মেঘলা দিনের কালো আলোয় ঘরের মধ্যে দুটি ছাইরঙা মানুষ দুজনের দিকে চেয়ে আছে। বাইরে সরু সরু অজস্র সাদা সুতোর মতো ঝুলে আছে বৃষ্টি। টিনের চালে ঝিমঝিম নেশাড় শব্দ। কথা নেই। বীণাপাণি আর নিমাই।

সেদিন অনেকক্ষণ পগার আচমকা মৃত্যুসংবাদটা ভাল করে বসছিল না বীণাপাণির মাথায়। কাঁদবে, না হোঃ হোঃ করে লটারি জেতার মতো আনন্দে হেসে উঠবে, সেটা তার ভিতরে তখনও স্থির হয়নি। আর ওই উজবুক লোকটা, পাঁচ ফুটিয়া, রোগাভোগা, ভীতু আর ধার্মিক লোকটা, চোখ তুলে ভাল করে বীণার দিকে যে তাকাতেই পারল না আজ অবধি, সেই লোকটা কেমন যেন চোখা চোখে চেয়ে ছিল তার চোখে। লোকটার সামনে গোছানো সুটকেস। একটু বাদেই চৌকাঠ পার হবে। তারপর হয়তো আর কোনওদিনই উল্টোবাগে চৌকাঠ পেরিয়ে এসে ঢুকবে না বীণাপাণির ঘরে।

বীণাপাণি এরকম অদ্ভুত অবস্থায় আর জীবনে পড়েনি। শোক, আনন্দ, উত্তেজনা, রাগ, ঘেন্না সব একসঙ্গে উথলে উঠছে ভিতরে। ঠিক এই সময়ে যদি চৌকির তলা থেকে তার পোষা বেড়াল কুঁচকি বেরিয়ে এসে তার কোলে না উঠে পড়ত, তাহলে কী যে করত বীণাপাণি কে জানে? কুঁচকিই সব কাটিয়ে দিল একটা আদুরে মিয়াও শব্দ তুলে। তার খিদে পেয়েছে।

বীণাপাণি বেড়ালটাকে বুকে চেপে ধরল। তার বুদ্ধি এখন স্থির নেই। মাথার ভিতরটা পাগল-পাগল। বুকটায় বড় দাপাদাপি। কী বলতে কী বলবে, কী করতে কী করে বসবে, কে জানে বাবা! আর ওই আহাম্মক লোটা তাকে কেন যে ওরকম করে দেখতে লেগেছে! বীণাপাণির কি একটু কাঁদা উচিত? বাড়াবাড়ি হবে না তো!

কদল না, তবে কাঁদার মতো একটা অবস্থায় সে থেমে রইল। চোখ ভরে উঠল জলে, কিন্তু গড়িয়ে পড়ল না। স্থির হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের অজস্র সুতোর বুনটের মতো একঘেয়ে বৃষ্টির দিকে চেয়ে রইল।

নিমাই এ সময়ে একটা গলা খাকারি দিল। তারপর তার সরু নরম মেয়েলি গলায় জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা কি পগার খবর দিয়ে গেল?

বীণা জবাব দিল না।

নিমাই জবাবের জন্য অপেক্ষা করল একটু। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এরকম সব কাণ্ড হয় বলেই তোমায় বারণ করেছিলাম।

বীণা চুপ করে যেমন চেয়েছিল তেমনি চেয়ে রইল। বাইরে চুপ বটে, কিন্তু তার ভিতরে এ সময়ে একটা কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। ঠিক এরকম একটা গোলমেলে ব্যাপারের মধ্যে নিমাই চলে গেলে তার কি হবে? ওকে চলে যেতে দেওয়া কি ঠিক হবে? রাগের মাথায়, কেঁকের মাথায় যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কিন্তু এখন তো সেই অবস্থাটা নেই। তাকে বুদ্ধি দেবে কে? বুদ্ধি চাইলে অনেকেই মাথা ধার দিতে আসবে, কিন্তু বীণাপাণির ভাল-মন্দ বুঝে কথা কইবে কি কেউ? তার বন্ধু অনেক, কিন্তু আত্মীয় তো এই একজনই। মাদামারা, পান্তাভাত, সব ঠিক। তবু নিমাই তো লোভী নয়, পাজি নয়, ধান্দাবাজ নয়। বকাঝকা-অত্যাচার ওর ওপর কম করে না বীণা! তবু নির্ভর করে। ওকে চলে যেতে দেওয়া কি উচিত কাজ হবে! আটকানোই বা যায় কি করে?

নিমাই উঠবার মতো একটু ভাব করে ফের বসে পড়ল উবু হয়ে, তারপর খুব সংকোচের সঙ্গে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। এ কথাটার জবাব অন্তত মাথা নেড়ে হলেও দাও। পা কি কাল রাতে টাকা পয়সা কিছু তোমার কাছে

গচ্ছিত রেখে গেছে?

এই প্রশ্নটাকেই ভয় পাচ্ছিল বীণা। পগা এসেছিল সন্ধের মুখে। খুব তাড়া ছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল তুমুল। নিমাই কোথায় বেরিয়েছে। খুব হাওয়া। হ্যারিকেনের আলোয় একখানা একসারসাইজ খাতা খুলে পরশমণি নামে একটা নতুন নাটকের পার্ট মুখস্থ করছিল বীণাপাণি। দরজায় ধাক্কা আর ডাকাডাকিতে উঠে দরজা খুলে দেখল, বর্ষাতি গায়ে পগা। জলে সপসপ করছে। মুখে একগাল হাসি। ফোম লেদারের ব্যাগ থেকে পলিথিনে মোড়া একটা প্যাকেট বের করে বীণার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, কাল সকালে নিয়ে যাবো।

বেশ ভারী প্যাকেট। এরা যে তাকে বিশ্বাস করে, ভালবেসে এসব রেখে যায় তা নয়। এরা জানে এদের টাকা পয়সা মেরে দিয়ে বীণাপাণি পার পাবে না। সীমান্ত জুড়ে এদের জাল বিছিয়ে রাখা আছে। সেই জাল কেটে বীণাপাণি কত দূর যারে? যতদিন মাথা নিচু করে চলবে ততদিন ঠিক আছে। গড়বড় করলে রেহাই নেই।

বীণা বাধ্য মেয়ের মতো প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলল, ঠিক আছে।

পগা আবার অন্ধকারে বাতাস-বৃষ্টির মধ্যে মিলিয়ে গেল। দরজা এঁটে বীণাপাণি প্যাকেটটা তেরঙ্গে রেখে তালা দিয়েছিল। এ সব প্যাকেটে কী থাকে তা তার জানতে নেই। জানতে চায়ও না সে। শুধু হেরোইন-টেরোইন না থাকলেই হল। পগা অবশ্য ও কারবার করে না। সে ডলার পাউন্ড আর টাকার লেনদেন করে।

কেউ দেখেনি। কেউ জানে না।

বীণাপাণির অভিনয়ের প্রতিভা এখন কাজে লাগল। সে অকপটে নিমাইয়ের দিকে চেয়ে কঠিন দৃঢ় গলায় বলে না। পগা রোজ আমার কাছে টাকা-পয়সা রেখে যায় না।

পার্টটা চমৎকার হল।

নিমাই চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, তাহলেই রক্ষে। নইলে বিপদ ছিল।

কিসের বিপদ?

নিমাই মাথাটা একটু নেড়ে বলে, তা কি জানি? বিপদ ওদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে।

বিপদ থাকলে আমার ছিল, তোমার তো আর নয়। তুমি তো বাক্সপ্যাটরা নিয়ে চৌকাঠ ডিঙিয়ে পগারপার হবে। আমি পড়ে থাকব, একা মেয়েমানুষ।

নিমাই কি একটু তটস্থ হল? নড়েচড়ে বসল। তারপর স্তিমিত গলায় বলল, বিপদ তো তোমারও ছিল না। মেশামেশিটা বড় করে ফেললে যে ওদের সঙ্গে। ভদ্রলোকের বউ-ঝিরা কি ওরকম করে?

বীণাপাণি নিজেকে সামলাতে পারল না। থমকানো চোখের জলটা এবার নেমে পড়ল গাল বেয়ে। টপটপ করে নামতে লাগল। গালে ছাকা দিয়ে নামতে লাগল। বীণাপাণি একটু ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আগে বলো, আমরা কবে ভদ্রলোক ছিলাম। কবে দ্রলোকের মতো ছিলাম? কেউ মানে আমাকে দ্রলোকের মেয়ে বলে? বলো, মানে কেউ? গোনে কেউ? সেই চোখে দেখে কেউ?

নিমাই কথাটা স্বীকার করল না। ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল, ওটা কথাই নয়। কথা হল তুমি মানো কিনা। তোমার বাবা মাস্টারমশাই ছিলেন। তোমার দাদা অত বড় বিদ্বান লোক।

বীণাপাণি কান্নার মধ্যেও ছিছিক্কার করে উঠল, তাই বুঝি আজ এই দশা আমার! বনগাঁয়ে যাত্ৰাদলে সঙ সাজতে হচ্ছে। রাস্তায় মুখখামুখি দেখা হলে আমার মায়ের পেটের দাদা আমাকে চিনতে চাইবে? আর বাবা! এ যাবৎ খোঁজ করেছে একবারও, মেয়েটা বেঁচে আছে না মরেছে?

আজ মাথাটা বড় গরম তোমার।

লোকে যখন আমাকে ভাল ভাল কথা বলে তখন আমার মুখে থুথু আসে, বুঝেছো? আর তুমি! তুমিই বা কোন দ্রলোটা শুনি! দাদার কথা বলছে, অমন মানুষের বোনকে বিয়ে করার সুবোদ কি তোমার ছিল? বাবা আহাম্মক বলেই না দিল বুলিয়ে!

নিমাই মাথা নিচু করেই বসে রইল। বড় অপরাধী ভাব।

আর বীণা জ্বলতে জ্বলতে ভিজতে লাগল চোখের জলে। বুঁচকি খিদে চেপে চুপ করে বসে রইল তার কোলে।

নিমাই অনেকক্ষণ বাদে গলা খাকারি দিয়ে বলল, একটা কথাই কই। কথাটা বাড়িয়ে বলছি না। বিয়ের কথাটা যখন উঠল তখন তোমার বাবাকে আমি কিন্তু বলেছিলাম, কাজটা আপনি ঠিক করছেন না মশাই। জাতে-কাটে এক হলেও, আমরা ঠিক সমান সমান নই। তা উনিও একটু বোকাসোকা মানুষ, লোক চিনতে পারেন না। বললেন, তোমার একদিন খুব উন্নতি হবে। এ আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি।

বীণাপাণি নাটক করে বলেই নিজের ওপর রাশ টেনে রাখতে পারে। দমকা কান্নাটা সামলে চুপ করে বসে রইল।

নিমাই খুব ভীতুভাবে আরও একবার গলা খাকারি দিয়ে বলে, কাজটা ঠিক হয়নি, জানি। আমি বড় নিচুতলার মানুষ। বড় পতিত। পড়েও ছিলুম কোন আঘাটায়। তোমার বাবাই কুড়িয়ে নিলেন। তা বলে সেই বুড়ো মানুষটার ওপর রেগে গিয়েও লাভ নেই। উনিও তাঁর কর্মের ফল ভোগ করছেন।

বীণাপাণি নিমাইয়ের দিকে অসুরবধের সময় মা দুৰ্গার মতো চেয়ে থেকে বলে, আর আমি কার কর্মফলটা ভোগ করছি শুনি! আমি কার পাকা ধানে মই দিয়ে এসেছি? দুনিয়াটা বুঝে শুনে উঠবার আগেই আহাম্মক বাপ আর একটা আহাম্মকের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে কন্যাদায় মিটিয়ে হাত ধুয়ে বসে রইল। একবার ভাবল না মেয়েটা খাবে পরবে কি। শুধু শুনেছিলাম ছেলের নাকি স্বভাবচরিত্ৰ ভাল। ওঃ ভাল চরিত্র ধুয়ে তো জল খাবো কিনা! এর চেয়ে যে স্মাগলাররাও অনেক ভাল। তারা তবু পুরুষমানুষ, ডাকাবুকো। এমন মেনীমুখখ তো নয়!

নিমাই ফের অপোবদন। এই বিদায় নেওয়ার মুহূর্তটা আরও একটু অন্যরকম হতে পারত বোধ হয়। সে তো চলেই যাচ্ছে। তবে আর এই বাক্যবাণ কেন? স্যুটকেসটার দিকে হাত বাড়িয়ে নিমাই ফের গলা খাকারি দিয়ে বলে, পাপমুখে একটা কথা আসছে। বলব?

বীণা জবাব দিল না।

নিমাই মাথাটা নিচু রেখেই বলে, আজকাল সবই হচ্ছে-টচ্ছে দেখছি চারদিকে। সেইসব দেখেই সাহস করে বলছি। বিয়ে ব্যাপারটা আগে যেমন পাকা ব্যাপার ছিল, আজকাল তেমনধারা নেই। ওসব অংবং মন্ত্রের কী-ই বা দাম। পুবুতরা তো দক্ষিণাটি পেলেই গড়গড় করে মন্ত্ৰ পড়ে চারহাত মিলিয়ে দেয়। কেউ মানছে না ওসব। আমি বলি কি, তোমারই বা মানবার কি দরকার?

বীণা বুঁচকিকে এত জোরে চেপে ধরল যে বেড়ালটা হাঁচোড় পাঁচোড় করে উঠল। বীণা বলল, কী বলতে চাইছ?

বিয়েটা তোমায় মানতে হবে না। আমরা বড় নিচুতলার লোক, আমরা যাই করি, আমাদের নিয়ে সমাজে কথা ওঠে না। কেউ ভাল করে নজরই করে না আমাদের। তাই বলি কি, এখনও সময় আছে তোমার। নামডাক হয়েছে। দু-পাঁচটা টাকাও আসছে। কাউকে পছন্দ হলে বিয়ে করা।

কথাটা নতুন নয়। আগেও ঠারেঠোরে বলেছে নিমাই। বীণাপাণি দাঁতে দাঁত পিষে বলে, কথাটা বলতে লজ্জা হল না। জিব খসে পড়ল না তোমার?

নিমাই মাথাটা নেড়ে বলে, আমি যদি একটা মানুষের মতো মানুষ হতাম তবে কি বলতে পারতাম। দখল রাখা এখন বড় শক্ত কাজ। জোরালো লোক না হলে কিছুর ওপর দখল থাকে না আজকাল। অনেক ভেবে দেখেছি, বিয়েটাও মাঝে মাঝে একটা জুলুম ছাড়া কিছু নয়। যেখানে বনে না সেখানেও ধরে বেঁধে আটকে রাখা! কাজটা অন্যায়। ছোটোলোকদের তো দেখছ! পেটে এক মুখে আর এক নয়। পাঁচু রিকশাওলা এই তো মাসটাক আগে টোপর পরে বিয়ে করে এল। সঙ্গে বাদ্যি-বাজনা, হ্যাজাকের আলো। মাস না ঘুরতেই বউ হাওয়া হয়েছে। পাঁচুও দিব্যি হাসিমুখে রিকশা চালাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি। আমার বেশ লাগল ব্যাপারটা। চাপান নেই, বাঁধন নেই। বেশ তো!

সেটা বুঝি ভাল হল!

খারাপটা কিসের বলো তো! আমাদের আর কি আসে যায়? কে মাথা ঘামাবে আমাদের নিয়ে?

তোমার নিজের আবার বিয়ে বসার ইচ্ছে হয়েছে, সে কথাটা কবুল করলেই তো হয়।

নিমাই জিব কেটে বলে, ও কথা বোলা না।

কেন বলব না? গরজ তো তোমারই বেশী দেখছি!

নিমাই দুঃখিত মুখে বলে, আমার আর্ষ নেই। অধিকারী না হলে কি হয়? তোমার মতো মানুষ পেয়েও কি হল কিছু। আর আমার জন্যই না তোমার এত আপদ-বিপদ-কষ্ট। অত বড় অসুখটা থেকে বাঁচিয়ে তুললে, খাওয়া পরার জোগাড় করলে। কিছু কম তো করোনি। আমার মা-বাবা বড় অভাবী, বড় লোভী। তারাই নামিয়ে দিল তোমাকে। সবই বরাত। এখন ভাবি, কিছু যদি শোধরানো যায়।

আমাকে বোধহয় আজকাল তোমার সন্দেহ হয়!

নিমাই সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, তা সে দোষও আমার আছে। মনে কত পাপ লুকিয়ে থাকে মানুষের

কার সঙ্গে সন্দেহ হয়? কাকা তো?

সে বড় ভাল লোক। স্মাগলার হোক, কি আর যাই হোক, সে একটা জিনিস নিয়েই পড়ে আছে। পালা ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবে না। অমন যার ধ্যান সে সহজে এসব দিকে ঝোঁকে? তাকে আমি খানিক চিনেছি। সে ঠিক ওরকম নয়। তবে যদি তোমার তাকে ভক্তি করতে ইচ্ছে করে তো মন্দ কী? কাকাকেই বিয়ে করতে পারো।

সম্প্ৰদানটা কি তুমিই করবে নাকি?

বড্ড রেগে যাচ্ছে। আমি হিংসুটে কথা বলিনি। আমার আর ওসব হয় না। বড় কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। কোথায় একটা শক্ত গিঁট পড়ে গেছে, খুলছে না। আমি অত গুছিয়ে কথা বলতে পারি না।

বেশ গুছিয়েই বলেছে। শোনো, যদি কাউকে বিয়ে করতে চাই তবে কি এতদিন তোমার অনুমতির জন্য বসেছিলাম? অনুমতি বা আদেশ দরকার হত নাকি? বরং নিজেকে বাঁচাতেই তোমাকে জোর করে ধরে এনেছিলাম। ভুলে গেছ সব?

ভুলব? আমি কি তেমন নিমকহারাম?

তুমিই তো সবচেয়ে বেশী নিমকহারাম। নাহলে ওকথা কেউ মুখে উচ্চারণ করে। বেইমান নও তুমি!

নিমাই ফের মাথা নিচু করে। অনেকক্ষণ নিচু করে রাখে মুখ।

বীণা দেখতে পায়, নিমাইয়ের চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে মাটির মেঝের ওপর।

আমি মেয়েমানুষ, আমার অত বুদ্ধি নেই। মেয়েমানুষ চলে পুরুষের বুদ্ধিতে। কিন্তু পারলে তুমি আমাকে চালিয়ে নিতে? আমাকে নষ্ট বলে ধরে নিচ্ছে, কিন্তু যদি সত্যিই নষ্ট হই তার জন্য দায়ী কে থাকবে শুনি! তুমি ছাড়া আর কে? বউকে ফেলে চলে যাওয়ার মধ্যেই বুঝি তোমার সব বাহাদুরি? আর ভাবছো আমাকে আবার বিয়ে করার কথা বলে খুব উদারতা দেখানো হল।

পুরুষমানুষের কান্না দুচোখে দেখতে পারে না বীণাপাণি। তার বুক জ্বলছে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। বাইরে অজস্র সুতো ঝুলছে। ঝুলেই আছে। টিনের চালে মিঠে মিহিন বৃষ্টির শব্দ। একটা ব্যাঙ লাফ মেরে নিমাইয়ের সুটকেসটা ডিঙিয়ে চৌকির তলায় ঢুকে গেল।

নিমাই ধরা গলায় বলল, আমরা একটু বোকাসোকা মানুষ। তোমাকে দেওয়ার মতো বুদ্ধিই কি আমার আছে! ভেবেচিন্তে একটা কথা হয়তো বললাম, সেটা তোমার হয়তো পছন্দ হল না। তোমাকে বড় ভয় খাই বীণাপাণি!

বীণাপাণি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সেটা জানি। আমার পয়সায় খাও বলে তোমার ভারী লজ্জা। সবসময়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকো, যেন পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে। তাই না?

আজ তুমি বড় সুন্দর করে বলছো। এরকম করে বললে বুকের একটা জোর হয়! বলো, আরও খানিক বলো।

বীণা লোকটার দিকে তাকাল। মাথাটা কি ঠাণ্ডা হয়েছে। ওর ঐ অনুতাপ হচ্ছে? সে বলল, তাহলে কথাগুলো সত্যি?

খুব। তুমি যেন সবসময়ে আমার নাগালের বাইরে। যখন বিয়ে করে আনলাম তখন একরকম ছিলো। এখন যেন গুটি কেটে প্রজাপতি বেরিয়ে পড়েছে। সেইজন্যেই কেমন যেন পর-পর লাগে, ভয়-ভয় লাগে।

দোষটা কি আমার, বলো!

নিমাই মাথা নেড়ে বলে, তোমার দোষ কেন হবে? আমিই কি একটা মানুষ? রোগে ভুগে আমার খানিকটা গেছে, ভয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি বলে আমার বারো আনাই বরবাদ। তার ওপর কাজ নেই, কর্ম নেই, আমি ষোল আনাই তো নষ্ট! তুমি ছিলে বলে টিক টিক করে বেঁচে আছি। কিন্তু পুরুষমানুষের এরকম বেঁচে থাকতে নেই, সে আমি খুব বুঝতে পারি।

আমার মাঝে মাঝে ভীষণ মাথা গরম হয়ে যায়। নিজেকে সামলাতে পারি না। জানো তো?

জানব না? এতকাল একসঙ্গে আছি।

জানোই যদি, তবে একটা কথার জন্য চলে যাচ্ছে কেন?

নিমাই এবার হাসল। তার রোগা মুখখানায় কোনও তেমন সৌন্দৰ্য নেই। তবে হাসলে ভারী ভাল দেখায়। লাজুক গলায় বলল, থাকতে বললে তবে তো থাকব। আমার তো কখনও তোমার ওপর রাগ-টাগ হয় না, অভিমান হয় না। শুধু ভাবি আমি থাকায় বীণার বড় অসুবিধে হচ্ছে।

হাঁড়ি কলসিতেও ঠোকাঠুকি হয়, তা বলে যা নয়। তাই ভেবে নাও কেন? আর রাগ করে বাঁধন ছিড়লেই তো হবে না। তোমার মা-বাবাকে খাওয়াবে কি? সব দিক বিচার করে তবে তো কাজ করতে হয়!

মা-বাবার কথা উঠলেই বড় দুঃখিত হয়ে পড়ে নিমাই। তার মা-বাবা বড় লোভী মানুষ। অভাবে অভাবেই এমনটা হয়েছে। একটু খাওয়া পরার আশায় সব ভাসিয়ে দিতে পারে। এমন কি বীণাপাণি যখন যাত্রায় নাম লেখায় তখন নিমাইয়ের মা খুব আশকারা দিয়ে বলেছিল,মনিবকে খুশি রাখতে চেষ্টা কোরো। শরীর যদি ঐটোকাটা হয়ে পড়ে তাহলে গঙ্গায় ড়ুব দিয়ে নিলেই হবে। একথা বীণাপাণিই বলেছে নিমাইকে। শুনে কানে হাত চাপা দিয়েছিল নিমাই। কিন্তু মায়ের ওপর তা বলে রাগ নেই তার। মা বড় বোকা মানুষ, বাবাও বড় বোকা মানুষ। এ দুটি বোকা মানুষের জন্য তার বড় মায়া। এ দুজন যদি খেতে না পায়, যদি কষ্ট পায়, তবে আর নিমাইয়ের বেঁচে থাকার মানে হয় না।

নিমাই কৃতজ্ঞতায় ছলছলে চোখে বীণাপাণির দিকে চেয়ে বলে, তোমার বড় দয়া বীণাপাণি! তোমার জন্যই বুড়োটা আর বুড়িটা এখনও বেঁচে আছে। কত আশীৰ্বাদ করে তোমাকে! তবে তাদের তো বুদ্ধি নেই, বড় লোভী, কখন কি বলে, কি করে তার ঠিক নেই! তুমি ওদের ওপর রাগ কোরো না।

তোমাকে অত গদগদ হতে হবে না। ওরকম গদগদ হও বলেই তো তোমার সঙ্গে আমার পট খায় না। বউয়ের সঙ্গে অত হাত-কচলানো ভদ্রতা কিসের? তোমার ভাবখানাই এমন যেন পরের বউ চুরি করে এনেছো।

নিমাই আবার নিরাশ-হওয়া গলায় বলে, আমি বড় বোকা মানুষ। খুব বুদ্ধি করে কিছু কইতে বা করতে পারি না।

আজ তোমাকে বোকা মানুষ পেয়েছে। শুধু বোকা বলে বসে থাকলেই হবে! বোকাদেরও তো বাঁচতে হবে, না-কি? আচ্ছা বলো তো, এই বাক্সটা গুছিয়ে রওনা হচ্ছিলে কোথায়? আমার কাছে লুকিও না।

নিমাই ভারি লজ্জায় পড়ে গেল। মাথা নিচু করে মাটির ওপর আঙুল দিয়ে একটু আঁক কাটতে কাটতে বলল, বসন্তপুরের গোকুল একটা যোগালির কাজ দিয়েছিল। আজ সেইখানেই যাচ্ছিলুম।

যোগালির কাজ! সে কিরকম?

বিয়েবাড়িতে গোকুল রান্না করে। তার বেশ নাম-ডাক। বড় একটা বসে থাকে না। দুতিনজন যোগালি লাগে। মাছ কাটা, পেষা, জল তোলা—এইসব আর কি।

মা গো! তুমি ওইসব করতে যাচ্ছিলে?

দোষের কি? কাজ অত গায়ে মাখতে নেই। গোকুল একটু খাতিরও করে। তবে পাকাঁপাকি করতুম না। দুচারটে বড় জোর। পলের দোকানটাই ফেরি করব একদিন।

সে তো এখানেও করতে পারো। করবে?

এখানে একটা অসুবিধে। তোমায় সবাই চেনে। দোকান দিলে তোমার অপমান হবে না তো!

শোনো কথা! আমার আবার সম্মানটা কিসের? আর দোকানদারই বা কোন খারাপ?

বাঁচালে! আমি শুধু তোমার কথা ভেবেই এতদিন কথাটা মাথায় রাখিনি।

শোনো, খোলা রোদে হাওয়ার স্টল দিয়ে বসলে হবে না। মাথার ওপর ছাউনি না থাকলে বড় কষ্ট। তুমি রোগা মানুষ, ওসব সাইবে না। দিলে ঘর ভাড়া নিয়ে দোকান দিও।

ও বাবা! সে যে বেজায় ভাড়া চাইবে। বাজারের দোকান, সেলামিও চেয়ে বসবে নির্ঘাৎ।

ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না! যা লাগে তা আমি দেবো।

তুমিই তো দিচ্ছে। শরীর পাত করে দিচ্ছে। দরকার কি ওসব বাবুগিরির? মনোেহারী দোকান তো আর নয়! ফলের দোকান খোলামেলাই ভাল।

মনোহারীই বা নয় কেন?

ও বাবাঃ! পাগলী বলে কি?

ওসব পরে ভাবা যাবে। আজ বাদলা দিনে খিচুড়ি আর পোপর ভাজা খাবে?

বসন্ত যে বসে থাকবে বটতলায় আমার জন্য!

তোমাকে আজ বেরোতে দিচ্ছে কে?

তাহলে অন্তত তাকে খবরটা দিয়ে আসতে হয়! লোকটা অপেক্ষা করবে। কাল সকাল থেকে যজ্ঞিবাড়ির রান্না, আজ বেলাবেলি গিয়ে সব ব্যবস্থাপত্তর যোগাড়-যন্তর করার কথা।

ওই অলক্ষুণে বাক্সটা খুলে জামাকাপড় সব নামিয়ে রাখো। তারপর ছাতাটা নিয়ে এক দৌড়ে তাকে জানিয়ে এসো গে যে, যেতে পারবে না।

কথার খেলাপ হবে না। তাতে?

মোটেই হবে না! মাঝে মাঝে বাঁচার জন্য কথার খেলাপ করতে হয়। তাতে দোষ নেই। আর যোগালির কি অভাব নাকি? চারদিকে কত বেকার লোক!

তা বটে।

দোকান থেকে একটু ঘি এনো। রসময়ের দোকানে পাওয়া যায়। আর পঁচিশ পয়সার তেজপাতা।

ও বাবা! আজি তো দেখছি ভোজবাড়ি?

যাও, দেরি কোরো না।

উঠে পড়ল নিমাই। ছাতা মাথায় সে বেরিয়ে যেতেই দরজা। এঁটে দিল বীণাপাণি। না, এখন নিমাইকে তাড়ালে তার চলবে না। নিমাইকে তার দরকার।

তোরঙ্গটা বের করার আগে সে জানালাগুলো বন্ধ করে নিল। সাবধানের মার নেই! তোরঙ্গটা যখন খুলছে তখন বুক কাপিছিল ভীষণ। মস্ত ভারী প্যাকেটটা সে অস্থির হাতে টেনে হিঁচড়ে মোড়কটা ছিঁড়ে খুলল। যা দেখল তাতে তার চক্ষুঃস্থির। ডলার আর পাউন্ডের কয়েক কেতা নোট। মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছিল তার। তাড়াতাড়ি উল্টেপাল্টে যতদূর দেখল। কয়েকটা একশ ডলারের নোটও আছে। তোরঙ্গের নিচে জামাকাপড়ের তলায় জিনিসটা আবার চাপা দিয়ে রেখে তালা বন্ধ করল। সে।

একটু আগে নিমাই যখন চলে যাচ্ছিল তখন মনটা বিষ হয়ে ছিল বীণার। যাচ্ছে যাক। বেঘোরে কোথায় মরে পড়ে থাকবে হয়তো! তাই থাক! বীণা আর ভাববে না। ওর কথা। মনটা শক্ত হয়ে ছিল। যেই পগার খুন হওয়ার খবরটা পেল অমনি সব ওলট পালট হয়ে গেল কেন? মনটা নরম হল। কেন যেন মনে হতে লাগল, নিমাই ছাড়া সে একা থাকতে পারবে না! সে কি এই এত এত পড়ে পাওয়া টাকার জন্য? সে জানে, এ টাকার কথা জানলে নিমাই কিছুতেই তাকে এ টাকা ছুতে দেবে না। বড্ড ধর্মভীরু মানুষ।

বীণাপাণিকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। সব দিক যাতে বজায় থাকে।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়