শিউলির গন্ধ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

১। পারিজাত

হে দরিদ্র ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, অজ্ঞ ভারতবাসী, তোমরা আমার ভাই, আমার বন্ধু, আমার একান্ত আপনার জন্য। আমি তোমাদেরই লোক। আমি যখন দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করতাম তখন যেমন, এখন দারিদ্র্যসীমার কিছু ওপরে বাস করার সময়েও তেমনই আমি তোমাদেরই লোক হয়ে গেছি। দারিদ্র্যসীমা হল একটা রেললাইনের মতো। মাঝখানে উঁচু রেলবাঁধ, তার দুধারেই লোকালয়। ওধারে তোমরা, এধারে আমরা। তবু আমি সেই রেলবাঁধ পেরিয়ে মাঝে-মাঝেই গিয়ে দেখে আসি ওপারের ভারতবর্ষকে। দারিদ্র্যসীমার নীচেকার ওই ভারতবর্ষই তো আমার শৈশবের মাতৃক্রোড়, কৈশোরের চারণভূমি, যৌবনের উপবন। দারিদ্র্যসীমা বা রেলের ওই বাঁধটা এমন কিছু পাকাঁপোক্ত বাধাও নয়। এ ধারের লোক প্রায়ই ওধারে যায়, ও ধারের লোক আসে এধারে। কোনও পাসপোর্ট বা ভিসা লাগে না। দারিদ্র্যসীমার নীচেকার ওই ভারতবর্ষে এখনও আমার বিস্তর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু রয়ে গেছে।

বন্ধুগণ, ভারতবর্ষ ঠিক কয় ভাগে বিভক্ত তা আমি জানি না। তবে গুণেনবাবু জানেন। তিনি এ বিষয়ে যে গবেষণাগ্রন্থটি রচনা করছেন তা শিগগিরই থিসিস হিসেবে পাঠাবেন বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, ভারতবর্ষকে ধর্ম, অর্থনীতি ও ভাষার দিক দিয়ে অন্তত চোদ্দোটি ভাগ করা যায়। শুধু তা-ই নয়, বেসরকারি ভাবে সেই ভাগ হয়েও গেছে, শুধু সরকারিভাবে তা স্বীকার করা হয় না।

স্বীকার আমিও করি না। আমার রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটি মনে পড়ে। ওই যে কবিতাটি যার মধ্যে আছে এক দেহে হল লীন। আমার ছাই কিছুই ভাল মনে থাকে না। তবু আমি এক দেহে লীন হওয়ার তত্ত্বটা খুব বিশ্বাস করি। কিন্তু তা নিয়ে গুণেনবাবুর সঙ্গে তর্ক করতেও আমি যাই না।

তার সব কথা মেনে নিই বলে গুণেনবাবু যে খুশি হন তা মোটেই নয়। উনি সর্বদাই কিছু-না-কিছু নিয়ে তর্ক এবং তাতে জয়লাভ করতে ভালবাসেন। বলতে কী এইটেই ওঁর হবি। সারাদিন উনি প্রতিপক্ষ খোঁজেন এবং যে কোনও লোকের সঙ্গেই যে কোনও বিষয়ে একটা তর্ক বাধানোর চেষ্টা করেন। ওঁর ভিতরে তর্কের বিষদাত সর্বদাই শুলশুল করে। গুণেনবাবুর সঙ্গে আমার তর্ক না করার আর একটা কারণ হল, তার বোন অসীমার সঙ্গে আমার বিয়ের একটা কথা চলছে। অসীমা রোগা, কালো এবং অসুন্দরী হলে কী হয়, সে একটা ভাল জাতের কো-এডুকেশন স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিসট্রেস, ডবল এম এ এবং বি এড-এ ফার্স্ট ক্লাস।

.

অসীমা একদিন আমার ঘরে একখানা বই ফেলে যায়। ইস্কুলের পাঠ্য বাংলা বই। তাতে আমি রবীন্দ্রনাথের সেই এক দেহে হল লীন কবিতাটি পেয়ে যাই। সেইদিনই গুণেনবাবুকে কবিতাটি শুনিয়ে বে-খেয়ালে বলে ফেলেছিলাম আপনি ভারতবর্ষকে যে চোদ্দোটা ভাগে বিভক্ত করেছেন আসলে ইমাজিনেশন।

তর্কের গন্ধ এবং প্রতিপক্ষ পেয়ে গুণেনবাবুর মুখ উজ্জ্বল হল, তিনি খুব ঠান্ডা গলায় শুরু করলেন, ইমাজিনেশন? ইমাজিনেশন? আপনি কি জানেন বিষুবরেখাও ইমাজিনেশন। হায়ার ম্যাথম্যাটিকসও ইমাজিনেশন! আপেক্ষিক তত্ত্বও ইমাজিনেশন! যারা এইসব ইমাজিন করেছে তারা কি ঘাস খায়?

বন্ধুগণ, এই ঘাস খাওয়ার কথায় আমি ভিতরে ভিতরে লজ্জা ও হীনমন্যতায় অধোবদন হয়ে যাই। কারণ আমাকে একবার বাস্তবিকই ঘাস খেতে হয়েছিল। তখন আমি দারিদ্র্যসীমার নীচে, অনেক নীচে বাস করতাম। আমার বাবা ছিলেন পোস্ট অফিসের সামান্য স্ট্যাম্প ভেন্ডর। তার ওপর দুরন্ত এক হাঁপানি রোগে এমন কাহিল যে বছরের ছমাস বিছানা থেকে উঠতে পারতেন না। সেবার ভারী বর্ষায় আমাদের এলাকাটা বানে ভাসছে। জলে ভিজে আমরা স্যাঁতা ও সাদা হয়ে গেছি। টানা তিন দিন আমাদের ভদ্রগোছের কোনও খাওয়া জোটেনি। একদিন মা আমাদের গমের সঙ্গে মিহি করে কুচোনো ঘাস ও অন্যান্য লতাপাতা লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে দেয়। খুব আনন্দের সঙ্গে না হলেও আমরা ভাইবোনেরা তা বেশ পেট ভরেই খেয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ঘাস খাওয়ার ফলে আমার মগজ তৃণভোজীদের মতো হয়ে গেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

ঘাস খাওয়ার সেই স্মৃতি আমাকে এতটাই অন্যমনস্ক ও বিষণ্ণ করে তুলল যে, গুণেনবাবুর যাবতীয় যুক্তিতর্কে আমি কেবল হুঁ দিয়ে গেলাম। উনি ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন।

আমার প্রতিবেশী জহরবাবু প্রায়ই বলেন, আপনার অতীতের সেইসব সাফারিংস নিয়ে একটা বই লিখুন না। এসব লোকের জানা দরকার। ইস্কুলেও পাঠ্য হতে পারে।

আমি বিনীতভাবে চুপ করে থাকি। জীবনী লেখার মতো বয়স বা সফলতা আমি এখনও অর্জন করিনি। তবু জহরবাবু কেন আমাকে জীবনী লেখার কথা বলেন তা আমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। উনি জানেন, নিজের অতীত জীবনের দারিদ্র্য সম্পর্কে আমার একটা রোমান্টিক ভাবাবেগ আছে। আমি কত কষ্ট করেছি সেটা লোককে আমি জানাতে ভালবাসি। দ্বিতীয় আর একটা কারণ হল, আমি ইচ্ছে করলে ওঁর মেজো মেয়ের একটা চাকরি অসীমাদের স্কুলে করে দিতে পারি। কারণ আমি ওই স্কুলের সেক্রেটারি।

জহরবাবু তাই আমার কাছে যাতায়াত বজায় রাখেন। কিন্তু মুশকিল হল জহরবাবু যথেষ্ট কথা জানেন না, বেশিক্ষণ বাক্যালাপ চালানো তাঁর পক্ষে কষ্টকর এবং তেল দেওয়ার সঠিক পদ্ধতিও তিনি শেখেননি। তবু আমাকে ভিজিয়ে রাখার জন্য তিনি আমার কাছেই আমাকে একজন মহৎ মানুষ বলে প্রতিপন্ন করা চেষ্টা করে যান। তাঁর মতে দরিদ্র অবস্থা থেকে আমার এই উন্নতি যুদ্ধজয়ের মতো। আজকালকার যুগে এরকমটা নাকি দেখা যায় না।

.

কেন দেখা যায় না? আমি একদিন তাকে প্রশ্ন করেছিলাম।

বলাবাহুল্য জহরবাবু জবাবটা খুঁজে পাননি।

কিন্তু গুণেনবাবু কাছেই ছিলেন। তিনি বললেন, জহরবাবু ঠিকই বলেছেন। আজকালকার যুগে হতদরিদ্র অবস্থা থেকে কেউই কোটিপতি হতে পারে না। এখানকার অরগানাইজড ক্যাপিট্যাল এমন একটা সিস্টেম তৈরি করেছে যে, আগের দিনের মতো পঞ্চাশ টাকার ক্যাপিট্যাল নিয়ে ব্যাবসা শুরু করে নিষ্ঠা, ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ের গুণে পাঁচ কোটি টাকার মালিক হওয়া এখন অসম্ভব। ছোট ব্যবসায়ীদের উন্নতিরও একটা অদৃশ্য এবং অঘোষিত সিলিং আছে। তার ওপরে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সব চ্যানেলেই রোড ব্লক আছে।

জহরবাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন, সেইজন্যই বলছিলাম, পারিজাতবাবু অসামান্য লোক। এই অরগানাইজড ক্যাপিট্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে উনি সামান্য অবস্থা থেকে কত বড় হতে পেরেছেন। এ যুগে দেখা যায় না।

গুণেনবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, পারিজাতের কথা আলাদা। ওকে কখনও অরগানাইজড ক্যাপিটালকে ফেস করতে হয়নি। ও এমন কিছু বড়ও হয়নি।

গুণেনবাবু অবশ্য তার মন্তব্যটিকে আর ব্যাখ্যা করলেন না। বরং হবু ভগ্নিপতি সম্পর্কে একটা বেস কথা বলে ফেলার লজ্জায় তাড়াতাড়ি উঠে বিদায় নিলেন।

.

জহরবাবু বোকা-বোকা মুখ করে বসে ছিলেন। আমি বোকা নই। আমার জানা আছে, বাইরে আমার সম্পর্কে নানা ধরনের গুজব জন্ম নেয় এবং বিস্তার লাভ করে।জহরবাবুর কানেও সেইসব গুজব গিয়ে থাকবে। উনি হয়তো সেগুলি বিশ্বাসও করেন। কিন্তু তবু আমাকে একজন মহৎ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা ছাড়া ওঁর আপাতত অন্য উপায় নেই।

আমি ওঁকে আমার দরিদ্র জীবনের একটা গল্প শোনালাম। সে একটা করুণ পায়জামার গল্প। বহুদিন বাদে পুজোর সময় বাবা আমাদের ভাইবোনকে নতুন জামাকাপড় দিলেন একবার। তেমন। কিছুই না। ভাইরা পেলাম খুব মোটা কাপড়ের একটা পায়জামা। বোনেরা পেল মোটা ছিটকাপড়ের ফ্রক। সে কী আনন্দ আমাদের। পায়জামা দেখি, শুকি, সারাদিন শতেকবার খুলি, আবার ভাজ করে রাখি।

সাদামাটা এই গল্পটা শুনে জহরবাবুর চোখ ছলছল করতে লাগল। খুবই কোমল-হৃদয় মানুষ বলতে হবে। ফিসফিস করে বললেন, লিখে ফেলুন, এসব লিখে ফেলুন, একটা মহৎ জীবনীগ্রন্থ হবে।

কিন্তু আমি বুঝি না, দারিদ্র্যের কথা লিখে কী লাভ? দারিদ্র্য জিনিসটা কেমন তা আমার জীবনী পড়েই বা কেন জানতে হবে লোককে? তারা কি জানে না? জহরবাবু নিজেও ভালই জানেন। কারণ ওই দারিদ্র্যসীমার খুব কাছেই ওঁর বাস। মেজো মেয়েটার চাকরি না হলে গ্রাসাচ্ছাদনের খুবই অসুবিধে দেখা দেবে। তবু উনি এমনভাবে আমার কাছে দারিদ্র্যের কথা জানতে চান যেন সেটা কোন দূরের অচেনা রাক্ষসপুরীর গল্প।

অবশ্য জহরবাবুকে দোষ দিই না। আমি নিজেও আমার অতীত দারিদ্র্যের কথা লোকের কাছে গল্প করতে ভালবাসি। জহরবাবুর মতো দু-চারজন লোক তা শোনেন এবং নানারকম সহানুভূতি প্রকাশ করেন। আমার পুরুষকারেরও প্রশংসা করেন কেউ কেউ।

কিন্তু নিন্দুক এবং রটনাকারীরও অভাব নেই। আমার সম্পর্কে অনেকরকম গল্প ও গুজব প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে রাজবাড়ির আলমারির গল্প।

এক সময় একটা শহরে আমি ছিলাম। সেটা ছিল এক করদ রাজ্যের রাজধানী। ছোটখাটো ছিমছাম শহর। রাজাদের সেই আগেকার রবরবা নেই। ক্রমে ক্রমে অবস্থা পড়তে পড়তে এমন তলানিতে এসে ঠেকল যে, রাজবাড়ি থেকে নানারকম পুরনো জিনিসপত্র বিক্রি করে দেওয়া হতে লাগল।

.

লোকে বলে, আমি নাকি জলের দরে রাজার একটা পুরনো কাঠের আলমারি কিনে নিই! বহুকাল খোলা হয় না এবং চাবিও বেপাত্তা বলে আলমারির ভিতরে কী আছে তা আর দেখে নেওয়ার সময় বা সুযোগ রাজার হয়নি। সেই বন্ধ আলমারির ভিতর নাকি আমি কয়েক লক্ষ টাকার সোনা ও রুপোর বাসন পেয়ে যাই। ফলে অরগানাইজড ক্যাপিটালের সমস্ত অবোধ পার হয়ে রাতারাতি পুঁজিপতিদের এলাকায় ঢুকে যেতে আমার কোনও অসুবিধেই হয়নি।

বলাবাহুল্য এ গল্প আদপেই সত্য নয়! রাজবাড়ি থেকে একটা বিলিতি ওক কাঠের আলমারি আমি কিনেছিলাম বটে, কিন্তু তার ভিতরে তেমন সাংঘাতিক কিছু ছিল না। কিন্তু সেকথা আমি বললেই বা লোকে বিশ্বাস করবে কেন? লোকে বিশ্বাস করে সেটাই যেটা তারা বিশ্বাস করতে চায়। সুতরাং আমার সম্পর্কে প্রচলিত গুজবগুলির প্রতিবাদ আমি কখনও করি না। বরং আমার চারদিকে যে অবাস্তব রহস্যময় একটা কল্পকুহেলি গড়ে উঠেছে সেটাকে আমি গড়ে উঠতে দিচ্ছি।

আজকাল বিকেলের দিকে প্রায়ই অসীমা আমার বাড়িতে আসে। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক নয়। অসীমাদের পরিবার খুবই রক্ষণশীল। বিয়ের আগে মেলামেশার ব্যাপারটা তারা আদপেই পছন্দ করে না। কিন্তু সময়টা সেই পুরনো আমলে বসে নেই। সব রীতিনীতি ও মূল্যবোধই পাল্টে গেছে। সুতরাং অসীমা আসে এবং তার বাড়ির লোক দেখি না দেখিনা ভাব করে থাকে।

.

তবে একথাও ঠিক যে, অসীমা আমার সঙ্গে প্রেম করার জন্য মোটেই আসে না। তার আসার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবু সে যখন আসে তার আসাটা আমি রোজ লক্ষ করি।

আমার বাড়ির সামনে অনেকটাই জমি ছাড় দেওয়া আছে। সিংহবাবুরা একসময়ে এই জমিতে খুব সুন্দর বাগান করেছিলেন। কিন্তু সাজানো বাগান আমি ভালবাসি না। বরং একটা বন্য ধরনের অনিয়মিত এবং অসজ্জিত গাছপালা আমার বেশি পছন্দ। সেইজন্য বাগানে আমি মালি লাগাইনি। যত্রতত্র গাছ গজাচ্ছে এবং বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠছে। একটা লাল মোরামের মি পথ ফটক থেকে বাঁকা হয়ে এসেছে বাড়ির সদর পর্যন্ত। এই পথটির দুধারে বেঁটে বেঁটে লিচু আর কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি। চমৎকার ছায়া পড়ে থাকে পথে। লতানে গোলাপগাছও মেলা। খুব ফুল ফোটে। এই চমৎকার পথটি দিয়ে বিকেলের দিকে, প্রায় সন্ধের কাছাকাছি সময়ে ক্লান্ত অসীমা যখন আসতে থাকে তখন তাকে লক্ষ করতে আমার বেশ ভাল লাগে। না, ওই পথ আর ছায়া আর গাছপালার চালচিত্রে অসুন্দরী যে অপরূপ হয়ে ওঠে তা নয়। বরং তাকে আরও রোগা আরও কালো, আরও লাবণ্যহীন দেখায়। খুব রোগা বলেই বোধহয় ইদানীং একটু কুঁজোমতও হয়ে গেছে সে। কড়া মেজাজের দিদিমণি বলে তার মুখচোখেও একটা অতিরিক্ত রুক্ষতার ছাপ পড়েছে। সে খোঁপা বাঁধে এবং সাদা খোলের শাড়ি পরে। হাতে একটা ঘড়ি ছাড়া অন্য কোনও গয়না নেই। তার মতে পুরুষরা ডিসিপ্লিন মানে না, বোকার মতো কথা বলে এবং প্রায় সময়েই অসভ্যের মতো আচরণ করে। পুরুষদের প্রতি সেই বিরাগও তার মুখে স্থায়ী ছাপ ফেলেছে। এই কুৎসিত, লাবণ্যহীন অসীমাকে তবু আমি লক্ষ করি। খুব লক্ষ করি।

আমি থাকি নীচের তলায় সামনের দিককার ডানহাতি ঘরখানায়। মাঝারি মাপের ঘরখানা মোটামুটি একটা অফিসের ধাচে সাজানো। মাঝখানে একটা বড় ডেস্ক ও চেয়ার, ফাইল ক্যাবিনেট, টাইপরাইটার, টেলিফোন ইত্যাদি। ঘরের এক কোণে একটা লম্বা সরু চৌকিতে বিছানা পাতা থাকে। আমি রাতে প্রায় সময়েই ওই বিছানায় শুই। কারণ অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করার পর প্রায়দিনই আমার আর ভিতর বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকে না।

অসীমা এই ঘরেই এসে আমার মুখোমুখি বসে। ছোট্ট একটা রুমালে মুখ ও ঘাড়ের ঘাম মোছে। প্রথমেই আমরা কথা শুরু করি না। আমার বা অসীমার কারওরই তেমন কোনও প্রগভতা নেই। তাছাড়া কথা বলার অসুবিধেও থাকে। আমার টাইপিস্ট ছেলেটি সন্ধে সাতটার আগে ছুটি পায় না। বিকেলের দিকে অনেক পার্টিও আসে। সুতরাং অসীমাকে অপেক্ষা করতে হয়।

প্রায়দিনই আমরা কিছুক্ষণের জন্য প্রকৃতির মধ্যে গিয়ে বাগানে বসি। সিংহবাবুদের শখ ছিল। বাগানে তারা চমৎকার কয়েকটা বেঞ্চি বসিয়ে গেছেন। কোনও কোনও বেঞ্চির চারধারে ঘনবদ্ধ কুঞ্জবন। প্রেম করার আদর্শ জায়গা।

আমরা এরকম একটা কুঞ্জবনেই গিয়ে বসি। খুব সাদামাটা ভাবেই আমাদের কথা শুরু হয়।

আমি জিজ্ঞেস করি, অডিটে আর কোনও কিছু রা পড়ল?

 হ্যাঁ। ফারনিচার অ্যাকাউন্ট, বুক পারচেজ, রিনোভেশন সবটাতেই গণ্ডগোল।

 ইস্কুলে নিশ্চয়ই বেশ উত্তেজনা!

হ্যাঁ।

কী রিঅ্যাকশন দেখলে?

 খুব ডিসটার্ব বোধ করছে সবাই।

আমি একটুও চিন্তিত হই না। বলি, আর কী খবর?

 কমলাদি খুব ডেসপারেট হয়ে উঠছে।

 কীরকম?

অধরবাবু আজ স্কুলে এসেছিলেন।

বলো কী? দিনের বেলায়?

 তাই তো দেখলাম। কী বিশ্রী ব্যাপার বলল তো!

 কেন এসেছিল?

নিজে থেকে আসেনি। দপ্তরির কাছে শুনলাম কমলাদিই নাকি তাকে চিরকুট দিয়ে অধরবাবুর কাছে পাঠিয়েছিল।

কেন, তা জানতে পারোনি?

না, তবে সেকেন্ড পিরিয়ড থেকে যোর্থ পিরিয়ড পর্যন্ত অধরবাবু কমলাদির চেম্বারে ছিলেন। বাধহয় গারজিয়ানস মিটিং নিয়ে কথা হচ্ছিল।

আমি একটু ভাবলাম। কমলা সেন অসীমাদের হেডমিসট্রেস। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স এবং এখনও কুমারী। অধরবাবু এই শহরের মোটামুটি নামকরা একজন ঠিকাদার। তাঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বিবাহিত এবং চার-পাঁচটি ছেলেপুলের বাবা। এঁদের দুজনের মধ্যে একটা অবৈধ সম্পর্ক বহুকাল ধরে চালু আছে বলে গুজব। তবে সম্পর্কটা দেহগত না শুধুই ভাবগত সে সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত নয়। কমলা কেন অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক, তার আমলে স্কুলের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। রেজাল্টও দারুণ। কাজেই তার সম্পর্কে অপপ্রচার যা-ই থাক সেটা তেমন গুরুত্ব পায় না। অপরপক্ষে অধরবাবু অত্যন্ত ডাকাবুকো লোক। শোনা যায় তিনিও দারিদ্র্যসীমার তলা থেকে উঠে এসেছেন। একসময়ে ভাল খেলোয়াড় এবং দুর্দান্ত গুন্ডা ছিলেন। তার একটা বেশ বড়সড় দল আছে। অধরবাবুর দানধ্যান এবং পরোপকারেরও যথেষ্ট সুনাম। কমলা সেনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যে রকমই হোক সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার মতো লোকবল ও অর্থবলের অভাব তার নেই।

কিন্তু এরকম একটা অনৈতিক ব্যাপারকে চলতে দেওয়া আমি উচিত বলে মনে করিনি। জনসাধারণের ঘুম ভাঙিয়ে ব্যাপারটা তাদের গোচরে আনতে আমি প্রথমে শহরে কয়েকটা পোস্টার দিই। তাতে একটু গুঞ্জন উঠলে পরে অভিভাবকদের একটা মিটিং ধারণ করে। অভিভাবকদের মিটিং-এ দুজন রাজনৈতিক নেতাও ভাষণ দেন। বিস্ময়ের কথা হল, কমলা সেন তার বিরুদ্ধে রটনাটাকে অস্বীকার করেননি। স্বীকারও করেননি। অর্থাৎ তিনি মুখ খুলতে চাননি।

আমি বললাম, নজর রেখো।

রাখছি। তবে, কমলাদি খুব রেগে আছেন।

 তাই নাকি?

অসীমা একটা ক্লান্তির বড় শ্বাস ছেড়ে বলল, আমার সঙ্গে আজ একটু কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে।

কেন?

 আমি অডিটারদের কাছে রোজ যাই এবং কথা বলি বলে।

তাতে দোষ কী?

দোষ তো নেই-ই। কিন্তু উনি ঝগড়া করার একটা পয়েন্ট খুঁজছিলেন।

আমি একটু হাসলাম। বললাম, কিছু বললে ছেড়ে দিয়ো না।

আমি উচিত কথা বলতে ছাড়ি না।

খুব ভাল।আমি উদার গলায় বলি।

অসীমা একটু চুপ করে থেকে সামান্য বুঝিবা বিষণ্ণ গলায় বলল, কিন্তু আমি কমলাদির সঙ্গে কথা কাটাকাটি করায় কলিগরা কেউ খুশি হয়নি।

না হওয়ারই কথা। কমলা সেন সম্পর্কে প্রচার যাই থাকুক, উনি অসম্ভব জনপ্রিয়। সহকর্মীরা ওঁকে বড় বেশি শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সুতরাং অসীমা উচিত কথা বললেও সেটা ওদের কাছে অনুচিত শোনাবে। তাই আমি অসীমাকে জিজ্ঞেস করলাম, খুশি হয়নি কী করে বুঝলে?

সবাই অ্যাভয়েড করছিল আমাকে।

আমি কুঞ্জবনের আলো-আঁধার অসীমার শুষ্ক রুক্ষ মুখখানা লক্ষ করছিলাম। বোধহয় সুন্দরের মতো কুৎসিতের মধ্যেও একধরনের আকর্ষণ আছে। আসলে হয়তো সেটা বিকর্ষণই। জটিল এক মানসিক প্রক্রিয়ায় সেইটেই আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে আমি অসীমার মধ্যে সৌন্দর্য বা সৌন্দর্যের অভাব লক্ষ করছিলাম না। আমি বরং ওর মুখে অতি সম্প্রতি যে গভীর ক্লান্তির ছাপ পড়েছে তার কারণটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম।

অসীমা তার স্কুলটিকে বোধহয় ভালবাসে। খুব গভীরভাবেই বাসে। এই স্কুলে কোনও কারচুপি বা হিসেবের গোলমাল ধরা পড়লে সে নিশ্চয়ই খুশি হয় না। কিন্তু তার কিছু করারও নেই। সম্ভবত খুব শিগগিরই সে এই স্কুলের হেডমিসট্রেস হবে। এবং তা হবে কমলা সেনকে সরিয়েই। একসময়ে কমলা সেন সম্পর্কে অসীমার অন্ধ ভক্তি ও ভালবাসা ছিল। আজ নেই। এই সবের মূলে হয়তো আমার অবদানের কথাই সে ভাবে। আর তাই তার ক্লান্তি গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।

আমি বললাম, সব ঠিক হয়ে যাবে।

অসীমাও তা জানে। তাই জবাব দিল না। অনেকক্ষণ বাদে শুধু বলল, স্কুলে আমি খুব আনপপুলার হয়ে গেছি।

কেন, ছাত্রছাত্রীরাও কি তোমাকে অপছন্দ করে?

 তাই তো মনে হয়।

কেউ ওদের উসকে দিচ্ছে না তো?

 কী করে বলব?

 খোঁজ নাও। যদি দেখো দিচ্ছে তাহলে আমাকে জানিয়ো।

অসীমা খুব করুণ বোবা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইল। সে দৃষ্টির ভাষা আমি পড়তে পারলাম না। তবু মনে হল, অসীমার চোখ আমাকে বলছে, ক্ষ্যামা দাও, আর আমার ভাল তোমাকে করতে হবে না।

ছাত্রছাত্রীদের কাছে অসীমা কেন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে তা আমি বলতে পারব না। তবে সে কোনওকালেই ওদের তেমন প্রিয় দিদিমণি ছিল না। সবাই তাকে ভয় করত এবং মেনে চলত, এই যা।

আকাশ মেঘলা করেছে। কুঞ্জবন আঁধার হয়ে এল। আমি ঘড়িটা দেখে নিয়ে বললাম, চলো, উঠি।

চলো।

এইভাবেই রোজ আমাদের প্রেমপর্ব শেষ হয়। আমরা উঠে পড়ি এবং যে যার কাজে চলে যাই। অসীমা সম্ভবত এইরকম উত্তাপহীন প্রেমই পছন্দ করে। সে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করছে। ফলে তার একটা কঠোর নীতিবোধ জন্ম নিয়েছে। তাকে স্পর্শ করলে বা আরও ঘনিষ্ঠ কিছু করতে গেলে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করবে। আমি জানি বিয়ের পরেও এই সংকোচ কাটাতে তার সময় নেবে। আমারও তাড়া নেই। অসীমাই তো আমার জীবনে প্রথম মহিলা নয়। এমনকী সে আমার প্রথম স্ত্রীও হবে না।

এর আগে আমি আর একবার বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার সেই স্ত্রী মণিমালা আত্মহত্যা করে।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়