চক্র – উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

০১.

ওই এল তার ঘুমের সময়। বাতাসে শীতের শিস, তার দীর্ঘ শরীরে ঘুমের রিমঝিম। আর সময় নেই। শরীরে ভরে নিতে হবে যথাসাধ্য রসদ। তারপর মাটির নীচে কবোষ্ণ অন্ধকারে ঢুকে পড়বে সে। ঘুম আর ঘুম। নেমে আসবে ঘুমের ভারী পর্দা। তার মন নেই, বিবেক নেই, সে কে বা কেমন তাও জানা নেই। তার আছে কেবল শরীর। আছে সন্ধানী চোখ, বিদ্যুতের মতো গতি, আর ক্ষুধা, আর ভয়।

নবীন ভটচাযের লাকড়িঘরের পিছনে শ্যাওলা ধরা একটা ইটের খাঁজে ব্যাঙটাকে পেয়ে গেল সে। বিশাল হলদেটে ব্যাঙ। তাকে দেখে ব্যাঙটা প্রাণভয়ে একটা লাফও দিয়েছিল। দ্বিতীয় লাফটা দেওয়ার মুখে প্রায় শূন্য থেকে তাকে সে লুফে নিল মুখে। খাদ্যগ্রহণ তার কাছে সুখপ্রদ নয়। তার জিহ্বা আস্বাদহীন। কম্পিউটারে ভরে দেওয়া তথ্যের মতোই সে শুধু জানে কোনটা খাদ্য, আর কোনটা নয়। আর খাদ্যগ্রহণও কি কম কষ্টের? ধীরে, অতি ধীরে বিশাল গরাসটাকে গিলতে হয় তার। চোয়াল ছিঁড়ে যেতে চায়, গলা আটকে আসে, বঁড়শির মতো দাঁতে আটকানো ব্যাঙটা বারবার ঝটকা মারে আর কাঁপে আর কঁ-অঁ-ক, কঁ-অঁ-ক করে প্রাণভয়ে অন্তিম আর্তনাদ করতে থাকে। আস্তে আস্তে তিল তিল করে তাকে আত্মসাৎ করতে হয় জীয়ন্ত গরাস। বড় কষ্ট তার। ঘুমিয়ে পড়ার আগে খেয়ে নিতে হবে আরও খাবার। আরও কষ্ট, আরও অধ্যবসায়।

অনেকক্ষণ সময় লাগল তার। আতাগাছের চিকড়ি-মিকড়ি ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে রোদের বল্লম এসে বেঁধে তার চোখে। বাতাসে শীতের নির্ভুল সংকেত, হাওয়া ঘুরছে, ঘুরে যাচ্ছে উত্তরে। সূর্য হেলে যাচ্ছে দক্ষিণে। তার শরীরে সব খবর পৌঁছে যায়।

শত্রুর অভাব নেই তার। ছোট্ট বিচরণভূমি ভরে আছে প্রতিপক্ষে। তাই ঘাসে, ঝোপে, মাটির খাঁজে, গর্তে কেবলই আত্মগোপন করে থাকা। অন্তরালই একমাত্র বাঁচিয়ে রাখে তাকে।

গলার কাছ বরাবর শ্বাসরুদ্ধ করে আটকে আছে ব্যাঙটা। প্রবল পরিশ্রমে শরীর নিথর। মাটিতে সামান্য কম্পন, চোখে একটা ছায়া পড়ল, একটু নড়াচড়া। সে জানে এখন সে বড় অসহায়। অবসন্ন শরীরে সেই বিদ্যুতের গতি নেই, আক্রমণও নেই। সে ভয় পাচ্ছে। সে একবার প্রতিপক্ষকে দেখে নিল। তারপর শরীরের ভার টানতে শুরু করল। প্রতি মুহূর্তেই তাকে আত্মগোপন করতে হয়।

তার দীর্ঘশ্বাসে বাতাস কেঁপে উঠল। পিঙ্গল শরীরটাকে বইয়ে দিল সে। কিন্তু বড় কষ্ট। শরীর জুড়ে যেন ব্যথার মৃদঙ্গ বেজে যাচ্ছে।

.

পেচ্ছাপের বেগটা ছেড়ে দিয়েই ধীরেন কাষ্ঠ বুঝতে পারল কাজটা ঠিক হয়নি। উঁচু ঢিবিমতো জায়গা দেখে বসে পড়েছিল, চারদিকটা খেয়াল করেনি। ব্যাঙটার প্রাণঘাতী আর্তনাদ শুনে তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। দু চোখেই ছানি বলে নজর ঘষাকাচের মতো। সামনে শুকনো পাতার ডাঁই, গাছের ছায়া। প্রথমে নজরে পড়ল না। ঠাহর করে দেখতে পেল, হাত দেড়েক দূরে পাকা গোখরোটা ব্যাঙটাকে ধরেছে আর তার পেচ্ছাপের ধারাটি ছড়ছড় শব্দ তুলে তেড়েফুড়ে ওই দিকেই যাচ্ছে। অতি বিপজ্জনক পরিস্থিতি। চমকে গেলে পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ধীরেন কাষ্ঠর কপালটাই খারাপ। বয়সকালে এখন পেচ্ছাপ পেলে বেগ চেপে রাখতে পারে না। শরীরের যন্ত্রপাতি ক্রমেই কেলিয়ে পড়ছে। পেচ্ছাপ তার নিজের মনেই হয়ে যাচ্ছে, ধীরেনের সাধ্যই নেই এখন বন্ধ করে। তা হলে কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে যাবে। পারবে না জেনেও একটা চেষ্টা করল ধীরেন, মুখ ফসকে একটা কোঁতানির শব্দও বেরোল। কিন্তু আটকানো গেল না। খাওয়ার সময় সাপটা বিরক্ত হচ্ছে। যদি রেগেমেগে তেড়ে আসে তাহলেই হয়ে গেল। না, কাজটা ঠিক হচ্ছে না, ঠিক হচ্ছে না। আজকাল তার এইসব ছোটখাটো কাজে বড় মাপের সময় লাগে। বয়সকালে লাগত না। অসহায় ধীরেন কাষ্ঠ তাই তার বিশ্বাঘাতক পেচ্ছাপের ধারাটাকে নজরে রাখছিল। হ্যাঁ, ওই আঁকাবাঁকা হয়ে ব্যাটা ঠিক গিয়ে সাপটার পেটের তলায় ঢুকে পড়ল। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল ধীরেন। শরীরটা শক্ত হয়ে এল আতঙ্কে। ভরসার কথা এই, মুখে ব্যাঙটা ধরে থাকায় চট করে ছোবল দিতে পারবে না। তবে সাপকে বিশ্বাসই বা কী?

ঠিক এই সময়ে সাপটা ফসস করে একটা বিচ্ছিরি শব্দ করায় ধীরেন বা প রে বলে চেঁচিয়ে উঠে পড়ল। পেচ্ছাপ তখনও হয়ে যাচ্ছে।

ধীরেনের চাপা চিৎকার শুনতে পেল পান্না। ডান হাতের দুটো আঙুল–মধ্যমা আর তর্জনী চোখের সামনে তুলে ধরে সে তখন লটারি করছে–গলায় দড়ি না গায়ে আগুন? গায়ে আগুন না গলায় দড়ি? কদিন হল তার এই চলছে। মনটাকে স্থির করতে পারছে না। তবে করবে সে ঠিকই। কিন্তু কোনটা বাছবে তা ঠিক করতে দেয়ালঘড়ির দোলকটার মতো দোল খাচ্ছে। কখনও মনে হয় গায়ে আগুন, কখনও মনে হয় গলায় দড়ি। উনিশের ভরা যুবতী সে, এই বয়সেই তো মরতে সাধ হয় সবচেয়ে বেশি। মনে একটু টুসকি লাগলেই মনে হয়, মরি। আকাশে রাঙা চাঁদ উঠলে কি একটু ভালবাসা না পেলে, কি শীতের দুপুরে মন হু হু করলেই হল, মরণ মুচকি হেসে শ্যামের বাঁশি বাজাতে থাকে।

সে মরলে কী কী হবে ভাবতেই আনন্দে গায়ে কাঁটা দেয় তার। লুটোপুটি খেয়ে কাঁদবে মা, ও পান্না, ফিরে আয়। বেশ হবে। যত অবিচার করেছে মা তা শোধ হবে চোখের জলে। আর কখনও বলবে না, গতরখাকী মর না। আর বাবা? বাবা এমন স্তম্ভিত হয়ে যাবে যে কাঁদতেও পারবে না। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকবে দাওয়ায় আর অবিশ্বাসভরে মাথা নাড়বে, এ হয় না, এ হয় না। আর হীরা, হীরার কথা কিছু বলা যায় না। হিংসুটিটা কে জানে বাবা খুশিও হতে পারে। আবার হয়তো দিদির শোকে লুটোপুটি খেয়ে কাঁদতেও পারে। মনে হয় কাঁদবেই। কাঁদলে খুব কাঁদবে। আর সে? সে কী করবে তা জানে না পান্না। তবে খুব বিষণ্ণ আর আনমনা হয়ে যাবে। হু-হু করবে বুক, চোখ ভিজে যাবে বারবার। এ কী করলে পান্না, আমাকে একা রেখে গেলে নির্বান্ধব পৃথিবীতে? এই সেটা যে কে তা আজও জানে না পান্না। সে-র সঙ্গে তার চেনাই হয়নি। সে যে কেমন তাও ঠিক করে ভাবেনি সে। আবছা আবছা একটা মুখ কল্পনা করে নেয়। আবার মুখটা কেমন বদলেও যায়।

মরার কথা ভাবতে ভাবতে দুপুরের নিরালা যখন একরকম সুখে ভরে উঠছিল তখনই চিৎকারটা শুনতে পেল সে। বুড়ো মানুষের গলায় বাপ রে! শোওয়া অবস্থাতেই শরীরটা গড়িয়ে উপুড় হয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সে দেখতে পায়, ধীরেন কাষ্ঠ দাঁড়িয়ে। হাতে ধরা ধুতির খুঁট, ছড়ছড় করে ধুতি ভিজিয়ে পেচ্ছাপ পড়ে যাচ্ছে পায়ের লালচে রঙের ক্যাম্বিসের জুতোর ওপর। এঃ মা!

লজ্জায় মুখটা সরিয়ে নিয়ে পান্না বলে, কী হয়েছে জ্যাঠামশাই?

সাপ।

 কামড়েছে নাকি?

না, আর একটু হলেই কামড়াত।

কোথায় সাপটা?

 ধীরেন কাষ্ঠ হাত তুলে লাকড়িঘরের দিকে দেখিয়ে বলল, ওইখানে।

.

ঘোষবাড়ির সুপুরিগাছের ডগায় উঠে মরণ নানা দৃশ্য দেখছিল। আফ্রিকার ম্যাপের মতো দেখতে একটা বড় মেঘ একটা শ্রীলংকার মতো ছোট মেঘকে আস্তে আস্তে গিলে ফেলল আর তারপর দুটিতে মিলে হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। আর দেখল, নয়নদের বাড়ির উঠোনে শীতের লেপকাঁথা বের করে চাটাই পেতে রোদে দেওয়া হয়েছে। আর চাটুজ্যেবাড়ির গৌরহরিদাদুর শ্রাদ্ধের সাদা ম্যারাপ ফুলে ফুলে উঠছে হাওয়ায়। আর সন্ধ্যাদির বাড়ির দোতলার গ্রিল দেওয়া বারান্দায় আজও সেই ফুটফুটে মেয়েটা উদাসভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আর সন্ধ্যাদির উদুখলের ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ শব্দটা পৃথিবীর হৃৎপিণ্ডের শব্দের মতো উঠে আসছে। গাছের ঘষটানিতে বুকের নুনছাল উঠে গিয়ে জ্বালা করছে। ঘোষ জ্যাঠাইমা তাড়া দিচ্ছে, ও মরণ, তোর হল? তাড়াতাড়ি কর বাবা। সুপুরিগুলো গোছ করে রেখে শ্রাদ্ধবাড়িতে যাব যে!

মাঝে মাঝে এত আনমনা হয়ে যায় বলেই তার বিপদ। একবার আমগাছ থেকে পড়ে বাঁ হাত ভেঙেছিল তার। তবু ওই আনমনা হওয়া তাকে ছাড়ে না। পেকে ওঠা সুপুরির গোছ মাত্র দুটো কেটে ফেলেছে, তারপর কেমন সব ভুলে বিস্ময় ভরা চোখে দেখছে তো দেখছেই। আর নানা কথার ভুড়ভুড়ি উঠছে মনের মধ্যে।

হঠাৎ সাপে ধরা ব্যাঙের ডাকটা কানে এল তার। কী করুণ আতাঁরব! কঁ-অক, কঁ-অ-ক। হাতের দা-টা ঠাঙাৎ করে নীচে ফেলে দিল সে। দু পায়ে দড়ির ফাঁস ছিল, নাড়া দিয়ে সেটাও ফেলে দিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে লাগল সে।

ও মরণ, নামছিস যে! পাড়বি না?

দাঁড়ান জ্যাঠাইমা, আগে সাপটাকে মারি।

 সাপ মারবি কী রে? কোথায় সাপ?

আছে।

সে জানে মানুষ বিপদে পড়লে যে বিপদসংকেত পাঠায় তাকে বলে এস ও এস। সেভ আওয়ার সোল। আমাদের প্রাণরক্ষা করো। ব্যাঙটাও সেই বার্তা পাঠাচ্ছে চারদিকে। জলে জঙ্গলে, ঘাটে আঘাটায় এমনই সব তুচ্ছ নানা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, মানুষ টেরই পায় না। কিন্তু ব্যাঙটা কার কাছে পাঠায় ওই বিপদসংকেত? ওর কি ভগবান আছে? নাকি আছে কোনও কমিউনিটি? অন্য ব্যাঙেরা কি এসে বাঁচাবে ওকে কখনও? তবে ও কাকে ডাকে? মরণ জানে সাপের মুখ থেকে ব্যাঙটাকে ছাড়িয়ে নিলেও বাঁচবে না। কিন্তু সাপটাকে যে তার মারতেই হবে।

শেফালী বউদি বলে, তুই কেমনধারা ছেলে রে? প্রজাপতির পাখা ছিঁড়ে দিস, চড়াইপাখির বাসা ভাঙিস, ফড়িং-এর পায়ে সুতো বেঁধে ওড়াস, সাপ মারিস! এমন পাষাণ কেন রে তুই?

সে ভাল ছেলে নয়, সে জানে।

গাছ থেকে নেমে দুটো ইটের ঢেলা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটছিল মরণ। ভটচাযবাড়ির লাকড়িঘরের সামনে ধীরেন জ্যাঠার মুখোমুখি।

ধীরেন কাষ্ঠ বলল, দেখ বাবা কী কাণ্ড। শ্রাদ্ধবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি, পথে এই বিপত্তি।

এঃ জ্যাঠামশাই, আপনি যে পেচ্ছাপ করে ফেলেছেন।

বুড়ো বয়সে কিছুই কি আর বশে থাকে রে বাবা। আর সাপটাও এমন ফোঁস করে উঠল যে, পালাতে গিয়ে কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে গেল। দিবি বাবা একটু টিউবওয়েলটা পাম্প করে? এখানেই একটু ধুয়ে টুয়ে নিই। গায়ে গায়ে শুকিয়ে যাবে। কাপড় পালটাতে হলে আবার মাইলটাক হেঁটে যাওয়া। যা খাড়া রোদ।

আসুন জ্যাঠামশাই, পাম্প করে দিচ্ছি।

রাস্তার কলে ধুতিটা ধুতে ধুতে ধীরেন কাষ্ঠ বলছিল, আজকাল আর কেউ ডাকখোঁজ করেও না তেমন। গৌরহরিদার পরিবার তবু তো ডেকেছে।

সাপটা এ যাত্রায় বেঁচে গেল। বিশাল গরাসটা কণ্ঠায় আটকে আছে তার। ধীরে সে একটা পরিত্যক্ত জমি আর ভাঙা বাড়ি পার হল। তারপর বেগুনক্ষেত। বাঁশের বেড়া। আগাছার জঙ্গল। ধীরে ধীরে পিছল গতিতে পার হয়ে যাচ্ছে সে। তার শীতল রক্তে শীতের পদধ্বনি। আর সময় নেই।

.

ঝিরঝিরে চঞ্চল নিমের ছায়ায় বসে একমনে সর্ষে গুঁড়ো করছে সন্ধ্যা। মস্ত এলো খোঁপা ভেঙে পড়েছে পিঠে। দামাল বাতাসের দিন আজ। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে শুকনো পাতা আর উড়ছে তার চুল।

উদুখলের ডান্ডাটা রেখে যখন খোঁপা ফের বেঁধে নিচ্ছিল সন্ধ্যা তখন সাপটাকে দেখতে পেল। ঘন জঙ্গল থেকে উঠে উঠোনের কানা দিয়ে দীর্ঘ শরীরটা খুব আস্তে টেনে নিয়ে খড়ের মাচানের নীচে তার অন্ধকার জগতে ঢুকে যাচ্ছে। গলার কাছটায় একটা ঢিবি। ব্যাঙ বা ইঁদুর গিলে এসেছে এইমাত্র।

মাই গড! ইটস এ বিগ কোবরা!

সন্ধ্যা মুখ তুলে বুডঢাকে দেখল।

 বুডঢা বলল, দেখতে পাওনি? জাস্ট বিলো দি হে স্ট্যাক।

দেখব না কেন? চোখের সামনে দিয়েই তো গেল।

লাঠি-ফাঠি কিছু নেই বাড়িতে?

থাকবে না কেন? লাঠি দিয়ে কী করবে?

 বাঃ, মারতে হবে না সাপটাকে?

ওটা বাস্তুসাপ মারতে নেই।

হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বাস্তুসাপ? এ স্নেক ইজ এ স্নেক। ইট মে বাইট এনিবডি এনিটাইম।

খুব ক্ষতি না করলে কামড়ায় না। তিনটে আছে, আজ অবধি কাউকে কামড়ায়নি।

গড! ও মাই গড! ক্যান এ স্নেক বি ওয়ান অফ দি ফ্যামিলি!

কদিন যাবৎ ইংরিজিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যা। মায়ে মেয়েতে ছেলেতে মিলে দিনরাত ইংরিজিতে কথা কইছে, তার এক বর্ণও সন্ধ্যা বোঝে না। তবে এটা বুঝতে পারে, ওরা তিনজনে মিলে এবাড়ির লোকেদের নিয়ে ঠাট্টাইয়ার্কি করে। ভাল কথা যে বলে না তা মুচকি হাসি, বাঁকা চাউনি আর ঠোঁট ওলটানো দেখে টের পাওয়া যায়। বড্ড অপমান লাগে, কান-টান ঝাঁ ঝাঁ করে। কিন্তু কিছু করারও তো নেই।

বুডঢা ওপর দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলে, ডিড ইউ সি ইট দিদি? এ বিগ কোবরা।

ইয়াঃ, আই স ইট। মে বি এ ক্রাইট।

নো, ইট ওয়াজ এ কোবরা। দিস ফুলিশ উওম্যান সেজ ইটস এ রেসিডেনশিয়াল স্নেক। এ মহাত্মা। ডাজ নট বাইট।

শি ইজ এ মোরোন।

সন্ধ্যা বুঝতে পারছে, তাকে নিয়ে কথা কইছে ওরা। খারাপ কথা। সে ভারী ডান্ডাটা তুলে নিল। শক্ত চোয়ালে অপমানটা গিলে ফেলতে চেষ্টা করল। আর সব আক্রোশ নিয়ে দুম দুম করে গুঁড়ো করতে লাগল সর্ষে। ঝাঁঝ আসছে নাকে, সর্ষের গুঁড়া ছিটকে যাচ্ছে চারদিকে। ঠোঁট নড়ছে সন্ধ্যার, কী কেলেঙ্কারি করে এসেছ তোমরা সে কি আর জানি না! পাঁচকান তো করতে পারি না। হাটে হাঁড়ি ভাঙলে টের পেতে বাপু। দিনরাত মায়ে মেয়েতে যে ইংরিজিতে ঝগড়া করছ সে কি এমনি এমনি? আমরা কথাগুলো বুঝতে না পারি, ঝগড়া যে হচ্ছে তা তো বুঝতে বাকি নেই। ছিটেফোঁটা বুদ্ধি আমাদেরও আছে বাপু। কলকাতা ছেড়ে গাঁয়ের বাড়িতে এসে ঘাপটি মেরে আছ সে তো সোহাগ করতে নয়, গা-ঢাকা দিতে। সোহাগ-সুন্দরী, তোমার মুখখানা সুন্দর হলে কী হবে, মনে বিষ।

সোহাগ ওপর থেকে অনুচ্চ স্বরে বলল, শি হেটস মি।

বুডঢা নীচে থেকে বলল, শি হেটস মি টু। অ্যান্ড আই লাইক দ্যাট।

সর্ষে গুঁড়ো করতে করতে সন্ধ্যা বিড়বিড় করতে থাকে, কেমন ইংরিজি বলিস তোরা জানি। বাবা তো কালকেই বলছিল, ওরা যতই ফটাফট ইংরিজি বলুক না কেন, গ্রামারে ভুল আছে। নিমাই মাস্টারের ছেলে অঞ্জনকে নিয়ে এসে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে তো চুপসে যাবি তোরা। ইংরিজিতে সে আশি নব্বই নম্বর পায়…

অনেকক্ষণ ধরেই সোহাগ সাপটাকে দেখছিল। বাঁ ধারে জঙ্গুলে মাঠটার মাঝখানে একটা ছাগল বাঁধা। সেটাই কেমন যেন হঠাৎ ম্যা ম্যা করে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিল। সোহাগের আজকাল কোনও কৌতূহল নেই। কোনও ব্যাপারেই নেই। সে উদাসভাবেই চেয়ে দেখছিল। ঘাস খেতে খেতে শান্ত ছাগলটা হঠাৎ ভয় পেল কেন? ছুটতে গিয়ে পায়ে দড়ি জড়িয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, ডাকতে লাগল। তখনই লম্বা শরীরটা ধীরে আঁকাবাঁকা হয়ে চলে আসছে। ছাগলটার কাছ ঘেঁষেই এল। তারপর তকতকে উঠোনের কোণ দিয়ে ধীরে ধীরে খড়ের মাচানের নীচে চলে যেতে লাগল। সোহাগ উদাস চোখে সাপটাকে দেখল শুধু। সাপ দেখলে কেউ ভয় পায়, কারও গা ঘিনঘিন করে। তারও ওরকম হয়। এখন হল না। ধীরে ধীরে সে ভেজিটেবল হয়ে যাবে। সে জানে।

সোহাগ, ভিতরে এসো। তোমার খাবার দেওয়া হয়েছে।

মা ডাকছে। সোহাগ উদাস মুখটা ফিরিয়ে বলল, এখন খাব না। খিদে নেই।

তুমি তো চাওমিন খেতে চাইলে। তাই করা হয়েছে।

রেখে দাও। পরে খাব।

পরে গরম করবে কে? এখানে তো মাইক্রোওয়েভ নেই। নুডলস জোগাড় করতেই কমলদাকে বর্ধমান যেতে হয়েছিল। এখানে এসব ফ্যান্সি ফুড অ্যারেঞ্জ করা মুশকিল।

গরম করতে হবে না। ঠান্ডাই খাব।

 এসব ভাল হচ্ছে না সোহাগ। তুমি কোনও রুটিন ফলো করছ না।

আই হ্যাভ নো অ্যাপেটাইট। প্লিজ।

তার মানে ইউ উইল স্কিপ দি লাঞ্চ। ব্রেকফাস্টে মোটে একটা বয়েলড ডিম খেয়েছ। এখন বেলা বারোটা বেজে গেছে।

বেলা বারোটা ইজ নট টু লেট।

 রাগ করে না খেয়ে থাকাটা প্রিমিটিভনেস। ইট উইল নট হেলপ।

না খেয়ে থাকব কেন? খাচ্ছি তো।

 মোটেই খাচ্ছ না। ইউ আর লুজিং ওয়েট। তোমার স্কিন ড্রাই হয়ে যাচ্ছে।

আমি বেশ ভাল আছি। ডোন্ট বদার।

আজ তোমার বাবা আসছেন। তাকে সব বলব।

বোলো। হি ইজ নট এ মেসায়া।

 তিনি তোমার বাবা।

সো হোয়াট?

ডোন্ট ডিগ সোহাগ। ডিগিং উইল নট হেলপ। বলছি খেয়ে নাও।

 খাব না বলিনি তো। পরে খাব।

ইউ আর ইমপসিবল।

ও কথা কেন বলছ? আই অ্যাম ডুয়িং হোয়াট এভার আই অ্যাম টোল্ড টু ডু। যদি হুকুম করো তা হলে ছাদে উঠে নীচে লাফিয়েও পড়তে পারি। কিন্তু খিদে না থাকলে কিছুতেই খাওয়া যায় না।

খিদে নেই তো সবসময়েই বলছ। এক্সারসাইজ করছ না, মেডিটেশন করছ না, শুধু ঘরে বসে আছ, খিদে না পাওয়ার তো দোষ নেই।

আমার ওসব ভাল লাগছে না।

 এই যে বললে ইউ আর ডুয়িং হোয়াটএভার ইউ আর টোল্ড টু ডু?

 তুমি কি আমাকে এক্সারসাইজ করতে বলছ?

বলছি। শরীরের জন্য করতে দোষ কী?

আমার ইচ্ছে করে না। মানুষ তো শুধু শরীর নয়।

অন্তত ইউ মে টেক এ ওয়াক।

আমার ভাল লাগে না। লোকেরা তাকায়।

সে তো কলকাতাতেও তাকায়। তাকায় না?

এমন হাঁ করে তাকায় না। আমার হাঁটতে ভাল লাগে না।

সোহাগ, আর ইউ ট্রায়িং টু কিল ইওরসেলফ?

 আমার এত কথা বলতে ভাল লাগছে না মা, আমি নীচে যাচ্ছি।

.

পারুল আজ সকাল থেকে পথ চেয়ে আছে। এক বুক তেষ্টা কেন তার আজও? না, এ বোধহয় তেষ্টা নয়, আকাঙ্ক্ষা নয়, এ এক গভীর কৌতূহল। বাঁধা পড়ে গেছে কবেই পারুল। এখন সংসারে জেবড়ে আছে। আর অমলদাও তো কী ভীষণ ব্যস্ত মানুষ।

পারুল চ্যাটার্জি আর অমল রায়ের গভীর প্রেমের ঘটনা মোটেই চাপা থাকেনি। বিশ বাইশ বছর আগে এই ঘটনায় সারা গাঁ তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। পথেঘাটে মজলিশে আলোচনা হত। বিয়েতেও কোনও বাধা ছিল না। সবর্ণ, পালটি ঘর। কিন্তু ঘটনা সবসময়ে সোজা পথে ঘটতে চায় না।

অমল রায় মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল। এই গাঁয়ের মুষ্টিমেয় কৃতী ছেলেদের মধ্যে সে একজন। হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ। মাধ্যমিকের পরও দুরন্ত অমল অনেক বেড়া টপকাল। যা চায় তাই পায় অবস্থা। পারুলকেও পেয়ে গিয়েছিল অনায়াসে। প্রায় কৈশোরকাল থেকে।

ঘটনাটা ঘটেছিল যে সময়ে সে সময়ে আই আই টি-র শেষ পরীক্ষা দিয়ে অমল গাঁয়ে ফিরেছে। দুজনের দেখাসাক্ষাৎ ছিল পরস্পরের বাড়িতে। যাতায়াতের তেমন কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু সেই সময়ে অমলের চোখেমুখে একটা ঘোর পরিবর্তন দেখতে পায় পারুল। কেমন খিদে ফুটে থাকে মুখে, চোখের দৃষ্টি সরু হয়ে আসে। কামুক পুরুষের দৃষ্টি চিনতে মেয়েদের কোনও অভিজ্ঞতার দরকার হয় না। তারা ও ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়। পারুল নির্ভুল বুঝতে পেরেছিল, অমল যে কোনও দিন তাকে চাইবে। আর তখনই একটু ভয় হয়েছিল তার।

একদিন এক প্রচণ্ড গরমের দুপুরে অমল উদভ্রান্তের মতো এসে হাজির। পারুল তার দোতলার পড়ার ঘরে নিরিবিলি বসে পরীক্ষার পড়া করছিল। অমলের চেহারা দেখে সে শিউরে উঠেছিল। মাথায় বড় বড় চুল উড়ছে, মুখখানা রোদে পুড়ে লাল, আর দুখানা চোখে ধক ধক করছে এমন একটা দৃষ্টি যা বুঝতে কোনও মানে-বইয়ের দরকার হয় না।

অমলদা, কী হয়েছে?

অমল হাঁফাচ্ছিল। এত জোরে হেঁটে এসেছে, এত উদভ্রান্ত, এতই দেহতাড়িত যে সে আর স্বাভাবিক নেই। চাপা গলায় সে বলল, পারুল আমি আর পারছি না।

পারুল প্রবল আতঙ্কে সিঁটিয়ে গিয়ে বলে, কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।

বুঝতে হবে না, শুধু চুপ করে থেকো।

প্রবল এক পুরুষ শরীর, সেই শরীরের ঘাম, উত্তাপ, আবেগ, আশ্লেষ আচমকা আক্রমণ করেছিল তাকে। সে শুধু চাপা চিৎকার করেছিল, না না না না

দরজাটা বন্ধ করতেও ভুলে গিয়েছিল অমল। তখন সে উন্মাদ, কাণ্ডজ্ঞানহীন। কাম ছাড়া তখন আর তার কোনও অনুভূতিই কাজ করছে না।

সে এক তুমুল লড়াই হয়েছিল দুজনের মধ্যে। আক্রমণ আর প্রতিরোধ। আর তার ভিতর থেকেই পারুলের মনে জন্ম নিচ্ছিল ঘৃণা।

বিধ্বস্ত পারুলকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল অমল। অনুতাপ হয়েছিল পরে।

পারুল তবু ক্ষমা করে দিতে পারত অমলকে। নিশ্চয়ই পারত। ভালবাসলে ওটুকু পারাই যায়। জোর একটা ধাক্কা খেয়ে হয়তো মানুষটা সম্পর্কে তার ধারণা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন তার সতেরো বছর বয়স, ও বয়সের আবেগ অনেক কিছুকে উপেক্ষা করতে পারে। তার ওপর সেই দুপুরের দুর্ঘটনায় সে যদি মা হয়ে পড়ত তাহলে অমলকে ক্ষমা করা ছাড়া তার উপায়ও থাকত না।

পরদিন সকালে শান্ত ভদ্র অমল লাজুক মুখে এসে হাজির।

 ইস। কাল কী কাণ্ডই না করে ফেললাম পারুল।

পারুল সারা রাত কেঁদেছিল, ঘুমোয়নি, রাতে খায়ওনি। শরীর ভীষণ খারাপ লাগছিল সকালে। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, কেন করলে এরকম? বিয়ের আগে কেউ ওসব করে? ছিঃ ছিঃ, এখন কী যে হবে।

ভয় পেও না।

ভয় পাব না? তুমি পুরুষমানুষ বলে কত সহজে কথাটা বলে ফেললে। মেয়ে হলে পারতে না। সব দায় তো মেয়েদেরই বইতে হয়। তাদের নামেই নিন্দে হয়, তাদেরই জীবনভর কলঙ্ক থেকে যায়। বাচ্চা নষ্ট করতে গিয়ে তারাই তো মরে।

ওভাবে ভাবছ কেন? প্রেগন্যান্সির লক্ষণ দেখলে বোলো, বিয়ের ব্যবস্থা করব।

সেটাই বুঝি খুব সহজ সমাধান? সবাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। প্রেগন্যান্সি হলে বাড়ির সবাই টের পাবে। ফিসফাস হবে, লোক জানাজানি হবে। অমলদা, তুমি আমার খুব ক্ষতি করলে। তোমার কথা ভাবলেই আমার ভিতরে একটা আলো জ্বলে উঠত। সেই আলোটা নিবে গেছে। আর জ্বলবে না।

কী করব পারুল, তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব? 

না, ক্ষমা চাইবে কেন? ক্ষমা চাইতে হয় কেন তোমাকে? একটু ধৈর্য ধরে রাখতে পারলে না কেন?

অপরাধী মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল অমল। তারপর বলল, আমি মাঝে মাঝে বড্ড বেসামাল হয়ে পড়ি। কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে সামলাতে। পারিনি। এমন পাগল হয়ে যাই তখন যে মাথায় খুন চেপে যায়। এ ব্যাপারে আমি এত হেলপলেস। ভাবছি ডাক্তার দেখাব। এ বোধহয় কোনও ডিজিজ।

তুমি যদি আমাকে ভালই বাসো তা হলে রেপ করো কী করে? এরকম কি কেউ করে?

যা হয়েছে হয়েই তো গেছে। কিছুতেই তো আর সেটাকে মুছে ফেলা যাবে না। বরং পজিটিভ কিছু ভাবি এসো।

না অমলদা, আমার মাথার ঠিক নেই। ভয়ে আতঙ্কে আমি মরে যাচ্ছি। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। এ বাড়িতে এরকম ঘটনা আর কারও ঘটেনি। বিয়ের আগে– এ মা।

অমল মিনমিন করে ফের বলল, আমাদের বিয়ে তো হবেই। তখন তো আর এসব দুশ্চিন্তা থাকবে না।

থাকবে। তোমাকে নিয়ে আমার ভয় থাকবে। তোমার সংযম নেই, তুমি বেহাল হয়ে যাও, মেয়েরা তাদের পুরুষকে ওরকম দেখতে ভালবাসে না।

আমার মনে হয় এটা আমার একটা অসুখ। চিকিৎসা করালে নিশ্চয়ই সেরে যাবে।

এসব কথায় বুকের জ্বালাপোড়া একটুও কমল না পারুলের। তার ভিতরটাই যেন হঠাৎ মরে গেছে। ভালবাসা যেন খোঁটা উপড়ে পালিয়ে গেছে কোথায়। শুধু এক জৈব ভয় তাকে দিনরাত নখে দাঁতে ছিঁড়ে খাচ্ছে। শরীর যে তাদের মধ্যে এমন দেওয়াল তুলে দেবে কে জানত।

কুড়ি দিন দম বন্ধ করা টেনশন। পারুল ঘর থেকে বেরোত না। শুধু কাঁদত, মন খারাপ করে বসে থাকত, সারা রাত ভয়ে তার ঘুম হত না। আর ঠাকুর-দেবতাদের ডাকত। নিজের পেটে হাত রেখে অনুভব করার চেষ্টা করত সেখানে কোনও সম্ভাবনার জন্ম হচ্ছে কিনা। ওই কুড়িটা দিন তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়। দুঃস্বপ্নের মতো। একুশ দিনের দিন রজোদর্শন করে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে আর কুমারী নেই বটে, কিন্তু লোকলজ্জা থেকে বেঁচে গেল এ যাত্রা। বেঁচে গেল তার পরিবারও।

তাদের ঠিকে ঝি হেনার মা একদিন রান্নাঘরে মশলা পিষতে পিষতে পারুলের মায়ের সঙ্গে কথা কইছিল। পারুল সেটা শুনে ফেলে।

ওই ছেলের সঙ্গেই কি বিয়ে দেবে নাকি গো মা?

 হ্যাঁ, সেরকমই তো কথা চলছে। ছেলে তো রত্ন। কপালে আছে কি না দেখি।

 রত্ন কিনা জানি না বাপু, তবে বলে রাখছি ছেলের কিন্তু আলুর দোষ আছে।

 কীসের দোষ?

আলুর দোষ গো। স্বভাব ভাল নয়।

কেন কী করেছে?

 খড়্গপুরে যখন পড়ত রোজ বেশ্যাবাড়ি যেত।

অ্যাঁ!

আমার বর তো আই আই টি-তেই ঠিকাদারের কাছে কাজ করে। সে বলেছে। একটু ভেবেচিন্তে এগিয়ো বাপু।

সেদিন মায়ের ব্লাড প্রেশার বেড়ে শয্যা নেওয়ার জোগাড়। কিন্তু পারুল একটুও অবাক হল না। যে অত অসংযমী তার পক্ষে এটাই তো স্বাভাবিক। সঙ্গে সঙ্গে পারুলের আর একটা ভয় হল। বেশ্যাবাড়ি যখন যায় তখন আবার খারাপ রোগ-টোগ হয়নি তো! সেই রোগ যদি পারুলের শরীরেও ঢুকে থাকে!

এইভাবেই গাঁয়ের উজ্জ্বল যুবকটির প্রতি তার দুরন্ত প্রেমের অবসান ঘটে গেল একদিন। এমনকী আই আই টি-র পরীক্ষায় অমলের ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার খবরেও বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হল না সে।

ওদের বাড়ি আর যেত না পারুল। অমল কিন্তু প্রায়ই আসত। পাসের খবর নিয়েও হাসিমুখে অমল এসেছিল। তখনও পারুলকে বিয়ে করার কথা ভাবছে। বসে বসে অনেক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলছিল সেদিন।

বিদেশে তো আমাকে যেতেই হবে। ভাবছি তোমার পাসপোর্ট এখনই করিয়ে রাখলে হয়।

কেন?

তোমাকে নিয়েই যেতে চাই।

কেন, ওদেশে কি প্রস কোয়ার্টার নেই?

স্তম্ভিত অমল তার দিকে হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, কী বলছ?

কথাটা বলে লজ্জা পেয়েছিল পারুল। কাউকে সে চট করে অপমান করতে পারে না। মাথা নিচু করে বলল, কিছু না।

কিছুক্ষণ ম্লানমুখে চুপ করে বসে রইল অমল। তারপর দুখানা করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, কে তোমাকে এসব বলেছে জানি না। তুমি কি এসব বিশ্বাস করো?

 বিশ্বাস করব কিনা তা বুঝতে পারছি না। আমার মন ভাল নেই।

 ভাবলাম আমার ভাল রেজাল্টের খবর পেয়ে তুমি খুশি হবে।

 খুশি হইনি কে বলল? তবে নতুন কিছু তো নয়, তুমি বরাবরই ভাল ছেলে।

আবার কিছুক্ষণ মনোকষ্টে বসে থেকে ম্লান মুখে অমল বলল, তুমি আমার ভাবী স্ত্রী। ব্যাপারটা তুমি এভাবে দেখো। ধরো আমি একজন মনোরুগি, আমার রুচি এবং শালীনতাবোধ দিয়েও আমি আমার ভয়ংকর প্যাশনকে ঠেকাতে পারছি না। তুমি যদি সাহায্য কর তো পারব।

তুমি কি স্বীকার করছ তুমি প্রস কোয়ার্টারে যাও?

অনেকেই যায়। অনেক ভাল লোকে, গণ্যমান্য মানুষও যায়।

 তুমি যাও কিনা সেটা নিয়েই আমার দুশ্চিন্তা।

 যাই পারুল। আমাকে নিশিতে পায়। কিন্তু বিয়ের পর এভরিথিং উইল চেঞ্জ।

পারুল মাথা নিচু করে বলল, আমার মন ভাল নেই অমলদা। আমার মাথায় কিছু আসছে না।

আমি তোমাকে বড্ড ভালবাসি যে পারুল। সবসময়ে আমি তোমাকে চিন্তা করি। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা যে আমার পক্ষে অসম্ভব।

তাই তো জানতাম।

তুমি কত নরম-সরম মেয়ে ছিলে, আমাকে দেখলেই তোমার মুখে খুশির ঝাপটা লাগত, কত লজ্জা পেতে আমাকে। এখন তুমি কেমন শক্ত হয়ে গেছ, কেমন মনমরা। ওই একটা শরীরের ঘটনা কি আমার এত বড় অপরাধ? কত ছেলেমেয়েই তো বিয়ের আগে

ওসব বোলা না অমলদা, পায় পড়ি।

আচ্ছা পারুল, বলব না। তবে এটুকু বলে যাই, আজকের দুনিয়ায় ওসব কেউ গায়ে মাখে না। ওটা খুব তুচ্ছ ব্যাপার।

অনেকের কাছে হয়তো তাই।

হতাশায় মাথা নেড়ে বিষণ্ণ অমল বলল, না পারুল, তোমার চোখ বলছে তুমি আমাকে আর চাও না। কিন্তু আমার জীবনটা যে তাহলে বড় একার হয়ে যাবে। তোমাকে ছাড়া যে পারব না আমি। কিছুতেই পারব না। আমাকে কি তাহলে আত্মহত্যা করতে হবে?

ওসব বোলো না অমলদা। আমি এখনও তো তোমাকে কিছু বলিনি। আমাকে ভাবতে দাও। বড় মনে কষ্ট দিয়েছ আমায়। আমাকে এখন ভাবতে হবে।

ভেবে লাভ নেই পারুল। তোমার মনের কথা আমি বুঝতে পেরেছি। একটা ভুল করে ফেলেছি। কী আর করব।

একটু মায়া কি অবশিষ্ট ছিল না পারুলের মনে? ছিল। খুব ছিল। অমল রায় যে তাকে গভীর ভালবাসে তাও সে বোঝে। কিন্তু অমল রায়ের দিকে নিজেকে এগিয়ে দিতে কিছুতেই সে পারছে না। বাধা হচ্ছে।

অমল বোম্বেতে চাকরি পেয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে দেখা করে বলল, যদি ক্ষমা করতে পার তবে করো পারুল। চাকরি পেয়েছি। মাস দুয়েকের ভিতরে বিদেশেও চলে যেতে পারি। আমার খুব ইচ্ছে তোমাকে নিয়ে যাই। আমার কথা একটু নরম মন নিয়ে ভেবো পারুল।

পারুল ডাকের সুন্দরী। সারা তল্লাটে তার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। বিজু বলত, তুই মিস ইন্ডিয়া হতে চাইলে ইজিলি পারবি ছোড়দি। কথাটা মিথ্যেও হয়তো নয়। নানা জায়গা থেকে তার বহু ভাল বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। অমল রায়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর আর বিশেষ প্রস্তাব আসত না।

অমল রায় বোম্বে চলে যাওয়ার পরই একদিন পারুল তার মাকে বলল, তোমরা যদি আমার বিয়ে দিতে চাও তাহলে আর দেরি কোরো না।

মা ভ্রূ তুলে বলল, অমলকে?

না মা, তোমরা পছন্দ করে দেখো।

 মা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, বাঁচালি মা। ও ছেলে সম্পর্কে যা সব কানে আসছে আমার বুকটা কেমন দুরদুর করে। তোর জন্য তো পাত্রের অভাব হবে না।

হয়ওনি। পাত্রের গাদি লেগে গিয়েছিল। সুন্দরী মেয়েদের জন্য যা বরাবরই হয়। বিলেত আমেরিকা বা প্রবাসী বাঙালি সরিয়ে রেখে একজন ভালমানুষ, কর্মঠ, স্বনির্ভর লোককে বেছে নেওয়া হয়েছিল। পারুলের আপত্তি হয়নি। মানুষটি খুব সুপুরুষ নয়, কিন্তু তার চোখে একটা যোগীচক্ষুর ভাব ছিল। কষ্ট করে ওপরে উঠেছে। জামশেদপুরে তার নিজস্ব কারখানা। ছোট যন্ত্রাংশ তৈরি করে। সবচেয়ে বড় কথা, কর্মচারীরা তাকে ভীষণ পছন্দ করে।

বিয়ে হয়ে গেল। কাজটা অমল রায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হল কি না তা ভেবে পেল না পারুল। কিন্তু মনটা মেঘমুক্ত হয়ে গেল, সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এবং লোকটাকে হঠাৎ ভালও বেসে ফেলল। স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ গাঙ্গুলি তাকে স্পোকেন ইংলিশ শেখাল, সেক্রেটারিয়েটশিপ প্রশিক্ষণ নেওয়াল, এবং ঘরে বসিয়ে না রেখে ব্যবসার সঙ্গী করে নিল। কী সাংঘাতিক পরিশ্রমী মানুষটা! আর ভীষণ সৎ। কথার নড়চড় করে না কখনও। রাগ বলে কিছু নেই। একবারও ভালবাসার সাজানো বানানো মিথ্যে কথাগুলো বলেনি তাকে, কিন্তু পরম বিশ্বাসে নির্ভর করেছে পারুলের ওপর। এরকম সংবর্ধনা কটা স্বামী দিতে পারে তার স্ত্রীকে!

পারুল আজ অপেক্ষা করছে অমল রায়ের জন্য। এতদিন পর কেমন লাগবে মানুষটাকে? হয়তো তার জন্য কেঁদেছে লোকটা, মন খারাপ করেছে। কে জানে কী। এই কৌতূহল নিশ্চয়ই ক্ষমার যোগ্য। তারা বদলে গেছে।

গৌরহরি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রাদ্ধে আজ আসবে অমল রায়। মস্ত প্যান্ডেলের নীচে লোক জড়ো হচ্ছে ধীরে ধীরে। বহু লোক আসবে। পারুলের আজ ব্যস্ত থাকার কথা। তবু পারুল এক ফাঁকে আজ এসেছে বাগানে। একা। আজ সেই কিশোরীবেলার পারুলকে খুব মনে পড়ছে তার। কী ছেলেমানুষ ছিল সেই পারুল! কী বোকা।

হঠাৎ একটু শক্ত হয়ে গেল পারুল। মাত্র দু হাত দূর দিয়ে একটা লম্বা, প্রকাণ্ড গোখরো সাপ চলে যাচ্ছে। গলায় একটা ঢিবি। যেতে যেতে তাকে একবার পাশ-চোখে দেখে নিল কি? পারুল নড়ল না। পলকহীন চোখে চেয়ে রইল সাপটার দিকে। উচ্চাবচ ভূমি আর গাছ আর পাতার আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছে সাপটা।

বিড় বিড় করে পারুল বলল, আস্তিক মুনি, আস্তিক মুনি, আস্তিক মুনি।

.

০২.

সন্ধেবেলার ঝুঁঝকো আঁধারে হঠাৎ তাকে দেখে খুব অবাক আর খুশি হয়ে সন্ধ্যা বলে উঠল, পারুলদি না কি? ও মা, আয় আয় পারুলদি! কতদিন পর!

যারা কাজ করে, যারা বেঁচে থাকার জন্য ক্রমাগত লড়াই করতে থাকে তাদের সৌন্দর্য বুঝতে পারে পারুল। ভাবালু মানুষ বা কামুক কখনও এই সৌন্দর্য খুঁজে পায় না। তাদের চোখে সন্ধ্যা কালো, বেঁটে, একটু মোটা, ছোটো ছোটো চোখ এবং লাবণ্যহীন মুখ। বয়সও হল সন্ধ্যার। হিসেবমতো তেত্রিশ বা চৌত্রিশ।

সন্ধ্যা যখন আবেগবশে তাকে জড়িয়ে ধরল তখন তার গা থেকে ঘাম আর নানা মশলার একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পেয়েছিল পারুল। সেন্ট, পাউডার, রূপটানের কোনও গন্ধ নয়।

এসবই পরশু দিনের কথা। এ-বাড়িতে গত কুড়ি বছর আসেনি পারুল। বাপের বাড়িতে এলেও এ বাড়িতে কখনও নয়। কিন্তু পরশুদিন নিশিতে পেয়েছিল তাকে, যখন শুনল, অমল রায়ের বউ আর ছেলেমেয়ে গাঁয়ের বাড়িতে এসে কয়েকদিন ধরে রয়েছে। অবাক হওয়ার মতোই খবর। পারুলের বিয়ের এক বছরের মধ্যেই অমল রায় বিয়ে করে। হয়তো পারুলের ওপর ওটা একটা নিষ্ফল প্রতিশোধ। তারপরই জার্মানিতে চলে যায়। বছর পনেরো বাইরে বাইরে কাটিয়ে বছর পাঁচেক হল কলকাতায় ফিরে বড় চাকরি করছে। গাঁয়ে আসবে কখন তারা? সবাই যে ভীষণ ব্যস্ত। আর আসবেই বা কেন? বুড়ো বাপ আজও বেঁচে আছে বলে অমল মাঝে মাঝে আসে। খুব দায় না ঠেকলে ওর বউ ছেলেমেয়েরা কখনও নয়।

আয়, ঘরে আয় পারুলদি। তোকে একটু দেখি।

 সন্ধ্যার ঘরের মধ্যেও সেই ঝাঁঝালো মিষ্টি টকচা নানারকম গন্ধের রেণু উড়ছে। সারাদিন ও কাসুন্দি, আচার, ডালের বড়ি, আমসত্ত্ব, আমলকীর মুখশুদ্ধি, জোয়ানের হজমি, পাঁপড় এই সব তৈরি করছে। ঘরে উদুখল থেকে শুরু করে প্রকাণ্ড শিল-নোড়া, মশলা গুঁড়ো করার যন্ত্র আর শিশি বোতলের ছড়াছড়ি। ভোল্টেজ কম থাকে বলে ইলেকট্রিকের বাতিতে ঘর আলো হয় না। তাই একটা কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। একটা মোটা মোমবাতির আগুনে দুটো অল্পবয়সি মেয়ে মেঝেতে বসে প্লাস্টিকের প্যাকেটের মুখ জুড়ছে।

ভারী ভাল লাগল পারুলের। একটুও ভাবালুতা নেই সন্ধ্যার। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ও জীবনের একটা হারা লড়াই অন্যভাবে জেতার চেষ্টা করছে।

কত কালো কুচ্ছিত মেয়েরও কত ভাল বিয়ে হয়ে যায়, সুখেই ঘরকন্না করে তারা। সন্ধ্যার কপালটা তত ভাল নয়। তার জন্য পাত্র খুঁজে খুঁজে হয়রান মহিমকাকা অবশেষে দুর্গাপুরের এক পাত্র পেয়ে লটারি জেতার মতো মুখ করে ফিরলেন। পারুল শুনেছে, পাত্রপক্ষের খাঁই ছিল। পঁচিশ হাজার নগদ এবং গয়না আর জিনিসপত্রের বহর বড় কম ছিল না। বিয়ের দু মাসের মাথায় সন্ধ্যা ফেরত হল। কী, না এ পাত্রীকে বরের পছন্দ হচ্ছে না। এমনই অপছন্দ যে, পাত্র বিয়ের পর দুবার বিবাগী হয়ে গিয়েছিল। না, সে সন্ধ্যাকে মারধর করেনি, অত্যাচারও নয়। এর টেকনিক ছিল অন্যরকম। সে নাকি কান্নাকাটি করে সন্ধ্যার কাছ থেকে মুক্তি চাইত। এমনকী পায়ে অবধি ধরতে বাকি রাখেনি। এমন নারাজ পুরুষের সঙ্গে থাকেই বা কী করে সন্ধ্যা? তবু সে তার বরকে বলেছিল, আমি কুচ্ছিত হতে পারি, কিন্তু খেটেপিটে সব পুষিয়ে দেবো। তোমার এমন যত্ন করব যা কেউ কখনও করেনি। একদিন দেখবে আমার চেহারাটার কথা তোমার আর মনেই থাকবে না। আমাকে ফিরিয়ে দিও না, তা হলে আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না। গলায় দড়ি দিতে হবে আমাকে। এ কথা শুনে তার বর ভেউ ভেউ করে কেঁদেছিল।

সেটা অভিনয় কিনা বোঝা যায়নি। অত বুদ্ধি সন্ধ্যার নেই। কান্নার জবাবে সেও কেঁদে ফেলেছিল। তার বর অনুনয় বিনয় করে বলেছিল, তুমি মোরো না। মরলে আমার বড় কষ্ট হবে। তুমি মরলে আমাকেও মরতে হবে।

কেউ মরেনি শেষ অবধি। বরের সঙ্গে সন্ধ্যার আইনমাফিক ডিভোর্সও হয়নি। বর বলেছিল, ডিভোর্স করলে অনেক হাঙ্গামা। তুমি ব্যাপারটা মেনে নাও। আমি জানি তুমি ভাল মেয়ে, কিন্তু আমার যে কোনও উপায় নেই।

সন্ধ্যা চলে এল। বর তাকে বর্ধমান স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বাসেও তুলে দিয়ে গেল। চোখের জল ফেলতে ফেলতেই বিদায় নিল। নিজের বর সম্পর্কে একটা ধাঁধা তাই আজও আছে সন্ধ্যার। ফেরত হওয়ার পরও তার আশা ছিল মানুষটা হয়তো ভালই। একদিন ভুল বুঝতে পেরে তাকে ফের নিয়ে যাবে।

তা অবশ্য হয়নি। লোকটা বছরখানেক বাদেই আর একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে। সন্ধ্যা খবরটা পেয়েও মামলা মোকদ্দমা করতে যায়নি। কী হবে হাঙ্গামা করে? গাঁয়ে তাদের পরিবারের একটা সম্মান তো আছে। আশ্চর্যের বিষয় তার দাদারাও কেউ তার হয়ে লড়তে যায়নি, কোনও ব্যবস্থাও করেনি খোরপোশ আদায়ের। শুধু তার বাবা মহিম রায় গিয়ে জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন। জামাই তাঁরও পায়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে “আমাকে জুতো মারুন, আমাকে ফাঁসি দিন” বলে অনেক বিলাপ করে। মহিম রায় অপ্রস্তুত হয়ে ফিরে আসেন।

মনের বিষণ্ণতা এবং ঘটনার আকস্মিকতা কাটতে এবং চোখের জল শুকোতে একটু সময় লাগল সন্ধ্যার। বছর দুয়েক। তার মধ্যেই সে বুঝে গেল সংসারে তার অবস্থান গলগ্রহের মতো। কোনও সম্মান নেই, কেউ গুরুত্ব দেয় না, বাঁকা কথা কানে আসে, পাড়া প্রতিবেশীরাও টিটকিরি দিতে ছাড়ে না।

এই অপমান ভুলতেই একদিন সে কাজে নেমে পড়ল। কাজে তার কখনও কোনও আলস্য ছিল না। বরাবরই তার শরীর খুব মজবুত। প্রথমে আচার নিয়ে পড়ল সন্ধ্যা। তারপর কাসুন্দি। অনভিজ্ঞতার ফলে দাম হয়ে গেল বেশি। নগেন হালদার নামে একটা ফড়ে ধরনের লোক এসে একদিন বলল, ওভাবে কি হয় দিদি? দামের ঘাট বাঁধা আছে। খরচ কমাও, নইলে পরতায় আসবে না। ব্র্যান্ডের মালের চেয়ে কম দামে না দিলে লোকে নেবে কেন? তা নগেন হালদারই তাকে খুব সাহায্য করল। এমনকী তার তৈরি জিনিস শহরের দোকানে দোকানে পৌঁছে দেওয়া অবধি। একটু একটু করে পয়সা আসতে লাগল। গত সাত আট বছর ধরে সন্ধ্যার যে-পরিশ্রম তার ফল আজ সে পায়। ব্যবসা তার বিরাট বড় কিছু নয়, কিন্তু তার জিনিস চলছে শহরে গাঁয়ে, চাহিদা বেড়েছে। এখন মাসে তার কম করেও তিন চার হাজার টাকা রোজগার।

পারুল এ সবই জানে। তিন রকম আলোয় সন্ধ্যার মুখশ্রীতে সে যে সৌন্দর্য আজ দেখতে পেল তা সে আগে দেখেনি।

সন্ধ্যা তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে নিজে একটা টুলে মুখোমুখি বসে দুঃখের গলায় বলল, হরিজ্যাঠা মারা যাওয়ায় এত খারাপ লেগেছিল যে কী বলব। মনে হল আপনজনই কেউ চলে গেল। আপনজনই তো, না কী বল পারুলদি! হরি জ্যাঠা মরে যাওয়াতে বাবাও খুব ভেঙে পড়েছে। কেবল বলছে, এই হরিদা চলে গেল, এবার আমার পালা।

পারুল বলল তা কেন, মহিমকাকা তো বাবার চেয়ে অনেক ছোট।

অনেক নয়। বাবা তো বলে পাঁচ ছয় বছরের তফাত। আজকাল কারও মরার খবর পেলেই বাবা কেমন ধড়ফড় করে।

এই বয়সে হয়।

 বাবার ঊনআশি চলছে। আমাদের সকলেরই কেমন বয়স হয়ে যাচ্ছে, না রে পারুলদি?

তোর আবার বয়স হল কোথায়? বেশ তো আছিস। তোকে দেখে আমার বড্ড ভাল লাগছে। বেশ নিজের চেষ্টায় দাঁড়িয়ে গেছিস।

সলজ্জ হেসে সন্ধ্যা বলে, দাঁড়ানো মানে আর কী? আমার তো ছোট ব্যবসা। কষ্টেসৃষ্টে চলে যায়।

পাড়াগাঁয়ে থেকে যা করেছিস ঢের করেছিস। তোর রোখ আছে, আর এইজন্যই তোকে ভাল লাগে।

এইটুকুর জন্যই বেঁচে গেছি পারুলদি। নইলে এ-বাড়িতে ঝি-গিরি করে খেতে হত।

সেই লোকটা আর খোঁজখবর করেনি, না?

 না। খোঁজখবর করবেই বা কেন? সুখে সংসার করছে।

 তোরা কাজটা ভাল করিসনি সন্ধ্যা। লোকটাকে ছেড়ে দিলি কেন? একটু শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল।

ধরতেই তো পারলুম না, ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছিস কেন? ওসব আর ভাবিই না। আমার কপালের দোষ। তোর মতো সুন্দর হয়ে জন্মালে কি আর সে আমাকে ছাড়ত?

পারুলের খুব দুঃখ হল কথাটা শুনে। একটু ভেবে বলল, তুই যে কত সুন্দর তা দেখার মতো চোখ কটা পুরুষের আছে? এই যে দিনরাত হাড়মাস নিংড়ে কাজ করছিস, এই যে স্নো-পাউডার মাখিস না, সাজিস না, এই যে লড়াই করছিস এর জন্যই তো তুই সুন্দর।

সে তো তোর চোখে। পাঁচজনের চোখে তো নয়।

 বউ সুন্দর হলেই বা। স্বামীর চোখে সেই সৌন্দর্যের আয়ু কতটুকু? কিছুদিন পর তো আর হাঁ করে তাকিয়ে বউয়ের সুন্দর মুখ দেখে এলিয়ে পড়বে না। তখন অন্য সব পয়েন্ট প্রমিনেন্ট হবে, কাজের মেয়ে কি না, বুদ্ধিমতী কি না, যত্নআত্তি করে কি না।

সে তো ঠিক কথাই পারুলদি। কিন্তু সে কথা ওই মেনিমুখোকে বোঝাতে পারলুম কই? আমি কাছে গেলেই ওর বোধহয় মনে হত একটা ভালুক আসছে।

পারুল হেসে ফেলল।

সন্ধ্যাও একটু হেসে বলে, তোর ব্যবসার কথা বল পারুলদি। তোর বর নাকি মস্ত ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট।

দুর বোকা, বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হওয়া কি সোজা? আদিত্যপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে আমাদের কারখানা। ছোট ছোট পার্টস তৈরি হয়। তেলের লাইনের জয়েন্ট, আরও সব ছোটখাটো জিনিস। টাটা স্টিল, টাটা অটোমোবাইল, রেল এরাই নেয়। কিন্তু এই একরত্তি একটা জিনিস তৈরি করতেও কতরকম ড্রয়িং, কত মাপজোখ, আর আটটা নটা অপারেশন দরকার হয়। তাই ভাবি বড় বড় কলকারখানায় আরও কত কমপ্লিকেটেড বাপার। ভাবলে মাথা ঘুরে যায়।

তুই আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছিস। একটুও মোটা হসনি। পারুলদি, তুই যে কেন মেজদাকে বিয়ে করলি না! তা হলে আজ হাঁফ ছেড়ে বাঁচতুম।

কেন রে? অমলদার বউকে কি তোর পছন্দ নয়?

এতক্ষণ সন্ধ্যার মুখে যে নির্লিপ্ত, হাসিখুশি, আলগা ভাবটা ছিল সেটা তীব্র ভ্রূকুটিতে মুখোশের মতো খসে পড়ে গেল। চাপা গলায় বলল, পছন্দ! ওরকম একটা বিচ্ছিরি স্বভাবের মেয়েমানুষকে আবার পছন্দ!

পারুল অবাক হয়ে বলে, কেন, কী করলেন উনি? ঝগড়া নাকি?

সে করলেও ভাল ছিল। ঝগড়ায় অনেক সময়ে সম্পর্ক পরিষ্কার হয়ে যায়। এ তো সে রকম নয়। মনের ভিতরে চক্কর। এ-বাড়ির কাউকে মানুষ বলেই মনে করে না। কিন্তু খুব মিষ্টি করে হেসে আর হাবেভাবে সেটা বুঝিয়ে দেবে, গলা তুলবে না, চেঁচাবে না।

তাই বুঝি?

এখন খুব মনে হয়, তোর সঙ্গে যদি মেজদার বিয়ে হত কী ভাল হত তবে। হ্যাঁ রে পারুলদি, তুই নাকি ভাল ইংরিজি বলতে পারিস?

পারুল হেসে বলে, পারব না কেন? আমার বরের পাল্লায় পড়ে শিখতে হয়েছে। কত অবাঙালি বা সাহেবসুবোকে নিয়ে ডিল করতে হয়, না শিখে উপায় আছে!

ওদের একটু ইংরিজি শুনিয়ে দিয়ে আয় না!

পারুল অবাক হয়ে বলে, ইংরিজি শোনাব কী রে? কেন?

ওরা বুঝুক গাঁয়ের মেয়েরাও ইংরিজি বলতে পারে।

পারুল হেসে বলে, তাতে কী লাভ হবে বল তো! ওরা খুব ইংরিজি বলে নাকি?

দিনরাত মায়েতে আর ছেলেমেয়েতে কেবল ইংরিজিতে কথা হচ্ছে। আমাদের নিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলে। ঠিক বুঝতে পারি না, হাবেভাবে টের পাই। চল না পারুলদি, গিয়ে মুখের ওপর ইংরিজি বলে আসবি।

পারুল স্মিত মুখে বলে, সেটা ঠিক হবে না। ওদের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, পরিচয় করার ইচ্ছেও নেই। আর ইংরিজি বলাটাও কোনও ক্রেডিট নয়। কিন্তু তুই ওদের ওপর রেগে আছিস কেন?

সন্ধ্যার মুখে আবার একটা শান্ত বিষণ্ণতা দেখা দিল। বলল, দেখ পারুলদি, তুই তো আমার কত প্রশংসা করলি। কিন্তু আমি ভিতরে ভিতরে নিজেকে নিয়ে লজ্জায় মরে থাকি। দেখতে কালো কুচ্ছিত, স্বামী নেয় না, তার ওপর তেমন লেখাপড়াটাও হয়নি। অমল রায়ের মায়ের পেটের বোন বলে কি আমাকে চেনা যায় বল? তার ওপর দিনরাত কামিনের মতো খাটি, তাতেই ওরা বোধহয় আমাকে লেবার ক্লাসের লোক বলে মনে করে। ছেলেমেয়ে দুটো কখনও আমাকে পিসি বলে ডাকে না। দ্যাট উওম্যান বলে কী সব যেন নিজেদের মধ্যে বলে। তাই ভাবি, তুই মেজদাকে বিয়ে করলে কত ভাল হত। কেন হলি না রে পারুলদি? মেজদার কোনও দোষ ছিল?

দোষ কার মধ্যে নেই? ওসব কথা থাক।

তুই মেজদার কথা আর ভাবিস না, না রে?

ও মা! ভাবব না কেন? সকলের কথাই ভাবি।

তোদের মধ্যে কত ভালবাসা ছিল।

পারুল একটু হেসে বলল, আজকাল ভালবাসা কথাটা শুনলেই আমার যে কী বিচ্ছিরি লাগে। টি ভি খুললেই ভালবাসা, বই খুললেই ভালবাসা, সিনেমায় গেলেই ভালবাসা। যত ভালবাসার বাদ্যি বাজছে তত ভালবাসা জিনিসটাই উবে যাচ্ছে।

তা হলে তোদের মধ্যে কী ছিল?

যা ছিল তা ওই সিনেমা টিভি উপন্যাসের মতোই, বিজ্ঞাপনের মতো ব্যাপার। আসলে ছিল কি না পরীক্ষাই হয়নি। আর ও বয়সটাও তো বুঝবার মতো বয়স নয়।

কী জানি বাবা, সেই ছেলেবেলা থেকেই তো জেনে এসেছি তুই আমার মেজো বউদি হবি। কিন্তু শেষ অবধি হল একটা–

পারুল হাসছিল। বলল, থামলি কেন?

 একটা খারাপ কথা মুখে আসছিল, সেটা আটকালুম।

ভাল করেছিস। হ্যাঁ রে, অমলদার বউকে আড়াল থেকে একবার দেখিয়ে দিস তো!

আড়াল থেকে কেন? আলাপ করলেই তো হয়।

না, আলাপ করব না।

কেন রে?

আমার কেন যেন ইচ্ছে করছে না। শুধু দেখলেই হবে।

সন্ধ্যা মৃদু হেসে বলে, তোর কিন্তু এখনও একটু হিংসে আছে। ভয় নেই, সে তোর কড়ে আঙুলের নখেরও যুগ্যি নয়। দেখবি? আয় তবে। এখন ওরা নিজেদের ঘরে বসে কথা কইছে। ঝগড়াই হয় বেশির ভাগ।

ঝগড়া?

হ্যাঁ, মা আর মেয়েতে।

 কী নিয়ে ঝগড়া?

সে কি আর বুঝতে পারি? ইংরিজিতে ঝগড়া। সন্দেহ হয় মেয়েটা কোনও কেলেঙ্কারি করে এসেছে। নইলে এ সময়ে হঠাৎ গাঁয়ে এসে বসে আছে কেন? পুজোর ছুটিও শুরু হয়নি, স্কুল কলেজ সব খোলা।

মেয়েটার বয়স কত?

ষোলো সতেরো তো হবেই।

পারুল একটু আনমনা হয়ে গেল। তারও তখন সতেরো বছর বয়স। মেয়েদের যৌবন মানেই চার দিকে পুরুষদের মধ্যে গুনগুন করে বার্তা পৌঁছে গেল, মেয়েটা সোমত্ত হল, ডাগর হল হে। কামগন্ধ উড়ল বাতাসে। আপনা মাসে হরিণা বৈরী। এই বয়সেই বাঘে খেয়েছিল তাকে। প্রেমিকের মতো নয়, লুঠেরার মতো তার কুসুম ছিন্ন করেছিল অমল। কিন্তু তাদের আমল আর নেই। এখন যৌবনের কেলেঙ্কারিকে অত কি আমল দেয় মা বাপেরা? যুগ কত পালটে গেছে। তার ওপর এরা বিদেশেও ছিল, যেখানে শরীর হল জলভাত।

যাবি ওপরে পারুলদি?

 গিয়ে?

মেজদার বউকে দেখবি বললি যে!

 ও হ্যাঁ। কিন্তু আড়াল থেকে।

হ্যাঁ, আমি তো আড়াল থেকেই দেখি। মায়ের ঘরের দরজায় একটা ফাঁক আছে। ঘরের আলো নিবিয়ে–

অমলের বউকে দেখার ইচ্ছেটা হঠাৎ কেন যেন উধাও হল পারুলের। তবু সে উঠল।

সন্ধ্যার মা মারা গেছে বছর দশেক। এ-ঘরে এখন আর কেউ থাকে না। মহিম রায় সিঁড়ি ভাঙতে অপারগ বলে আজকাল একতলায় থাকেন। দু ঘরের মাঝখানে বন্ধ দরজার ফাটলে চোখ রেখে সন্ধ্যা আগে দেখে নিল। তারপর চাপা গলায় বলল, মেয়েটা নেই। মায়ে পোয়ে বসে আছে। দেখ।

পারুল দেখল। কোন কোনও মহিলা আছে যাদের রূপ যেন পুরুষের দিকে তেড়ে আসে। সব কিছুই যেন বড় বেশি উগ্র। অমলের বউকে সুন্দরী বলতেই হবে। তবে সেটা বড় উচ্চগ্রামে বাঁধা। অতি ফর্সা, নাক অতি টিকোলো, চোখ অতি টানা, ঠোঁটে নিষ্ঠুর ক্ষীণতা। শরীরটা কাঠ-কাঠ। মেয়েলি ভাব একটু যেন কম। আর বয়সটাও একটু বেশি, অমলের কাছাকাছি।

বেশ সুন্দরীই তো রে।

আহা, ওকে সুন্দর বলে নাকি?

মেমসাহেব-মেমসাহেব দেখতে।

স্বভাবও মেমসাহেবদের মতোই। এঁটোকাঁটা মানে না, বাঁ হাতে জল খায়।

মুখটায় একটু টেনশন আছে।

 বলেছি না, দিনরাত ঝগড়া হচ্ছে। মুখে মেচেতা আছে, দেখেছিস?

ছেলেটা এদিকে পিছু ফিরে ছিল। একবার মুখ ঘোরাতেই বোঝা গেল, ছেলের মুখ তার মায়ের মতো।

মেয়েটা কোথায় গেল?

 হাঁটাহাঁটি করতে গেছে বোধহয়। দিনরাত তো তিনজনে ঘরবন্দি হয়ে থাকে।

তোদের সঙ্গে কথা বলে না?

না। শুধু বড়দার সঙ্গে। তাও কাজের কথা। এটা ওটা আনতে ফরমাশ করে।

সরু সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় মেয়েটার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। মেয়েটা দু-তিন সিঁড়ি উঠে এসেছিল, তাদের পাশ দেওয়ার জন্য নেমে দাঁড়াল। সিঁড়ির মাথায় টিমটিমে ডুমের আলোয় মেয়েটাকে দেখল পারুল। ফুটফুটে সুন্দর ডল পুতুলের মতো মেয়ে। মায়ের মতো কাঠ-কাঠ ভাব নেই শরীরে। একেবারেই মেয়েলি মেয়ে। মুখে হয়তোবা অমলের আদল আছে। তবে অমল সুপুরুষ ছিল না। মুখে বাপের আদল থাকলেও মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর।

মেয়েটা তাকে দেখছিল। একটু অবাক হয়েই দেখছিল। উঠোনের ওপাশে সন্ধ্যার ঘরের দরজায় উঠে ফিরে দেখল পারুল, মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে।

সন্ধ্যার ঘরে আরও প্রায় আধঘণ্টা বসে কথা কইল পারুল। সবই পুরনো কথা, ছেলেবেলার কথা।

যে মেয়ে দুটো বসে কাজ করছিল তারা চলে যাওয়ার পর হঠাৎ লাজুক মুখে সন্ধ্যা বলল, দেখ পারুলদি, তোকে একটা কথা বলব?

বল না। কী কথা রে?

একটা ছেলে–হি হি–একটা ছেলে আমাকে বিয়ে করতে চাইছে।

পারুল অবাক হল না। এরকম তো হতেই পারে। বলল, কে রে?

তুমি চিনবে না। যারা আমার জিনিস নিয়ে দোকানে দোকানে সাপ্লাই করে তাদেরই একজন। বামুনের ছেলে।

প্রেমে পড়েছে নাকি? তুই পড়লি, না ও পড়ল?

দুর! সেসব নয়। আসলে আমাদের ওসব করার সময় নেই, প্রেম আবার কীসের? ও বলে বিয়ে করলে ব্যবসাটা বাড়ানো সহজ হবে। দুজনে মিলে একটা পার্টনারশিপের মতো হয় তা হলে।

পারুল একটু ভেবে বলল, খারাপ কী? মহিমকাকাকে বলেছিস?

না। কেউ জানে না। আমরা তো আর ঢলাঢলি করি না। তোমাকেই প্রথম বললুম।

তোর এখন কিছু টাকা হয়েছে সন্ধ্যা, আর সেইটেই ভয়। টাকার লোভে যদি বিয়ে করতে চেয়ে থাকে তা হলে সাবধান হওয়া ভাল।

আমিও অনেক ভাবছি। হিসেব-নিকেশ করছি। বাড়ির লোকেই বা কী ভাববে বল! আমি তাই এখনও মত দিইনি।

খুব ঝোলাঝুলি করছে নাকি?

না না, সেসব নয়। অত আঠা নেই আমাদের। শুধু বলেছে বিয়ে করলে পরস্পরকে বিশ্বাস করতে সুবিধে হবে।

তোকে কিন্তু খুশি-খুশি দেখাচ্ছে।

মা কালীর দিব্যি, খুশি-টুশি নয় রে, বরং ভয়ে বুক শুকিয়ে আছে। নেড়া আবার বেলতলায় যাওয়ার আগে একটু ভয় পাবে না, বল?

ছেলেটা যদি ভাল হয় তবে বিয়ে করে ফেল সন্ধ্যা। নইলে যখন বয়স হবে তখন দেখবি এককাঁড়ি টাকা ছাড়া আর তোর কিছু নেই।

কিন্তু কী জানিস পারুলদি, ওই লোকটার জন্য আমার আজও একটু কেমনধারা মায়া আছে। বাজে লোক, খুব পাজি লোক, তবু কেমন যেন মনে হয়, বিয়ে করলে একটা বুঝি পাপ-টাপ কিছু হবে। এটা বোধহয় কুসংস্কার, না রে?

পারুল মাথা নেড়ে বলে, আমার তা মনে হয় না। কুসংস্কার কেন হবে! লোকটা পাজি হোক, শয়তান হোক, তুই হয়তো তবু ভালবেসেছিলি। তুই তো বোকা। আর বোকারাই অন্ধের মতো ভালবাসতে পারে। চালাকরা পিছল প্রাণী।

তাই ভাবছি।

তা হলে আরও ভাবতে থাক। যা করবি ভেবে করিস।

আমার কথা তুইও একটু ভাবিস পারুলদি। ভেবে একটা বুদ্ধি দিস। আমার একদম বুদ্ধি নেই।

ভাবতে ভাবতে অন্ধকার উঠোনটা পার হচ্ছিল পারুল। অমল রায়ের বউকে দেখার জন্য এত কৌতূহল কেন তার? এতদিন বাদে সে কি নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিল ওকে? ওই জায়গাটা তারই বাঁধা ছিল বলে তার কি আজও একটু দুঃখ আছে? না তো! নিজের মনকে সে খুব ভাল চেনে না বটে, কিন্তু এতদিনের বিবাহিত জীবনে অমল রায়ের জন্য তার কোনও দুঃখবোধ ছিল না তো! পড়তি বয়সে তাহলে এসব কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? অমল তো তার নাকচ করা পুরুষ।

এক তুমুল বর্ষার রাতে ভিতরে চেপে রাখা গোপন কথার কীটদংশন সইতে না পেরে সে তার স্বামী জ্যোতিপ্রকাশকে সবই বলে দিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, সব প্রকাশ না করলে জ্যোতিপ্রকাশের সঙ্গে তার জীবনটা সম্পূর্ণ হবে না। খাদ থেকে যাবে। ভারমুক্ত হতে পারবে না সে।

শান্ত মানুষ জ্যোতিপ্রকাশ মন দিয়ে সব শুনল। তারপর বলল, শরীরের তো পাপ নেই, পাপ মনে। মনে যদি শিকড়বাকড় না থাকে তবে আর ভয় কী?

না, আমার মনে কোনও দুর্বলতা নেই।

তাহলে সব ঠিক আছে পারুল। মেয়েদের মনে একাধিক পুরুষের ছাপ থাকলে তার সন্তান অস্থিরমতি হয়।

কী করে জানলে?

জানি। যে মেয়ের মন একমুখী, কোনও কারণে তার দেহ অশুচি হলেও খুব ক্ষতি হয় না। তার সন্তান ভালই হওয়ার কথা।

তুমি শুধু সন্তানের কথা ভেবে বলছ?

 বিয়ের উদ্দেশ্যই তো সন্তান। তার জন্যই শরীর লাগে, মনও লাগে। কোনওটাই তুচ্ছ নয়। সন্তান মানে সমতান। একদিন আমাদের জৈব প্রয়োজন শেষ হয়, আয়ু ফুরোয়, তখন ওই সন্তানের ভিতর দিয়ে আবার আমরাই বেঁচে থাকি।

জ্যোতিপ্রকাশ একটু প্রাচীনপন্থী, একটু গোঁড়াও হয়তো। আর কেন যেন সেই কারণেই লোকটার ওপর নির্ভর করতে ভরসা পায় পারুল।

নিজের রূপ নিয়ে বিয়ের পরও ঝামেলা কিছু কম হয়নি। জান সিং এক মস্ত খদ্দের তাদের। লম্বা-চওড়া আখাম্বা চেহারার রূপবান পুরুষ। কিছু তরলমতি এবং ফুর্তিবাজ। লোকটা জান-কবুল প্রেমে পড়ে গিয়েছিল পারুলের। কাণ্ডজ্ঞানরহিত অবস্থায় সে একদিন অফিসঘরে একলা পেয়ে পারুলের হাত চেপে ধরে বলল, আমার অনেক টাকা আছে। দিল্লি আর হরিয়ানায় আমার অনেক সম্পত্তি। চলো আমার সঙ্গে।

পারুল সেই শক্তিমান পুরুষটির দিকে চেয়ে ফের অমল রায়কেই দেখতে পেয়েছিল। সে খাদ্য, পুরুষেরা খাদক। সে মিষ্টি ও কঠিন করে বলেছিল, আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি একটা কিছু গড়ে তোলার জন্য। মানুষ সবসময়েই কিছু গড়ে তুলতে চায়। আবহমানকাল ধরে মানুষের সেই চেষ্টা। তুমি সব ভেঙে দিতে চাও? ছক উলটে দেবে? মিসমার হয়ে যাবে সব? তুমি আমাদের মস্ত ক্লায়েন্ট সিং সাহেব, কিন্তু তোমাকে ছাড়াও আমাদের চলে যাবে।

জান সিং বার্তা পেয়ে গেল। কিন্তু হাত ছেড়ে দিয়ে সে বলেছিল, দেয়ার ইজ সামথিং উই কল লাভ। আই অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ। সেই প্রেমটাকে একটা সম্মান তো দেবে?

আমার ভালবাসা শুধু পুরুষমানুষ নিয়ে তো নয়। আমি এবং আমার স্বামী উই শেয়ার বেড, বিজনেস, বিয়ারিংস। আমাদের ভালবাসা হুট করে হয়নি, ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। হুট করে তা ভেঙেও যাবে না। আমি দমকা প্রেমে বিশ্বাস করি না।

ডু ইউ অ্যাডোর মি?

না সিং সাহেব, আই ডোন্ট অ্যাডোর ইউ। ইউ আর এ বিগ অ্যান্ড উইক ম্যান।

একটা মেয়েই জানে কতরকম লড়াই একটা মেয়েকে গোপনে এবং একা করে যেতে হয়। প্রত্যাখ্যানের পর প্রতিশোধের পালাও শুরু হয় কখনও কখনও। বদনাম ছড়ানো, মুখে অ্যাসিড মারা, খুন অবধি। জান সিং বহু টাকার অর্ডার ক্যানসেল করল, গুণ্ডা লাগিয়ে কারখানায় গোলমাল পাকাল। খুব অশান্তি গিয়েছিল কয়েক দিন।

জান সিং একাই তো নয়। কেউ গভীরভাবে তার প্রেমে পড়েছে, কেউ হালকা ফুর্তি লুটে নিয়ে যেতে চেয়েছে, কেউ নানা সুবিধে করে দেওয়ার টোপ ফেলেছে, কেউ নিজেকে ময়ূরের মতো সাজিয়ে জাহির করেছে। আর ট্রেনে বাসে গায়ে অঙ্গ স্পর্শ করানো তো আছেই। খদ্দের সবাই। প্রায় সবাই। সারি সারি মুখ মনে পড়ে যায় তার। নির্লিপ্ত মানুষও কি নেই? ঢের আছে। তাই সব পুরুষকে সে ঘেন্না করে না, বেছে বেছে করে। মুখচোখ দেখেই তার মেয়েলি অ্যান্টেনায় পুরুষের তরঙ্গ ঠিক ধরা পড়ে।

তবু অমল রায়ের প্রতি তার কেন কৌতূহল? কেন এখনও? নিজেকে এই প্রশ্নের ছোবলে ছোবলে অস্থির করে তুলে সে খুব আনমনে টর্চের আলো ফেলে ফেলে বড় উঠোনটা পার হচ্ছিল।

পিছন থেকে সন্ধ্যা বলল, আবার আসিস পারুলদি।

পারুল কথাটা শুনতেই পেল না। উঠোন পেরিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা, দুধারে গাছপালার ডালপাতা গায়ে লাগছিল তার। আচমকাই কামিনী ঝোপটার পাশে টর্চের আলোয় মেয়েটাকে দেখতে পেল সে।

পরনে হলুদ রঙের কুর্তা সালোয়ার।

থমকে দাঁড়াল পারুল। মেয়েটা এখানে কী করছে?

পারুল হয়তো কথা না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেত। কিন্তু মেয়েটাই হঠাৎ পরিষ্কার বাংলায় বলল, আপনি পারুল না?

“পারুল” শুনে ভ্রূ কোঁচকাল পারুল। পিসি বা মাসি বা দিদি নয়, শুধু পারুল! অবশ্য ওরা বিদেশে ছিল, সেখানে এরকমই রেওয়াজ।

পারুল রাগ না করে স্নিগ্ধ গলাতেই বলল, হ্যাঁ। তুমি আমাকে চিনলে কী করে?

আমি সোহাগ, অমল রায়ের মেয়ে। আমাদের অ্যালবামে আপনার একটা ছবি আছে।

আমার ছবি! আশ্চর্য!

 মাই ড্যাড অ্যাডোর্স ইউ।

 ঝম করে লজ্জার একটা ঝাপটা লাগল তার মুখে। পারুল বলল, তাই নাকি? হতে পারে। আমরা তো এক গাঁয়েরই মানুষ।

আপনার যে ছবিটা আমাদের অ্যালবামে আছে সেটা অনেক কম বয়সের। বোধ হয় সতেরো আঠেরো।

উদাস গলায় পারুল বলে, তা হবে।

ইউ আর এ ভেরি বিউটিফুল উওম্যান।

তুমিও তো সুন্দর।

মে বি। কিন্তু বাবা বলে আপনার মতো নাকি বাবা আর কাউকে দেখেনি।

অমলদা এসব বলেছে বুঝি তোমাদের।

হ্যাঁ। আমাদের মধ্যে খুব ফ্র্যাঙ্ক আর ট্রুথফুল কথা হয়।

তাই বুঝি!

আপনার যে বয়সের ছবিটা আমাদের অ্যালবামে আছে বোধহয় সেই বয়সেই ইউ ওয়্যার ডি-ফ্লাওয়ারড বাই মাই ড্যাড।

পারুলের শরীর সিঁটিয়ে গেল লজ্জায়। বুকের ভিতরটা ঝমঝম করছে রাগে। তারপর ফণা তুলল।

তোমরা বুঝি এতটাই ফ্র্যাঙ্ক?

 অ্যান্ড হোয়াই নট?

তোমার বাবা একটা শিক্ষিত গাধা। একে ফ্র্যাঙ্কনেস বলে না, একে বলে ফুলিশনেস।

মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে একমত হয়ে বলে, হি ইজ অফকোর্স অ্যান ইডিয়ট।

 রাগে ফুঁসছিল পারুল। মেয়েটাকে একটা থাপ্পড় মারার প্রবল ইচ্ছে যে কী করে সে দমন করল কে জানে।

আর ইউ ক্রস উইথ মি পারুল?

 ইয়েস আই অ্যাম ক্রস উইথ ইউ।

হোয়াই কান্ট ইউ টেক এ ট্রুথ অ্যাজ এ ট্রুথ? তা ছাড়া বাবা প্রথম কথাটা আমাদের কাছে বলে ফেলে আফটার এ ফিউ রাউন্ডস অফ হুইস্কি। আমি আর মা বসে অ্যালবামটা দেখছিলাম, তখন। পরে যখন আমরা বাবাকে চেপে ধরি তখন সোবার অবস্থাতে বাবা স্বীকার করেছিল। নো হার্ড ফিলিং পারুল। আই অ্যাম সরি।

পারুল তখনও ফুঁসছিল। কিন্তু সে বোকা বা অবিবেচক নয়। সে হয়তো জানে না, দুনিয়াটা তার অজান্তে কত পালটে যাচ্ছে দ্রুত। বিশাল প্রজন্মের ব্যবধান। এইসব ছেলেমেয়ে হয়তো তাদের কাছে মঙ্গলগ্রহের জীবের মতোই অচেনা। সে মাথা নেড়ে বলে, তুমি আমার আজকের দিনটা খুব তেতো করে দিলে।

মেয়েটা একটু যেন অবাক হয়ে বলে, ইজনট ইট এ ট্রুথ? টেক ইট ইজি ডিয়ার। আমি কিছু ভেবে বলিনি। ওরকম তো কত হয়।

পারুলের মনে পড়ল, কুড়ি বছর আগে অমল রায়ও এই কথাটা বলেছিল। এরকমই নাকি আকছার হয়, এতে মনে করার কিছু নেই, আজকালকার ছেলেমেয়েরা ওসব মাইন্ড করে না। ইত্যাদি।

পারুল টর্চটা নিবিয়ে ফেলেছিল। ফের জ্বেলে বলল, এরকম হওয়া উচিত নয়। ইট ইজ এ শেম।

ফের অবাক সোহাগ বলে, কেন পারুল? হোয়াই ইট ইজ এ শেম?

সেটা তুমি হয়তো এখনই বুঝবে না। হয়তো কোনওদিনই বুঝবে না। তোমার পরিবার তোমাকে অন্যরকম শিখিয়েছে।

ও কে পারুল, আই ডিড সামথিং রং। কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করতেই চেয়েছিলাম। আপনার ছবিটা আমাকে পাগল করে দিত। কী সুন্দর। ইউ আর স্টিল ভেরি বিউটিফুল।

কমপ্লিমেন্টটা পারুলের গায়ে ছ্যাঁকা দিচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে সে বলল, বারবার ওকথা বলছ কেন? আমি জানি আমি সুন্দর। কিন্তু তাতে এখন আর আমার কিছু এসে যায় না।

মেয়েটা বোধহয় এবার অপমানিত বোধ করল। বলল, আপনি কি একজন নান? এ পিওর উওম্যান?

 নিজেকে আমি তাই মনে করি। তুমি একটি অসভ্য মেয়ে।

মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, উই হ্যাভ আওয়ার ওন অবসেশনস।

পারুল মেয়েটার পাশ কাটিয়ে খানিকটা চলে এসেছিল।

মেয়েটা হঠাৎ ডাকল, পারুল!

পারুল অনিচ্ছের সঙ্গে দাঁড়াল।

আই হ্যাভ টু টেল ইউ সামথিং।

দৌড়ে এসে হাঁপাচ্ছিল মেয়েটা।

পারুল ঠান্ডা গলায় বলল, আবার কী বলবে?

আমি বলতে চাই, ইন আওয়ার ফ্যামিলি এভরিবডি হেটস এভরিবডি। মাই ড্যাড অ্যান্ড মম হেটস ইচ আদার, আই হেট মাই ড্যাড অ্যান্ড মম অ্যান্ড দে হেটস মি। ইভন মাই ব্রাদার হেটস ড্যাড অ্যান্ড ড্যাড হেটস হিম। কিন্তু তার মধ্যেই দেখতে পাই, আমার বাবা অ্যালবাম খুলে আপনার ছবিটা যখন দেখে তখন তার মুখটা কেমন সফট আর পেনসিভ হয়ে যায়। ছবিটা আমিও মাঝে মাঝে দেখি। দেখতে দেখতে আমারও কেমন যেন হয়। মোনালিসার ছবিতে যেমন ম্যাজিক আছে তেমনই কিছু। বুডঢাও কথাটা আমাকে অনেকবার বলেছে। আমার মন খারাপ লাগলেই আমি ছবিটা দেখি আর মন ভাল হয়ে যায়। ইউ হ্যাভ বিকাম এ কাল্ট ফিগার অ্যান্ড ইভন এ গডেস টু আস। অ্যান্ড ইটস এ ট্রুথ।

এত অবাক হয়েছিল পারুল যে মুখে প্রথমে বাক্যই সরল না। তারপর বলল, এসব তো তোমার কল্পনা। আমি সামান্য মেয়ে, দেবী-টেবী নই।

উই হ্যাভ আওয়ার ইলিউশনস, আই নো৷ তবু আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। মে বি ইউ আর নট এ গডেস, বাট মাস্ট বি সামওয়ান ভেরি স্পেশাল।

তুমি ভুল ভাবছ সোহাগ। ওরকম ভেবো না।

আমি একটু বেশি কথা বলে ফেলেছি আজ, কিছু মনে করবেন না। বাই।

মেয়েটা চলে যাচ্ছিল। পারুল টর্চটা জ্বেলে ওর পথের ওপর আলো ফেলে বলল, শোনো সোহাগ, এটা গ্রামদেশ। অন্ধকারে হুটহাট বেরিয়ে পোড়ো না, সাপ-খোপ আছে কিন্তু।

অন্ধকারে সোহাগের হাসি শোনা গেল, আই লাভ স্নেকস। স্নেকস আর অলওয়েজ ওয়েলকাম।

এসবই পরশুদিনের কথা। আজ তার বাবা গৌরহরি চাটুজ্জের শ্রাদ্ধের দিনে বৃহৎ লোকসমাগম থেকে একটু সরে এসে বাগানের নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে পারুল ভাবছিল মেয়েটা কি একটু পাগল? সাপটা সামনে দিয়ে চলে যাওয়ার পরই মেয়েটার কথা মনে পড়ল তার। সুন্দর, তবে মুখটায় একটু বিষণ্ণতা মাখানো ছিল।

অমল রায় তার ছবির দিকে চেয়ে আজও কি পুরনো ভালবাসার কথা ভাবে? নাকি তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করে মনে মনে তেতো হয়ে যায়?

কে যেন পারুলকে ডাকছে চেঁচিয়ে। পারুল ফিরে আসছিল। উঠোনে পা দিতেই সামনে বুড়ো মানুষটা এসে পড়ল।

হ্যাঁ মা, তা খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কি ছাদে করা হয়েছে?

 হ্যাঁ ধীরেনখুড়ো। আপনি ভাল আছেন তো!

ভাল আর কী, গৌরহরিদা গেলেন, আমরাও সব পা বাড়িয়ে আছি।

একটা পেচ্ছাপের গন্ধ পাচ্ছিল পারুল। এসব গন্ধ সে একদম সইতে পারে না। নাকে আঁচল চাপা দিয়ে বলল, ইস, কী বিচ্ছিরি গন্ধ! কেন যে এরা ব্লিচিং পাউডার বা ফিনাইল ছড়ায় না!

ধীরেন কাষ্ঠ তাড়াতাড়ি দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলে, খাওয়া-দাওয়া কি শুরু হয়ে গেছে মা? আমার আবার অনেকটা পথ– এই রোদ্দুরে–

যান না খুড়ো, ওপরে চলে যান। বোধহয় শুরু হয়েছে।

.

০৩.

গত দশদিন যাবৎ বড় জ্যাঠামশাইয়ের ভূত চারদিকে আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চটির শব্দ শোনা যায়, গলাখাঁকারির শব্দ পাওয়া যায়, নিশুত রাতে দীর্ঘশ্বাস অবধি ভেসে বেড়ায়। দশ দিন আগে বড় জ্যাঠামশাই যখন মারা যান তখন ভরসন্ধেবেলা। চারদিকে ধোঁয়াটে আবছা অন্ধকার নেমে আসছে। সন্ধেবেলাটা হল সবচেয়ে মন খারাপ করার সময়। কালিঝুলিমাখা এক ডাইনি বুড়ি যেন এসে হাজির হলেন। প্রত্যেক দিন এই সময় তার খুব মরার কথা মনে হয়।

এক ছুটের রাস্তা। অবস্থা খারাপ শুনে তারা সব গিয়েছিল দেখতে। কয়েকজন মুরুব্বিগোছের পাড়াপ্রতিবেশী, বর্ধমান থেকে গাড়ি-চেপে-আসা গম্ভীরমুখো ডাক্তার আর আত্মীয়স্বজনে বারান্দা আর ঘর ভর্তি। তাদের জ্যাঠার ঘরে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। নিঃশব্দ ঘরে জ্যাঠা একা একা মারা যাচ্ছিল যখন, সেই সময়ে দুটো-তিনটে বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ এল, জ্যাঠামশাইয়ের গোয়ালঘর থেকে একটা গোরু গাঁ গাঁ করে ডাকছিল। সে বোধহয় আলো। সাদা ধবধবে আলো বড় জ্যাঠামশাইয়ের এমন বাধুক যে, জ্যাঠা গায়ে হাত রেখে পাশে না দাঁড়ালে সে দুধ ছাড়ে না, আটকে রাখে। আলো কি কিছু টের পেয়েছিল? অবোলা জীবরা বোধহয় ঠিক বুঝতে পারে। জাম্বো কুকুরটা যেমন। জ্যাঠার বারান্দার এক কোণে কেমন ঝুম হয়ে বসা। সামনের দু পায়ের ফাঁকে মাথাটা রাখা। নড়ছে না, চড়ছে না। এত লোক দেখেও একটা ঘেউ পর্যন্ত দিল না।

আর বাড়ির বাতাসটা কেমন ভারী হয়ে উঠছিল ক্রমে। শূন্য থেকে সাদা প্রেতের মতো একটু কুয়াশা যেন হঠাৎ নেমে এসে ঝুলে থাকল উঠোনের ওপর। কেমন ছমছম করছিল চারধার। যেন প্রেতলোকের ছায়া চারধারে। পান্না সিঁড়িতে বসেছিল চুপচাপ। বড় জ্যাঠা মরে যাচ্ছে। কেন যে মরে যাচ্ছে! আর ওই ভুতুড়ে সন্ধ্যা আর ওই আলোর করুণ ডাক আর ওই কুয়াশার পাতলা সর, সব মিলিয়ে কান্না পাচ্ছিল।

আর তখন উঠোনের উত্তর ধারে মরা আলোয় একমনে এক্কাদোক্কা খেলে যাচ্ছিল দুখুরি। কালো রোগা মেয়েটার পরনে একখানা কার যেন মস্ত ঢলঢলে ফ্রক। শোকাহত বাড়িতে আসন্ন মৃত্যুর নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু ওই মেয়েটা একমনে খেলে যাচ্ছে। এখন তাকে কেউ কাজে ডাকছে না, ফাইফরমাশ করছে না। এই ফাঁকটুকুতে সে আপনমনে খেলে নিচ্ছে। মৃত্যুহিম বাড়িটায় ওই একটু যেন জীবনের লক্ষণ– হৃৎপিণ্ডের মতো। লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে মেয়েটা।

প্রথমে শাঁখের আওয়াজ বলেই ভুল হয়েছিল। এক ঝটকায় ভুল ভাঙল। জ্যাঠাইমা কেঁদে উঠল না? ওঁওঁওঁ শব্দের একটা লম্বা টানা শব্দ। কে একজন বলে উঠল, সময়টা লিখে রাখো, লিখে রাখো, ছটা বেজে সতেরো মিনিট। আর একজন বলল ও ভটচাযমশাই, লগ্নটা কী পেল দেখুন তো, দোষ-টোষ কিছু পেল নাকি? নবীন ভটচাযের গলা পাওয়া গেল, তেমন কিছু নয়, গৌরহরিদা ভালই গেছেন।

জ্যাঠাইমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে অনেকগুলো কান্নার আওয়াজ উঠল আর গম্ভীরমুখো ডাক্তার বেরিয়ে এসে সিঁড়ি বেয়ে উঠোনে নেমে চলে গেলেন। কান্না শুনে দুখুরি খেলা থামিয়ে মুখের ওপর থেকে ঝুরো চুল সরিয়ে পান্নার দিকে চেয়ে বলল, মরে গেছে?

মরা মানুষ দেখবে না বলে পান্না আর দাঁড়ায়নি। এক ছুটে বাড়ি। আর বাড়িতে তার জন্য অপেক্ষা করছিল ফাঁকা, অন্ধকার, হাঁ-হাঁ করা ঘর, উঠোন জোড়া অন্ধকার, আর ধোঁয়াটে অশরীরী কুয়াশার কুণ্ডলী। পান্না উঠোনে দাঁড়িয়ে, চোখ বুজে, শক্ত হয়ে প্রাণপণে চিৎকার করেছিল, বাসন্তী… বাসন্তী.. বাসন্তী…

বাসন্তী গিয়েছিল পুকুরঘাটে। বাসনের পাঁজা ফেলে রেখেই উঠে এল।

কী হয়েছে গো? চেঁচাচ্ছ কেন?

 আমার ভয় করছে।

ও মা! ভরসন্ধেবেলা ভয়ের কী?

বাড়িতে কেউ নেই দেখছিস না? সব ও-বাড়িতে।

 তা তুমি চলে এলে যে! গৌরকর্তার কি হয়ে গেল?

 হ্যাঁ। আমার ভীষণ ভয় করছে।

 সেদিন সন্ধেবেলা কারেন্ট ছিল না। বাসন্তী লণ্ঠন জ্বেলে দিয়ে বলল, আমার তো বসে থাকলে চলবে না, বাড়ি ফিরতে হবে। ছেলেটার জ্বর দেখে এসেছি। একা যদি না থাকতে পারো তা হলে ভশ্চায খুড়িমাকে ডেকে দিয়ে যাচ্ছি।

ভয়! ভয়ের কি শেষ আছে! কোথা থেকে যে হঠাৎ হঠাৎ তার ভয়েরা এসে হাজির হয় তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু ভয় তার অমনি হয় না। তার ভয়ের পিছনে সবসময়েই গূঢ় কারণ থাকে। কিন্তু সেটা কেউ বুঝতে চায় না। ভয়ের জন্য কত বকুনি খায় সে।

মানুষ মরে যে কেন ভূত হয় কে জানে বাবা! ভটচায খুড়িমা বলল, মরার পর আত্মা দশ দিন প্রেতলোকে থাকে, শ্রাদ্ধের পর দেবলোকে চলে যায়। আর প্রেতলোকটা বেশি দূরেও নয়, আশেপাশেই।

কী যে গা ছমছম করল তার। রাতে মায়ের সঙ্গে লেগে শুয়েও ঘুম এল না। নিশুত রাতে জ্যাঠামশাইয়ের দীর্ঘশ্বাস ঘুরে বেড়াতে লাগল উঠোনে। শুকনো পাতার সড়সড় শব্দে কীসের যে সঞ্চার ঘটছিল। তাদের কুকুরটা অকারণে কেঁদে উঠেছিল একবার বারান্দায়। অকারণে নয়, পান্না জানে। ঠিক জ্যাঠামশাইকে দেখতে পেয়েছিল।

দাহকাজ শেষ করে তার বাবা রামহরি চাটুজ্যে ফিরল শেষ রাতে। আগুন ছোঁয়ানো, লোহা ছোঁয়ানো এসব করতে উঠে গেল মা। তখন পান্নার চোখ জুড়ে ঘুম এল।

বিয়ে করলে আমি বাপু, কলকাতায় করব। মেলা লোক, আলো, ভিড়ভাট্টা, অত গা ছমছম করবে না। আমার যা ভয়।

নিতু বলে, দুর! কলকাতা আমার ভাল লাগে না। তুই কী রে ভিড় ভালবাসিস! আমার ভাল লাগে পাহাড়, উপত্যকা, শীত-শীত ভাব আর খুব নির্জন, গাছগাছালি…

সেসব আমারও ভাল লাগে। কিন্তু একা থাকলে ভয়েই মরে যাব।

তোর যে কী অদ্ভুত ভয়। আর কলকাতায় বুঝি ভয় নেই। কত খুনখারাপি, অ্যাকসিডেন্ট।

তাও ভাল বাবা।

আজ বড় জ্যাঠার শ্রাদ্ধ। সকাল থেকে বাবা ও-বাড়িতে। মাও একটু আগে গেল। পান্নাকে ডেকে বলে গেল, দেরি করিসনি যেন। চানটা করেই চলে আয়। যা মাঠো মেয়ে তুই।

তা আছে একটু পান্না। মাঠোই বোধহয়। সব কাজে তার গড়িমসি। শরীরটা নড়াতে-চড়াতে ভালই লাগে না তার। তার ভাল লাগে বসে বসে ভাবতে।

শরীরের গভীর আলসেমি যেন মদের নেশার মতো। আর মাথার মধ্যে লাগামছাড়া উদ্ভট সব ভাবনা। পান্না ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে বসে গড়িয়েই কাটিয়ে দিতে পারে। আর মনে মনে সে যে কোথায় কোথায় উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় তার ঠিক-ঠিকানা সে নিজেও জানে না।

আজ কোনও সাজ নেই। শ্রাদ্ধবাড়ির নেমন্তন্নে কেউ তো সাজে না। সাদামাটা একটা সাদা খোলের শাড়ি, মুখে একটু পাউডার, চুলে সামান্য চিরুনি। ব্যস হয়ে গেল। তাই আজ একটু গড়িমসি করে নিচ্ছে পান্না। মোটে সাড়ে এগারোটা বাজে। হাতে এখনও অনেক সময়। কাজের বাড়িতে আগে-ভাগে গিয়ে হাজির হলে লোকে বড্ড ফাইফরমাশ করে। এটা নিয়ে আয়, ওকে ডেকে দে, পানগুলো সেজে ফেল, আরও কত রকম। আর অত ভ্যাজর ভ্যাজর, কুটকচালি ভাল লাগে না তার।

গনগনে পুরুষের মতো দুপুর, নির্জন বাড়ি, আর অন্যরকম এক দামাল হাওয়া। আজ তার খুব ‘সে’র কথা মনে হচ্ছে। এই ফাঁকা বাড়িতে পান্না এখন একা, এ সময়ে যদি সে এসে সামনে দাঁড়ায়। মাগো, ভাবতেই গা সিরসির করে, রোঁয়া দাঁড়িয়ে যায়। কেমন হবে সে? আজও স্পষ্ট কোনও চেহারা মনে পড়ল না পান্নার। না বাবা, কার্তিক ঠাকুরটার মতো সুন্দর চেহারা চাই না। তবে পুরুষমানুষের মতো। একটু অগোছালো, একটু আনমনা, ভুলো মন, একটু পাগলাটে হোক না তাতেও ক্ষতি নেই। খুব সুন্দর ঝকঝকে মসৃণ দাঁত আর হাসিটা হবে খুব সুন্দর। হাসলে যেন মাড়ি না বেরিয়ে পড়ে বাবা। পান্নাকে খুব ভালবাসবে, কিন্তু বউ-মুখো যেন না হয়।

বউ-মুখো একদম দেখতে পারে না পান্না। শেফালী বউদি তো বরকে নিয়ে ওইজন্যই ভাজা-ভাজা হল। বরুণদা যা মাগী-মার্কা পুরুষ, বউয়ের মাথা টিপে দেয়, কুটনো কুটে দেয়। গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঘোরে। শেফালী বউদি মাঝে মাঝে ধৈর্য হারিয়ে বলেই ফেলে, ও বাবা, এ যেন একটা মেয়েমানুষকেই বিয়ে করেছি রে!

পান্না বলে, তা কেন বউদি, বরুণদা তোমাকে কত ভালবাসে, মাথা টিপে দেয় জ্বর হলে।

 দেয় কেন? মাথা টিপে না দিলে কি মরে যাব?

অত ভালবাসা তোমার বুঝি সয় না?

তোরও সইবে না। পুরুষমানুষ যদি সবসময়ে গায়ে গায়ে লেগে থাকে মেনি বেড়ালের মতো, যদি সংসারের সব ব্যাপারে নাক গলায় তা হলে কি ভাল লাগে বল? ঘেন্নায় মরে যাই ভাই, কী সুন্দর রিপু করতে পারে, উল বুনতে পারে, কুরুশকাঠিতেও দিব্যি হাত।

বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে শেফালী বউদি।

 আর মনে মনে পান্না বলে, হে ঠাকুর, আমার পুরুষমানুষটা যেন কিছুতেই বরুণদার মতো না হয়।

নয়না শিবেনদার সঙ্গে ছুঁকছুঁক করছে, পায়েল তার মাস্টারমশাই জিতু সমাদ্দারের সঙ্গে লাইন দিচ্ছে, শুধু পান্নারই গাল উঠল না। এ নয়, ও নয়, সে নয়। তার ‘সে’ এদের কারও মতো নয়। অন্যরকম। এই অন্যরকমটা রোজ রোজ বদলে যায়।

হীরা বলে, অত খুঁতখুঁত হলে তোর কেউ জুটবে না শেষ অবধি, দেখিস। তোর জন্য কি বর কলে তৈরি হবে? মেড টু অর্ডার?

তাও বটে।

কিন্তু এই নির্জন দুপুরে সেই আবছা পুরুষের কথা খুব মনে আসে পান্নার। তার বান্ধবীরা খুব সেক্স নিয়ে কথা বলে। পান্নার ও ব্যাপারটা ভাবতে ভাল লাগে না। শরীরের গ্যাদগ্যাদে ব্যাপারটা তো আছেই বাবা। কিন্তু ওটাই সব নয়। সে চায় ভাবের পুরুষ, শরীরের পুরুষ নয়।

ইলাবতী আর সোমেশ্বর প্রেমে পড়েছিল। ইলাবতীর পনেরো, সোমেশ্বরের কুড়ি। জানাজানি হওয়ার পর ইলাবতীকে তার মা বাবা খুব মেরেধরে বেঁধে রাখল ঘরে আর সোমেশ্বর রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরতে লাগল। তারপর একদিন ফাঁক পেয়ে দুজনেই পালাল। শ্মশানের ধারে দুজনকে পাওয়া গেল পরদিন। জড়াজড়ি করে মরে পড়ে আছে।

কী যে কেঁদেছিল পান্না। হ্যাঁ, ভালবাসা হবে ওইরকম। কেমন মরে গেল দুজনে। আর তারপর দুজনেই তুচ্ছ শরীর ছেড়ে ফেলে হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াত মনের আনন্দে। কত লোক তাদের দেখেছে। নদীর ধারে বা হাট মুকুন্দপুরের জঙ্গলে, নিশুত রাতে অলকেশ স্মৃতি সংঘের ফুটবল খেলার মাঠে। পান্না দেখেনি, কিন্তু পান্না তাদের ফিসফাস মধ্যরাতে কতদিন শুনেছে। স্বর নেই, শুধু শ্বাসের শব্দে কথা। গায়ে কাঁটা দেয়।

হ্যালো! এনিবডি হিয়ার।

ঝিমঝিম দুপুরে তন্দ্রাচ্ছন্ন তন্তুজাল ছিঁড়ে সপাটে উঠে বসল পান্না। বুকটা ধক ধক করছে। মেয়ে গলায় ইংরিজি বলছে কে? এরকম তো হওয়ার কথা নয়! কণ্ঠা পর্যন্ত আতঙ্ক উঠে এল তার।

উঠোনের জানালাটা দিয়ে উঁকি দিতেই সে সোহাগকে দেখতে পেল। অমল রায়ের মেয়ে। খুব দেমাক, ইংরিজি ছাড়া কথাই বলে না। সন্ধ্যাদি আরও বলেছে, কলকাতায় নাকি কেলেঙ্কারি করে এসেছে। সন্ধ্যাদি পান্নাকে খুব ধরেছিল, যা না, গিয়ে ওদের ইংরিজিতে দুটো কথা শুনিয়ে দিয়ে আয়। বুঝবে আমরাও মুখ্যু নই। পান্না রাজি হয়নি। সে ইংরিজি বলবে কি, ভয়েই মরে যাবে। কথাই ফুটবে না।

অবাক হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল পান্না, কিছু বলছ?

মেয়েটার তেমন সাজগোজ নেই, পরনে একটা লম্বা ঝুলের ফ্ৰকমতো ম্যাদাটে পোশাক, চুল উড়োখুড়ো। তার দিকে চেয়ে বলল, সরি, আমি ভুল করে তোমাদের কোর্ট ইয়ার্ডে ঢুকে পড়েছি বোধহয়। এখানে কোনটা রাস্তা আর কোনটা নয় তা বোঝা মুশকিল। এখান দিয়ে কি রাস্তায় যাওয়া যাবে?

যাবে। তুমি কোথায় যাচ্ছ?

 মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এনি হোয়ার। নাথিং ম্যাটারস।

 তুমি তো সোহাগ। অমল রায়ের মেয়ে।

হ্যাঁ। আর তুমি?

 আমি পান্না চট্টোপাধ্যায়। আমাদের বাড়িতে একটু বসবে?

 মেয়েটা ঠোঁট উলটে বলল, বসতে পারি, ইফ ইউ আর নট ডিস্টার্বড।

পান্না মাথা নেড়ে বলল, না না, ডিস্টার্বড হব কেন? এসো। মে

য়েটা বারান্দায় উঠে এসে পেতে রাখা কাঠের চেয়ারে বসল।

খুব সাহস হয়ে যাচ্ছে পান্নার। এই ইংরিজি বলা বিলেত ফেরত মেয়েটার সঙ্গে টক্কর দেওয়া তার কর্ম নয়। তবু কী জানি সুন্দর মেয়েটার এমন মলিন চেহারা দেখে তার মায়া হচ্ছিল।

কোথায় যাচ্ছিলে ভাই?

কোথাও না। বাড়ির বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করছিল।

এক গেলাস জল দেব? খাবে?

মেয়েটা অবাক হয়ে বলে, জল খাব কেন? আমার তেষ্টা পায়নি তো!

তুমি তো বেশ বাংলা বলতে পার। আমি ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় বাংলা জানোই না।

 মেয়েটা হাসল, বলতে পারি, পড়তে পারি, লিখতেও পারি একটু একটু।

 বিদেশে যারা থাকে তাদের ওরকম হয়।

মেয়েটা একটু হাসল। হাসলে এত সুন্দর দেখায় ওকে।

দু চোখে তৃষিতের মতো মেয়েটাকে দেখে নিচ্ছিল পান্না। যেন এক পরি এসে আলগোছে বসেছে তাদের বাড়িতে। একটু পরেই উড়ে যাবে।

তোমরা কি বেড়াতে এসেছ?

মেয়েটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, বেড়াতে! তাও বলতে পার, সর্ট অফ এ চেঞ্জ। কলকাতার পলিউশনে আমার অ্যালার্জি হয়। অ্যাজমার মতো। ডাক্তার বলেছে মাঝে মাঝে বাইরে গিয়ে থাকতে হবে।

কিছুদিন থাকবে তো?

না। আই হ্যাভ মাই স্টাডিজ। আজ বাবা আসবে। তারপর আমরা হয়তো ফিরে যাব।

এ-জায়গাটা তোমার ভাল লাগছে না?

ভাল, কিন্তু একটু হ্যাপহ্যাজার্ড। কোনও প্যাটার্ন নেই। আর নেই বলেই আমি ভুল করে তোমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছি।

ভাগ্যিস নেই। থাকলে তোমার সঙ্গে ভাবই হত না। তুমি কিছু খাবে?

না তো! আই অ্যাম নট হাংরি।

মুখ দেখে পান্নার মনে হল মেয়েটা মিথ্যে কথা বলছে। মুখটা শুকনো, খিদের ছাপ আছে।

তোমরা কি ভাত ডাল খাও?

 কেন খাব না? তবে আই প্রেফার চাইনিজ।

উঃ, চাইনিজ আমারও ভীষণ ভাল লাগে। কলকাতায় গেলেই আমি চাইনিজ খাই। তবে অনেকে বলে কলকাতার চাইনিজ নাকি আসল চিনে খাবার নয়।

হ্যাঁ। অন্যরকম।

আমাদের বাড়িতে অনেক রকম আচার আছে। খাবে?

 মেয়েটার চোখদুটো একটু উজ্জ্বল হল। মুখে একটু হাসি। বলল, ইউ আর এ রিয়েল চার্মার।

খাবে?

মেয়েটা এক গাল হেসে ঘাড় কাত করে বলল, খাব।

তা হলে এসো, কোন আচারটা খাবে পছন্দ করে দাও।

 মেয়েটা লক্ষ্মীর মতো উঠে তার সঙ্গে এল। সহবত জানে। ঘরে ঢোকার সময় চটিজোড়া বাইরে ছেড়ে রাখল।

পান্না যখন তাক থেকে আচারের বয়ম নামাচ্ছে তখন সোহাগ ঘরের চারধারটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। পান্নারা গরিব নয়। তবে ঠাঁটবাটও তেমন কিছু নেই। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরদোর।

ওয়া! সোনি টু থাউজ্যান্ড মিউজিক সিস্টেম! বিগ সাউন্ড।

 পান্না একটু হাসল, হ্যাঁ, বড্ড আওয়াজ ওটার।

ক্যাসেটের কেসটা দেখতে দেখতে সোহাগ বলল, রক মিউজিক, জ্যাজ এসব তুমি শোনো বুঝি?

না বাবা, ওসব আমার দাদা শোনে। আমাকেও জোর করে বসিয়ে শোনায়। আগে কিছু বুঝতাম না, শুনতে শুনতে এখন একটু-আধটু বুঝতে পারি।

তোমার দাদা কোথায়?

ও তো কলকাতায়। যাদবপুরে ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনিয়ারিং পড়ে। আচ্ছা, আচার খেলে তোমার আবার অ্যাজমা বাড়বে না তো!

না। আমার অ্যালার্জিটা পলিউশন থেকে হয়। ডাস্ট, স্মোক এইসব থেকে।

পাঁচরকম আচার প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে পান্না ভাবল এই ফুলপরিকে আর কী দেওয়া যায়। তার আরও কিছু সাজিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে যে!

এই সোহাগ, তুমি শুধু আচার কী করে খাবে?

 সোহাগ অবাক হয়ে বলল, আচারটাই তো খাবার।

পান্তাভাত আছে। খাবে?

সোহাগ হেসে ফেলল, তুমি ভারী সুইট মেয়ে তো!

 খেয়েছ কখনও? লেবুপাতা দিয়ে মেখে খেতে বেশ লাগে। খাও না।

সোহাগ লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘাড় কাত করে বলল, দাও।

পান্না এক ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে পান্তাভাত একটা চিনেমাটির বাটিতে করে নিয়ে এল। সঙ্গে লেবুপাতা, নুন।

মাখতে পারবে? না মেখে দেব?

 মৃদু হেসে সোহাগ বলে, তুমিই মেখে দাও।

ঘেন্না পেও না কিন্তু। আমার হাত পরিষ্কার। তবু সাবান দিয়ে ধুয়ে আসছি।

 যখন সোহাগ খাচ্ছিল তখন খাওয়ার ধরন থেকে তার খিদেটা বুঝতে পারল পান্না। সামান্য পান্তাভাত কত যত্ন করে খাচ্ছে।

একটা ডিম ভেজে দেব তোমাকে? এক মিনিট লাগবে।

সোহাগ মিষ্টি করে হেসে বলে, এর সঙ্গে ডিম ম্যাচ করবে না। ইটস ভেরি টেস্টফুল। তোমার হাতের গুণ আছে।

আমার হাতের কোনও গুণ নেই। পান্তাভাত দিতে হল বলে লজ্জা করছে।

কেন, লজ্জা কীসের? আমরা বিদেশেও পান্তাভাত খেয়েছি। বাবা খুব ভালবাসে কি না। আচ্ছা, তোমার বাড়ির লোকেরা সব কোথায় বলো তো! কাউকে দেখছি না।

আমার জ্যাঠামশাই গৌরহরি চট্টোপাধ্যায় মারা গেছেন তো, আজই তাঁর শ্রাদ্ধ। সব সেই বাড়িতে।

ইউ মিন পারুলের বাড়ি!

অবাক হয়ে পান্না বলে, তুমি চেনো নাকি?

সোহাগ একটু হাসল, চিনি। শি লুকস লাইক এ গডেস।

হ্যাঁ। আমাদের বংশে ওরকম সুন্দরী আর কেউ নেই। তারপর একটু লজ্জা-লজ্জা মুখ করে রাঙা হয়ে পান্না বলে, জান তো একসময়ে তোমার বাবার সঙ্গে পারুলদির বিয়ে হওয়ারও কথা হয়েছিল। সেসব অবশ্য আমার জন্মেরও আগেকার ঘটনা। বিয়েটা হলে আজ তুমি আমার বোনঝি হতে, জানো? আমি হতুম তোমার মাসি।

খুব হাসল সোহাগ, মাসি? তোমার বয়স কত বলো তো!

 সতেরো চলছে।

সতেরো প্লাস?

না, ষোলো প্লাস।

আমার সতেরো প্লাস। তোমার চেয়ে আমি বড়। ভেরি ইয়ং মাসি।

ভারী ভালই তো মেয়েটা। একটুও তো দেমাক দেখাচ্ছে না। সন্ধ্যাদিটা যে কী আজেবাজে বলে! তবে মেয়েটার এঁটোকাঁটার বিচার নেই। ভাত খেতে খেতে কতবার যে চুলে হাত দিয়ে পাট করল, কোলের ওপর বাটিটা রাখল। তা হোক, ওরা কি অত সব শিখেছে তাদের মতো?

মাঝে মাঝে একটু উদাস হয়ে যায় মেয়েটা। মুখে একটা বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে। ভাত খেয়ে মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে কুলুঙ্গিতে গণেশের মূর্তিটার দিকে চেয়ে রইল। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে তার দিকে চেয়ে বলল, দে ওয়্যার ইন লাভ, বাট দে ডিড নট ওয়েড। পারুলের মেয়ে হলে আমি অন্যরকম হতাম। তাই না? কী অদ্ভুত!

পান্না কথাটা ভাল বুঝতে পারল না। আবছা মনে হল, পারুলের মেয়ে হয়ে জন্মায়নি বলে ওর একটু বুঝি দুঃখ আছে।

মেয়েটা ফের যেন, পান্নাকে নয়, আকাশ বাতাসকে বলল, ইউ ক্যান্ট চুজ ইওর পেরেন্টস। ক্যান ইউ?

এ কথাটাও পান্না বুঝল না। মেয়েটার মনে বোধহয় একটা কষ্ট আছে। কিন্তু পান্না কী বলবে! মুখখানা হাসি-হাসি করে বসে রইল, যদিও কথাটা মোটেই হাসির নয়।

বাটিটা রেখে মেয়েটা উঠল। বলল, থ্যাংক ইউ ফর এভরিথিং।

আবার আসবে না?

হাসি মুখে সোহাগ বলে, আসব। ইউ আর সিম্পলি চার্মিং। তুমিও চলে আসতে পার। তবে ইউ মে নট লাইক আওয়ার লট। আমরা একটা আনহ্যাপি ফ্যামিলি।

পান্না জানে, এখন কৌতূহল প্রকাশ করা উচিত নয়। তাই সে বলল, তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে।

থ্যাংক ইউ।

তোমাকে পথ দেখিয়ে দেব? নইলে ফের রাস্তা গুলিয়ে ফেলে অন্য কারও উঠোনে গিয়ে উঠবে হয়তো।

সোহাগ হেসে ফেলল, না না, পারব।

মানুষ চলে গেলেও তার একটা রেশ থেকে যায়। কিছুক্ষণ রেশটা বাতাসে অনুভব করল পান্না। দু একটা কথা যেন গুনগুন করে উড়ে বেড়াতে লাগল তার চারপাশে।

কালো কলকা পাড়ের সাদা খোলের শাড়িটা পরে নিতে নিতে সে দেয়ালঘড়ির দিকে চাইল। একটা পাঁচ। আজ মায়ের বকুনি খেতে হবে। বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে।

ফুল ফুটলেই যেমন মৌমাছি এসে জোটে তেমনই যেন পারুলদিকে ঘিরে মেয়েপুরুষের একটা ছোট্ট ভিড়। একে সুন্দরী তায় বড়লোকের বউ। বাবার কাছে শুনেছে ওদের নাকি বছরে দশ বারো কোটি টাকার টার্নওভার। টার্নওভার কথাটার মানেই জানে না পান্না। ব্যবসাবাণিজ্যের কথা সে কী বুঝবে? তবে ওদের যে অনেক টাকা সেটা আঁচ করতে পারে।

এই, কাছে আয় তো! বাঃ, দিব্যি মিষ্টি হয়েছিস তো দেখতে।

 যাঃ, তোমার কাছে আমি! কী যে বলো!

বেশি সুন্দরী হওয়া কি ভাল? এরকমই ভাল। রোগা কেন রে!

পান্না লজ্জা পেয়ে বলে, এমনি। আমার গায়ে মাংস লাগতেই চায় না।

শেষবার যখন তোকে দেখেছিলুম তখনও ফ্রক পরতিস।

এখনও পরি।

পরিস? তোর মতো বয়সে আমিও পরতুম। কিছুতেই বড় হতে ইচ্ছে হত না। কিন্তু বয়স কি আটকানো যায় বল! চোরাপথে ঠিক বয়স বেড়ে যায়।

কিন্তু পারুলদি, তোমার তো একটুও বয়স বাড়েনি।

তোর চেয়ে আমি কুড়ি বছরের বড় তা জানিস? তুই যদি যুবতী তো আমি থুত্থুড়ি।

হি হি করে হেসে ফেলে পান্না। কী মিষ্টি গন্ধ আসছে পারুলদির গা থেকে। আজ সাজেনি একদম, তবু চারদিকে যেন রূপের ঢেউ ভেঙে পড়ছে। চারদিকে মুগ্ধ দৃষ্টির ভিড়।

পান্না সরে এল। এটুকুই ভাল। এর চেয়ে বেশি ভাল নয়। পারুলদি ঈশ্বরীর মতো। সাঁইত্রিশেও ব্যালেরিনার মতো শরীর, গজদন্তের মতো রং, ভগবানের অনেক পরিশ্রমে তৈরি মুখের ওই কারুকার্য। এত সুন্দরীর নাকি সুখী হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কপাল। স্বামীর সোহাগ যে মেয়েদের মুখে ফুটে থাকে। তাকে কি লুকোনো যায়। দূর থেকে ওই সোহাগের আলো স্পষ্ট দেখতে পেল পান্না পারুলের মুখে। ওর মেয়ে হয়ে জন্মায়নি বলে সোহাগের কি খুব দুঃখ?

বড় জ্যাঠামশাইয়ের আত্মা আজ প্রেতলোক ছেড়ে দেবলোকে চলে গেল। ভিড়ে ভিড়াক্কার মণ্ডপ। লুচি ভাজার গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল পান্নার।

এই, তুই কোথায় ছিলি রে এতক্ষণ! খুঁজে খুঁজে মরছি।

এক দঙ্গল মেয়ে ধেয়ে এল। পনেরো ষোলো সতেরো আঠেরোর পায়েল, নয়না, ঝুমুর, রুমকি, পুকু। তারপর হা-হা, হু-হু, হি-হি। দমকা বাতাসে মনের সব ধুলোময়লা উড়ে গেল। তারপর একসঙ্গে বসে খাওয়া আর খেতে না পারা।

তারও পর একসময় নির্জন আর একা হয়ে যেতে হয়। সন্ধ্যা নামে। শাঁখ বাজে। প্রেতলোকের অন্ধকার থেকে ধোঁয়াটে ভূতেরা নেমে এসে ঝুলে থাকে একটু ওপরে। তখন কান্না পায়। তখন রোজ মরতে ইচ্ছে করে। তখনই মন কু-ডাক ডাকতে থাকে, গায়ে আগুন, না গলায় দড়ি? গলায় দড়ি, না গায়ে আগুন?

দশ দিন গান-টান গাওয়া নিষেধ ছিল অশৌচ বলে। আজ হারমোনিয়াম নিয়ে বসল একটু। অমনি মা এসে হাজির।

এখন আবার হারমোনিয়ম নিয়ে বসলি কেন? সামনে পরীক্ষা না?

মনটা খারাপ লাগছে মা।

রোজই মন খারাপ, রোজই শরীর খারাপ, এ কেমনধারা কথা? গতর বসিয়ে রাখলে যে শুঁয়োপাকা ধরবেই।

মা তাকে দু চোখে দেখতে পারে না। মা সবচেয়ে বেশি ভালবাসে দাদাকে, তারপর হীরাকে। পান্না তার দু চোখের বিষ, যেন সৎ মেয়ে। আজ কেন যে কান্না পেল খুব। হারমোনিয়াম তুলে রেখে পড়ার টেবিলে বসে সে বই খুলে চেয়ে চোখের জলে বুক ভাসাতে লাগল। মরবে, সে একদিন মরে সবাইকে ঠিক এইরকম কাঁদিয়ে ছাড়বে।

কান্না থেকে ঢুলুনি, ঢুলুনি থেকে ঘুম।

মাস ছয়েক আগে এরকমই এক সন্ধেবেলা সাঁঝঘুম থেকে তাকে ঠেলে তুলেছিল মা। বকাঝকা নয়, বরং খুব আহ্লাদের গলায় বলেছিল, ওরে ওঠ, ওঠ, দেখ কারা এসেছে।

অবাক হয়ে বলল, কারা এসেছে মা?

ওরে তারা মস্ত মানুষ, বিরাট গাড়ি নিয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি চোখে মুখে জল দিয়ে আয় দেখি।

কিচ্ছু বুঝতে পারেনি সে। চোখে জল দিয়ে আসতেই মা বলল, ওই শাড়ি বের করে রেখেছি। চুল টুল আঁচড়ে একটা টিপ পরো, শাড়িটা ঠিকমতো পরবে কিন্তু, কুঁচি-টুচিগুলো লক্ষ রেখো। মুখে একটু পাউডার দিয়ে নিয়ে বাইরের ঘরে এসো। হড়বড়িয়ে এসো না, ধীরে সুস্থে।

কিচ্ছু বুঝতে পারেনি পান্না। ঘুমচোখে সাজতে কারও ভাল লাগে।

হীরা এসে উত্তেজিত চোখমুখে বলল, ইস, কী বিরাট গাড়ি রে দিদি, একেবারে ঝকমক করছে। উর্দিপরা ড্রাইভার।

ওরা কারা?

তোকে দেখতে এসেছে।

দেখতে এসেছে! দেখতে এসেছে কেন?

 এ মা, তোর বিয়ের কথা হচ্ছে না?

মাথায় বজ্রাঘাত হলে বোধহয় এরকমই অবশ হয়ে যায় মানুষ। ছয় মাস আগে যে সবে ষোলো পেরিয়েছে, এর মধ্যেই বিয়ে? সে বিছানায় বসে পড়ে খাটের বাজুতে মাথা রেখে ঝিম ধরে রইল। বুকে ধড়ফড়ানি তো ছিলই, তার ওপর বমি বমি ভাব হতে লাগল। তখনও মনে হয়েছিল, মরি।

কী সুন্দর সুন্দর সব চেহারা ওদের। ফর্সা টকটক করছে। গিন্নিমার গা ভর্তি গয়না। সেজে আয় না একটু।

একটুও নড়েনি পান্না। ঝিম ধরে বসেই ছিল। মাথা ঘুরছিল তখন।

মা এসে বলল, এ কী! শরীর খারাপ করল নাকি? সর্বনাশ। ওঁরা যে বেশিক্ষণ বসবেন না। ওঠ ওঠ, লক্ষ্মী মা আমার। অমন করতে নেই। ব্যস্ত মানুষ ওঁরা, সময় করতে পারেন না বলে অসময়ে এসেছেন। এই রাতেই ফের বর্ধমানে ফিরে যাবেন। উঠে পড় মা।

কেমন বোধহীন, যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো সে উঠল, সাজল এবং বৈঠকখানায় গেল।

বৈঠকখানা আলো করেই কর্তা-গিনি, দুজন যুবক যুবতী এবং একজন বয়স্ক মানুষ বসা। চা খাবার দেওয়া হয়েছিল, ছোঁয়ওনি। তবে তাকে দেখেছিল ড্যাব ড্যাব করে।

বাবা বলে উঠল, গান জানে, লেখাপড়াতেও ভাল।

কর্তা বোধহয় তার নাম জিজ্ঞেস করেছিল, গিন্নি জিজ্ঞেস করেছিল তার বয়স কত। খালি গলায় একটা গানও শোনাতে হয়েছিল, মনে আছে। অমন শুকনো গলায় প্রাণান্তকর গান সে জীবনে গায়নি।

তারা বাবাকে জানিয়ে গিয়েছিল, এই মেয়ে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। এখন কোষ্ঠী মিললেই হয়।

বাবার সেই রাত্রে কী আস্ফালন, বড়দা ভেবেছে তার মেয়ের মতো পাত্র আর কারও জুটবে না? অ্যাঁ! এই যে পাত্রপক্ষ দেখে গেল এরা দশটা জ্যোতিপ্রকাশ গাঙ্গুলিকে কিনতে পারে।

কিছুদিন বাবাকে ওই পাগলামি পেয়ে বসেছিল। গৌরহরি চাটুজ্যে দুই ভাইকে টাকা দিয়ে পৈতৃক বাড়ির দুটো অংশ কিনে নেন। সেখানে কোনও গোলমাল ছিল না। দুই ভাই নরহরি আর রামহরি কাছাকাছি নিজেদের বাড়ি করে ফেলেছিল। গোলমাল বেঁধেছিল জিনিসপত্র, বাসন-কোসন এবং গয়নাগাঁটি ভাগাভাগি নিয়ে। গৌরহরি চাটুজ্জে তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিত্তশালী এবং প্রবল ব্যক্তিত্বওলা লোক। তার ওপর দুঁদে উকিল। মামলা মোকদ্দমা না হলেও সালিশির বিচারে দুই ভাই হেরে গেল। রামহরির সেই থেকে হঠাৎ হীনম্মন্যতা দেখা দেয়। তার হঠাৎ মনে হয়েছিল বড়দা যেন বড্ড উঁচুতে উঠে গেছে। এর একটা বিহিত করতেই হবে। নানাভাবে রামহরি গৌরহরিকে টপকানোর একটা অক্ষম চেষ্টা করেছিল কিছুদিন। তার মধ্যে একটা ছিল বড়লোক হওয়ার চেষ্টা। লটারির টিকিট কেনা, পলিটিক্সে নাম, ঠিকাদারি, পতিত জমি কিনে চাষ আবাদ। তাতে রামহরি কোনওটায় সফল, কোনওটায় বিফল হলেও গৌরহরিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। গৌরহরির মেয়ের বিয়েটাও তার চক্ষুশূল হয়েছিল। জামাই ছোটখাটো শিল্পপতিই শুধু নয়, অতিশয় সজ্জনও। রামহরি জামাই-ধরা প্রতিযোগিতায় বড়দাকে হারিয়ে দিতে কিছুদিন মরিয়া হয়ে নাবালিকা মেয়ের জন্য বড় বড় পাত্র ধরতে লেগে গিয়েছিল।

ভাগ্যিস এই পাগলামি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। হলে এতদিনে পান্না কোনও বড়লোকের বাড়ির বউ হয়ে নির্বাসনে যেত। কে জানে বাবা। জীবনের রহস্যময় নানা আনন্দের শিহরন কোথায় হারিয়ে যেত। একদিন বিবেচক গৌরহরিই এসে রামহরিকে ঠান্ডা মাথায় কথা বলে শান্ত করলেন। বললেন, ভাগজোখ যদি তোর অন্যায্য বলেই মনে হয়ে থাকে তবে আমাকে এসে বলিস না কেন? যা চাস পাবি। পরিবারটাকে বিপদে ফেলিস না।

ভাব হয়ে যাওয়ায় তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল।

এই মুখপুড়ি, সন্ধেবেলায় ঘুমুচ্ছিস যে!

মুখে জোরালো টর্চের আলো পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসে পান্না।

ও মা! পারুলদি!

কাল চলে যাচ্ছি, তাই দেখা করতে এলাম।

এ সময়ে ভোল্টেজ কম থাকে বলে ঘরের টিমটিমে আলোয় ভাল করে কিছু দেখাই যায় না। তবু এই ম্লান আলোতেও যেন জ্যোতির্ময়ীর মতো দেখাচ্ছে পারুলদিকে।

তুমি যে কী করে এত সুন্দর থাকো কিছুতেই বুঝতে পারি না।

 দুর বোকা, সুন্দর আর কোথায়! মা বলছিল রং নাকি অনেক কালো হয়ে গেছে। বয়সও কি কম হল? সাঁইত্রিশ। ও বাবা, সাঁইত্রিশ মানে তো বুড়ি।

তোমার একটুও বয়স হয়নি পারুলদি।

 হয়েছে হয়েছে। অনেক কষ্ট করে ফিট রাখতে হয়। এক চুল এদিক ওদিক হলেই ওজন চট করে বেড়ে যেতে চায় আজকাল।

একটা মেয়ের সঙ্গে আজ ভাব হল, জানো! তার নাকি খুব ইচ্ছে ছিল তোমার মেয়ে হয়ে জন্মায়।

 পারুল অবাক হয়ে বলে, সে কী রে! কে সেই মেয়েটা?

অমলদার মেয়ে সোহাগ।

পারুল একটু গম্ভীর হয়ে বলে, মেয়েটি এঁচোড়ে পাকা। ওর সঙ্গে বেশি মিশিস না।

 মিশব কী? আজ পথ ভুল করে এসে পড়েছিল বলে আলাপ হয়ে গেল। অমলদা আজ আসবে, কালপরশুই চলে যাবে ওরা।

অমল রায় আসেনি। ওদের মধ্যে একটু গণ্ডগোল চলছে বোধহয়। তুই বেশি মাখামাখি করতে যাস না। ওরা অন্যরকম। মাথা গুলিয়ে দেবে।

কিন্তু পারুলদি, মেয়েটাকে যে আমার ভীষণ ভাল লাগল। সে বলছিল, তুমি নাকি একজন গডেস।

পারুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, গডেস হওয়া কি অত সোজা? মেয়েমানুষ হয়ে জন্মালে কত পাপ চারদিক থেকে ফণা তোলে। গডেস হয়ে থাকতে দেয় কই?

একটু আনমনা হয়ে গেল পারুলদি। হাতের বড় টর্চটা কয়েকবার ছেলেমানুষের মত জ্বালাল, নেবাল।

তোর কত বয়স হল রে পান্না?

সতেরো।

সতেরো! বলে একটু ভাবল পারুলদি। ওই সতেরো শব্দটাই যেন পারুলদিকে একটু দূরে নিয়ে গেল। বোধহয় সতেরোয় ফিরে যাচ্ছিল সে।

তখনও জন্মায়নি পান্না। কুড়ি বছর আগে পারুলদির সঙ্গে প্রেম হয়েছিল অমল রায়ের। কীরকম প্রেম ছিল ওদের কে জানে। বিয়ে হয়নি। তাতে ভালই হয়েছে। বিয়ে হলে হয়তো প্রেমটা গ্যাদগ্যাদে হয়ে যেত।

তার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল, পারুলদি এখনও অমল রায়ের কথা ভেবে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিনা। ট্র্যাজেডি বড় ভাল লাগে পান্নার। ট্র্যাজেডির মতো এমন রোমহর্ষ আর কীসে আছে?

.

০৪.

মাঘ মাসের রাত দশটায় হঠাৎ বাই চাপল রুইমাছের কালিয়া খাব। খাবেন তো খাবেনই। হ্যারিকেন নিয়ে বড় ছেলে গৌরাঙ্গ আর চাকর শিবু গিয়ে পুকুরে জাল ফেলল। উঠল দশসেরী পেল্লায় এক রুই। কেটেকুটে রান্না করতে করতে রাত বারোটা। তৃপ্তি করে খেয়ে উঠে গৌরহরি গিয়ে শুয়ে পড়লেন। কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। কালিয়া খেতে চেয়েছিলেন, খাওয়া হয়েছে, ব্যাস আর কী। ওদিকে বাড়ির গিন্নিকে ওই রাতে পাহাড়প্রমাণ সেই মাছ সাঁতলাতে হল। পেটের খিদে পেটেই মরে গেল। যখন এক গেলাস জল খেয়ে শুতে গেলেন তখন ভোর হতে আর বাকি নেই। পরদিন সেই বিপুল মাছ পাড়াপ্রতিবেশীদের বিলি করা হয়েছিল, মাছের সঙ্গে সঙ্গে কালিয়ার গল্পও বিলি হল। বৃত্তান্ত শুনে এসে হাজির হয়েছিল মহিম রায়।

এসব কী হরিদা, বাড়ির পাঁচজনের সুখসুবিধের কথা যে একটুও ভাবেন না। এ কি ভাল?

গৌরহরি অতীব সুপুরুষ, গৌরবর্ণ, লম্বাচওড়া হাড়েমাসে চেহারা। মুখে একটু বিদ্রূপের হাসি, তুই খুব ভাবিস বুঝি? সেইজন্যই তোকে কেউ মানে না।

কথাটা পাথুরে সত্যি। একটা লোক কীভাবে আধিপত্য করে, কোন মন্ত্রবলে মান্যগণ্য হয়ে ওঠে এ তত্ত্বটা আজও বোঝা হল না মহিমের।

একটা মামলার রায় বেরোল বিকেলে। সতেরো জন ফৌজদারি মামলার আসামি। খালাস হতে হতে সন্ধে পেরিয়ে গেল যখন, তখন আর তাদের বাড়ি ফেরার বাস নেই। ট্যাঁকেও নেই পয়সা। গৌরহরি বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে বর্ধমান থেকে তাদের সোজা নিজের বাড়িতে এনে তুললেন। সতেরোটা উপোসি ষণ্ডামার্কা গেঁয়ো লোক। এমনিতেই তারা ভাতের পাহাড় এক চোপাটে উড়িয়ে দেয়। সেদিন তারা দুনো খিদে নিয়ে যে পরিমাণ ভাত খেল তা টিকিট কেটে দেখার মতো দৃশ্য। সতেরোটা মুখের ভাত ডাল জোগাতে বাড়ির গিন্নির কী হাল হল তা ফিরেও দেখেননি গৌরহরি। ওটা দেখা যেন তার কাজ বা কর্তব্য নয়।

তিন ভাইয়ের পৈতৃক বাড়ি। দালানকোঠা জমি নিয়ে বিরাট সম্পত্তি। হঠাৎ গৌরহরির খেয়াল হল দুই ভাইয়ের অংশ কিনে নিতে হবে। প্রস্তাব উঠতেই রামহরি আর নরহরি গাঁইগুঁই করতে লাগল। পৈতৃক ভিটে ছাড়বে না। গৌরহরি তখন দাম বাড়াতে লাগলেন। শেষমেশ সেই দাম এত অবিশ্বাস্য রকমের উঁচুতে তুলে দিলেন যা দিয়ে গোটা বাড়িটাই দুবার কেনা যায়। তখন আর ভাইরা আপত্তি করল না, আপত্তি করাটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু আপত্তি তুলতে পারত বাড়ির লোকেরাই। দুই উপযুক্ত ছেলে, গিন্নি। তারা বুঝিয়ে বলতে পারত, এরকম আকাশছোঁয়া দাম দিয়ে দুটো অংশ কেনা আহাম্মকি হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কেউ শ্বাসটুকুও ফেলেনি।

কিন্তু মহিম রায় বলেছিল, দাদা, এ যে হাতির দামে নেংটি ইঁদুর কেনা হল!

গৌরহরির প্রতিক্রিয়া হল সামান্যই। ভ্রূ দুটো একটু উঁচুতে তুলে বললেন, দামের তুই জানিস কী? সারা জীবন চার আনা আট আনার হিসেব কষে মরলি, দাম কাকে বলে তা শিখলি কই?

মহিম আর পারেনি। বলে ফেলেছিল, আপনি যেন শরৎ চাটুজ্জের নবেলের ক্যারেক্টার, রক্তমাংসের মানুষ নন।

গৌরহরির ঠোঁটে বাঁকা বিদ্রূপের হাসিটি বদলাল না। ঠান্ডা গলায় বললেন, তুই বড্ড গেরস্ত। অত গেরস্ত হোস না, কষ্ট পাবি।

যে সুরে চাকর-বাকরকে হুকুম করতেন সেই একই সুরে নিজের দুই ছেলেকেও হুকুম করতেন। ছেলে দুটো দিশেহারা হয়ে বাপের হুকুম তামিল করতে ছুটত। ফুলের মতো সুন্দর দুটো মেয়েও কদাচিৎ আসকারা পেত তাঁর কাছে। ছেলেপুলেদের নাড়াঘাঁটাও করতেন না বড় একটা।

সেই মেজাজি, অহংকারী, দাপুটে এবং খানিকটা আত্মসর্বস্ব ও অত্যাচারী পুরুষটি যখন মারা যাচ্ছিলেন তখন মহিম রায় সেখানে আগাগোড়া উপস্থিত। ডাক্তার নাড়ি দেখছেন, আর পুরো পরিবারটা একাগ্র হয়ে ঝুঁকে আছে তাঁর ওপর। চোখ পলকহীন। শ্বাস পড়ছে না কারও। শিয়রে পাথরপ্রতিমার মতো বউঠান। ডাক্তারের একটা নেতিবাচক মাথা নাড়ার পরই একটা দীর্ঘ হাহাকারে ভরা আর্তনাদ করে বউঠান অজ্ঞান হয়ে সোজা মেঝেতে পড়ে গেলেন। দুই ছেলে আছড়ে পড়ল বাবার বুকে। দুটি পুত্রবধূ দুই পা আঁকড়ে ধরে সে কী কান্না!

সারাটা জীবন যে পরিবারটিকে নাজেহাল করে ছেড়েছেন গৌরহরি, যাঁর মর্জি সামলাতে পরিবারের লোকজনকে ধিন ধা নাচতে হয়েছে, তাঁর মৃত্যুতে তো পরিবারটার হাঁফ ছাড়ার কথা। কিন্তু সেরকম হল না তো! বরং মনে হল, গৌরহরির সঙ্গে সঙ্গে যেন এ বাড়ির সূর্যাস্ত হয়ে গেল।

জ্ঞান ফেরার পর বউঠান কেবল বলছিলেন, আমি ওঁর সঙ্গে যাব, কিছুতেই আমি আর বেঁচে থাকতে পারব না।

মহিম রায় মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখছিল, মুগ্ধ কানে শুনছিল। এ সে শুনছে কী? একজন স্বাধিকারপ্রমত্ত অত্যাচারী স্বামীর নির্যাতিতা স্ত্রী বলছে এ কথা? এও কি সম্ভব?

মেলে না, মেলে না, হিসেব কিছু মিলতে চায় না। এই ঊনআশি বছর বয়সে জীবনের অঙ্কে ভুল ধরা পড়ে সে যেন মনে মনে কানমলা খায়। হরিদার কাছে সে অনেক ব্যাপারেই হেরে-যাওয়া মানুষ, কিন্তু মরার ভিতর দিয়ে সেই পরাজয়ের বিপুলতা যেন আরও উদঘাটিত করে দিয়ে গেছে লোকটা।

যে ছেলেটিকে বাপের খেয়াল মেটাতে মার্চ মাসের হাড়কাঁপানো শীতের রাতে পুকুরে জাল ফেলে মাছ তুলতে হয়েছিল, ফিজিক্সের কৃতী অধ্যাপক সেই ছেলে ঝন্টু বাপের বুক থেকে হঠাৎ মুখ তুলে ছোট ভাইকে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে উঠল, এই মন্টু, দেখ দেখ, বাবার বুকে যেন হার্টবিট পাচ্ছি! কেমন শব্দ হচ্ছে বুকের মধ্যে। বাবা নিশ্চয়ই মরেনি! ফকিরবাবার জল-পড়া খাইয়েছি, মরতে পারেই না।

কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছোট ছেলে মন্টু ভ্যাবলার মতো বাবার বুকে কান পেতে কী শুনছিল কে জানে। কিন্তু মহিমের মনে হচ্ছিল, ফকিরবাবার জল-পড়ার গুণ নয় বাবারা, বেঁচে উঠলে হরিদা তোমাদের পিতৃভক্তির জোরেই বেঁচে উঠত। ঘোর কলিকাল বাবারা, নইলে এত ভালবাসা বৃথা যেত না।

দুটি ছেলে সারাজীবন বাপের সঙ্গে কথা বলার সময় দাঁড়িয়ে কথা বলেছে, কখনও বসেনি। বউমারা এই আধুনিক যুগের মেয়ে হয়েও শ্বশুরের সামনে ঘোমটা ছাড়া আসেনি। শোকের বাড়ি যখন মুহ্যমান, চারদিকে কান্নার রোল, তখন মহিম মৃতের ঘরে আনন্দে অভিভূত হয়ে বসে আছে। তার চারদিকে যেন সত্যযুগের হাওয়া বইছে।

শরীর ভাল নয়, সবাই বারণও করেছিল, তবু মহিম রায় গৌরহরির মৃতদেহের অনুগমন করেছিল। তখন গভীর রাত, তিন মাইল রাস্তা ভেঙে যেতে যেতে মনে মনে বলেছিল, কায়দাটা শিখিয়ে দিয়ে গেলেন না হরিদা! বহুকাল ধরে চেলাগিরি করলুম তবু শিখতে পারলুম কই? না কি এসব শেখার বা শেখাবার জিনিসই নয়, এসব কেউ কেউ নিয়ে আসে।

না, মহিম রায় কখনও গৌরহরি চাটুজ্জের মতো ছিল না। সে বরাবর তার পরিবারের প্রতি অত্যধিক স্নেহশীল। পাঁচজনের দুঃখকষ্টের কথা ভেবে সর্বদাই নিজেকে আরাম আয়েস থেকে গুটিয়ে রেখেছে, এক গেলাস জল কাউকে গড়িয়ে দিতে বলতেও ছিল ভারী কুণ্ঠা। ছেলেদের সঙ্গে এক সারিতে খেতে বসেছে, বড় মাছের টুকরোগুলো ছেলেদের পাতেই দিয়েছে দেবিকা–তার বউ। কখনও তাতে কিছু মনে করেনি মহিম। ভুলটাও কি সেখানেই? তখন থেকেই কি সংসারে সে উদ্বৃত্তের খাতে?

যখন মেজো ছেলে অমল ক্লাসে কাঁড়ি কাঁড়ি নম্বর পেয়ে ফাস্ট হওয়া শুরু করল তখন হল আরও চিত্তির। প্রথমে আনন্দ এবং বিস্ময়। পুত্ৰগৌরবে বুক তিন ইঞ্চি বেড়ে গেল। মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করে যখন সেই ছেলে হইচই ফেলে দিল তখন এল ভয়। ছেলেকে সেই থেকে সমীহ করতে শুরু করেছিল সে। বাপকে কোনওদিনই ছেলেরা সমীহ করত না। অমলের তাচ্ছিল্যটা ছিল আরও প্রকট। কৃতী ছেলেদের বোধহয় সেই অধিকার জন্মায়–এই ভেবে মহিম মেনেও নিল ব্যাপারটা। দেবিকা মাঝে মাঝেই বলত, অমল! অমল তো মানুষ নয়, ভগবান।

জিন থেকেই সব হয়-টয় বলে শুনেছে মহিম। বংশধারার কোন গাঁটে কোন জিন যে ঘাপটি মেরে থাকে আর তা থেকে কী করে যে এক একজন এরকম দলছুট জন্মায় কে জানে! নইলে তার মতো অ্যাভারেজ সাদামাটা মানুষের ঘরে অন্য সব সাদামাটা ছেলেমেয়ের মধ্যে একটা কী করে অমন মাথাওলা বেরোল!

ঠোঁটকাটা, বদরসিক রসময় একবার বলেছিল, ওরে, এ যে কাকের ঘরে কোকিলের ছা। তোর হাতে আর কেউ তামাক খেয়ে গেল না তো!

এ কথায় প্রায় হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। ঠাট্টাই হবে, তবু অমন ঠাট্টা কেউ করে? আজ অবশ্য কথাটা ভাবলে রাগ হয় না। অমল কি সত্যিই তার ছেলে? সে কি ওর নির্মাতা? ওর চোখ, কান, মুখ, মন, মেধা এসব তো মহিমের তৈরি নয় হে বাপু। সে জন্মদাতা হতে পারে, সৃষ্টিকর্তা তো নয়।

অমলের সঙ্গে ভাবভালবাসা হয়েছিল গৌরহরিদার ছোট মেয়ে পারুলের। সেটা মহিমের কাছে আনন্দের ব্যাপারই ছিল। হরিদার সঙ্গে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক তার আকাঙ্ক্ষারই বস্তু। তা ছাড়া ও বংশের মেয়ে ভালই হওয়ার কথা। যে মেয়ে নিজের বাবার সেবা করে বড় হয়েছে সে স্বামীর ঘরে এসেও সবাইকেই সুখী করে।

কিন্তু আচমকাই পারুলের অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।

মহিম রায় দৌড়ে গিয়েছিল গৌরহরির কাছে।

 হরিদা, এ কী শুনছি!

গৌরহরি বৈঠকখানায় বসে দলিলপত্র দেখছিলেন। তলচক্ষুতে তাকে একটু দেখে নিয়ে বললেন, কখনও প্রেমে-ট্রেমে পড়েছিস?

আমি! কী যে বলেন! আমাদের সুযোগ ছিল কোথায়?

তাহলে বুঝবি কী করে? ও-বস্তু আমারও তো হয়নি। পঁচিশ বছর বয়সে একটা দশ বছর বয়সি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল বাবা। সে প্রেম করবে কী, ভয়েই মরে। তাই বলছি এসব আমাদের বোঝবার কথা নয়।

কিন্তু ওদের যে ভালবাসা ছিল, বিয়ের কথা হয়ে আছে।

তাই তো বলছি। তুই কি ভাবছিস আমি জোর করে পারুলের বিয়ে অন্য জায়গায় দিচ্ছি? সেসব ভাবিসনি। অমল ভাল ছেলে, আমাদের সকলেরই পছন্দ। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে পারুলের ইচ্ছেতেই।

কেন এরকম হল হরিদা?

বললুম যে, তুই আর আমি দুজনেই পুরনো আমলের মানুষ, এসব আমাদের বোঝার কথা নয়। তবে এসব প্রেম-ট্রেম হল কাঁচা মাটির কাজ। জলে বৃষ্টিতে গলে ধুয়ে যায়। সংসারের আঁচে না পড়লে কি এসব পাকাপোক্ত হয়? ওদের প্রেম কেঁচে গেছে।

মনটা বড় দমে গেল মহিমের।

গণ্ডগোলটা কোথায় হল হরিদা?

গৌরহরি মাথা নেড়ে বলেছিলেন, সবটাই গণ্ডগোল, আগাপাশতলাই গণ্ডগোল। মন খারাপ না করে বাড়ি যা। অমলের একটা ভাল দেখে বিয়ে দে।

দেবিকা ফুঁসেছিল খুব, হুঁ, অমন সুন্দরী কত আমার অমলের পায়ে গড়াগড়ি যাবে। কত বড় ঘরের মেয়ে যেচে আসবে। দেখে নিও।

দেখা ছাড়া মহিমের কিছু করারও ছিল না। সংসারের প্রায় কোনও ব্যাপারেই তার মতামতের তোয়াক্কা কেউ করত না কখনও। পারুলের বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই অমল আর তার মায়ে মিলে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল। সেই বিয়েতে মহিমের ভূমিকা বরকর্তার মতো ছিল না, ছিল আমন্ত্রিত একজন অতিথির মতোই। বড় ঘরেরই মেয়ে, সুন্দরীও। কিন্তু মহিমের তেমন কোনও আহ্লাদ হল না। বিয়ের পরই ছেলে-বউ উধাও হয়ে গেল বোম্বেতে। তারপর বিদেশে। মুছেই গেল জীবন থেকে। যেমনটা হয়ে থাকে।

আজ তৃষিত চোখে বসে গৌরহরিদার দুই ছেলের পিতৃতর্পণ মন দিয়ে আগাগোড়া দেখছিল মহিম। দুটো ছেলেই নিষ্ঠার সঙ্গে হবিষ্যি করেছে, ন্যাড়া হয়েছে, নাবালক দুটি অনাথের মতো বসে বাবার স্বর্গের পথ পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। প্রচুর দানসামগ্রী, বিরাট আয়োজন। কোথাও কিছু অভাব রাখেনি। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। স্বর্গের পথ পরিষ্কার না হোক এত ভালবাসার কি দাম নেই নাকি? মহিম মরলে তার ছেলেরাও হয়তো নেড়া হবে। কিন্তু হবে বিরক্তির সঙ্গে। শ্রাদ্ধও কি করবে না? করবে, তবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে। মনে মনে বলবে, বাপটা মরে বড্ড ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে।

কাকা, অমন চুপটি করে বসে আছেন যে!

চোখ তুলে চোখ দুটো জুড়িয়ে গেল মহিমের। পারুল।

ক্লিষ্ট হেসে বলল, এই বসে বসে দেখছি।

ওসব আপনাকে দেখতে হবে না। বরং ঘরে এসে মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করুন।

বুদ্ধিমতী মেয়ে। হয়তো ভেবেছে, বুড়ো মানুষের এই বসে বসে অন্যের শ্রাদ্ধ দেখাটা বোধহয় ভাল হচ্ছে না।

মহিমের চোখে জল আসছিল। বলল, মরার কথা মনে হচ্ছে না মা, ভালবাসার কথা মনে হচ্ছে। হরিদা বড় ভাগ্যবান।

না কাকা, ওসব ভাবতে হবে না। ঘরে চলুন, এখানে যজ্ঞের ধোঁয়া লাগছে আপনার। মুখটাও তো শুকিয়ে গেছে! ডাবের জল খাবেন?

না মা, ওসব দরকার নেই।

তাহলে বরং আপনাকে এক কাপ চা দিই।

হাতে চায়ের কাপ নিয়ে অভিভূতের মতো বসে রইল মহিম। এইটুকু সমাদরও যেন অনেক। অমলের সঙ্গে পারুলের বিয়েটা হয়নি বলে আজ বিশ বছর বাদে নতুন করে বুকটা ব্যথিয়ে উঠছিল তার। চায়ে চুমুক দেওয়া হল না। হাতে ধরা চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে গেল, বুকের ভিতরটা হল না। একটা চাপা-পড়া আগুন বহুকাল বাদে ধীইয়ে উঠল।

সারাদিন আজ শ্রাদ্ধবাড়িতেই কেটে গেল মহিম রায়ের। গৌরহরিদা নেই, না থেকেও বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন। মরে যাওয়ার পরও এক একটা মানুষ বহুকাল থেকে যায়। ধ্যানে, শোকে, মনে পড়ায়, শূন্যতায় সে বারবার জীয়ন্ত হয়ে ওঠে। কারও কারও মরার পরেও মরে যেতে অনেক সময় লাগে।

সন্ধের পর ফিরছিল মহিম। বেলা ছোট হয়ে গেছে, টক করে বড্ড অন্ধকার হয়ে যায়। টর্চটাও আনেনি সঙ্গে। চোখের তেমন জোর নেই আজকাল। বেগুনক্ষেতের পাশ দিয়ে মেটে রাস্তা ধরে আনমনে ধীর পায়ে হেঁটে ফিরছে মহিম। বিষণ্ণতায় সামান্য নুয়ে-পড়া শরীর।

হঠাৎ আবছা আঁধারে একটা সাদা ছায়ামতো ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এসে আবার অন্ধকারে দ্রুত মিলিয়ে গেল। থমকাল মহিম। কে ওটা? আবার সাদা ছায়ামতো কী যেন দুলে উঠল সামনে। লহমায় মিলিয়ে গেল।

কে? কে রে?

কেউ জবাব দিল না। সামনে বুক সমান ফণীমনসার আড়াল। তার ওপাশে ফটিক কাঞ্জিলালের পতিত জমি। ফটিক বাড়ি করবে বলে জমিটা কিনে ভিতপুজো অবধি করেছিল। তারপর বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে আমগাছে ফাঁসি দিয়ে মরে। বাড়িটা আর হয়নি। জমিটা আগাছায় ভরা। মাঝখানে অভিশপ্ত আমগাছটা ঝুপসি হয়ে দাঁড়িয়ে। সাপ-খোপের আড্ডা। লোকে অশরীরীর ভয়ও পেত আগে। ফটিক নাকি ওখানেই গেড়ে বসে আছে, জ্যান্ত লোকদের মরার জন্য ডাকাডাকি করে।

মহিমের ভূতের ভয় নেই। কিন্তু সাদাটে ছায়াটা কীসের তা বুঝতে পারল না। এ সময়ে কুয়াশা একটু হয় বটে, কিন্তু কুয়াশা তো ছুটে বেড়াবে না। চোখেরই ভুল হল কি?

মহিম রায় গুটি গুটি আরও কয়েক পা এগোল। না, চোখের ভুল নয়। ফটিকের পতিত জমিতে বাস্তবিক একটা সাদা মূর্তি দু হাত দুদিকে পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ঘুরে ঘুরে ঢেউ হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। শিউরে উঠল মহিম। কত ইট কাঠ পড়ে আছে জমিতে, কত আগাছার দুর্ভেদ্য জঙ্গল। সাপ খোপ এবং হীন দংশক প্রাণীদের আড্ডা। কোনও মানুষ এই সন্ধেবেলা ওখানে যায় পাগল না হলে?

কে? কে রে ওখানে?

মূর্তিটা যে মেয়েছেলের তাতে সন্দেহ নেই। মহিম স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখতে লাগল। মেয়েটা ঢেউয়ের মতো শরীর বইয়ে দিচ্ছে, নানা বিভঙ্গে হেলে যাচ্ছে ডাইনে বাঁয়ে পিছনে। ঝুঁঝকো আঁধারে বোঝা যাচ্ছে গলা থেকে গোড়ালি অবধি একটা সাদা পোশাক পরে আছে মেয়েটা।

হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল এরকম একটা পোশাক কয়েকদিন আগে সোহাগকে পরতে দেখেছিল মহিম। পোশাকটার ওপর জরির বুটি আছে। নিজের নাতনি, কিন্তু ওর সঙ্গে ভাল করে পরিচয়ই নেই মহিমের। ওরা কথাটথা বিশেষ বলতে চায় না কারও সঙ্গে। একটা কঠিন, নীরব দূরত্ব বজায় রাখে। কিছুদিন আগে অমল হঠাৎ একদিন এসে ওদের পৌঁছে দিয়ে গেল। বলে গেল, ওরা এখন কিছুদিন এখানেই থাকবে। মেয়ের নাকি একটু চেঞ্জ দরকার। খরচের টাকাপয়সাও দিয়ে গেল দাদা কমলের হাতে।

একটু অবাকই হয়েছিল মহিম। ওরা কস্মিনকালেও কেউ এখানে আসে না। দু মাস চার মাস পরে হয়তো কখনও অমল এসে হাজির হয়, এক বেলা থেকেই চলে যায়। হয়তো চেনা দিয়ে যায়, সৌজন্য বজায় রাখে। অমল এলেও পরিবার কখনও আনে না। তাই ওদের সঙ্গে ভাব বা ভালবাসা কিছুই হল না। আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যাপারগুলো ক্রমেই বস্তাপচা বর্জ্য ধারণা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একদিন হয়তো বাপ-ছেলের সম্পর্কও ঘুচে যাবে। যাবে কেন, যাচ্ছেও ক্রমে ক্রমে। শ্বশুর, ভাসুর, দেওর, ননদ এসব শব্দ থাকবে শুধু ডিকশনারিতে। সেটা মহিম এই জীবনেই টের পেয়ে যাচ্ছে।

বউমাটি এসে প্রথম দিন তাকে একটা প্রণাম করেছিল। খুব ভক্তিভরে নয়, পা দুটো ভাল করে ছোঁয়ওনি, একটু ভান করেছিল মাত্র। ব্যস, তারপর সেই যে আলগোছ হল, তারপর আর মুখোমুখিই হল না একই বাড়িতে থেকেও। নিজেরা নিজেরা থাকে, নিজেদের মধ্যেই ইংরিজিতে কথা কয়, ঝগড়া টগড়ার শব্দও কানে আসে।

মহিমাদীপ্ত রায় নামে যে ছেলেটি একসময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরিজিতে এম এ পাস করেছিল তাকে আজকের মহিম রায় বলে চেনা মুশকিল। না, দুটো লোক এক নয়। মহিমাদীপ্তর দীপ্তি আর মহিমা দুটোই অস্তাচলে গেছে। এখন এই যে মহিম রায় নামে লোকটি এ এক গেঁয়ো ভিতু মানুষ, দেখলে মুখ্যু বলেই ধরে নেবে মানুষ। মুখ্যু ছাড়া আর কী? কবে দু পাতা অংবং ইংরিজি পড়েছিল তার জোরে কি আর বিদ্বান বলে পরিচয় দেওয়া যায়। লোকে ভুলে গেছে, মহিম রায় নিজেও ভুলে গেছে। কোন তোরঙ্গের অন্ধকারে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে পড়ে আছে সার্টিফিকেটখানা।

তবে ওই ডিগ্রির জোরে রেলে চাকরি পেয়েছিল মহিম রায়। শিয়ালদার ক্রু ইন চার্জ। কিন্তু বেশিদিন চাকরিটা করে উঠতে পারেনি। বদলির চাকরি, ঘুরে ঘুরে কয়েক জায়গায় বদলি হওয়ার পর শরীর খারাপ হতে লাগল, পেটে জাপ্পো আমাশা। বাবা বলল, চাকরির দরকার নেই, জোতজমি যথেষ্ট আছে, গাঁয়ের হাই স্কুলে ইংরিজির মাস্টারও দরকার। এলেই হয়।

সেই চলে আসা। কিছুদিন হাই স্কুলে ইংরিজি পড়িয়েছিল। তারপর বিদ্যাচর্চা সেই যে থেমে গেল আর চালু হয়নি।

ভুলেই গিয়েছিল সবাই, হঠাৎ বুঝি একদিন সন্ধ্যার মনে পড়ে গেল যে, তার বাবা ইংরিজিতে এম এ পাস। একদিন সন্ধেবেলা সে এসে হামলে পড়ল, ও বাবা, তুমি কী গো!

কেন, হলটা কী রে?

ওরা যে অত কটর কটর করে ইংরিজি বলে আমাদের দিনরাত জব্দ করছে, আর তুমি চুপ করে বসে আছ! তুমি না ইংরিজিতে এম এ পাস!

তাতে কী হল?

মুখের ওপর দুটো ইংরিজি কথা শুনিয়ে দিতে পারো না ওদের?

অবাক হয়ে মহিম বলল, কেন রে, ওরা ইংরিজি বলছে বলে আমি কেন ইংরিজি বলতে যাব?

কেন বলবে না শুনি? ওরাও দেখুক, আমরা ওদের চেয়ে কিছু কম নেই।

 মায়াভরে একটু হেসেছিল মহিম। তার এই মেয়েটির লেখাপড়ার মাথা ছিল না। ক্লাস সিক্স অবধি উঠতেই গলদঘর্ম হয়ে ইস্তফা দিল। হয়তো সেইজন্য মনে মনে নিজেকে ছোট ভেবে কষ্ট পায়, হিংসেতে জ্বলেও হয়তো একটু।

মহিম রায় স্নিগ্ধ গলায় বলেছিল, তুই কি ভাবিস ওরা ইংরিজি শুনে জব্দ হয়ে যাবে? ব্যাপারটা তা নয় রে।

না বাবা, দিনরাত বড় অপমান লাগছে আমার। ইংরিজিতে আমাদের নিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলে, ঠাট্টাইয়ার্কি করে। অন্তত আমরা যে ওদের কথা বুঝতে পারছি সেটা ওদের জানিয়ে দেওয়া দরকার। তাহলে সাবধান হবে, আর বলবে না। যখনই ওরা কেউ উঠোনে নেমে আসবে তখনই এই জানালা দিয়ে তুমি ওদের লক্ষ করে খুব ইংরিজি বলে দিও। দু-চারবার বললেই দেখবে কাজ হচ্ছে।

মহিম রায় কী বলবে ভেবে পেল না। মুখ্যু-সুখ্যু মেয়েটার জীবনে অনেক দুঃখ। তার ওপর এই ইংরিজি না-জানার দুঃখটা চেপে বসায় মাথাটা গরম হয়েছে। জানালা দিয়ে খামোখা ইংরিজি আউড়ে যাওয়ার হাস্যকরতা ও বুঝতেই পারছে না।

সন্ধ্যা বুঝবে না, ইংরিজি কোনও বাধা নয়। ওদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব শুধু ইংরিজিই তো রচনা করেনি। করেছে মনোভাব। সেটা সন্ধ্যা বুঝবে না।

মহিম রায় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।

 সন্ধ্যা ফিস ফিস করে বলল, অত দেমাক দেখাচ্ছে, জানো তো মেয়েটা কলকাতায় একটা কিছু কেলেঙ্কারি করে এসেছে।

কেলেঙ্কারি! কী করেছে?

 কিছু একটা হবে। যখন মায়ে মেয়েতে ঝগড়া হয় তখন বুঝতে পারি।

মহিম ক্লান্ত বোধ করে। সন্ধ্যা ওদের পছন্দ করে না বলেই বানিয়ে বলছে বোধহয়। বড় জ্বলুনি হচ্ছে মেয়েটার। কিন্তু এসবের নিদান তো তার জানা নেই।

ঘরে বসে অবশ্য লক্ষ করে মহিম। ছেলেটা, মেয়েটা, বউমা মাঝে মাঝে আলাদা আলাদা উঠোনে নেমে আসে। জানালা দিয়ে দেখে ওদের মহিম। আপনজন বলে মনে হয় না। বহু দূরের মানুষ বলে মনে হয়। ওরা ভাল না খারাপ তা জানে না মহিম। জেনে হবেটাই বা কী? এ-ঘরে কখনও উঁকিও দেয় না তারা। একটা হ্যাগার্ড বুড়ো এক কোণে পড়ে থাকে, উঁকি মারার আছেটাই বা কী?

এই সন্ধেবেলা মেয়েটাকে ফটিকের পতিত জমিতে নেচে বেড়াতে দেখে প্রমাদ গুনল মহিম। সাপে কামড়ালে মরবে যে। এ সময়ে সাপ-খোপ বেরোয়।

কে রে? সোহাগ নাকি তুমি! অ্যাঁ।

কোনও জবাব নেই। নৃত্যের কোনও বিরতিও পড়ল না। যেন শুনতেই পায়নি। উপেক্ষা করছে কি?

 শোনো সোহাগ, ওখানে সাপ-খোপ আছে, চলে এসো।

জবাব নেই।

কথা বলছ না কেন? আমি দাদু। ওখান থেকে চলে এসো। ও-জায়গাটা ভাল নয়। মেলা কাঁটাগাছ আছে, কাচের টুকরো আছে, ইট আছে। পড়ে যাবে যে!

মেয়েটা তেমনই বিভোর হয়ে হালকা পরির মতো ঘুরে ঘুরে নেচে বেড়াতে লাগল। মহিম শুনতে পেল, মেয়েটা গুন গুন করে কী যেন বলছেও। গান কি? না, গান নয়, অনেকটা স্তোত্রের মতো কিছু। ভাল শোনা যাচ্ছে না।

মহিম ব্যাপারটার অস্বাভাবিকতা হঠাৎ টের পেল। হয়তো মাথার গণ্ডগোল আছে বা আর কিছু। এভাবে মেয়েটাকে রেখে তো চলে যাওয়া যায় না। অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। মেয়েটা নিজের বিপদ বুঝতে পারছে না। নিরস্ত্র, টর্চহীন মহিম রায় রাস্তা ছেড়ে ছোট শুখা নালাটা পার হয়ে জমিতে ঢুকল।

সোহাগ! সোহাগ! আমি দাদু। এই যে–বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ খপ করে নৃত্যপর মেয়েটার একটা হাত চেপে ধরল সে। সঙ্গে সঙ্গে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে মেয়েটা আছড়ে পড়ে গেল মাটিতে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল মহিম। এ আবার কী হল? মূর্ছা গেল নাকি?

হাঁটু গেড়ে পাশে বসে মেয়েটাকে একটু নাড়া দিয়ে সে ডাকছিল, সোহাগ! দিদিভাই! কী হয়েছে তোমার?

মেয়েটার গায়ে জবজব করছে ঘাম। গায়ের পোশাক ভিজে সপসপ করছে। শরীরে একটা কাঁপুনিও উঠে আসছে। হঠাৎ অস্ফুট বিড়বিড় করে স্তোত্রপাঠের মতো কী যেন বলে যেতে লাগল মেয়েটা। কিছু বোঝা গেল না।

কী করবে মহিম? ভয়ে তার শরীর হিম হয়ে গেল। এই তল্লাটে লোকজনের যাতায়াত নেই, বাড়িঘরগুলোও একটু দূরে দূরে। উলটোদিকে নির্জন আমবাগান। দৌড়ে গিয়ে লোকজন ডেকে আনা যায় বটে, কিন্তু ততক্ষণ এই নিরালায় মেয়েটা অরক্ষিত থাকবে। কাজটা ঠিক হবে না।

একা নিয়ে যেতে পারবে সে? ঊনআশি বছর বয়সের শরীরে কি আর সেই ক্ষমতা আছে? মেয়েটাও তেমন রোগাপটকা নয়। কিন্তু চেষ্টা তো করতেই হবে। কিছুতেই তো ফেলে যাওয়া যায় না।

দু হাতে পাঁজাকোলা করে যখন সোহাগকে তুলতে যাচ্ছিল মহিম তখনই হঠাৎ এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। অলৌকিক! সম্পূর্ণ অলৌকিক! যখন মেয়েটাকে প্রাণপণে তুলতে চেষ্টা করছে তখনই হঠাৎ তার নিজের ভিতরেই ঘটে গেল সেই অলৌকিক।

হঠাৎ যেমন জলভারনম্র মেঘ থেকে অঝোর বৃষ্টি নেমে আসে ঠিক তেমনই বুকের ভিতরে এক রক্তের কলরোল উঠল। সমস্ত শরীর ভেসে গেল মায়ায়। এ তো তারই প্রাণ থেকে প্রাণ পেয়ে জন্মানো মেয়ে, এ যে তারই রেতঃবাহী, শোণিতবাহী একজন! ওরা মানে না। জানে না বলে মানে না। না মানুক, আজ এই সন্ধ্যায় পরম্পরার এক সূত্রপথ উদঘাটিত করে দিল ওই অলৌকিক অনুভূতি। এ সোহাগ, এ তো সে নিজেই, মহিমাদীপ্ত রায়।

শরীর ভেঙে আসছিল মেয়েটাকে তুলতে। ঊনআশি বছরের শরীর তবু হার মানেনি। ধীরে ধীরে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে একটু টলোমলো পায়ে বন্ধুর জমিটা পা চেপে চেপে পার হয়ে মেটে পথে উঠে এল মহিম। হাঁফ ধরে যাচ্ছে, হাত ভেরে আসছে। পারবে কি?

পারত না। পথে উঠে সোহাগের এলানো শরীরটাকে একটু দাঁড় করাল সে, তারপর নিচু হয়ে ডান কাঁধে পাটকরা চাদরের মতো তুলে নিল সে। তাতে একটু সহজ হল ব্যাপারটা। কিন্তু তবু শরীর দিচ্ছে না। বহুকাল পর গায়ত্রী জপ করতে লাগল মহিম। আর কোনও মন্ত্র তো জানা নেই। গায়ত্রীতে কাজ হবে কি না জানা নেই। অন্তত কিছু একটা চলতে থাকুক ভিতরে। কুলি মজুররাও তো শক্ত কাজের সময় হেঁইও-হেঁইও করে। সেরকমই একটা কিছু ধরা যাক।

পথটুকু পার হতে ঘেমে গেল মহিম। বুকটা যেন ফেটে যেতে চাইছে। এই পরিশ্রম শরীর হয়তো সইবে না। হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। হলে হোক। সারা জীবন কার কোন উপকারে লেগেছে মহিম। আজ এই বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে আনতে গিয়ে যদি মরতে হয় তো দুঃখের কিছু নেই।

সন্ধ্যার এক সাপ্লায়ার ছোকরা তার সাইকেলের হ্যান্ডেলে ক্যাম্বিসের ব্যাগে মাল বোঝাই করছিল। মহিম উঠোনে পা দিতেই সে চেঁচিয়ে উঠল, কী হয়েছে জ্যাঠামশাই? দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি ধরছি।

সাইকেল রেখে ছুটে এসেছিল ছেলেটা।

কিন্তু মহিম রায় বারণ করলেন, তুমি ছুঁয়ো না বাছা। এতদূর এনেছি, বাকিটুকুও পারব। তুমি বরং ওর মাকে ডেকে দাও।

নিজের ঘরে এনে বিছানায় সোহাগকে শুইয়ে দিল মহিম। তারপর, চেয়ারে বসে কলকল করে ঘামতে আর কুকুরের মতো হাঁফাতে লাগল। হার্টফেল হওয়ারই কথা। তবু হচ্ছে না এখনও। শরীরটা যন্ত্রণায় অবশ।

খবর পেয়ে দৌড়ে এল মোনা। মোনালিসা না কী যেন নাম বউমার। অমল মোনা বলেই ডাকে। ঘরে ঢুকেই মেয়ের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল মোনা। দুটো শ্বাস ফেলার সময়টুকু ফাঁক দিয়ে বলল, কী হয়েছে?

পরে শুনো। এখন ওর চোখেমুখে জল দাও। ওই ঘটিতে জল আছে।

মোনার মুখে কোনও উদ্বেগ দেখা দিল না। দেখা দিল চাপা রাগ। চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেল, কপালে ভ্রূকুটি, ফর্সা মুখটায় লাল আভা। ঘটিটা তুলে নিয়ে তীব্র আক্রোশে কয়েকটা জলের ঝাপটা মেরে রাগে গনগনে গলায় বলতে লাগল, ইউ আর ডুয়িং দি ভুডু এগেইন, ইউ বিচ… ইউ বিচ… বিচ…

বুকটা শান্ত হচ্ছিল না মহিমের। মস্ত হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছিল।

সন্ধ্যা ঘরে ঢুকে এসে তাড়াতাড়ি বাবাকে ধরল, কেমন লাগছে বাবা? ডাক্তার ডাকব?

 মহিম মাথা নেড়ে বলল, না। ঠিক হয়ে যাবে।

সন্ধ্যা হঠাৎ এবার মোনার দিকে ফিরে বলল, ওভাবে জল ছিটোচ্ছ কেন মেজো বউদি? বিছানাটা যে ভিজে যাচ্ছে!

মোনা তীব্র বেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে ধমকে উঠল, তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। গেট আউট ফ্রম হিয়ার…

সন্ধ্যা ফুঁসে উঠে বলল, অত মেজাজ দেখাচ্ছ কেন? বিছানাটা ভিজে যাচ্ছে, তাই বলেছি। খারাপ কথা বলেছি কিছু?

মোনা তেমনই বিষাক্ত গলায় বলে, মেয়েটার চেয়ে বিছানাটা বেশি হল? ক্রাঙ্ক হেড কোথাকার?

সন্ধ্যা ছাড়বার পাত্রী নয়, সমানে গলা তুলে বলল, বাঃ বেশ তো! আমার বুড়ো বাবা তোমার ন্যাকা মেয়েকে ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে এল, আর এখন একেবারে দরদ উথলে উঠছে! একটু আগে তো মেয়েকেই গালাগাল করছিলে।

বেশ করেছি। তুমি তোমার কাজে যাও।

আমি কোথায় যাব সেটা আমি বুঝব। এটা আমার বাবার ঘর। আমাকে যদি সইতে না পার তাহলে তুমি নিজের ঘরে যাও। আমাকে যেতে বলার তুমি কে?

ঝগড়া থামানোর জন্য যে দুজনের মাঝখানে পড়ে সামাল দেবে সেই শক্তিও নেই মহিমের। অসহায়ভাবে সে দেখছিল, যেন দুটো বনবেড়াল কথা দিয়ে আঁচড়াআঁচড়ি কামড়াকামড়ি করছে। সে একবার হাতটা তুলল। দুর্বল হাতটা পড়ে গেল ধপাস করে।

.

০৫.

হরিহরপাড়ার কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে, গাছগাছালির আড়াল-আবডালে ঢাকা পড়তে পড়তে এবং ফের প্রকাশ পেতে পেতে যেন একটা চিরুনির ভিতর দিয়ে ওই আসছে রসিক বাঙাল। পরনে কালচে পাতলুন, তাতে হলদে জামাটা গোঁজা, হাতে অ্যাটাচি কেস।

চৌধুরীদের পুকুরে আজ টিকিট কেটে মাছ-ধরার কম্পিটিশন। কাতারে লোক হুইল ছিপ নিয়ে বসে গেছে। মেলা লোক জুটেছে মাছ ধরা দেখতে। ভিড়ে ভিড়াক্কার। সকাল থেকেই জায়গাটায় থানা গেড়ে ছিল মরণ। খানিকক্ষণ মাছ ধরা দেখে সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে একটু বল খেলল। খিদে চাগাড় দেওয়াতে বাড়ি-মুখোই ফিরছিল সে। তখনই দূর থেকে দেখল রসিক বাঙাল আসছে। আজ বুধবার, বাঙালের আজ আসার কথা নয়। তার মানে কলকাতায় ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়া করে এলে রসিক বাঙালের মেজাজ বড্ড তিড়িক্কি থাকে।

সুতরাং মরণ ছুট লাগাল। বাড়িতে গিয়ে মাকে আগাম জানান দেওয়া দরকার। আর জিজিবুড়িকেও তাড়াতে হবে। বেরোবার সময়ে দেখে এসেছে, জিজিবুড়ি উঠোনে বসে হাপড়হাটি বকে মরছে। জিজিবুড়ির হল অভাবের সাতকাহন। সব সময়ে এটা চাই, সেটা চাই। রসিক বাঙাল জিজিবুড়িকে দু চোখে দেখতে পারে না।

মরণ অঙ্কে চল্লিশের বেশি পায় না বটে, কিন্তু দৌড়ে বরাবর ফার্স্ট হয়। ক্লাবঘরের খেলার মাঠ পেরিয়ে সে চোখের পলকে চাটুজ্যে বাড়ির উঠোন দিয়ে শর্টকাট মেরে নিজেদের বাড়ির উঠোনে ঢুকেই চেঁচাল, বাঙাল আসছে! বাঙাল আসছে!

জিজিবুড়ি পানের বাটা কোলে নিয়ে রোদে বসে ছিল। মুখে দোক্তা দেওয়ার পর জিজিবুড়ির চোখে যেন আরামের তন্দ্রা চলে আসে। চেঁচানি শুনে জিজিবুড়ি চমকে উঠে বলে, আ মোলো! আজ আবার বাঙাল এল কেন?

পালাও জিজিবুড়ি, এসে পড়ল বলে।

তড়িঘড়ি উঠতে গিয়ে কোলের পানের বাটা ঠনাৎ করে পড়ে গেল উঠোনে। খোলা কৌটো থেকে সুপুরির টুকরো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, চুন লেপটাল, দোক্তা ছিটিয়ে গেল।

দ্যাখ দিকিনি কাণ্ড! অমন চেঁচাতে আছে! এখন এসব তোলে কে?

 তুলতে হবে না জিজিবুড়ি, পালাও শিগগির।

যাচ্ছি বাপু, যাচ্ছি। দোক্তাগুলো একটু কুড়িয়ে দিবি ভাই? যতীনকে কত বলে বলে তবে আনাতে হয়। দামও কি কম? এই দোক্তাটুকুর জন্যই বেঁচে আছি, প্রাণটা এখনও ওই জন্যই ধুকপুক করে।

তুমি বড্ড বকো জিজিবুড়ি। বাড়ি যাও না, মুক্তাদি কুড়িয়ে তোমাকে দিয়ে আসবেখন।

 মাজায় ব্যথা, জিজিবুড়ি তাই একটু বাঁকা হয়ে উঠোনের পিছনভাগে এগোতে এগোতে বলে, দিস কিন্তু পাঠিয়ে ভাই।

দোতলার বারান্দায় এসে মা বলল, কী হল রে? কে আসছে বললি?

বাঙাল আসছে।

মায়ের মুখ শুকোল। বলল, তবে বড়গিন্নির সঙ্গে অশান্তি হয়েছে ঠিক। যা যা পড়তে বস গে। আলায়-বালায় ঘুরিস, টের পেলে আস্ত রাখবে না।

সেটা খুব জানে মরণ। জিজিবুড়িকে রওনা করে দিয়ে সে এক লাফে ঘরে ঢুকে পড়তে বসে গেল। অসময়ে, অ-দিনে বাঙাল আসা মানেই গণ্ডগোল। বই খুলে কান খাড়া করেই বসে রইল সে। পরবর্তী দৃশ্য ও ঘটনাগুলি তার খুব জানা। বাঙাল আসবে, এসে ওপাশের একতলার কোণের ঘরে ঢুকে সোজা গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়বে। কারও সঙ্গে একটিও কথা কইবে না। একদম পাথরের মতো চুপ। ওই সময়ে কেউ কাছে যাওয়ার সাহস পায় না। অন্তত আধঘণ্টা মা পর্যন্ত চৌকাঠ ডিঙোয় না। আধঘণ্টা বাদে মা এক কাপ গরম চা নিয়ে গিয়ে টেবিলে রাখবে। তারপর খুব মোলায়েম গলায় বলবে, চা এনেছি।

তার পরেও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে বাঙাল। মা খুব সন্তর্পণে বিছানার এক পাশে বসে পায়ের ওপর একটু হাত বোলাবে। বাঙাল তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। তারপর হু-উ-উম করে একটা অদ্ভুত শব্দ করবে। তারপর উঠে বসবে। তখনও কোনও কথা নেই। বসে বসে কিছুক্ষণ সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা খাবে। গরম চা যত পেটে যাবে তত মেজাজ শীতল হয়ে আসবে।

মরণের একটা হামা-দেওয়া বোন আছে। সেটা একেবারে নরম তুলতুলে, গোবরের নাদা। মরণ তাকে কোলে-টোলে নিতে পারে না কখনও। সেই বোনটাকে নিয়ে এসে মুক্তা এর পর বাঙালের কোলে ফেলে দেবে। বাঙাল তখন হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ করে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে মেয়েটাকে খুব আদর করবে। মরণের বোনটাও কে জানে কেন বাঙালের ভীষণ ভক্ত। সে তখন বাঙালের নাক কামড়ে দেবে, কান ধরে টানাটানি করবে। মরণ যখন ছোট্টোটি ছিল তখনও নাকি বাঙালের মেজাজ বিগড়োলে তাকে এনে বাঙালের কোলে ফেলে দেওয়া হত আর বাঙাল ঠিক ওইরকম করে আদর করত তাকে। আর মেজাজ আরও শীতল হয়ে যেত।

সবাই বলে বাঙালের মেজাজটা একটু টং বটে, কিন্তু সে লোক ভাল। কিন্তু মরণ জানে বাবারা কখনও ভাল লোক হয় না। এই যে বাঙাল ফি শনিবার আগেভাগে তার পোস্তার দোকান বন্ধ করে এখানে বিকেল-বিকেল এসে পৌঁছোয় তখন মরণকে তৈরি থাকতে হয়। বাড়িতে পা দিয়েই বাঙাল তার খোঁজ করবে, বান্দরটা গেল কই?

সে ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই বাঙাল তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হঠাৎ বলবে, এইটার মাথাডা যে কাউয়ার বাসা হইয়া আছে দ্যাখে না কেউ? এই হারামজাদা, মাথা খাউজ্যায় না তর? খাউজ্যায়? এঃ উকুনও হইছে মনে হয়। কাইলকাই নাইপত্যা ডাকাইয়া মাথাটা লাউড়া কইরা দিতে হইব।

রসিক বাঙালের এসব কথা জলের মতো বুঝতে পারে মরণ। যদিও এ তাদের ভাষা নয়, কিন্তু জ্ঞান হওয়া অবধি শুনে শুনে সে বুঝতেও পারে, বলতেও পারে অনেকটাই। রসিক বাঙালের পাল্লায় পড়ে তাকে বার দুই ন্যাড়াও হতে হয়েছে। বাঙালের গোঁ, যেই কথা সেই কাজ।

কখনও বা হাতের নখ দেখে বলে, এ, এইটার তো দেখি, পিচাশের মতো নখ হইছে। ইস রে, নখের মইধ্যে কালা কালা মাটি।

নেল কাটার দিয়ে রসিক বাঙাল ডাব্বিয়ে তার নখ কেটে দেয়। এমন মুড়িয়ে কাটে যে কয়েকদিন তার আঙুলের ডগা টনটন করে।

আর সবচেয়ে দুঃখের কথা, শনি রবি দুদিনই তাকে দুবেলা রীতিমতো পড়তে হয়। টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ। শ্বাসটাও ফেলতে হয় হিসেব করে। আর বাঙালের সঙ্গে বাগানের কাজে সাহায্য করতে হয়, ফাইফরমাশ খাটতে হয়।

আর সবচেয়ে যেটা লজ্জার কথা, এই বছর দশ-এগারো বয়সে সে তো বেশ বড়টিই হয়েছে, তবু রসিক বাঙাল মাঝে মাঝেই তাকে কলতলায় নিয়ে গিয়ে ন্যাংটো করে সাবান মাখিয়ে ছোবড়া দিয়ে ঘসে ঘসে চান করিয়ে দেয়। একে ন্যাংটো হওয়ার লজ্জা, তার ওপর ছোবড়ার ঘষটানিতে গায়ের জ্বালা। কিন্তু বাঙালের সঙ্গে এ নিয়ে কথা কইবে কে? না, রসিক বাঙালকে তার মোটেই পছন্দ হয় না। সোমবার সকালে ভাতে ভাত খেয়ে বাঙাল কলকাতার বড়বাজারে তার দোকান খুলতে রওনা হয়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মরণ। মনে হয়, এক সপ্তাহ ছুটি।

রসিক বাঙালকে নিয়ে ঠাট্টা-রসিকতারও প্রচলন আছে। তারাপদদা তাকে ইংরিজি পড়ায়। মাঝে মাঝে বলে, ও হল তোর উইক এন্ড ড্যাডি। আর বন্ধুরা বলে, রসিক বাঙাল হল তার ফিফটি পারসেন্ট বাবা।

কথাগুলো আজকাল বোঝে মরণ। একটু লজ্জা করে, রাগও হয়।

জানালা দিয়ে সাবধানে পাশ-চোখে মরণ দেখল, বাঙাল আগড় ঠেলে উঠোনে ঢুকছে। মাথার লম্বা চুল হাওয়ায় উড়োখুড়ো, মুখখানা চোয়াড়ে বটে, তবে গম্ভীর নয় যেন। হাড়ে মাসে কেঠো চেহারা। এইরকম পাকানো চেহারার লোকগুলোই রাগী হয়।

না, আজ বাঙাল রাগ করে আসেনি। উঠোনে ঢুকেই উঁচু গলায় হাঁক মারল, কই গো, কই গেলা?

 মা ওপরে দম বন্ধ করে ছিল বোধহয় এতক্ষণ। বাঙালের হাঁক শুনে বলল, এই যে যাচ্ছি!

হাসিমুখে নেমে এসে বলল, আজ এলে যে!

বাঙাল বারান্দায় বসে পাশে অ্যাটাচি কেসটা রেখে বলে, আর কইও না, সুধীর মণ্ডল খবর পাঠাইছে খালপাড়ের জমিটা বেচব। তাই আর দেরি করলাম না। আইজই রেজিস্টারি।

যাক বাবা, ওই জমিটার ওপর তোমার কত কালের শখ।

অখনই বাইর হইতে হইবো, কখন ফিরুম ঠিক নাই। আইজ আর কইলকাতায় ফিরন যাইব না।

এখনই বেরোবে কি? না খেয়ে বুঝি? চান-টান করো, আমি ভাত বেড়ে দিচ্ছি।

 বাঙাল তেমন আপত্তি করল না। বলল, তা হইলে লুঙ্গি গামছা দেও। গরম লাগত্যাছে।

মরণ প্রমাদ গুনল। বাঙাল তাহলে আজ থাকছে। দিনটাই মাটি। ডানধারের জানালা দিয়ে জিজিবুড়ির ভাঙাচোরা মুখ উঁকি মারল, ও ভাই মরণ, দোক্তাগুলো তুলেছিস?

সময় পেলুম কোথায়? বাঙাল এসে পড়ল যে।

ও আমার কপাল, না তুললে যে কে কখন মাড়িয়ে দেবে, কাক এসে মুখ দেবে।

হি হি করে হেসে মরণ বলে, কাক বুঝি দোক্তা খায়?

 না খেলেও ছিষ্টি ছড়াবে ভাই, গু-মুত-খাওয়া ঠোঁটে ঠোকরাবে–সে বড় নিঘিন্নে ব্যাপার।

 বাঙাল বারান্দায় বসে আছে যে!

চোখ কপালে তুলে জিজিবুড়ি বলে, বসে আছে বুঝি! গোঁসাঘরে যায়নি এখনও?

না গো জিজিবুড়ি, বাঙাল আজ ঝগড়া করে আসেনি।

 তবে কী মতলবে?

কী যেন জমিজমা কেনার কথা শুনছি!

বাঙাল ওই করেই শেষ হবে। জমি-জমি করে এমন পাগল আর কাউকে দেখিনি। থাকবে নাকি আজ?

তাই তো শুনছি।

তাহলে গেল আমার অতগুলো দোক্তা।

তুমি এখন যাও জিজিবুড়ি, মুক্তাদি তোমার দোক্তা কুড়িয়ে দিয়ে আসবেখন।

আর দিয়েছে। ও আমার ভূতভুজ্যিতেই গেল। বাঙাল কার জমি কিনছে কিছু শুনলি?

সুধীর মণ্ডলের।

জমি কিনেই শেষ হবে বাঙালটা।

তুমি এখন যাও জিজিবুড়ি, বাঙাল দেখতে পেলে কুরুক্ষেত্র করবে।

 যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। তা বলি বাঙালের নয় মাথার দোষ, পাগলের মতো জমি কিনছে, কিন্তু আমার মেয়েটাই বা অমন মেনিমুখো কেন? দুটো উচিত কথা মুখের ওপর কি বলতে নেই। কী দিয়ে যে বশ করে রেখেছে কে জানে বাবা। স্বামী তো নয়, যেন গুরুঠাকুরটি এলেন। সব সময় হ্যাঁ-হুজুর জো-হুজুর করে যাচ্ছে। জন্মে এমন দেখিনি বাবা। কই, বড় বউ কি ছেড়ে কথা কয় বাঙালকে? দিচ্ছে তো গুষ্টির পিণ্ডি চটকে থোঁতা মুখ ভোঁতা করে। তখন তো ল্যাজ গুটিয়ে এখানে এসে গোঁসাঘরে টান টান হয়ে শুয়ে থাকে, পারে কিছু বলতে গিয়ে তাকে? আমার মেয়েটাই হল গে মেনিমুখো।

কথাটা ঠিক নয়। তার মায়ের সঙ্গে রসিক বাঙালের কখনও-সখনও ঝগড়া হয়। তবে সেটা বেশি দূর গড়ায় না। মা পায়ে-টায়ে ধরে মিটিয়ে ফেলে। মরণের আগে মনে হত, মা রসিক বাঙালকে খুব ভয় পায়। আর শুধু ভয়ই পায়। আজকাল বুঝতে পারে, মা বাঙালকে ভালও বাসে খুব। এইটে মাঝে মাঝে মরণের তেমন পছন্দ হয় না।

বাঙাল উঠোনে দাঁড়িয়েই লুঙ্গি গলিয়ে প্যান্ট, জাঙ্গিয়া ছাড়ল, জামা গেঞ্জি খুলে ফেলল। মা সেগুলো নিয়ে উঠোনের তারে মেলে দিল ঘাম শুকোনোর জন্য। বাঙাল গেল টিউবওয়েলে চান করতে।

বাঙালদের জমির নেশা থাকে বলে শুনেছে মরণ। সেই নেশাতেই একদিন জ্ঞাতিভাই মাখন দত্তের সূত্রে এখানে এসে জমিজিরেত কিনেছিল বাঙাল। ইচ্ছে ছিল এখানেই থাকবে, ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে কলকাতার ব্যবসা বজায় রাখবে। কিন্তু বাঙালের বউ শেষ অবধি গাঁয়ে এসে টিকতে পারেনি৷ রসিক তখন ফাঁপড়ে। কে এই জমিজমা, বাড়িঘর দেখে! ভাড়া করা লোক দিয়ে তো আর সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। বেচে দিয়ে চলে যাওয়ার পরামর্শই লোকে দিয়েছিল, কিন্তু বাঙালের গোঁ যাবে কোথায়! সে বলল, বেচুম ক্যান? জমির লগ্নির মাইর নাই।

বাঙালের সেইসব গল্প আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। নিজের মায়ের কাছে খানিক, আর খামচা খামচা নানা জনের মুখে শুনেছে মরণ। সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক হল বউ। তাই বাঙাল একদিন ঠিক করে ফেলল, এখানে আর একটা বিয়ে করবে। খুঁজে খুঁজে স্বজাতি স্বঘর গরিবের একটা মেয়েকে পছন্দও করে ফেলল সে। আর তখনই গাঁয়ে বিরাট শোরগোল উঠল। বাঙাল দেশ থেকে এসে একটা লোক গাঁয়ে নষ্টামি করছে। বাঙালকে মারধর করারও চেষ্টা হল। পুলিশ ডাকা হল। সে অনেক ঘটনা।

বাঙাল তখন গিয়ে ধরে পড়ল গৌরহরি চাটুজ্যেকে। মস্ত উকিল, মান্যগণ্য বিচক্ষণ মানুষ। গৌরহরি চাটুজ্যে তলচক্ষুতে খানিকক্ষণ বাঙালকে দেখে নিয়ে নাকি বলেছিল, বুকের পাটা আছে হে!

বুকের পাটা আর টাকা এ দুটো যার থাকে তাকে জব্দ করা কঠিন। গৌরহরি চাটুজ্যে একদিন মিটিং ডেকে সবাইকে বলল, রসিক সাহা একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে বলে তোমরা আপত্তি করছ শুনলাম। আপত্তি ওঠারই কথা। তবে বাপু, রসিক বিয়ে না করে যদি চারটে মেয়েমানুষ রাখত তাহলে তোমরা কী করতে? বড় জোর আড়ালে-আবডালে ফিসফাস গুজগুজ বা নিন্দেমন্দ। তার বেশি কিছু নয়। আমি বলি কী, এ লোক তো বুকের পাটা আছে বলেই বিয়ে করছে। বাইগ্যামির চার্জে যদি ওর বউ ওকে জেলে পাঠায় তো পাঠাবে। সে দায় ওর। তবে বাসন্তী যাতে ফাঁকে না পড়ে তার জন্য রসিক সাহা বাসন্তীর নামে সম্পত্তি লিখে দিতে রাজি আছে। সে ভার আমিই নিচ্ছি।

একজন মাতব্বর বলেছিল, দাদা, আপনি জেনেশুনে এই বে-আইনি কাজকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন?

গৌরহরি বললেন, মানুষের প্রয়োজন বুঝেই বরাবর আইন তৈরি হয়েছে, সেরকমই হওয়া উচিত। মানুষের প্রয়োজনে কাজে না এলে আইন বোঁদা জিনিস। রসিক ফুর্তি করার জন্য তো আর একটা বিয়ে করছে না। তার সম্পত্তি দেখাশোনার জন্যই দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রয়োজন। প্রাচীন কালে সামাজিক প্রয়োজনেই মানুষকে এরকম বিয়ে করতে হয়েছে। উদ্দেশ্য খারাপ না হলে আমি অন্তত দোষ দেখছি না।

অনেক গণ্ডগোলের ভিতর দিয়ে বিয়েটা অবশ্য হয়ে গেল। কিন্তু খবরটা কলকাতায় রসিক বাঙালের বাড়িতে পৌঁছোনোর পর হয়েছিল আরও সাংঘাতিক কাণ্ড। বাঙালের বউ দুবার গলায় দড়ি দিতে গেল, থানা-পুলিশ হল, বাঙালকে ধরে নিয়ে গিয়ে ফাটকেও পুরল পুলিশ।

কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে কালের নিয়মে উত্তেজনা প্রশমিত হল, রাগের পারদ নেমে গেল। বাঙাল তার দুই সংসারের মধ্যে ভাগ হয়ে দিব্যি চলতে শিখল।

কলকাতার মা বা বড়মা কেমন তা অবশ্য জানে না মরণ। তার একটা দাদা আর একটা দিদিও আছে। তাদের কখনও দেখেনি সে। কিন্তু সে মাঝে মাঝে খুব ঝুম হয়ে বসে তাদের কথা ভাবতে চেষ্টা করে। দেখা হলে তারা কি মরণকে দুর-দুর ছাই-ছাই করবে? করবে বোধহয়। কিন্তু মরণের মনে হয়, তারা বোধহয় তার খুব পর-মানুষ নয়। বাঙাল কাঠখোট্টা লোক, কলকাতার বাড়ির কথা বিশেষ তার মুখে শোনা যায় না। তবে মাঝে মাঝে যে ও বাড়িতে খুব ঝগড়া হয় তা টের পায় তারা, যখন বাঙাল মুখ গোমড়া করে অসময়ে এসে হাজির হয়।

মায়ের ওপর রাগ করে মরণ কখনও কখনও বলে, আমি একদিন বড়মার কাছে, দাদা দিদির কাছে চলে যাব।

মা বলে, যা না, তা-ই যা, গিয়ে বুঝবি কত ধানে কত চাল। গালভরে আবার বড়মা বলা হচ্ছে। গিয়ে বুঝবি পেটে ধরা মা আর ডাকের মায়ের তফাত কী।

তফাত বোঝার মতো বয়স হয়নি মরণের। কিন্তু কলকাতার বাড়ি, বড়মা, দাদা বা দিদি সম্পর্কে তার একটা রূপকথার মতো কুহক আছে। তারা হয়তো খুব সুন্দর মানুষ, বাড়িটা হয়তো রাজপ্রাসাদের মতো। তারা হয়তো দুরছাই করবে না তাকে।

বাঙাল বারান্দায় বসে ভাত খেল। তারপর জামা-প্যান্ট পরে রওনা হওয়ার সময় বলল, তা হইলে আসি গিয়া।

এসো। তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু?

 হ। দুর্গা দুর্গা।

দুর্গা দুর্গা।

বাঙাল চলে গেল। মরণ ঘর থেকে বেরিয়ে লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে হোঃ হোঃ করে দু হাত ওপরে তুলে দু চক্কর নেচে নিল।

মা ভ্রূ কুঁচকে বলে, ও মা! অমন করছিস কেন?

মায়ের সামনে বাবাকে বাঙাল বললে মা রাগ করে। তাই সে ভয়ে ভয়ে বলে, এমনি।

মা শুধু বলল, ওরকম করতে নেই।

নিকোনো উঠোন থেকে জিজিবুড়ির পড়ে যাওয়া দোক্তা বাঁ হাতের তেলোতে তুলে জড়ো করতে করতে মরণ বলল, বাবা আসছে শুনে জিজিবুড়ি এমন ভয় পেল যে দোক্তা ফেলে পালিয়েছে।

মা বাঙালের ভেজা লুঙ্গি তারে মেলতে মেলতে বলল, মায়ের যেমন কাণ্ড! ভয় পাওয়ার আর দোষ কী? কম লেগেছিল লোকটার পিছনে? এখন মুখোমুখি হলে লজ্জায় মাথা কাটা যায়।

ঘটনাটা জানে মরণ। মায়ের সঙ্গে বাঙালের বিয়ে দিতে গিয়ে এককাঁড়ি টাকা আদায় করেছিল জিজিবুড়ি। বিয়ের পরেও নানা অভাবের কথা বলে টাকা নিত। নিজের দুই পাষণ্ড ছেলে কানাই আর বলাইকে লাগিয়েছিল বাঙালের চাষ আবাদে। তারা ধান-চালের হরির লুট ফেলে দিয়েছিল। বাঙালের গোলায় ফসল আর উঠতই না। মতলব ছিল বাঙালকে তাড়িয়ে সম্পত্তি দখল করার। কারণ সম্পত্তি সবটাই প্রায় মেয়ের নামে। তা সেটা প্রায় ঘটেও গিয়েছিল। কলকাতার সংসারে যখন অশান্তি লাগে তখন বাঙালের যাতায়াত গিয়েছিল কমে। সেই ডামাডোলে বাঙাল যখন প্রায় নেই হয়ে গেছে সেসময় দুই ভাই এসে বোনকে নানা কানমন্তর দিত। বাঙাল যে খারাপ লোক, সে যে ঘুরে ঘুরে বিয়ে করে বেড়ায় এবং তার যে আরও নানা দোষ আছে সেসব কথা। সেই দুর্দিনে মায়েরও খুব মনের কষ্ট গেছে। পেটে তখন মরণের বড় বোনটা, যেটা বাঁচেনি। বাঁচার কথাও নয়। সেই সময়ে মন খারাপের চোটে মূৰ্ছা রোগ হয়েছিল। কয়েকবার মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মেয়েটা পেটের মধ্যে মরে গেল।

বাঙাল যখন ফিরে এল বিষয়ী মানুষের চোখে তখন পরিস্থিতি বুঝে নিতে দেরি হয়নি। দুই শালাকে তাড়িয়ে নিজের বউকে আগলে যখন সে রুখে দাঁড়াল তখনই জিজিবুড়ি আর তার ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্কটা বিষ হয়ে গেল। মারাত্মক ঘটনাটা ঘটল তার পরেই। কানাই আর বলাই দুটো গুণ্ডা ভাড়া করে লাগাল বাঙালকে নিকেশ করতে। সেটা হলে বোনের সম্পত্তির দখল নিতে আর বাধা হত না। দুটো গুণ্ডা বাঙালকে কুপিয়েও দিয়েছিল বাসরাস্তার কাছে বাঁশবনে। কিন্তু বাঙাল একটাকে পেড়ে ফেলেছিল। ধরা পড়ে দুজনেই কবুল করেছিল তারা কানাই বলাইয়ের টাকা খেয়ে এ কাজ করেছে।

মোকদ্দমা হতে দেয়নি বাসন্তী। বাঙালের হাতেপায়ে ধরে ভাইদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কেলেঙ্কারির ভয়ে বাঙালও বেশি কিছু করেনি। কিন্তু সেই থেকে বাঙাল এলে ও বাড়ির কেউ ভয়ে আর এবাড়িতে আসে না। কিন্তু বাঙাল না থাকলে তারা এখনও এসে টাকাটা সিকেটা ধানটা চালটা মেগে-পেতে নিয়ে যায়।

এসব ঘটনার পর মরণ হয়েছিল। ওপরের বোন মারা যাওয়ায় তার নাম রাখা হয়েছিল মরণকুমার। যমকে খুশি করতেই রাখা।

জিজিবুড়ি বলছিল, জমি কিনে কিনেই বাঙাল একদিন শেষ হয়ে যাবে।

জমি কিনে শেষ হবে কেন? জমি রাখতে জানলে জমির মতো জিনিস নেই। আর শোনো, তুমি এখন বড় হয়েছ, এখন আর বাবাকে তাঁর আড়ালেও বাঙাল বলবে না।

সবাই বলে যে, তাই মুখে এসে যায়।

অন্যের কাছে উনি যা, তোমার কাছেও কি তাই? একটা মান্যিগন্যি নেই?

আছে বাবা, খুব আছে। মরণ তার বাপকে যমের মতো ভয় খায়। আর ভয় খায় বলেই আড়ালে বাঙাল ডেকে সেই ভয়টার সঙ্গে লড়াই করে।

বাঙালের লুঙ্গিটা টান টান করে খুব যত্নের সঙ্গে মেলে দিয়ে ক্লিপ আটকাচ্ছে মা, অনেক সময় নিয়ে। এমন আদুরে ভাব, যেন লুঙ্গিটাই বাঙাল। তেমনি যত্ন করে গামছাটা মেলতে মেলতে মা আপনমনে বলল, তোমার বাবা ভাল লোক।

জিজিবুড়ি ঠিক উলটো কথা বলে, ও হল বাঙাল দেশের লোক, ওদের জাতজন্মের ঠিক নেই। তেলি সাউ না শুঁড়ি সাউ কে জানে বাবা, ভোল পালটে সব আসে। আর কথারই বা কী ছিরি। উর্দু বলছে না পার্সি বলছে বোঝার জো নেই। মুড়িকে বলে হালুম, কাদাকে বলে প্যাক। ছিছিক্কার যাই বাবা। তার ওপর ঊর্ধ্ববায়ু, রগচটা মুষল। ওরা কি সব ভাল লোক? ভাল লোকেরা কি লুকোছাপা বিয়ে করে বাপ? আরও কটা করে বসে আছে তার খোঁজ নেয় কে? কপালটাই আমার অমন, লোভ দেখিয়ে মেয়েটার সব্বোনাশ করল।

তাই যদি হবে তাহলে বাঙাল এলে মায়ের চেহারায় একটা ভেজা ভেজা স্নিগ্ধ ভাব কেন ফুটে ওঠে? চোখ দুখানা কেন অমন নরম হয়ে যায়? বাঙালের লুঙ্গি আর গামছাখানা কেমন টান টান করে মেলে দিল মা, আর কারও জামাকাপড় অত যত্ন করে মেলে না তো! হাঁ করে দেখছিল মরণ। বাঙাল ভাল লোক না খারাপ লোক এই অঙ্কটা তার মিলতে চায় না কিছুতেই।

জিজিবুড়ি পিছনের দিকের খিড়কি দরজায় কচুপাতার আড়াল থেকে উদয় হয়ে সাবধানে মুখ বাড়িয়ে বলল, বাঙালটা বিদেয় হয়েছে?

কথাটা শুনে মায়ের ভ্রূ কোঁচকাল।

 জিজিবুড়ি উঠোনে ঢুকতে ঢুকতে বলল, দিন নেই ক্ষণ নেই এসে উদয় হলেই হল। এমন আঁতকে উঠলুম যে পানের বাটাখানা পড়ে সব ছয়ছত্রখান। পিলে চমকানো লোক বাপু। দিলি ভাই তুলে দোক্তাটুকু? সুপুরিও পড়ে আছে দেখ কয়েক কুচি।

বাসন্তী একটু ঝাঁঝের গলায় বলে, সবসময় অমন ঠেস মেরে বাঙাল-বাঙাল বলো কেন বলো তো! শুনে শুনে বাচ্চারাও শিখছে। তোমার যে কবে আক্কেল হবে!

ও মা! বাঙালকে বাঙাল বলব না তো কী? নবদ্বীপের গোসাঁই তো নয় রে বাপু। ওসব মনিষ্যি আমাদের মতো তো আর নয়।

ওসব কী কথা মা! এতকাল বলে এসেছ, শুনেছি। কিন্তু এখন একটু মুখটা সামলাবে তো। ছেলেপুলেরা বড় হচ্ছে না? ভক্তিছেদ্দা শিখবে কিছু ওসব শুনলে?

ও মা! বাঙাল লোকদের আবার ভক্তিছেদ্দা কীসের রে? ওসব ডাকাত লুঠেরা লোক। দেখলি না গাঁয়ে এসেই কেমন রসালো জমিগুলো গাপ করে নিল। যারা দুটো-চারটে করে বিয়ে বসে তারা আবার ভাল লোক! রাঁঢ় পুষলেও না হয় কথা ছিল, বিয়ে বসে কোন আক্কেলে রে?

তুমি দোক্তা কুড়িয়ে নিয়ে বিদেয় হও তো! বেশি কথা কয়ো না। আমার বাঙাল বরই ভাল। জন্মে জন্মে যেন আমার অমন বাঙাল বরই হয়।

বলিস কী লো মুখপুড়ি? এ যে নিজে কুড়িয়ে অভিসম্পাত নিলি! মাথাটা তোর খেয়েছে দেখছি।

যখন দশটি হাজার টাকা নিয়ে নিজের মেয়েকে ওই বাঙালের কাছে বেচে দিয়েছিলে তখন এত শাস্ত্রজ্ঞান কোথায় ছিল? তখন তো বাঙাল বলে ঠোঁট বাঁকাওনি, হাতও গুটিয়ে নাওনি!

ও মা! তখন কি বুঝেছিলুম রে বাপু! এমন সোনাহারা মুখ করে এসে দাঁড়িয়েছিল যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। ওরা সব কামিখ্যের ডাকিনী বিদ্যে জানে, এক এক সময়ে এক এক রূপ ধরে। বুঝতে পারলে কি আর গুখেকোর মতো কাজ করি! একটা বাঙাল মরলে দুটো গোখরো সাপ জন্মায়।

খুব হয়েছে মা, তোমার আর বেশি বুঝে কাজ নেই। এতই যদি সে খারাপ তবে তার বাড়িতে এসে রাজ থানা গেড়ে বসে থাকো কেন, তার চাল ডাল টাকা হাত পেতে নিয়ে যাও কোন লজ্জায়?

বাঙালের জিনিস হলে নিতুম নাকি রে পোড়ারমুখি? তোর জিনিস বলে নিই। না দিস তো না-ই দিবি, অত কথা কীসের? তবে এও বলি বাপু, বাঙাল তোকে ওষুধ করে রেখেছে। ঘোর কাটলে টের পাবি।

এ যেন একটা টেপ রেকর্ডারে একই ক্যাসেট ঘুরে ফিরে বাজছে। জ্ঞান হয়ে অবধি মা আর জিজিবুড়ির এইসব চাপানউতোর শুনে আসছে মরণ। দুজনে লাগলেই মরণ মনে মনে নারদ মুনিকে ডাকতে লাগে। মা যত রাগবে সেদিন ততই মায়ের হাতের রান্না খোলতাই হবে। এর কখনও নড়চড় হয়নি। রেগে গেলে মায়ের হাত যেন অন্নপূর্ণার হাত। আজ আবার বাঙাল এসেছে, দু-চারটে ভালমন্দ হবে।

তোমরা কত ভাল তা জানা আছে। মানুষটাকে খুন অবধি করতে চেয়েছিল তোমার হিরের টুকরো ছেলেরা। আজও লোকটার কাঁধে আর পিঠে ভোজালির দাগ দগদগে হয়ে আছে।

ওসব বাজে কথা। বাঙাল রটাল আর তুইও বিশ্বাস করলি। কার সঙ্গে কোথায় গণ্ডগোল করে রেখেছিল তারা খুনোখুনি করতে লোক লাগায়। সত্যিই যদি হবে তাহলে বাঙাল মামলা করল না কেন শুনি!

সে আমি হাতেপায়ে ধরেছিলুম বলে। সবাই জানে মা, আর গুণধর ছেলেদের সারতে চেয়ো না। খুব তো ছেলেদের হয়ে টানছ, তা সেই গুণধর ছেলেরা এখন দেখছে তোমায়? লাথি ঝাঁটা মুখনাড়া খেয়ে তো পড়ে আছ, আর রোজ এসে এ বাড়িতে একখানা ঘর দেওয়ার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করছ।

ছেলেদের দোষ কী? বউগুলো খচ্চড়।

তোমার হাতের পাতের টাকাকড়িগুলো তো আর বউরা কেড়ে নেয়নি, গয়নাগুলোও তারা গাপ করেনি। করেছে তোমার অকালকুষ্মাণ্ড ছেলেরা। আর কত মিছে কথা কইবে মা!

জিজিবুড়ি একটু দম ধরে বসে রইল উঠোনে। তারপর হঠাৎ গলাটা মিহিন করে বলল, তা বাঙালের মেজাজটা ঠান্ডা হলে একবার কথাটা তুলিস। বেশি কিছু তো নয়, ওই পশ্চিমের দালানের নীচেরতলায় কোণের ঘরটা যদি দেয়। আর দুবেলা দুমুটো ভাত। এটুকু কি আর তার গায়ে লাগবে? দোহাত্তা তো কামাচ্ছে বাবা।

ওসব মতলব ছাড়ো মা। সে রাজি থাকলেও আমি রাজি নই। কিছুতেই সেরকম বন্দোবস্ত হবে না।

পেটের শত্তুরের মতো শত্রুর নেই, বুঝলি?

গজর গজর করতে করতে জিজিবুড়ি পাছদুয়ার দিয়ে বিদেয় হল।

মা কিছুক্ষণ বারান্দার সিঁড়িতে চুপ করে বসে রইল ঝুম হয়ে। দুটো চোখ ধীরে ধীরে টস টস করতে লাগল জলে। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে নীরবে কাঁদছে মা। কেন কাঁদে মরণ তা বুঝতে পারে। এখন সে বড় হয়েছে। মা বাঙালের কথা ভেবে কাঁদে। মা বাঙালকে বড্ড ভালবাসে। বাঙালকে কেন যে মরণ অত ভালবাসতে পারল না কে জানে।

সে কাছে গিয়ে ডাকল, মা!

হাত বাড়িয়ে মা তাকে ধরে পাশে বসিয়ে ধরা গলায় বলল, চুপটি করে বসে থাক। কথা বলিস না। আমার মনটা ভাল নেই।

একটু উশখুশ লাগছিল বটে, তবু মরণ চুপ করেই বসে রইল। মা আঁচল সরিয়ে কিছুক্ষণ উদাস চোখে সামনের দিকে চেয়ে রইল। সামনে ফর্সা উঠোন, চাটাইয়ে সর্ষে শুকোচ্ছে আর পুরনো তেঁতুল। একটা দুটো কাক ঘুরে ঘুরে উঠোনে নেমে আসছে। মা কাকগুলোকে হুড়ো অবধি দিল না। মায়ের মন আজ সত্যিই খারাপ।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে মা হঠাৎ বলল, বড় ভয় করছে বাবা, শুনছি নাকি সুমন আসবে।

 সুমন! সে কে মা?

বড়গিন্নির ছেলে।

ধম করে উঠল মরণের বুক। উত্তেজিত গলায় বলল, দাদা?

হ্যাঁ বাবা। তোর বাবা আজ খেতে বসে বলছিল, ছেলের নাকি খুব ইচ্ছে হয়েছে গাঁয়ের বাড়ি দেখে যেতে।

তাতে ভয় কী মা?

ভয় বলে ভয়। কী মনে করে আসছে তা তো জানি না। আমি তো তাদের শত্তুর।

 কেন মা?

সংসার ভাঙিনি আমি? একটা সংসার দু টুকরো হল তো আমার জন্যই। ছেলে কি ভাল মন নিয়ে আসবে?

কথাটা ভাববার মতো। মরণেরও ভয় হচ্ছে একটু, আনন্দ হচ্ছে খুব। শহরের দাদা বা দিদির কথা সে কত ভাবে কত স্বপ্ন দেখে তাদের নিয়ে। বড়মার কথাও খুব ভাববার চেষ্টা করে সে।

সত্যিই আসবে মা?

তোর বাবা তো বলল।

 কবে?

তার কোনও ঠিক নেই। হয়তো আসছে সপ্তাহে, বা তার পরে কোনওদিন। বড়গিন্নি তো তাদের কানে বিষ ঢালতে ছাড়েনি। তাই বড় ভয় হচ্ছে। কী জানি বিষয়সম্পত্তি নিয়ে দাবি তুলবে কিনা।

তাহলে কী হবে মা?

কে জানে কী হবে। সম্পত্তি তো তোর বাবার, আমার নামে দলিলটুকুই যা। তাই ভয় হচ্ছে।

 মরণ চুপ করে বসে রইল। ভিতরে যে আনন্দের আলোটা জ্বলে উঠেছিল সেটা ফের নিবে গেল। মরণ ভাবছে। মরণ বড় হচ্ছে।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়