চারুশীলার দীর্ঘকালের জন্য বিদেশ চলে যাওয়ার পর একটু ফাঁকা লাগছিল চয়নের। চারুশীলা তার প্রতি খুবই দয়ালু ছিল। যাওয়ার আগে তাকে হাজার দুই টাকা, একগাদা শার্টপ্যান্ট, কলম, ক্যালকুলেটর, সুগন্ধী স্প্ৰে দিয়ে গেছে। চয়ন এয়ারপোর্ট গিয়েছিল। চারুশীলা খুব কাদছিল। কান্নার প্রধান কারণ, তাকে বিদায় জানাতে হেমাঙ্গ আসেনি। যথাসময়ে খবর পেয়েও আসেনি বা কোনও খবরও দেয়নি। তবে,শিয়েছিল অনেকেই। ভিড়ে ভিড়াক্কার।

হেমাঙ্গ লোকটাকে চয়ন খানিকটা বোঝে, রোমান্টিক, একা, ঝঞাট-ঝামেলা পছন্দ করে না। তার জীবনে একটা স্থায়ী ঝঞ্ঝাট সৃষ্টি করতে চেয়েছিল চারুশীলা। ভাল ভেবেই করেছিল। কিন্তু সিদ্ধান্তটা ছিল ভুল। চয়নের বরাবর মনে হয়েছে, হেমাঙ্গর সঙ্গে রশ্মি ঠিক খাপ খাবে না।

এয়ারপোর্টে তাকে আলাদা ডেকে চারুশীলা ধরা গলায় বলল, শোনো চয়ন, হেমাঙ্গ আজ আমাকে সত্যিকারের দুঃখ দিয়েছে। ওকে আমি কতটা ভালবাসি তা হয়তো বোকাটা জানেও না। আমাকে সি-অফ করতে আসেনি। বোধ হয় রাগে। তুমি প্লিজ ওর সঙ্গে একটু কাল বা পরশু দেখা করতে পারবে?

পারবো না কেন?

ওর অফিসে আজ ফোন করেছিলাম। ওরা বলল হেমাঙ্গ আউট অফ স্টেশন। কোথায় গেছে বলতে পারল না। এরকম ভুঞ্জয়ার কথা নয়, আজ আমি চলে যাচ্ছি এটা ও ভালই জানে। তুমি গুর সঙ্গে দেখা করে বোলো, আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। ভীষণ।

বলব চারুদি, আপনি চিন্তা করবেন না।

আমি আরও ওর কোনও ব্যাপারে থাকতে চাই না। বিয়ে করুক বা না করুক, কখনও কিছু বলব না। তা বলে সম্পর্ক কেন তুলে দেবে বলো তো! আমরা পিঠোপিঠি ভাইবোনের মতো মানুষ হয়েছি, আমাকে ভীষণ ভালবাসত ও। কেন যে এরকম হয়ে গেল!

আপনাকে এখনও উনি ভালবাসেন।

চারু মাথা নেড়ে বলে, আর বাসে না, এখন ও অন্যরকম হয়ে গেছে, একেবারে বাউণ্ডুলে। হয়তো সন্ন্যাসী হওয়াই ওর কপালে আছে। সেই জঙ্গলের বাড়িটাতে গিয়ে পড়ে থাকে। শোনো, দরকার হলে তুমি সেখানেও যেও।

যাবো।

ওকে একটু দেখো।

চারুশীলার যে কী গভীর মায়া হেমাঙ্গর প্রতি সেটা বুঝতে পেরে একটু ঠাণ্ডা হল চয়ন। এই ভালবাসাটা তার আর অয়নের মধ্যে নেই। খুব কম পরিবারেই ভাইবোনে এরকম ভালবাসা আছে। তাও চয়ন শুনেছে, হেমাঙ্গ আর চারুশীলা আপন ভাইবোন নয়, পিসতুতো মামাতো। একসঙ্গে বড় হয়েছে মাত্র।

কথা রেখেছিল চয়ন। দুদিন পর অফিসে ফোন করে জানল, হেমাঙ্গ ফিরেছে, তবে ফের বাইরে গেছে।

আরও দুদিন অপেক্ষা করল চয়ন। তারপর এক সোমবার হেমাঙ্গকে ধরল অফিসে, টেলিফোনে।

হেমাঙ্গ খুব খুশির গলায় বলল, আরে গ্রেট চয়ন! কী খবর?

আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।

চলে আসুন আজ বিকেলে আমার বাড়িতে। ধরুন সাতটা?

যাবো।

রাতের খাবারটা একসঙ্গেই খাবো দুজনে, কেমন?

না না, তার দরকার নেই।

অত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? আমি আজকাল খুব সিম্পিল খাই। স্পার্টন লাইফ স্টাইল, ফ্রগাল মিল, আমার পরিবর্তনটা লক্ষ করে অবাক হবেন। চলে আসুন। আড্ডা মারা যাবে।

সাতটার পনেরো মিনিট আগেই পৌঁছে গেল চয়ন। হেমাঙ্গ তখন নিজের হাতে কী একটা রান্না করছিল মাইক্রোওয়েভে, পাশে তার চাকরীটিও বেশ ব্যস্ত।

তাকে দেখে সত্যিকারের খুশি হল হেমাঙ্গ। তাকে দেখে খুশি হয় এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। হেমাঙ্গ তাদের মধ্যে একজন। সে বলল, আরো বাঃ, আপনার চেহারার তো বেশ উন্নতি হয়েছে দেখছি।

চয়ন লাজুক হাসল, কথাটা মিথ্যে নয়। তার চেহারার সম্প্রতি কিছু উন্নতি ঘটেছে।

বসুন বসুন, আগে কি একটু চা বা কফি খেয়ে নেবেন?

না, আমার নেশা নেই।

হালকা কিছু খাবার খাবেন? ইফ ইউ আর হাংরি?

না; চারুদি আমাকে যাওয়ার আগে একটা মেসেজ দিয়ে গেছে।

তাই নাকি? কিরকম মেসেজ?

আপনি সি-অফ করতে যাননি বলে উনি খুব দুঃখ পেয়েছেন, ভীষণ। খুব কান্নাকাটিও করছিলেন।

হেমাঙ্গর মুখ থেকে হাসিটা ধীরে ধীরে মুছে গেল। সে একটু মাথা নেড়ে বলল, চলুন বসি।

সোফা-সেটে সাজানো ড্রয়িং রুম মুখোমুখি বসে হেমাঙ্গ ধীর গম্ভীর গলায় বলল, খুব কাদছিল?

খুব, উনি আপনাকে বড্ড ভালবাসেন।

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলে, জানি। খুব ছেলেবেলা থেকেই চারুদি আমাকে সারা দিন কোলেপিঠে করে রাখত। আমি ওর খুব ন্যাওটা ছিলাম। আমাদের বাড়িতে কড়া শাসন আর ডিসিপ্লিনের মধ্যে ওই চারুদিই। আমাকে আড়াল করে রাখত। আমি দুষ্টুমি করলে বা অন্যায় কিছু করলে আমার হয়ে নির্বিকারভাবে মিথ্যে কথা বলত। ওর নিজের ভাইবোন বলতে কেউ ছিল না। মা-হারা মেয়েকে ওর বাবা বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়িতে রেখে দেয়। সেই থেকে ও আমার নিজের দিদির মতোই। তা ছাড়া ও আমার খুব বন্ধুও। একটু ডমিনেটিং, কিন্তু চারুদি অত্যন্ত অফ-বিট মেয়ে। লোভ নেই, সঞ্চয় করতে জানে না, টাকা ওড়াতে ভালবাসে, লোকের জন্য করেও অনেক। সবগুলো হয়তো প্রাস কোয়ালিটি নয়, কিন্তু তাতেই ও অফ-বিট। তাই না?

হ্যাঁ। ওঁকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি।

হেমাঙ্গ হেসে ফেলে, শ্রদ্ধা-ফ্রদ্ধা আপনার একটা রোগ। চারুদিকে শ্রদ্ধা করার কি আছে? সি ইজ এ ভেরি গুড ফ্রেন্ড। এরপর হয়তো বলবেন আপনি আমাকেও শ্রদ্ধা করেন। শ্রদ্ধা রোগটা আপনার সারানো দরকার।

চয়ন ফের লাজুক হাসল। বলল, উনি বলে গেছেন, আপনাকে আর ডিস্টার্ব করবেন না।

হেমাঙ্গ একটু হেসে বলল, আপনাকে আর কষ্ট করে মেসেজ দিতে হবে না। বোম্বাইয়ের শাহর এয়ারপোটে প্রায় সারা রাত আমি চারুন্দির অনেক করুণ বিলাপ শুনেই এসেছি।

অবাক হয়ে চয়ন বলে, তার মানে?

চারুদি রওনা হওয়ার আগের দিন আমি বোম্বাই যাই।

ওঃ।

চারুদিকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই খবরটা আগে দিইনি। বোম্বাইতে আমার ইনফ্লয়েনশিয়াল ক্লায়েন্ট আছে। তাদের একজনই আমাকে ট্রানজিট লাউঞ্জে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেয়। চারুদি আর সুব্রতদা তো ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠেছিল। আর ছেলেমেয়ে দুটো যা খুশি হয়েছিল তা বলার নয়। ভোরে প্লেনে ওঠার আগে অবধি জোর আড্ডা হয়েছিল।

চয়ন একটা শ্বাস ফেলে বলল, যাক, আপনি একটা খুব ভাল কাজ করেছেন। চারুদি এত আপসেট ছিলেন। তা ছাড়া অনেক দিনের জন্য চলে গেলেন তো!

হেমাঙ্গ ভ্রূ কুঁচকে একটু ভেবে বলল, চারুদিকে যতদূর চিনি, ও বেশি দিন বিদেশে থাকতে পারবে না। ছেলেমেয়েকে ছেড়েও থাকা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আমার মনে হয় ওর গোটা প্ল্যানটাই ভেস্তে যেতে পারে। ডেভেলপাড় দেশগুলোর অবস্থা আমার ভাল বলে মনে হয় না। বড্ড পারমিসিভ। বড্ড বেশি ব্যক্তিস্বাধীনতা, বড্ড বেশি সেক্স অ্যান্ড অবসেশনস। সবচেয়ে বেশি লোনলিনেস। কিছুদিনের মধ্যেই দেখবেন ওসব দেশে সাজঘাতিক মানসিক সংকট দেখা দেবে। অ্যাফলুয়েনস যে শেষ কথা নয় সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগবে না।

চয়ন বিদেশ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। সে চুপ করে রইল।

হেমাঙ্গ বলল, চারুদি হয়তো ফিরে আসবে। আগেও একবার চেষ্টা করেছিল সুব্রতদার সঙ্গে বিদেশে সেটল করার।

মন খাবে বলে বেশ ভাল আয়োজন করেছিল হেমাঙ্গ। তবে আমিষ ছিল না। হেমাঙ্গ বলল, আজকাল আমি নিরামিষ

কেন?

এমনি, আমার মনে হচ্ছে, পশুপাখিদের ধরে ধরে খাওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই।

তাই বা কেন? লোকে তো খায়।

লোকে কত কিছু করে। সব কিছুর মানে হয় না। আপনার কি নিরামিষ খেতে অসুবিধে হচ্ছে?

চয়ন মৃদু হেসে বলল, না তো! আমি তো নিরামিষই খাই। মাছ কেনার ক্ষমতা নেই, রাধেই বা কে? তবে প্রেজুডিস নেই। আচ্ছা, আপনার চারটে মিক্সি কেন লাগে?

হেমাঙ্গ হেসে ফেলল, আগে নতুন নতুন জিনিস কেনার খুব ঝোঁক ছিল। বাজারে একটা নতুন প্রোডাক্ট এলেই কিনে ঘোড়াম। এসব তখনকার ব্যাপার। রয়ে গেছে। এখন একটাও কাজে লাগে না। আপনাকে একটা প্রেজেন্ট করে দিচ্ছি।

আমি! আমি নিয়ে কি করব?

প্রোডাক্টটা হাতে এলে কাজে লাগানোর কথা মনে হবে।

না, দরকার নেই। আমার ঘরে জায়গাও নেই। চারুদি কত কী দেন, আমার সবই পড়ে আছে। কাজে লাগে না।

আপনিও একটু অফ-বিট, তাই না?

না, অফ-বিট নই। আমি যা হয়েছি তা অবস্থার চাপে!

ভিকটিম অফ সারকামন্ট্যান্সেস? আমরা সবাই তো তাই। আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলবেন? আপনার টিউশনি করে মাসে কত ইনকাম হয়?

চয়ন একটু হিসেব করে বলল, বোধ হয় হাজার দুই।

কত খরচ করেন?

হিসেব করিনি। তবে হাজার খানেক তো বটে।

বছরে তাহলে আপনার বারো হাজার টাকা সেভিংস হওয়ার কথা। হয় কি?

চয়ন একটু অস্বস্তি বোধ করে বলল, তা তো জানি না।

আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই?

আছে একটা।

তাতে কিছু রাখেন না?

হ্যাঁ, মাঝে মাঝে টাকা রাখি। কারণ ঘরে রাখলে চুরি যেতে পারে।

ব্যাঙ্কে কত জমা হয়েছে জানেন না?

পাস বই অনেকদিন এন্ট্রি করানো হয়নি।

আপনি কি মানি-কনশাস। নন?

চয়ন লজ্জা পেয়ে বলে, ঠিক তা নয়। তবে মনে হয় ব্যাংকে আমার খুব বেশি থাকে না।

আমি অ্যাকাউন্ট্যান্ট। টাকা পয়সার ব্যাপারে মনো-হওয়াকে গুরুত্ব দিই না। কালকেই ব্যাঙ্কে গিয়ে জেনে নেবেন আপনার ঠিক কত টাকা আছে। আর পাস বইটা আপ-টু-ডেট করে নেবেন।

কেন বলুন তো?

টাকা পয়সার ব্যাপারে ইনফমর্ড থাকা ভাল। আপনি কি এখনও চাকরি খুঁজছেন?

চয়ন একটু স্তিমিত গলায় বলল, না, আর খুঁজছি না। ওটা আমার হবে না।

দেশে তত চাকরিও নেই। যদি চাকরি একটা কষ্ট করে পেয়েও যান মাইনে পাবেন অত্যন্ত কম। খাটাবে বেশি। এমপ্লয়ারদেরই এখন যুগ।

তাই দেখছি।

যদি কিছু টাকা জমাতে পেরে থাকেন ড়ু সামথিং অন ইওর ওন।

কি করব? ব্যবসা?

আপনি তো পড়াতে পারেন। বরং একটা টিউটোরিয়াল খুলুন।

টিউটোরিয়াল অনেক আছে। আমারটা চলবে না।

নেগেভিটি আইডিয়া নিয়ে শুরু করলে হবে না। আন্দা-জল খেয়ে লাগুন না! কাজটা করতে শুরু করলেই দেখবেন, কিছু একটা হতে শুরু করেছে। স্টার্ট ইট রোলিং।

চয়ন একটু হাসল।

হেমাঙ্গ বলল, এদেশে দেখবেন কেউ কোনও ভেনচার করতে চায় না। একটা কাপড়ের দোকান কেউ করল, দেখাদেখি আর একজনও কাপড়ের দোকানই করল তার পাশে। ফের আর একজনও তাই করল। ফলে বিজনেসটা ভাগ হয়ে গেল। কারোই তেমন লাভ হয় না। কিন্তু মাথা খাটালে দেখতে পেত। সেখানে হয়তো সেলুন খুললে বা স্টিম লন্দ্রি করলে বা ওরকম কিছু করলে কম্পিটিশন কম হত। এই মাথা খাটানোটুকুও নেই। আর একটা কথা কি জানেন? এদেশের ব্যবসাদার বা দোকানদাররা সেবাবুদ্ধি কাকে বলে জানে না। মানুষকে সেবা দেওয়ার মনোভাব থাকলে ব্যবসার ভোল পাল্টে যেত। প্ৰত্যেকটা ব্যবসাই হওয়া উচিত ওয়েলফেয়ার বিজনেস। দিনরাত অসৎ লোকদের ট্যাক্স ফাকিতে সাহায্য করতে করতে আমি টায়ার্ড।

টিউশনি করতেও আমার তেমন ভাল লাগে না।

টিউটোরিয়াল হয়তো ভাল লাগবে। না হলে আমার সঙ্গে গ্রামে চলুন। চাষবাস করবেন। পারবেন না?

চয়ন এবার হাসল না। একটু ভাবলা। তারপর বলল, আমার দ্বারা বোধ হয় কিছু হবে না।

ভাবুন। ভাল করে ভাবুন। মাথা থেকে কিছু একটা বেরোবেই। তারপর হার্ড ওয়ার্ক অ্যান্ড অনেস্টি অ্যান্ড সার্ভিস।

চয়ন মৃদু হেসে বলল, আপনি খুব প্র্যাকটিক্যাল। আমি তা নাই। অথচ চারুদি আমাকে কী বলে গেছেন জানেন? বলে গেছেন যেন আপনাকে আমি চোখে চোখে রাখি।, s

হেমাঙ্গ হাঃ হাঃ করে হাসল। বলল, ও আমাকে এখনও নাবালক বলে মনে করে।

ওঁর ভয় আপনি সন্ন্যাসী হয়ে যাবেন।

হেমাঙ্গ গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলে, না, সন্ন্যাসী হওয়ার কোনও চান্স নেই।

চয়নের ভিতরে মন্দু একটা বেল বেজে উঠল। সে জানে। সে টের পায়। কি করে পায়? হয়তো রোগে ভুগে তার স্নায়ুতে এমন কিছু রতার সঞ্চার হয়েছে যাতে সে অনেক সূক্ষ্ম জিনিস আবছা বুঝতে পারে।

মৃদু হেসে চয়ন বলল, সেটা আমি জানি।

অবাক হয়ে হেমাঙ্গ বলে, কি জানেন?

আপনি হয়তো শিগগিরই ঘর-সংসার করবেন।

সে কী? আমি তো সে কথা বলিনি!

না, আপনি বলেননি।

তাহলে?

এমনি মনে হল।

এমনি মনে হল? না মশাই, ওটা কথা নয়। ঝেড়ে কাশুন।

চয়ন মৃদু হাসল শুধু।

আমি বলতে চেয়েছিলাম সন্ন্যাসী হওয়ার হ্যাজার্ডস আমার পোষাবে না। তা ছাড়া আমি তো ধর্ম করি না। সংসারী হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।

চয়ন মৃদুস্বরে বলে, হয়তো তার আছে।

কারি?

যাকে আপনি বিয়ে করবেন!

অবাক হেমাঙ্গ বলে, কাকে?

ভেতরটা বলি বলি করে ওঠে চয়নের। সে বলে না। মৃদু হাসে শুধু।

আপনি তো সাজাতিক লোক মশাই। জ্যোতিষী করেন নাকি?

না।

তাহলে?

মনে হয়।

কী মনে হয়?

মনে হয় আপনি কাউকে ভালবাসেন। সত্যিকারের ভালবাসেন। কিন্তু টের পান না।

আমিই যদি টের না পাই তাহলে সেটা আপনি টের পান কেমন করে?

আমিও পাই না।

তবে বলছেন যে!

আমার মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু একটা মনে হয়।

সেই অদ্ভুতটা কি?

ওই তো বললাম, আপনি না জেনেই কাউকে ভালবাসেন। সেটা এত ভিতরের ব্যাপার যে টের পান না।

তাই কি হয়? ভালবাসা টের না পেয়ে উপায় নেই।

হয়তো সেটাকে ভালবাসা বলে চিনতে পারেন না।

এসব হেঁয়ালিতে আমি বিশ্বাস করি না। তবে আমি একজনকে খানিকটা ভালবাসার চেষ্টা করেছিলাম ঠিক কথা। সে

চয়ন চুপ করে রইল।

হেমাঙ্গ বলল, ভালবাসাটা ছিল বন্ধুর মতো। কিন্তু চারুদি সব গোলমাল করে দিল।

উনি ভুল করেননি। বিয়ের চেষ্টা করে উনি আপনার উপকারই করেছেন। তাতে আপনি বুঝতে পারলেন যে রশ্মিকে আপনি সেরকম ভালবাসেন না।

এরকম একটা কথা। আপনি আগেও বলেছিলেন। আপনি কিন্তু একটু বিচ্ছু টাইপের আছেন। এবার বলুন তো, আজ যা বললেন তার সোর্সটা কি?

আমি সত্যিই জানি না।

না জেনেই বলছেন?

মনে হয়, ব্যাপারটা এতই গভীর এবং গোপন যে, আপনি সেটা কনশাসলি স্বীকার করতে চান না। তাই ব্যাপারটা আপনার কাছে ধরা দেয় না।

এটা কি ফ্রয়েভীর ব্যাপার নাকি মশাই?

ফ্ৰয়েড আমি পড়িইনি।

কিন্তু ভালবাসার জন্য তো একটা মেয়ে অন্তত চাই। সেটা কে?

আছে হয়তো!

কে হতে পারে?

চয়ন মুচকি একটু হেসে চুপ করে থাকে।

হেমাঙ্গ তার চোখের দিকে চেয়ে বলে, আপনি কি তাকে চেনেন?

হয়তো চিনি।

আপনাকে আজ হয়তোতে পেয়েছে কেন?

আমার অনুমানটাও এত পাতলা যে বলার মতো নয়।

আমার পরিচিত মেয়ের সংখ্যা এতই কম যে অনুমানটা খুব ডিফিকাল্ট নয়।

দুজনে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর হেমাঙ্গ বলল, চলুন আপনাকে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। থাক। আমি চলে যেতে পারব।

সেটা জানি। তবু আপনার কম্পানি আমার কিছুক্ষণ আরও দরকার।

তাহলে চলুন।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়