১৬.

রাবণরাজা নাকি রামচন্দ্রকে শত্রুভাবে ভজনা করত। শত্রু ভাবলে কি ভজনা হয়? তবে আশ্চর্য ব্যাপার হল, যাকে ঘেন্না করা হয়, যার ওপর প্রবল আক্রোশ, তার কথা কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে। ভালবাসার মানুষকে যত না মনে পড়ে তার চেয়ে ঢের বেশি মনে পড়ে ঘেন্না আর আক্রোশের লোকটাকে। ঘেন্না, আক্রোশ, রাগও কি তাহলে একরকম আকর্ষণ? কেউ কেউ বলে ঘেন্না আর ভালবাসা টাকার এ পিঠ ও পিঠ। কিন্তু তাই কি হয়! রাবণরাজা রামচন্দ্রকে হয়তো সারাক্ষণ ভাবত, কী ভাবে তার সর্বনাশ করবে বলে। সেটা কি ভজনা রে বাপু?

তৃতীয় ফ্রন্ট হল শীতল উদাসীনতা। ওই কুয়োয় নেমে গেলে মানুষ আর উঠে আসতে পারে কমই। ভালবাসলে মনে পড়ে, ঘেন্না বা রাগ থেকেও মনে পড়ে, কিন্তু উদাসীনতা ভেজা ন্যাতার মতো মনের সেলেটখানা মুছে ফেলে। তখন সেখানে আর কোনও আঁকিঝুঁকি নেই, কিচ্ছু নেই। কালো সেলেট হাঁ করে চেয়ে থাকে শুধু।

পাশের ঘরে মোনা, সোহাগ আর বুডঢা। আর মা-বাবার পরিত্যক্ত ঘরখানায় একা অমল। গত চার পাঁচ দিন সে দাড়ি কামায়নি। শেষ কবে কামিয়েছিল তা ভাল মনেও নেই। গাল গলা কুট কুট করে দাড়িতে। চুলে চিরুনি দিতে মনে থাকে না, ইচ্ছেও হয় না। কোঁকড়া চুল বলে না আঁচড়ালেও চলে।

এ-ঘরে সাবেক মস্ত খাট। তাতে নানা গেঁয়ো কারুকার্য। কাঠ আর স্টিলের গোটা তিনেক আলমারি। গোল মতো টেবিল, ভারী কাঠের চেয়ার, ট্রাঙ্ক বাক্স মিলিয়ে ঘরে গুদোমঘরের মতো অবস্থা। ইঁদুরের উৎপাত আছে, আরশোলা ঘুরছে সারাক্ষণ। জানালা কপাট খুলে রাখলেও বন্ধ বাতাসের গন্ধ যেতে চায় না। অমল টের পায়, কিন্তু গ্রাহ্য করে না।

ওই ঘরে তার পরিবার, তার দুই সন্তান, অনাত্মীয়া স্ত্রী, মাঝখানে এক ঠান্ডা অন্ধকার সমুদ্র। ওই সমুদ্র অতিক্রম করা বোধহয় আর সম্ভব নয়। সেই চেষ্টা আর করে না অমল। পণ্ডশ্রম। দু ঘরের মাঝখানের দরজাটাও ভোলা হয়নি। প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ।

পারুলের প্রতি কি খুব অন্যায় করেছিল অমল? খুব? অনেক ভেবে দেখেছে সে, অন্যায় হলেও সেটা ক্ষমার অযোগ্য ছিল না, বিশেষ করে বিয়ে যখন ঠিক হয়েই ছিল। তার একটা অন্যায়ের প্রতিশোধ অনেক বেশি হয়ে গেল নাকি?

এখন মধ্যরাতে উঠে বসে আছে অমল। গ্রামে শীত পড়ে গেছে। হালকা, মনোরম শীত। মায়ের পুরনো একটা কাঁথা চাপা দিয়ে ভারী আরামে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু মধ্যরাতে চটকা ভেঙে গেল। প্রায়ই যায়। ঘুম একবার ভেঙে গেলে সে জেগে শুয়ে থাকতে পারে না। উঠে বসে সে শুনতে পেল, দূরে লাউডস্পিকারে কোনও যাত্রাপালার সংলাপ। সবুজ সংঘ নবমী পুজোয় কলকাতার একটা নামী দলকে আনিয়েছে। বাড়ি সুষ্ঠু লোক গেছে যাত্রা দেখতে। এমন কী মহিমও। শুধু অমলের পরিবারের কেউ যায়নি।

রাত কত হল জানার জন্য ঘড়ির দিকে চাইলেই হয়। কিন্তু সেই ইচ্ছেটাও হল না অমলের। কী হবে জেনে? উঠে সে চুপচাপ ভূতগ্রস্তের মতো চেয়ে থাকে। ঘর অন্ধকার, তবে দূরের প্যান্ডেল থেকে গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটু আলো এসে লেগে আছে মশারিতে। এইসব নির্জন, নিঃসঙ্গ সময়ে পারুলের কথা ভাবতে চেষ্টা করে সে। আগে খুব মনে পড়ত পারুলকে। আবেগ উথলে উঠতে চাইত। স্ত্রীর সঙ্গে মিলনের সময়ে পারুলের মুখশ্রী আরোপ করে নিত মোনার মুখে। বেশ কিছুকাল মোনা আর পারুলের এক সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নিতে পারত সে। সে এক আশ্চর্য রসায়ন। প্রবল কল্পনাশক্তি বাস্তবের অনেক ঘাটতি পূরণ করে নেয়।

এখন কেন যে পারুলের মুখ আর তেমন স্পষ্ট মনে পড়ে না কে জানে! পারুলের মুখের ওপর আরও নানা মুখের আদল এসে পড়ে। তখন ভীষণ কষ্ট হয় তার। পারুল কি হারিয়ে যাচ্ছে তার স্মৃতি থেকে। অ্যালবাম খুলে সে কতবার মুখটা ফের স্মৃতিতে গেঁথে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তবু তার স্মৃতিতে বিন্দু বিন্দু অন্ধকার চলে আসে কেন? হাজার মুখের টুকরো এসে কেন যে ভেসে বেড়ায় মনশ্চক্ষে।

একটা শীতল ভয়ও আজকাল ছুরির মতো ঢুকে যায় বুকে। যদি মোনার বদলে পারুল তার বউ হত তা হলেই কি সুখী হত সে? নিজেকে সে বিরহী ভেবে, বঞ্চিত হতাশ প্রেমিক ভেবে একরকম সান্ত্বনা পেয়ে যায়। কিন্তু যদি এরকম হত, পারুলকে বিয়ে করত সে এবং তারপর ধীরে ধীরে প্রেম অবসিত হয়ে ঘৃণা আর আক্রোশ ঘুলিয়ে উঠত দুজনের মধ্যে, তারপর আসত শীতল উদাসীনতা–তা হলে কী হত? না পাওয়া পারুলকে দেবীর আসনে বসানো সোজা, কিন্তু পাওয়া পারুলকে কি পারত সে? পারুলের অপমৃত্যু ঘটে যেত কবেই। এবং আজ এই মধ্যরাতে ও-ঘর আর এ-ঘরের মধ্যে যে অথৈ সমুদুরের ব্যবধান সেই সমুদুর চলে আসত তার আর পারুলের মাঝখানেও।

শ্বাসকষ্টের মতো একটা কষ্ট হচ্ছিল অমলের। শারীরিক নয়, কষ্টটা অন্যরকম। মাথাটা বড্ড গরম। সে কৃতী ছাত্র, সফল মানুষ। কিন্তু এখন যেন তার সব সফলতা ছাড়া জামাকাপড়ের মতো পড়ে আছে কোথায়। অন্ধকারে বড় বিবসন মন হয় নিজেকে। বড় গৌরবহীন!

অমল উঠল। মশারি তুলে বেরিয়ে একটু জল খেল গেলাস থেকে। চেয়ারের ওপর পাকার হয়ে পড়ে থাকা আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নিল সে। ঘুম অসম্ভব। ঘরের মধ্যে সে হাঁফিয়ে উঠছে।

দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এল সে। জ্যোৎস্না রাত্রি। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে রেখে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল উঠোনে। ভুলু কুকুরটা দু বার ভুক ভুক শব্দ করে দৌড়ে এসে ন্যাজ নাড়তে লাগল। একবার মনে হল, দরজায় তালাটা লাগিয়ে আসে। অ্যাটাচি কেসে কয়েক হাজার টাকা আছে। জরুরি কাগজপত্র, দামি কলম, ক্যালকুলেটর, পারসোন্যাল অর্গানাইজার। চোরের আনাগোনা আছে এখানে। দোনোমোনো করেও ভাবল, থাক গে, গেলে যাবে।

বাইরের ঠান্ডায় এসে বেশ ভাল লাগছিল তার। ঘাসে শিশির জমে আছে। হিম পড়ছে। সামান্য কুয়াশায় জড়ানো ভারী ভুতুড়ে রাত। সে হাঁটতে লাগল। গত কয়েকদিন একা একা ঘাটে আঘাটায় অনেক ঘুরে বেড়িয়েছে সে। মনটা সেই থেকে জড়বস্তুর মতো হয়ে আছে। কোনও উত্তেজনা নেই, আবেগ নেই, রাগ নেই, ঘেন্না নেই, শুধু নিথরতা আছে।

খানিকক্ষণ হাঁটার পর তার মনে হল, এও পণ্ডশ্রম। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি আসবে মাত্র।

ছেলেবেলায় গাঁয়ে যাত্রা এলে যেন বারুদে আগুন লাগত। বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে পালিয়ে গিয়ে কত যাত্রা দেখেছে। সিরাজদ্দৌল্লা, কেদার রাজা, শাজাহান, কঙ্কাবতীর ঘাট, কর্ণার্জুন। সব মনে আছে।

একটু ইচ্ছে, একটু অনিচ্ছের দোটানায় পড়ে খানিকটা সময় গেল। তারপর সে যাত্রার আসরের দিকেই এগোতে লাগল। পকেটে পয়সা নেই। টিকিট কাটতে হলে পারবে না।

না, টিকিট কেটে নয়। খোলা আসরেই যাত্রার আয়োজন হয়েছে। কয়েক হাজার লোকের জমজমাট ভিড়। আশেপাশে বাদাম, তেলেভাজা, ঝালমুড়ির দোকানও বসেছে অনেক। রইরই কাণ্ড।

এত কাল পরে যাত্রা দেখতে কেমন লাগবে কে জানে। ভিড় ঠেলে এগোনোও কঠিন। অমল একটু ঘুরে ফিরে একটু ফাঁকামতো জায়গায় দাঁড়াল। বড় দূরে স্টেজ। কুশীলবকে খুব ভাল করে ঠাহর করা যাচ্ছে না। তবে মাইকের দৌলতে সংলাপ শোনা যাচ্ছে।

জনৈকা কুলসুমের সঙ্গে জনৈক ফিরোজের প্রেমের ডায়ালগ হচ্ছে। ফিরোজ বলছে সে গরিব, পিতৃমাতৃহীন অনাথ, আবদাল্লা নামক জনৈক সওদাগরের অধীনে কাজ করে আর কুলসুম ধনীকন্যা, সুন্দরী, সুতরাং সে বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চায় না। আর কুলসুম বলছে, তার বুকে যে চিরন্তন প্রেমের শিখা জ্বলে উঠেছে তা দিয়ে তারা সব বাধা অতিক্রম করবে।

অমল একটা হাই তুলল। কানের ভিতর দিয়ে বাতাস বেরিয়ে গেল।

কোথা থেকে বুকে ভলান্টিয়ারের ব্যাজ আঁটা একটা ছেলে ছুটে এসে বলল, আরে অমলদা! আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আসুন আমার সঙ্গে।

অমল সংকুচিত হয়ে বলল, না না, এই তো বেশ আছি।

 পাগল! বাইরে দাঁড়ালে ঠান্ডা লেগে যাবে। আসুন, স্টেজের ওপাশে ভি আই পি-দের এনক্লোজারে চেয়ারের ব্যবস্থা আছে।

আমি তো ভাই বেশিক্ষণ দেখব না। চলে যাবো।

 তা হোক না। যতক্ষণ খুশি দেখবেন। বিজুদা আমাকে পাঠাল। চলুন।

অনিচ্ছুক পায়ে এগোতে হল অমলকে। ভিড়ের পিছন দিয়ে ছেলেটা পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। গ্রিনরুমের পাশেই স্টেজ ঘেঁষে একটা বাঁশ দিয়ে ঘেরা জায়গায় সারি সারি চেয়ার পাতা। গাঁয়ের মান্যগণ্য এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা বসে আছে। সামনে জায়গা ছিল না। ছেলেটা কোথা থেকে একটা চেয়ার এনে তাকে সামনের সারির পাশেই বসিয়ে দিয়ে বলল, আমরা আপনাকে ইনভাইট করতে গিয়েছিলাম। চিঠি পাননি?

অমল অস্বস্তি বোধ করে বলল, না তো!

বউদির হাতে কার্ড দিয়ে এসেছিলাম।

ও। তা হবে।

ছেলেটা চলে যাওয়ার পর অমল একবার চারদিকে চেয়ে দেখল। বহু মুখ, বহু মানুষ। সকলেরই স্টেজের দিকে চোখ। নায়িকা স্টেজের ওপর পড়ে ফিরোজ, ফিরোজ চিৎকার করে কাঁদছে। ফিরোজ চলে গেছে। ঝাঁকর ঝাঁকর করে বাদ্যি বাজনা বেজে উঠল। নায়িকা উঠে বসল। তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়াল। তারপর দিগন্তের দিকে হাত বাড়িয়ে বিরহের গান ধরল। গানের অর্থ অনেকটা এরকম, কত দূরে যাবে তুমি? আমি যে তোমার হৃদয়ের পিঞ্জরে বসে নিরন্তর তোমার নাম ধরে ডাকব…ইত্যাদি।

ঘুম পাচ্ছিল। ফের একটা হাই তুলল সে। ফের কানের ভিতর দিয়ে বাতাস বেরিয়ে গেল। রাত্রে পায়েস খেয়েছিল একবাটি, অম্বলে গলা জ্বলছে। পায়েসে বড্ড মিষ্টি দেওয়ার ধাত বউদির।

দুটি অপরূপ চোখ ভিড়ের থেকে এক ঝলক তাকে দেখে টপ করে আড়াল হল।

কে?

একটু সচকিত হল অমল। কার চোখে হঠাৎ চোখ পড়ল তার? বারবার লক্ষ করেও বুঝতে পারল না কিছুতেই। অস্বস্তি হচ্ছে। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে।

বাঁদিক থেকে মেয়ে-পুরুষের একটি দল উঠে চলে যাচ্ছে। রাত হয়েছে। শেষ অবধি অনেকেই থাকে না। হয়তো দূরে যাবে। নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে দলটাকে একটু দেখল অমল।

নায়িকা কুলসুম শাশ্বত প্রেমের জয় ঘোষণা করে যে গান গাইছিল তাতে বাধা পড়ল। কর্কশ এক পুরুষের গলা গর্জন করে উঠল, গান থামাও কুলসুম, তুমি কি আত্মপরিচয় বিস্মৃত হয়েছ? ভুলে গেছ তোমার বংশমর্যাদা?

কয়েকটি মেয়ে এসে কুলসুমকে ধরে নিয়ে গেল। কুলসুমের ঝলমলে পোশাক-পরা বাবা স্টেজ জুড়ে দাপাদাপি করে নিজের বংশপরিচয় দিয়ে যেতে লাগল…

এসব ভাল লাগার জন্য যতখানি মস্তিষ্কহীন হওয়া দরকার ততটা এখনও হতে পারেনি অমল। যখন ভাল লাগত তখন ছিল ভাল লাগারই বয়স। পারিপার্শ্বিকে যাই ঘটুক বুভুক্ষুর মতো গিলে খেত সে। রাজরাজড়াদের গল্প, পৌরাণিক কাহিনী, চাঁদ সদাগর, মনসা মাহাত্ম্য কিছুই খারাপ লাগত না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতে যাচ্ছিল অমল।

একটা লম্বা ছিপছিপে ছেলে কাছে এসে বলল, উঠছেন?

 হ্যাঁ।

মণ্ডপের পিছনে পারুলদি অপেক্ষা করছেন। একটু দেখা করে যাবেন।

হাঁ করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল অমল। বুকটায় ধকধক হচ্ছে।

আমি বিজু। চিনতে পারছেন না?

অমল হাসল, হ্যাঁ হ্যাঁ। কত বড় হয়ে গেছ।

সেদিনও তো দেখা হল আপনার সঙ্গে।

অমল অপ্রতিভ হয়ে বলে, কিছু মনে থাকে না আজকাল। তুমি কেমন আছ বিজু? কী করছ?

 এখনও কিছু করছি না। পাস-টাস করে বসে আছি।

ভিতরে তাড়াহুড়ো অনুভব করছে অমল। বিজু কী পাস করেছে তা আর জানার ইচ্ছে হল না তার। বলল, আচ্ছা আচ্ছা, বেশ ভাল।

আলোয়ানের এক প্রান্ত খসে পড়েছিল মাটিতে। টানতে গিয়ে চেয়ারের সঙ্গে আটকে গিয়ে চেয়ারটাই পড়ে যাচ্ছিল কাত হয়ে। বিজু চেয়ারটা ধরে ফেলে আলোয়ানটা ছাড়িয়ে কাঁধে তুলে দিয়ে বলল, সাবধানে যাবেন।

একটু দিগভ্রান্ত অমল আসর থেকে বেরিয়ে মণ্ডপটা কোনদিকে তা বুঝতে পারছিল না। এত ভিড় চারদিকে। ঠাহর করতে একটু সময় লাগল তার। তাড়াহুড়োয় পড়লে মানুষের কতরকম ঠিক ভুল যে হতে থাকে।

অমলদা!

অন্ধকারে মুখটা প্রথমে দেখাই গেল না। ফিকে অন্ধকারে পারুল দাঁড়িয়ে।

পারুল!

চেহারাটা কী করেছ বলো তো!

 কেন, খারাপ দেখছ?

রোগামোটার কথা বলছি না। অমন উলোঝুলো কেন? দাড়ি কামাওনি, চুল আঁচড়াওনি, দোমড়ানো পাজামা, বিচ্ছিরি আলোয়ান–এ কী রকম ভাব তোমার!

অমল হাসল, আসলে ঘুম আসছিল না বলে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে যাত্রা হচ্ছে দেখে ঢুকে পড়েছি।

কতকাল পরে দেখা, কিন্তু এমন পোশাকে আর চেহারা দেখে চমকে গিয়েছিলাম। কই, বাড়িতে এলে না তো! খবর পাঠিয়েছিলাম ধীরেন খুড়োকে দিয়ে, বলেনি?

বলেছে।

 তবে?

অমল শ্বাসকষ্ট টের পাচ্ছে। শরীর কাঁপছে এখনও। মৃদু স্বরে বলল, কোন মুখে আসব বলো! খুব লজ্জা হচ্ছিল।

পুরনো কথা ভাবো বুঝি খুব?

 ভাবব না?

আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি এখন মস্ত মানুষ হয়েছ, বিরাট চাকরি, অনেক দায়িত্ব, ঘন ঘন দেশ বিদেশ যেতে হয়, তুমি নিশ্চয়ই পুরনো কথা মনে রাখোনি।

অমল একটু চুপ করে থেকে বুকের থরথরানিটা সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল। তারপর বলল, সেরকমই তো হওয়ার কথা। কিন্তু আমার আজকাল কী যেন হয়েছে।

কী হয়েছে?

আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। ইন্ট্রোভার্ট হয়ে যাচ্ছি।

আত্মবিশ্বাস কমছে কেন?

পারুলকে এবার চারদিকের আলোর আভায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল অমল। বলল, সামথিং ইজ রং। কিন্তু এসব কথা থাক। তোমার কথা বলো।

আমি! আমার আর কী কথা বলল। আর পাঁচজন মেয়ের মতোই ঘরসংসার করছি। নতুন কিছু নয়।

ভাল আছ তো পারুল? সব দিক দিয়ে ভাল?

তাই কি হয়? সব দিক দিয়ে কেউ কি ভাল থাকে?

তোমাকে বেশ ভাল দেখাচ্ছে। এখনও বয়সের ছাপ পড়েনি। দেখে মনে হয়, তুমি সুখী হয়েছ। তাই না?

নিজের কথা নিজে কি বলতে পারি? কিন্তু তোমাকে দেখে আমার একটুও ভাল লাগছে না।

অমল মাথা নেড়ে বলে, আমি ভাল নেই। কিংবা আমি যে কেমন আছি তা বুঝতে পারছি না।

কোনও অসুখ-টসুখ করেনি তো!

না, তেমন কিছু অসুখ আছে বলে জানি না। আর থাকলেই বা কী! ওসব নিয়ে ভাববার কিছু নেই।

বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?

 ভালই।

 জিজ্ঞেস করলাম বলে কিছু মনে করলে না তো! এ প্রশ্নটা আমি তোমাকে করতেই পারি, তাই না?

হ্যাঁ, পারোই তো! মোনাও তোমার কথা জানে।

পারুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শুধু মোনা নয়, তোমার মেয়ে সোহাগও জানে। আর সেইটেই দুঃখের কথা। তুমি ওদের কাছে সব বলে দিয়েছ। কাজটা ভাল করোনি অমলদা।

অমল অপ্রতিভ হয়ে বলে, কী থেকে যে কী হয়ে যায় তা বলা মুশকিল। আমি আজকাল নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। কিন্তু ভারী আশ্চর্যের কথা, ওরা যেমনই হোক, তোমাকে কেউ অপছন্দ করে না। কী করে যে এটা সম্ভব হয় বুঝতে পারি না।

পারুল একটু হাসল, সোহাগ আমাকে গডেস বলে মনে করে। সেটা আবার আমার পক্ষে অস্বস্তিকর। তোমার বউ কী মনে করে তা অবশ্য জানি না।

অমল মাথা নেড়ে বলে, বললে তুমি বিশ্বাস করবে না।

কেন করব না?

অবিশ্বাস্য। সে তোমার সম্পর্কে কখনও একটিও খারাপ কথা বলে না। একবারের জন্যও না। বরং একবার অ্যালবামে তোমার ছবিটা দেখছিলাম, দেখে বলেছিল, দেখ দেখ, তোমার বিবেক জাগ্রত হোক।

হেসে ফেলল পারুল, যাঃ।

বললাম তো, তোমার বিশ্বাস হবে না।

 অ্যালবামে আমার ছবি রাখার কী দরকার ছিল?

আমি তো রাখিনি। ছবিটা আমার পারসোনাল ফোল্ডারে ছিল। সেটা অ্যালবামে রেখেছে মোনা। তোমার বোধহয় একটা হিপনোটিজম আছে পারুল।

ওসব বাজে কথা। আমি খুব সাধারণ একটা মেয়ে। সোহাগ আমাকে কেন গডেস ভাবে বলল তো! আইডিয়াটা কি তুমিই ওর মাথায় ঢুকিয়েছ?

না পারুল। আমি ওদের মাথায় কখনও কোনও আইডিয়া ঢোকাতে পারিনি। ছেলেমেয়েকে সময়ও দিতে পারলাম কই? দিনরাত ভূতের মতো খেটেছি। ওরা তাই ওদের মতোই হয়েছে। কিছু শিখিয়েছে ওদের মা। আর বাকিটা নিজেরাই শিখে নিয়েছে। তুমি কবে, কী ভাবে সোহাগের জীবনে ঢুকে গেছ তা আমি জানি না।

পারুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তির মতো বলল, পাগল।

হ্যাঁ পারুল, সোহাগ প্রবলেম চাইল্ড। স্বাভাবিক নয়। ওর একটা অদ্ভুত মনোজগৎ আছে, যেটাকে আমি বুঝতে পারি না। ও আমাদের বাধ্য নয়। ও আমাকে অনেকবার বলেছে, তোমার ছবিটা দেখলে নাকি ওর মন ভাল হয়ে যায়।

এসব শুনে আমার একটু ভয়-ভয় করছে। এরকম কেন হবে?

শুধু সোহাগ নয়, আমার ছেলে বুডঢার মুখেও শুনেছি। মোনা মুখে অতটা বলেনি বটে, কিন্তু অসম্ভব নয় যে, মোনাও তোমার একজন ভক্ত।

পারুল প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, কী যে সব কাণ্ড তোমাদের কিছু বুঝতে পারি না বাবা! এখন তো ওদের সঙ্গে দেখা করতেই আমার ভীষণ লজ্জা করবে। ভেবে রেখেছিলাম মহিমকাকাকে বিজয়ার প্রণাম করতে গিয়ে ওদের সঙ্গে পরিচয় করে আসব। দেখছি তা আর হবে না।

পালাবে পারুল? তাতেই কি সব উলটে যাবে?

আমার আড়ালে আমাকে নিয়ে যা খুশি হোক, আমাকে তো আর সাক্ষী থাকতে হবে না। না বাপু, এসব মোটেই ভাল কথা নয়।

অমল বিষণ্ণ গলায় খুব ধীরে ধীরে বলল, আমাকে তুমি তোমার জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে পারুল। আমার কোনও চিহ্নই রাখোনি। কিন্তু আমরা তোমাকে বুকে তুলে নিয়েছি। যত অদ্ভুতভাবেই হোক, তোমাকে এক ধরনের অ্যাকসেপটেন্স দিয়েছে আমার পরিবার। ব্যাপারটা আমার ভালই লাগে।

কিন্তু আমার ভয় করে, লজ্জা হয়।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। জায়গাটা খুব একটা নির্জন বা শব্দহীন নয়। অদূরে ঝোপঝাড়ে অনেকে এসে পেচ্ছাপ করে যাচ্ছে। যাতায়াত করছে অনেক মানুষ। মাইক বাজছে, কোলাহল শোনা যাচ্ছে।

এবার আমি যাই অমলদা?

 যাবে! চলল, একটু এগিয়ে দিই।

তার দরকার নেই। ওই তো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। তুমি বরং একবার বাড়িতে এসো। আমার কর্তার সঙ্গে পরিচয় করে যেও।

ম্লান মুখে অমল বলে, কতবার যাব বলে তোমাদের বাড়ির ফটক অবধি গেছি। কেন যে শেষ অবধি ঢুকতে পারিনি তা জানি না। ফটক থেকেই ফিরে এসেছি।

এত লাজুক তো তুমি ছিলে না।

না পারুল, এটা লাজুক বলে নয়। আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। কেন যেন মনে হয় আমি ভুলভাল কথা বলে ফেলব, অদ্ভুত কিছু করে ফেলব।

ওমা! ওরকম কেন মনে হয় তোমার?

সেইটেই বুঝতে পারি না। আমার আজকাল এমনও মনে হয় যে, লোকে আমাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করে।

উদ্বিগ্ন পারুল বলে, অমলদা, তুমি কি ভুলে গেছ যে, তুমি একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলে! তোমার কত ডিগ্রি, কত বড় চাকরি, কত সম্মান!

আমার মেধা, ডিগ্রি বা সম্মানকে কি আজ তুমি মূল্য দাও পারুল? একদিন কিন্তু সব মাড়িয়ে দিয়ে তুমি আমার জীবন থেকে সরে গিয়েছিলে।

সেটা অন্য প্রসঙ্গ অমলদা। অন্য ঘটনা। তোমার গুণের দাম কি তা বলে কমে গেছে।

অমল মাথা নেড়ে বলে, ওসব দিয়ে কিছু হয় না পারুল। ডিগ্রি হল, চাকরি হল, টাকা হল, তবু মনে হয় কী করে জীবনযাপন করতে হয় সেটাই তো এখনও জানা হল না।

এত ফ্রাষ্ট্রেশন কেন তোমার? আমার জন্যই কি?

তোমার জন্যই কিছুটা। কিন্তু সবটুকু বোধহয় তুমি নও। ধরো যদি তোমাকে বিয়ে করতে পারতাম তা হলে কি তুমি আমার কাছে ক্ৰমে পুরনো এক অভ্যাসের মতো হয়ে যেতে না? বরং বিয়ে হয়নি বলেই আজও অ্যালবাম খুলে তোমার ছবি দেখি। বিয়ে করা বউয়ের ছবির দিকে কেউ কি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে? না পারুল, তোমাকে অন্যভাবে তো পেয়েছিই। আরও ভালভাবে।

বেশ বললে! শুনে কান জুড়িয়ে গেল। কিন্তু তোমার এই হতশ্রী দশা তবে কেন হল বলো তোর

বুঝতে পারি না পারুল। যত দিন যাচ্ছে তত মনে হচ্ছে, ছাইভস্ম অনেক শিখলুম, কিন্তু তা দিয়ে কিছু হয় না।

একটা কথা সত্যি করে বলবে?

 বলব না কেন? তোমাকে তো সবই বলা যায়। যায় না পারুল?

না যায় না! সব আমাকে কেন বলবে অমলদা? বোলো না। আমি শুধু জানতে চাই নিজের বউয়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কেমন?

মাথা নেড়ে অমল বলে, ভাল নয়। একটুও ভাল নয়। প্রথম প্রথম একরকম ছিল। বিয়ের পরেই ও তোমার কথা জানতে পারে, কিছু অশান্তিও হয়। আবার একটা আপসরফাও হয়ে গিয়েছিল। তারপর কেমন করে যেন একটা ঘেন্নার সম্পর্ক তৈরি হল। সামান্য ছুতোনাতায় পরস্পরকে অপছন্দের মাত্রা বাড়তে লাগল। আক্রোশে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করত। কিন্তু তবু সে একরকম ছিল, আক্রোশ-ঘেন্নাও একটা সম্পর্ক বজায় রাখে। কিন্তু ভয়াবহ হল ঠান্ডা উদাসীনতা। কী বলব তোমাকে, এখন ওকে সামনে দেখেও ওর কথা মনে পড়ে না।

তুমি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছ?

অমল একটু মলিন হেসে বলে, সাইকিয়াট্রিস্টরাই এখন সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত ডাক্তার। সাইকিয়াট্রিস্ট, ম্যারেজ কাউন্সেলর কিছু বাকি নেই।

তা হলে তোমার প্রবলেম তো খুব অ্যাকিউট।

হ্যাঁ। কিন্তু ওসব নিয়ে ভেবো না পারুল। আমার কথা বাদ দিয়ে এবার তোমার কথা বলো।

 আমার তো কথা কিছু নেই।

 শুনেছি জ্যোতিপ্রকাশ গাঙ্গুলি একজন ভাল মানুষ।

সে তার মতো ভাল।

কথাটার মানে কী পারুল?

তোমার মতো অত কোয়ালিফিকেশন তার নেই। অনেক কষ্ট করে, নিজের চেষ্টায় যা হওয়ার হয়েছে।

অমল একটু হেসে বলে, আমাকে কি একটু খোঁচা দিলে নাকি পারুল? দাও। খোঁচাটা আমার ভালই লাগল।

মোটেই খোঁচা দিইনি। জানতে চাইলে বলে বললাম।

বুঝলে, আগে খুব অহংকার ছিল আমার। ব্রিলিয়ান্ট বা কাজের লোক দেখলে হিংসে হত। মনে হত আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বুঝি কেউ নেই। এখন হয়েছে তার উলটো। একটা ন্যালাক্ষ্যাপা লোককেও মনে হয় আমার চেয়ে বড় মানুষ বুঝিবা। অহংকারটা যে কোথায় গেল কে জানে।

অহংকার কি ভাল অমলদা?

অহংকারকে সাধকরা জয় করেন, সে অন্য ব্যাপার। অনেক মহৎ কাজ। আমার তো তা নয়। আমার হল ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্স।

ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্স বলে কিছু হয় না তা জানো?

 মনোবিজ্ঞানে না থাক, কথাটা তো চালু আছে পারুল। যা বোঝার বুঝে নাও।

আজ অনেক দুঃখের কথা বলেছ। আর নয়। রাত দেড়টা বাজে। এবার বাড়ি যাও। ঘাড়ে গলায় জল দিও, চোখে ভাল করে জলের ঝাপটা দিও, জয়েন্টগুলো ভিজিয়ে নিও। তারপর ঘুমোও।

নির্বোধের ঘুমের অভাব হয় না। আমার ঘুম খুব গাঢ়। ইদানীং হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। ঘুম ভেঙেছিল বলেই হাঁটতে হাঁটতে যাত্রা দেখতে চলে এলাম। ভাগ্য ভাল, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

ভাগ্য ভাল না খারাপ তা কে বলবে? আমার মনটা আজ তুমি খারাপ করে দিয়েছ।

 আচ্ছা আমি কি একটু বেশি কথা বলছি বলে তোমার মনে হয়?

না তো! বেশি বলেনি, তবে যা বলেছ সবই নেগেটিভ কথা।

 আমার মনে হয়, আজকাল বোধহয় আমি একা একাও কথা বলি।

ওরকম ভেবো না অমলদা। নিজেকে নিয়ে বেশি ভাবলে শেষে তুমি ক্ষ্যাপাটে হয়ে যাবে।

 ক্ষ্যাপাটে কি এখনই নই পারুল? বলে মৃদু মৃদু হাসতে থাকে অমল।

মায়াভরা চোখে তার দিকে চেয়ে থেকে পারুল বলে, একটু ক্ষ্যাপাটে হওয়া পুরুষমানুষদের পক্ষে মন্দ নয়। হিসেবি, কৃপণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষীর চেয়ে বরং একটু ক্ষ্যাপাটে হওয়া ভাল।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব? খুব সংকোচ হচ্ছে।

সংকোচের কী? বলো।

আমাদের সম্পর্কের কথাটা কি জ্যোতিপ্রকাশবাবুকে বলেছ?

বলেছি।

সেই ঘটনাটার কথাও?

পারুল ঠোঁট কামড়াল, চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ।

উনি কিছু মনে করেননি!

মনের কথা জানি না। তবে আমাকে গ্রহণ করেছেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অমল বলে, উনি তাহলে শক্তিমান পুরুষ। তুমি ঠিক মানুষকেই পেয়েছ পারুল।

হিসেবটা অত সহজ নয়। সুন্দরীদের কিছু প্লাস পয়েন্ট থাকে। তাদের অনেক দোষঘাট রূপের তলায় চাপা পড়ে যায়। পরস্পরের মনের কথা ইহজীবনে কি সবটা বোঝা যায়?

উদাস মুখে অমল বলে, তাই হবে। অত জানার দরকারই বা কী?

 একটা কথা বলি। অ্যালবাম থেকে আমার ফটোটা সরিয়ে নষ্ট করে দিও।

অবাক হয়ে অমল বলে, নষ্ট করব? নষ্ট করলে আমি কী নিয়ে থাকব পারুল? আমরা কী নিয়ে থাকব?

.

১৭.

মানুষের শরীরের ভিতরে যেসব হাজারো জটিলতা রয়েছে তার খবর পান্নার জানা নেই। কিন্তু কণ্ঠনালির ভিতরে শ্বাস আর খাদ্যের নলের মধ্যে যে একটি ভয়ংকর বিপজ্জনক ফোকর রয়েছে সে খবরটা সে খুব ভাল জানে। যখন ছোট ছিল, অস্পষ্ট স্মৃতির সেই সময়ে কেউ তাকে ভয়টা দেখিয়ে রেখেছিল, খাদ্যনালি থেকে মাঝে মাঝে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল শ্বাসনালিতে গিয়ে আটকে দম বন্ধ করে দেয়। সেই শৈশবের শেখা ভয় পান্নাকে আজও ছাড়েনি। বরং যত বয়স বাড়ছে তত ভয় বাড়ছে। জ্ঞানবয়সে আজ অবধি ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল গিলে খেতে পারল না পান্না।

এ-বাড়ির বাঁধা ডাক্তার ছিলেন মণিরাম। ধুতি জামা পরা ডাক্তার আজকাল আর দেখা যায় না। মণিরাম সেই বিরলবেশের ডাক্তার। কে জানে ওই পোশাকের জন্যই শেষ দিকটায় মণিরামের পশার কমে গিয়েছিল কিনা। ধুতি পরা ডাক্তার দেখে অকারণেই এ যুগের রুগিরা নাক সিঁটকোয়। ঠিক ঠিক নির্ভর করতে পারে না বোধহয়। কিন্তু মণিরাম বিচক্ষণ ডাক্তারই ছিলেন। বর্ধমান থেকেও তাঁর ডাক পড়ত। ইদানীং জনা দুই ছোকরা প্যান্ট-শার্ট পরা ডাক্তার এসে মণিরামকে অস্তাচলে ঠেলে দিয়েছিল।

মণিরামই পান্নাকে বলেছিলেন, ক্যাপসুল গিলতে পারিস না, কিন্তু অত বড় ভাতের গরাসটা গিলিস কী করে?

ভাতের গ্রাস আর ক্যাপসুল কি এক হল জ্যাঠামশাই?

না, তা হল না। কারণ ক্যাপসুল ভাতের গরাসের চেয়ে অনেক ছোট।

তা হোক, ক্যাপসুল বলে কথা। ও আমি গিলতে পারব না। জলে গুলে খেয়ে নেব।

মণিরাম মাথা নেড়ে বলতেন, সে তো অশৈলী কাণ্ড। সব ট্যাবলেট আর ক্যাপসুল কি গুলে খাওয়া যায়? খাওয়া উচিতও নয়। খা দেখি আমার সামনে, কেমন না পারিস।

পান্না পারেনি। চেষ্টা করেছিল, কিংবা বলা ভাল চেষ্টা করার ভান করেছিল, তারপর জলসুদ্ধ ক্যাপসুল ফেলে দিয়েছিল মেঝেয়। মা সেই ভেজা ক্যাপসুল কুড়িয়ে শেষে জলে গুলেই খাইয়েছিল। মণিরাম মাথা নেড়ে বলেছিলেন, এভাবে তো সারাজীবন পারবি না। এখন থেকে ছোট ছোট হোমিওপ্যাথিক বা বায়োকেমিক ট্যাবলেট গিলে গিলে প্র্যাকটিস কর। নইলে পরে বিপদে পড়বি।

প্র্যাকটিস আর করা হয়নি। কণ্ঠনালির রহস্যময় জটিলতা তাকে আজও আতঙ্কিত করে।

ডা. মণিরাম বেঁচে নেই। তাঁর পুরনো স্টেথোস্কোপ, প্রেশার মাপার যন্ত্র, গোরু-ছাগল-পুকুর-জমি-বাড়ি সব পড়ে আছে। ছেলেরা কেউ ডাক্তার হয়নি বলে স্টেথো আর প্রেশারের যন্ত্রে ধুলো পড়ছে।

পান্নার জ্বর এল বিজয়া দশমীর শেষ রাতে। জ্বর যে আসবে তা পান্নার জানাই ছিল। বিজয়া দশমীর বিকেলে নিগ্রোর চুলের মতো কোঁকড়া ও কালো একটা মেঘ দিগন্তে আততায়ীর মতো উঠে এল। তখন প্রতিমা লরির খোলে ভোলা হয়ে গেছে আর মেয়েরা সব হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠছে লরিতে। লরিতে ওঠাও যেন এক যুদ্ধ। টুলের ওপর দাঁড়িয়ে শাড়ি সামলে উঠতে গিয়ে সে মুখ থুবড়ে পড়ল লরির নোংরা পাটাতনে।

মা অবশ্য বারণ করেছিল, যাসনি পান্না। দহে অনেক জল। তুই কিন্তু সাঁতার জানিস না।

 মায়ের বারণ তেমন না শুনলেও চলে। মা কিছু নরম মানুষ। আর বাড়ির লোকের তো সবটাতেই বারণ। শুনলে কি চলে? তাদের তিন বাড়ির প্রায় সব মেয়েই যখন যাচ্ছে তখন পান্নাই বা পড়ে থাকবে কেন?

কিন্তু নিগ্রোর মাথার মতো মেঘটা একটু চিন্তায় ফেলেছিল পান্নাকে। মেঘটা ফুঁসে ফুলে উঠেছিল ক্রমে। যেন হঠাৎ এক অদৃশ্য আগ্নেয়গিরি মাটি খুঁড়ে উঠে এসেছে, ওগড়াচ্ছে তার ভিতরের চেপে রাখা রাগ।

বাদ্যিবাজনাসহ সামনে একটা পদাতিক মিছিল, পেছনে প্রতিমাসহ মেয়েদের লরি, তার পিছনে আরও দুটো লরিতে ক্লাব আর পাড়ার ছেলেমেয়েরা। লরির খোলের মধ্যে পাতা শতরঞ্চিতে ঠাসাঠাসি বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে এক একবার আততায়ী মেঘটাকে দেখছিল পান্না। দেখেছিল পরমাণু বোমার মতো বিশাল ছত্রাকে আকাশের অর্ধেক ঢেকে ফেলেছে প্রায়, ছত্রাকের নীচে পাঁশুটে এক অতিকায় স্তম্ভ। সত্যিই কি অ্যাটম বোমা ফেলল নাকি কেউ?

দুটো কারণে মেঘটাকে ভয় পাচ্ছিল পান্না। এক তো আজকের ভাসান ভাসিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, তার সর্দির ধাত। একটু ঠান্ডা লাগলেই ফুচফুচ হাঁচি আর খুকখুক কাশি আর ঘুসঘুসে জ্বর আর টিপটিপ মাথা ধরা। বৃষ্টির জল তার একদম সয় না। আর কেউ তার মতো নয়। আর সবাই বৃষ্টিতে ভিজে ঠিকঠাক থাকবে, পান্না থাকবে না। তবু বিজয়া দশমী বলে কথা। আজ একটু হুল্লোড় না করলে চলে? পান্না চেপে বসে রইল।

বৃষ্টির আগে একটা বাতাস আসবেই। অগ্রদূত। বাতাসে বৃষ্টির মিঠে গন্ধটা থাকে, আর থাকে হিম। ঝোড়ো বাতাসটা ওই ভিড়ের মধ্যেও ঠিক পান্নাকে খুঁজে নিয়ে ছুঁয়ে ফেলল, চোর চোর খেলার চোরের মতো। গায়ে কাঁটা দিল পান্নার।

মেঘ গম্ভীর গলায় সিংহের মতো ডেকে উঠল দূরে। তারপর গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগল। এসব ঘটনা কেউ গায়ে মাখল না, কিন্তু পান্না আঁচল তুলে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় মাথা ঢাকা দিয়েছিল। বৃথা চেষ্টা।

পান্নাকে লক্ষ করে বরফকুচির মতো প্রথম বৃষ্টির ফোঁটাটি নিক্ষেপ করল মেঘ। পান্না কেঁপে উঠল শীতে। তারপর সরু, ঠান্ডা ভূতের অজস্র আঙুলে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল বৃষ্টি। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা ছেড়ে অসহায়ভাবে পান্না শুধু বলেছিল, হায় ভগবান!

আর সেই বৃষ্টিতে আনন্দে অনেকেই কোলাহল তুলেছিল। বিশেষ করে বাচ্চারা। তারা যে-কোনও অঘটনই খুব পছন্দ করে। ভিজছে আর আনন্দে হি-হি করে হাসছে। হাত বাড়িয়ে চেটো পেতে ধরার চেষ্টা করছে বৃষ্টির জল।

আনন্দ পান্নাও করেছিল কিছুক্ষণ।

বৃষ্টির মধ্যেই দহের ফুটন্ত জলে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে জলে নেমে দাপাদাপি করেছিল অনেকে। পান্না নামেনি। শরীর জুড়ে জ্বরের ঝংকার টের পাচ্ছিল সে।

পারুলদি বলল, এমা! তোর কী হবে রে পান্না?

কী আবার। জ্বর আসবে।

তুই যে কেন এলি! ছাতা-টাতা কিছু আনিসনি?

পাগল! বিসর্জনে কেউ ছাতা আনে?

শোন, তুই বরং ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বোস। আর ভিজিস না। যা ঠান্ডা জল!

ওখানে বসলে যে আলাদা হয়ে যাব।

কিছু আলাদা হবি না। সবাই তো সঙ্গেই রয়েছে। দাঁড়া, বিজুকে বলছি তোকে সামনে তুলে দিক।

তাই হল শেষ অবধি। ড্রাইভারের পাশে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। আরও জনা দুই বুড়োবুড়ি। তাদের পাশে ঠাস হয়ে বসে ফেরার সময়ে পান্নার শরীর ভেঙে আসছিল। ভেজা শাড়ি শায়া, ভেজা শরীরে বাতাস লেগে শিহরিত হচ্ছিল গা।

যখন বাড়িতে এসে পৌঁছল তখন একশো দুই জ্বর। সকালে উঠল চারে। এবং দুপুরে সাড়ে চারে উঠে গেল। চিন্তিত মা ঘরবার করছে। মা মানেই বকুনি, মা মানেই শাসন।

কতবার বারণ করলুম যেতে, তবু শুনলি সেই কথা। তোর কি আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক ধাত? পচা শরীর তোর যখন-তখন ঠান্ডা লাগে, টনসিল ফোলে, তার ওপর ওরকম মুষলধারের বৃষ্টিতে অতক্ষণ ভেজা!

আরও চলত কিছুক্ষণ।

হঠাৎ সেই চিরাচরিত ঝ্যালঝালে লম্বা ঝুলের বিচ্ছিরি জামা পরা একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল দরজায়।

মাই গড! তোমার কি জ্বর? চোখ দুটো তো খুব লাল দেখাচ্ছে!

আবছা একটু হাসল পান্না। ক্ষীণ গলায় বলল, ওই চেয়ারটা টেনে বোসো।

কাল খুব ভিজেছ বুঝি?

হ্যাঁ।

শুনেছি তোমরা সব ভাসানে গিয়েছিলে।

 তুমিও গেলে না কেন সোহাগ? কতবার বললুম।

 অত ভিড় আমার ভাল লাগে না। আর যা শব্দ।

খুব আনন্দ হয়েছিল কিন্তু।

 মুখ টিপে হেসে সোহাগ বলে, একটু একটু ইচ্ছেও হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, আমি তো অনেককেই চিনি না।

যাঃ, না চেনার কী আছে! প্রতিমার লরিতে তো আমরাই সব ছিলাম বাবা। সব মেয়েরা। তোমার গডেসও ছিল।

সোহাগ একটু হাসল। তারপর ফের বলল, একটু একটু ইচ্ছে যে হয়নি তা নয়। চুপি চুপি গিয়ে প্যান্ডেলের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু কেউ ডাকল না দেখে আর এগোইনি৷

আমি দেখতে পেলে ঠিক তোমাকে তুলে নিতাম।

তোমাকেই খুঁজছিলাম। দেখতেই পেলাম না ভিড়ের মধ্যে। এই জন্যই ভিড় আমার ভাল লাগে না। ভিড়ে আইডেন্টিটি হারিয়ে যায়।

সবুজ সংঘের পুজো অনেকটা বাড়ির পুজোর মতোই। অচেনা তো কেউ নয়।

আমার কাছে সবাই প্রায় অচেনা।

তা অবশ্য ঠিক।

তোমরা চলে যাওয়ার পর আমার একটু মন খারাপ লাগছিল। মনে হল, আমি আর একটু মিশুক হলে ভাল হত।

তুমি কি লাজুক?

ঠিক তা নয়।

তবে কি অহংকারী?

 একটু বোধহয় তাই। সবাইকে ইনফিরিয়র ভাবা ভীষণ অন্যায় জানি। কিন্তু আমার ওই এক স্বভাব।

যাঃ, তুমি মোটেই অহংকারী নও। আমার সঙ্গে ভাব হল কী করে বলো?

 তুমি বোধহয় অন্যরকম।

 একটুও না। তবে আমিও কিন্তু একটু অহংকারী। কীসের অহংকার জানি না বাবা। তবে আছে একটু। বন্ধুরা বলে, তোর ভীষণ দেমাক।

তুমি কথা বলতে গিয়ে হাঁফিয়ে পড়ছ। আর কথা বোলো না। চুপ করে চোখ বুজে শুয়ে থাকো। আমি কি তোমার জন্য কিছু করতে পারি?

কী করবে?

 মাথা টিপে দিতে পারি বা আইসব্যাগ ধরতে পারি।

না, না, তুমি বসে থাকো। আমার এখন একটু ভাল লাগছে। অসুখ হলে বড় একা লাগে।

পান্না বাস্তবিক বড্ড ক্লান্ত বোধ করছিল। চোখ বুজতেই কেমন যেন এক আচ্ছন্নতায় তলিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। হিজিবিজি স্বপ্নে ভরে গেল মাথা। তারপর চটকা ভেঙে চেয়ে দেখল, সোহাগ তখনও বসে আছে, চলে যায়নি। একটা হাত রেখেছে তার কপালে।

পান্না ক্ষীণ হেসে বলে, আমি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর তার মধ্যেই একটু স্বপ্নও দেখে ফেললাম।

তুমি ঘুমাও।

 তুমি থাকবে তো?

একটু থাকব। আমার তো কোনও কাজ নেই।

চুপচাপ বসে থেকো না। কথা বলো। নিস্তব্ধতা আমার ভাল লাগে না।

 তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

 করো না। একটা লম্বামতো ছেলে, খুব ফর্সা, কাঁধে একটা বাঁদর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ছেলেটা কে বলো তো!

পান্না হি হি করে হেসে ফেলল, ও তো বিজুদা, ওর অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড। কোথা থেকে একটা বাঁদর এনেছে পুষবে বলে। আমাদের গায়ে ছেড়ে দেয় মাঝে মাঝে। যা ভয় পাই না।

দ্যাট হিরো!

বিজুদা কিন্তু ভীষণ ভাল। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র।

উনি একজন ডু গুডার, তাই না?

 হ্যাঁ। কেন বলো তো?

কাল যখন তোমরা ভাসানে যাচ্ছিলে তখন আমাকে একা প্যান্ডেলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি এসে বললেন, তুমি যাবে না খুকি?

এই যে তুমি বললে তোমাকে কেউ ডাকেনি? বিজুদা তো ডেকেছিল।

 মাথা নেড়ে সোহাগ বলল, মোটেই ডাকেনি।

তা হলে?

উনি কথাটা এমনভাবে বলেছিলেন যাতে আমি খুব অপমান বোধ করেছি।

সে কী? বিজুদা তো সেরকম নয়।

 জুতোর পেরেক কোথায় ফোটে তা টের পায় শুধু জুতোটা যে পরে। আর আমি কি খুকি?

 ওঃ, খুকি বলায় তুমি রাগ করেছ বুঝি?

সেটাও একটা কারণ। আর বলার ধরনটাও ছিল ঠাট্টার মতো। আমার একটুও ভাল লাগেনি।

 তুমি ভুল বুঝেছ সোহাগ। বিজুদা সেরকম ছেলেই নয়।

সেটা তোমার চোখে। আমার চোখে নয়।

তোমাকে বিজুদা অপমান করবে কেন বলো তো! তুমি তো কিছু করোনি।

করেছি। আমি ওঁর সাহায্য রিফিউজ করেছি। যে বাজে ছেলেগুলো আমাকে দেখে কমেন্ট করত উনি তাদের শাসন করতে চেয়েছিলেন। আমি বড়মাকে বলে দিয়েছি ওর সাহায্যের কোনও প্রয়োজন আমার নেই।

ও, তুমি ভীষণ একগুঁয়ে মেয়ে। ছেলেগুলোকে যে একটু ভয় দেখানো দরকার সেটা কেন বোঝো না। প্রশ্রয় দিলে যে বাড়াবাড়ি করতে থাকবে। তোমাকে দেখে যে ভীষণ খারাপ খারাপ কথা বলছিল সেদিন।

সবাই ওকথা বলে।

 কিন্তু আমার কথা হল, লড়াই যদি করতেই হয় তবে আমিই করব। আমার কোনও বডিগার্ডের দরকার নেই।

পান্না খুব ক্লান্তি বোধ করে চোখ বুজল। সোহাগকে তার মাঝে মাঝে খুব ভাল লাগে, মাঝে মাঝে খুব খারাপ। এখন খারাপ লাগছে।

সন্ধেবেলা একজন ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এল বাবা। নতুন ডাক্তার। জ্বরের ঘোরে খুব আবছা চেহারাটা দেখতে পেল পান্না। লোডশেডিং বলে হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে। সেই আলোয় বড় বড় ছায়া পড়েছে চারদিকে। ভূত-ভূত আলো-আঁধারিতে সবকিছুই যেন ভাসমান।

মাথার যন্ত্রণায় চোখে জল আসছে। সেই অস্পষ্ট চোখে সে হঠাৎ আবিষ্কার করল, ডাক্তারের মুখটা খুব গম্ভীর। তার কি তবে সাংঘাতিক কিছু হয়েছে? সে কি মরে যাবে?

আমার কী হয়েছে ডাক্তারবাবু?

স্টেথোস্কোপ বুকে লাগিয়ে ডাক্তার গম্ভীর গলায় বলল, কথা বলবেন না। জোরে শ্বাস নিন।

আমার সারা গায়ে খুব ব্যথা।

জানি। ব্যথা হওয়ারই কথা। জোরে শ্বাস নিন।

বুকে লাগছে যে শ্বাস নিতে।

যতটা জোরে পারেন।

আমি মরে যাচ্ছি না তো!

মরা কি মুখের কথা? দেখি পাশ ফিরে শোন তো একটু।

ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া নয় তো! কিংবা মেনিনজাইটিস।

আজকাল রুগিরা বেশ ভাল ডাক্তারি বুঝে গেছে দেখছি।

একটু আগে আমার মা পাশে বসে কাঁদছিল যে!

 মায়েরা অল্পেই কাঁদে।

আপনি গম্ভীর কেন? বাবার মুখেও হাসি নেই।

আপনি চোখ বুজে থাকলেই ভাল হয়। আপনার কিছু হয়নি তেমন। পালসটা একটু দেখি।

 লেপের তলা থেকে হাতখানা বের করে দিতেই যেন কত পরিশ্রম হল পান্নার।

 এবার জিবটা বের করুন।…এবার হাঁ করুন তো, গলাটা একটু দেখব।

প্লিজ চামচ ঢোকাবেন না কিন্তু, আমার বমি হয়ে যাবে।

আচ্ছা আচ্ছা, চামচ ছাড়াই দেখে নিচ্ছি। বড় করে হাঁ করুন।

মণিরাম জ্যাঠাও এইভাবেই দেখতেন। খুব মন দিয়ে। নাড়ি ধরে অনেকক্ষণ চোখ বুজে থাকতেন। স্টেথোস্কোপ বসাতেন চেপে চেপে। নানারকম প্রশ্ন করতেন। পায়খানা, পেচ্ছাপ, খিদে সবকিছুর খতেন নিয়ে তবে প্রেসক্রিপশন লিখতেন। এ ডাক্তার অবশ্য অত সময় নিল না। প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বলল, জ্বর খুব বাড়লে ঠান্ডা জলে গা স্পঞ্জ করে পাখার বাতাস করবেন। জ্বর নেমে যাবে। প্যারাসিটামলটা দুবারের বেশি দেবেন না।

মা অবাক হয়ে বলে, ঠান্ডা জলে?

হ্যাঁ। ভয় নেই, কিছু হবে না।

 ডাক্তারটা বোধহয় পাগল। এমনিতেই শীতে মরে যাচ্ছে পান্না, ঠান্ডা জল গায়ে দিলে সে তক্ষুনি হার্টফেল করবে।

পথ্যি কী দেব ডাক্তারবাবু?

কেন, ভাতরুটি যা খেতে চায়?

এই জ্বরে ভাত?

 হ্যাঁ, ভাতে কোনও ক্ষতি হবে না।

ডাক্তারটার মাথা খারাপ। মণিরাম জ্যাঠা জ্বর সারবার পরেও আরও দুদিন ভাত পথ্য দিতেন না। স্নান নিষিদ্ধ ছিল বেশ কয়েকদিন। বার্লি ছাড়া পথ্য ছিল না।

কী দিলেন ডাক্তাবাবু? ক্যাপসুল?

হ্যাঁ। কেন বলুন তো।

আমি ক্যাপসুল গিলতে পারি না।

সে কী? ক্যাপসুল না খেলে অসুখ সারবে কেমন করে?

 লিকুইড নেই?

লিকুইড। না, এই হাই পোটেনসিতে লিকুইড পাওয়া যায় না।

আমি যে গিলতে পারি না। ক্যাপসুল গুলে খেতে রয়।

ডাক্তারবাবুটি হাসলেন। কিন্তু উপদেশ দেওয়া বা জবরদস্তির চেষ্টা না করে বললেন, সেভাবেই খাবেন। তবে একটু তেতো লাগবে হয়তো। অরেঞ্জ স্কোয়াশ থাকলে তাতে গুলেও খেতে পারেন।

ক্যাপসুল গিলতে পারি না বলে আপনি কই বকলেন না তো!

 ডাক্তারবাবুটি ফের হাসলেন, অনেকের সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম থাকে, ওষুধ গিলতে ভয় পায়। বকবার মতো কিছু তো নয়। আমার এক জামাইবাবু আছেন, তিনিও ট্যাবলেট গিলতে পারেন না।

বাঁচল পান্না, শ্বাস ফেলল একটা।

আচ্ছা এনকেফেলাইটিস বলে একটা অসুখ আছে, না! সেটা হলে কী হয়?

খারাপ হয়।

 মরে যায়?

মরতেও পারে।

আমার এনকেফেলাইটিস হয়নি তো!

আপনি খুব খারাপ খারাপ অসুখের কথা ভাবতে ভালবাসেন বুঝি?

আমার যে মনে হচ্ছে আমি মরে যাব।

অসুখ হলেই অনেকের ওরকম মনে হয়।

 টাইফয়েড হয়নি তো!

সেটা এত আর্লি স্টেজে তো বলা যাবে না। তবে আপনার জ্বর হয়েছে ঠান্ডা লেগে। বুকে সর্দি জমেছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

কয়েক মুহূর্তের জন্য তার ভিতরে চলে গেল পান্না। দেখতে পেল মণিরাম ডাক্তার ঘোড়ায় চেপে রুগি দেখতে যাচ্ছেন, সাদা জামার ওপর ফর্সা রোদ পড়েছে।

কিন্তু মণিরাম জীবনে কখনও ঘোড়ায় চড়েননি। তাঁর ছিল একখানা বশংবদ সাইকেল। তা হলে ঘোড়াটা এল কোথা থেকে?

পান্না যখন চোখ মেলল তখনও ডাক্তার যায়নি। তবে উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার যাবে। কারেন্ট আসায় ডাক্তারবাবুটিকে স্পষ্ট দেখতে পেল পান্না। বেশি বয়স নয়। ত্রিশ-বত্রিশ হবে হয়তো। তার দিকে চেয়ে হেসে বলল, দু-একদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবেন। ভয় নেই।

পান্না চোখ বুজল এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নের মধ্যে চলে গেল। মণিরাম জ্যাঠা পাশে এসে বসেছে। চোখে নিবিষ্ট দৃষ্টি।

দেখি, হাতখানা দে তো!

উঃ জ্যাঠা, আপনার হাত এত ঠান্ডা কেন?

 ঠান্ডা! ঠাণ্ডাই তো হওয়ার কথা। তোর গায়ে যে জ্বর।

 জ্যাঠা, আপনার কি ঘোড়া আছে?

হ্যাঁ। থাকবে না কেন?

ঘোড়ায় চেপে আপনি রুগি দেখতে যান?

 হ্যাঁ। এই তো বিদ্যাধরীপুর থেকে এলুম। সেখানে কলেরা হচ্ছে।

ইস। তা হলে আমার হাতটা ছাড়ুন। আপনার হাতে যে কলেরার জীবাণু রয়েছে।

তা আছে। খুব আছে।

এখন আমাকে যে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে!

 হ্যাঁ, ধোয়া ভাল। হাত ধোয়া খুব ভাল।

কতক্ষণ কে জানে। ফের চোখ মেলল সে। মাথার আইসব্যাগ থেকে সমস্ত শরীরে শীত ছড়িয়ে পড়ছে।

ওঃ মা, আইসব্যাগটা সরিয়ে নাও। ঠান্ডা লাগছে যে!

 তোর যে জ্বর।

কত জ্বর?

একশো দুই-টুই হবে।

মোটেই না। আমার এখন একশো ছয় সাত হয়ে গেছে।

না না, অত নয়।

ডাক্তারবাবু কী বলে গেল?

কী আর বলবে?

আমার কী হয়েছে?

 কী আবার হবে। জ্বর হয়েছে।

সাধারণ জ্বর নয় মা, আমি জানি।

এতই যদি জানো বাছা, তবে জ্বরটাকে ডেকে আনতে ভাসানে না গেলেই তো পারতে।

একটা দিন ভাসানে আনন্দ করব না?

আনন্দ তো এখন বেরোচ্ছে। এখন চিঁচিঁ না করে আনন্দ করলেই তো হয়।

তুমি একটা বিচ্ছিরি মা। পচা মা। অসুখ হলে কাউকে বকতে হয় বুঝি?

 বকব না তো কি আহ্লাদ করব নাকি? পই পই করে বারণ করলুম, শুনলি সে কথা!

 শোনো মা, আমি একটু আগে মণিরাম জ্যাঠাকে স্বপ্নে দেখেছি, জ্যাঠা এসে আমার নাড়ি দেখছিল। আমি কিন্তু আর বাঁচব না। মরা মানুষের স্বপ্ন দেখা খারাপ, তা জানো?

দুর্গা দুর্গা। ওসব কথা বলে না। বলতে নেই। বড় ডাক্তার দেখে গেছে। ভয়ের কী আছে মা?

 ডাক্তারটি কে বলো তো! কখনও দেখিনি।

বর্ধমানের ডাক্তার। অনেক ডিগ্রি।

বর্ধমানের ডাক্তার যা বলে গেল শুনবে তো! জ্বরের মধ্যে আমাকে ভাত খেতে দেবে?

 বড্ড ভয় পাই মা। কোনওকালে এমন অশৈলী কথা তো শুনিনি। আজকালকার তেজালো ওষুধের জোরে ওসব হয়তো চলে। কিন্তু ভাত না হয় জ্বর সারলেই খাস।

তা হলে ডাক্তার দেখিয়ে কী হবে?

পান্না ফের আচমকা স্বপ্নের জগতে চলে গেল। ঝোপের আড়াল থেকে কে একটা পাগলি তাকে ঢিল মেরেই লুকিয়ে পড়ল। ঢিলটা ঠং করে কপালে এসে লাগতেই মাথাটা ঝনঝন করে উঠল ভয়ংকর ব্যথায়।

কে? কে রে তুই?

পাগলিটা হি হি করে হেসে একটা ঝোপের আড়াল থেকে যখন আর একটা ঝোপের আড়ালে ছুটে গেল তখনই পান্না দেখতে পেল তার পরনে ঝালঝালে একটা বিবর্ণ জামা।

তুমি সোহাগ।

হি হি হি।

এমা! তুমি পাগল হলে কী করে?

ওরা যে আমাকে রেপ করল!

 কারা রেপ করল তোমাকে?

ওই তো ওরা।

তুমি আমাকে ঢিল মারছ কেন?

ওরা পাজি। ভীষণ পাজি।

তোমাকে তো বলেইছিলাম ওদের একটু ভয় দেখানো দরকার। তুমি শুনলে না। বিজুদাকে কিছু করতেও দিলে না।

তোমার বিজুদা কি ভগবান?

 তা কেন? বিজুদা একজন ডু গুডার।

ওকে আমার চাই না, বলে দিও। বেশ করেছে রেপ করেছে।

 কাছে এসো সোহাগ। ঢিল মেরো না। আমি তো তোমার বন্ধু।

হি হি হি হি।

ফের চটকা ভেঙে গেল।

ওষুধটা খেয়ে নে!

 তেতো বিচ্ছিরিওষুধটা খেয়ে নিয়ে পান্না বলল, ইস, অরেঞ্জ স্কোয়াশ দাওনি। ডাক্তারবাবু বলে গেল যে!

ভুল হয়ে গেছে মা। এর পর থেকে দেব। আরও ওষুধ আছে। একটা ট্যাবলেট আর একটা ক্যাপসুল।

ভীষণ বেশি ওষুধ দেয় তো লোকটা।

 তা দেবে না কেন। অসুখটাও তো ভালই বাধিয়েছ।

স্বপ্ন আর জাগরণের মধ্যে একটা মজার যাতায়াত চলছে তার। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সে দুর্গা প্রতিমার মুখ দেখতে পাচ্ছিল কিন্তু মুখটা জলে ডুবে আছে। মা দুর্গা যেন চিৎকার করে বলছে, এই! এই! আমি ডুবে যাচ্ছি যে! আমি সাঁতার জানি না, আমাকে তোলা।

এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের চেঁচামেচিতে মা দুর্গার চিৎকার চাপা পড়ে গেল। আর তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। পান্না একজনের বুকে দুম দুম কিল মারতে মারতে বলল, কী করছ তোমরা! মা দুর্গাকে ভোলো শিগগির! মা দুর্গা ডুবে যাচ্ছে যে!

লোকটা বলল, মা দুর্গাকে তুলতে নেই। আপনি ঘুমোন।

কেন ঘুমোব?

আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। সব দিকে নজর রাখার দরকার কী?

অবাক হয়ে পান্না দেখল, লোকটা নতুন ডাক্তারবাবুটি।

সে লজ্জা পেল। জ্বর নেমে যাচ্ছিল তার। মাথা ধরা কমে যাচ্ছে। গা ঠান্ডা হয়ে আসছে। শীত লাগছে না তেমন। প্যারাসিটামল খেলে এরকম হয় কিছুক্ষণের জন্য। সে জানে। জ্বর কমল বলেই বোধহয় স্বপ্নও আর তেমন দেখল না সে।

মা।

কী রে?

 জল দাও।

মা জল দিল।

এখন রাত কত মা?

বারোটা।

আমাকে ওষুধ খাওয়াবে না?

 খাওয়াব। তার আগে বার্লি।

ওয়াক। ওরকম করতে হয় না মা। ডাক্তারবাবু কি কাল আবার আসবে।

তো! বড় ডাক্তার কি রোজ আসে? পান্না একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে যদি বিয়ে করে একজন ডাক্তারকেই করবে।

.

১৮.

যেন অতল জল থেকে উঠে আসা। এক ঘোর-ঘোর রূপকথার জগৎ থেকে বাস্তবের চৌকাঠে পা রাখা, কোনটা ভাল তা পান্না বলতে পারবে না। স্বপ্ন আর সত্যের মেলামেশা যে অদ্ভুত জগতে সে ছিল কয়েকদিন–তা তো কই খারাপ লাগছিল না তার। মৃত্যুভয় অবশ্য ছিল, কিন্তু তা তো তার সবসময়েই থাকে। অসুখ হলে একটু বেড়ে যায়, এই যা।

সকালবেলার আলো-ঝলমলে ঘরে দুর্বল শরীরে উঠে বসেছে পান্না। বুক অবধি লেপ টানা দেওয়া ছিল। লেপটা কোলের ওপর খসে পড়েছে। নিজের দুখানা হাত চোখের সামনে তুলে ধরে খুব মন দিয়ে দেখছে সে। একেই সে রোগা। এই অসুখে আরও কি রোগা হয়ে গেছে সে?

জ্বর ছেড়ে গেলে শরীরটা যেন বেশি ঠান্ডা মেরে যায়। খুব শান্ত এক শীতলতায় ভরে আছে শরীর। খুব দুর্বল। মুখে বিস্বাদ।

মা!

হুঁ।

আমি কি আজ চান করব?

 পাগল!

গা থেকে বোঁটকা গন্ধ পাচ্ছি যে!

 মোটেই কোনও গন্ধ নেই। আমি তো পাশেই শুই, গন্ধ হলে পেতুম না!

 আমি পাচ্ছি যে!

গন্ধের নাক একটু কমাও মা। সবতাতেই গন্ধ-গন্ধ বলে নাক সিঁটকোলে তো হবে না। বড্ড গন্ধ বাই। তোর।

তাহলে কি নাকটা উকো দিয়ে ঘষে দেব?

 আর উকো দিয়ে ঘষতে হবে না, এমনিতেই তো নাকটা একটু চাপা।

কই চাপা? দাও তো আয়নাটা! তুমি তো আমার সবকিছুই খারাপ দেখ।

আয়নায় নিজের নাক মোটেই চাপা বলে মনে হল না তার। একটু ছোট বটে, কিন্তু মোটেই চাপা নয়।

আমি কি খুব কুচ্ছিত মা?

কুচ্ছিত না হলেও ডানাকাটা পরি তো আর নও। জ্বরের আগে তাও যা একটু ছিল, জ্বরের পর তো হাড়গিলে চেহারা হয়েছে।

শুধু বার্লি গিলিয়ে রেখেছ, চেহারা তো খারাপ হবেই। ডাক্তারবাবু ভাত দিতে বলে গেল, তুমি কিছুতেই দিলে না।

আহা, ডাক্তাররা বড় পণ্ডিত কি না। নিদান দিয়ে দক্ষিণা পকেটে খুঁজে পগার পার হল, তারপর যত হ্যাপা সব আমাদের সামলাতে হবে।

ডাক্তারের কথা যদি না-ই শুনবে তবে ডাক্তার ডাকো কেন?

সে ডাকতে হয় বলে ডাকা। ডাক্তার ওষুধ দেবে, পথ্যি আমাদের হাতে।

বাঃ, বেশ মজা তো! ডাক্তারের কথা অর্ধেক শুনবে আর অর্ধেক ফেলে দেবে?

সেটাই রেওয়াজ। ডাক্তারদের কথা পুরো কেউ শোনে না। জন্মে শুনিনি একশো পাঁচ ছয় জ্বরে কেউ ভাত দেয়। মণিরাম ডাক্তার শুনলে মূর্ছা যেতেন। ওসব হালফিলের ডাক্তারের ওপর আমার ভরসা হয় না তেমন।

আজ তো জ্বর নেই, দেবে তো চাট্টি ভাত?

আজকের দিনটা থাক না, কাল খাস।

আমি কিন্তু আর বার্লি গিলতে পারব না। বার্লির বাটি ছুঁড়ে ফেলে দেব জানালা দিয়ে।

আচ্ছা, দুটো পাতলা রুটি দেব খন, আলু বড়ির ঝোল দিয়ে খাস।

 রুটি! আমার যে অম্বল হয়ে যায়।

বাবা রে, বায়নাক্কার শেষ নেই তোর।

 মুখটা যে কী বিস্বাদ! একটা লঙ্কা দেবে?

লঙ্কা!

লঙ্কা আর নুন খেলে জিবটা বোধহয় পরিষ্কার হবে।

 পাগল নাকি? বরং আদাকুচি আর নুন খা। কাশিরও উপকার হবে।

তাই দাও বাবা। তার আগে এক কাপ চা। দেবে তো?

আবার চায়ের বায়না কেন? একেই তো লিভার ভাল নয়।

ওই এক কথা শিখেছ তুমি। লিভার ভাল নয়। কী করে জানলে যে আমার লিভার ভাল নয়? তুমি কি ডাক্তার? লিভার কাকে বলে তাই তো জানো না।

না জানলেও বুঝতে পারি। ওসব শিখতে হয় না আমাদের। তোর কটা শ্বাস পড়ল তারও হিসেব আমার আছে।

কাঁচকলা আছে। বলো তো সকাল থেকে কটা শ্বাস ফেলেছি? অত সোজা না। মা হয়েছ বলে মাথা কিনে নিয়েছ বুঝি!

তাই নিয়েছি। এই যে বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করলুম, শুনলি সেই কথা? মায়েরা সব আগাম খবর পায়, তা জানিস?

পান্না হেসে ফেলে, দুহাত বাড়িয়ে বলে, এসো তো আমার কাছে! একটু আদর করো।

আর আদিখ্যেতায় কাজ নেই মা। জড়াজড়ি করলেই বুঝি আদর হয়? রাত জেগে মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকা, মাথায় জলপট্টি বা তালুতে বরফ দেওয়া, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওষুধ খাওয়ানো সেসব বুঝি আদর নয়?

সে তো কেজো আদর। একটু অকাজের আদর করো তো! মুখটা সবসময়ে ওরকম গোঁসাপানা করে রাখো কেন? হাসতে জানো না?

হাসি বুঝি অমনি আসে! কটা দিন তো হাড় ভাজা-ভাজা করে খেলে। একশো পাঁচ ছয় জ্বর উঠে যাচ্ছে, সবাই ভয় দেখাচ্ছে বেশি জ্বরে নাকি মাথায় রক্ত উঠে যায়। ভয়ে মরি। হাসি আমার শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে।

জ্বর বুঝি মানুষের আর হয় না! না হয় মরেই যেতাম। তোমার একটা চক্ষুশূল কমত। হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে।

খুব বুঝেছ।

তুমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসো দাদাকে, সেকেন্ড হীরা, আমি লাস্ট।

তাই না?

 ওই তো বললুম, খুব বুঝেছ।

জ্বরের ঘোরে আমি বারবার কাকে দেখেছি জানো? মণিরাম জ্যাঠাকে। মণিরাম জ্যাঠা এসে পাশে বসে আমার নাড়ি দেখছিল। কী ঠান্ডা হাত!

থাক, ওসব আবার মনে করতে হবে না। অলক্ষুণে সব স্বপ্ন।

মরা মানুষকে স্বপ্ন দেখা ভাল নয়, না?

স্বপ্ন স্বপ্নই। তার কি কোনও মাথামুণ্ডু আছে! জ্বরের ঘোরে কত হাবিজাবি দেখে মানুষ। ওসব নিয়ে ফের ভাবতে বোসো না। একেই তো ভিতুর ডিম!

আমার অত জ্বর দেখে বাবা কেমন করল বলবে?

পুরুষমানুষ বড্ড নরম হয়। তার ওপর বাপসোহাগী মেয়ে। কেমন আবার করবে। ঘরবার করেছে, বারবার জ্বর মেপেছে, আর উদ্ভট উদ্ভট সব নিদান দিয়েছে।

কী রকম মা? একটু বলো না!

 কোথায় কোন তান্ত্রিকের কাছে যাবে বলে বায়না ধরেছিল। আমি যেতে দিইনি। তান্ত্রিকদের নানা মতলব থাকে। কোন ফকিরবাবার জলপড়ার কথাও যেন বলছিল। তখন কি আর কারও মাথার ঠিক ছিল মা?

আর হীরা?

ও বাবা এমনিতে দু বোনে বনিবনা নেই বটে, কিন্তু যেই দিদির জ্বর হল অমনি হীরা জব্দ, সারাদিন চোখ ছলোছলে, ভাল করে খায় না, ঘুমোয় না। বেশ খেলা দেখিয়েছ।

তাকে নিয়ে যে বাড়িতে একটা ভীষণ টেনশন গেছে এটা জেনে খুব খুশি হচ্ছিল পান্না। এইসব অসুখ-বিসুখ শরীর নিংড়ে নেয় বটে, কিন্তু বিনিময়ে কিছু পুরস্কারও তো দিয়ে যায়। অসুখের ভিতর দিয়ে কি মানুষের একটা নবীকরণও হয়?

কে কে আমাকে দেখতে আসত বলো তো! বড়মা আসেনি?

ওমা! বড়দি আসবে না? রোজ দুবেলা এসেছে। বকুল, পারুল, জামাইরা সবাই এসে ঘুরেফিরে দেখে গেছে।

আমি কিন্তু টের পাইনি কিছু।

কী করে পাবে? চৈতন্যই তো ছিল না একরকম। মাঝে মাঝে একটু চেতনা এলে দু-চারটে হাবিজাবি কথা বলে ফের ঘোরে ডুবে যেতিস।

ধ্যেৎ! বলে হাসে পান্না, হাবিজাবি বলতাম বুঝি?

বেশিরভাগই অসংলগ্ন কথা। মাথামুন্ডু নেই।

কেউ শোনেনি তো!

তেমন কেউ নয়। শুধু ওই অমলের মেয়ে সোহাগ। সে সারাক্ষণ তো মুখের ওপরই পড়ে থাকত।

সোহাগ কি কলকাতায় চলে গেছে মা?

জানি না বাপু। কাল থেকে তো আসছে না। আমারও কি পাড়াপ্রতিবেশীর খবর নেওয়ার সময় ছিল?

আজ কি খুব শীত পড়েছে?

তা পড়েছে বাছা। সকালে তো কনকনে হাওয়া দিচ্ছিল।

তা হলে আমাকে উঠোনে একটা চেয়ার পেতে দাও। রোদে একটু বসি। কতকাল বাইরেটা দেখা হয়নি।

আজ থাক না। শরীর দুর্বল, মাথা-টাথা যদি ঘুরে যায়।

কিছু হবে না মা। পেতে দাও। 

বাইরে রোদে বসে চারপাশটাকে চোখ নাক ত্বক দিয়ে শুষে নিচ্ছিল পান্না। বাঁ ধারে বড় জ্যাঠাদের তিনতলা বাড়ির ছাদ দেখা যায়, ঘোষবাড়ির মস্ত মস্ত নারকোল গাছে আছাড়ি-পিছাড়ি হাওয়া, পুকুরপাড় থেকে বাসন ধোয়ার শব্দ আসছে, একটা গোরু হাম্বা বলে ডেকে উঠল।

আজ হাওয়ার দিন। বাতাসে লুকোনো ছুরির মতো শীত এসে তার শরীরের আনাচে কানাচে ঢুকে যাচ্ছে। একটা বাটিতে মুড়ি আর আধকাপ চা দিয়ে গেছে মা। মুড়িটা বাতাসের থাবায় অর্ধেক উড়ে গেল। তাড়াতাড়ি জুড়িয়ে গেল চা। গায়ের আলোয়ানটা উড়ে যাচ্ছে বারবার বাতাসের ঝাপটায়। রোদ তেমন গায়ে লাগছে না।

না, এই শীত বাতাসটা সহ্য করা তার উচিত হচ্ছে না। ফের যদি জ্বর আসে।

 হাহাকারের মতো শব্দ উঠছে গাছপালায়। বাতাস বড্ড দামাল। রোদের তাপটুকু লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। উঠোনে এ সময়ে যেসব পুষি বেড়াল বা ভেলু কুকুরেরা বসে থাকে তারাও কেউ নেই।

একটু বসে থাকার ইচ্ছে হয়েছিল পান্নার। সাহস হল না। উঠে ঘরে চলে এল। বিছানায় বসে কোমর অবধি লেপটা টেনে নিল। গলায় জড়িয়ে নিল মাফলার। কোলে পুবের জানালা দিয়ে ঝকঝকে রোদ এসে পড়েছে। তাপটুকু বড় ভাল লাগছে তার। বাইরে লুটেরা বাতাসের দাপাদাপি। শীত করছে।

চোখ জ্বালা করে জল আসছে। বুকে ধুকুরপুকুর। গলায় খুশখুশ। জ্বর আসছে নাকি? ও বাবা, তা হলে মরেই যাবে সে। রোদে রোগা দুখানা হাত মেলে দিয়ে সে ফর্সা চামড়ার নীচে নীল শিরা উপশিরা দেখতে পাচ্ছিল। গায়ে জ্বরের গন্ধ। না, তার ভাল লাগছে না। সে চোখ বুজল, ঠিক তার জ্বর আসবে।

চোখ বুজে ভারী মন খারাপ লাগছিল তার। জ্বর এলে আবার তো পড়ে থাকা। কান্না পাচ্ছে যে!

দাঁতে ঠোঁট কামড়ে যখন এই অলক্ষুণে চিন্তা করছিল পান্না, তখনই ফের মনে হল, জ্বর কি খুব খারাপ? বেশ তো কয়েকটা দিন এক অদ্ভুত আলো-আঁধারের জগতে বাস করে এল সে। স্বপ্নের কত ফুলঝুরি ঝরে পড়ল চোখে। কত কিম্ভুত দৃশ্য দেখল। জ্বর এলে হয়তো সেই ডাক্তারটিও আসবে। তার নাম অনল বাগচী। কী অদ্ভুত নাম। ডাক্তারের মুখটা মনেও পড়ে না তার। কেমন দেখতে কে জানে! ক্যাপসুল-ট্যাবলেট গিলতে পারে না বলে তাকে বকেনি একটুও। আর ভাত খেতে বলেছিল। বেশ ডাক্তার। মণিরাম জ্যাঠার মতো নয়।

মণিরাম জ্যাঠা রুগি দেখতে আসতেন ঠিক ডাক্তারের মতো নয়। অনেকটা আত্মীয়ের মতো। বসে রাজ্যের গল্প ফেঁদে বলতেন। একসময়ে সত্যাগ্রহ করেছেন, জেল খেটেছেন, গান্ধীবাবার কাজ করেছেন–সেসব কথা, বাজারদর, গাঁয়ের পলিটিক্স, তাবিচকবচ, রান্নাবান্না, এমনকী ভূত-প্রেত নিয়েও কথা কইতেন, যার মধ্যে ডাক্তারির নামগন্ধও থাকত না। বেশ ভালই লাগত জ্যাঠাকে। কিন্তু ডাক্তারির রকমটা ছিল বড্ড সেকেলে। জ্বর হয়েছে তো কী? মণিরাম ডাক্তার কিছুতেই চট করে জ্বর কমানোর ওষুধ দেবেন না। তাঁর বক্তব্য, ওরে বাবা, জ্বর যখন শরীরের দখল নিয়েছে তখন তারও একটা মেয়াদ আছে। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাকে বার করতে গেলে শরীরে তার দাঁত নখের দাগ থেকে যায়। হুড়োহুড়ি করার কিছু নেই। জ্বর ঠিক সময়মতো ছেড়ে যাবে। যাতে খুব জট না পাকায় ডাক্তারের কাজ হচ্ছে তাই দেখা।

মণিরাম দাস্ত বা বমিও চট করে বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। পেনিসিলিন পারতপক্ষে দিতেন না। এমনকী পান্নার বাবার যখন টাইফয়েড হয়েছিল তখনও টাইফয়েডের নির্দিষ্ট ওষুধ না দিয়ে বাহান্ন দিন ভুগিয়েছিলেন বাবাকে। আর বাবাও মণিরামের অন্ধ ভক্ত ছিলেন বলে অন্য ডাক্তার ডাকেননি। বার্লি গিলেছিলেন, রোগা হয়ে মুরগির ছানার মতো চেহারা হয়েছিল, এত দুর্বল যে হাঁটাচলা করতে দিন পনেরো সময় লেগেছিল।

এটা নিশ্চিত যে মণিরামের যুগ আর নেই। মণিরাম জ্যাঠার সঙ্গে অনল বাগচীর অনেক তফাত।

অনল বাগচী! কী অদ্ভুত নাম! নামটা গুনগুন করছে মনের মধ্যে। মানুষটার নয়, নামটারই প্রেমে পড়ে গেল নাকি সে? নাকের কাছে হাতটি ফেলে সে শ্বসের তাপ দেখছিল গরম নয় তো!

তার একটু গন্ধ-বায়ু আছে এ কথা ঠিক। যেখানে কেউ কোনও দুর্গন্ধ পায় না সেখানেও দুর্গন্ধ আবিষ্কার করার আশ্চর্য প্রতিভা আছে তার। গেলবার পিকনিকে যে নোকটা মাংস পরিবেশন করছিল তার জামায় আঁশটে গন্ধ পেয়ে ওয়াক তুলে মরে। মানুষের গায়ের গন্ধ, মুখের গন্ধ, হাসপাতালের গন্ধ, লোহার গন্ধ, বিড়ির গন্ধ, জামাকাপড়ে বাসি গন্ধকত গন্ধই যে সারাদিন তাকে তাড়া করে তার ঠিকঠিকানা নেই।

এ-বাড়ির রেওয়াজ হল, জ্বর হলে ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজা বন্ধ। সর্ষের তেল আর নুন দিয়ে মাজতে হবে। মাকে কে যে এই নিয়ম শিখিয়েছে কে জানে বাবা! তেল নুন দিয়ে মাজলে দাঁত একটুও পরিষ্কার হয় না, বরং কাঁচা সর্ষের তেল আর নুনে দাঁত ঝিনঝিন করে। নিজের মুখ থেকে যেন বাসি গন্ধ পাচ্ছিল পান্না। আর গা থেকেও বোঁটকা গন্ধ। অপছন্দের গন্ধ সে একদম সইতে পারে না। সে শরীরে ট্যালকম পাউডার ছড়াল। মুখে লবঙ্গ ফেলে চিবোল খানিকক্ষণ। তবু খিতখিত করে তার। কিছু করার নেই বলে উঠে বাসি জামাকাপড় ছেড়ে কাঁচা শাড়ি পরল। চুল আঁচড়াল। কপালে একটা টিপ সেঁটে নিল। তারপর একখানা গল্পের বই নিয়ে বসল বিছানায়। বিরহের গল্প তার ভীষণ প্রিয়। বিরহের মতো জিনিস আছে! পড়লে চোখে জল আসবে, বুক ভার হয়ে উঠবে, মরে যেতে ইচ্ছে করবে–তবে না গল্প!

এই উপন্যাসটা তার বহুবার পড়া। বামুনের মেয়ে। পড়তে পড়তে উদাস হয়ে মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে পান্না। এত সব বিয়োগান্ত ঘটনা যে, এই সুন্দর ঝকঝকে সকালটা যেন আস্তে আস্তে বিবর্ণ পাঁশুটে হয়ে যেতে থাকে।

সরস্বতী গোবর কুড়াচ্ছে। ময়লা কাপড় পরনে, পিঙ্গল চুল, মুখশ্রীতে কোনও আনন্দ নেই। আজকাল দেখা হলে হাসে একটু, কথা বলতে লজ্জা পায়। সরস্বতী তার সঙ্গে পড়ত। কিন্তু মাথায় পড়া ঢুকত না বলে সিক্স থেকে ফেল করতে শুরু করে। তারপর অনেক পিছিয়ে পড়াই ছেড়ে দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল পান্নার। পৃথিবীতে যে কত ট্র্যাজেডি! সরস্বতীর সঙ্গে এখনও তার তুই তোকারির সম্পর্ক। তবু দুজনের যে কত তফাত!

সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে থাকত অমলেন্দু। তাকিয়েই থাকত। শোনা যায় চোখের পলক অবধি পড়ত না। সরস্বতী স্কুলে যাচ্ছে, কদমতলায় ঠিক অমলেন্দু নিষ্ঠার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। দুটি চোখ পেতে। সরস্বতী টিফিনের সময় স্কুলের মাঠে খেলছে বা আলুকাবলি খাচ্ছে, উলটোদিকে ঠিক অমলেন্দু দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচুর মতো।

না, কখনও কথাটথা বলতে এগিয়ে আসেনি, হাতে চিঠি গুঁজে দেয়নি বা হিন্দি প্রেমের গান গায়নি চেঁচিয়ে। শুধু তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই তেমন করেনি সে।

কিন্তু এতেই ভারী ভয় পেত সরস্বতী। অমলেন্দুকে দেখলেই সে সাদা হয়ে সিঁটিয়ে যেত।

দেখ, দেখ, ছেলেটা আজও দাঁড়িয়ে আছে।

বন্ধুরা বলত, দে না একদিন দু কথা শুনিয়ে।

 ও বাবা, সে আমি পারব না, বড্ড ভয় করে।

 আহা, ভয়টা কীসের? তুই না পারিস, আমরাই দিচ্ছি শুনিয়ে।

সরস্বতী ভয় খেয়ে বলত, তাতে যদি খেপে গিয়ে আরও কিছু করে?

কী করবে?

কী করবে তা ভেবে পেত না সরস্বতী। মেয়েদের বিরুদ্ধে পুরুষেরা কত কীই তো করতে পারে। অ্যাসিড বালব ছুঁড়ে মারল, কি কলঙ্ক রটাল বা গুণ্ডা লাগিয়ে টেনে নিয়ে গেল। মেয়েরা কি পারে পুরুষদের সঙ্গে?

বন্ধুরা শেষ অবধি একদিন কদমতলায় ঘিরে ধরল অমলেন্দুকে।

এই যে, আপনি রোজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন বলুন তো! কী মতলব?

অমলেন্দু ভয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে, শরীর মুচড়ে সপ্রতিভ হয়ে বলল, এমনি দাঁড়িয়ে আছি। মতলব কিছু নেই।

মতলব নেই বললেই হল! সরস্বতী আপনার ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। ফের যদি এরকম করেন তা হলে কিন্তু আমরা তোক ডাকব।

অমলেন্দু অপমানিত হয়ে চলে গেল।

প্রকাশ্যে আর সে দেখা দিত না বটে, কিন্তু ঘাপটি মারার সুযোগ তো কম নেই। এই ঘটনার পর সে পুরনো শিবমন্দিরের ভাঙা পাঁচিলের আড়াল থেকে একটা ফুটো দিয়ে সরস্বতীকে রোজ দেখত।

আর কেউ টের না পেলেও সরস্বতী ঠিকই টের পেত অমলেন্দুকে। প্রকাশ্যে একরকম ছিল। তাতে গা-ছমছম করত না। কিন্তু অমলেন্দু যখন আড়াল হল তখন উৎকণ্ঠা আর ভয় বেড়ে গেল সরস্বতীর।

বন্ধুরা এবারও অমলেন্দুকে ধরল। তাদের দেখে সে পালাতে যাচ্ছিল। স্কুলের সাহসী মেয়ে বনলতা দৌড়ে গিয়ে তাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দেয়।

অতগুলো মেয়ের মারমুখী ভাব দেখে অমলেন্দু ভয়ে কেঁদেই ফেলেছিল।

আমি তো কিছু দোষ করিনি!

দোষ করেননি মানে! আপনি রোজ গা ঢাকা দিয়ে সরস্বতীকে ফলো করেন। আপনার মতলব খারাপ।

বিশ্বাস করুন, আমার খারাপ মতলব ছিল না।

তবে ওরকম করেন কেন?

কী জানি! ওকে না দেখলে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়।

বাঃ, বেশ তো কথা! দাঁড়ান, আপনার বাড়িতে বলে দেবো।

না না, বলবেন না। আমি আর আসব না।

 অমলেন্দু ভয় পেয়ে কদিন সত্যিই আর সরস্বতীর যাতায়াতের পথে আসত না।

দেখতে সরস্বতী বরাবরই ভাল। সুন্দরী না হলেও মিষ্টি লাবণ্য আছে। ঢলঢলে গোলপানা মুখ, বড় টানা চোখ। কিন্তু ভারী ভিতু। কোনও ছেলের সঙ্গে প্রেম করার কথা ভাবতেই পারত না।

পান্না ওকে বলেছিল, ছেলেটা যখন ওরকম হ্যাংলামি করে তখন একটু-আধটু কথা বললেই তো পারিস। কথাটথা বললে আর ওরকম ছোঁকছোঁক করবে না।

কথা! ও বাবা, ভাবতেই বুক ধড়াস ধড়াস করে। আমি পারব না।

 তোর বুক ধড়াস ধড়াস করে কেন? তুই তো আর ওর প্রেমে পড়িসনি।

 প্রেম! দুর, কী যে বলিস! বুক ধড়াস ধড়াস করে ভয়ে।

অমলেন্দুরা গাঁয়ের পুরনো লোক হলেও ওরা থাকত বাইরে বাইরে। ওর বাবা শান্তনু ঘোষাল মধ্যপ্রদেশে কলিয়ারিতে চাকরি করতেন। রিটায়ার করে গাঁয়ের পৈতৃক বাড়িতে এসে থিতু হয়েছেন। কাজেই অমলেন্দুর তেমন বন্ধুবান্ধব, দল বা ক্লাব নেই যারা তার পেছনে দাঁড়াবে,শ্যামলা রোগা লাজুক ছেলেটিকে খারাপ বলেও মনে হত না পান্নার।

শান্তনু ঘোষালও নিরীহ সজ্জন মানুষ। রিটায়ার করার পর গাঁয়ে ফিরে সকলের সঙ্গে আলাপ সালাপ করে পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতেন। পান্নাদের বাড়িতেও এসেছেন কয়েকবার। তাঁর মেয়ে বড়, ছেলে ছোট। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে অমলেন্দু অঙ্কে অনার্স নিয়ে বি এসসি পাশ করে বসে আছে। কলিয়ারিতে তার একটা চাকরি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শান্তনু ঘোষাল ছেলেকে মধ্যপ্রদেশে একা ফেলে রাখতে চান না।

পান্না একদিন সরস্বতীকে বলল, হ্যাঁ রে সরস্বতী, অমলেন্দু তত খারাপ ছেলে নয়। তুই ওকে অপছন্দ করিস কেন?

ও এরকম কেন? গাঁয়ে আর মেয়ে নেই?

ওর যে তোকে পছন্দ!

না না বাবা, ওসব আমার ভাল লাগে না।

অমলেন্দু এরপর যেটা করেছিল সেটা একটু বাড়াবাড়ি। স্কুলের পথে দিনের বেলা সরস্বতীকে দেখার যে অসুবিধে আছে সেইটে বুঝতে পেরে সে এরপর রাতের দিকে সরস্বতীর বাড়ির আনাচে কানাচে ঘোরা শুরু করে। সুবিধে হল, সরস্বতীদের বাড়ি একতলা। চারদিকে বাগান আর গাছগাছালি আছে। পাগল প্রেমিক সেইসব গাছপালার মধ্যে সাপ-খোপ উপেক্ষা করে ঘাপটি মারতে পাগল।

একদিন পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে সন্ধেবেলা সরস্বতী লক্ষ করল, জানালার বাইরে পাতিলেবুর গাছটায় হঠাৎ সরসর শব্দ হল।

কে? কে ওখানে? বলে আর্তনাদ করে উঠতেই কে যেন দুড়দাড় দৌড়ে পালায়। লোকটা যে অমলেন্দু তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না সরস্বতীর। বাড়ির লোককে সে ভয় পেয়ে সব বলে দেয়।

বোকা ছেলেটা ধরা পড়ল পরদিনই। বাড়ির লোক ওত পেতে ছিল। লেবু গাছের আড়ালে ছায়ামূর্তির আবির্ভাব হতেই টর্চ জ্বলল, লাঠিসোঁটা বেরিয়ে এল।

তারপর কী মার! মাথা ফেটে রক্ত পড়ল, ঠোঁট ফুলে গেল, কোমরে চোট হল। উঠোনে দাঁড়িয়ে এই রঙ্গের দৃশ্যটা লোক দেখল। অমলেন্দু মাটিতে পড়ে থর থর করে কাঁপছে। চোখে পশুর মতো বোবা দৃষ্টি।

সেই দৃশ্য দেখতে শান্তনু ঘোষালকে টেনে আনা হল। ভদ্রলোক ছেলের দশা দেখে কেঁপেকেঁপে অস্থির।

অমলেন্দুর বিরুদ্ধে যে সব নালিশ করা হল তার কোনও জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না শান্তনু ঘোষাল। তিনি শুধু হাতজোড় করে সকলের কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। অমলেন্দুর মুখ থেকে কোনও কথাই বেরোয়নি।

ঘটনার দিন দুই বাদেই ছেলেকে নিয়ে শান্তনু ঘোষাল মধ্যপ্রদেশে চলে গেলেন। ফিরলেন প্রায় মাসখানেক পর। নিজের ছেড়ে আসা কলিয়ারিতে ধরে করে অমলেন্দুকে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছেন তিনি। ছেলে মুখে চুনকালি মাখিয়েছে বলে গাঁয়েও আর থাকলেন না ভদ্রলোক। শ্বশুরবাড়ি শ্রীরামপুরে বাড়ি কিনে চলে গেলেন।

অমলেন্দু যেদিন মার খায় তার পরদিনও স্কুলে সরস্বতীর সঙ্গে দেখা হল পান্নার। সরস্বতীর মুখচোখ ফুলে আছে কান্নায়। পান্নাকে বলল, জানিস পান্না, আমি কিন্তু সবাইকে বলেছিলাম ওকে মারধর না করতে।

তবে মারল কেন?

বাড়ির লোক সবাই খুব রেগে গিয়েছিল, কেউ কথা শুনল না।

পান্না খুব দুঃখের সঙ্গে বলল, ভালবাসা জিনিসটা খুব সেনসিটিভ, দু-চারটে ধমক বা অপমান করলেই যথেষ্ট হত। কেন যে তোর বাড়ির লোকেরা বাড়াবাড়ি করল!

আমার বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে।

এখন আর কী করবি! যা হওয়ার হয়ে গেছে।

সরস্বতীর চোখ ফের ছলছল করে উঠল। বলল, আমি ওকে ভয় পেতাম ঠিকই, কিন্তু দেখলাম ও কিছু খারাপ মানুষ তো নয়।

কী করে বুঝলি?

 চুপচাপ মার খেয়ে গেল। প্রতিবাদ করেনি।

এখন কি তোর একটু অনুশোচনা হচ্ছে?

 ভীষণ। সবসময়ে মনটা খারাপ লাগছে আর কান্না পাচ্ছে।

 ক্ষমা চাইবি ওর কাছে?

ইচ্ছে তো করে। কিন্তু ওরা নিশ্চয়ই এখন আমাকে ভাল চোখে দেখবে না।

তা ঠিক। তাহলে?

 তুই একটা কাজ করবি পান্না? আমার হয়ে ওর কাছে যাবি?

 গিয়ে?

বলিস আমি ঠিক এরকমটা চাইনি। আমি অত নিষ্ঠুর মেয়ে নই।

 বলে কী হবে?

অন্তত জানুক যে, সব দোষ আমার নয়।

 তোরই দোষ সরস্বতী। তুই অত ভয় পেতে গেলি কেন? আর কেনই বা বাড়িতে নালিশ করলি? আড়াল থেকে তোকে দেখত। ভাল লাগে বলেই দেখত। সেটা কি খুব বড় অপরাধ?

আর বলিস না। আমার ফের কান্না পাচ্ছে।

পরদিন স্কুলে এসে গোপনে একটা মুখ আঁটা খাম পান্নার হাতে দিয়ে সরস্বতী বলল, তুই এ চিঠিটা ওকে দিস।

কী লিখেছিস চিঠিতে?

যা লেখার লিখেছি।

 আমাকে খুলে বল।

লিখেছি আমি ক্ষমা চাই।

 আর কিছু?

 সরস্বতী মৃদু লাজুক হাসি হেসে বলল, লিখেছি ও যা চায় তাই হবে।

অমলেন্দু কী চায় তা জানিস?

জানব না কেন? আমাকে চায়।

সে তো ঠিক। কিন্তু এখনও চায় কি? এত মারধর অপমানের পরও?

খুব দৃঢ় গলায় সরস্বতী বলেছিল, এখনও চায়।

কী করে বুঝলি?

আমার মন বলছে।

ঠিক আছে, ও যদি তোকে বিয়ে করতে চায়, করবি?

হ্যাঁ। চিঠিতে সে কথাই তো লিখেছি।

তুই তো একদম পালটি খেয়ে গেছিস দেখছি।

হ্যাঁ। ওর জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

কিন্তু মনে রাখিস, ওরা বামুন, আর তোরা কায়েত।

তাতে কী?

বিয়ে করতে চাইলে দু পক্ষেরই আপত্তি হবে।

আমি মাকে রাজি করাব। আর আমার বাবা তো নাস্তিক।

চিঠিটা নিয়ে পান্না সত্যিই গিয়েছিল। ছেলেটার সঙ্গে একান্তে একটু কথা বলারও ইচ্ছে ছিল তার। এরকম লাগামছাড়া প্রেম সে বড় একটা দেখেনি।

গিয়ে দেখে সামনের ঘরে সুটকেস বিছানা বাঁধা ছাঁদা হচ্ছে সন্ধেবেলা। শান্তনু ঘোষাল তাকে দেখে বললেন, লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না মা। আমার দুর্ভাগ্য। কী যে সব হল?

পান্না বলল, তেমন কিছু তো হয়নি। ওরা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।

না মা, ওরা ঠিক কাজই করেছে। উপযুক্ত হয়েছে।

শান্তনু ঘোষাল বলতে বলতে কেঁদেই ফেললেন। অপমানটা বড্ড লেগেছিল ভদ্রলোকের।

অমলেন্দু পাশের ঘরেই শুয়ে ছিল। কপালে, গালে স্টিকার, মাথায় ব্যান্ডেজ। ঘরে ওর মা আর এক পিসি ছিলেন। তাই একান্তে কথা বলার সুযোগ হল না। তাকে দেখে অমলেন্দু এমন লজ্জা আর সংকোচ বোধ করতে লাগল যে, চোখ তুলে তাকাতেই পারল না।

পান্না বলল, ওরকম লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু হয়নি আপনার। যারা এ কাজ করেছে তারাও অনুতপ্ত। হয়তো ক্ষমা চাইতে আসবে।

অমলেন্দু মুখ ঢাকা দিয়েছিল দু হাতে।

ওর মা বলল, প্রাণটা যে বেঁচেছে সে-ই ঢের। গাঁয়ে এসে থাকার সাধ ঘুচেছে মা।

চিঠিটা অনেকবারের চেষ্টায় ওর হাতে গুঁজে দিয়ে চলে এসেছিল সে।

পরদিন সরস্বতী উন্মাদিনীর মতো তাকে ধরল, দিয়েছিলি চিঠি?

হ্যাঁ। কিন্তু ওরা তো শুনলুম মধ্যপ্রদেশে যাচ্ছে।

সে কী! কেন?

ওরা আর এখানে থাকবে না।

যাঃ, হতেই পারে না। থাকবে না কেন?

ওঁরা খুব অপমানিত বোধ করছে। ভয়ও পাচ্ছে।

থম ধরে রইল সরস্বতী। তারপর পান্নার আঁচল চেপে ধরে পাগলের মতো বলতে লাগল, কেন চলে যাবে? কেন চলে যাবে?

পান্না মৃদু স্বরে বলল, অত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? চিঠিটা তো পেয়েছে। ও যদি সত্যিই তোকে চায় তাহলে ঠিক জবাব দেবে।

সেই জবাবের জন্য দুবছর অপেক্ষা করে আছে সরস্বতী। জবাব আসেনি। হয়তো সরস্বতী ওর ঠিকানায় আরও চিঠি পাঠিয়েছে। কে জানে! কিন্তু জবাব আসেনি।

সরস্বতীকে দেখে আজ সকালটায় তার ভারী ভাল লাগল। বিয়ে হল না, কেউ কাউকে পেল না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে টানটা রয়ে গেল। বিরহই ভাল। পান্না উঠে তার প্রেমপত্রের ঝাঁপি নামিয়ে বসল আজ। লেপের তলায় লুকিয়ে পড়তে লাগল।

.

১৯.

সুধীর ঘোষের ভূতকে আগে প্রায়ই দেখা যেত এখানে সেখানে। আজকাল আর বিশেষ কেউ দেখে বলে শোনা যায় না। আগেকার লোকেরাও আর নেই। বিজলি বাতি এসে গেছে, গাঁয়ে বসতিও কিছু বেড়েছে, ভূতের এখন জায়গার টান পড়েছে।

সুধীর ঘোষ অল্প বয়সেই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। তাঁর ছিল অঙ্কে ভাল মাথা। নানা দেশে ঘুরে অবশেষে বিলেতে একটা ইস্কুলে মাস্টারির চাকরিতে থিতু হন। শোনা যায়, সেখানে মাস্টারমশাইদের এখানকার মতো দুর্দশার জীবন নয়। সুধীর ঘোষ ভালই ছিলেন। মোটা মাইনে, বাড়ি, গাড়ি সবই হয়েছিল। কিন্তু অঙ্ক কষতে কষতে আর বিয়ে করার ফুরসত হল না। হঠাৎ একদিন দেখলেন, বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন। বিলেতের শীত তেমন সহ্য হচ্ছে না। বার দুই নিউমোনিয়ায় ভুগে উঠলেন। বিলেতের ডাক্তাররা বলল, ট্রপিক্যাল কান্ট্রিতে তিনি ভাল থাকবেন। প্রস্তাবটা পছন্দই হল সুধীর ঘোষের। দেশের সঙ্গে বছর পঁয়ত্রিশ সম্পর্ক নেই। অঙ্কে আচ্ছন্ন মাথায় হঠাৎ দেশ-গাঁয়ের চিত্র সব ভেসে ওঠায় মনটা হু-হু করতে লাগল। আপনজন বলতে ভাই, ভাইপো-ভাইঝিরা সব আছে। তারাও চিঠি লিখল দেশে ফিরে আসতে।

অবশেষে সুধীর ঘোষ বিলেতের পাট চুকিয়ে দেশে ফেরার জাহাজ ধরলেন। মনে খুব আশা, শেষ জীবনটা দেশের বাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকবেন।

বিস্তর বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে একদিন সুধীর ঘোষ দেশে ফিরলেন। খুব হইচই হল গ্রামে। বিস্তর লোক এসে দেখা করে গেল। সুধীর ঘোষ যখন বিলেতে যান তখন ভাইপো-ভাইঝিদের বেশির ভাগেরই জন্ম হয়নি। দুটি কি তিনটি যারা ছিল তারা তখন খুব ছোট। তিন ভাইয়ের মধ্যে দাদা অধীরের তিন ছেলে, দুই মেয়ে, দাদার পরে সুধীর, তারপর ভাই রণধীরের দুই ছেলে, ছোটো তপোধীরের দুই ছেলে, দুই মেয়ে। পৈতৃক বাড়িতে গিজগিজ করছে লোক। সুধীরের থাকার মতো আলাদা ঘর-টর কিছু নেই। অধীর ভরসা দিয়ে বলল, ঘাবড়ানোর কিছু নেই, দোতলাটা তুলে ফেললেই হবে।

কিন্তু দোতলাটা কে তুলবে সে বিষয়ে কেউ কিছু বলল না। দায় সুধীরের। বিলেত থেকে এসেছেন সঙ্গে মোটা টাকা। সুধীরের অবশ্য আপত্তি হল না। সংসারের প্রতি দায়দায়িত্ব কিছু পালন করেননি। মা বাবার তেমন সাহায্যে আসেননি। মাঝে মাঝে কিছু টাকাপয়সা পাঠিয়ে দায় সেরেছেন। সুতরাং নিজের পয়সায় দোতলাটা তুলে ফেললেন। বেশ ভাল করেই করলেন। খাট-টাট কিনলেন, চেয়ার টেবিল দিয়ে সাজালেন।

প্রথম প্রথম আদর যত্নের তেমন অভাব হয়নি। বরং একটু বাড়াবাড়িই হচ্ছিল যেন। সুধীর ঘোষ বেশ খুশি। কিন্তু মাসখানেক যেতে না যেতেই দাদা অধীর হাজারখানেক টাকা ধার নিল। রণধীরেরও ছেলের পরীক্ষার ফি না কী যেন কম পড়ে গেল। তপোধীর একটা ধানজমি কেনার জন্য খুব চাপাচাপি শুরু করে দিল। বউদি আর বউমারা খুব একটা পিছিয়ে রইল না। নানা না-মেটা শখ আহ্লাদের কথা শোনাতে লাগল। অধীরের ছেলে শ্যামল ব্যবসা করার জন্য টাকা চাইতে লাগল। ভাইঝিদের মধ্যে দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা শুনিয়ে গেল বিয়েতে কাকার কাছ থেকে তারা কোনও উপহার পায়নি।

দু মাসের মাথায় সুধীর বুঝতে পারল, এরা তাকে কামধেনু ঠাউরেছে। যার ফলে যে যা নিচ্ছে তার একটি আধলাও শোধ দিচ্ছে না। বরং বাজার হাট, সংসার খরচের টাকা এক রকম চেয়েই নিচ্ছে। এভাবে চললে যে বিলেত থেকে আনা টাকা বেশিদিন থাকবে না, তা অঙ্কবিদ পরিষ্কার বুঝতে পারলেন।

মহিমের বাবা তখন বেঁচে। উঠোনের উত্তর ধারে সকালে শীতের রোদে সুধীর ঘোষ বাঁদুরে টুপি আর তুষের চাদর জড়িয়ে জাম্বুবান সেজে এসে বসতেন। পায়ে হাঁটু অবধি উলের মোজা। হাতে দস্তানা। ঠান্ডার ভয়ে কাবু।

দুঃখ করে বলতেন, ভাল ভেবে দেশে ফিরলুম, কিন্তু এ যে বড্ড খরচের ধাক্কায় পড়ে যাচ্ছি।

মহিমের বাবা বললেন, তুই একটা আহাম্মক। প্রথম কথা বাড়ি ভাগ বাঁটোয়ারা না করেই পট করে দোতলা তুলে ফেললি। কার ভাগে কী পড়বে তা না জেনেই ওসব করতে আছে! এখন হিস্যা নিয়ে গণ্ডগোল লাগলে মুশকিলে পড়বি। তার ওপর ওরা তোকে যেভাবে দুইয়ে নিচ্ছে তাতে সর্বস্বান্ত হতে দেরি হবে না।

এখন কী করি দাদা, একটা পরামর্শ দিন।

যা গেছে তা তো গেছেই। ও নিয়ে ভাবিস না। যা আছে তা নিয়ে ফের বিলেতে পালিয়ে যা।

তা কি হয়? ও পাট যে চুকিয়ে দিয়ে এসেছি।

ফিরে গেলে কি আর চাকরি-বাকরি জুটবে না তোর?

তা জুটবে। কিন্তু বুড়ো হচ্ছি, একা থাকতে কেমন কেমন লাগে। তার ওপর ঠান্ডাটাও সহ্য হচ্ছে না আজকাল।

তার বয়স কত হল? ছাপ্পান্ন সাতান্ন হবে?

সাতান্ন পুরে গেছে।

গাঁদেশে এই বয়সে লোকে বিয়ে-টিয়ে করে। করবি?

ও বাবা! বিয়ে! পাগল নাকি?

তাহলে তোকে রক্ষে করবে কে? তোর তো একটা জন চাই।

মায়ের পেটের ভাইরাই যদি জন না হয় তাহলে অনাত্মীয় একটা মেয়ে এসে কি জন হতে পারবে?

দুনিয়ার নিয়মই যে তাই। বউ যেমনই হোক, তোর স্বার্থ দেখবে। এরা দেখবে না। ভাল করে ভেবে দেখ।

উঠোনের ওই কোণটায় রোজই শীতে জবুথবু সুধীরকাকাকে বসে থাকতে দেখা যেত। মুখখানা বড্ড কাহিল।

একদিন বললেন, আমার ক্যামেরাটা পাচ্ছি না। ভাল জাতের লাইকা ক্যামেরা, অনেক দাম।

চুরি হয়েছে নাকি?

মুখখানা চুন করে সুধীরকাকা বললেন, মদনা কয়েকদিন ধরেই চাইছিল। বন্ধুদের সঙ্গে নাকি কোথায় বেড়াতে যাবে, ছবি-টবি তুলবে। আমি বললাম, এ খুব কমপ্লিকেটেড জিনিস, তুই হ্যান্ডেল করতে পারবি না। তাতে বাবুর মুখ ভার হয়েছিল। কাল রাত থেকেই দেখছি ক্যামেরাটা সুটকেসে নেই।

মহিমের বাবা বললেন, ভাল করে খুঁজেছিস?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুধীর বললেন, খুঁজে লাভ নেই দাদা। এর আগেও কয়েকটা জিনিস গেছে। একটা রোলেক্স হাতঘড়ি ছিল, দিন দশেক আগে সেটা হাপিস হয়। জিলেটের রেজার, অডিকোলোন, সাবান, একটা ভাল সোয়েটার, টুকটাক আরও সব জিনিস হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির লোককে জিজ্ঞেস করলে সবাই আকাশ থেকে পড়ে। দাদা তো কালকেই বলছিল, সত্যিকারের গেছে, নাকি বানিয়ে বলছিস!

মহিমের বাবা বললেন, আরও যাবে। তোর সবই যাবে। এখনও পালানোর সময় আছে। টাকাপয়সা কেমন গেছে?

ওটা বর্ধমানের ব্যাঙ্কে আছে। নগদ সামান্যই ঘরে থাকে।

বিলেতে যদি নাও যাস অন্তত আলাদা বাড়ি করে থাক। তাতেও খানিকটা রক্ষে পাবি।

কাঁচুমাচু হয়ে সুধীরকাকা বলেন, একা থাকব বলে কি দেশে ফিরে এলুম দাদা?

কী করবি? বাঁচতে তো হবে!

আর একটু ভেবে দেখি।

একটু শক্ত হওয়ার চেষ্টা কর।

কিন্তু সুধীর ঘোষ লড়াইটা হেরে যাচ্ছিলেন অন্য কারণে। বাড়ির সবাইকে চোর ছ্যাঁচড় বলে প্রকাশ্যেই গালমন্দ করায় গোটা পরিবারটাই তাঁর বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে গেল। বিলেতের সাহেব বলে সবাই আওয়াজ দিতে শুরু করল। সুধীর ঘোষ একা হয়ে পড়তে লাগলেন।

সাত আট মাস এভাবেই গেল। একদিন এসে মহিমের বাবাকে বললেন, আপনার পরামর্শই মেনে নিচ্ছি। বিয়ে করব। একজন ঘটক ঠিক করে দিন তো।

মহিমের বাবা সর্বানন্দ ঘটককে খবর দিলেন।

সর্বানন্দ ঘটক মহিমদের বাড়িতে এসেই দেখা করলেন সুধীরের সঙ্গে। বললেন, বয়েসটা তো একটু ঢলেছে, গরিবগুর্বো ঘরের মেয়ে হলে চলবে তো!

চলবে। হাতে আছে?

তা থাকবে না কেন? এদেশে ভিখিরিরও বিয়ে হয়।

 তাহলে দেখুন।

সুন্দরী হবে না, তবে কাজের মেয়ে হবে।

সুধীর তাতেও রাজি।

সর্বানন্দ যে সুধীরের জন্য পাত্রী দেখছেন তা চেষ্টা করেও গোপন রাখা যায়নি। একদিন ঘোষ বাড়িতে তুমুল হই-হল্লা হয়ে গেল। সুধীর ঘোষকে প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করারই জোগাড় করে ফেলল ভাইপোরা। ভাই আর ভাইয়ের বউয়েরাও চেঁচামেচি কিছু কম করল না। বুড়ো বয়সে বিয়ে ভীমরতি ইত্যাদি বলে গাঁয়েও একটা জনমত তৈরি করে ফেলল তারা। গাঁয়ের মোড়ল মাতব্বররাও রুখে দাঁড়াল সুধীরের বিরুদ্ধে। গাঁয়ের ছেলে হলেও সুধীর বিদেশে ছিলেন, সুতরাং তাঁর দিকে জনমত কম।

মহিমের বাবা বললেন, কী রে, কী করবি এখন?

তাই ভাবছি। দেশে ফিরে যে কী ভুলই করেছি।

মহিমের বাবা বললেন, ভুলটা তোর অন্য জায়গায়। এতকাল বিদেশে পড়ে থেকেছিস বলে দেশ আর আত্মীয়স্বজন সবই তোর পর হয়ে গেছে। প্রবাসী থাকা সেই কারণেই ভাল নয়। ১৪৮

আবার ফিরে যেতে ইচ্ছেও হচ্ছে না। এখন আমার আর বিলেতে থাকতে ইচ্ছে হয় না।

তাহলে কলকাতা বা নিদেন বর্ধমানে গিয়ে থাক। বড় শহরে গাঁয়ের কূটকচালি নেই, আত্মীয়রাও নাগাল পাবে না।

সুধীর ঘোষ থম হয়ে বসে রইলেন। অনেকক্ষণ বাদে বললেন, ওদের কেউই আমার আপন হল না কেন বলুন তো! একই বংশ এক পরিবার, বাবা মাও এক। তবে গণ্ডগোলটা কোথায়?

সংসার মানেই গণ্ডগোল।

 তাই দেখছি।

আরও দেখবি।

অঙ্কবিদ সুধীর শেষ জীবনের অঙ্ক মেলাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন। সাহেবদের দেশে একা থেকে একটা জীবন কাটিয়ে এসে যে তাফালের মধ্যে পড়েছেন তা সামলে ওঠার কায়দাই তাঁর জানা ছিল না। গাঁয়ের বিজ্ঞ-বিচক্ষণ কিছু মানুষ উভয় পক্ষের মধ্যে একটা সন্ধি স্থাপনের জন্য মিটিং বসাল। সুধীর ঘোষের ভাইরা সেই মিটিং-এ পরিষ্কার বলল, সুধীর সংসারের জন্য এতকাল কিছুই করেননি, এখন উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। এ বাড়িতে থাকতে হলে তাঁকে মাথা নিচু করেই থাকতে হবে।

বাইরের লোক এসে যে সুধীর ঘোষের সমস্যা মেটাতে পারবে না সেটা মহিমের বাবা ভালই জানতেন। তিনি বললেন, ওরে, ওভাবে হবে না। তোর এখন তফাত হওয়া দরকার।

সুধীর থম মেরে বসে থাকেন। রা কাড়েন না। হয়তো তাঁর একটা ভুল ধারণা ছিল যে, আত্মীয়তাই আসলে সম্পর্ক। কিন্তু সম্পর্ক যে একটা আলাদা জিনিস, সেটা যে রচনা করতে হয় এ ব্যাপারটা তাঁর জানা ছিল না। এই নবোদিত জ্ঞান তাঁকে ঠিক করে না তুলে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিল। অনেকক্ষণ বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ওরা তো আমাকে চায় না, আমার পয়সাকড়িই চায়। ভাবছি টাকাপয়সাগুলো ওদের দিয়েই দেবো, তাতে যদি মন পাওয়া যায়।

মহিমের বাবা বলেছিলেন, সেটা আর একটা আহাম্মকি হবে।

কিছুদিন পর দেখা যেতে লাগল, বিলেত ফেরত সুধীর ঘোষ একা একা গাঁয়ের পথে পথে ঘুরছেন আর আপনমনে বিড়বিড় করছেন। চোখে গোল রোন্ডগোন্ডের ফ্রেমের চশমার ভিতর দিয়ে অস্থির চোখে চারদিকে তাকান। যথারীতি গাঁয়ের ছেলেরা তাঁর পিছুতে লাগল, ঢিল পাটকেল মারতে লাগল, তাঁকে নিয়ে ছড়া বাঁধতে শুরু করল। পাগলামির প্রথম লক্ষণ দেখা দিলেই এসব প্রতিক্রিয়া হয়েই থাকে। মানুষের ভিতরে করুণা ও নিষ্ঠুরতা দু রকমের বীজই উপ্ত থাকে।

মহিমের বাবা দুঃখ করে বলতেন, এত বড় অঙ্কের মাথা ভূ-ভারতে বিরল। কিন্তু অত প্রতিভাই বোধহয় ওর কাল হল। সাহেবদের দেশে তবু বুঝবার মানুষ ছিল, গাঁয়ে-গঞ্জে ওর দামই বুঝল না কেউ।

ধীরে ধীরে সুধীর ঘোষ রাস্তার পাগলই হয়ে যেতে লাগলেন। চেঁচামেচি করতেন না, কাউকে উলটে তেড়েও যেতেন না। শুধু বিড়বিড় করতেন আর চারদিকে ভিতু চোখে তাকাতেন। বাড়ির লোকেরা তখনও দুবেলা খাবার-টাবার দিত। শোনা যায়, পাগলামির প্রথম দিকেই বর্ধমানের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের টাকাপয়সা তিনি ভাইদের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দেন। সেইজন্যই বোধহয় ভদ্রতাবশে ভরণপোষণটা বন্ধ করা হয়নি।

ঠান্ডার ধাত ছিল। সুতরাং বিলেত থেকে ফেরার বছর দুয়েকের মাথায় সুধীর ঘোষকে শীতকালে একদিন এক মাঠের ধারে গাছতলায় ভোরবেলা পড়ে থাকতে দেখা গেল। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে, বুকে প্রবল শ্লেষ্মার শব্দ।

দিন দুই বাদে বর্ধমানের হাসপাতালে সুধীর ঘোষ মারা যান।

লোকটা গাঁ থেকেই মুছেই গেলেন এক রকম। তাঁকে মনে রাখার তেমন কোনও কারণ ছিল না। মহিমের বাবা শুধু মাঝে মাঝে বলতেন, পণ্ডিত মানুষ যে এরকম আঁকাড়া বোকা হয় তা এই প্রথম দেখলুম। ঘটনাটা প্রথম ঘটল একদিন নিশুত রাতে। মহিমের বাবা রাতে পেচ্ছাপ করতে উঠে দক্ষিণের জানালার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পান জানালার ওপাশে এক জোড়া গোল গোল চশমার ফ্রেম চিক চিক করছে।

কে রে, কে ওখানে? বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।

তখন গাঁয়ে এত লোকবসতি ছিল না। বাড়ির লোকজন উঠে বাতি-টাতি জ্বেলে দেখল, কেউ নেই। জানালার ওপাশে দুর্ভেদ্য কাঁটা গাছের জঙ্গল বলে সেখানে কারও যাওয়ার কথাও নয়।

পরদিন মহিমকে তিনি বললেন, হতভাগাটাই এসেছিল।

কে বাবা?

সুধীর। আত্মাটা কষ্ট পাচ্ছে।

এক রাতে তপোধীরের বউ বাচ্চার মুতের কাঁথা পালটাতে উঠে সলতে কমানো লণ্ঠনের মৃদু আলোয় কাঠের বড় আলমারির পাশে বুঝকো আঁধারে হঠাৎ দুখানা গোল চশমা দেখতে পেল। ভয়ে চিৎকার দিয়ে মূৰ্ছা গিয়েছিল সে। দাঁতকপাটি লেগে নীলবর্ণ হয়ে যায় যায় অবস্থা।

এর পর দেখল অধীর ঘোষ। দোতলার ঘর দুখানা সুধীর ঘোষ মারা যাওয়ার পর সেই দখল করেছিল। সেই দোতলার জানালায় একদিন মাঝরাতে রোল্ডগোল্ডের চশমা জোড়া দেখা দিল। ভয় খেয়ে অধীর ঘোষ গয়ায় গিয়ে পিণ্ডদান করে এল।

কিন্তু তাতেও গোল চশমার আবির্ভাব ঠেকানো যায়নি। মাঝেমধ্যেই এ ও সে মাঝরাতে গোল চশমা দেখতে লাগল। এমনকী রাতচরা মানুষের অনেকেই এমনও নাকি দেখেছে যে, সুধীর ঘোষ ফাঁকা রাস্তায় বিড়বিড় করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে। গলা খাঁকারির শব্দ, কাশির আওয়াজ এসবও নাকি শোনা যেত ঘোষ বাড়ির আনাচে কানাচে।

কালক্রমে সবই আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। ভূতপ্রেতরাও পুরনো হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে সুধীর ঘোষের প্রেতাত্মাও বিলীন হয়ে গেল।

কত কালের কথা!

বহু বছর পরে তাই হঠাৎ মাঝরাতে পেচ্ছাপ করতে উঠে উঠোনের দিককার ভেজানো জানালার পাল্লাটা খোলা দেখে হ্যারিকেন উসকে মহিম তাকিয়ে দেখে দুখানা গোল ধাতব ফ্রেমের চশমা অন্ধকারে ভেসে আছে।

মহিমের বুকটা ছলাত করে উঠল। আশির কাছাকাছি বয়সে হৃদযন্ত্র এখন তো আর মজবুত নেই। ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছিল বুকে, সঙ্গে যেন একটা ক্ষীণ ব্যথাও। মরেই যাবে নাকি সে? আর মৃত্যু সন্নিকট বলেই কি সুধীর ঘোষ এসে হাজির হয়েছে?

কে? কে ওখানে? কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে মহিম।

বাবা! আমি–আমি অমল!

 হাঁ করে বাক্যহারা হয়ে কিছুক্ষণ জানালার বাইরে চেয়ে থেকে মহিম বলে, অমল!

হ্যাঁ বাবা।

তুই এত রাতে বাইরে কেন?

একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।

মহিম ঘড়ি দেখল। জাম্বুবান টেবিল ঘড়িটায় রাত আড়াইটে। এই অশৈলী সময়ে তো কেউ প্রাতভ্রমণে বেরোয় না!

তোর কি ঘুম আসছে না?

আজকাল প্রায়ই ঘুম আসে না।

মহিম দরজাটা খুলে দিয়ে বলল, আয়, ভিতরে আয়।

এই ছেলের সঙ্গে মহিমের সম্পর্ক নেই বহুকাল। যখন স্কুলে ভাল রেজাল্ট করে বেরোল, যখন গ্রামে সবাই পঞ্চমুখে সুখ্যাতি শুরু করল তখন থেকেই। মহিম তখন থেকেই তার এই মেধাবী ছেলেটিকে একটু একটু সমীহ করতে আর মৃদু ভয় পেতে শুরু করে। সে নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজিতে এম এ হওয়া সত্ত্বেও। আসলে নিজের জ্ঞানগম্যি, ডিগ্রির ওপর তার কোনও ভরসাও ছিল

কখনও, যখন থেকে ছেলেকে ভয় খেতে শুরু করল তখন থেকেই রচিত হল এক অনতিক্রম্য দূরত্ব। অমল বাবাকে বিশেষ গ্রাহ্য করত না। ব্যক্তিত্বহীনদের কপালে সবসময়েই উপেক্ষা জোটে। নিজেদের তারা না পারে জানান দিতে, না পারে তুলে ধরতে। দুর্বলচিত্ত মহিম বাড়ির কারও কাছেই তেমন গুরুত্ব পায়নি কখনও। ১৫০

অমলের সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়ল ওর বিয়ের পর। বিদেশে যাওয়ার পর আরও। পরই হয়ে গেল ছেলেটা।

আজকাল যে মাঝে মাঝে আসে বা বউ বাচ্চাদের গায়ে পাঠিয়েছে এটা ভাল লক্ষণ বটে, কিন্তু মহিমের সঙ্গে সম্পর্কটা আর কাছের হয়নি। কখনও হয়তো খেয়াল হলে একটা দায়সারা প্রণাম করে বা খুব আলগা একটা কুশল প্রশ্ন করেই সরে যায়। মহিম এই আলগোছ আত্মীয়তাটা এক রকম মেনেই নিয়েছে। তার কোনও নালিশ নেই, অভিযোগ বা অভিমান নেই। ওরা ভাল থাকলেই ভাল। ব্যক্তিত্ব জিনিসটা সকলের থাকে না, কেউ কেউ ওটা নিয়েই জন্মায়। জন্মগত হলে ব্যক্তিত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়, এটা বুঝে গেছে মহিম। গৌরহরি চাটুজ্জেকে দেখে দেখেই ব্যাপারটা সে বুঝেছে। ছেলেপুলেরা যে তার আপন হল না, কাছের হল না এটা তার নিজেরই অযোগ্যতা বলে সে মনে করে। এই বয়সে আর স্রোতের ধারাকে উলটেও দিতে পারে না সে।

পুজোতেই শীত পড়েছিল। দুদিনেই শীত আরও তীব্র হয়েছে। কনকনে উত্তুরে হাওয়ায় হাত-পা জমে যাওয়ার জোগাড়। এই বাঘা শীতেও অমলের গায়ে গরম জামা নেই। গায়ে একটা পাতলা গেঞ্জি, তার ওপর ধুতির খুঁট জড়ানো। পায়ে চটি। সংকোচে সে ঘরে ঢুকে চারদিকে চেয়ে দেখছিল। চাউনিটা অস্থির, তাতে কোনও পর্যবেক্ষণ নেই!

এই শীতে গায়ে গরম জামা দিসনি কেন?

অমল মহিমের মুখের দিকে গভীর অন্যমনস্কতায় চেয়ে থেকে বলে, এমনিই। আমার তেমন শীত করছে না।

অমলের চোখের চশমাজোড়া অবিকল সুধীর ঘোষের চশমার মতো। দুটি নিখুঁত গোলাকার কাঁচ রোল্ডগোল্ডের ফ্রেমে বসানো। বহুকাল বাদে যেন সেই সুধীর ঘোষই ফিরে এসেছে। এরকম গোল ফ্রেমের চশমা কি আজকাল কেউ পরে! কে জানে বাবা, পুরনো সব ফ্যাশন ফিরিয়ে আনাটাই বোধ হয় আজকালকার রেওয়াজ।

এখন বড় হিম পড়ে। ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয় আছে।

মহিম যথেষ্ট জোর বা শাসনের মতো করে কথাটা বলতে পারে না। এমনকী স্নেহেরও যে একটা জোর থাকে সেটাও তার গলায় এল না। অমল এখন বড় দূরের মানুষ, একজন জেন্টেলম্যান।

ঠান্ডাটাই আমার দরকার ছিল। মাথাটা গরম লাগছিল খুব।

অকূল পাথারে পড়ে যায় মহিম। জিজ্ঞেস করাটা উচিত হবে কি না, জিজ্ঞেস করলে রেগে যাবে কিনা এসব ভেবে দোনোমোনো করে বলেই ফেলল, মাথা গরম লাগছিল কেন?

ব্যক্তিগত ব্যাপারে বেশি প্রশ্ন করাটা আজকাল কেউ বিশেষ পছন্দ করে না। তাতে তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়ে যায়।

অমল অবশ্য উদাস মুখে চেয়ে থেকে বলল, নানারকম চিন্তা করে করে এরকম হয় মাঝে মাঝে।

এর পরের স্বাভাবিক প্রশ্ন হতে পারত এই চিন্তা কীসের বা কেন এত চিন্তা করিস গোছের কিছু। মহিম প্রশ্নটা করতে গিয়েও সতর্ক হল। নিজের এই মেধাবী ও উজ্জ্বল ছেলেটির মনোজগৎ তো তার মতো সাদামাটা নয় নিশ্চয়ই! ওর মনের খবর তার মতো গেঁয়ো লোক কীভাবে বুঝতে পারবে? বয়সে। ছোট হলেও অমল যে অনেক উঁচু থাকের মানুষ।

মহিম বলল, মানুষের মন সর্বদাই কিছু না কিছু ভাবে। চিন্তা ছাড়া এক মুহূর্ত কাটে না কারও।

আমি একটু বসি বাবা?

শশব্যস্তে মহিম বলে, বোস না, বোস। ওই কাঠের চেয়ারটায় বসবি নাকি বিছানায় লেপ চাপা দিয়ে?

না না, চেয়ারই ভাল।

অমল বসল। বসার ভঙ্গিতেই বোঝা গেল, খুব ক্লান্ত।

মৃদু একটা অ্যালকোহলের গন্ধ পাচ্ছিল মহিম। দরজাটা বন্ধ করে দিতেই গন্ধটা একটু প্রকট হল। অমল যে একটু আধটু মদ-টদ খায় তা মহিম জানে। খেতেই পারে। আজকাল মদ খাওয়াটাই তো রেওয়াজ। চিন্তার কথা হল মদ খেয়ে ঘুম আসবার কথা, কিন্তু অমলের ঘুম আসছে না।

মহিম বিছানায় অমলের মুখোমুখি বসে ওর দিকে একটু চেয়ে থাকে। ছেলে সিলিং-এর দিকে মুখ করে বসে আছে। চোখ বোজা।

আমি আপনার ঘুম ভাঙাইনি তো!

না। আমি রাতে বার দুই উঠি। এখন উঠতেই যাচ্ছিলাম। আগে টানা ঘুম হত, আজকাল হয় না।

আপনার কত বয়স হল?

 আশির কাছাকাছি।

চোখ খুলে সামান্য বিস্ময়ের সঙ্গে অমল বলে, এত!

 মহিম সামান্য হাসে, তা হবে না? বয়স কি বসে থাকে!

আমার ধারণা ছিল আপনি সত্তরের কাছাকাছি বোধ হয়।

সত্তর কবে পেরিয়ে এসেছি।

আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করছি না তো!

 বিলিতি ভদ্রতা। মহিম মাথা নেড়ে বলে, না, ডিস্টার্বের কী আছে? বললাম না, ঘুম এমনিতেই কমে গেছে।

আজ রাতে যখন ঘুম আসছিল না তখন বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আজ একা একা ঘুরতে ঘুরতে আমার একটু ভয়-ভয় করছিল।

ভয়! ভয় তো হতেই পারে। তোরা শহরে থাকিস, সেখানে এত সুনসান হয়ে যায় না। গাঁ নির্জন জায়গা। তার ওপর কুকুর-টুকুর আছে, তাড়া করে।

না, ওসব ভয় নয়।

 তবে?

কী জানি, কেবলই মনে হচ্ছিল চারদিক থেকে যেন একটা হাহাকার শুনতে পাচ্ছি।

হাহাকার!

হ্যাঁ, ঠিক বোঝানো যাবে না। এ সেন্স অফ লস। গ্রেট লস।

বহু টাকা মাইনের চাকরি, মাথায় বিদ্যে গিজগিজ করছে, তবে ভয় পায় কেন ছেলেটা? কীসের হাহাকার! ওর তো বগলে চাঁদ!

মহিম গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, তোর মনটা কি খারাপ?

হ্যাঁ, খুব খারাপ।

কেন রে, মন খারাপের কী হল?

 মনের ওপর তো কারও হাত নেই।

 তা তো ঠিকই।

 আমার মনটা রোজই একটু একটু করে খারাপ হয়েই যাচ্ছে। কিছুতেই ভালর দিকে যাচ্ছে না।

তোর শরীর কেমন?

শরীরের খবর জানি না। বোধ হয় খারাপ নয়।

শরীর ভাল আছে বলছিস?

 বললাম তো, সমস্যাটা শরীরের নয়। মনের।

মহিম চিন্তিত হল। কিন্তু দিশা পেল না। একটু ভেবে বলল, বউমার সঙ্গে কিছু হয়নি তো!

মাছি তাড়ানোর মতো মুখের সামনে হাতের একটা ঝটকা দিয়ে বিরক্তির সঙ্গে অমল বলে, বউমার কথা ছাড়ুন তো। ও কোনও ফ্যাক্টর নয়।

মহিম সতর্ক হল। বেফাঁস কথা বলা চলবে না। একটু ভেবে বলল, মনটা কি গাঁয়ে এসেই খারাপ হল নাকি?

না বাবা। মনটা ইদানীং আমার সবসময়েই খারাপ। সবচেয়ে ভয়ের কথা আমার যে ফোটোগ্রাফিক মেমরি ছিল সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আজকাল অনেক কিছু ভুলে যাই, যা ভুলবার কথা নয়।

মহিম ঘরের কমজোরি বালবের আলোয় নিজের ছেলেটির দিকে চেয়ে খুব অবাক হয়ে ছেলের মুখশ্রীতে আর গোল চশমায় সুধীর ঘোষের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল। সর্বনাশ! সুধীর ঘোষই আবার তার ছেলে হয়ে জন্মায়নি তো!

এক মুহূর্তের বিভ্রম কাটিয়ে উঠল মহিম। কী যে সব ছাতামাথা মনে হয় তার। মাথাটাই ভূতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বুড়ো বয়সে। নিজেকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মনের দুর্বলতাটা কাটিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা করে সে বলল, তোর টেকনিক্যাল নলেজের মেমারিও কি কমে যাচ্ছে?

মাথা নেড়ে অমল বলে, না, সেসব ঠিক আছে। ভুল হচ্ছে মানুষের মুখ, নাম, ছোটখাটো ঘটনা, ঠিকানা এইসব। কোথাও যেতে যেতে হঠাৎ মাঝপথে মনে হয়, আরে! কোথায় যাচ্ছি আমি! কোথায় যাওয়ার কথা তা মনে পড়তে সময় লাগে।

ওটা বোধ হয় লস অফ মেমারি নয়।

 তাহলে কী?

বোধ হয় প্রি-অকুপেশন। একটা কোনও নিবিষ্ট চিন্তা মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বলে স্মৃতি একটু ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

আপনি কি সাইকোলজি জানেন?

না বাবা, জানি না। তবে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে অভিজ্ঞতা অনেক কিছু শেখায়। তোমরা হয় তো দাম দেবে না তার।

অমল চুপচাপ বসে কিছুক্ষণ ভাবল।

তার পর বলল, কিছু একটা হবে। সামথিং ইজ রং উইথ মি।

নিজেকে নিয়ে অত ভাবিস না। অন্যদের নিয়ে ভাব।

অমল বোধ হয় কথাটা শুনতে পেল না। ঘরের একটা অনির্দেশ্য জায়গায়, একটু ওপর দিকে অন্যমনস্ক চোখে চেয়ে থেকে বলল, মাথাটা গরম লাগছিল বলে রাত দেড়টায় বেরিয়ে পড়েছিলাম। চেনা গ্রাম, চেনা রাস্তা, তবু কিছুক্ষণ হাঁটার পরই মনে হতে লাগল, জায়গাটা আমি একদম চিনতে পারছি না। কোথায় এলাম, কোথায় যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তার পর হঠাৎ মনে হল আকাশ থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো কী যেন ঝরে পড়ছে চারদিকে। খুব সূক্ষ্ম, পাউডারের চেয়েও মিহি গুঁড়ো। ভয় হচ্ছিল, গ্রহ নক্ষত্র সব কিছুর আয়ু ফুরিয়ে গেছে, সব গুঁড়ো গুড়ো হয়ে পড়ে যাচ্ছে। এত ভয় পেলাম যে, দৌড়োত শুরু করলাম।

মহিমের হঠাৎ মনে হল, অমল তাকে উদ্দেশ করে নয়, সম্পূর্ণ বে-খেয়ালে আপন মনেই কথা বলে যাচ্ছে। ও কি একা কথা বলে? ও কি সুধীর ঘোষের পুনর্জন্ম?

মহিম নড়েচড়ে বসে। মন থেকে অলক্ষুণে চিন্তাটাকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে, সব কিছুরই পরিণতি আছে। ধ্বংস হয়, আবার জন্মায়। শাস্ত্রে ওকে কল্পান্ত বলে।

অমল কথাটা কানে তুলল না। শুনতেই পেল না বোধ হয়। তেমনই বিভোর হয়ে বলতে লাগল, একটা হাহাকার শুনতে পাচ্ছিলাম। যেন চারদিকে হায় হায় শব্দ। বিষাদ-সিন্ধুতে যেমন ছিল।

ওসব ভাবতে নেই।

আমি যেন চারদিকে কুলক্ষণ দেখতে পাচ্ছি।

তুই বিজ্ঞানের ছাত্র, বিজ্ঞান আমাদের কাণ্ডজ্ঞান আর বাস্তববুদ্ধিই তো দেয়। মনটাকে দুর্বল হতে দিস কেন, নির্মোহ বিজ্ঞানের চোখে দুনিয়াটাকে বিচার কর। দেখবি মনটা সহজ হয়ে গেছে।

 অমল একথাটাও যেন শুনতে পেল না। শুধু আপনমনে বলল, এত ভ্যাকুয়াম, এত ফাঁকা, এত অর্থহীন কেন যে লাগছে!

মহিম বলল, আয়, এখানেই শুয়ে পড়।

একথাটা শুনতে পেল অমল। বলল, শুয়ে পড়ব।

হ্যাঁ, শুয়ে পড়।

 এটা তো আপনার বিছানা।

 তাতে কী? তুই শো।

আপনি কোথায় শোবেন?

আমি আর শোব না। ঘুম যেটুকু হওয়ার হয়ে গেছে। রাত সোয়া তিনটে বাজে এখন। আমি তো ভোর চারটেয় উঠে পড়ি।

অমল হঠাৎ লোভাতুর চোখে চেয়ে বলল, শোব?

হ্যাঁ। বলছি তো, শুয়ে থাক।

 অমল চটিজোড়া ছেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে মশারির তলায় ঢুকে গায়ে লেপটা টেনে বাচ্চা ছেলের মতো শুয়ে পড়ল। এবং প্রায় দু মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে পড়ল। ছেলের নাকের ডাক শুনতে পেল মহিম।

মদটা কি একটু বেশি মাত্রায় খেয়ে ফেলেছে আজ? তাই হবে বোধহয়। যদিও কথাগুলো ঠিক মাতালের মতো বলছিল না। কিন্তু মদের একটা ঘোর আছে বোধহয়।

মহিম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দূরে দূরে ছিল বেশ ছিল। দুশ্চিন্তা করতে হত না। কিন্তু এই যে আজ রাতে কাছে এল, এত কথা বেরোল পেট থেকে এইতেই মনটা খচ খচ করে। আবার এই বুড়ো বয়সে নতুন নতুন দুশ্চিন্তা এসে মাথায় চাপে।

ভোর হল। তারপর বেলাও গড়িয়ে গেল অনেকটা। মহিম পুজোপাঠ সেরে রোদের উঠোনে চেয়ার পেতে বসে সকালটাকে পেকে উঠতে দেখল। মনটা ভাল নেই। ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছে।

আজকাল প্রায় প্রতিদিনই সকালে ধীরেন এসে হানা দেয়। বাড়িতে তার আদর নেই। অভাবের সংসার। সকালে চা-টুকু অবধি জুটতে চায় না। তাই একটু চায়ের লোভে এতটা পথ ঠেঙিয়ে আসে। আজও এল।

এ-বাড়ির কেউ ধীরেনকে পছন্দ করে না। একে তার জামাকাপড় নোংরা। তায় সকলের ধারণা ধীরেন লোভী, হ্যাংলা। মাঝে মাঝে ধারকর্জ চায়, শোধ দিতে পারে না বলে বদনামও আছে তার। তবে ধীরেন পাঁচ-দশ টাকার বেশি ধার চায় না কখনও। তাই দিতে গায়ে লাগে না বড় একটা।

আর কেউ পছন্দ না করুক, ধীরেন এলে মহিম খুশি হয়। তোক যেমনই হোক, পুরনো মানুষ তো! কত কালের চেনা। খানিকটা বন্ধুর মতোই ছিল এক সময়ে। আবার ঠিক বন্ধুও নয়। আজ্ঞাবাহী ছিল খুব। ফাইফরমাশ খেটে দিত হাসিমুখে। এখন বুড়ো হয়েছে, কিন্তু সেই বশংবদ ভাবটা যায়নি।

আজ সকালের ফর্সা আলোয় কালো ধীরেনকে দেখে মহিম অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশি খুশির গলায় বলল, আয় ধীরেন, বোস।

ধীরেন কষ্টে সসংকোচে মোড়াটা টেনে নিয়ে বসল। মুখে গ্যালগ্যালে হাসি। গায়ে একটা উলোঝুলো পুরনো ঢলঢলে পুলওভার। মাথায় বাঁদুরে টুপি। পরনে ধুতি। বহুরূপীর মতোই দেখাচ্ছে।

পুরনো দিনের কথাই হয় বেশির ভাগ।

হ্যাঁ রে ধীরেন, তোর সুধীর ঘোষের কথা মনে আছে?

খুব। সেই ম্যাথেমেটিশিয়ান তো!

হ্যাঁ।

ওরকম মাথাওলা লোক আর এ-গাঁয়ে হয়নি।

তার কথা সব মনে আছে?

থাকবে না? যত বুড়ো হচ্ছি পুরনো দিনের কথা ততই ফুটে উঠছে। আশ্চর্য ব্যাপার।

তুই কখনও সুধীর ঘোষের ভূতকে দেখেছিস?

খুব দেখেছি।

 মহিম হাসল, কোথায় দেখেছিস?

 উফ সে কথা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়।

বটে!

 পাশের গাঁয়ে সেবার যাত্রাপালা এসেছিল নদের নিমাই। কী একটা নামকরা দল এসেছিল। পালা শেষ হতে হতে রাত দুটো। তিনজনে মিলে ফিরছিলাম। সুনসান রাত্তির। সঙ্গের দুজন কুমোরপাড়ার কাছে এসে অন্য দিকে চলে গেল। আমি একা।

হ্যাঁ, তোর যাত্রার খুব নেশা ছিল বটে।

 এখনও আছে। হলেই যাই।

তারপর বল।

চৌধুরীদের পুকুরের ধার বরাবর রাস্তা দিয়ে আসছি। ওদিকটায় তখন খুব জঙ্গল ছিল। ফলসা গাছের বন ছিল। মনে আছে?

তা থাকবে না! খুব মনে আছে।

সে জায়গায় দিনমানেও তখন লোক চলাচল ছিল না। আপনমনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আসছিলাম। হঠাৎ সামনে রশিখানেক তফাতে দেখলুম একটা লোক নিচু হয়ে কী যেন কুড়োচ্ছে।

কুড়োচ্ছে?

হ্যাঁ। সেরকমই ভঙ্গি। তা আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললুম, কে ওখানে? কেউ জবাব দিল না। তখন বললুম, কিছু হারিয়ে থাকলে তো আর এই অন্ধকারে খুঁজে পাবেন না মশাই। এখন বাড়ি যান, কাল সকালে খুঁজবেন এসে। তখন লোকটা হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকাল।

অন্ধকারে দেখলি কী করে?

খুব জ্যোৎস্না ছিল তখন। ফটফটে পরিষ্কার দুধ-জ্যোৎস্না। স্পষ্টই দেখলুম। সুধীর ঘোষ দাঁড়িয়ে। চোখে গোল চশমা। আমার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল। শরীর এমন ঠান্ডা মেরে গেল ভয়ে যে নড়তে-চড়তে পারি না, গলার স্বর ফুটছে না। হার্টফেল যে হইনি সেই ঢের। তবে বেশিক্ষণ নয়, যেমন হঠাৎ দেখা গিয়েছিল তেমনই হঠাৎ মিলিয়ে গেল বাতাসে। রাম নাম করতে করতে আর ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে আসি।

চশমাটা সবাই দেখত। হ্যাঁ রে, ভূত চশমা পরে কেন?

ধীরেন কাষ্ঠ হেসে ফেলে বলে, তা কে বলবে বলুন! তবে কথাটা ভাবার মতো, ভূতের আবার চশমা লাগে কীসে? তা হঠাৎ সুধীর ঘোষের কথা উঠছে কেন? কিছু দেখেছেন-টেখেছেন নাকি?

না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল। আজকাল আলটপকা অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে যায়, যেগুলো মনে পড়ার কথাই নয়। একেবারে বিস্মরণ হয়ে যাওয়া কথাও পট করে কেন যে মনে পড়ে! তখন মনে হয় এসব বোধ হয় এ-জন্মের ঘটনাই নয়, আর জন্মে ঘটেছিল। কাল রাতে হঠাৎ সুধীর ঘোষের মুখখানা ভেসে উঠল চোখে। সেই থেকে ভাবছি।

আমিও খুব ভাবি। একাবোকা থাকলে, অন্ধকার ঘরে কি নিরালা রাস্তায় হঠাৎ সেই মিদ্দারের পো যেন কাছাকাছি চলে আসে। যেন ছোঁক ছোঁক করে, গা খুঁকে শুঁকে পিছু পিছু আসতে থাকে। তার বউটাও যেন ঘুরঘুর করে আশেপাশে। আর তখন সেই বর্ষার রাতটা যেন চোখের সামনে একেবারে জলজিয়ন্ত হয়ে ওঠে। যত বুড়ো হচ্ছি তত যেন মনস্তাপ বাড়ছে।

নাতনি বিন্তি একখানা থালার ওপর দু কাপ চা নিয়ে এল, সঙ্গে শস্তার টোস্ট বিস্কুট। আড়চোখে মহিম দেখল, ধীরেনের জন্য সেই ময়লা হাতলভাঙা কাপেই চা দিয়েছে, ওই কাপটায় বাড়ির কাজের মেয়েটা চা খায়। মনটা খারাপ লাগল। শত হলেও ধীরেন তো আর ওটোলোক ছোটলোক নয়। তাকে এত তাচ্ছিল্য করলে মহিমেরও যেন খানিকটা সম্মানহানি হয়। কিন্তু কাকে কী বলবে মহিম? আর বললেই বা শুনছে কে?

ধীরেনের অবশ্য তাপউত্তাপ নেই। ভারী আহ্লাদের সঙ্গেই সে যত্ন করে মুড়মুড় শব্দে বিস্কুট চিবোয়, সুভুত সুড়ুত করে আরামে চা খায়। নিজের বরাদ্দের দুখানা বিস্কুটের একখানা এগিয়ে দেয় মহিম, রোজকার মতোই বলে, নে, খা।

রোজকার মতোই ধীরেন লাজুক গলায় বলে, না, না, থাক। আপনি খান।

 রোজের মতোই মহিম বলে, ওরে, আমার যে দাঁতের জোর নেই সেটা কি ভুলে যাস?

ধীরেন এক গাল হেসে বলে, ঠাকুরের দয়ায় আমার দাঁতগুলো এখনও আছে। কোনও গণ্ডগোল নেই দাঁতে। গণ্ডগোল হল, দাঁতের কাজ কমে গেছে।

কেন রে?

বুঝলেন না? চিবোনোর জিনিসই তো জোটে না। মাংস-টাংসর কথা তো ভুলতেই বসেছি, মাছের কাঁটা কি মুড়ো সেসবও তো আর চোখে দেখি না।

মহিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনটা ভাল নেই। ছেলেটা এখনও তার বিছানায় অসাড়ে ঘুমোচ্ছে।

.

২০.

আকাশে পাখি ফিরিছে গাহি, মরণ নাহি, মরণ নাহি। এই ধ্রুবপদ মাথার ভিতরে বিনবিন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। খুব মৃদু, শীতল, গুনগুন সুর। জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর, জুড়িয়ে যাচ্ছে মন। এ যেন গান নয়, মায়ের আঙুল। জ্বরে তপ্ত কপালে ঠান্ডা হাত। বড় ভরসা, বড় আশা, বড় সান্ত্বনা। মরণ নাহি, মরণ নাহি।

পাখি ডাকছে। তাদের প্রবল ডাকাডাকি আর ডানার চঞ্চল শব্দে কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে বাতাস। আলো ফুটছে ক্রমে। ঘরে পাঁশুটে একটু ময়লা রং। তার মধ্যেই হঠাৎ জানালার ফাঁক দিয়ে তপ্ত লোহার রডের মতো লাল একটা রেখা এসে পড়ল মশারির গায়ে।

লেপের ওমের ভিতর থেকে মুখ বের করে এইসব নৈমিত্তিক দৃশ্য ও শব্দ ঘুমচোখেই সে লক্ষ করে ফের চোখ বোজে। মনে হয়, বহুকাল পরে একটা সুপ্রভাত এল বুঝি। এত সুন্দর ভোর বহুকাল দেখেনি সে।

এ-ঘরে চড়াই পাখির বাসা হয়েছে। বন্ধ ঘরে তাদের পুরীষ ও গায়ের বোঁটকা গন্ধ। জানালার সামান্য ফাঁক দিয়ে তাদের প্রবল যাতায়াতের শব্দ ও পরস্পরের ডাকাডাকিতে একটুও বিরক্ত হচ্ছিল সে। কত জীবন, কত রকমের জীবন চারদিকে! পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, জীবজন্তু, সরীসৃপ। আকাশে পাখি ফিরিছে গাহি, মরণ নাহি, মরণ নাহি…।

কোথায় কবে শুনেছিল এই লাইন? মনেও ছিল না তো! হঠাৎ কোন গভীর অবচেতনা থেকে উঠে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার দেহ-প্রকোষ্ঠে! মরণ নাহি, মরণ নাহি। এ কি মধুর মিথ্যা! নাকি সত্যিই এ জীবন মৃত্যুহীন?

মৃত্যুহীন কি জীবন হয়? কখনও নয়, কখনও নয়।

আধোঘুমে সে অনুভব করে মাথার নীচে অচেনা বালিশ। নিচু, চ্যাপটা, শক্ত। বালিশের ওপরেশস্তা খসখসে টার্কিস তোয়ালে থেকে তিলতেলের মৃদু গন্ধ আসছে। পাতলা তোশকের জন্য পিঠে ফুটছে তক্তপোশের তক্তা। লেপটার তেমন ওম নেই। পুরনো তুলো জায়গায় জায়গায় দলা পাকিয়ে ফাঁকফোকর তৈরি হয়েছে। তবু এই বিছানায় মধ্যরাত থেকে অঘোরে ঘুমিয়েছে সে। বাচ্চা ছেলের মতো। স্বপ্নও দেখেছে। একটাও দুঃস্বপ্ন নয়। অথচ দুঃস্বপ্ন ছাড়া খুব কম রাতই কাটে তার। ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে ভয়ে, আতঙ্কে উঠে বসে সে। বুক ধড়ফড় করে, জিব শুকিয়ে যায়। মৃত্যুর স্বপ্ন যেন বিজবিজ করে তার অস্বস্তিকর ঘুমের মধ্যে।

অনেক দিন বাদে এই অচেনা বিছানায় শুয়ে একটা-দুটো ভাল স্বপ্ন দেখেছে সে।

 দেখল, খুব ভোরবেলা সে একটা সাঁকোর ওপর রেলিং-এ ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। নীচে কুয়াশায় আবছা এক নদী। একখানা নৌকো খুব ধীর দোলে চলে যাচ্ছে। নৌকোয় একখানা হলুদ লণ্ঠন জ্বলছে। লণ্ঠন ঘিরে মুড়িসুড়ি দেওয়া কয়েকজন মানুষ। ধীরে ধীরে নৌকোটা কুয়াশার আবছায়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সবটাই যেন একখানা ওয়াশ-এর ছবি। বাস্তব পরাবাস্তবে মেশামেশি। খুব রোমান্টিক।

তার পাশে দাঁড়ানো একটি মেয়ে। ঘোমটায় ঢাকা মুখ। কিশোরীর ফিনফিনে চিকন গলায় নরম স্বরে সে বলে, তুমি খুব ভোরে ওঠো বুঝি?

না তো! ভোর কাকে বলে আমি তা জানিই না।

ভোরবেলার মতো এত সুন্দর সময় আর নেই। এ সময়ে ভগবানের সব জানালা দরজা খোলা থাকে। তুমি কেন ভোরে ওঠো না?

আজকাল ঘুম সহজে আসতে চায় না। কখনও মদ খেয়ে বা ওষুধ খেয়ে ঘুমোই। সেই ঘুম খুব বিচ্ছিরি। শরীরটা তখন আমার থাকে না। জড়বস্তুর মতো হয়ে যায়।

কিশোরী মেয়েটি জলে প্রায় স্থির ছবির মতো নৌকোটার দিকে চেয়ে রইল। বলল, তুমি যাবে?

কোথায় যাবো?

ওদের সঙ্গে?

ওরা কোথায় যাচ্ছে?

বড় গাঙে মাছ ধরতে।

যাবো।

পর মুহূর্তেই সে দেখল সেই আশ্চর্য নৌকায় সে লণ্ঠনের ধারে বসে আছে। বাবা আছে, দাদা আছে, কিশোরী মেয়েটিও বসে আছে ঠিক তার উলটো দিকে। আর নিতাই জেলে ছইয়ের ওপর থেকে জলে জাল ফেলতে গিয়েও দোনোমোনো করছে।

বাবা হাঁক দিল, ওরে নিতাই, জাল ফেলছিস না কেন?

জলে বড্ড বেশি মাছ বাবু। বিজবিজ করছে মাছ। রুই-কাতলা-মৃগেল কালবোশ। জাল টেনে তুলতে পারব কি?

দুর বোকা! মাছ ধরতেই তো আসা।

না বাবু। এত মাছ তুললে নৌকো ডুবে যাবে।

মেয়েটি জলের দিকে চেয়ে ছিল। হঠাৎ মুখ তুলে তার দিকে ফিরে বলল, জলে মাছ আছে, ক্ষেতে ধান আছে, চারদিকে কোথাও কোনও অভাব নেই।

অমলের মনটা বড্ড ভাল হয়ে গেল চারদিককার সম্পন্নতার কথা শুনে।

হঠাৎ বাবা বলল, এঃ চারটে টেক্কাই তোর হাতে। কল দে।

অমল দেখল তার হাতে তাস। তারা চারজন লণ্ঠনের আলোয় ব্রিজ খেলছে। নিজের হাতের তাস ভাল দেখতে পাচ্ছিল না সে। কেমন যেন হিজিবিজি তাস। দুটো জোকারের মুখও দেখতে পাচ্ছে সে। কোথায় চারটে টেক্কা?

এতক্ষণ দেখতে পায়নি। ছইয়ের ভিতরে মা রান্না করছিল। ডাক দিয়ে বলল, খোকা, কাঁকড়ার ঝোল হয়ে গেছে। খাবি আয়। ভাত বাড়ছি।

আমার কি খিদে পেয়েছে মা?

হ্যাঁ পেয়েছে। ছেলের খিদে মা ঠিক টের পায়।

তারপর আরও কী কী হল যেন। কী হল তা আর মনে নেই। স্বপ্নটা যেন জঙ্গলের মধ্যে কাঠুরেদের পায়ে-হাঁটা পথের মতো হঠাৎ হারিয়ে গেল।

দ্বিতীয় স্বপ্নটাও কিছু খারাপ নয়। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ একটা পার্টি দিচ্ছেন। বিশাল বড় একটা জায়গা–অনেকটা রোমান কলোশিয়ামের মতো। সেখানে হাজার হাজার মোম জ্বলছে আর অনেক লোক বাজনার তালে তালে হাততালি দিচ্ছে। রানি আসবেন বলে অপেক্ষা করছে সবাই। অনেক সাহেব মেমের সঙ্গে বিস্তর বাঙালিকেও দেখতে পাচ্ছে সে। অনেকে ধুতি পাঞ্জাবি পরা।

পাশে দাঁড়ানো এক সাহেব হঠাৎ তাকে পরিষ্কার বাংলায় বলল, আমার নাম স্টিফেন স্নাইডার। আমি একজন কমোডর। আপনি কে বলুন তো?

আমি অমল রায়। একজন ইঞ্জিনিয়ার।

আরে! আপনিই তো আজ রানির কাছ থেকে নাইটহুড পাবেন। আপনি তো বিখ্যাত লোক!

লোকটার মাথায় টাক, বেশ লম্বা, মুখে অমায়িক হাসি।

অমলের একবার মনে হল, ঠিক এরকম পার্টিতে কাউকে নাইটহুড দেওয়া হয় না। আবার মনে হল, কী জানি বাবা, হতেও পারে। নিয়মকানুন হয়তো বদলে গেছে।

অমল বলল, আচ্ছা, নাইটহুড নেওয়ার সময় কি হাঁটু গেড়ে বসতে হয়?

না না, ওসব নিয়ম আর নেই। তবে রানির গালে চুমু খেতে কোনও বাধা নেই।

নিয়মগুলো আমার ভাল জানা নেই।

লোকটা দুঃখ করে বলল, পুরনো আদবকায়দা উঠে যাচ্ছে। ওসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। নাইটহুড পেলে আপনার খুব বড় একটা প্রোমোশন হবে।

অমল খুশি হলে বলল, ধন্যবাদ।

এ আর এমন কী! আপনি তো এর পর নোবেল প্রাইজও পাবেন!

সে কী?

হ্যাঁ। আমার কাছে গোপন খবর আছে। শর্ট লিস্টে নাম উঠেছে।

অমল খুবই খুশি হল। নিজের সম্পর্কে তার ধারণা কখনও এতটা উঁচু ছিল না।

সমবেত তীব্র করতালির শব্দে অমল চমকে উঠে দেখল, একটা চমৎকার সাদা সিঁড়ি দিয়ে রানি নেমে আসছেন।

ওইখানেই স্বপ্নটা পাশ ফিরল। হারিয়ে গেল। যেমন হাটেবাজারে বাবার হাত-ছুট হয়ে বাচ্চা ছেলে মাঝে মাঝে হারিয়ে যায়। ছেলে ফেরত পাওয়া যায় বটে, কিন্তু হারানো স্বপ্নকে ফের ধরা খুব মুশকিল। সে যেন ঝিলের ওপর দিয়ে উড়ে-যাওয়া কাটা ঘুড়ি। তাকে কি ধরা যায়! কতবার ঝিলের ধারে দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে বেহাত ঘুড়ির দিকে চেয়ে থেকেছে অমল।

বাবার বিছানায় পাতলা তোশক, ওমহীন লেপের মধ্যে শুয়েও আজ বেলা পর্যন্ত খুব ঘুমোল সে।

তুমি কি এখনও ঘুমোচ্ছ?

চোখ চেয়ে অমল দেখে, বাইরে রোদের ঝাঁঝ বেড়েছে। ঘর আলোয় আলোময়। বউদি সামনে দাঁড়ানো। হাতে চায়ের কাপ।

এবার ওঠো। বেলা হয়েছে। চা এনেছি।

এই বউদির সঙ্গে তার এক সময়ে খুব খুনসুটির সম্পর্ক ছিল। ঠাট্টা, রঙ্গ রসিকতা খুব হত। আজকাল সবাই নিরাপদ দূরে সরে গেছে। তার অনেক বিদ্যে, অনেক বড় চাকরি, গাম্ভীর্য এইসব কিছুকে সবাই ভয় পায়।

অমল উঠে বসে এক গাল হেসে বলল, ঠাকরোন যে! বাব্বাঃ!

কত কাল পরে ঠাকরোন বলে ডাকলে বলো তো! ডাকটা মনে ছিল তা হলে!

খুব ছিল। বোসো, ওই চেয়ারটায় গ্যাঁট হয়ে বোসো, কথা কই।

 চায়ের কাপটা তার হাতে দিয়ে দ্রুত দক্ষ হাতে মশারিটা চালি করে তুলে দিয়ে বউদি বলে, দু দণ্ড যে বসব তার কি উপায় আছে। কিন্তু কী ব্যাপার বলো তো ঠাকুরপো, তুমি বাবার বিছানায় এসে শুয়ে আছ যে!

অমল চায়ে চুমুক দিয়ে একটু লাজুক হেসে বলে, সে একটা কাণ্ড!

 কী কাণ্ড?

 কাল রাতে আমাকে বোধহয় ভূতে পেয়েছিল।

বড় বড় চোখ করে বউদি বলে, ওমা! বলো কী গো! কোন ভূতটা ধরেছিল তোমাকে?

এখানে কটা ভূত আছে বলো তো!

তা আছে বাপু। সুধীর ঘোষ, ফটিক কাঞ্জিলাল, ইলাবতী, সোমেশ্বর আরও কতজনা।

বাপ রে! এত ভূত! গাঁয়ে তো তা হলে ভূতের মচ্ছব পড়ে গেছে।

 ঠাট্টা কোরো না তো, ভাল লাগে না। ভূত-প্রেত নিয়ে ইয়ার্কি নয়।

খুব হাসল অমল। তারপর বলল, বাইরের ভূত নয় গো ঠাকরোন, এ ভূত আমার মাথার মধ্যে ভর করেছে।

হ্যাঁ ঠাকুরপো, তুমি নাকি রাত-বিরেতে বেরিয়ে যাও!

 হ্যাঁ তো৷ ঘুম না এলে বেরিয়ে পড়ি।

 ধন্যি তোমার সাহস!

গাঁ-দেশে কি রাত-বিরেতে লোকে বেরোয় না?

তা বেরোয়। ঠাকুর-দেবতার নাম করতে করতে বেরোয়। তুমি তো বাপু আবার নাস্তিক। নাস্তিক— হওয়া মোটেই ভাল নয়, জানো?

নাস্তিক হলে কী হয় ঠাকরোন?

নাস্তিকরা যেন কেমনধারা হয় বাপু!

 কেমনধারা হয় ঠাকরোন?

বড্ড রুখো-শুখো, কাট কাট কথা কয়, কাউকে মান্যিগন্যি করে না।

আমিও কি ওরকম ঠাকরোন?

 বলতে ভয় পাই, তুমিও আছ একটু ওরকম।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। ছেলেবেলায় ভগবানে ভারী ভক্তি ছিল তার, ভয়ও ছিল। সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিত কত নিষ্ঠার সঙ্গে। পরে দেখল, যারা সরস্বতীর নামও জানে না সেইসব সাহেবরা বিদ্যাবত্তায় অনেক এগিয়ে আছে। তখন সরস্বতীর ওপর ভরসা উবে গেল।

আমি ঠিক নাস্তিক নই ঠাকরোন। ভগবানকে বিশ্বাস করার চেষ্টা কিছু কম করিনি। কিন্তু দুনিয়ার কোথাও ভগবানের টিকির ডগাটিরও চিহ্ন খুঁজে পাই না যে! তবু নাস্তিকও হতে পারিনি পুরোপুরি। মনে অনেক সংস্কার গেড়ে বসে আছে।

বউদি বড় বড় চোখ করে শুনছিল। গাঁয়ের মেয়ে, গাঁয়ের বউ। লেখাপড়া তেমন নয়। একটু ভালমানুষ গোছেরই ছিল একসময়ে। এখন সংসারের জাঁতাকলে পড়ে কেমন হয়েছে কে জানে! বলল, হ্যাঁ ঠাকুরপো, সোহাগও কিন্তু বড্ড ডাকাবুকো। একদিন মাঝরাতে বেরিয়ে গিয়েছিল, ঠিক তোমার মতো।

চমকে অমল বলে, কোথায় গিয়েছিল?

তা কী জানি! যখন ফিরল তখনও ভোর হয়নি। আমি তো ভয়ে সারা। ভাবলুম, হাওয়া বাতাস লেগেছে বুঝি!

অমল মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, ও একটু খেয়ালি।

বেশি খেয়ালখুশি ভাল নয় বাপু। দিনকাল খারাপ পড়েছে। এ-গাঁয়ে আগে কোনও উৎপাত ছিল না। আজকাল ফচকে ছোঁড়াদের আড্ডা হয়েছে শুনতে পাই।

অমল নির্বিকারভাবে বলে, হ্যাঁ, তা জানি। সোহাগের ওপর ওদের নজর পড়েছে। চাটুজ্যেবাড়ির বিজু রুখে না দাঁড়ালে একটা ভালমন্দ কিছু হয়ে যেতে পারত।

অমল খানিকটা শুনেছে। গা করেনি। এরকম তো হতেই পারে। দুনিয়ায় মেয়েরা যত এগোবে ততই পুরুষের প্রতিরোধ বাড়বে, আর তা নানা বিকৃত পথ ধরে প্রকাশ পাবে। এ রকমই হওয়ার কথা।

অমল বলল, শুনেছি।

মেয়েকে একটু সামলে রেখো ঠাকুরপো, অত আলগা দিও না। কখন কোন সর্বনাশ ঘটে তার ঠিক কি!

অত ভয় পাও কেন ঠাকরোন? এখনকার মেয়েরা তোমাদের মতো নয়। তারা ঘর ছেড়ে বেরোতে শুরু করেছে সবে। একটু আধটু ওরকম ঘটনা এখন ঘটবেই। তারপর সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমার মেয়েকে আমি স্বাধীনতা দিয়েই দিয়েছি। দুনিয়াটার ওপর ওর কতখানি অধিকার তা ও নিজেই বুঝে নেবে।

বড় বড় চোখে কথাগুলো শুনল বউদি। তারপর বলল, তোমাদের বড় সাহস ভাই। আমি কিন্তু পারতাম না।

না ঠাকরোন, তুমি পারোনি, পারবেও না। তোমার সময় কেটে গেছে। কিন্তু ভয় নিয়ে বেঁচে থাকাটা একটা অভিশাপ। তোমাদের জীবনটা নানা ভয়-ভীতি নিয়েই কেটে যাবে। কিন্তু পরের জেনারেশনের মেয়েরা ভয় নিয়ে বাঁচতে চাইছে না যে!

কী জানি বাপু, অত কথা তো বুঝতে পারি না। মেয়েদেরই যে বিপদ বেশি।

 বিপদে না পড়লে কি বিপদ কাটে?

বউদি কথাটা মানল না বোধহয়। তবে তর্কও করল না। বলল, এখন চা খেয়ে ওপরে যাও। মোনা তোমার খোঁজ করছিল।

আমি যে এ ঘরে আছি তা কি জানে?

 জানে। বাবা বলেছে। শুনে মোটেই খুশি হয়নি।

অমল একটু হেসে বলল, আমার বউ সহজে খুশি হয় না।

আচ্ছা ঠাকুরপো, তুমি আলাদা ঘরে শোও কেন? বর-বউ এক বিছানায় শোও না কেন?

 সেটা কি নিয়ম?

ও মা! বলে কী রে! সেটা নিয়ম নয়?

না শুলে ক্ষতি কী?

শোনো কথা! বর বউ এক বিছানায় না শুলে কি ভাব-ভালবাসা গাঢ় হয়?

অমল হেসে ফেলে, এক বিছানা ছাড়া ভাব-ভালবাসা হয় না নাকি?

কী জানি বাপু, তোমাদের সব অদ্ভুত কথা! বলি বিছানাটাও তো একটা কাছে-থাকা, তা নয়?

অমল ম্লান হেসে বলল, আমাদের তো সেরকম মনে হয়নি। অনেক সময়ে আমার কাজ থেকে ফিরতে দেরি হত। কখনও কখনও মধ্যরাতে ফিরেছি। তখন কারও ঘুম ভাঙিয়ে ভাব-ভালবাসা করতে গেলে উলটো ফল হতে পারত। তাই আলাদা বিছানায় শোওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। ব্যাপারটা খুব একটা হাইজিনিকও নয় কিন্তু।

কেন, হাইজিনিক নয় কেন?

পরস্পরের শ্বাস দেওয়া নেওয়া কি ভাল। তা ছাড়া কারও কোনও কন্টেজিয়াস ডিজিজ বা খারাপ অভ্যাস থাকতে পারে।

সে আবার কী?

 ধরো কেউ ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছোড়ে, কারও হয়তো নাক ডাকে, কিংবা মুখে দুর্গন্ধ বা দাঁত কড়মড় করে…

থাক থাক, আর ফাড়াকাটতে হবে না বাপু। কত কথাই যে জানো! বর-বউয়ের মধ্যে আবার ওসব অসুবিধে কোনও বাধা হয় নাকি! তোমার দাদার তো ভীষণ নাক ডাকে, তাতে তো আমার একটুও অসুবিধা হয় না। বরং একদিন নাকের ডাক না শুনলেই দুশ্চিন্তা হয়।

তুমি নমস্যা ঠাকরোন।

ইয়ার্কি হচ্ছে, না?

বহুকাল পর তোমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছি। বড় ভাল লাগছে। আর একটু বোসো। আজকাল তো তোমার সঙ্গে কথাই হয় না।

কী করব ভাই, তোমাদের গোমড়া মুখ দেখে ইদানীং বড্ড ভয় হত। সাহেব মেমদের দেশ থেকে এসেছ, পেটে কত বিদ্যে, আমরা তো কোন অন্ধকারে পড়ে থাকা জীব। তাই সমানে সমানে কথা কওয়ার চেষ্টা করিনি।

ঠাকরোন, আজ আর বিদ্যে-বুদ্ধি-চাকরি আমার কোনও গয়না নয়। মনে হয় ওসব দিয়ে কিছু হয় না।

বল কী গো! কিছু হয় না মানে! তোমার কি কিছু হয়নি! কত নামডাক, কত দায়িত্বের কাজ, যখন তখন বিলেত আমেরিকা চলে যাচ্ছ! তবু বলছ কিছু হয় না? আর কী হবে?

সেটাই তো ভাবছি।

তোমার সব বিদঘুটে কথা! তোমার দাদাও সেদিন বলছিল, অমলটার কী হয়েছে কে জানে, মুখে কখনও হাসি নেই। তুমি আজকাল সত্যিই হাসোনা, কেন বল তো!

আজ তো বেশ হাসিখুশিই আছি ঠাকরোন, তাই না?

তা বাপু, সত্যি কথা, বহুকাল পর আজ তোমাকে একটু হাসিখুশি দেখছি। শ্বশুরমশাইয়ের বিছানার তাহলে গুণ আছে।

অমল আস্তে আস্তে গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, কথাটা খুব ভুল বলনি তুমি কাল নিশি-পাওয়ার মতো মাঝরাতে বেরিয়ে পাগলের মতো কোথায় কোথায় ঘুরেছি কে জানে! ফিরে এসে হঠাৎ বাবার কাশির আওয়াজ শুনে জানলাটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। বাবার সঙ্গে বহুকাল সম্পর্কই তো নেই। জন্মদাতা বাপ, তার যে আর কোনও প্রয়োজন আছে জীবনে তাই তো ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাল রাতে হঠাৎ ইচ্ছে হল, আচ্ছা, বাবা কী করছে একটু দেখি।

কেন হঠাৎ ইচ্ছেটা হল?

কোনও কারণ নেই। এমনই হঠাৎ ইচ্ছে হল। বাবা জেগেই ছিল। আমাকে ঘরে ডেকে এনে বসাল। কীসব কথাবার্তা হল তা ভাল মনে নেই। তারপর বাবা নিজেই বলল, আমার বিছানায় শুয়ে থাক। আর সেই কথাটা শুনেই আমার এমন লোভ হল যে আপত্তি না করে সোজা এসে শুয়ে পড়লাম। কী বলব তোমাকে, শুতে না শুতেই ঘুম। বহুকাল এমন নিশ্চিন্তে বাচ্চাছেলের মতো ঘুমোইনি।

বউদি একটু হেসে বলল, হ্যাঁ, খুব ঘুমিয়েছ বাপু। তিন-চারবার ডাকতে হয়েছে ঘুম থেকে তুলতে।

 বিছানাটা মোটেই ভাল নয়। তোশক পাতলা, লেপটাও পুরনো বলে ওম নেই, শক্ত বালিশ, তবু আশ্চর্য ঘুম হয়েছে কিন্তু। বিছানার গুণই হবে, কী বল!

শোনো বাপু, তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর ওই আলাদা শোওয়াটা মোটেই ভাল দেখাচ্ছে না। আজ থেকে দুজনে একসঙ্গে শোও।

তাতেই সমস্যার সমাধান হবে?

সমস্যা আবার কীসের? স্বামী-স্ত্রীর মন কষাকষি হয়ই, আবার মিটেও যায়। শুয়েই দেখো না। অনেক সময়ে শরীর কাছাকাছি হলে মনও কাছাকাছি হয়।

তোমাকে আজ বিছানায় পেয়েছে দেখছি। কিন্তু মোনার আর আমার মধ্যে সমস্যাটার সমাধান শুধু বিছানা দিয়ে যে হওয়ার নয় ঠাকরোন। মাঝখান দিয়ে নদী বইছে।

শুধু হেঁয়ালি কথা!

একটু হেঁয়ালি যে থেকেই যাচ্ছে।

 হ্যাঁ গো ঠাকুরপো, চাটুজ্যে বাড়ির মেয়েটার কথা কি তুমি এখনও ভুলতে পারনি?

অমল একটু চুপ করে থেকে বলল, মোনারও ধারণা আমি মনে মনে পারুলের কথাই ভাবি। কিন্তু পারুল কোনও বাধা নয়, পারুল কোনও কারণ নয়।

তোমার আর মোনার মধ্যে তো ঝগড়াও হয় না কখনও। শুধু মিলমিশের একটু অভাব।

ঝগড়া হলে তো বুঝতাম ভাবও আছে। কিন্তু ওই যে বললাম, মাঝখানে নদী বইছে।

আবার হেঁয়ালি! এখন ওঠো, ঘরে যাও। মোনা হয়তো রাগ করে আছে।

 ও সবসময়ই রাগ করে থাকে।

 আর এক কাপ চা খাবে?

দেবে?

 কেন দেব না? ওপরে যাও, পাঠিয়ে দিচ্ছি।

অমল উঠল। হাই তুলল, আড়মোড়া ভাঙল।

 ধীরে ধীরে দোতলায় উঠে এল অমল। সামনেই প্রথম ঘরটা মোনার। দরজায় মোটা পর্দা ঝুলছে। সন্তর্পণে ঘরটা পেরিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল অমল।

ঢুকেই থমকে গেল। ঘরে মোনা দাঁড়িয়ে।

তুমি কি বাড়ির লোকের কাছে এটাই প্রমাণ করতে চাও যে, তোমার আর আমার সম্পর্ক ভাল নয়?

অমল অবাক হয়ে বলে, সেটা কীসে প্রমাণ হল?

শুনলাম তুমি মাঝরাতে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে গিয়ে তাকে তুলে দিয়ে তার বিছানায় শুয়েছিলে?

হ্যাঁ। অনেকটা তাই।

 তোমার কি কাল রাতে খুব নেশা হয়েছিল?

খুব বেশি নয়। কেন, কী হয়েছে?

লোকে কী ভাবল সেটা ভেবে দেখেছ?

কথাটা ম্যান্তামায়া না ম্যাদামারা? যা-ই হোক, কথাটার মানে আগে বুঝতে পারত না অমল। আজকাল একটু একটু পারে। ম্যান্তামারা মানে বোধ হয় ঠান্ডা মেরে যাওয়া ফ্রিজ বা ফ্রিজিড হয়ে যাওয়া মানুষ, যার কোনও ব্যাপারেই তেমন কোনও তীব্র বা মৃদু প্রতিক্রিয়াও হয় না। যেমন গাছ বা ইট কাঠ। সকালের তেরছা তীব্র রোদের মস্ত চৌখুপি বিছানা জুড়ে এবং বিছানা ছাড়িয়ে ঘরের মেঝে অবধি এসে পড়েছে। ঝলমল করছে ঘর। তার আলোয় মধ্যবয়সি, প্রায় যুবতী এবং অসম্ভব ফর্সা মোনালিসাকে খুব তীব্র দেখাচ্ছে। কাটা কাটা মুখ-চোখের মোনাকে সুন্দরীই বলতে হবে। যদিও লাবণ্য জিনিসটার অভাব আছে। সে যাই হোক, মোনা এক তীব্র রূপের নারী এবং এখন তার চোখে অপমান এবং তজ্জনিত রাগ ঝলসাচ্ছে। অমলের এক ব্রিটিশ বন্ধু ড্যান তাকে প্রায়ই বলত কিস হার, এ কিস সলভস এভরিথিং। মুষ্টিযোগটা বহুবার প্রয়োগ করে দেখেছে অমল। কখনও কাজ হয়েছে, কখনও হয়নি। প্রেমহীন চুম্বনের বোধহয় কোনও বার্তা নেই।

এখন অবশ্য চুমু খাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। নিজের ভিতরে ভিজে, স্যাঁতা ম্যান্তামারা ভাবটা এমন পাথর হয়ে আছে যে মনে হয়, এত উদ্যোগ নেওয়ার কোনও মানেই হয় না। চুম্বনও যেন শ্রম। কঠোর শ্রম।

উনি আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে কিনা।

কে জিজ্ঞেস করছিল?

শ্বশুরমশাই। কী লজ্জার কথা বলো তো!

লজ্জা! লজ্জার কী আছে? তুমি কি ওদের পরোয়া কর?

করি না। কিন্তু তুমি ওঁর ঘরে গিয়ে শেলটার নিলে কেন?

 ব্যাপারটা ওরকম নয়।

 কীরকম?

আমার ভাষার জোর কম, এক্সপ্রেশনও হয় না। ভাবছি তোমাকে বোঝাতে পারব কিনা। এসব অদ্ভুত কথা বুঝতে গেলে তোমাকেও অনেকটা এগিয়ে আসতে হবে। তার চেয়ে থাক। ধরে নাও আমাকে একটা পাগলামিতে পেয়ে বসেছিল।

পাগলামি তোমাকে যে পেয়ে বসছে তা বুঝতে পারছি। মাঝরাতে তুমি কোথায় গিয়েছিলে? টু এনি গার্ল ফ্রেন্ড? পারুল নয় তো! শুনেছি ওর হাজব্যান্ড চল গেছে।

ভারী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে অমল। পারুল! মোনা কি এখনও পারুলের সঙ্গে তাকে সন্দেহ করে? তার ধারণা ছিল পারুল সম্পর্কে মোনার কোনও সন্দেহ নেই। পারুল যে একজন দেবী তা মোনা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আজ সকালে এ কী শুনছে সে?

ব্যথাতুর মুখে অমল বলল, তাই কি হয়! ওরকম ভাবতে নেই।

 বাধ্য হয়ে ভাবছি। তুমিই ভাবিয়ে তুলছ।

 মাথা নেড়ে ম্যান্তামারা অমল শুধু দিশাহারার মতো বলল, ভাবতে নেই, ওরকম ভাবতে নেই।

 তাহলে কী ভাবব তা তুমিই বলে দাও।

বেরিয়ে পড়েছিলাম। অনেকটা হটলাম। ফিরে এলাম। বাবা ডেকে বলল, আমার বিছানায় শুয়ে থাক। আমিও বাচ্চা ছেলের মতো গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঠিক এইরকম ঘটেছিল।

আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আজই কলকাতায় যেতে চাই।

আজই? এখনও কয়েকদিন ছুটি আছে।

 ছুটি থাকলেই কি এখানে পড়ে থাকতে হবে নাকি? আমার আর এখানে ভাল লাগছেনা। আমি যাব।

কলকাতায় গেলেই কি সব সমাধান হয়ে যাবে!

না, তা হবে না। তোমার সঙ্গে আমার আর রি-কনসিলিয়েশন হওয়ার নয়, জানি। কিন্তু আমার আর এ জায়গাটা ভাল লাগছে না। সোহাগকে নিয়েও প্রবলেম হচ্ছে।

ঠিক আছে।

আমি গোছগাছ করছি কিন্তু।

 করো।

মোনা চলে যাওয়ার পর রোদে ভরা বিছানাটায় চুপ করে বসে রইল অমল। না, গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় যেতে হচ্ছে বলে তার কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। ম্যান্তামারা অমলের এখন আর তেমন কোনও পছন্দ-অপছন্দ নেই। সবই সমান বলে মনে হয়।

জানালা দিয়ে রোদ আসছে, ঠান্ডা হাড়কাঁপানো হাওয়াও আসছে। শরীর কেঁপে যাচ্ছে শীতে। তবু গায়ে কোনও চাপা দিল না সে। জানালা দিয়ে বাবার ঘরের পিছন দিককার বাগানটার দিকে চেয়ে রইল সে। বাগানে হলুদের বন্যা বইছে, গাঁদা ফুল ফুটে আছে মেলা। একটা বারোমেসে শিউলি গাছও রয়েছে বেড়ার কাছ ঘেঁষে। শরতে গাছ ভরে ফুল ফুটত, অন্য সময়ে কম হলেও সারা বছরই দু-চারটে করে ফুল হত। পুরনো গাছটা মরে গেছে। তার বীজ বা কলম করে আবার গাছ বানানো হয়েছে। খুব মন দিয়ে গাছটাকে দেখছিল সে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গাছ, তলায় বিছিয়ে আছে সাদা কার্পেটের মতো।

বাবা!

উঃ! বলে গভীর অন্যমনস্ক চোখ ফেরাল অমল।

মা বলছে আমরা নাকি আজ কলকাতায় যাচ্ছি।

সোহাগকে যেন কতদিন পর দেখল অমল। মেয়েটা যেন একটু রোগা আর লম্বা হয়ে গেছে। রুখু চুল, পরনে একটা ধূসর নাইটি।

হ্যাঁ।

ডিসিশনটা কার?

তোমার মায়ের।

 আমরা কেন যাচ্ছি?

 তা তো জানি না। তোমার মা যেতে চাইছেন।

সেখানে তো আমাদের এখন কোনও কাজ নেই। তোমারও তো ছুটি।

হ্যাঁ।

তাহলে?

তুই কি এখানে থাকতে চাস?

আমার তো এখানটাই ভাল লাগছে।

 ওঃ। তাহলে সেটা তোর মাকে বলে দেখ।

 মা খুব অ্যাডামেন্ট।

অমল জলে-পড়া মুখ করে অসহায়ের মতো বলে, তাহলে?

আমি তাহলে এখানে একাই থাকব। পারমিশন দেবে?

খুব অবাক হয়ে যেন পারমিশন কথাটা জীবনে এই প্রথম শুনছে– এমন মুখ করে অমল বলে, পারমিশন!

হ্যাঁ। তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি আরও কয়েকদিন এখানে থাকতে চাই।

ও! তাতে অসুবিধে কী?

তা তো বুঝতে পারছি না। মা আমাকে নিয়ে যেতে চাইছে।

 তাহলে?

তুমি মাকে বলো।

মেয়ের মুখের দিকে খুব নিবিষ্টভাবে চেয়ে থেকে অমল বলে, তোর কি এ-জায়গাটা ভাল লাগছে?

হ্যাঁ। খুব ভাল লাগছে।

 তোর মা বলছিল তোর নাকি কীসব প্রবলেম হচ্ছে এখানে।

 কোনও প্রবলেম হচ্ছে না তো!

হচ্ছে না?

না।

অ্যান্টিসোশ্যাল ছেলেরা কি ডিস্টার্ব করছিল?

হ্যাঁ। কিন্তু তারা এখন আমার বন্ধু হয়ে গেছে।

বন্ধু?

হ্যাঁ। দাদু, পিসি, জেঠিমা সকলের সঙ্গেই আমার বেশ ভাব। আমার কোনও প্রবলেম হচ্ছে না।

ও। বলে অমল ফের অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে। ঘটনার লাগাম তার হাতে নেই। সোহাগ কি তা জানে না? তবু শিখণ্ডীর মতোই তাকে ব্যবহার করতে চাইছে।

তুমি, মা, বুডঢা তোমরা চলে যাও। আমি এখানে বেশ থাকতে পারব কয়েক দিন।

একা থাকবি?

একা! একা কোথায়! বাড়ি ভর্তি এত লোক!

 হ্যাঁ, তা তো ঠিকই। কিন্তু ওদের সঙ্গে তো আমাদের ঠিক অ্যাডজাস্টমেন্ট ছিল না।

 মার সঙ্গে এখনও নেই। কিন্তু আমার সঙ্গে হয়ে গেছে।

সামান্য কৌতূহল বোধ করে অমল প্রশ্ন করে, তুই কি সকলের সঙ্গে কথা বলিস?

কেন বলব না?

ঘরে-টরে যাস!

হ্যাঁ তো। সকলের ঘরে যাই। কত গল্প হয়।

অমল অবাক হয়ে বলে, খুব আশ্চর্যের কথা।

কেন, অবাক হওয়ার কী আছে?

না, আমি ভেবেছিলাম আমার লোকজনের সঙ্গে চলতে তোদের খুব অসুবিধে হবে।

আমার অসুবিধে হচ্ছে না। তুমি মাকে একটু বুঝিয়ে বলবে?

বলব। তবে হয়তো আমার কথাটার গুরুত্ব হবে না। আমি কাউকে কিছু বুঝিয়ে বলতে পারি না। কেউ বুঝতে চায়ও না।

মা যদি ফোর্স করে তাহলে কিন্তু আমিও ফোর্স করব।

ঝগড়া করবি?

যদি করতে হয়, করব।

অমল একটু তটস্থ হল। ঝগড়া তার পরিবারে মাঝে মাঝে হয়, তবে বেশি দূর গড়ায় না। ঝগড়ার চেয়েও ভয়াবহ হল শীতল নীরবতা! দিনের পর দিন কেউ কারও সঙ্গে কথা কয় না। খুব সামান্য প্রয়োজনীয় দু-একটা কথা বলেই ঝাঁপ ফেলে দিয়ে যে যার নিজের মনের মধ্যে ঢুকে যায়। কোনও আবেগ, উচ্ছলতা নেই তাদের। অবসরে বসে কথাবার্তা কয়ে সময়যাপনও করে না তারা।

একটা শ্বাস ফেলে অমল বলল, দেখা যাক।

মা কেন চলে যেতে চাইছে জানো?

কেন?

আজ পারুল মার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়