যেন ভাবে বসে সবসময়ে।

বউয়ের সঙ্গে নাকি বনিবনা নেই! সেদিন সন্ধ্যা এসে অনেক কথা বলে গেল। বউটা কেমন, জানিস?

ভালই তো মা। বেশ ভাল। বুদ্ধি বিবেচনা আছে। খারাপ নয়।

ও মা! তা হলে বনে না কেন? আজকাল বউগুলোই এসে যত ঘোঁট পাকায়। বউ যদি ভাল হয় তাহলে আর ভাবনা কী?

বাঃ, বেশ ভাল কথা তো মা? মেয়েরা ঘোঁট পাকায় আর পুরুষরা বুঝি সব লক্ষ্মীছেলে!

তাই তো। পুরুষদের আবার দোষঘাট কী? পুরুষেরা সংসারের কূটকচালি বোঝেও না, ঘোঁটও পাকায় না। মেয়েরাই তো নষ্টের মূল।

বেশ মা, বেশ পক্ষপাতিত্ব তোমার!

 বলাকা হাসেন। বলেন, আচ্ছা আর ঝগড়া করতে হবে না তোকে। কী হয়েছে ছেলেটার বলবি

সে তো জানি না। তবে কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে, খুব অন্যমনস্ক, ওর বউ বলে খুব নাকি ডিপ্রেশনে ভোগে।

বেচারা! কত মেডেল-টেডেল পেয়ে শেষে এই দুর্দশা!

 বামুনদিকে দিয়ে লুচি বেগুনভাজা আর এক কাপ চা পাঠিয়ে দাও তো ও-ঘরে।

দিচ্ছি। কিন্তু তোর কি খিদে পায় না নাকি? রাতে যা খেয়েছিলি সব তো উগরে দিয়েছিস।

ও বাবা, খাওয়ার কথা বোলো না তো! শুনলেই গা বিড়োয়।

ওরে, নিজের কথা ভেবে নয় না-ই খেলি। পেটেরটার কথা ভাব। তুই শুঁটকি মেরে থাকলে ওটাও যে শুকিয়ে যাবে। মায়ের খাওয়াই তো ওদের খাওয়া।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পারুল বলল, তা হলে ঝাল-টাল দিয়ে কিছু একটা করে দাও।

বেশি ঝাল খাওয়াই কি ভাল এ সময়ে?

কেন, ঝালে কী দোষ করল? মুখে রুচি নেই যে!

 ঝাল খেলে পেটেরটারও যে ঝাল লাগবে।

উঃ, কত কথাই যে জানো! তাহলে নতুন রকমের কিছু করে দাও। চেনা খাবার মুখে তুলতে ইচ্ছে করে না।

বামুন মেয়ে কি আর নতুন রান্না কিছু জানে? আচ্ছা দেখছি, আমার মাথা থেকেই যদি কিছু বেরোয়। তোর বাবা তো নানারকম খেতে ভালবাসত, তারই কোনও একটা ভেবেচিন্তে বের করি। বাঙাল রান্না খুব ভালবাসত। দেখি একটা বাঙাল দেশের পদই বেঁধে, উতরোয় কি না। এখন বরং দুটো শুকনো মুড়ি খা।

সে আর একা নয়। একা নয়। তার গর্ভে অনাগত সন্তান তাকে ডাকে, তার শরীর শুষে খায়, তার অন্ধকার গর্ভে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়।

ঘরে ঢুকে পারুল দেখে, ঠিক যেভাবে অমলকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল সেই একইভাবে বসে আছে সে। নড়েনি, চোখের পলকও ফেলেনি বোধহয়। যেন পাথরের মূর্তি।

অমলদা।

উ!

কী এত ভাবছ?

 অমল হাসল। বলল, কী যে ভাবি বলতে পারি না পারুল। ভাবনার কোনও মাথামুন্ডু নেই।

এত ভাবো কেন?

বললাম তো মাথাটা আমার বশে নেই।

মা বলছিল তোমার চেহারাটা ঝড়ো কাকের মতো হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, সেটা আমিও টের পাই।

অনেকদিন চুল কাটোনি, দাড়িও কামাওনি বোধহয় দিন দুয়েক।

 হ্যাঁ। ওসব ভালই লাগে না।

তা হলে কী ভাল লাগে?

কিচ্ছু না। বাঁচতেও ভাল লাগে না।

ওসব বলতে নেই অমলদা। ইচ্ছে করলেই মরা যায়। সহজেই। কিন্তু বাঁচাটাই শক্ত।

হ্যাঁ, আমারও বড় কঠিন মনে হয় বেঁচে থাকাটাকে। বড্ড কঠিন।

.

৩৪.

মরণের লেখাপড়া নিয়ে বাসন্তী বা রসিক বাঙাল কারওই তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিল না এতদিন। বাসন্তী লেখাপড়ার মর্ম তেমন বোঝে না। তবু তাড়না করতে হয় বলে তাড়না করে। আর রসিকের বক্তব্য একটু অন্যরকম। একদিন দুঃখ করে বলেছিল, আমার বড় পোলাখান হইল গুড বয়। হ্যায় লেখাপড়া শিখ্যা বিলাত আমেরিকায় যাইব। আমার ব্যবসা-বাণিজ্য লইয়া তার কোনও মাথাব্যথা নাই। তাই ভাবত্যাছি দোকানখান মরণন্যারেই দিয়া যামু। বুইঝ্যা চলতে পারলে খাইয়াপইর‍্যা থাকতে পারব।

বাসন্তীরও অমত ছিল না। তার বাপের বাড়িতেও লেখাপড়ার চর্চা নেই, সে নিজেও বেশি দূর পড়েনি। কাজেই মরণকে নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না তার।

কিন্তু সুমন এসে হিসেবের একটু ওলটপালট ঘটিয়ে দিল। এক রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে সে তার বাবাকে বলল, মরণের জন্য একজন টিউটর রাখা দরকার।

বাঙাল ইলিশমাছের ঝোল দিয়ে সাপুটে ভাত মাখছিল। মুখ তুলে বলল, নাকি?

হ্যাঁ। আমি ওর বইখাতা সব নেড়েচেড়ে দেখলাম, ওর প্রগ্রেস বেশ খারাপ। টিউটর ছাড়া ও কিন্তু ভাল করতে পারবে না। অঙ্কে ইংরিজিতে বেশ কাঁচা।

রসিক সাহা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে বলল, আরে বান্দরটা তো লেখাপড়াই করে না। আমিও থাকি না এইখানে। বান্দরটা তো ধরারে সরা পাইছে। তারাপদ নামে এক ছ্যামড়া তো ইংরাজি পড়াইত। হ্যায় নাকি অখন সময় পায় না।

সেইজন্যই বলছি, ওকে ভাল দেখে একজন টিউটর রেখে দাও।

রসিক সাহা সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে উঠে বলে, ঠিকই তো কইছস! আমার মাথায় তো কথাটা আসে নাই! কাইলই মাস্টার ঠিক করতে হইবো। যত টাকা লাগে, বেস্ট মাস্টার চাই।

টেবিলের অন্য ধারে সিঁটিয়ে বসে ছিল মরণ। গেল তার সব সুখ আর আনন্দ। গেল তার টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। পড়াশুনোর চেয়ে কষ্ট আর কীসে আছে। তার গলায় ভাতের গ্রাস আটকে রইল কিছুক্ষণ।

রসিক সাহা বাসন্তীর দিকে চেয়ে অত্যন্ত উত্তেজিত গলায় হেঁকে বলল, কও তো এইখানকার বেস্ট মাস্টার কে আছে। কাইলই খবর দিয়া আনাইতে হইবো।

বাসন্তী ভয় খেয়ে বলে, ভাল মাস্টারের খবর কি আর আমি জানি! কাল সকালে খবর নেবোখন।

আহা, সব ব্যাপারেই তোমরা বড় ঢিলা। আইজ রাইতেই খবর পাঠাইয়া দাও। কাইল সক্কালেই য্যান মাস্টার আইয়া হাজির হয়।

বাসন্তী শুকনো মুখে বলে, রাত দশটা যে বেজে গেছে। এখন কাউকে খবর পাঠালেই কি আসবে? কাল রবিবার আছে, কাল সকালেই খবর নেবোখন।

কার কাছে খবর নিবা?

সে অনেক লোক আছে। তুমি চিন্তা কোরো না।

 রসিক দমিত না হয়ে মরণের দিকে কটমট করে চেয়ে বলে, এই বান্দর, তর ইস্কুলে ইংরাজি পড়ায় কে?

মরণ ভয়ে ভয়ে বলে, ক্ষেত্রমোহনবাবু।

 ক্ষ্যাত্রমোহন! কাইল সকালেই গিয়া ডাইক্যা আনবি। আর অঙ্ক করায় কে?

কালীবাবু।

তারেও ধইরা আনবি।

আচ্ছা।

বাঙাল অত্যন্ত উত্তেজিত গলায় বলতে লাগল, কথাটা যে ক্যান আমার আগে মনে হয় নাই! ঠিকই তো, মাস্টার না হইলে কি আইজকাইল চলে? বান্দরটা তো হেই লাইগ্যাই দুই তিন সাবজেক্টে ফেল মাইরা মাইরা ক্লাসে ওঠে।

পর দিন সকালেই খোঁজখবর হতে লাগল। উত্তেজিত রসিক সাহা যার কথা শোনে তাকেই রেখে ফেলে আর কি।

সুমন বাপকে শান্ত করে বলল, এখনই বেশি টিউটর রাখার দরকার নেই। মোটে তো ক্লাস সিক্স। একজন হলেই চলবে। উঁচু ক্লাসে উঠলে সাবজেক্টওয়াইজ টিউটর রাখলেই হবে।

ধীরেন কাষ্ঠ সকালে এসেই ফেরে পড়ে গেল।

খুড়া, এইখানে ভাল মাস্টার কে আছে কন তো! একটু কড়া ধাতের শক্ত মাস্টার। আমার ছোট পোলাটা তো জাহান্নামে যাইত্যাছে।

তটস্থ ধীরেন কাষ্ঠ বলে, তার আর ভাবনা কী! পূর্ণশশী স্কুলের নরেন মাস্টারকে রাখো। অঙ্ক ইংরিজিতে তুখোড়, কত গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করছে।

তারেই লইয়া আহেন।

ধীরেন কাষ্ঠ হেসে বলে, দাঁড়াও বাঙাল, নরেন স্যারের যে অনেক টিউশনি। ব্যাচ ধরে পড়ায়। সে বাড়িতে আসবে না। খাঁইও খুব বেশি। বাড়িতে যদি চাও তাহলে সনাতন মাস্টারকে ধরতে পারো।

বিস্তর আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে বদরাগী, কেঠো চেহারার রসকষহীন পবিত্রবাবুকে রাখা সাব্যস্ত হল। কাছেই বাড়ি, মানুষটাও রসিক বাঙালের চেনা। বাইরের ঘরখানা তুলতে গিয়ে একবার রসিকের কাছে হাজার খানেক টাকা হাওলাত করেছিলেন।

পবিত্রবাবু এলেন বেলা এগারোটা নাগাদ। এসেই বললেন, ওর তো ভিতই কাঁচা রয়ে গেছে, খাটতে হবে।

বাঙাল সঙ্গে সঙ্গে বলে, আরে খাটবেন খাটাইবেন তবে না কাম আউগ্যাইব। কত টাকা চান কন।

পবিত্রবাবু গরজ দেখে একটু বেশিই হাঁকলেন। রসিক সঙ্গে সঙ্গে রাজি, আইজই লাইগ্যা পড়েন।

আজ রোববার। রোববারে পড়াই না। কাল থেকে আসব। স্কুলের পর, বিকেল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায়।

মরণ প্রমাদ গুনল। গেল তার ফুটবল, ব্যাটবল, দৌড় ঝাঁপ। ইস্কুলের পরই এসে পড়তে বসতে হবে। চোখে জল আসছিল তার।

রান্নাঘরে গিয়ে ছলোছলো চোখে মাকে বলল, বিকেলে পড়তে হয় বুঝি! আমি কিছুতেই বিকেলে পড়ব না।

ওরে চুপ! চুপ! তোর বাবার কানে গেলে কুরুক্ষেত্র হবে।

 জিজিবুড়ি উনুনের ধারে শীতে জড়সড় হয়ে বসা। হাতে দুধে গোলা চায়ের গ্লাস। বিষ চোখে নাতির দিকে চেয়ে বলে, ম্যাস্টার এসে তো সগগে তুলবে। বাপের টাকা তো গাছে ফলেছে কি না, চোখে ভেলভেট দেখছে।

বাসন্তী চাপা গলায় বলে, আঃ, চুপ করো তো মা! ওর বাবা শুনতে পেলে রক্ষে রাখবে না।

 বলি ম্যাস্টার কি বইখাতা জলে গুলে খাইয়ে দেবে? বাপেরই বা বিদ্যে কত?

ওর বাপের বিদ্যের খতেন নিচ্ছ কেন? বাবা কি ফ্যালনা?

ফ্যালন কি না জানি না বাপু। তবে বিদ্যেধর বলেও শুনিনি। বড়বাজারের গদিতে বসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামায়, এইটুকুই জানি।

তাতে কী হল? সেটা করতেও মুরোদ লাগে।

তা সেই বিদ্যেতে লাগিয়ে দিলেই তো পারে ছেলেকে। লেখাপড়া শিখে তো হচ্ছে লবডঙ্কা। বি এ, এম এ পাস ছোঁড়াগুলো ভেরেন্ডা ভাজছে দেখছিস না চারদিকে? আর পবিত্র মাস্টারেরই বা কী ছিরি। কালও তো দেখলুম দুখনের গোয়ালঘর থেকে গামলাভর্তি গোবর নিয়ে যাচ্ছে। ওই কি আবার একটা ম্যাস্টার হল বাপু? নিত্যি আমাশায় ভুগছে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঘটি নিয়ে দৌড়োচ্ছে পায়খানায়। ও আবার কী পড়াবে শুনি! গাঁয়ে আর মাস্টার পেলি না!

বাসন্তী একটু দমে গিয়ে বলে, তা মাস্টারের মর্ম আমরা কী জানি বলো! ধীরেনখুড়ো বলল, তাই

আহা, ওই জুটেছে এক ধীরেন ছুঁচো। সারাদিন এ-বাড়ি ও-বাড়ি ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছে আর কার মাথায় কাঁঠাল ভাঙবে সেই মতলব কষছে। বাঙালের সঙ্গে অত গলাগলি কীসের লা ছুঁচোটার? ইনিয়ে বিনিয়ে অভাবের কথা গেয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কি না খবর রাখিস? অত আনাগোনা তো ভাল নয় বাপু!

আহা, ওরকম বোলো না তো৷ ধীরেন খুড়ো তো দুঃখী লোক।

ভেজা বেড়াল। বাঙাল যেমন হদ্দ বোকা, তেমনি তুই। ধীরেনের ছেলেগুলোর খবর রাখিস? একটা জুয়ো খেলে বেড়ায়, অন্যটার ছ্যাঁচড়ামি করে চলে। সাধ করে আবার ছেলের বিয়ে দিয়েছে ধীরেনের বউ মাগী। এখন শাউড়ি-বউতে চুলোচুলি হচ্ছে রোজ। অভাবী লোক হলেই কি আর ভাল লোক হয়? ঝেটিয়ে বিদেয় করে দিবি এর পর আবার এলে।

বাসন্তী কড়াইতে ফোড়ন ছাড়তে ছাড়তে বলে, ওসব আমি পারব না। ধীরেনখুড়োকে মরণের বাবা ভারী পছন্দ করে।

ওই তো বললুম, শালুক চিনেছে গোপালঠাকুর। যেদিন গাঁটগচ্চা যাবে সেদিন বুঝবি। টাকার দেমাকে বাঙালের কি আর মাথার ঠিক আছে! আর ওই খ্যাঁকশেয়ালটাও টাকার গন্ধে গন্ধে রোজ এসে ঢুঁ মারছে। সেদিন এক গোছা রুটি খেল, একদিন আবার ডিম ভাজা দিয়ে চিড়ের পোলাও। রোজই তো এসে সেঁটে যাচ্ছে দেখছি। অন্নসত্র তো আর খুলে বসিসনি! মুখের ওপর সে কথাটা একদিন শুনিয়ে দিবি।

মরণ এসব শুনে-টুনে খুব আশায় আশায় বলে, পবিত্র মাস্টারমশাই ভীষণ রাগী লোক, খুব মারে।

জিজিবুড়ি বলে, তা মারবে না কেন? পরের ছেলের পিঠ তো। হাতের সুখ করলেই হল!

 ও মা, বাবাকে বলে দাও না, আজ থেকে আমি নিজে নিজেই পড়ব। খুব ভাল করে পড়ব।

বাসন্তী ছেলের দিকে চেয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, দাদা কী বলল কাল রাতে, শুনিসনি? লেখাপড়া কিচ্ছু হচ্ছে না। দুটো তিনটে বিষয়ে ডাব্বা খেয়ে উঠছ। সেটা কি ভাল দেখাচ্ছে? দাদা কত ভাল ছাত্র! তার ভাই হয়ে

জিজিবুড়ি চাপা গলায় বলে, আহা, ভাই বড় এক মায়ের পেটের কিনা। সৎ ভাই আবার ভাই! কলকাত্তাই চাল মারতে এয়েছে। তা ওইটুকুন ছোঁড়া এখন তোদের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাবে নাকি? সে বলেছে বলেই মাথা কিনে নিয়েছে?

বাসন্তী বলে, আচ্ছা, খারাপ কথা কি বলেছে কিছু? ভাইয়ের লেখাপড়া নিয়ে ডাকখোঁজ করা কি খারাপ? তোমার কেন গায়ে জ্বালা ধরছে!

বলি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা করে ছেলেকে বিদ্যেসাগর বানিয়ে তোর হবে কোন অষ্টরম্ভা? একটা দুটো বিষয়ে ফেল করে তা করুক না। ক্লাসে তো উঠছে ফি বছর! ওর বেশি বিদ্যের দরকারটাই বা কী? আর ও ছোঁড়াই বা এসে গেড়ে বসে আছে কেন কিছু আঁচ করতে পারলি?

তোমার যেমন কথা! গাঁয়ে বেড়াতে এসেছে তাতে দোষের কী হল বলল তো! এটাও তো ওর বাবারই বাড়ি।

সেই কথাই তো বলছি লা! এটা যে ওর বাবার বাড়ি সেটা বুঝে নেওয়ার জন্যই তো এসেছে। বিষয়সম্পত্তির খোঁজখবর নিচ্ছে। যদি ভাল চাস তো দলিলপত্র একজন ভাল উকিলকে দেখিয়ে রাখ। দলিলে কোন ফাঁকফোকর আছে কে জানে বাবা। কোন দিন থাবা মেরে সব নিয়ে নেবে, তোর তখন হাতে হ্যারিকেন।

বাসন্তী ডাল ফোড়নে ছেড়ে বিরক্তির গলায় বলল, তোমার মাথায় সেই যে পোকা ঢুকেছে আজও তা গেল না।

তোর ভালর জন্যই বলি। বেড়াতে এসে কেউ সৎ মায়ের বাড়িতে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে? এর পিছনে মতলব নেই বলছিস! তুই আহাম্মক বলেই বিশ্বাস করিস ও কথা। খোঁজ নিলে দেখবি, বড়বউ যুক্তি করে পাঠিয়েছে। ছেলে এসে সব দেখে গেল, এর পর একদিন বড়বউ এসে তোকে উৎখাত করবে।

অত সোজা নয় মা। দেশে আইন আছে।

আইন আছে না হাতি। এই তো মহেশের বিধবা বউয়ের জমি তার ভাসুর গাপ করে নিল। পারল কিছু করতে?

কপালে যা আছে তাই তো হবে! আগে-ভাগে ভেবে কী করব বলো! তা বলে আমি তো ছেলেকে তাড়াতে পারি না। এ-বাড়িতে ওর জোর আছে।

সে তুই হাঁদারাম বলে পারিস না। তোর জায়গায় চালাক মেয়েছেলে হলে ও ছেলে পালাতে পথ পেত না। বলি বাছা, বাঙালকেই বা বিশ্বাস কী? সাঁট হয়তো সেও করেছে। তোকে তো আর বউ বলে ভাবে না। তার মতলবও খারাপ হতে পারে।

এবার দয়া করে যাও মা, বসে বসে আমার মাথাটা আর চিবিয়ে খেও না। তোমার এমন সব কথা যে বুক কাঁপে।

আমারও বুক কাঁপে মা, ছেলেপুলে নিয়ে না তুই পথে বসিস। আমি বলি কী, গোপনে গোপনে কিছু কিছু করে জমি বেচে দে। দিয়ে নগদ টাকা হাতে রাখা তোর ছোড়দা বলছিল, খালধারের জমিটা পরাণ দাস কিনতে চাইছে। পাঁচ হাজার করে বিঘে। চার বিঘে বেচলে নগদ বিশ হাজার টাকা আসবে হাতে। টাকাটা হাতে রাখ। অভাবে পড়লে কাজে দেবে।

আর সে বুঝি টের পাবে না? অনেক কুচুটেপনা করেছ, এবার যাও। প্রত্যেক দিন সকালবেলাটায় এসে তুমি আমার মেজাজটা খারাপ করে দিয়ে যাও। বয়স তো হয়েছে, এবার একটু ঠাকুরদেবতার এসে তুমি পার না ঘরে বসে?

জিজিবুড়ি সঙ্গে সঙ্গে ভারী ভালমানুষের মতো বলল, কী ডাল রাঁধলি আজ? সোনামুগ মনে হচ্ছে। ডালের মাথায় একটু কাঁচা ঘি ঢেলে দে তো একবাটি, নিয়ে যাই। দুপুরে ভাতের সঙ্গে খাবোখন।

এখন পারব না মা। পরের দিকে এসে নিয়ে যেও, আর বাটিও এনো। গেল হপ্তায় দু দুটো কাঁসার বাটি নিয়ে গেছ, ফেরত দাওনি।

কে বলল দিইনি?

আমার সব হিসেব আছে।

বুড়ো বয়সে ভুলভাল হতে পারে। দেখবখন খুঁজে।

আর খুঁজেছ। ও বাটি আমার গেছে, এখন থেকে কিছু নিতে হলে নিজের বাসন এনো, এই বলে দিলাম।

আর খুঁড়িস না বাপু, অভাবে পড়লে লোকে কত কী ভাবে। পেটের মেয়ে হয়ে শেষে আমাকে চোরও বলতে লেগেছিস!

মোটেই চোর বলিনি, বাটি দুটো ফেরত দিতে বলেছি, ভারী খাগড়াই বাটি, এ-তল্লাটে অমন জিনিস পাওয়া যাবে না।

আচ্ছা বাপু, খুঁজে দেখবখন।

.

মরণের মনে হচ্ছে ভগবান বলে কেউ নেই। তিন দিন হয়ে গেল, বিকেলের নরম রোদে যখন বাইরের মাঠঘাট তার বয়সি ছেলেদের আয়-আয় করে ডাকে, তখন পবিত্র স্যারের রাগী আর চোয়াড়ে মুখের দিকে বেচারার মতো চেয়ে তাকে বসে থাকতে হয়। তিন দিনে তেমন শাসন না হলেও গোটা দুই গাঁট্টা খেতে হয়েছে তাকে।

আজকাল দাদাকে তার বিশেষ ভাল লাগছে না। তার এই সর্বনাশটা দাদা না করলেও পারত।

কদমগাছটার তলায় গিয়ে ছুটির দুপুরে সে শিবঠাকুরকে কম ডাকাডাকি করেনি দুদিন। কিন্তু শিবঠাকুর বোধহয় নেশাভাঙ করে পড়ে আছেন, কান দেননি তার কথায়।

চিকু বলে, আরে শিবঠাকুর বর দিলেও ভুলে যায়। তার চেয়ে কালীকে বল। কালী হচ্ছে জাগ্রত ঠাকুর। দেখসনা জিবটা কেমন লকলক করে!

কালীও তার কথা শুনবে বলে আর ভরসা হয় না মরণের। সে বলে, ধুর, ভগবান-টগবান নেই।

ভগবানের দোষ কী জানিস? ছোটদের কথা একদম শুনতে চায় না।

তাই হবে বোধহয়। মুশকিল হল, ছোটদের কথা কেউই তেমন শুনতে চায় না।

চিকু বলে, ভগবানদের ঘুষ-টুসও দিতে হয়।

কীরকম ঘুষ?

যার যেমন ক্ষমতা। সোয়া পাঁচ আনা বা পাঁচ সিকে।

সোয়া পাঁচ আনা কত পয়সায় হয়?

তা বলতে পারব না, আনা ফানা তো এখন পাওয়া যায় না। মার কাছে শুনেছি তাই বললাম।

আমিও শুনেছি।

স্কুলে এখন পুজোর লম্বা ছুটি চলছে। তাই দিনমানে কিছু সময় পাওয়া যায়। তাও কমে এসেছে। পবিত্র স্যার মেলা হোম টাস্ক দিয়ে যান রোজ। সকালে আর দুপুরে সেগুলো করতে হয়। এত দিন এসবের বালাই ছিল না।

গত তিন দিন দাদার সঙ্গে প্রায় কথাই বলেনি মরণ। তিন দিন পর দাদা দুপুরে ডাকল।

 আয়, রোজ দুপুরে আমার ঘুমোতে ভাল লাগে না। কলকাতায় তো কখনও দুপুরে ঘুমোই না।

দুপুরে তাহলে কী করো?

বাড়িতেই থাকি না। হয় কলেজ থাকে, নয়তো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিট করি, সিনেমা-থিয়েটার এগজিবিশন কত কী থাকে। বাড়িতে আর কতক্ষণ থাকি? এখানে তো সময়ই কাটতে চায় না।

আমার কিন্তু এখানেই বেশ ভাল লাগে। কত কী করার আছে।

সুমন হাসে, তোর করা তো জানি। এ বাড়ির নারকোল পেড়ে দিস, ও বাড়ির সুপুরিগাছে উঠিস।

লজ্জা পেয়ে হাসে মরণ, কী করব, সবাই আমাকে ডাকে যে।

এখন থেকে ওসব কাজ করার জন্য পয়সা নিবি।

 মরণ অবাক হয়ে বলে, পয়সা?

কেন নয়? বলবি সুপুরি পাড়তে পাঁচ টাকা, নারকোল দশ।

এ মাঃ, তাহলে আমাকে ডাকবে কেন? কুমোরপাড়ার ছেলেরাই তো আছে। ওরা পয়সা পেলে পেড়ে দেয়।

তোকে পয়সা চাইতে বলেছি অন্য কারণে, চাইলে আর ডাকবে না।

 কিন্তু আমার যে খুব ভাল লাগে।

তোর মা জানে যে তুই অত উঁচু উঁচু গাছে উঠিস?

তোর মা কথাটা খট করে কানে লাগল মরণের। মৃদুস্বরে বলল, একটু একটু জানে। আগে বকত, আজকাল কিছু বলে না।

বাবা জানে?

উরে বাবা।

বাবাকে ভয় খাস খুব?

 খুব।

 সুমন বলল, গাছে ওঠা খুব সেফ ব্যাপার নয়।

আমি খুব ভাল গাছ বাইতে পারি। বেলগাছের মগডালে উঠে যাই, কিছু হয় না।

লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে না?

পড়ি তো।

সুমন হাসল, কেমন পড়িস তা জানি।

মরণ লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল।

লেখাপড়া করাটা শক্ত কিছু নয়। তোর তো মাথা আছে।

 মাস্টারমশাইরা বলে আমার মাথায় গোবর।

গোবর ভাবলে গোবরই হয়।

 আমার খুব কলকাতার ইস্কুলে পড়তে ইচ্ছে করে।

কলকাতা! সেখানে গিয়ে কি থাকতে পারবি? কলকাতায় তো গাছ-টাছ নেই।

 মরণ লজ্জার হাসি হাসে।

 কলকাতায় যাওয়ার শখ হল কেন?

বাঃ, কলকাতায় বড়মা আছে, দিদি আছে। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে যায়।

কথাটা বুঝতে না পেরে চেয়ে রইল সুমন। তারপর বলল, তারা কারা?

 বাঃ, বড়মা আর দিদি আছে না সেখানে!

বুঝতে একটু সময় লাগল সুমনের। মুখটা মলিন হয়ে গেল তার। ধীর গলায় বলল, আমাদের বাড়ির কথা বলছিস!

হ্যাঁ তো।

খুব নিস্পৃহ গলায় সুমন শুধু বলল, ও।

একটু দমে গেল মরণ। কই, দাদা খুশি হল না তো! বলল না তো, বেশ তো, যাবি আমাদের বাড়ি!

মরণ ভয়ে ভয়ে বলল, কলকাতার স্কুলও তো কত ভাল।

সুমন একটু চুপ করে থেকে বলে, নিজে যদি পড়িস তাহলে স্কুল নিয়ে ভাবতে হবে না।

.

বাঙাল না থাকলে সকালবেলাটায় এবাড়িতে মোটা জলখাবারটা জোটে না। তবে চা-বিস্কুটটা দেয় বাসন্তী। ধীরেনের খই বেশি নয়, জোটে ভাল, না জুটলেও ক্ষতি নেই।

আজও সকালবেলাটায় এসে পড়েছে ধীরেন। অন্য সব বাড়িও আছে, কিন্তু সব বাড়িতে সবসময় জুত হয় না। এই তো সেদিন মহিমদার বাড়িতে গিয়ে ভারী বিপদ হল, সকালবেলায় সেখানে তুমুল কাণ্ড। ওপরতলা থেকে অমলের বিলেতফেরত বউ চেঁচিয়ে সন্ধ্যাকে গালমন্দ করছিল আর সন্ধ্যাও সপাটে চোপা করছিল। দূর থেকে কাণ্ড দেখে সটকে পড়েছিল ধীরেন। এসব তার বাড়িতেও নিত্যি হচ্ছে। আকথা কুকথা শুনে শুনে কানেও সয়ে গেছে সব। তবে অশান্তির বাড়িতে গেলে দু-দণ্ড বসার উপায় থাকে না।

সেদিক দিয়ে বাঙালবাড়ি ভাল। এ বাড়িতে ঝগড়াঝাটি হয় না। আসলে জনও তো নেই তেমন। তবে দু বউ একত্র হলে সে একটা কাণ্ডই হবে বোধহয়।

বারান্দায় বসে গলাখাঁকারি দিয়ে নিজেকে একটু জানান দিল ধীরেন।

কেউ কোনও সাড়া দিল না। দুটো কাজের মেয়ে উঠোন ঝটপাট দিচ্ছে। ভারী ব্যস্ত। তা ধীরেনেরও তাড়া নেই। কাজই বা কী তার? বসে বসে সে উঠোনের রোদ, পেয়ারাগাছের শালিখ, বাঁশের ডগায় কাক, বারান্দার নীচে কুণ্ডলী পাকানো নেড়ি কুকুর– এইসব দেখছিল।

রান্নাঘরের দিক থেকে একটা ঝনঝনে গলার আওয়াজ এল হঠাৎ, ওই যে এয়েছে বাঙালের ধর্মবাপ। এবার যা গিয়ে পিণ্ডি গিলিয়ে আয়।

গলাটা খুব চেনা ধীরেনের। বাসন্তীর মা। গণেশ দাস যখন বিয়ে করতে আতাপুর গিয়েছিল তখন বরযাত্রীদের দলে ধীরেনও ছিল। ঘটাপটার বিয়ে নয়, নমো নমো বিয়ে, মাছটা খাইয়েছিল খুব। সব মনে আছে ধীরেনের। আঠেরো টুকরো মাছ খেয়ে যা একখানা ঢেঁকুর তুলেছিল তার গন্ধ যেন আজও নাকে ভেসে আসে। গণেশদার বউ কিন্তু গাঁয়ের মেয়ে আন্দাজে ভারী লক্ষ্মীমন্ত সুন্দর ছিল দেখতে। হাত পায়ের গড়ন পেটন, মুখের উঁচ সবই ভারী ভাল। বলতে নেই, বউ দেখে ধীরেনের এমন কথাও মনে হয়েছিল, আহা, আমার যদি এমন একখানা বউ হত!

সেই তারই গলা। গণেশদা পটল তুলেছে সেই কবে, দুটো ছেলে আর এই মেয়ে বাসন্তীকে নিয়ে বিধবা হল মনোরমা। ক্রমে ক্রমে মানুষ যে কী থেকে কী হয়ে যায় তা দেখলে ভারী ভয় হয় ধীরেনের।

মনোরমা তাকে শুনিয়েই বলল, ভাগাড়ের শকুন সব এসে জোটেও বাপু। গুচ্ছের গিলবে, ছোঁক ছোঁক করবে, মাথায় হাত বুলিয়ে তোতাই পাতাই করে টাকাপয়সা আঁকবে, হাড়ে হাড়ে চিনি বাপু।

আহা, চুপ করো না মা, শুনবে যে।

শোনানোর জন্যই তো বলছি। সক্কালবেলাটায় কাকে গু খাওয়ার আগেই মড়া কেন মরতে আসে ভেবে দেখেছিস? কোন পিরিতের মানুষ রে! আবার জামাই-আদর করে চা-বিস্কুট সাজিয়ে দেওয়া! চা পাতা, চিনি, দুধ- এসবের দাম জানে না!

পায়ে পড়ি মা, চুপ করো, ওরকম বলতে নেই।

দুদিন চারদিন আসে না হয় কিছু বলতুম না। তা বলে রোজ সকালে এসে থানা গেড়ে বসে কোন আক্কেলে?

ধীরেন কাষ্ঠ বুঝল, শব্দভেদী বাণ তার উদ্দেশ্যেই ছোঁড়া হচ্ছে। ধীরেন উঠে পড়ল। মরণের বাবা শুনলে ভারী দুঃখ পাবে।

তা পায় পাক বাছা, তা বলে স্পষ্ট কথা বলতে আমি ছাড়ব না, তোর বাপ বেঁচে থাকতে কম জ্বালিয়েছে আমাকে? গিয়ে সঁত বের করে হাত কচলে ধানাইপানাই কথা। তারপর এটা দাও, সেটা দাও।

কথাটা মিথ্যে, গণেশদার অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। ধীরেনও বিশেষ যেত-টেত না। কিন্তু প্রতিবাদ করে হবেটাই বা কী? লোকে যা ভাবে তাই বলে। যা ঘটে তা তো বলে না সবসময়।

রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে বাসন্তী। ধীরেনখুড়ো কোথায় যাচ্ছেন? বসুন না। ইয়ে, আজ বড্ড রোদ উঠে গেছে মা। আজ বরং যাই। চা হচ্ছে তো। বসুন।

ঘরের ভিতর থেকে ঝনঝনে গলাটা বলে উঠল, যেতে চাইছে দে না যেতে। তোর আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না।

ধীরেন একটু দাঁড়িয়ে থেকে ফের বসে পড়ল। গাঁয়ে তার বসবার জায়গা কমে আসছে। লক্ষণটা ভাল নয়, কথাগুলো গায়ে মাখলে তার চলবে না।

.

৩৫.

গাড়িটা ঠিক করে দিয়েছে কমল। সে সব সুলুকসন্ধান জানে। সুবিধেজনক গাড়ি নয়। বহু পুরনো অ্যাম্বাসাডর ল্যান্ডমাস্টার। সিটে বসলেই বোঝা যায়, ফোম রবার চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে গেছে, স্প্রিং ঠেলে উঠছে ওপরে। নানারকম কাঁচকোঁচ শব্দ তো আছেই। মফস্বলের ভাড়ার গাড়ি এরকমই হয়ে থাকে।

সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে কমল, ধারে বুডঢা। পিছনে একধারে সোহাগ, মাঝখানে মোনা, বাঁ ধারে অমল। সবাই চুপচাপ। শুধু কমলই যা কথা বলছে। সে বোকাসোকা সরল মানুষ, কথা একটু বেশিই বলে ফেলে।

বুঝলি বুডঢা, এ-গাড়িতে চোদ্দজন তোক উঠতে আমিই দেখেছি। কী মদন, চোদ্দজন করে নিস না?

মদন একটু খোটকামুখো অল্পবয়সি ছেলে। তেমন হাসে না, কথাও কয় না। দুবার জিজ্ঞেস করার পর বলল, না নিলে পাবলিক ছাড়বে কেন?

কমল বলল, শুনলি তো! এ-গাড়িতে চোদ্দজন, ভাবা যায়?

বুডঢা বলল, পুলিশে ধরে না?

হাটবার বা মেলা-টেলার দিন কোথায় পুলিশ, কোথায় কে? এখানে ওসব আইনকানুনের বালাই নেই। পুলিশ ধরতে এলে পাবলিকই ঠেঙিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে। কী বলিস মদন?

মদন জবাব দেয় না।

বুডঢা বলল, ওঃ হাঁটুতে যা গরম লাগছে না!

কমল বলে, লাগবেই তো! ইঞ্জিন থেকে ভাপ আসছে না? পুরনো গাড়ি হলে যা হয়। আজকের গাড়ি নাকি? যখন নিশিবাবু কিনেছিল তখন থেকে জানি। হেসেখেলে পঁচিশ বছর হবে। দিব্যি সাদা রং ছিল গাড়িটার। তখন শুনতুম মরিস গাড়ির পার্টস দিয়ে তৈরি। তাই হবে বোধহয়। দিশি মাল হলে এতদিন চলত না। কী বলিস রে মদন! তুই তো গাড়ির একজন এক্সপার্ট!

মদন জবাব দেয় না।

কমল ওরকমই, ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। সকলকেই খাতির মহব্বৎ করে বেড়ায়। আর সেই জন্যই কেউ পাত্তা দেয় না তাকে। তবে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না কমল। ভাল মানুষদের যে বাজারদর কম সেটা বুঝবার মতো মস্তিষ্ক তার নেই।

খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা চোয়াড়ে চেহারার ছোকরা ড্রাইভারটাকে মোটেই ভাল লাগছিল না অমলের। দাদার ওপরেও বিরক্ত হচ্ছিল সে। কী কাজ গায়ে পড়ে আলাপ জমানোর? ট্রিপ দিয়ে পয়সা নেবে–এর চেয়ে বেশি সম্পর্ক তো আর নয়।

কমল বেশ বড়াই করে বলল, তোর পচা গাড়িতে যাচ্ছে বলে এদের হেঁজি-পেঁজি লোক ভাবিস না। আমার ভাই মস্ত চাকরি করে। বুঝলি?

মদন বুঝল কিনা কে জানে, তবে উচ্চবাচ্য করল না। দাদাকে একটা ধমক দেওয়ার ইচ্ছে অতি কষ্টে সংবরণ করল অমল।

কমল বলে যাচ্ছিল, ওদের নিজেদেরই তো কত দামি গাড়ি আছে। এস্টিম না কী যেন রে বুডঢা?

এস্টিম।

এস্টিম, বুঝলি? এয়ারকন্ডিশন গাড়ি, গায়ে আমাদের রাস্তাঘাট খারাপ, শরৎকাল পেরিয়েও জলকাদা জমে থাকে, তাই গাড়ি আনে না। নইলে কি আর তোর গাড়িতে চড়ে?

এবার মদন বোধহয় একটু প্রভাবিত হল। বলল, এস্টিম ভাল গাড়ি। দুর্গাবাবুর আছে, চালিয়েছি।

পঞ্চায়েত এবার রাস্তাঘাট সারাবে শুনছি, তখন আনবে, দেখিস।

কমলের কথাটা মিথ্যে নয়। বড় রাস্তা ছেড়ে গাঁয়ের পথে পড়লেই খানাখন্দ, জল কাদা। মোনা তাই কিছুতেই গাড়ি নিয়ে গ্রামে আসতে রাজি হয়নি। বলেছে, ও বাবা! ও রাস্তায় গাড়ির বারোটা বেজে যাবে।

গাড়ি নিয়ে এলে ঝামেলা অনেক কম হত। দুর্গাপুর রোড ধরলে কলকাতা থেকে বর্ধমান ঘণ্টা দুয়েকের পথ।

তারা কেউ কথা কইছে না। শুধু কমল একা কথা বলে যাচ্ছে। এবার মদনের কাছে সে ভাইয়ের বিলেতে থাকার কথা ফেঁদে বসল। অমলের ভারী লজ্জা করে, রাগও হয়। না শোনার জন্য সে চোখ বুজে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। আজকাল তার যখন-তখন ঘুম এসে যায়। একটু চেষ্টা করলেই এসে যায়। এটা সম্ভবত শুভ লক্ষণ নয়। মস্তিষ্কবিহীন মানুষদেরই চটপট যখন-তখন ঘুম আসে। কলকাতায় রাস্তায় ঘাটে, পার্কে, রকে দিনের বেলায় সে এরকম সব নিষ্কর্মা, নির্বোধ বহু লোককে ঘুমাতে দেখেছে।

আজও অমলের ঘুম চলে এল।

 চটকাটা ভাঙল বর্ধমানে গাড়ি ঢোকার পর। হাজারো রিকশা আর গাড়ির হর্ন, ধুলো, গরম, চেঁচামেচি। গ্রামের চেয়ে শহরে গরম বেশ কয়েক ডিগ্রি বেশি। গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে এসে ঢুকলেই সেটা টের পাওয়া যায়। কলকাতায় গরমটা আরও একটু বাড়বে।

দু-তিনটে জ্যাম পেরিয়ে স্টেশন চত্বরে যখন পৌঁছল তারা তখন ডাউন শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস আসতে মিনিট কুড়ি বাকি। কমল ছুটল টিকিট কাটতে। বলে গেল, মালপত্র আমি এসে নামাচ্ছি। তোরা দাঁড়া।

অমল নেমে ড্রাইভারকে দিয়ে লাগেজ বুটটা খোলাল। বিশাল বড় দুটো ফাইবারের সুটকেস ছাড়াও রয়েছে গোটা তিনেক ব্যাগ। মাল বড় কম নয়।

মোনা বলল, উনি তো বলেই গেলেন উনি এসে মাল নামাবেন, তুমি টানাটানি করছ কেন?

অমলের একটু রাগ হল। সামান্যই। মোনার দিকে চেয়ে রুক্ষ গলায় বলে, উনি কিন্তু কুলি নন, আমার দাদা। কথাটা মনে রেখো।

আহা, খারাপ কিছু বললাম নাকি? উনি হয়তো একটা ব্যবস্থা করার কথা ভেবে রেখেছেন।

অমল খুব শক্তিশালী লোক নয়। বড় সুটকেস দুটো নামাতে তাকে রীতিমতো কসরত করতে হচ্ছিল।

মদন তাকে আপনি সরুন, আমি দেখছি বলে এক ঝটকায় স্যুটকেস দুটো নামিয়ে দু হাতে নিয়ে বলল, চলুন, প্ল্যাটফর্মে দিয়ে আসছি।

এই লোকটা তার চেয়ে বলবান, একথা ভেবে অমল হঠাৎ একটু ঈর্ষা বোধ করল। তার মস্তিষ্ক প্রখর, সোনার মেডেল-টেডেল পেয়েছে, তবু কত লোকের কাছে কতভাবে সে একজন হেরো।

টিকিটঘরের সামনে সুটকেস দুটো নামিয়ে মদন ভাড়া নিয়ে চলে গেল। স্টেশনটায় গিজগিজ করছে। ভিড়। ট্রেনে জায়গা পাওয়া নিয়ে সমস্যা হতে পারে।

অমল একটা স্বগতোক্তির মতো বলল, একটা কুলি নিলে হয়।

 বুডঢা কাঁধ কঁকিয়ে বলে, কুলি! কুলির কী দরকার? আমি একাই পারব।

অমল মৃদু হতাশার গলায় বলে, পারবি না। ওভারব্রিজ পার হতে হবে।

 জানি। ঠিক পারব।

কমল টিকিট কেটে এনে বলল, সেকেন্ড ক্লাসই কাটলাম, বুঝলি?

অমল বিরক্ত হয়ে বলে, কেন, সেকেন্ড ক্লাস কাটলে কেন? তোমাকে যে বললাম, এ সি চেয়ারকার কাটতে।

মুশকিল কী জানিস, এ সি মোটে একটা কামরা। সিট না পেলে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। আর সেকেন্ড ক্লাস হলে অনেক সুবিধে। করিডোর ট্রেন, একটা কামরায় সিট না পেলে আর একটায় চলে যেতে পারবি।

কিন্তু ভিড় থাকলে মালপত্র নিয়ে ওঠা প্রবলেম হবে না?

কোনও অসুবিধে নেই। এ সি-তেও উঠতে পারিস। টিকিট কনভার্ট করে নিলেই হবে।

এ-দেশে এই যে যাতায়াতজনিত নানা অসুবিধে এসব অমলের ঠিক ধাতে সয় না। লড়াকু লোকেরা এসব ঝঞ্ঝাট হাসিমুখে সয়ে বয়ে নিতে পারে। কিন্তু সে লড়াকু লোক নয়। সামান্য সমস্যাই তার কাছে বিরাট হয়ে দাঁড়ায়। টেনশন বাড়তে থাকে।

এখানে ট্রেনটা কতক্ষণ দাঁড়ায় বলতে পারো?

দু মিনিট।

মাত্র?

দু মিনিট কি কম সময়?

আবার একটা টেনশন তৈরি হল অমলের। মাত্র দু মিনিটে কি তারা চারজন, দুটো বড় স্যুটকেস, ব্যাগ-ট্যাগ সমেত ভিড়ের ট্রেনে উঠতে পারবে? ধাক্কাধাক্কি হবে না?

স্যুটকেস দুটো কমল আর বুডঢা ভাগাভাগি করে নিল।

 কত নম্বর প্ল্যাটফর্ম?

কমল মাথা নেড়ে বলে, এখনও অ্যানাউন্স করেনি। এখন ওভারব্রিজে উঠে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তিন বা চার নম্বরে দেয়। দুটোই আলাদা প্ল্যাটফর্ম তো!

ঈর্ষাকাতর চোখে অমল দেখল, কমল আর বুডঢা ভারী স্যুটকেস দুটো নিয়ে দিব্যি ওভারব্রিজে উঠে যাচ্ছে।

না, সে পারবে না। তার গায়ে অত জোর নেই।

 ওভারব্রিজের ওপরে এসে মাঝামাঝি জায়গায় তাদের দাঁড় করিয়ে কমল বলল, এখানেই দাঁড়াও সবাই।

অমল দেখল ওভারব্রিজের ওপর বিস্তর লোক দাঁড়িয়ে আছে, কোন প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দেবে সেই অপেক্ষায়।

ডিসগাস্টিং! কোন প্ল্যাটফর্ম সেটা পর্যন্ত আগে জানানো যায় না! এটা কি একটা সিস্টেম? দেশটা যে কী ভাবে চলে কে জানে!

বিড়বিড় করে বললেও অমলের কথা কমলের কানে গেল। সে ভাইকে খুশি করার জন্য বলল, ঠিকই তো! এদেশের কি আর সাধে অত অবনতি! তবে তুই ভাবিস না, ঠিক তুলে দেব। লোকাল ট্রেনে গেলে একটু সময় লাগে বটে, কিন্তু কোনও টেনশন থাকে না। দিব্বি হেসে খেলে হাত-পা ছড়িয়ে যাওয়া যায়।

অমল ঝাঁঝের সঙ্গে বলে, তোমাদের লোকাল ট্রেনকেও জানি। হকারের চেঁচানিতে মাথা ধরে যায়। তার ওপর চারদিকে নোংরা, ভিখিরির উৎপাত। তিনজনের সিটে ঠেলে চারজন বসবে, বিড়ি ফুকবে, বারবার টাইম জিজ্ঞেস করবে।

কমল সেঁতো হাসি হেসে বলে, হ্যাঁ, খুবই বিচ্ছিরি।

 মাইকে কী একটা ঘোষণা হচ্ছিল, গমগমে শব্দের দরুন তার এক বর্ণ বুঝতে পারল না অমল। কিন্তু কমল সোল্লাসে বলে উঠল, চার নম্বরে দিয়েছে! চল, চল, ট্রেন ঢুকল বলে।

ফের টেনশন শুরু হয় অমলের। মালপত্র ওঠানো, নিজেরা ওঠা, জায়গা পাওয়া ইত্যাদি কত যে অনিশ্চয়তা তার ঠিক নেই। এ সময়ে খানিকটা হুইস্কি খেয়ে নিলে হত। কিন্তু সেটা বোধহয় শোভন হবে না।

দুদ্দার করে সিঁড়ি ভেঙে তোক নামছে। তার মানে এরা বেশির ভাগই ওই ট্রেনেই উঠবে। তার মানে ফের টেনশন। এত সব বলবান, তৎপর, উদ্যোগী, রগচটা, ঠেলেঠেলিতে ওস্তাদ মেয়ে-পুরুষের সঙ্গে তারা পেরে উঠবে কি?

লোকের ভিড়ে পিছিয়ে পড়ছিল অমল। সবার আগে স্যুটকেস নিয়ে কমল, তার পিছনে আর একটা স্যুটকেস সহ বুড, একটু পিছিয়ে সোহাগ আর মোনা, সবার শেষে অমল। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে নেমে দুরন্ত লোকজনের ভিতরে কাউকেই দেখতে পেল না অমল। আগের দিকে গেল না পিছনে তাও জানে না সে। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে লোকজনের দিশাহীন ধাক্কায় টাল খেয়ে চোখ থেকে চশমাজোড়াই, খসে পড়ছিল তার। অতি কষ্টে সামলে নিল।

প্ল্যাটফর্মে নামতে না-নামতেই সে দূরে গাড়ির মুখ দেখতে পেল। ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে।

তার ডান কাঁধে একটা চামড়ার বড়সড় ব্যাগ, বাঁ হাতে অ্যাটাচি কেস। কোন দিকে যাবে তা বুঝতে– পেরে অমল কিছুক্ষণ হতভম্ব মাথায় দাঁড়িয়ে থাকল। ছেলেবেলায় একবার রথের মেলায় বাবার হাত ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল অমল। কী কান্না তার। অবিকল সেরকমই একটা অনুভূতি হচ্ছে এখন। সে কি হারিয়ে গেল।

সামনে চলন্ত দেয়ালের মতো ট্রেনটা ঢুকে পড়ছে। চাকার গম্ভীর শব্দে যেন বিপদের পূর্বাভাষ। লোকজন জান কবুল করে হামলে পড়ছে দরজায় দরজায়। নামা-ওঠার মর্মান্তিক ঠেলাঠেলি। এই বিপুল উদ্যম তার নেই।

মাত্র দু মিনিট সময়। ট্রেন ছেড়ে দেবে। এত অল্প সময়ের মধ্যে ওদের খুঁজে বের করা অসম্ভব। তাহলে কি ট্রেনটা ছেড়ে দেবে সে? নাকি উঠবে পড়বে? সিদ্ধান্ত নেওয়া যে কী কঠিন! আচমকা মনে পড়ল, দাদা টিকিট কেটেছিল বটে কিন্তু সেটা তার হাতে দেয়নি। সম্ভবত মোনাকে দিয়েছে। কিন্তু মোনাকে যদি খুঁজে না পায় সে এবং যদি ট্রেনে উঠে পড়ে তাহলে নিশ্চয়ই টিকিট চেকার তাকে ধরবে।

কী যে করবে অমল তা বুঝতে পারছিল না। এর চেয়ে বিদেশে থাকাই তার ভাল। তার মতো বৌদ্ধিক লোকদের পক্ষে এ-দেশ মোটেই উপযুক্ত নয়। আমেরিকার ইস্ট কোস্ট থেকে রুট এইট্টি ধরে সাড়ে তিন হাজার মাইল গাড়ি চালিয়ে যেতে তার কোনও অসুবিধেই হয়নি। আর এখানে বর্ধমান থেকে কলকাতা যাওয়া যেন মঙ্গলগ্রহ যাওয়ার মতোই কঠিন হয়ে উঠেছে তার কাছে।

লোকে তো যাচ্ছে। তবে সে পেরে উঠছে না কেন? বর্ধমান থেকে কলকাতা কত লোক তো ডেইলি প্যাসেঞ্জারিও করে। ব্যাপারটা তাদের কাছে জলভাত।

সামনের কম্পার্টমেন্টের কাছে একটু এগিয়ে গিয়ে ভিতরটা দেখল অমল। সাংঘাতিক চাপ ভিড় নয়, তবে বেশ কয়েকজন তোক দাঁড়িয়ে আছে। বসার জায়গা নেই।

পিছিয়ে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল অমল।

হঠাৎ পিছন থেকে কে এসে তার ডান কনুইটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, আয়, আয়, জায়গা পাওয়া গেছে!

দাদা কমলকে দেখে নিশ্চিন্ত হল অমল। দাদাকে কখনও জীবনে পাত্তা দেয়নি সে। পালে পার্বণে প্রণামও করে না। কথা হয় কালেভদ্রে। কিন্তু এখন মনে হল, দাদা যেন পারের কাণ্ডারী।

জায়গা পাওয়া গেছে?

হ্যাঁ রে হ্যাঁ, পিছন দিকটায় ফাঁকা থাকে।

কত দূর? গাড়ি ছেড়ে দেবে না তো!

আরে না। এখনও এক মিনিট বাকি।

বাস্তবিকই একটা কামরা ছেড়ে পরের কামরাতেই ভিড় বেশ পাতলা।

উঠে পড়।

অমল উঠে পড়ল। পাশাপাশি না হলেও কাছাকাছিই তিনটে সিটে মোনা, সোহাগ আর বুডঢা বসার জায়গা পেয়েছে। বুডঢার পাশের সিটটা ব্যাগ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে তার জন্য। সিটের পাশে দাঁড় করানো স্যুটকেস।

বাবা, বোসা। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে?

একটু লজ্জা পেয়ে অমল বলল, হারাইনি। আসলে এত ভিড়

আমি তো ভাবলাম, তুমি পড়েই রইলে বর্ধমানে।

কমল সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিয়ে বলল, মালপত্র সব গুনে নিয়েছিস তো বুডঢা?

 হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। নামবার সময় কিছু ফেলে নামিস না!

না। তুমি নামো জেঠু, গাড়ি ছেড়ে দেবে।

আমি ঠিক নেমে যাব। ভাবিস না।

 গাড়ি নড়ে ওঠার পর কমল দরজার দিকে গেল এবং চলন্ত গাড়ি থেকে টুক করে নেমে পড়ল।

জেঠু তোমার চেয়ে কত বছরের বড় বলো তো বাবা?

একটু অবাক হয়ে অমল বলে, চার বছরের। কেন বল তো!

 জেঠু এখনও তোমার চেয়ে অনেক ফিট আছে। তুমি একটু ম্যান্তামারা হয়ে গেছ কিন্তু।

এতগুলো বাংলা কথা একসঙ্গে বুডঢার মুখে কখনও শোনেনি অমল। বিশেষ করে ম্যাস্তামারার মতো শব্দ। সম্ভবত বেশ কয়েকদিন গ্রামে বসবাসের ফলে ওদের ভোকাবুলারিতে গ্রামীণ বাংলারসঞ্চার ঘটেছে। আজকাল সোহাগকেও বেশ বাংলা বলতে শোনো অমল। তার মধ্যে গেঁয়ো শব্দও থাকে। ভাতের পাতে উচ্ছে সেদ্ধ দেওয়ায় রাগ করে একদিন বলেছিল, উচ্ছের নিকুচি করেছে।

মোনা বলে এখানে থেকে ওর কালচার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এরপর গেঁয়ো মেয়েদের মতো ঝগড়া করতে শিখবে।

একটু দেরি করে বুডঢার কথার জবাব দিল অমল। হ্যাঁ, আমি যেন এখন কেমন হয়ে গেছি। সামথিং ইজ রং।

পাছে আশেপাশের লোক শুনতে পায় সেইজন্য বুডঢা খুব চাপা গলায় বলে, নাথিং ইজ রং। তোমার একটু ফিটনেস প্রবলেম আছে, আর কিছু নয়। আমাদের যোগ ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।

বলছিস?

হ্যাঁ। যোগে মিরাকল হচ্ছে আজকাল।

অমল গভীর অবসাদ বোধ করছিল। সে তেমন কিছু পরিশ্রম করেনি, দৌড়ঝাঁপ করতে হয়নি, মাল টানেনি, সুতরাং এ অবসাদ শরীরের নয় নিশ্চয়ই। এই অবসাদের উৎস রয়েছে তার মনের মধ্যে। কোথায় কোন অতলগহীন মনোরাজ্যে এই অবসাদের শিকড় তা কে বলবে? যোগ ক্লাস কি তার মনকে সারাতে পারবে? না, এসব নিদানকে সে আজ আর বিশ্বাস করতে পারে না।

বাইরে বেলা তিনটের রোদে ক্ষেত-খামারের চিত্র ফুটে উঠছে। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে তা বলার নয়। উদাস চোখে চেয়েছিল অমল। আজকাল তার মনে হয়, এত লেখাপড়া না শিখলেই হত। দরকার ছিল না যান্ত্রিক জগতে ঢুকে পড়ার। প্রয়োজন ছিল না মোটা মাইনের চাকরি বা সুন্দরী স্ত্রী বা কলকাতার ফ্ল্যাট বা স্ট্যাটাস সিম্বলসমূহের। অনেক সহজ জীবনযাপন করতে পারত সে।

সোহাগ আড়াআড়ি ওপাশের সারিতে বসে একটা মেয়ের সঙ্গে গল্প করছিল। এটাও নতুন ব্যাপার। পথেঘাটে যার তার সঙ্গে ভাব জমানোর অভ্যাস ওর নেই। এবং দিব্যি বাংলাতেই কথা বলে যাচ্ছিল। একটু একটু কানে আসছিল অমলের। ধীরে ধীরে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে যাচ্ছে নাকি ওরা? ভাবতে ভাবতে চোখে তন্দ্রা জড়িয়ে এল অমলের। এ সেই মস্তিষ্কহীনের ঘুম। নির্বোধের ঘুম। অনুভূতিহীন মানুষের ঘুম। এই ঘুমটাকে খুব ভয় পায় অমল। আবার ঘুমোয়ও। ভারতের অর্থমন্ত্রীর নামটা তার আজও মনে পড়েনি।

সোহাগ ডাকল, বাবা!

চটকা ভেঙে যায় অমলের।

তার ঘুম মানেই স্বপ্ন। সে দেখছিল একটা কাক তিরবেগে উড়তে উড়তে একটা ইলেকট্রিক তার ভেদ করে চলে যেতে গিয়ে দু আধখানা হয়ে গেল। দুভাগ হওয়া কাকটা তারপর দুটো কাক হয়ে উড়ে যেতে লাগল। তারপরেই দেখল টিকিট নেই বলে টিকিট চেকার তাকে একটা অন্ধকার নির্জন স্টেশনে ট্রেন থেকে ঠেলে নামিয়ে দিয়ে বলল, এটাই শেষ ট্রেন। এবার অন্ধকারে বসে থাকুন, আর কোনওদিন কোনও ট্রেন এখানে আসবে না।

দুঃস্বপ্নই। চটকা ভেঙে যেন বাঁচল অমল। বলল, কী বলছিস?

চা খাবে? লেবু চা?

চা! বলে কিছুক্ষণ শব্দটার অর্থ বুঝবার চেষ্টা করল সে।

আমরা সবাই খাচ্ছি। বেশ ভাল চা।

প্লাস্টিকের কাপে এক কাপ চা এগিয়ে আসে। প্রচণ্ড গরম লাগছিল আঙুলে। একটু হলেই পড়ে যেত। বুডঢা তার রুমালটা এগিয়ে দিয়ে বলে, এটা দিয়ে ধরো। তোমার অভ্যাস নেই, প্লাস্টিকের কাপের কানায় ধরতে হয়।

মুগ্ধ হয়ে শুনল অমল। কতটা বাংলা বলে গেল বুডঢা।

 সোহাগ বলে, ঝালমুড়ি খাবে?

 ঝালমুড়ি!

 খাও না!

একটু অবাক হচ্ছে অমল। তার ছেলেমেয়েরা আজকাল তো এত সহজ নয় তার কাছে! কলকাতার ফ্ল্যাটে তাদের মধ্যে বাক্যবিনিময়ই হয় না বড় একটা। মাঝে মাঝে মায়ে মেয়েতে তুমুল ঝগড়া হয়, ধুন্ধুমার লেগে যায় স্বামী-স্ত্রীতে। যখন কথা হয় না তখন ফ্ল্যাটে শ্মশানের শান্তি বিরাজ করে।

ঝালমুড়ির ঠোঙা এগিয়ে আসে। ক্ষুধার্তের মতোই খায় অমল। এটাও একটা খারাপ লক্ষণ। তার আজকাল বিচ্ছিরি খিদে পায় এবং হামলে খায়। ফলে তার শরীরে চর্বি জমছে, ওজন বাড়ছে।

বাঁ পাশের লোকটা একটা বাংলা খবরের কাগজ পড়ছে। খবরের কাগজ জিনিসটাকে ভুলেই গিয়েছিল অমল। একটু উঁকি মেরে দেখতে ইচ্ছে করছিল তার, ভারতের শিল্পমন্ত্রীর নামটা চোখে পড়ে কিনা। তারপর ভাবল, কী লাভ জেনে?

টিকিট কার কাছে রে?

বুডঢা বলল, ট্রেনের টিকিট! আমার কাছে। কেন?

না, ভাবছিলাম দাদা তাড়াহুড়োয় আবার দিতে ভুলে যায়নি তো!

না, না। জেঠু খুব হুঁশিয়ার লোক। টিকিট কেটে ফেরত পয়সা গুনে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে।

শিডিউলের চেয়ে আধঘণ্টা দেরিতে হাওড়া স্টেশনে যখন ট্রেন ঢুকছে তখন অমলের ফের টেনশন হতে থাকে। দুটো ভারী স্যুটকেস যা টানতে পারার মতো শক্তি তার নেই, একা বুডঢা পারবে কি?

প্রসঙ্গ উঠতেই বুডঢা বলল, ইজি। দু হাতে দুটো ঝুলিয়ে তো নেওয়াই যায়। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ। কেন যে দুটো স্যুটকেসেই চাকা লাগানো আছে।

 তাই তো! একদম খেয়াল ছিল না অমলের। এসব সহজ ব্যাপার তার মাথায় থাকে না কেন কে জানে!

বুডঢাই বলল, তাড়াহুড়োর দরকার নেই। ভিড় একটু পাতলা হলেই আমরা নামব।

ঠিক কথা। তবু অমলের ভিতরটায় একটা উচাটন ভাব। যেন সে পিছিয়ে পড়ছে, হেরে যাচ্ছে, পৌঁছতে পারবে না, অনিশ্চয়তা। কেন এরকম হয় আজকাল কে জানে।

বেশি দেরি করলে ট্যাক্সি পাব না।

বুডঢা অবাক হয়ে বলে, হাওড়া স্টেশনে ট্যাক্সির অভাব! কী যে বলো!

এর পরের ঘটনাগুলো তার কাছে পারম্পর্যহীন হিজিবিজি। তারা ভিড় ঠেলে এসে ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়াল। হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি ঢুকল কলকাতায়। তারপর কেয়াতলা লেনের ফ্ল্যাটে একসময়ে পৌঁছে গেল তারা। কিন্তু এই গোটা ব্যাপারটা তার কাছে কেমন যেন স্বপ্নদৃশ্যের মতো। রিয়াল নয়। পরাবাস্তব?

বাড়ির কাজের লোক বাসুদেবের ওপর ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল তারা। না দিয়ে গেলে উপায়ও নেই। বাসুদেব বাড়িতে ছিল না। কোথাও বেরিয়েছে। মোন এই ফাঁকে দামি জিনিসপত্রগুলো ঠিক আছে কিনা দেখে নিচ্ছিল। টি ভি, কম্পিউটার, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ইত্যাদি জিনিস ছাড়া গয়নাগাঁটি বা টাকাপয়সা বাড়িতে রেখে যায়নি তারা। কিছু বাসনপত্র তো থাকেই।

ঘরে ঢুকেই কম্পিউটার নিয়ে বসে গেছে সোহাগ। ই-মেইল চেক করছে একমনে। বুডঢা বাথরুমে।

ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল অমল। সামনে কেয়াতলার নির্জন পথ। বিকেলের আলো পড়ে আসছে দ্রুত। কিছুই দেখার নেই নীচে। ওপরে আবহমানকালের স্থির আকাশ। কয়েক কুচি মেঘ ভেসে আছে।

আজ কী বার তা হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করল অমলের। কী বার আজ। হাতঘড়িটার দিকে তাকালেই জানা যাবে। কিন্তু ইচ্ছে করেই তাকাল না সে।

শুক্র? শনি? এমন কী রবি? না, মনে পড়ছে না। সোমবার নয় তো আজ? হতেও পারে। আজ যে কোনও বার হতে পারে।

পিছনে হঠাৎ মোনার গলা পাওয়া গেল। তীব্র, জরুরি গলা, শোনো!

ধীরে মুখ ফেরায় অমল, কী বলছ?

ঘরে এসো, কথা আছে।

অমল এগিয়ে গিয়ে বলে, কী?

বাঁ হাতের মুঠো খুলে একটা জিনিস দেখিয়ে মোনা জিজ্ঞেস করে, এটা কী? 

অমল কিছুক্ষণ জিনিসটা চিনতে পারে না। তারপর চিনতে পেরে বলে, কন্ডোম। কেন?

এটা আমাদের বিছানায় এল কী করে?

অমল অবাক হয়ে বলে, তা কী করে বলব!

তুমি জানো না?

অমল মাথা নেড়ে বলে, না।

চাপা হিংস্র গলায় মোনা বলে, আউট উইথ দি ট্রুথ!

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়