৭। পারিজাত

সংকীর্ণ পার্বত্যপথে দুদিক থেকে দুজন সশস্ত্র অশ্বারোহী ছুটে আসছে। সামনেই এক উপত্যকা। সেইখানে দুজনের দেখা হবে। শুরু হবে দ্বৈরথ। দুজনের মধ্যে যতক্ষণ না একজনের মৃত্যু হয় ততক্ষণ চলবে মরণপণ লড়াই। অস্ত্রে অস্ত্রে ধুন্ধুমার শব্দ উঠবে। অশ্বক্ষুরের ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে চারদিক। ঝরে পড়বে রক্ত ও স্বেদ। না, লড়াই এখনও শুরু হয়নি। তবে অমোঘ লক্ষ্যে এখন ছুটে যাচ্ছে নিয়তিনির্দিষ্ট দুই প্রতিদ্বন্দ্বী।

বলাই বাহুল্য এই দুই অশ্বারোহীর একজন আমি, অন্যজন অধর। আমাদের দুজনের কারওরই ঘোড়া নেই, তবে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। তরোয়াল নেই, টাকা আছে। দ্বৈরথ ঘটবার সম্ভাবনা নেই। আজকাল লড়াই হয় কূটনৈতিক চালে। কিন্তু লড়াই আসন্ন।

চাংড়াপোঁতার বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কলকাতার কাগজে ছোট করে বেরিয়েছে সংবাদ। কিন্তু সেটা কোনও কথা নয়। বর্ষাকালে ফি বছরই এই রাজ্যের কয়েকটা জেলা ও অঞ্চল ভাসে। কথা হল, চাংড়াপোঁতার দিককার বাঁধ মেরামতির ঠিকা গতবছর অধরকেই দেওয়া হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব হয়তো পুরনো রেকর্ড ঘাঁটতে চাইবেন না, তাই আমি তথ্যটি যথাযোগ্য প্রমাণ সহকারে তার গোচরে এনেছি। যদি অ্যাকশন না নেওয়া হয় তাহলে ঘটনাটিকে সাধারণ্যে রটনার একটি প্রচ্ছন্ন হুমকিও তাকে আমি যথাযথ বিনয় সহকারে দিয়ে দিতে ভুলিনি। বাঁধ মেরামতি বাবদ খরচ হয়েছিল আট লক্ষ টাকার কাছাকাছি। খুব কম নয়। জনসাধারণের টাকা। কিন্তু জনসাধারণ তাদের টাকা কোথায় কীভাবে নয়ছয় হচ্ছে সে বিষয়ে খুবই নির্বিকার। সুতরাং আমাকেই তাদের প্রতিনিধি হয়ে কাজটা করতে হচ্ছে।

জাতসাপটা পছন্দ করছে না, তবু আমি বারবারই তার লেজ দিয়ে কান চুলকোচ্ছি! সাপটা রাগছে, ফুঁসছে। এবার ছোবল তুলবে। অধর।

একটা রিকশা এসে থামল আমার গাড়িবারান্দার তলায়। কমলা সেন নামলেন। ভোরের কোমল আলোয় তাকে নম্র দেখাচ্ছিল। যৌবনে শ্রীময়ী ছিলেন, সন্দেহ নেই। এখন কিছু মেদ ও মেচেতার সঞ্চারে চটকটা ঢাকা পড়েছে। তার মুখে একটা আভিজাত্যের ছাপ বরাবর ছিল। এখনও আছে। স্বভাবে গম্ভীর ও ব্যক্তিত্বময়ী এই মহিলাকে আজ কিছু শ্রান্ত ও ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। পরনে কমলা রঙের একখানা শাড়ি, চওড়া বাসন্তী রঙের পাড়। ওই রঙেরই মানানসই ব্লাউজ। চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা। এখনও অগাধ ও গভীর, বন্যার মতো এক ঢল চুল তার মাথায়। এলোখোঁপায় বাঁধা। হাতে একটা বড়সড় ফোলিও ব্যাগ।

পর্দা সরিয়ে চৌকাঠে তিনি দেখা দিতেই উঠে দাঁড়িয়ে সসম্ভ্রমে বললাম, আসুন, আসুন।

এই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্যে কোনও অবিনয় বা কৃত্রিমতা নেই। খাঁটি লোকদের আমি বরাবরই শ্রদ্ধা করি। দেশে এরকম লোকের সংখ্যা বড়ই কম। কমলা সেন শিবপ্রসাদ হাইস্কুলের জন্য যা করেছেন তা এখন প্রায় কিংবদন্তী।

দরজা থেকে টেবিল পর্যন্ত এগিয়ে আসতে কমলার অনেকটা সময় লাগল। পদক্ষেপ ধীর, অবিন্যস্ত, কুণ্ঠিত। যেন বা তিনি নিজেই বুঝতে পারছেন না। কেন এখানে এসেছেন। ওঁর চোখের দৃষ্টিতেও সেরকম একটা অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল, যা ওঁর স্বভাবসিদ্ধ নয়।

উনি যতক্ষণ কাছে এসে না বসলেন ততক্ষণ আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম।

দুজনেই বসলাম মুখোমুখি। কিন্তু কেউ কারওদিকে সহজভাবে তাকাতে পারছিলাম না। কমলা সেন নীরবে তার কোলের ওপর রাখা ফোলিও ব্যাগ এবং তার ওপর রাখা তার হাত দুখানি কিংবা মণিবন্ধের ঘড়ির দিকে চেয়ে রইলেন। আমি ওঁর সিথির ওপর দিয়ে, খোঁপার কিনারা ছুঁয়ে দৃষ্টিটাকে মোটামুটি স্থির রাখলাম দরজার দিকে।

ঘর ফাঁকা। শব্দ নেই। বাইরে শুধু পাখির ডাক।

আমরা দুজন অনেকদিন একসঙ্গে কাজ করছি। আমাদের আন্ডারস্ট্যানডিং খুবই ভাল। যতদূর জানি আমাকে উনি সেক্রেটারি হিসেবে পছন্দই করতেন, যেমন আমি করতাম ওঁকে হেডমিসট্রেস হিসেবে। কিন্তু কোনও প্রতিষ্ঠানই চিরকাল একভাবে চলে না। চলতে নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কেরও বিবর্তন ঘটে। ঘটা দরকারও। পরিবর্তন যদি না ঘটত তা হলে আমি দারিদ্র্যসীমার ওপাশ থেকে চিরকাল এপাশে আসার স্বপ্নই দেখতাম। সত্যিকারের আসা হত না কখনও।

মৃদুস্বরে বললাম, ভাল তো?

 চশমার কাঁচ ও ফ্রেমে একটু আলো ঝিকিয়ে উঠল, হ্যাঁ। আপনি?

 চলে যাচ্ছে।

আবার নিস্তব্ধতা। শুধু অজস্র পাখির ডাকে ভরে উঠল ঘর। সকালের কোমল আলোর এক মায়া ঘরের মধ্যে সম্মোহন বিস্তার করে দিচ্ছে। আমরা কেউ কখনও কাউকে তেমন অপছন্দ করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ছিল না। শত্রুতা নয়। আজও কি অপছন্দ হবে না পরস্পরকে?

কমলা সেন মণিবন্ধের ঘড়ির দিকে চেয়ে রইলেন। মুখ তুললেন না। শুধু মৃদুস্বরে বললেন, খুব খাটুনি যাচ্ছে তো, আগেকার মতো?

খাটতে তো হয়ই। আপনিও তো বিশ্রাম নেন না।

আমার তো ছোট্ট জায়গা নিয়ে কাজ। আপনার তো তা নয়। টেনশন হয় না?

 হয়।

বলে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। কমলা আমাকে ঘৃণা করতে পারছেন না। সেটা ঘটে ওঠা সম্ভব বলে আমারও মনে হয়নি কখনও। তবু আশা করেছিলাম, শেষ অবধি আমাকে উনি ঘৃণা করতে পারবেন। পারেননি। মৃদুস্বরে বললাম, ডানহাতে একটা সোনার বালা ছিল বরাবর। আজ দেখছি না।

কমলা চকিতে একবার তাকালেন। চোখ নামিয়ে নিজের শূন্য ডান হাতখানি ঘুরিয়ে দেখলেন একটু। বললেন, পুরনো হয়ে গিয়েছিল।

ভেঙে গড়তে দিয়েছেন?

উনি মাথা নাড়লেন, না। রেখে দিয়েছি।

একটু হাসলাম। ডান হাতখানা বড় শূন্য দেখাচ্ছে। বৈধব্য যেমন দীর্ঘ ও সাদা।

 চা?

চশমার কাঁচ ও ফ্রেমে আবার একটু ঝিলিক, হু।

ভারী কৃতজ্ঞ বোধ করলাম ওঁর কাছে। ওই হু-টুকুর বড় প্রয়োজন ছিল আজ। টেবিলের গায়ে লাগানো কলিং বেল-এ ওপরের রান্নাঘরে চায়ের সংকেত পাঠিয়ে দিই। ওরাই দেখে যাবে কজন এবং ক কাপ। আমি মুখে উদাস ভাব মেখে বসে থাকি। একটু পিছনে হেলে, গা ছেড়ে।

নীরবতা। পাখির ডাক। কোমল আলো।

চা আসে। দুজনেই মৃদু চুমুক দিই। কমলা একটু এদিকে তাকান, একটু ওদিকে। কিছু দেখছেন না, জানি। নিজেকে স্থির করছে। আমাকে ঘৃণা করতে পারলে ওঁর পক্ষে কাজটা সহজ হয়ে যেত। সোজা তাকাতে পারতেন আমার চোখের দিকে। সহজে বলতে পারতেন কিছু কঠিন কথা। পারছেন না।

ঠিক কথা, স্কুলটার জন্য আমার বিশেষ কোনও দরদ নেই। আমার ভাবপ্রবণতা কম। একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিছুতেই আমার কাছে জিয়ন্ত ও শরীরী কোনও সত্তা হয়ে ওঠে না। স্কুলের প্রতিটি ইটের প্রতি ওঁর যেরকম ভালবাসা আমার তা কোটি বছরেও হওয়ার নয়। তবু আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেটেছি, যখন যেমন দরকার। এও ঠিক আমার আরও পাঁচ রকমের কারবার আছে। স্কুলের পিছনে আমি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় দিইনি। কিন্তু কমলা সেন তার অবকাশটিও স্কুলের গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলেছিলেন। এই স্কুলের জন্য আমার ব্যক্তিগত ত্যাগ বিশেষ কিছু নেই, কিন্তু ওঁর অনেক আছে। বিদ্যায়তনে নাচগানের ক্লাস বসানোতে ঘোর আপত্তি তুলেছিলেন তিনি, আমি সেই সেন্টিমেন্টকে প্রশ্রয় দিইনি। এই নিয়ে খটাখটিও হয়েছে। শেষ অবধি আমার বাস্তববুদ্ধিকে তিনি গ্রহণ করেছেন অনেক ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রে করেননি। লেখাপড়া জিনিসটার প্রতি তামার বিরাগ চিরকালের। স্কুল-কলেজের নামে আমার এলার্জি হয়। অভিজ্ঞতাবলে আমি জানি কিছুটা লেখাপড়া ভাল, কিন্তু তার সঙ্গে পেটভাতের জোগাড় করার মতো যোগ্যতা অর্জন আরও ঢের ভাল। তাই আমি স্কুলের নিচু ক্লাস থেকেই চাষবাস, গোপালন, ইলেকট্রিক, বা ছুতোর মিস্ত্রির কাজ, ট্যানারি, মৌমাছির চাষ, হ্যান্ডমেড পেপার তৈরি, বাঁশ বা অন্যান্য উপকরণ দিয়ে ঘর গেরস্থালির জিনিস বানানো ইত্যাদি শেখার ব্যবস্থা করার পক্ষপাতি ছিলাম। সবচেয়ে জোরালো বাধা দিয়েছেন উনি। তাতে নাকি ছেলেমেয়েরা বইয়ের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়বে। তাছাড়া ওসব তো কোর্সেও নেই। বহুবার বহু ব্যাপার নিয়ে ওঁর সঙ্গে আমার মতান্তর হয়েছে, বিতর্ক ঘটেছে। তবু কীভাবে যেন একটা গভীর আস্থাবোধও জন্ম নিয়েছিল।

কমলা সেন আমার কাছে হেরে গেছেন বা আমি জয়ী হয়েছি এমন কিছু আমার মনে হয় না। আমি জয়ী হলেও সেই জয়ের স্বাদ আমি উপভোগ করছি না। আমি ওঁরই জয় চেয়েছিলাম। উনি পারলেন না। সেটা হয়তো আমার পরাজয়ও।

চা শেষ হল। দুটি শূন্য পাত্র ও আমরা দুজন মুখোমুখি বসে রইলাম। শব্দ নেই। শুধু পাখি ডাকছে। আজ যে কোথা থেকে এত পাখি এল! না কি রোজই আসে, আমি হয়তো রোজ তাদের ডাক শুনতে পাই না। আজ পাচ্ছি।

কমলা সেন নতমুখে খুব ধীরে ধীরে, শব্দ না করে তার ফোলিও ব্যাগের চেন খুলছিলেন। কেন তা আমি জানি। ব্যাগের মধ্যে একটি চিঠি আছে। টাইপ করা এবং বেশি বড় নয়। ওঁর পদত্যাগপত্র।

আমি ঘরের ছাদের দিকে চেয়ে আলোর কিছু প্রতিফলন লক্ষ করছিলাম। গত দুদিন বৃষ্টি নেই। চনমনে রোদ উঠেছে। চাংড়াপোতার বাঁধ ভাঙা ছাড়া কি এবারের বর্ষা আর কোনও দুর্দৈবের সৃষ্টি করতে পারল না? বন্যা হবে না তা হলে?

আমি ওপরের দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করি, কোথাও যাচ্ছেন নাকি বাইরে?

উনি চেনটা আধখোলা রেখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, যাচ্ছি। প্রথমে কলকাতায়। তারপর কাছেপিঠে কোথাও।

আমি মাথা নাড়লাম, অনেকদিন কোথাও যাননি। এবার একটু ঘুরে আসুন।

কথাটার মধ্যে কোনও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত নেই। সমবেদনা আছে। কমলা চুপ করে আমার টেবিলের সবুজ কাঁচে একটা নকশাদার পেপারওয়েটের প্রতিবিম্ব দেখলেন। তারপর বললেন, বেড়াতে আমার ভাল লাগে না।

আমি হাসলাম। বললাম, কাজ ছাড়া আপনার আর কবে কীই বা ভাল লাগল!

উনি সলজ্জ, হেসে খুব মৃদু স্বরে, প্রায় স্বাসবায়ুর শব্দে বললেন, এবার ছুটি।

আমি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ওঁর খোঁপার সীমানা ছুঁয়ে দরজা দেখতে দেখতে বললাম, আমি শুনেছি, অনেকগুলো স্কুল থেকে অফার এসেছে আপনার কাছে।

উনি মাথা নাড়লেন, মুখে দুষ্টুমির ক্ষীণ একটু হাসি ফুটে উঠল। বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু করব না।

 কেন করবেন না?

করা উচিত নয় বলে। হাসিমুখেই বললেন কমলা, কেন তা তো আপনি জানেন।

 জানি। সবই জানি। আমি কমলার চরিত্র বিষয়ে যে প্রশ্ন তুলেছি তা তো থেকেই যাচ্ছে। এই সুদক্ষ প্রশাসক ও মহান শিক্ষিকার চাকরির কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু এই অসাধারণ মহিলার সমস্যা তিনি নিজেই। নৈতিক অধঃপতনের জন্যই যদি তার একটা চাকরি যায় তবে অধঃপতি তিনি আবার অন্য চাকরিতে যাবেন কেন? কমলা সেনের জীবনদর্শন, যা-ই হোক তা বেশ কঠোর। অধরের সঙ্গে তার সম্পর্ক যেমনই হোক, আমাদের শ্রদ্ধা তিনি অকারণে পাননি।

আজ বড় কোমল আলোর দিন। তারের বাজনার মতো বেজে চলেছে পাখিদের আবহসংগীত। দিনটা বড় লাবণ্যময়, বড় গভীর। পৃথিবীর পাত্রটি বুঝি উপচে পড়ছে অধরা মাধুরীতে আজ। এটা কাজের দিন নয়। এইসব দিন আসে মানুষকে খেয়ালখুশিতে পাগল করতে মাঝে মাঝে।

আমি খুব সন্তর্পণে কমলার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আজ আমাকে কিছু বলুন। শুতে ইচ্ছে করছে।

কমলা হাসলেন। মাস্টারির নির্মোক খসে যাওয়ায় ভিতরকার লাজুক ও অপ্রতিভ এক কমলা সেন আজ জাদুবলে বেরিয়ে এসেছেন। মৃদুকণ্ঠে বললেন, বলতেই আসা।

বেলা বাড়ছে। কাজের লোকেরা ভিড় করে আসবে। ঘরটা হয়ে যাবে হট্টমালার দেশ। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তা হলে বাগানে যাই।

কমলা চোখ না তুলে মাথা নাড়লেন, চলুন।

বাগানের সবচেয়ে দূরবর্তী কোণে অবস্থিত কুঞ্জবনটি এই বর্ষার জলে, আরও ঘন হয়েছে। লতানে গাছ কেঁপে উঠেছে চারদিকে। ভিতরে নিবিড় ছায়া। আমরা দুজন বসি, মাঝখানে অনেকখানি ফাঁক রেখে। মৌমাছির গুনগুন আনাগোনা চারদিকে। দোলনচাঁপার গন্ধে বাতাস ভারী।

কমলা একটু সময় নিলেন। আমি অপেক্ষা করলাম।

উনি মৃদুস্বরে বললেন, আপনাকেই বলা যায়। বলব?

অপেক্ষা করছি।

আমি বহুদিন আগে মরে গেছি। সেই কিশোরীবেলায়। আজকের ঘটনা তো নয়। তখন দুই বেণী বেঁধে স্কুলে যাই, ফ্রক পরি। অধর কী সুন্দর সাইকেল চালাত আপনি জানেন না। এ উইজার্ড অন এ সাইকেল। তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে যেতে পারত। সাইকেলে চেপে সেটাকে স্থির দাঁড় করিয়ে রাখতে পারত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চমৎকার ছিল তার বন্দুকের টিপা খুব শরীরী ছিল অধর। চমৎকার গড়ন। উদাত্ত গলায় গান গাইতে পারত। কোন কিশোরীই না তার জন্য? এসব সেই সময়কার কথা। বিয়ে হয়নি, সবসময় তো হয়ে ওঠে না। কিন্তু রেশটা রয়ে গেল কেন তা বুঝি না। অভ্যাসই হবে। মেয়েরা সহজে সম্পর্ক ভাঙতে পারে না।

আমি এসব বুঝি কমলা। আমি ছাড়া কে বুঝবে?

কমলা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। লৌহমানবীরও বুঝি স্পর্শকাতর কোনও জায়গা থাকে। আঁচলটা তুলে রেখেছিলেন মুখের কাছে আগে থেকেই। বুঝি জানতেন, আজ তার কান্না আসবে।

কিন্তু আর সকলের মতো তো তার কাঁদতে নেই। খুব আলগোছে চোখটা একটু ঢাকলেন আঁচলে। সরিয়ে নিলেন। সামান্য ভারী গলায় বললেন, সবাই জানত, কিন্তু বুঝত না। বিয়ে করলাম না বলে বাড়িতে কত অশান্তি পোয়াতে হয়েছে। মেয়েদের যে কত কিছুর জন্য দাম দিতে হয়, কত প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তা পুরুষেরা বোঝে না। মেয়েরা হয়তো বোঝে। কিন্তু তারা গা করে না।

যার জন্য এত ভোগান্তি সে বোঝে?

 কমলা চমৎকার করে হাসলেন। শিশুর মতো। আগে এমন হাসতেন না। মাথা নেড়ে বললেন, না।

আমি ধীরে ধীরে স্বভাববিরুদ্ধ স্মৃতিভারে আক্রান্ত হচ্ছিলাম। স্মৃতি বড় ভারী। বড় মন্থর করে দেয় মানুষের গতি। কিন্তু স্মৃতি কীসের? আমার জীবনে তেমন কোনও প্রেম নেই, হৃদয়দৌর্বল, নেই। অন্যান্য ব্যাপারে যেমন, এ ব্যাপারেও তেমনি, পিছনটা এক রৌদ্রতপ্ত খাখা বালিয়াড়ি। সেই বালিয়াড়ি ভেঙে ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসছে এক পাগল ঘোড়সওয়ার। তাকে একটা সীমারেখা ডিঙোতেই হবে। দারিদ্র্যসীমা। নারীপ্রেম নেই, স্নেহ নেই, অবকাশ নেই। তার স্ত্রী ছিল সুন্দরী। তার স্ত্রী ছিল প্রণয়ভিক্ষু। তার তখন সময় ছিল না। স্ত্রী অপেক্ষা করতে পারত আর একটু। করল না। চলে গেল। ঘোড়সওয়ার তার দারিদ্র্যসীমা ডিঙিয়েছে শেষ অবধি। সে জানে, সেইটেই আসল কথা।

আমি অনুচ্চ স্বগতোক্তির মতো বলি, স্কুল ছাড়া আপনি আর কোনও কিছুর কথাই ভাবেননি বহু বছর ধরে। শুধু স্কুল আর স্কুল। স্কুলটাই সর্বস্ব ছিল আপনার। আমি আপনার সেই সর্বষই কি কেড়ে নিচ্ছি।

কমলার ঘাড় নোয়ানো, ঘড়ির স্ট্র্যাপ নিয়ে খেলা করতে করতে মৃদু একটু হাসলেন। জবাব দিলেন না।

আমি বললাম, এবার অন্য দিকগুলোয় মন দিতে পারবেন।

 কমলা আমার দিকে একটু তাকালেন, পট করে চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন, ঠিক জানেন, পারব?

পারবেন না?

কমলা একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর খুব ধীর স্বরে বললেন, কী জানি! মনে হয় না। আমার সবদিকই হারিয়ে গেছে।

বহুদিন। আমি বহুদিন ধরে লক্ষ করছি এক অসম লড়াই। একদিকে স্কুল, অন্যদিকে অধর। একজন বিবাহিত প্রায়-মধ্যবয়স্ক পুরুষ, যে আর সাইকেলের জাদু দেখায় না, কিংবা দেখালেও তাতে আর কিছু যায় আসে না। অন্যদিকে একটা বিশাল স্কুল, যা গড়ে উঠছে, গড়ে তুলছে। প্রাণবন্ত, স্পন্দনশীল। অধরের কিছু দেওয়ার নেই আর। কিন্তু স্কুল অসংখ্য কচি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরছে কমলাকে। ব্যগ্র, আকুল হাত। অধর পারবে কেন? কমলার মনের মধ্যে কবেই তো মরে গেছে সে। তবু তার একটা প্রেতচ্ছায়া আছে। সেটাকেই সে বলে ভুল হয় বারবার। আমি জানতাম।

কমলা নতমুখে হাসলেন। কেন হাসছেন? এ তো হাসির সময় নয়!

কমলা আচমকা মুখ তুললেন। স্পষ্ট ও সহজ ভঙ্গিতে তাকালেন আমার দিকে। মুখে এখনও স্মিত ভাব। বললেন, স্কুলের হিসেবে অনেক কারচুপি ধরা পড়েছে।

আমি মাথা নাড়লাম, জানি।

কমলা আমার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন। আস্তে আস্তে বললেন, স্কুলের মেন্টেনেন্সের জন্য আমরা কনট্রাক্ট দিয়েছিলাম অধর বিশ্বাসকে। বহু টাকার কনট্রাক্ট। স্কুলের নতুন দুটো উইং তারই তৈরি। তাকে যেসব পেমেন্ট দেওয়া হয়েছিল তার অনেকগুলো ভাউচার নেই। আপনি কখনও আমাকে প্রশ্ন করেননি, ভাউচারগুলো কী হল।

আমি মৃদু হেসে বললাম, না। কারণ আমি জানতাম সেগুলো আপনি সরিয়ে নিয়েছেন। হয়তো অধর আপনাকে সরাতে বলেছে।

হ্যাঁ। মানুষকে যখন নিশিতে পায় তখন সে অনেক অস্বাভাবিক কাণ্ড করে। আপনার কাছে কি ক্ষমা চাইতে হবে?

আমি মাথা নেড়ে বলি, না। কারণ আমার কাছে প্রত্যেকটা ভাউচারের ফটোকপি আছে। আমি বিপদে পড়তে ভালবাসি না।

স্নিগ্ধ এক দৃষ্টিতে আমাকে অকপটে কমলা নিরীক্ষণ করছিলেন। মুখে দুষ্টুমির একটু হাসি মেখে নিয়ে বললেন, আমিও জানতাম, আপনাকে বিপদে ফেলা সহজ নয়। আর সেই ভরসাতেই চুরি করেছিলাম।

আমার ভিতরকার সেই আশ্চর্য ক্যালকুলেটরটির কথা ওঁকে বললাম না। সর্বদাই সে হিসেব কষে, সর্বদাই সে টের পায়, সর্বদাই সে দেয় নির্ভুল বিপদসংকেত। কিন্তু সেটা কোনও বড় ব্যাপার নয়। স্কুলের কাগজপত্রে যে অদৃশ্য হাত পড়ছে তা অনেক আগেই অসীমা মারফত আমি জানতে পারি। ঘটনাটা আমার ভিতরকার ক্যালকুলেটরকে জানাই এবং প্রশ্ন করি, হাতটা কার হতে পারে বলল তো! ক্যালকুলেটর অল্প সময়েই তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দিয়েছিল, হাতটা কমলা সেনের। কিন্তু মুশকিল হল, কমলা সেনকে আমি জানি। এই কঠোর প্রশাসন ও নীতিপরায়ণ মহিলার পক্ষে এ কাজ করা প্রায় অসম্ভব। তবে ওঁর একটি রন্ধ্র আছে। সেই রন্ধ্র দিয়েই লোহার বাসরে মাঝে মাঝে হানা দেয় কালনাগিনী। অধর। পুরো একটা দিন আমি ক্যালকুলেটরে অনেক হিসেব-নিকেশ করি। বারবার প্রশ্ন করতে থাকি ক্যালকুলেটরকে, কী করব? কমলাকে হাতেনাতে ধরব, না কি একটা বিকট গণ্ডগোল পাকিয়ে বসব?

না, আমি ওসব করিনি। বরাবর আমার যুদ্ধ ছিল অন্যরকম। অনেক আধুনিক ও বৈপ্লবিক সেই যুদ্ধাস্ত্র। আমি জানতাম, কমলা সেন নিজের দ্বারা চালিত হয়ে এ কাজ করছেন না। এ কাজ তাকে দিয়ে করাচ্ছে একটা ভূত। একটা প্রেতচ্ছায়া। একটা মৃত প্রেমের স্মৃতি। একদিন কমলা সেন জেগে উঠবেনই। একদিন সচকিত হয়ে তিনি আত্মধিক্কারে বলে উঠবেন, ছিঃ ছিঃ! এবং সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি অধরকে ঘৃণা করতে শুরু করবেন। এর চেয়ে বড় কাউন্টার-অ্যাটাক আর কী হতে পারে আমার পক্ষে?

তাই আমি শুধু নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য কাগজপত্রগুলির ফোটোকপি গোপনে তৈরি করে রেখেছিলাম মাত্র। মুখে কিছুই বলিনি। আজ কমলা সেনের মুখ দেখে বুঝতে আর কষ্ট নেই তার কৈশোর থেকে বহন করে আনা প্রেমের শবদেহটিতে পচন শুরু হয়েছে। তিনি তা কাধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন। স্নান করেছেন। শুদ্ধও হননি কি?

আমার দিকে চেয়ে থাকা কমলা সেনের শেষ হচ্ছে না যেন। চেয়ে থেকেই বললেন, কেউ কথাটা জানবে না, না?

না। জানার দরকার নেই।

কিন্তু লোকে চিরকাল আপনাকে অপবাদ দেবে, এমন একজন ভাল হেডমিসট্রেসকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করেছেন বলে।

মৃদু হেসে বলি, দিক। লোকে আমার আরও অনেক গুরুতর অন্যায়ের কথা জানে। আমার তাতে কিছু যায় আসে না।

কমলা সেন মুখ টিপে হেসে বললেন, অথচ পাবলিকের কাছে আমাকে কত ছোট করে দিতে পারতেন আপনি। করলে আর কেউ আপনাকে দায়ী করত না।

আপনি ছোট নন।

কমলা সেন আবার হাসলেন। ভারী শিশুর মতো হাসছেন আজ। শিশুর মতোই সরলভাবে চেয়ে থাকছেন। মৃদুস্বরে বললেন, তাই বুঝি?

আমি একটু আনমনা হয়ে যাই। আমার অস্ত্র শুধু কমলাকে আঘাত করেই যে ক্ষান্ত হয়েছে এমন নয়। অস্ত্রটি হয়তো এখনও ক্রিয়াশীল এবং হয়তো একদিন তা আমাকে লক্ষ্য করেই ছুটে আসবে। অধর যেমন কমলাকে কাজে লাগিয়েছিল, তেমনি কাউন্টার-অ্যাটাকে আমার দাবার ঘুটি ছিল অসীমা। জাগ্রতবিবেক কমলা যেমন করে ঘৃণা করছেন অধরকে, তেমনি একদিন অসীমাও কি করবে না আমাকে?

আমি মৃদুস্বরে বললাম, আপনি ছোট হলে আমিও হোট। কিন্তু নিজেকে ছোট ভাবতে নেই।

 কমলা ধীরে ধীরে উঠলেন। বললেন, চলুন চিঠিটা আপনার হাতে তুলে দিই।

 চলুন–আমিও উঠলাম।

আমরা ঘরে ফিরে আসি। টাইপিস্ট ছেলেটা এসে গেছে। বাইরের বেঞ্চে এসে বসে আছে নানা অর্থপ্রার্থী। কোমল আলোর লাবণ্য মুছে গেছে ঘর থেকে। পাখিদের সেই নিঝরিণীর মতো কলকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে না আর। শুরু হয়ে গেছে কাজের দিন।

কমলা চেনটা খুলে ব্যাগ থেকে খামে আঁটা চিঠিটা বের করে টেবিলে রাখলেন। বললেন, আসি তাহলে?

আমি ঘাড় নাড়লাম।

রিকশাটা দাঁড়িয়েই ছিল। কমলা লঘু, ভারহীন পায়ে গিয়ে উঠে বসলেন। মুখে সেই স্মিত ভাবটুকু শেষ মুহূর্ত অবধি লক্ষ করলাম। মনে হল, কমলা এখন সত্যিই ভারহীন। এখন তিনি স্কুলের বাচ্চা এক ছাত্রীর মতোই হঠাৎ হাফছুটি পেয়ে অবাক আনন্দে ভরে আছেন।

রিকশা মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।

আমি মহৎ বা আমি সৎ এমন কথা আমি বলছি না। কারণ আমি তা নইও। দারিদ্র্যসীমা পার হওয়া যে শুধুমাত্র কর্মদক্ষতা নিষ্ঠা বা ঐকান্তিকতার ওপর নির্ভর করে না তা অভিজ্ঞ মাত্রই জানেন। তবু লোকে আমাকে যতটা অসৎ বা অমহৎ বলে জানে আমি বোধহয় ততটা নই। আমি আমার স্ত্রীর হত্যাকারী বলে গণ-দরবার রায় দিয়েই রেখেছে। হায়, তাদের ফাঁসি দেওয়ার অধিকার নেই। ফলে আমার নিষ্ঠুরতার কথা কেই বা না জানে! অন্যের কথা বাদই দিলাম, কেউ যদি আমার বোন রুমাকে জিজ্ঞেস করে আমি অর্থাৎ তার দাদা আমার স্ত্রী অর্থাৎ তার বউদিকে বিষ দিয়ে মেরেছি কি না তা হলে সে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে না কথাটা বলতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। এ বিষয়ে একটা দ্বিধা বা সন্দেহ তারও আছে।

এইসব অখ্যাতি ও কিংবদন্তী মানুষের অদৃশ্য শত্রু। এদের বিরুদ্ধে লড়াই চলে না। আমি সেই বৃথা যুদ্ধ কখনও করিনি। বরং একটা কিংবদন্তী গড়ে উঠতে দিয়েছি। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, যা কিংবদন্তী নয়, যা বহু মানুষের চোখের সামনে নিত্য ধীরে ধীরে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে তা নিয়ে কেউ কোনওদিন একটি বাক্যও উচ্চারণ করেনি। বেশিরভাগ মানুষই যদি বোকা ও কিয়ৎ পরিমাণে অন্ধ না হত তা হলে তারা আমার ও কমলার সম্পর্কে একটা মুখরোচক কাহিনি রটনা করতে পারত। সেটা মিথ্যেও হত না।

কিন্তু তারা তা করেনি।

আমি সারাদিন আজ জনসাধারণের বিচিত্র মানসিকতা নিয়ে ভাবলাম। তাদের সকলের চোখের সামনেই তো ঘটেছিল সবকিছু। একটা স্কুলকে গড়ে তোলার জন্য কমলা প্রাণপাত করছিলেন। আমি তার কাছাকাছিই ছিলাম। মাঝে মাঝে ভেঙে পড়তেন, উত্তেজিত হয়ে উঠতেন, রেগে যেতেন। প্রথমদিকে ছাত্রছাত্রী বেশি হত না। রেজাল্ট ছিল খারাপ। অর্থকরী অবস্থা বিপন্ন। নিজস্ব বাড়ি পর্যন্ত ছিল না। সব ধীরে ধীরে অতি কষ্টে হল। আমি তত পুরনো সেক্রেটারি নই। মাত্র শেষ তিনটে টার্মে আমি কমলার কাছাকাছি আসতে পারি। কো-এডুকেশন আমার পছন্দ ছিল না। কিন্তু কমলা জেদ ধরলেন, শুধু গার্লস স্কুলে ছাত্রী হয় না তেমন। বিশেষ করে একটা সরকারি গার্লস স্কুল যখন শহরে রয়েছে। ওঁর জেদ জয়ী হল। আমি হারলাম। এইসব নানা তুচ্ছ জয়-পরাজয় আমাদের মধ্যে তৃতীয় আর একটা সম্পর্কের দরজা খুলে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। কমলা মাঝে মাঝে আমাকে বলতেন, ধমক দিয়েই বলতেন, টাকা দিন। ধার নয়, ডোনেশন। আমি দিতাম। কমলা একদিন বলেছিলেন, শুনুন পারিজাতবাবু, কেবলমাত্র টাকা আছে বলেই আপনি স্কুলের সেক্রেটারি হতে পেরেছেন, আর কোনও গুণে নয়। আমি মৃদু হেসে কথাটা মেনে নিয়েছিলাম। তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ সব ঘটনা। তবু জানি, আর কেউ নয়, একমাত্র আমার কাছেই তিনি স্কুলের জন্য নিঃসংকোচে হাত পাততে পারতেন। সেই হাত আমি কখনও শূন্য ফেরাতে পারিনি। না, এর বেশি কিছু নয়। তবু এর চেয়ে গভীর আর কীই বা হতে পারে? কমলার মনের মধ্যে অধরকে আমি তো কবেই হত্যা করেছি। কিন্তু কেউ বোঝেনি। বোধহয় অধর নিজেও নয়।

কদিন হল বৃষ্টি নেই। শুকনো খটখটে দিন। অ্যাকটিং হেডমিসট্রেস হিসেবে দুটো ব্যস্ত দিন কাটিয়ে অবশেষে এক বিকেলে অসীমা এল। আরও জীর্ণ, আরও শীর্ণ, মুখে চোখে গভীর উদ্বেগের ছাপ।

আমার দিকে পলকহীন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, রোজ স্কুলে কারা গোলমাল করতে আসে বলল তো!

ঘটনাটা আমিও জানি। তবু নির্বিকার মুখে বললাম, কীসের গোলমাল?

স্কুলের সারা দেওয়ালে পোস্টার। ব্রিং ব্যাক কমলা সেন, অসীমা দিদিমণি গদি ছাড়ো, পারিজাতের মুণ্ডু চাই, এইসব। স্কুলে দুদিনই ঢিল পড়েছে। শ্লোগান দিয়েছে কিছু লোক। শোনা যাচ্ছে, স্ট্রাইকও হবে।

আর স্কুলের ভিতরে কী হচ্ছে অসীমা?

অসীমা একটা শুকনো ঢোঁক গিলল। গভীর এক হতাশা মাখানো মুখে বলল, স্কুলের ভিতর? ভীষণ থমথমে। কেউ আমার সঙ্গে ভাল করে কথাবার্তা বলে না। টিচার্স রুমে খুব উত্তেজিত আলোচনা চলে সারাদিন।

তুমি ভয় পাচ্ছ না তো অসীমা?

ভয়?–অসীমা অনিশ্চয় মুখে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলে, একটা ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি পারব না।

কেন পারবে না অসীমা? একটা স্কুল চালানো কি খুব শক্ত?

অসীমা আজ চোখের পলক ফেলছে খুবই কম। আমার দিকে সেই চোখে আবার কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, এটা যেন কমলাদিরই স্কুল। আমাকে তো কেউ চাইছে না। এরকম সিচুয়েশনে কি কাজ করা যায় বলো!

আমি তো আছি।

অসীমা ওপর নীচে মাথা নেড়ে চিন্তিতভাবে বলল, হ্যাঁ, তুমি আছ। সেটা অবশ্য ঠিক।

কিন্তু আমি আছি জেনেও অসীমার চোখ মুখ বিন্দুমাত্র উজ্জ্বল হল না। একটুও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল না সে। আজ যেন ও সেই বাড়ি, যার বাথরুমের আলোটাও নিভে গেছে। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।

আমার অসীমাকে একবার বলতে ইচ্ছে হল, বিপদের ভয় তোমার কতটুকু অসীমা? স্কুলে পোস্টার দেখোনি? পারিজাতের মুন্ডু চাই! কই একবারও আমার বিপদের কথা বললে না তো!

একটা নির্জন উপত্যকায় দুজন অশ্বারোহী বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসছে। দেখা হবে। আমার ক্যালকুলেটর বলছে, লগ্ন আসন্ন। আর বড় একটা দেরি নেই।

অসীমাকে আমি ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম।

ফিরে এসে অনেকক্ষণ অন্ধকার কুঞ্জবনে বসে রইলাম চুপ করে। কুঞ্জে কোনও রাধা আসবে না। চিরকাল অপেক্ষা করলেও না। তার বদলে ঝাক বেঁধে এল মশা। কিন্তু আজ তাদের হুল আমি তেমন টের পেলাম না।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়