তিথি – উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

তিথির বয়স চোদ্দো প্লাস। বাইরে এখন ফুটফুটে ভোর। তাদের লবণহ্রদের বাড়ির বাগানে এখন অসময়ে কেন যে একটা কোকিল ডাকছে। আরে একটা বাতাস–খুব অদ্ভুত ভূতুড়ে বাতাস হু-হু করে বয়ে যাচ্ছে। ঠিক মনে হয়, বাতাসের কিছু কথা আছে, বলতে চাইছে, কিন্তু বোঝাতে পারছে না।

তিথি এই ভোরবেলাটিকে টের পাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছে কোকিলের ডাক। বাতাসের ঝাপটায় তার ববকাট চুল উড়ছে, ঝাপটা মারছে। কিন্তু তিথির সমস্ত মনপ্রাণ নিবদ্ধ একটা প্যাডের কাগজে লেখা কয়েক লাইন চিঠিতে। ঠিক চিঠিও নয়। তার বাবা বিপ্লব দত্ত বাংলা ভালো জানত না, লিখতে গেলে অজস্র বানান ভুল করত, তাই পারতপক্ষে বাংলা ব্যবহার করত না। একটু বেশি কোনাচে অক্ষর এবং ডানদিকে খুব বেশি হেলানো একধরনের ছাঁদ ছিল তার বাবার। এই হাতের লেখা চিনতে কোনো অসুবিধেই নেই তিথির। ওপরে খুব আনুষ্ঠানিকভাবে লেখা–টু হুম ইট মে কনসার্ন। তার নীচে সেই মারাত্মক কয়েকটি লাইন–নোবডি-অ্যাবসোলিউটলি নোবডি ইজ রেসপনসিবল ফর মাই ডেথ। লাইফ ওয়াজ অল ফান, ইট ইজ ফানিয়ার টু টেক ইট অ্যাওয়ে। আই লিভড ওয়েল, কন্টেটেড। ডোন্ট বদার মাই ফ্যামিলি। বাই। বিপ্লব দত্ত। বাবার ইংরেজি সবই খুব ভালো চেনে তিথি। পরিষ্কার সই, কোনো অস্পষ্টতা নেই, ঠিক যে ধরনের মানুষ ছিল তার বাবা। স্পষ্ট মানুষ। তবু কেন যে কেউ ঠিকমতো বুঝতে পারেনি লোকটাকে।

বিপ্লব দত্ত মারা গেছে মাস দুয়েক আগে। তখন কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি। ফলে পুলিশ কিছু ঝামেলা পাকিয়ে তুলেছিল। সোমনাথমামা এবং তার প্রভাবশালী বন্ধুরা লালবাজারকে নাড়া দিয়ে তবেই মৃতদেহ পুলিশ হেফাজত থেকে উদ্ধার করে আনে।

তিথি ভোরের ফুটফুটে আলোয়, কোকিলের ডাক আর বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে তার বাবার সুইসাইড নোটটার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইল। কপালের ওপর চুলের ঝটকা নেমে আসছে মাঝে মাঝে। সে কি বাবার ঈষৎ ভগ্ন কিন্তু গভীর কণ্ঠস্বরও শুনতে পাচ্ছে? লাইফ ওয়াজ অল ফান, ইট ইজ ফানিয়ার টু টেক ইট অ্যাওয়ে।…বাই।

এলিয়টের ওল্ড পোসামস বুক অফ প্র্যাকটিক্যাল ক্যাটস বইটা এই ভোরে খুঁজে বের করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না তিথির। কবিতা সে পড়েও না। দু-মাস বাদে আজই আবার ভোররাত থেকে সে শুরু করেছিল তার ফিজিক্যাল ওয়ার্ক আউট। প্রতিদিন সে অন্তত দু তিন মাইল দৌড়োয়। এক মাস বিরতির পর অবশ্য অর্ধেকও পারল না। ঊরু আর পায়ের ডিম ব্যথায় অবশ করে আনল। সঙ্গে একটা ক্লান্তি, হতাশা, ঘাম, বিরক্তি। মনে হচ্ছিল বৃথা শ্রম। বারান্দায় স্কিপিং করতে করতে মনে হচ্ছিল, বাঁদরের মতো লাফাচ্ছি কেন? কী হবে এইসব করে? ঘরে এসে পাখাটা খুলে মেঝের ওপর শুয়ে পড়েছিল তিথি। গরম লাগছিল ভীষণ তাই মেঝের ঠাণ্ডাটা বড়ো ভালো লাগছিল তার। মেঝেয় শুয়েছিল বলেই দেখতে পেল, বুক কেসের একদম নীচের তাকে একখানা বই উলটো করে রাখা। তিথি গোছানো মেয়ে, উলটোপালটা পছন্দ করে না। মেঝের ওপরই গড়িয়ে গিয়ে সে বুক কেস খুলে বইটা সোজা করে রাখতে গিয়ে দেখল একটা সাদা কাগজের কোনা উঁচু হয়ে আছে। টেনে বের করতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল।

এই আবিষ্কারের এখন আর কোনো মূল্য নেই। তার বাবার শরীর পঞ্চভূতে মিলিয়ে গেছে কবে। তবু তিথির যেন মনে হচ্ছিল সে তার বাবাকে স্পষ্টভাবে টের পাচ্ছে। বাবা যেন কাছেই! পাশেই!

এবাড়ির প্রায় সবাই নাস্তিক। কিংবা নাস্তিকও বলা যায় না, একটু হচপচ। ভগবান-টগবান নিয়ে কেউ কিছু ভাবে-টাবে না। ভূত-টুত ইত্যাদি নিয়েও তারা কখনো মাথা ঘামায়নি।

কিন্তু কী আশ্চর্যের বিষয়, বিপ্লব দত্ত মারা যাওয়ার পরই এই বাড়ির আবহাওয়ায় কিছু একটা সঞ্চারিত হল। কেমন থম ধরে গেল চারদিকটা! একটা ঘোর-ঘোর ভাব ঘনিয়ে উঠল কি বাড়ির ভিতরে?

প্রথম দু-চারদিন কেউ কিছু বলল না। কান্নাকাটি, শোক, আত্মীয় সমাগম ইত্যাদির পর সঞ্চারি একদিন ব্রেকফাস্টের সময় বলল, কাল রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি, অ্যাণ্ড আই হার্ড সামবডি ওয়াকিং অন দা রুফ।

আশ্চর্যের বিষয় কেউ এই কথার প্রতিবাদ করল না। সবাই চুপ করে রইল।

বিকেলে বুক্কা বলল, তোমাকে বলিনি মা, আই হিয়ার সামবডি কাফিং অ্যাট মিডনাইট।

তিথির মা মিলি দত্ত কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে বলল, ওসব কিছু নয়।

এর বেশি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা মিলি দিতে চেষ্টা করল না।

কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা গেল বাসন্তীর। সে এ-বাড়ির সবসময়ের কাজের লোক। সুন্দরবনের এই বাইশ-তেইশ বছর বয়সের যুবতীটি বেশ স্পষ্ট ভাষায় একদিন বলল, ও বউদি, দাদাবাবু কিন্তু এখনও আছে। কাল দেখলুম দোতলার বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে কে সিগারেট খাচ্ছে যেন। তখন রাত দুটো-আড়াইটে হবে।

মিলি খুবই দুর্বল গলায় বলল, বাসন্তী, এবাড়িতে বাচ্চারা রয়েছে। ওসব কখনো বলবে না। তোমরা গাঁয়ের লোক, অনেক কিছুই বিশ্বাস করো, আমরা করি না।

বাসন্তী আর উচ্চবাচ্য করল না তখনকার মতো। কিন্তু তারপর থেকে সে অন্য কৌশল নিল। কাজ করতে করতে সে স্বগতোক্তির মতো বলে যেতে লাগল, এসব অশৈলী কান্ড…এই তো স্পষ্ট শুনলুম দুপুর বেলা দাদাবাবুর ঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসছে…আচ্ছা, মলিন তো আর কানা নয়, সেও তো রাতে উঠে বাইরে যেতে গিয়ে দেখেছে ছাদের ওপর থেকে ঝুঁকে কে চেয়ে আছে বাগানের দিকে…অপঘাত বলে কথা…

এমনকী বাসন্তী কাজ ছেড়ে দেওয়ার হুমকি অবধি দিয়েছে মাঝে মাঝে।

এবাড়িতে কেউ ভূতে বিশ্বাস করত না বা এখনও করে না। কিন্তু বিপ্লব দত্ত মারা যাওয়ার পর সকলেই একে একে কিছু সংকোচের সঙ্গে এবং নানা অমোঘ অজুহাতে ঘর বদল করে ফেলল। বুক্কা চলে এল মায়ের ঘরে। হলঘরে বাসন্তী মেঝেতে আর সঞ্চারি সোফা কাম বেডে শুতে লাগল।

তিথিও ঘর বদলাল। তবে সেটা প্রতিবাদ হিসেবে। মৃত বাবাকে তার কোনো ভয় নেই। নিজের ঘর ছেড়ে সে চলে এল একতলায় তার বাবার ঘরে–যে ঘরে তার বাবা আত্মহত্যা করেছে!

মিলি রাগ করে বলল, এসব কী হচ্ছে তিথি? মোটেই ভালো নয়। আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না, কিন্তু মানুষের মনের ইমপ্রেশন তার চারদিকের অ্যাটমসফিয়ারে থেকে যায়। তোমার নিজের দক্ষিণ খোলা ঘর থাকতে ও ঘরে যাচ্ছ কেন?

তিথি উত্তর দেয়নি। কিন্তু মায়ের কথাও শোনেনি।

গত দু-মাস তিথি এঘরে আছে। একা। বাবার খাটে শোয়। বাবার টেবিলে লেখাপড়া করে। গভীর রাত অবধি জেগে থেকে ভাবে জন্মের কথা। মৃত্যুর কথা।

সে পায়ের শব্দ বা কাশির আওয়াজ শোনেনি। সিগারেটের গন্ধ পায়নি। দেখেওনি কোনো ছায়ামূর্তিকে। গভীর রাতে সবাই ঘুমোলে ঘুমহীন তিথি সারা বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছে ভূতের মতো। ছাদে, বারান্দায়, ঘরে ঘরে।

কিন্তু আজ সকালে বিপ্লব দত্তর সুইসাইড নোটটার দিকে চেয়ে থেকে তার মনে হল, বাবা যেন খুব কাছে। আর এই যে ভূতুড়ে বাতাস আর কোকিলের ডাক–এর ভিতর দিয়ে তার বাবাই যেন কিছু বলতে চাইছে তাকে।

.

০২.

বিপ্লব দত্ত মারা যাওয়ার পর কোনো সুইসাইড নোট আছে কিনা তা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। পাওয়া যায়নি। সোমনাথমামা শেষ অবধি বিরক্ত হয়ে বলে ফেলেছিল, হি ওয়াজ এ ভেরি ইরেসপনসিবল গাই। নিজের ফ্যামিলি হ্যারাসড হোক এটাই কি চেয়েছিলেন উনি? কোনো ভদ্রলোক তা চায়?

বিরক্ত মিলি দত্তও হয়েছিল। তবে সেটা প্রকাশ করেনি।

কেন নোটটা তখন পাওয়া যায়নি তা ধীরে ধীরে আজ সকালে বুঝতে পারল তিথি। বাবা সবসময় একগাদা বই নিয়ে শুতে যেত রাতে। অনেক রাত অবধি পড়ত। ঘুম পেলে বেডসুইচ টিপে ঘুমিয়ে পড়ত। সকাল বেলায় বিছানা থেকে বইগুলো সরিয়ে আবার বুক কেসে ভরত ঠিকে কাজের মেয়ে একা–অর্থাৎ একাদশী। সেদিনও তাই করেছিল। একা তো আর জানত না বিপ্লব দত্ত কবিতার বইতে তার সুইসাইড নোট গুঁজে রেখে গেছে। সে যখন বিপ্লব দত্তের বিছানা থেকে বই সরায় তখন লোকটি যে মারা গেছে একথাও তার জানা ছিল না। বিপ্লব দত্ত রোজকার মতোই কাত হয়ে পাশবালিশ জড়িয়ে শুয়ে ছিল। প্রায় তিন দিন ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টির পর সেদিনই পরিষ্কার আকাশে ভোরের রোদ দেখা দিয়েছিল। চমৎকার ছিল আবহাওয়া। সেদিন খবরের কাগজে খুন-জখম দুর্ঘটনার খবর ছিল খুবই কম। সেদিন একটি বিরল দোয়েল শিস শুনিয়ে গিয়েছিল। শিউলি গাছে শরতের প্রথম ফুল সেদিনই দেখেছিল প্রথম সঞ্চারি, মা, দেখে যাও শিউলি ফুল!

বাবাহীন পৃথিবীতে দু-মাস কেটে গেল। কাটবে বলে বিশ্বাস ছিল না তিথির। নোটটা হাতে নিয়ে তিথি খুব ধীর পায়ে বারান্দায় আরও আলোর মধ্যে এসে দাঁড়াল। বাঁকা জোরালো হাতের লেখা সুইসাইড নোটটার দিকে তাকিয়ে থেকেই সে শুনতে পেল, বাগানের ফুলে ফুলে মৌমাছির শব্দ। গ্যারেজের ওপাশে রাজমিস্ত্রিরা একটা ঘর করেছিল টিনের। ঘরটা ভাঙা হয়নি আজও। অনেক অব্যবহৃত জিনিস পড়ে আছে। সেই ঘরে মৌমাছি চাক বেঁধেছে। বিপ্লব দত্ত রোজ ওই চাকটা দেখে আসত গিয়ে। নরম রোদে দাঁড়িয়ে তিথি একটু ভাবল। মরবার আগে বাবার কি মনে হয়নি যে তার তিথি খুব কাঁদবে? তিথির বড় কষ্ট হবে? একটুও ভাবল না বাবা?

কোকিলটা যখন তার আর এক দফা ডাক শুরু করল তখন তিথি টের পেল, সে কাঁদছে।

 চোখের জল মুছে দোতলায় উঠে এল তিথি। চায়ের গন্ধ, রুটি সেঁকার গন্ধ, বাসনমাজার শব্দ।

মিলি দত্ত ডাইনিং টেবিলে বসা। সামনে চা।

তিথি মায়ের সামনে কাগজটা রেখে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, এই নাও মা, বাবার সুইসাইড নোট।

মিলি খুব অবাক হয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে বলল, কী এটা! কী বললি?

-বাবার সুইসাইড নোট। পড়ো না।

হাতটা একটু কেঁপে গেল কিনা বোঝা গেল না। মিলি দত্ত কাগজের ভাঁজটা খুলতে একটু সময় নিল। লেখাটা পড়তে প্রয়োজনের চেয়ে সময় আরও অনেকটা বেশি লাগল। তারপর উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, এই তো! কোথায় ছিল এটা? কোথায় পেলি?

-একটা বইয়ের মধ্যে। একা ওটা বুক কেসে তুলে রেখেছিল।

মিলি দত্ত সভয়ে আতঙ্কের সঙ্গে বিপ্লব দত্তের জোরালো হাতের কয়েকটি লাইনের দিকে চেয়ে থেকে অসহায় মুখখানা তুলে তিথিকে বলল, এখন এটা দিয়ে আমরা কী করব? ঠিক তখনই তিথি অনেকদিন বাদে হঠাৎ আবার টের পেল তার মা কী অসম্ভব সুন্দরী! ছোটোখাটো, ক্ষীণাক্ষী এই মহিলাকে এখন মনে হচ্ছে যেন দেবযান থেকে পড়া কোনো অপ্সরা। হ্যাঁ অপ্সরা, দেবী নয়। মিলি দত্তের চেহারায় দেবী-দেবী ভাব নেই। তার সৌন্দর্যে ঝাঁজ আছে, আছে আক্রমণ।

তিথি কাগজটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল, এটা আমার কাছে থাকুক মা। তুমি চা-টা খাও।

সব মহিলারই স্বামী সম্পর্কে কিছু অভিযোগ থাকে। মিলি দত্তেরও ছিল এবং আছে। তিথি জানে তার বাবা শুধু বাবা হিসেবে ছিল দারুণ। টপ গ্রেড। কিন্তু স্বামী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, আত্মীয় হিসেবে, মনিব হিসেবে, কর্মচারী হিসেবে অন্যান্য মানুষের কাছে হয়তো ততটা ভালো ছিল না।

যাকে আদ্যন্ত অসহায় বলে মিলি দত্ত ঠিক তাই। মিলি দত্ত একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কোনও কিছু নির্ধারণ করতে পারে না, কোনো মানুষ কেমন তা বিচার করতে পারে না, কোন দিন কী রান্না হবে তা ঠিক করতে পারে না, মিলি দত্ত ভিসি আর বা স্টিরিও চালাতে পারে না, মিলি দত্তের এইসব খামতিকে কোনোদিন নেগেটিভ সাইড বলে ভাবে না তিথি। কে জানে হয়তো এগুলোরও কিছু প্লাস পয়েন্ট থাকতে পারে।

মিলি মেয়ের দিকে চেয়ে ছিল প্রায় অপলক চোখে। স্বামী আত্মহত্যা করলে সন্তানেরা কি ভাবে বাবার মৃত্যুর পিছনে মায়ের গঞ্জনা আছে? মিলি দত্ত আজকাল ছেলে-মেয়েদের দিকে যেরকম ভয়ে ভরা চোখ নিয়ে তাকায় তাকে ইংরেজিতে বলে শীপিশ।

তিথির পরনে এখনও ছাইরঙা ট্র্যাক স্যুট, পায়ে কেডস। আজ এগুলো ছাড়ার কথা খেয়ালই হয়নি তার।

–চিঠিটার কথা কি আমাদের কাউকে বলা দরকার?

 তিথি ভ্রূ কুঁচকে বলল, না। এ চিঠিটার আর কোনো মূল্য নেই। এটা আমার কাছেই থাকবে।

–কী দরকার ওসব রেখে? ওটা কি ভালো চিঠি?

 তিথি মাথা নেড়ে বলল, ভালো-খারাপ কিছু নয়। থাক না।

–আমার কেমন যেন ভয় করছিল চিঠিটা পড়তে। কীসব লিখেছে। কেমন মানুষ ছিল তোর বাবা?

বাইশ বছর ঘর করার পর স্বামী সম্পর্কে এরকম অকপট প্রশ্ন একমাত্র মিলিই করতে পারে।

তিথি বলল, মাই ড্যাড ওয়াজ ফ্যান্টাস্টিক। সিম্পলি ফ্যান্টাস্টিক।

 মিলি চা খেল। খুব ধীরে ধীরে।

-তুই আবার আজ থেকে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলি?

–হ্যাঁ মা।

–ওসব করলে তোর চেহারাটা বড্ড রুক্ষ হয়ে যায়।

–তা যায়। তাতে কী?

মিলি মাঝে মাঝে ভ্রূ কোঁচকায়। ওটা ওর মুদ্রাদোষ। এখনও কোঁচকাল। বাইরের ঘরে দেয়ালজোড়া মস্ত এক শো-কেস। মিলির চোখ এখন সেই দিকে।

শো-কেসে দেখার কিছু নেই। কোথাও দেখার তেমন কিছু নেই। মানুষ তাই স্মৃতির মধ্যে ডুবে অতীতকে দেখতে থাকে। অতীত তার চারদিকে মিলেমিশে একাকার এক সময়হীন উলটোপালটা ছবি বিছিয়ে দেয়।

মিলিকে এই অবস্থায় রেখে তিথি চলে এল নীচে। বাথরুমে গিজার চালু করল। হট অ্যাণ্ড কোল্ড শাওয়ার তার খুব প্রিয়। তারপর পোশাক না-ছেড়েই সে বাবার ঘরখানা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল আনমনে। দেখার কিছুই নেই এবং বহুবার দেখা। তবু গত একমাস ধরে এঘরের নানা জিনিসে সে বাবাকে অনুভব করছে। এঘরে বাবার কোনো ছবি নেই। বিপ্লব দত্ত ফটো ভোলাতে ভালোবাসত না। আরও অপছন্দ করত ফোটোর ডিসপ্লে। বাবাকে মনে করার জন্যে অবশ্য তিথির কোনও ফোটোগ্রাফ দরকার নেই।

দুটো বুক কেস, একটা ওয়ার্ডরোব, একটা ডিভান, ছোটো হাফ সেক্রেটারিয়েট টেবিল এবং স্টিলের একখানা চেয়ার। মোটামুটি এই হল আসবাব। বিপ্লব দত্তের ডায়েরি লেখার কোনো অভ্যাস ছিল না। কিন্তু কয়েকটা ডায়েরি খুঁজে পেয়েছে তিথি। সেগুলির বেশির ভাগের মধ্যেই কিছু লেখা নেই। দু-একটা পাতায় কিছু মন্তব্য আছে। যেমন দু-বছর আগে একদিন তার বাবা লিখেছিল, ওঃ ইটস গোয়িং টু বি অ্যান অফুল ডে। গড। আরেকটাতে ছিল, আননোন। আরেকটাতে ছিল, অ্যাডিউ স্মোকিং।

সিগারেট ছাড়তে বিপ্লব দত্তের খুবই কষ্ট হয়েছিল, এটা বেশ মনে আছে তিথির। লবঙ্গ চিবিয়ে ছিবড়ে করে ফেলত আর ঝালের চোটে উঃ আঃ করত।

লোকটাকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মরবেই যদি তাহলে সিগারেট ছাড়লে কেন? তোমার কেন কোনও লাইফ প্ল্যানিং ছিল না?

স্নানের আগে কিছুক্ষণ যোগব্যায়াম। তিথি যন্ত্রের মতো তার আসনগুলো করে গেল। স্নান করল। পোশাক পরল। জিনস আর কামিজ।

সিঁড়িতে প্রবল পায়ের শব্দ তুলে তিথির ঘরে এসে হামলে পড়ল দু-জন। বুক্কা আর সঞ্চারি।

বুক্কা বলল, বাবার সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে?

তিথি গম্ভীর মুখে বলল, হ্যাঁ।

–দেখাবি?

 তিথি বের করে দিল।

বুক্কা তাদের তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত। একটু মোটাসোটা। খুব খেতে ভালোবাসে। বুক্কার সঙ্গে বাবার একটু আড়াআড়ি ছিল বরাবর। বুক্কা বাবার ছেলের চেয়েও বেশি মায়ের ছেলে। বুক্কার ভুবনজোড়া মা। এখনও সে মায়ের কোল ঘেঁষে শোয়। এখনও বায়না করে। বাবাকে ভয় পেত, একটু এড়িয়ে চলত।

সঞ্চারি আর তিথি দুই বোন। সঞ্চারি বড়ো, তিথি ছোটো। তিথি সকলের ছোটো। কিন্তু সঞ্চারির সঙ্গে তিথির কোনো মিল নেই। সঞ্চারি গৌর বর্ণের, তিথির রং মাজা। সঞ্চারি ঢলঢলে, তিথির চেহারা একটু রুক্ষ আর কেঠো। মনের মিলও দু-জনের বিশেষ নেই।

এবাড়ির কার সঙ্গেই বা তিথির মনের মিল? আজকাল তিথি কারো সঙ্গে তেমন কথা বলে না।

সঞ্চারি বুক্কার হাত থেকে নোটটা নিয়ে কুঁচকে দেখল। বলল, এর মানে কী?

তিথি বলল, তুই বুঝবি না।

-তুই বুঝেছিস?

তিথি সঞ্চারির দিকে একঝলক তাকাল। সে চোখে তাচ্ছিল্য। কথাটার জবাব দেওয়ার মানেই হয় না।

যদিও সঞ্চারি তিথির চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো তবু সে তিথিকে সমঝে চলে। একটু ভয়ও খায়। ভয় খায় বুক্কাও, দু-বছরের বড়ো, দখলদার এবং মাতব্বরি করার অধিকারসম্পন্ন দাদা হওয়া সত্ত্বেও। তিথি কারো সঙ্গে ঝগড়া কাজিয়া করে না, তর্কে যায় না, বেশি কথাও কয় না। তবু তিথিকে সবাই একটু এড়িয়ে চলতে চায়। চোখে চোখ রাখে না। তার মতামতকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুরুত্ব দেয়। তিথি জানে।

বুক্কা চেয়ারে বসল, সঞ্চারি আর তিথি বিছানায়। বিপ্লব দত্তের মৃত্যুজনিত শোক এবাড়ি থেকে একরকম বিদায় নিয়েছে। যা আছে তা একটু শূন্যতামাত্র। সময়ের প্রলেপ সেই ফাঁকটুকু ভরিয়ে দেয়।

সুইসাইড নোটটা বুক্কা টেবিলের ওপর আলগা রেখেছিল। চাপা দেয়নি। বাতাসে সেটা পালটি খেয়ে উড়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বুক্কাই সেটা ধরে ফেলল।

সঞ্চারি দু-হাঁটু তুলে দু-হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে বসা, জোড়া হাঁটুর ওপর তার থুতনি। বুক্কা বসেছে চেয়ারে হেলান দিয়ে, এলিয়ে, দু-পা সামনে ছড়িয়ে। তিথি পা মেঝেয় রেখে বিছানায় বসেছে সোজা হয়ে, যেন-বা সে এবাড়ির লোক নয়, অভ্যাগত মাত্র, এখনই চলে যাবে।

সঞ্চারি একদৃষ্টিতে তিথির দিকে চেয়েছিল। বলল, বাবা যে লিখেছে–লাইফ ওয়াজ অল ফান, ইট ইজ ফানিয়ার টু টেক ইট অ্যাওয়ে–একথা কেন লিখল বল তো! বেঁচে থাকাটা না-হয় ফান বোঝা গেল, কিন্তু মরাটা কি আরও মজার?

বুক্কা মাথা নেড়ে বলল, বাবা মোটেই মজা করার লোক ছিল না। ওরকম সিরিয়াস লোকের কাছে জীবনটা কখনোই ফান হতে পারে না। আমার কাছে বাবার এই সুইসাইড নোটটা খুব অদ্ভুত লাগছে। যেন এটা বাবার লেখাই নয়।

সঞ্চারি বিরক্ত হয়ে বললে, বাবার নয় তো কার লেখা? বাবার হাতের লেখা চিনিস না!

–চিনি। বাবারই লেখা। তবু মনে হচ্ছে এটা লিখবার সময় বাবা ঠিক বাবার মতো ছিল না। কিছু একটা ভর করেছিল বাবার ওপর।

সঞ্চারি তার ভ্রূ তুলে বলে, ভর! ভর মানে?

–হি ওয়াজ পজেজড বাই সামথিং।

–সেই সামথিংটা কী?

–আমি কী করে বলব? লেট আস ইনভেস্টিগেট। আমার মনে হয় তিথি বলতে পারে। শি ওয়াজ ক্লোজ টু হিম।

তিথির মুখ প্রতিদিনই সারাক্ষণ গম্ভীর থাকে। আজ আরও গম্ভীর। সে দাদা বা দিদির বেশির ভাগ কথারই জবাব দেয় না। বুক্কার একথারও জবাব দিল না। তবে তার মনে হল, কথাটা বুক্কা খুব মিথ্যে বলছে না। বাবার কাছে জীবনটা খুব মজার ছিল বলে তার তো মনে হয়নি কখনো। ই.এম.এস.-এর ইঞ্জিনিয়ার ছিল বিপ্লব দত্ত। একটু মিলিটারি ধাঁচ ছিল স্বভাবে। রিটায়ারমেন্টের অনেক আগেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিপ্লব দত্ত কনসালটেনসি খুলেছিল। তারপর থেকেই যেন আরও গুটিয়ে যাচ্ছিল নিজের মধ্যে। আর এই যে সংসারের সকলকে পাশ কাটিয়ে নীচের ঘরে একা ভূতগ্রস্তের মতো থাকা এটাও তার মজাদার জীবনের লক্ষণ তো নয়।

বুক্কা তিথির দিকে চেয়ে বলল, তুই এঘরে কী করে একা থাকিস বল তো তিথি, ইউ মাস্ট বি এ ভেরি ব্রেভ গার্ল। আমি তো সবসময়ে ফিল করি দেয়ার ইজ সাম স্পিরিট অর সামথিং ইন দিস হাউস।

সঞ্চারি ভাইয়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে বিরক্ত গলায় বলে, আবার ওসব কথা! বলেছি না ওটা সাইকোলজিক্যাল! কেউ মারা গেলে কিছুদিন ওরকম ফিলিং হয়।

বুক্কা মাথা নেড়ে বলে, মোটেই নয়। আই হিয়ার থিংস, আই সি থিংস।

তিথি সামান্য একটু হাসল। ইস্পাতের মতো হাসি। এ-বাড়ির সকলের কাছেই বাবা এখন ভূত! সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, তুই কি বাবার ভূতকে দেখেছিস?

বুক্কা একটু অস্বস্তিতে পড়ে বলে, ঠিক তা নয়। কিন্তু সামথিং। ঠিক বোঝানো যায় না। আজকাল মাঝে মাঝে আমার অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায়। তখন আই ফিল সামথিং। মনে হয় মশারির বাইরে কে যেন এসে দাঁড়িয়ে আমাকে একদৃষ্টে দেখছে। আমি বাথরুমে শব্দ শুনতে পাই, কে যেন বেসিনে মুখ ধুচ্ছে বা ফ্লাশ টানল। অথচ কেউ ওঠেনি অত রাতে।

তিথি দৃঢ়স্বরে বলে, বাবা তো দোতলার বাথরুম ব্যবহারই করত না। বাবা থাকত এঘরে, নীচে।

বুক্কা অসহায় গলায় বলে, সেটা কোনো যুক্তি নয়। আই ফিল এ ভেরি মিস্টিরিয়াস প্রেজেন্স অফ সামবডি।

সঞ্চারি ধমকের স্বরে বলে, তোর সামবডি আর সামথিং নিয়ে তুই থাক গে। বুদ্ধ কোথাকার!

তুইও তো ভয় পাস দিদি, বেশি বাহাদুরি দেখাতে হবে না। ব্রেভ হল তিথি। রিয়াল ব্রেভ।

আমি মোটেই ভয় পাই না। বাসন্তী ভয় পায় বলেই আমার কাছে এসে শোয়।

 তুই তো মাকেই বলেছিস যে তুইও এরকম কিছু ফিল করিস আজকাল।

সঞ্চারি চোখ পাকিয়ে কী বলতে যাচ্ছিল, তিথি উঠে পড়ে বলল, তোরা যদি ঝগড়া করিস তাহলে বরং আমি যাই।

বুক্কা সঙ্গেসঙ্গে গুটিয়ে গিয়ে বলে, ঝগড়া করছি না। এনিওয়ে বাবা, আমি স্বীকার করছি যে আমি ভীতু ছেলে। বাবার এই নোটটা পড়ে আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাবা শেষ সময়টায় খুব মজা পেয়েছিল। মরবার আগে খুব হো: হো: করে হেসে উঠেছিল নিশ্চয়ই।

সঞ্চারি চাপা গলায় বলল, ইডিয়ট। গাধা।

 বুক্কা তিথির দিকে চেয়ে করুণ গলায় বলে তাই মনে হচ্ছে নারে তিথি? তুই-ই বল।

তিথি মৃদু স্বরে বলল, সে-কথা বাবা ছাড়া কেউ বলতে পারে না।

বুক্কা তিথির দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, তুই একটা কথা সত্যি করে বলবি?

–কী কথা?

 –আমার মনে হয় বাবার ইনসিডেন্টটা সম্পর্কে একমাত্র তুই সব জানিস।

–আমি! আমি কী করে জানব?

 –বাবা তোকে খুব ভালোবাসত, তুইও বাবাকে।

–তাতে কী?

বাবা মরবার পর তোকে এসে সব বলে যায়।

তার মানে?

বুক্কা পরমবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, বাবার ঘোস্ট এবাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় কাউকে কিছু বলতে চায়। আর তুই এঘরে–ইন দি রুম দি ইনসিডেন্ট টুক প্লেস–একা থাকিস। আমার মনে হয় বাবা তোকে এসে সব বলে যায়।

সঞ্চারি চাবুকের মতো গলায় বলে, শাট আপ!

বুক্কা নির্বিকার মুখে বলে, তুই কী বলিস তিথি?

তিথি খুব উদাস মুখ করে বলে, বাবার আত্মা আমার কাছে কখনো আসেনি। ওসব আমি বিশ্বাস করি না।

তাহলে তুই এঘরে একা থাকিস কেন?

এমনি।

কিছু ফিল করিস না? কিছুই না।

ফিল করি। বাবাকেই ফিল করি। তবে সেটা ভূতকে নয়, লোকটাকেই।

তার মানে?

বাবার ক্যারেকটার, বাবার ইমপ্রেশন এঘরে ছড়িয়ে আছে। অ্যাটমসফিয়ার কিছু ক্যারি করে। আমি সেটাকেই ফিল করি। বাবার বিছানায় ঘুমোই, বাবার টেবিলে বসে লেখাপড়া করি, বাবার জিনিসপত্র ছুঁই, আর এভাবে বাবাকে ফিল করি। তার বেশি কিছু নয়।

–তুই ব্রেভ। দারুণ ব্রেভ।

সঞ্চারি ঈর্ষার চোখে তিথির দিকে চেয়েছিল। তিথি যে দারুণ সাহসী তাতে সন্দেহ নেই। এত সাহস তার নেই, এবাড়ির কারো নেই। হঠাৎ সঞ্চারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমাদের যে কী হবে?

বুক্কা তেমনি গা ছেড়ে এসে খুব নির্বিকার গলায় বলে, কী আর হবে। উই হ্যাভ বিকাম রিয়েল পুওর। দিদির বিয়ে হওয়ার চান্স নেই, আমার হায়ার এডুকেশন হবে না, তিথির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

তিথি একটু অবাক হয়ে বলে কীসব বলছিস?

বুক্কা তেমনি উদাস গলায় বলে, হু-হু বাবা, সব জানি। মার সঙ্গে মামার রোজ এসব নিয়ে ডিসকাশন হচ্ছে। দেয়ার ইজ নাথিং লেফট। বাবার ব্যাংকে তেমন টাকা ছিল না, ইনসিওরেন্স পলিসি যা আছে তা সামান্য টাকার। কোম্পানির কাগজটাগজও কিছু নেই। অলমোস্ট ব্যাংকরাপ্ট। থাকার মধ্যে আছে শুধু এই বাড়িটা।

সঞ্চারি উত্তেজিত হয়ে বলে, বাবার কনসালটেন্সি তো ছিল।

মামা সব খবর নিয়েছে। কনসালটেন্সি ভালো চলত না। অফিসের ভাড়া পর্যন্ত ক্লিয়ার নেই। উই হ্যাভ বিকাম ভেরি পুওর।

তিথি জানে বুক্কা মিথ্যে বলছে না। তার বাবার টাকার নেশা ছিল না, জমাতেও ভালোবাসত না। অনেকবার বলেছে, জমাব, কার জন্য? ছেলেপুলের জন্য? ওরা নিজেরা যদি উপার্জন করতে না-শেখে তাহলে ভুগবে। বাপের উপার্জনের ওপর নির্ভর করবে কেন?

বিপ্লব দত্ত টাকা খরচ করত জলের মতো। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। বিপ্লব দত্তের ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে প্রাচুর্যের মধ্যে। একটার জায়গায় চারটে পোশাক করে দিত বাবা। তাদের প্রত্যেকের পাঁচ-সাত জোড়া করে জুতো। ঘরে মেলা আসবাব।

সঞ্চারি আতঙ্কের চোখে চেয়েছিল ভাইয়ের দিকে, তুই সব শুনেছিস।

সব। আমার সামনেই তো কথা হয়।

সঞ্চারি হাঁটুতে মুখ গুঁজল। বুক্কা একটা অনির্দিষ্ট তাল বাজাল টেবিলে। তিথি সামান্য আনমনা হয়ে গেল।

.

০৩.

থলি থেকে বেড়াল বেরুলো আরও দু-মাস বাদে। সোমনাথ এসে এক ঝোড়ো বাদলা বাতাসের দিনে ওপরের ডাইনিং হল-এ বসল। পরনে একটু ভারি জামাকাপড়। বাইরে ঋতু বদলাচ্ছে। এই বাদলাবাতাস শীতের আগমনি গাইছে। এবার হয়তো শীতটাও পড়বে জেঁকে।

বেলা এগারোটা। এ সময়টায় রান্না-খাওয়া স্নান ইত্যাদির একটা ব্যস্ত সময়। শুধু মিলি দত্তের তেমন কোনো কাজ নেই। বিষণ্ণ মুখে মিলি একটা সাদা সোয়েটার বুনে তুলছে। খুবই সাদামাটা ডিজাইন। বরাবরই মিলি দত্তের এটা একটা প্রিয় কাজ। আসলে শখ। এই শখের জন্য এবাড়িতে সকলেরই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি একাধিক সোয়েটার আছে।

কী রে সোমনাথ, কোথা থেকে এলি?

ওফ, অনেক ঘুরে-টুরে। শোনো ছোড়দি, ব্যাপারটা হোপলেস।

 মিলি দত্ত যেন আরও একটু কুঁকড়ে গিয়ে বলে, কীরকম?

এবাড়িটার দরুন এখনও অনেক আউটস্ট্যাণ্ডিং লোন রয়ে গেছে। অফিসেও বিস্তর লায়াবিলিটিজ। তিনটে প্রোজেক্ট মার খেয়ে গেছে। পাওনাদার ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। অফিসের ভাড়া চার মাস বাকি। তুমি কি জান যে জামাইবাবু অফিসের জন্য একটা কম্পিউটার কিনেছিল?

কিছু তো বলত না আমাকে।

কিনেছিল। লোকটা কীভাবে টাকা উড়িয়েছিল ভাব একবার। কোনো মানে হয় মাত্র কয়েক লাখ টাকার টার্নওভারের জন্য একটা কম্পিউটার কেনার?

মিলি দত্ত উল বোনা থামিয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইল। সেই চেয়ে থাকার কোনো অর্থ নেই।

সোমনাথ দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, কোনো মানে হয় না, একদম মানে হয় না।

এখন আমরা কী করব?

দেনা মেটাতে হলে মিনিমাম তিন-চার লাখ টাকা এখনই দরকার। এ ছাড়া তো পথ নেই।

 তার মানে বাড়িটা বিক্রি করতেই হবে?

তোমার যা গয়না আছে তা দিয়ে তো হবে না। বাড়ি বিক্রি ছাড়া আর তো পথ দেখছি না।

সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু তিনটে বাচ্চা নিয়ে আমি কোথায় গিয়ে উঠব বল তো। সংসারই বা চলবে কী করে?

ওঠবার ভাবনা কী? আপাতত আমাদের কাছে। তারপর দেখা যাবে ধীরে-সুস্থে।

মিলি মাথা নাড়ল, ছেলে-মেয়েদের তুই চিনিস না। ওরা কোথাও যাবে না। কারো ডিপেণ্ডেন্ট হওয়া ওদের ধাতে নেই। বাপের স্বভাব পেয়েছে। ও আইডিয়া ছাড়তে হবে।

তাহলে কী করবে? তুমি সিচুয়েশনটা বুঝতে পারছ তো?

 মিলি নিষ্কল উল আর কাঁটায় ভুল ঘর তুলতে লাগল আনমনে। ভ্রূ কোঁচকানো। খুব স্তিমিত গলায় বলল, খুব পারছি। আমি এখন অগাধ জলে, এই তো!

বলতে গেলে তা-ই।

এবাড়ি বিক্রি করলে কত টাকা পাওয়া যাবে?

 ইট ডিপেণ্ডস। দশ থেকে পনেরো লাখ হয়তো।

 তার থেকে দেনা শোধ করলে কত থাকবে আমার হাতে?

খুব খারাপ নয়। যা থাকবে হিসেব করে চললে তোমার চলে যাবে। ঠিকমতো ইনভেস্ট করতে পারলে ভালোই চলবে। তবে এতটা ভালো নয়।

এছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই?

তোমার আর অ্যাসেট কোথায় ছোড়দি? কী দিয়ে দেনা শোধ করবে? শুধু বাড়িটার কথাই বলছি, কেননা বাড়িটা তোমার নামে। জামাইবাবুর নামে হলে সাকসেশন সার্টিফিকেট বের করতে জান বেরিয়ে যেত। আরও গাড্ডায় পড়ে যেতে। তোমার ভাগ্য ভালো, জামাইবাবু বাড়িটা তোমার নামে করেছিল। দি ওনলি ক্লেভার থিং হি এভার ডিড।

মিলি দত্তের হঠাৎ ভাইয়ের দিকে সোজা এবং কঠিন চোখে চেয়ে যেন ঝলসে উঠল, দেনা তো ওর, আমার তো নয়। কিন্তু বাড়িটা আমার। আমি যদি ওর দেনা শোধ করতে না-চাই?

সোমনাথ এবার একটু হাসল, স্বামী-স্ত্রীর অ্যাসেট আলাদা বলেই কি আর পার পাওয়া যায়? ওটা হয় না। তবু আমি উকিল নিয়ে আসব, কথা বলে দেখো। দেনা যদি শোধ করতে না-চাও তাহলেও বিপদ আছে। জামাইবাবু চড়া সুদেই লোন নিয়েছিল। যত দেরি করবে তত সুদ বাড়বে। আমার ধারণা ক্রিমিন্যাল কেস করলে আদালত এবাড়ি ক্রোক করবে। পাওনাদাররা খুব সহজ পাত্র তো নয়।

তারা কারা তা জানিস?

সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, সব জানি না। একটা হাউসিং লোন সোসাইটি আছে। ব্যাংক আছে।

মিলি দত্ত সোয়েটারে ভুল ঘর তুলে যেতে যেতেই বলে, আমাকে আর কয়েকটা দিন ভাববার সময় দে। মনে হচ্ছে বাড়িটা বিক্রিই করতে হবে। কত কষ্ট করে করেছিল বাড়িটা। এটা গেলে আমাদের আর কিছুই থাকবে না।

শোনো ছাড়দি, আমাকে ভিলেন বলে ভাবছ না তো! একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে নিজের বাড়ি কীরকম সেন্টিমেন্টের জিনিস হয় তা কিন্তু আমি জানি। অন্য কোনও পথ খোলা নেই বলে বিক্রির কথা বলছি। ভিলেনের মতো শোনালেও আসলে আমি যা বলছি তা প্র্যাকটিক্যাল। তোমার বাড়ি তুমি বিক্রি করবে কিনা ভেবে দেখো ভালো করে। সময় যত খুশি নাও, কিন্তু সেটা যেন লিমিট ছাড়িয়ে না-যায়।

মিলি দত্ত কাঁটা আর উল রেখে দু-হাতে মুখ চাপা দিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর যেন আরও গুটিসুটি মেরে ছোটো হয়ে গিয়ে বলে, ছেলে-মেয়েদের বলি। ওদেরও তো একটা মতামত আছে।

ওদের মত একটাই হবে। ওরা এবাড়ি বিক্রি করা পছন্দ করবে না। যাক গে, তবু ওদেরও বলল। একজন ভালো উকিল ডেকে কথা বলো।

তুই রাগ করছিস না তো।

সোমনাথ হাসল, না ছোড়দি, রাগ করছি না। তোমার সেন্টিমেন্ট আমি বুঝতে পারি। শুধু ডিসিশনটা তাড়াতাড়ি নিতে বলছি।

সেদিন বিকেলেও ঝড়-জল সমানে চলল। ফোন ডেড। লোডশেডিং। মিলি দত্ত পাশের মুখার্জিবাড়ি থেকে একটা ফোন করল বিপ্লব দত্তর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তরণী সেনকে। অনেকদিন আগে তরণী বিপ্লবের বিজনেস প্ল্যানিং করে দিয়েছিল। তরণী এখন খুব নামজাদা ইনকাম ট্যাক্স প্র্যাকটিশনার এবং অডিটার। প্রায়ই হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ায়। মিলির কাছে সব শুনে বলল, হ্যাঁ মিলি, এসব ক্ষেত্রে অ্যাসেট রেখে লাভ নেই। বিপ্লবটা যে আপনাদের ডুবিয়ে দিয়ে গেছে তা আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারি।

করুণ গলায় মিলি বলে, অ্যাসেট বলতে শুধুই তো বাড়িখানা। আর কিছুই তো আমাদের নেই।

তরণী সান্ত্বনার গলায় বলে, বুঝতে পারছি। তবে সল্টলেক-এ দোতলা বাড়ি, ভালো দাম পাবেন। সে টাকায় অন্য কোথাও একটা ছোটোখাটো ফ্ল্যাট হয়ে গিয়েও হাতে বেশ কিছু টাকা থাকবে। চান তো আমি সে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

মিলি বুঝল, ওই সিদ্ধান্তই একমাত্র খোলা পথ। বাড়ি বিক্রি করা।

রাতে খাওয়ার পর বসবার ঘরে ছেলে-মেয়েদের মুখোমুখি হল মিলি, শোনো, তোমাদের বাবার অনেক ধারদেনা রয়েছে। আমাদের হাতেও ক্যাশ টাকা বিশেষ নেই। সবাই বলছে বাড়ি বিক্রি করে দিতে।

শুনে কেউ চমকাল না। মনে হয়, ওরা আড়াল থেকে কিছু আঁচ আগেই করেছে। তবে মুখগুলো খুব গম্ভীর আর থমথমে দেখাল। সঞ্চারির চোখে টলটল করছে জল। তিনজনের মধ্যে ওই সব চেয়ে নরম।

মিলির চোখে জল নেই বটে, কিন্তু তারও কান্না পাথর হয়ে আছে বুকের মধ্যে। শুকনো গলায় মিলি বলল, তোমাদের আগে থেকেই জানিয়ে রাখলাম। কষ্টের জন্য তৈরি হও।

হঠাৎ তিথি বলল, বাবা এই বাড়িতেই মারা গেছে।

মিলি অবাক হয়ে বলে, তাতে কী হল?

তিথি হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যেন জেগে উঠে বলল, কিছু নয়। জাস্ট সেন্টিমেন্ট।

 মিলি অনুত্তেজিত গলায় বলে, আমাদের সেন্টিমেন্ট আর মানায় না। খুবই খারাপ অবস্থায় আমাদের রেখে গেছেন তোমাদের বাবা। এবাড়ি ছাড়তে আমারও যে কত কষ্ট হবে তা তোমরা বুঝতেই পারছ। কিন্তু উপায় কিছু নেই।

বিপ্লব দত্তের তিন ছেলে-মেয়ে কেমন যেন ঘাড় শক্ত করে, কাঠ হয়ে, গোঁজ হয়ে বসে রইল। কেউ কিছু বলল না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, প্রস্তাবটা তাদের মনঃপূত নয়।

মিলির ভিতরটা টনটন করছিল অনেকক্ষণ। ছেলে-মেয়েদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ পিতৃহারা এই তিন অসহায় সন্তানের জন্য এবং কে জানে আর কোন কারণে হঠাৎ তার দু-চোখ ফেটে জল এল। বাড়ি। বাড়ি মানে কি শুধু ইট কাঠ পাথর? বাড়ি মানে সকলে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকা নয়? এবাড়ি কবেই তাদের আত্মীয় হয়ে গেছে। সঞ্চারি, বুক্কা, তিথি, বিপ্লব যেমন অনেকটা তেমনি। মিলি কাঁদতে লাগল। নিঃশব্দে উঠে চলে গেল তিন ছেলে-মেয়ে। তার অদ্ভুত অনাত্মীয় সন্তানেরা।

.

০৪.

বাড়ির হবু খদ্দেররা আসতে শুরু করল ঠিক তিন দিন বাদে। চনচনে শীত আর খরশান রোদ আর শনশনে উত্তুরে হাওয়া এক রবিবারের সকালকে যখন মোহগ্রস্ত করে তুলছে তখন সল্টলেকের এই নির্জনতর রাস্তায় বাড়ির সামনে একটি নতুন লাল মারুতি এসে থামল। নামল অবাঙালি এক স্বামী আর স্ত্রী। দু-জনেই কিছু মোটাসোটা। বয়স ত্রিশের কোঠায়। তাদের পোশাক আর চেহারা দুই-ই ঐশ্বর্যের আভা বিকিরণ করছিল। যথেষ্ট বিনয়ী, শিষ্টাচারসম্পন্ন, মৃদুভাষী এবং গম্ভীর স্বামী আর স্ত্রীকে ফটকের কাছে রিসিভ করল সোমনাথ। তার মুখে আপ্যায়নের অর্থহীন বিগলিত হাসি।

কোন অজ্ঞাত কারণে ছুটির দিনে আজকাল তিন ভাই-বোন একজোট হয় তাদের মৃত বাবার ঘরে। সেখান থেকে তারা তিনটে রন্ধ্রপথে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে চেয়ে থাকে। দুটো জানালায় দুই বোন, দরজায় বুক্কা।

বুক্কাই চাপা গলায় বলে উঠল, ক্লায়েন্ট। ক্লায়েন্ট!

শুনে ছুটে এল সঞ্চারি। তিথি ধীর পায়ে এসে কপাটের পাশে দাঁড়াল।

পুরুষটি বেশ লম্বা, পরনে হালকা ক্রিম রঙের সাফারি সুট। গায়ে একটু বেশি চর্বি থাকায় বোধহয় লোকটার শীতবোধ কম। এই শীতেও তাই গায়ে কোনো গরম জামা নেই। তবে সাফারি সুটটা গরম কাপড়ের হতেও পারে। ভুড়িটি যথেষ্ট নজরে পড়ার মতো। ভদ্রমহিলার গায়ে একখানা খুব সূক্ষ্ম সুতোর কাজ করা শাল, যার একটা আঁচল ধুলোয় লুটোচ্ছে। কেউই ব্যগ্র নয় বাড়ি দেখতে। ভঙ্গি কিছুটা ক্যাজুয়্যাল। বড়োলোকদের ঠিক এরকমই হওয়ার কথা। বিষয়বস্তু দেখে দেখে তাদের চোখ পাকা এবং উদাস।

বুক্কা বলল, ওরা নিশ্চয়ই বাড়িটা ঘুরে দেখবে!

সঞ্চারি বলে, দেখতেই তো এসেছে। পছন্দ হবে?

হবে না! কেমন বাড়ি আমাদের! দক্ষিণ খোলা, এত আলো বাতাস, কতগুলো ঘর, দুটো ব্যালকনি, বাগান! তার ওপর সার্ভেন্টস কোয়ার্টার।

বুক্কা শুধু গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলে, এভরিথিং এ ম্যান ক্যান ওয়ান্ট ফ্রম এ হাউস। কত দাম দেবে বল তো! ফিফটিন ল্যাকস?

কে জানে বাবা! অত টাকা জন্মেও দেখিনি। বাবার কাছে শুনেছি বাড়িটা করতে লাখ চারেক টাকা খরচ হয়েছিল।

তখন টাকার দাম বেশি ছিল। তাই খরচ হয়েছিল কম।

কোকিলটা কি তার শেষ ডাক ডাকছে? উৎকর্ণ হয়ে শুনছিল তিথি। খুব ডাকছে আজ। গলার রক্ত তুলে ডাকছে যেন।

হঠাৎ বুক্কা তার দিকে ফিরে বলে, মার ঠিক কত টাকা দরকার বল তো।

 তিথি ঠোঁট উলটে বলে, কে জানে।

–আমার পিগি ব্যাংকে কিছু আছে। আর দুটো আংটি। আর টেনিস র‍্যাকেট। তোদের কী আছে? দিদিরও পিগি ব্যাংক আছে, ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্টও।

-হ্যাঁ। কেন?

–যদি সব আমরা মাকে দিয়ে দিই?

–তাহলেও হবে না। আমাদের দেনা কয়েক লাখ টাকার।

–ওঃ, কেউ যদি দিত, টাকাটা এমনিতেই।

—কে দেবে? আমাদের কেউ নেই।

সোমনাথের পিছু পিছু আগন্তুক হবু ক্রেতা সস্ত্রীক দোতলায় উঠে গেল।

মান্য অতিথিরা আসবে বলে আজ একটু সেজেগুজে তৈরি ছিল মিলি। পরনে সবুজ সিল্কের শাড়ি, চুল পরিপাটি খোঁপায় বাঁধা, মুখে সামান্য প্রসাধন। গায়ে একখানা সবুজ শাল জড়ানো। আগন্তুক পুরুষটি বোধহয় দেশে ও বিদেশে সুন্দরী মেয়ে অনেক দেখেছে, তবু এই ছোটোখাটো মহিলার প্রখর সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়ে একটু থমকাল। যেন প্রত্যাশিত ছিল না। মিলি বাংলাতেই বলে, এই আমাদের বাড়ি। অনেক কষ্ট করে করা। দেখুন যদি পছন্দ হয়।

মিলির গলায় কোনো উৎসাহ নেই, মুখে দীপ্তি নেই। বিষয়ী পুরুষটি তত সূক্ষ্ম বোধসম্পন্ন নয় যে এইসব লক্ষ ও অনুধাবন করবে। এই বাড়ির জড় শরীরে কতখানি ভালোবাসা আর মায়া ঢুকে আছে তা বুঝবার মতো বুঝদার কে-ই বা আছে?

বাসন্তী কফি নিয়ে এল, ঠিক যেমন শেখানো ছিল, ওরা সোফায় বসবার ঠিক দু-মিনিটের মাথায়।

লোকটা কম কথার মানুষ। কফির সুদৃশ্য চীনা ডৌলের পেয়ালাটির দিকে একবার মাত্র উদাস দৃষ্টিক্ষেপ করে বেশ নরম গলায় বলল, আই নো ইটস এ গুড হাউস। ইউ বিল্ট ইট ফর ইয়োরসেলফ।

বলে নিজের স্ত্রীর দিকে একবার তাকাল। তারপর একটু উদাস হয়ে গেল।

সোমনাথ তদগতভাবে লোকটির মুখপানে চেয়েছিল। বলল, ইটস রিয়েলি এ গুড হাউস। অল ফার্স্টক্লাস হ্যাণ্ডপিকড ফিটিংস।

দোকানদারেরা যেভাবে নিজের জিনিসের গুণ গায় সোমনাথের গলাটা অবিকল সেরকম শোনালো মিলির কানে। মনে মনে সে বিরক্ত হচ্ছে। অস্থির করছে তার বুকটা। অভিমানে ভরে যাচ্ছে সর্ব অঙ্গ। চোখে জল আসছে।

মহিলা উঠল। মুখে বিনয়ী হাসি। নাকে হিরের নাকছাবি সামান্য ঝিকিয়ে উঠল। বলল, আপনার বাড়িটা একটু ঘুরে দেখব?

মিলিকে জড়তা কাটিয়ে উঠতে হল।

মহিলা নিষ্ঠাবতী। পায়ের দামি চপ্পলজোড়া ছেড়ে রেখে বলল, আপনার ঠাকুরঘরটা কোথায়? আগে প্রণাম করব।

ঠাকুরঘর! মিলি অসহায়ভাবে চারদিকে একবার চেয়ে দেখে বলল, ঠাকুরঘর তো নেই!

মহিলা একটু যেন অবাক হয়ে বলে, ঠাকুরঘর নেই? আপনারা হিন্দু নন?

মিলি তাড়াতাড়ি বলে, হ্যাঁ, তবে ঠাকুরঘর তো করা হয়নি।

মহিলা হেসে বলে, নাস্তিক? বাঙালিরা খুব নাস্তিক হয়।

–না। আমরা ঠিক নাস্তিকও নই। আসলে ওসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

মহিলার মুখশ্রী থেকে বিনয়ের ভাবটা গেল না বটে, তবে যেন একটু হতাশার ভাব যুক্ত হল।

বাড়ি দেখানোর কোনো উৎসাহ ছিল না মিলির। নিঃশব্দে শুধু ঘর থেকে ঘরে, ব্যালকনিতে, ছাদে হেঁটে হেঁটে সঙ্গ দিল। কিছুই ব্যাখ্যা করল না, বাড়ির গুণকীর্তন করল না।

নীচের ঘরে এসে মহিলা বলে, এরা আপনার ছেলে-মেয়ে?

 তিন গম্ভীর, বিষণ্ণ, শক্ত হয়ে থাকা কিশোর-কিশোরীর দিকে চেয়ে মিলি বলে, হ্যাঁ।

–আর এই ঘরেই তো–?

 মিলি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

স্যাড।

ওপরের ঘরে এসে দেখা গেল, সোমনাথ নীচু স্বরে কিছু বলছে। লোকটা আনমনে অবহেলাভরে শুনছে। কফি ছোঁয়নি।

দিদিকে দেখে সোমনাথ উঠে এল। কানের কাছে মুখ এনে সামান্য উত্তেজিত গলায় ফিসফিস করে বলল, দশ লাখ অফার করেছে।

বাড়ি ভালো করে না দেখেই?

ওদের জহুরির চোখ। তাছাড়া এবাড়ি রাখবে নাকি? দেয়ার উইল বি টোটাল রিকনস্ট্রাকশন অ্যাণ্ড রিনোভেশনস। ওরা খুব ফাস্টিডিয়াস।

মিলি একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল। দশ লাখ অনেক টাকা, তবু তার বিমর্ষতা দশ লাখে কাটছে না। কত লাখে কাটবে তা বলা কঠিন।

সোমনাথ গলাটা আরও নামিয়ে বলল, কলকাতায় ওর আরও ছ-খানা বাড়ি আছে। বাড়ি আছে প্যারিস, লণ্ডন, নিউ ইয়র্ক আর সানফ্রানসিসকোয়। এবাড়ি ফেলেই রাখবে ধরে নিতে পারিস।

ফেলে রাখবে! খুব অবাক হয়ে বলে মিলি, ফেলে রাখবে কেন?

স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই সামান্য কয়েকটা কথা সেরে নিল নিজেদের মধ্যে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অতিভদ্র গলায় বলল, নমস্তে জী।

শশব্যস্ত সোমনাথ ওদের এগিয়ে দিতে গেল। বোধহয় ব্যস্ত মানুষটি বেশি সময় দিলে না সোমনাথকে। সোমনাথ মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে এসে বলল, ভালো অফার। তাই না?

মিলি সোফায় বসে কিছু ভাবছিল। বলল, ওরা এ-বাড়িতে থাকবে না কেন?

ক-টা বাড়িতে থাকবে? বললুম না ছ-খানা বাড়ি আছে। বালিগঞ্জেই দুটো। নিউ আলিপুরে, পার্ক সার্কাসে, শ্যামবাজারে আর আলিপুরে আরও চারটে। এর মধ্যে অবশ্য তিনটে অ্যাপার্টমেন্ট। শুধু সল্টলেক-এ ছিল না, তাই কিনছে।

তাহলে কারা থাকবে এখানে?

 কেয়ারটেকার থাকবে বোধহয়। দুটো ছেলে, দু-জনেই আমেরিকায়। স্কুলে পড়ছে।

তাহলে এক কাজ করুক না কেন, বাড়িটা কিনে নিয়ে ফের আমাদেরই থাকতে দিক। আমরাই কেয়ারটেকার হয়ে যাব।

সোমনাথ এটাকে রসিকতা হিসেবে নিয়ে হাসল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, এ ব্যাপারে ভীষণ কড়া। বলল, দশ লাখ টাকা পেমেন্ট করার সঙ্গেসঙ্গেই একদম ভ্যাকান্ট বাড়ি চাই। টাকা যখন চাই তখনই দিতে রাজি, কিন্তু বাড়ি ভ্যাকেন্ট করতে হবে সঙ্গেসঙ্গে।

বা:, টাকাটা পেয়ে তবে তো আমরা একটা ফ্ল্যাট-ট্যাট কিনব, তার আগে যাব কোথায়? এত জিনিসপত্রেরই বা কী হবে? ওরা সময় দেবে না একটু?

সোমনাথ মাথা নেড়ে বলে, একটুও না। ওটাই ভদ্রলোকের একমাত্র কণ্ডিশন।

তুই বুঝিয়ে বললি না?

 বলেছি। কিন্তু ভদ্রলোক ওই একটা ব্যাপারে ভীষণ রিজিড।

মিলি চুপ করে রইল। তারপর বলল, বাড়িটা কি সত্যিই ভেঙে ফেলবে বলল?

 সবটা ভাঙবে না। তবে ভাঙচুর কিছু হবেই।

এত সুন্দর বাড়িটা ভাঙবে?

হয়তো আরও সুন্দর হবে। তুই ভাবছিস কেন? বাড়ি ছেড়ে দিলে এটা তো আর তোর বাড়ি থাকবে না।

মিলি অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ ঝাঁঝের গলায় বলে, এটা বরাবরই আমার বাড়িই থাকবে। হাতবদল হলেও।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়