রাতে খাওয়ার টেবিলে বুক্কা বলল, তিথি একটা কোম্পানির মালিক, আমাদের এ ঘটনাটা সেলিব্রেট করা উচিত মা।

মিলি তার স্থায়ী কোঁচকানো ভ্রূ তুলে বলে, সেলিব্রেট। আমাদের সেলিব্রেট করার মতো কিছু তো নয়? কে কোম্পানি চালাবে? বাড়িওয়ালা নাকি মামলা করবে। অনেকদিনের ভাড়া বাকি।

সঞ্চারি বলল, দেয়ার ইজ হোপ এগেনস্ট হোপ। আমাদের তিন ভাইবোন যদি একসঙ্গে চেষ্টা করি?

মিলি কঠিন চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে বলে, আর পড়াশুনো?

বুক্কা বলে, পড়াশুনো করে কী হবে মা? আগে তো আমাদের সারভাইভাল।

 মিলি বলে, আমাদের চলে যাবে। বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলে ঠিক চলে যাবে।

 বজ্রাঘাতের ইচ্ছে ছিল না তিথির। কিন্তু তবু কথাটা না-বলেও পারল না, বাড়ি বিক্রি হবে না মা। এ বাড়ি মর্টগেজে আছে।

 মর্টগেজ! তোকে কে বলল?

আছে মা। আমি খবর পেয়েছি। সেইজন্যই ওরিজিন্যাল দলিল আমাদের কাছে নেই।

 তোর বাবা তো কখনো আমাকে বলেনি সে-কথা!

হয়তো তোমাকে দুঃখ দিতে চায়নি। হয়তো ভেবেছিল, টাকা শোধ দিয়ে মর্টগেজ ছাড়িয়ে নেবে।

উঃ, আর কত ভোগ বাকি আছে বল তো! তাহলে এখন কী হবে?

কী হবে তা কেউ জানে না। তিথি একটু চুপ থেকে আস্তে করে বলল, ভাবছ কেন? কিছু একটা আমরা করবই।

কী করবি সেটাই জানতে চাইছি।

 জানি না মা। এত তাড়াতাড়ি কি সব ঠিক করে ফেলা যায়?

বাড়ি কার কাছে মর্টগেজ আছে তা জানিস?

জানি। সেইদিন অমিত গুহ বলে যে ছেলেটি এসেছিল ওদের কাছে।

 তোকে কে বলল?

অফিসে রেকর্ড আছে।

 কত টাকার মর্টগেজ?

 সব তোমাকে বলব মা। এখনও অনেক কিছু দেখতে হবে, জানতে হবে।

বুক্কা বলল, লড়তেও হবে। উই শ্যাল ফাইট।

মিলি চুপ করে রইল। সম্ভবত সে ধূসর চোখে তার দাম্পত্য জীবনটা আগাগোড়া দেখতে চাইছিল। একজন খেয়ালি, দায়িত্বজ্ঞানহীন, ঢিলা-প্রকৃতির মানুষ। কেন লোকে কবিতা পড়ে তা ভেবে পায় না মিলি। অকাজের কাজ। বিপ্লব কবিতা পড়ত।

.

১০.

দুবাই! দুবাই! মিডল ইস্ট! পশ্চিম এশিয়া! মরুভূমি! উট! আঙুর! আজান! তেল! টাকা! কেন দুবাই যায় লোকে? এবং ফেরার ঠিক থাকে না?

বাবার অফিসঘরে এসে রোজই বসে তিথি। মাঝে মাঝে তিন ভাই-বোন আসে। মামা আসছে। মা আসছে। কিন্তু কী করতে হবে তা তারা কেউ ভালো বুঝতে পারছে না। ইয়ুল টমসন কোম্পানি অবশ্য একটা চেক দিয়েছে নব্বই হাজার টাকার। গাঁইগুঁই করেনি। আর একটা কোম্পানি বলেছে, সাত দিনের মধ্যে দেবে। বাড়িওলাকে আপাতত ঠেকানো গেছে।

আজ তিথি কম্পিউটার নিয়ে বসেছিল। তার চোখ ফেটে জল আসছিল। সে কম্পিউটারকে ভেদ করবে কী করে? তাকে তো কেউ শেখায়নি? এ কোম্পানিই বা চালাবে কী করে সে? সে চালানোর জন্য দরকার ইঞ্জিনিয়ার, দরকার ভালো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, কো অর্ডিনেশন। তারা সবাই মিলেও মাথামুন্ডু কিছুই স্থির করতে পারছে না, আর লোকটা দুবাই গিয়ে বসে আছে। রোজ অমিতের বাড়িতে ফোন করছে তিথি আর শুনতে পাচ্ছে, দুবাই! দুবাই! ওই শব্দটাই এখন শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। দুবাই যায় কেন লোকে?

একদিন ফোন করতেই একটা মেয়ে ধরল।

আপনি কি অমিতবাবুর স্ত্রী?

 স্ত্রী! অমিতের আবার স্ত্রী হল কবে?

মানে আপনি কি ওঁর কেউ হন?

আমি ওর ছোটো পিসি। আপনি কে?

আমি দত্ত রিলায়েনসের একজন পার্টনার। ওঁকে ভীষণ দরকার।

 কবে ফিরবে ঠিক নেই। এলে খবর দেব।

ফোন রাখার পর তিথির শুধু খটকা হতে লাগল, অমিতের আবার স্ত্রী হল কবে থেকে? এ কথাটার মানে কী অমিত গুহ বিয়ে করেনি! অসম্ভব। নিশ্চয়ই বিয়ে করেছে এবং ছেলেপুলে আছে।

দু-দিন পর সে আবার টেলিফোন করল, আচ্ছা অমিতবাবুর স্ত্রী কি বাড়িতে আছেন?

একটা হেঁড়ে গলা বলে, অমিতের স্ত্রী! কীসব বলছেন। সে তো বিয়েই করেনি! আপনি কে বলছেন?

আমি দত্ত রিলায়েন্সের পার্টনার তিথি দত্ত।

 ওঃ হ্যাঁ, আপনি তো প্রায়ই ওকে টেলিফোনে খুঁজছেন। কী দরকার বলুন তো!

একটা অফিসিয়াল ব্যাপারে ওঁর একটু হেল্প

আমরা আশা করছি দু-চার দিনে এসে যাবে। আপনাকে ও কী হেল্প করছে বলুন তো! আমি ওর কাকা।

আমাদের বিজনেসের ব্যাপারে আমি ওঁর পরামর্শ নিচ্ছি।

আপনি কি বিপ্লব দত্তের মেয়ে?

হ্যাঁ।

অ। আপনাদের নামে তো একটা নোটিস যাচ্ছে।

নোটিশ! কীসের নোটিশ?

একটা লোনের ব্যাপারে।

হ্যাঁ, জানি।

 গত তিন দিন ফোন করেনি তিথি। রোজই অবশ্য তীব্র ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু করেনি। অমিতের বাড়ির লোকেরা তার গলা চিনে ফেলেছে। ফোন করলেই ভাববে আবার ওই মেয়েটা জ্বালাচ্ছে।

তিথি কম্পিউটারের অন্ধকার পর্দার দিকে চেয়ে বসে আছে। ভাবছে। বা কিছুই ভাবছে না। ইচ্ছে করে নয়। মাথার ভিতর দিয়ে হু-হু করে এলোমেলো চিন্তারাশি মেঘের মতো ভেসে যাচ্ছে।

দরজায় একটা টোকা পড়ল। বোধহয় বুক্কা বা সঞ্চারি। কিন্তু মনটা টিকটিক করে উঠল, চলকে উঠল। যদি সে হয়!

দরজা খুলে সে দেখল, সে-ই।

 কেন যে অভিমানে তার ঠোঁট কেঁপে উঠল কে জানে! শ্বাস আটকে আসছে, গলা আটকে আসছে, স্খলিত কণ্ঠে সে শুধু বলল, এত দেরি হল কেন?

অমিত অবাক হয়ে তিথির দিকে চেয়ে বলল, আরে! তুমি ওরকম করছ কেন? কাঁদবে নাকি? আরে…

অমিত ভারি বিব্রত হয়ে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে অসহায় ভাব প্রকাশ করল। ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, এত জরুরি তলব কীসের জন্য বলো তো! কী এমন বিপদ হল তোমার?

ততক্ষণে তিথি টেবিলে মুখ নামিয়ে হাতের আড়ালে অঝোরে চোখের জল ফেলছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর!

কী মুশকিল। মেয়েটা কাঁদে কেন? এনিথিং রং?

কোনো জবাব না-পেয়ে অগত্যা একটা চেয়ারে বসে নীরবে অপেক্ষা করতে লাগল অমিত। সে কাজের মানুষ। মেয়েদের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের অবকাশই হয় না। এ মেয়েটার নতুন কোনো বিপদ হল নাকি? তাহলে সেটা বলছে না কেন? ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগল সে। গলা খাঁকারি দিল বার কয়েক। অস্ফুট স্বরে বার দুই বলে উঠল, কী মুশকিল!

অবশেষে তিথি মুখ তুলল, বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর যেমন হয় চরাচর, তেমনই স্নিগ্ধ সজল মুখ। কান্নার কিছু উপকারের দিকও আছে হয়তো।

অমিত একটু উদবেগের গলায় বলে, কী হয়েছে বলবে তো!

–কিছু হয়নি। আপনি এত দেরি করলেন কেন?

অবাক অমিত বলে, আমার তাড়াতাড়ি ফেরার কথা ছিল নাকি? আর আমার দেরি হল বলে তুমি–। ওফ, বাড়িতে পা দেওয়া মাত্র যার সঙ্গে দেখা হয় সে-ই বলে, ওরে অমিত, দত্ত রিলায়েন্সের মেয়ে পার্টনার ফোন করছিল, ভীষণ নাকি জরুরি দরকার! পিসি তো রীতিমতো জেরা শুরু করে দিল, বয়স কত, দেখতে কেমন ইত্যাদি। কী বিপদ বলো তো! রোজ ফোন করতে নাকি?

লজ্জায় মাথা নামিয়ে তিথি বলে, করতাম।

অমিত কী বুঝল কে জানে, তবে হালছাড়া ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলে, যাকগে, শোনো। তোমাদের প্রবলেমটা নিয়ে আমি অনেক চিন্তাভাবনা করেছি। দেখলাম, তোমাদের পক্ষে দত্ত রিলায়েন্স চালানো অসম্ভব। তোমাদের টেকনিক্যাল নো-হাউ নেই। যদি রাজি থাকো তাহলে আমরা এ কোম্পানিটা কিনে নিতে পারি।

কিনে নেবেন?

উইথ অল অ্যাসেটস অ্যাণ্ড লায়াবিলিটিজ। এটার বদলে তোমাদের বাড়ির লোনটা ছেড়ে দেওয়া হবে।

অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে তিথি বলে, কী বলছেন!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অমিত বলে, এর জন্য বাবা কাকা জ্যাঠার সঙ্গে তুমুল হয়ে গেছে আমার। তবে শেষ অবধি দে এগ্রিড।

আমাদের বাড়ি ছাড়তে হবে না তাহলে?

অমিত হাসল, না। তবে তুমিও আর দত্ত রিলায়েন্সের মালিক থাকবে না। ঠিক আছে?

তিথি মাথা নেড়ে বলল, ঠিক নেই। আপনি দয়া করছেন।

বেশ পাকা হয়েছ তো। দয়া নয়, দত্ত রিলায়েন্স খুব সিংকিং কনসার্ন নয়। কম্পিউটারের তথ্য বলছে, কিছু অ্যাসেট এখানে-সেখানে আছে। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে একটা কনসিডারেল অ্যামাউন্ট দাঁড়াতেও পারে। এগুলো রিয়ালাইজ করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের পাওয়ারফুল অর্গানাইজেশন কতৃত্ব হাতে নিলে সেটা অনায়াসে পারবে। কাজেই দয়া বলে ভাববার কিছু নেই। ইটস এ সিম্পল বার্টার।

আমি একটা নব্বই হাজার টাকার চেক পেয়েছি। কী করব?

আমরা কোম্পানি পারচেজ করার আগে তুমি যা পাবে তা তোমার। আমরা পুরোনো পেমেন্ট দাবি করব না। সেরকম নিয়ম নেই।

আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না। মিথ্যুক। এটাও দয়া।

মোটেই নয়। অমিত গম্ভীর হয়ে বলে, ইন ফ্যাক্ট আরও দু-একটা মোটা পেমেন্ট তুমি কয়েকদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবে। ব্যাংকে জমা করে দিও। আজ চলি, অনেক কাজ আছে।

অমিত উঠে পড়ল। দরজা খুলল।

তিথি তার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে বলল, আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইওর মানি।

বিরক্ত অমিত বলে, তাহলে কী চাও?

দাঁতে দাঁত পিষে চোদ্দো বছরের কিশোরী তিথি তীব্র চাপা স্বরে বলল, আই, ওয়ান্ট ইউ! ইউ! ইউ!

হোয়াট! বলে প্রকান্ড হাঁ করে চেয়ে রইল অমিত।

দরজাটা সজোরে তার মুখের ওপর বন্ধ করে দিল তিথি। তারপর হাসতে লাগল খিলখিল করে একা ঘরে। পর মুহূর্তেই চোখে জল এল।

পাগল! পাগল! সে কী পাগল!

.

১১.

বাড়ির টেলিফোন ঠিক হয়ে গেছে দু-দিন হল। একটু রাতের দিকে তিথি ফোনটা করল কয়েকদিন পর।

আমি তিথি।

মাই গড! চোদ্দো বছরের মেয়ে!

 প্রায় পনেরো। আমি একটা কথা জানতে চাই।

 কী কথা?

উইল ইউ বি ওয়েটিং ফর মি?

আরে পাগল। আমার বয়স কত জান?

উইল ইউ বি ওয়েটিং?

তোমার এটা হল বেড়ে ওঠার বয়স। হাসো, ফুর্তি করো, লেখাপড়া, নাচগান, খেলাধুলো এই সব নিয়ে থাকো। দেখবে ওসব ভাবাবেগ কেটে যাবে।

উইল ইউ বি ওয়েটিং ফর মি?

শোনো তিথি, তোমার সামনে, বিচিত্র জীবন পড়ে আছে। লাইফ ইজ ভেরি ইন্টারেস্টিং! এখনও তো শাড়িও ধরোনি তুমি। কত কী হওয়ার আছে, জানার আছে, পাওয়ার আছে জীবনে।

উইল ইউ বি ওয়েটিং?

ইয়ে মানে, উঃ, তোমাকে নিয়ে একদম পারা যায় না। খুব দুষ্টু মেয়ে তো!

উইল ইউ বি ওয়েটিং?

 আচ্ছা, সেটা দেখা যাবে। এখন লেখাপড়ায় মন দাও। নাচ শেখো না কেন? তুমি ভালো দৌড়োও না? খুব ভালো। দৌড়োও, নাচো, গাও।

উইল ইউ বি ওয়েটিং?

আচ্ছা মুশকিল। এটুকু বয়সে এখনই কেন–?

 উইল ইউ বি ওয়েটিং?

আচ্ছা, আচ্ছা বাবা, আচ্ছা।

ওভাবে নয়। আরও ভালো ভাবে। আবার জিজ্ঞেস করছি, উইল ইউ বি ওয়েটিং?

অমিত একটু চুপ করে থাকে। তারপর সামান্য নরম গলায় বলে, আই উইল বি ওয়েটিং।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়