রশ্মি চলে যাওয়ার দিন চারেক পর ফের গায়ের কুটিরে ফিরে গেল বটে। হেমাঙ্গ। কিন্তু বেশি দিন থাকা হল না। তার পার্টনাররা তাগাদা দিচ্ছে, কাজকর্মে মন দাও। বিস্তর কাজ পেন্ডিং।

অস্বাভাবিকতাটা হেমাঙ্গও বুঝতে পারছে। সে যদি কাজ না-ই করে তা হলে ফার্ম থেকে তার শেয়ার তুলে নিয়ে বেকার হয়ে যেতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের কেসগুলি যদি সে না করে তা হলে ক্লায়েন্টরা অন্য ফার্মের কাছে চলে যাবে। তাতে বিস্তর ক্ষতি। শুধু তার নয়, পার্টনারদেরও।

সুতরাং হেমাঙ্গ তার কুটির ছেড়ে কলকাতায় ফিরল। দাড়িটা কাটল না। রয়ে গেল। কলকাতায় ফিরেই আকণ্ঠ কাজে ড়ুবে গেল সে। তার ফাঁকে ফাঁকেই ক্লায়েন্টের ডাকে যেতে হল বোম্বাই, মাদ্রাজ, বাঙ্গালোর, কানপুর। গায়ে থেকে থেকে একটা জড়তা আসছিল শরীর আর মনে। কাজের জাতাকলে পড়ে সেটা কেটে গেল।

দীর্ঘদিন আলস্যজড়িত সময় কাটানোর পর হঠাৎ এত কাজের চাপে প্রথমটা হাঁফ ধরে যাচ্ছিল হেমাঙ্গর। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে সয়ে গেল। রশ্মির ফাঁকা জায়গাটা কি কাজ দিয়েই ভরাট করে নেওয়া যাবে!–

প্রায় দুমাস বাদে এক রাতে রশ্মির টেলিফোন এল লন্ডন থেকে।

কোথায় থাকো বলো তো! অন্তত তিনবার ফোন করেছি। গত দু মাসে। ফের কি গাঁয়ে ফিরে গেছ নাকি?

না রশ্মি। অনেক দিনের কাজকর্ম জমে ছিল, বাইরে যেতে হল। কয়েকবার। কেমন আছ?

খুব ভাল। প্রথমটায় এসে এক বান্ধবীর কাছে ছিলাম কয়েকদিন। তারপর কাউনসিলের ফ্ল্যাটে। এক সপ্তাহ হল গ্রিনফোর্ডে একটা বাড়ি কিনেছি।

বাড়ি কিনেছ?

ছোট সুন্দর বাড়ি। বেশ অনেকটা জায়গা আছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অগোছালো হয়ে দিব্যি আছি। এবার এখানে ভীষণ ঠাণ্ডা। তুমি কেমন আছ?

এই একরকম। একটু ফাঁকা লাগছে। তুমি নেই।

রশ্মি হাসল, বোকা। আমি তো হাতের নাগালেই। কলকাতা থেকে কেউ কেউ আজকাল উইক-এন্ডেও লন্ডনে আসে, তা জানো?

সে যারা পারে তারা যায়।

সামারে চলে এসো না! ওই সময়ে আমার মাও আসবে আমার কাছে। ইউরোপে একটা ট্রিপ দিয়ে আসব। আর শোনো, আমরা কিন্তু এখন অ্যাডাল্ট। কথাটা মনে রেখো।

একটু বিষণ্ণ হাসল হেমাঙ্গ। রশ্মি তাকে ডাকছে। সে গিয়ে রশ্মির সঙ্গেই থাকবে? তার সঙ্গেই ইউরোপ ঘুরবে? না, সেটা পেরে উঠবে না হেমাঙ্গ।

মুখে সে বলল, আচ্ছা, দেখা যাবে। গাড়ি কিনেছ?

হ্যাঁ। একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মার্সিডিস। দাড়িটা কি কেটে ফেলেছ?

না। আছে।

তা হলে কেটো না। দাড়িতে তোমাকে বেশ রোমান্টিক দেখাচ্ছিল।

তোমার নিশ্চয়ই লন্ডনে গিয়ে ভাল লাগছে?

দারুণ। তুমিতো জানোই এটাই আমার দেশ। এখানে আমি যত নিশ্চিন্ত বোধ করি ততটা আর কোথাও নয়। দিস ইজ মাই হোম। এখানেই জন্মেছিলাম, হয়তো এখানেই মরব।

জানি। তুমি এখানে একদমই স্বচ্ছন্দে ছিলে না।

না। আমার হাফ ধরে যেত।

বরফ পড়ছে?

আমি আসার পর একদিন পড়েছিল। সবুজ একটু মরে গেছে, কিন্তু তত্ত্ব লন্ডন এই সিজনেও কলকাতার চেয়ে অনেক বেশি গ্রিন।

কোনও অশান্তি নেই তো?

লন্ডনে বরাবর কিছু অশান্তি থাকেই। তবে এখনও তো লন্ডন পুলিশ আর্মস ক্যারি করে না। ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়। গ্রিনফোর্ড খুব পিসফুল এলাকা। সামারে আসবে? কথা দাও।

চেষ্টা করব।

তোমার সেই শপিং-এর নেশোটা এখনও আছে? নতুন কী কিনলে?

হেমাঙ্গ মৃদুস্বরে বলল, কিছু না। অনেক দিন কিছু কিনিনি। আজকাল খুব গেয়ো হয়ে গেছি।

তাই বুঝি? এটা তো খুব ভাল খবর।

রশ্মি, তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি মিস করছি?

জানো না বুঝি? বলে রশ্মি একটু শব্দ করে হাসল, তোমাকেই মিস করছি।

ওখানে তোমার এখন নিশ্চয়ই অনেক কাজ!

ওঃ ভীষণ। চাকরির পর বাড়ি এসে অনেক রাত অবধি পড়াশুনো করি। তার ওপর রান্নাটান্নাও করতে হচ্ছে! সময় একদম পাই না।

এইরকম আরও কিছুক্ষণ আলগা কথা হল। তারপর ফোন ছেড়ে দিল তারা। হেমাঙ্গ ভাবতে বসল, রশ্মির সঙ্গে কথা বলে তার কোনও ভাবান্তর হল কি? বুকে দামাল রক্ত ছুটিল কি পাগলা ঘোড়ার মতো? আলো হয়ে গেল কি অন্ধকার মন?

না, ঠিক তা হল না। কিন্তু ভাল লাগল। সেই মৃদু ভাললাগা যেন আফটার শেভ লোশনের মৃদু গন্ধের মতো লেগে রইল অনেকক্ষণ তার মনে।

আজকাল চারুশীলা ফোন করে না। একটু রাগ করেছে। করতেই পারে। চারুশীলা খুব চেয়েছিল, বিয়েটা হোক। চেষ্টাও করেছিল যথাসাধ্য। অপমানটা ভুলতে পারছে না।

রশ্মির ফোন আসার দুদিন বাদে সে চারুশীলাকে ফোন করল এক রাত্রে।

কেমন আছিস চারুন্দি?

এই একরকম। তোর কি খবর?

আমারও ওই একরকম। রেগে আছিস নাকি?

রাগিব। কেন?

আজকাল খোঁজ নিচ্ছিস না।

শুনতে পাচ্ছি তুই নাকি ভীষণ ব্যস্ত। দিল্লি-বোম্বাই করে বেড়াচ্ছিস।

तालु छिब्लभ।

রশ্মির কোনও খবর পেয়েছিস?

দুদিন আগে ফোন করেছিল।

কী বলে?

ভাল আছে। ওটা তো ওর দেশ, জন্মভূমি।

আমাকেও ফোন করেছিল।

তাই নাকি? কী বলছে তোকে?

ভুঃ। তোর কথাও হল। তোকে মিস করছে।

কী যে কারলি তুই-ই জানিস।

প্রসঙ্গটা ভুলতে পারছিস না কেন?

ভুলব? রশ্মিকে কি ভোলা যায়?

রশ্মিকে ভুলবি কেন? কী বোকা তুই! বিয়ের প্রসঙ্গটার কথা বলছি। ওটা তো এখন ইতিহাস।

ইতিহাস ভুলতে হয় বুঝি?

ভুলে যা চারুদি। প্লিজ! ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।

এখন ভগবানকে টেনে এনে নিজের দোষ ঢাকছিস? বেশ ছেলে!

আচ্ছা চারুদি, তুই কেন আমার জীবনটায় অশান্তি ঢোকাতে চাস বল তো! আমার বহুকালের একটা মাত্র শখ, সেটা হল একা থাকা। অনেক কষ্টে বাবা-মাকে বুঝিয়ে বিডন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে এখানে এসে দিব্যি ছিলাম। তোরা তার মধ্যে একগাদা জটিলতা এনে ফেললি।

রশ্মিকে কি আমি এনেছিলাম ধরে?

আমিও আনিনি, রশ্মি একটা আকস্মিকতা, আমরা বন্ধুর মতোই তো ছিলাম। বিয়ের আইডিয়াটা তোর মাথায় খেলেছিল বোধ হয়।

সেটা তোর ভালর জন্যই। পরে পস্তাবি।

প্রসঙ্গটা থাক চারুদি। অনেক দিন আমাকে নেমন্তনু খাওয়াসনি। একদিন খাওয়াবি।

যেদিন খুশি চলে আয়।

সুব্রতদা বাইরে চলে যায়নি তো?

না। এখন কিছুদিন থাকবে। ইউ পি-তে একটা বড় প্রোজেক্টের কাজ পেয়েছে। এখন তার বেস ওয়ার্ক চলছে।

কলকাতায় আছে তো?

আছে। কালকেই আয়।

সন্ধের পর যাব।

চারুশীলা খুশি হল। বলল, তোর মস্ত সাপোর্টার হল তোর সুব্রতদা। কেন রে?

আমি লোকটা যে ভাল।

ছাই ভাল। ও কেবল বলে, হেমাঙ্গ ইজ এ গুড ডিসিশন মেকার। আমি শুনে হেসে বাঁচি না। শালুক চিনেছে গোপালঠাকুর।

সুব্রতদা ইজ এ ওয়াইজ ম্যান।

দুজনে দুজনের পিঠ চুলকে গেলেই তো হবে না। তোরা দুজনেই চূড়ান্ত ইমপ্র্যাক্টিক্যাল।

কাল যাচ্ছি তা হলে।

ফোন ছেড়ে দিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল হেমাঙ্গ। আজকাল টি ভি বা ভি সি আর ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। গান শুনতে ইচ্ছে হয় না। বই পড়তে ইচ্ছে হয় না। শুধু চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে। বসে বসে যে কিছু একটা ভাবে তাও নয়। এলোমেলো নানা চিন্তা উড়ে যায় মাথার ভিতর দিয়ে ছেড়া মেঘের মতো।

তাকে কি আলসেমিতে ধরেছে?

পরদিন সন্ধের পর হেমাঙ্গ গাড়ি চালিয়ে হাজির হয়ে গেল চারুশীলার বাড়িতে। নানা সুখাদ্য রান্নার গন্ধ পেল বাতাসে। দেখল, তাকে উপলক্ষ করে আরও কয়েক জনকে নিমন্ত্রণ করে এনেছে। তার একটা ঘনিষ্ঠমহল আছে। অবশ্যম্ভাবী তাতে থাকবেই কৃষ্ণজীবন সন্ত্রীক, থাকবে অনু আর ঝুমকিরা, ইদানীং থাকছে চয়নও। তারাই আছে। না, ঝুমকি নেই, অনু আছে।

এত লোকের ভিড় আজকাল ভাল লাগে না হেমাঙ্গর। কথা বলতে ক্লান্ত লাগে।

তাকে দেখে অনুই প্রথম লাফিয়ে উঠল, হ্যাল্লো!

হেমাঙ্গ মৃদু হেসে বলল, হ্যাল্লো। আরে! তুমি যে বেশ বড় হয়ে গেছ!

ছাই হয়েছি। একদম লম্বা হচ্ছি না যে!

তুমি কত?

পাঁচ ফুটের একটু বেশি।

তা হলে খুব লম্বা হবে। এটাই তো বাড়ের বয়সী।

অনু মাথা নেড়ে বলে, কোনও চান্স নেই। ষোলোতেও মাত্র এতটুকু হাইটি! ষোলোর পর কি আর মেয়েরা লম্বা হয়?

তা বলতে পারব না। তবে শুনেছি আঠারো পর্যন্ত সবাই বাড়তে থাকে।

উঃ, তা হলে বেঁচে যাই। পাঁচ চার বা পাঁচ হলে মোটামুটি চলে যাবে। পাঁচ সাত বা আট হলে তো কথাই নেই।

তুমি বুঝি খুব হাইট ভালবাস?

কে না বাসে বলুন, আপনি কিন্তু বেশ লম্বা। কত বলুন তো!

পাঁচ এগারো।

ওঃ, সুপার্ব!

একটু ইতস্তত করে হেমাঙ্গ জিজ্ঞেস করল, ঝুমকি আসেনি বুঝি?

দিদির জ্বর হয়েছিল। উইক।,

চাকরি পেয়েছে?

না তো!

একটু গভীর বিষণ্ণ মুখে কৃষ্ণজীবন বসেছিল এক ধারে। হেমাঙ্গকে দেখে একটু হাসল।

হেমাঙ্গ পাশের সোফাটায় বসে বলল, কেমন আছেন?

কৃষ্ণজীবন বিনীতভাবে বলল, ভালই। আপনার কি খবর?

ভাল।

দাড়ি রাখলেন বুঝি?

ঠিক রাখা নয়। রোজ শেভ করতে ইচ্ছে হয় না।

দাড়ির একটা প্লাস পয়েন্ট আছে। র্যাডিয়েশন থেকে বাঁচায়।

তাই নাকি? আমি অবশ্য সেটা ভেবে রাখিনি।

শুনলাম কোথায় এক গ্রামে নদীর ধারে একটা বাড়ি কিনেছেন!

কে বলল?

চারুশীলা বলছিলেন।

হ্যাঁ।

বেশ করেছেন। শহরের মানুষেরা আজকাল একটু দূরে কোথাও ফার্ম হাউস বা খামারবাড়ি করছে। উইক এন্ডে চলে যায়। একটু বিশুদ্ধ বাতাসে দম নিয়ে আসে।

কাজটা তা হলে ঠিকই করেছি। বলছেন? সবাই তো আমাকে পাগল বলছে।

কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বলল, মোটেই নয়। আমার তো মনে হয়, শহরের বাইরে একটা শেলটার করে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

আপনি খুব শহর-বিরোধী, তাই না?

জীবন ম্লান হেসে বলে, তাও ঠিক নয়। শহর তৈরি করতে হলে তাতে লোকবসতির সঙ্গে সমানুপাতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল। মানুষের অস্তিত্বের জন্যই দরকার ছিল। ছেলেবেলার কলকাতার আকাশে চিল দেখেছেন?

অনেক দেখেছি।

আমরাও দেখেছি। দোকান থেকে খাবার আনার সময় প্রায়ই ছো। মেরে নিয়ে যেত। আজকাল আর দেখতে পান?

না।

তার মানে, কাছাকাছি চিল বসতে পারে এমন যে-সব গাছপালা ছিল সব লোপাট হয়ে গেছে। পাখি কমছে, জীবজন্তু কমছে। বাড়ছে শুধু ঘরবাড়ি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল হেমাঙ্গ। কৃষ্ণজীবন খুব বলিয়ে কইয়ে মানুষ নয়। নিজের বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়ে কথা বলতে পারেই না।

হেমাঙ্গ বলল, কোথায় যেন গিয়েছিলেন আপনি?

আমস্টারডাম। বলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ কৃষ্ণজীবন বলল, ওরা আমাদের একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। একটা অয়েল ট্যাঙ্কার ক্যাপসাইজ করে অনেকটা এলাকা জুড়ে সমুদ্র বিষিয়ে গেছে। মাছ মরছে, পাখি মরছে। সেইসব দেখাল ঘুরিয়ে।

হ্যাঁ। আমরা টেলিভিশনেও দেখতে পাই।

কী অপচয় বলুন তো! অত তেল নষ্ট হল, সমুদ্রের কত প্রাণী মারা গেল।

তা তো ঠিকই।

আমার মনে হয় কি জানেন? আজকাল প্রায়ই অয়েল ট্যাঙ্কার লিক করে যে তেল পড়ে যাচ্ছে এর জন্য ওয়ার ফুটিংএ একটা ব্যবস্থা করা উচিত। এমন যন্ত্র তৈরি করা দরকার যা দিয়ে জল থেকে তেল ফের তুলে নেওয়া যাবে। কাজটা খুব শক্ত হওয়ার কথা নয়। কারণ, তেল জিনিসটা জলে ভাসে। এটা সম্ভব হলে তেলটাও বাঁচে, সমুদ্রটাও বাঁচে।

ঠিকই বলেছেন।

কিন্তু এইসব জরুরি যন্ত্র তৈরি হচ্ছে না। হচ্ছে অকাজের জিনিস। তাই না? ট্যাঙ্কারগুলোও যে কোন স্ট্যান্ডার্ডে তৈরি হয় কে জানে। আপনারা এটাকে বিজ্ঞানের যুগ বলে চিহ্নিত করেন, কিন্তু এসব দেখে মনে হয় মানুষ বিজ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করছে না।

হেমাঙ্গ এই তদগত লোকটার দিকে চেয়েছিল। বেশ আছে কৃষ্ণজীবন। বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্করহিত, ভাবনার ড়ুবজলে এর দিন কাটে। বেশ আছে কৃষ্ণজীবন। এর জীবনে একটা দুরন্ত ভালবাসা আছে। সে ভালবাসা পৃথিবীর প্রতি।

নিঃশব্দে কৃষ্ণজীবনের ডান পাশে এসে বসল অনু।

হেমাঙ্গর কেমন যেন মনে হল, আর বসে থাকার মানে হয় না। এদের দুজনকে আগেও দেখেছে হেমাঙ্গ। অসম বয়সী এই দুটি নারী ও পুরুষ—এদের একজনের চোখে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সম্মোহিত দৃষ্টি, অন্য জনের চোখে অনুকম্পা মেশানো প্রশ্রয়। এখানে হেমাঙ্গ বহিরাগত। মানুষে মানুষে সম্পর্কের যে কতরকম কম্বিনেশন হয়, কত জটিল, সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তার কোনও শেষ নেই।

এক নির্জন কোণে একা বসে ছিল চয়ন।

এই যে, কেমন আছেন?

চয়ন তটস্থ হয়ে বলে, ভাল।

বসতে পারি?

আরে কী যে বলেন। বসুন না।

হেমাঙ্গ বসল এবং হাসতে লাগল। বলল, আপনার কথা যতবার মনে হয় ততবার হাসি পায়।

চয়ন কাচুমাচু হয়ে রইল। প্রশ্ন করল না।

সেদিন এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময়ে আপনার কথাগুলো নিয়ে আমি আজও ভাবি আর আপনমনে হাসি।

চয়ন ক্ষীণ একটু স্মিতভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে বলে, আমি খুব গুছিয়ে কথা বলতে জানি না। আপনার কোনও অসম্মান করিনি তো!

আরে না মশাই, না। আপনি আমাকে নিজেকে বুঝতে সাহায্যই করেছেন। অনেক সময়ে নিজের আবেগগুলোকে ঠিক চেনা যায় না কিনা!

যে আজ্ঞে।

প্রেম-ট্রেম করেছেন কখনও?

চয়ন একটু সচকিত হয়ে বলে, আজ্ঞে না।

কখনও পড়েননি?

চয়ন মাথা নেড়ে বলে, না। আমার জীবন ঠিক আর পাঁচজনের মতো নয়।

আপনি গরিব আর এপিলেপটিক বলে?

চয়ন নিবে গিয়ে বলে, আমি ওসব ভাবতেই পারি না। সবসময়ে আমার অস্তিত্বের সংকট।

হেমাঙ্গ তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, আপনার কোনও সংকট নেই।

আজ্ঞে, আপনি আমার সব খবর তো জানেন না।

কিছুটা জানি। বাকিটা অনুমান করে নিতে পারি। আপনি একটা কমপ্লেক্সে ভুগছেন। নিজেকে নিয়েই আপনার বেশি ভাবনা। ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স নয় তো!

চয়ন মৃদু হাসে, যে ইনফিরিয়র সে নিজেকে ইনফিরিয়র ভাবলে তা আর কমপ্লেক্স থাকে না।

কথা তো বেশ জানেন দেখছি। আমি বলি কি, আপনি কয়েক দিনের জন্য আমার বাড়িতে চলে আসুন। স্পেয়ার রুম, একস্ট্রা বেড় সব আছে। কয়েক দিন আপনার সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যাক। আপনার প্রবলেমগুলো সলভ করা যায় কি না দেখব।

চয়ন করুণ হেসে বলে, যে আজ্ঞে।

বিশাল হলঘরের অন্য প্রান্তে মহিলামহল বসে গেছে। সেখান থেকে একবার হেমাঙ্গর উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল চারুশীলা। হেমাঙ্গও হাতটা তুলল।

হঠাৎ চয়ন বলল, আপনার জন্য আজ একটা নতুন রান্না হচ্ছে। হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলল, আমার জন্য?

যে আজ্ঞে।

কি রান্না হচ্ছে?

তা জানি না। শুনেছি আপনাকে সারপ্রাইজ দেওয়া হবে।

নাঃ, তা হলে তো সারপ্রাইজটা থাকল না।

তা হয়ত থাকল না। কিন্তু কে জানে?

তার মানেটা কী হল?

চয়ন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, না, মানে কিছু নেই। শুনলাম আপনার জন্য একটা স্পেশাল মেনু হচ্ছে।

হেমাঙ্গ একটু চুপ করে রইল। কিছু বলল না। বুঝলও না।

বুঝল আর ঘণ্টাখানেক বাদে। খাওয়ার সময়। সর্ষে শাক দিয়ে একটা দারুণ মুখরোচক তরকারি। এত সুন্দর জিনিস কখনও খায়নি হেমাঙ্গ।

কে রাঁধল রে?

তাকে লুকিয়ে রেখেছি।

তার মানে?

মুখ টিপে হেসে চারুশীলা বলল, এই, ডাক তো অঞ্জলিকে।

অঞ্জলি এসে খাওয়ার ঘরে দাঁড়াল। মুখে এক রাশ লজ্জা। ছিপছিপে, লম্বা, ফর্সা, চাবুকের মতো চেহারার এই তরুণীকে আগে কখনও দেখেনি হেমাঙ্গ। মুখখানাও ভারি সুন্দর।

হেমাঙ্গ চাপা গলায় বলে, কে রে?

এ পাড়ায় নতুন এসেছে। ওরা পাক্কা নিরামিষাশী। সেই জন্য আমাদের সঙ্গে খেতে বসেনি।

ওঃ।

দেখতে সুন্দর নয়?

হ্যাঁ। রাঁধেও ভাল।

অরিজিন্যালি গুজরাতি। তবে বাঙালি হয়ে গেছে। পছন্দ?

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়