০৫.

ঝুমু, তুই বাসাটা ছেড়ে দে। আমার বাড়িতে চলে আয়। যা বাকি বকেয়া পড়েছে তা আমি দিয়ে দেব।

-কেন?

ওয়াচ হিম। ওয়াচ হিজ স্টেপস।

–কোনও লাভ নেই।

কেন?

 –ওর ভিতরে কিছু সাহেবি ব্যাপার ঢুকে গেছে।

 –সেটা কী?

–সব বুঝবার তোমার দরকার কী?

আমার ছেলে, আর আমার বুঝবার দরকার নেই?

–জেনারেশন গ্যাপ বোঝো?

বুঝব না কেন? বুঝি কিন্তু মানি না। ও সব বানানো কথা।

হবে।

 ঝুমু, আমার কেবলই মনে হয় ও শিগগিরই নিজেকে শেষ করবে।

 মনোরম চুপ করে থাকে।

তুই সব সময়ে আমার আর ওর কাছাকাছি থাক ঝুমু।

–মানুষ তো আমি একটা, দুজনের কাছে থাকব কী করে?

সময় ভাগ করে নে। না, বরং তুই ওর কাছে কাছেই থাক। ওরই বিপদ বেশি।

–এ কথা বলছ কেন? কীসের বিপদ?

ও তো কিছু বলে না, কিন্তু মনে হয়, ও একটা প্রবলেমের মধ্যে আছে।

 –প্রবলেমের মধ্যে সবাই থাকে।

-কিন্তু বীরুর তো প্রবলেমের কোনও কারণ নেই। ভেবে পাই না, ওর প্রবলেমের কী থাকতে পারে। তাই মনে হয়, ওর বড় বিপদ।

বিপদ? না কিছুই খুঁজে পায় না, ভেবে পায় না মনোরম। ও খারাপ মেয়েমানুষের কাছে যায় না যে রোগ নিয়ে আসবে। ওর মেয়েবন্ধুরা অভিজাত পরিবারের। অবৈধ সন্তানের ভয় নেই, খোলা বাজারে বিক্রি হয় কন্ট্রাসেপটিভ। ওর প্রেমের কোনও ঝামেলা নেই, কারণ ঘুমের সময়ে ওর কারও মুখ মনে পড়ে না। জুয়ায় অনেক টাকা হেরে গেলেও ওর অনেক থাকবে।

প্রবলেমটা খুঁজে পায় না বটে মনোরম, কিন্তু খুঁজে ফেরে। দিশি গাড়িটা নিয়ে সে ক্লান্তিহীন ছোটে বীর পিছনে। বীরু মুহুর্মুহু পোশাক কেনে, কেনে গ্রামোফোনের উত্তেজক ডিস্ক, ভাল হোটেলে খায়, নাচে, খেলে বেড়ায় বড় ছোট ক্লাবে, সাঁতরায়, মেয়েদের নিয়ে যায় অ্যাপার্টমেন্টে, মনোরম সারা কলকাতা বীরুর ফিয়াটটাকে তাড়া করে ফেরে। বীরু বিতর্কসভায় বক্তৃতা করে, ভিয়েতনামে মার্কিন বোমারু বিমানের কাণ্ডকারখানার হুবহু বর্ণনা দেয়, লাইফ ম্যাগাজিনের পাতা খুলে জনসাধারণকে দেখায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মর্মন্তুদ ছবি। কিন্তু কোথাও থেমে নেই বীরু। চলছে। চলবে।

অনেক রাতে যখন বাসায় ফেরে মনোরম, তখন ক্লান্ত লাগে। বড় ক্লান্ত লাগে। রাতে সে প্রায় কিছুই খায় না। দুধে পাউরুটি ভিজিয়ে বিস্বাদ দলাগুলি গিলে ফেলে। দু ঘরেই জ্বেলে দেয় টিউবলাইটগুলি। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়। মাঝে মাঝে ওপরের দিকে চেয়ে দেখে।

কী দেখে মনোরম? দেখে নীলচে স্বপ্নের আলো। জানালার বুটিদার পর্দাগুলি উড়ছে বাতাসে। ঠিক মনে হয়, ঘরের ভিতরে রয়েছে তার প্রিয় মেয়েমানুষটি। সে কে? রিনা? চপলা? না কি এক প্রাণহীন মেমসাহেব-পুতুল প্রাণ পেয়ে ঘুরছে তার শূন্য ঘরে? সীতা নয় তো?

রক্তমাংসময় একজনকেই পেয়েছিল মনোরম। সীতা। যতক্ষণ সিগারেট না শেষ হয়, ততক্ষণ রাস্তায় পায়চারি করে সে। কখনও দুটো-তিনটে সিগারেট ফুরিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে মনোরম। কাল্পনিক কথা, এক কাল্পনিক স্ত্রীর সঙ্গে। মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়। কল্পনাটা এমনই সত্যের মতো জোরালো হয়ে ওঠে যে তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। গভীর রাতে নির্জন পূর্ণদাস রোডে কেউ তার সেই মূকাভিনয় দেখে না। দেখলে তারা দেখত, একজন প্রেমিক কেমন তার শূন্যনির্মিত নায়িকার সঙ্গে অবিকল আসল মানুষের মতো প্রেম করে।

রাত গম্ভীর হলে সে তার ছয় বাই সাত খাটে গিয়ে শোয়। মস্ত খাট। বিছানাটা একটু স্যাঁতসেঁতে। ফুটপাথ থেকে দুটাকা জমা রেখে আট আনা ভাড়ায় আনা ডিটেকটিভ বই খুলে বসে। হাই ওঠে। জল। খায়। টেবিল ল্যাম্প নেবায়। শেষ সিগারেটটাকে পিষে মারে মেঝের ওপর। তারপর ঘুমোবার জন্য চোখ বোজে।

অমনি কল্পনায় ভিন্ন পৃথিবী জেগে উঠতে থাকে। শরীরের ভিতরে নিকষ কালো অন্ধকারে জ্বলে ওঠে নীল লাল স্বপ্নের আলো। অবিকল এক জনহীন প্রেক্ষাগৃহ। আসবাব টানাটানি করে কারা পর্দার ওপাশে মঞ্চে দৃশ্যপট সাজাচ্ছে। পরদা সরে যায়। দীর্ঘ পৈঠার মতো ইস্কুলবাড়ির কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তাতে তিনশো ছেলে দাঁড়িয়ে গায়-জয় জগদীশ হরে…

শূন্য বিছানায় তার প্রসারিত হাতখানা পড়ে থাকে। কিছুই স্পর্শ করে না।

সকাল দশটা থেকে কাঠগোলা। মাঝখানে একটু লাঞ্চ ব্রেক। মামাবাড়ি থেকে ভাত আসে। মামা-ভাগ্নে খায়। খেতে খেতে মামা বলে-ঝুমু, ওয়াচ হিম।

আজকাল বাঙালির কথা মামা ভুলে যাচ্ছে। নেতাজির কথাও। নিরুদ্দেশ সেই মানুষটির জন্য আর অপেক্ষা করতে ভয় পায় মামা। ফার্স্ট স্ট্রোক হয়ে গেছে। বীরু থেকে যাচ্ছে বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে।

ফিস ফিস্ করে একটা লোক কানের কাছে বলে ব্যানার্জি না?

তখন বীরু তার গাড়িটা রেখে দ্রুতবেগে ঢুকে যাচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জে। অনুসরণ করতে করতে বাধা পেয়ে মনোরম থেমে ফিরে তাকায়। চিনতে পারে না। মস্ত একটা কাঠামোয় নড়বড় করে দুলেদুলে মাংস আর চামড়ায়। চোখের নীচে কালি। ক্লান্ত মানুষ একটা।

টেলিফোনে যেমন শোনা যায় মানুষের গলা, তেমনি, ফিসফিসিয়ে বলে–বিসোয়াস্ হিয়ার।

–বিশ্বাস! কী হয়েছে, চেনা যায় না?

বলছি। খুব ব্যস্ত?

মনোরম মুখটা একটু বাঁকা করে হাসে–না। জাস্ট একজনকে চেজ করছিলাম।

–চেজ?

–অলমোস্ট ডিটেকশন জব। জিরো জিরো সেভেন।

কাকে?

–এক বড়লোকের লক্কা ছেলেকে।

বিশ্বাস ক্ষীণ একটু হাসল-চা খাবেন?

চা? বিশ্বাস, চায়ের কথা বলছেন? আপনাকে দেখেই একটা তেষ্টা পেয়েছিল, উবে গেল। অফ অল থিংস গরমের দুপুরে চা কেন?

 –দি ওয়ার্ল্ড ইজ লস্ট ব্যানার্জি।

কী হয়েছে?

স্ট্রোক।

 বিশ্বাস জোর করে চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। বসল দুজন।

স্ট্রোক? মনোরম বলে।

স্ট্রোক।

 ব্যাপারটা কী রকম হয় বিশ্বাস?

স্ট্যাবিং-এর মতো। বুকে। বিশ্বাস করবেন না। মনে হয় এতগুলো স্ট্যাবিং যদি বুকে হচ্ছেই, তবে মরছি না কেন?

হু?

–বিশ্বাস করবেন না। মৃত্যুযন্ত্রণা তবু মৃত্যু নয়। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। তার ওপর ডায়েবেটিসটাও ধরে ফেলল এই বয়সে। হাঁটাচলা ছিল না তো, কেবল গাড়ি দাবড়াতাম। ব্যানার্জি, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

-শুনছি।

–আপনি একটা ওপেনিং চেয়েছিলেন। ম্যানেজারি করবেন?

ম্যানেজারি, বিশ্বাস? এ নিয়ে গোটা দুই করেছি, কোনওটাতেই সুবিধে করতে পারিনি। আপনারটা থার্ড অফার।

আমার ম্যানেজারিতে পারবেন। আমি বদ হলেও, কথা দিলে কথা রাখি।

 টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন?

–জানেন তো ব্যানার্জি, আমার বিজনেস খুব ক্লিন নয়। কিছু গোস্ট মানি খেলা করে। কাজেই

কী?

–ওয়াচ ইয়োর স্টেপস।

 –সেই রসিদের বিজনেসটাও কি এর মধ্যে?

এভরিথিং। আমার ব্যবসাগুলো ছোট, প্রত্যেকটার জন্য আলাদা ম্যানেজার রাখব কী করে? তবে টাকা দেব, ওভার অল প্রায় সাতশ। কিন্তু খুব সাবধানে হ্যাঁন্ডেল করবেন। কী, রাজি?

–দেখি।

 –দেখি-টেখি নয়। আমি লোক খুঁজছি কতদিন ধরে। আজই কথা দিয়ে দিন।

বিশ্বাস, এখন আমি যে চাকরিটা করছি তাতে আমি টায়ার্ড, একটা অল্পবয়সি ছেলেকে দিনরাত চেজ করা, ওর মতো স্পিড আমার নেই, হাঁফিয়ে পড়ি।

–চেজ করেন কেন?

–ওয়াচ করার জন্য, যাতে সে বিপদে না পড়ে। বিপদ কিছু নেই, তবু তার বাবার ধারণা সে বিপদে পড়বেই। তাই।

–খুব ফাস্ট লাইফ লিড করে?

–খুব। আমার এমপ্লয়ারের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।

–আচ্ছা, কবে আসছেন?

 –শিগগিরই।

–কিন্তু মনে রাখবেন, আমার ম্যানেজারি কিন্তু অন্ধকার জগতে। এভরিথিং ব্ল্যাক।

-জানি বিশ্বাস। চলি।

—শিগগিরই আসছেন?

হু।

মনোরম বিদায় নেয়।

.

আবার একদিন বীরুর পিছু নিয়ে সে এসে পড়ে সমীরের অফিসের সামনে। জোহানসন অ্যান্ড রোর সাদা সম্ভ্রান্ত অফিস বাড়িটা। বীরুকে কলকাতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে দিয়ে মনোরম গাড়ি পার্ক করে। নামে। আঙুলে গাড়ির চাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে ঢুকে যায় ভিতরে।

সমীর ঠিক সেদিনের মতোই সুকুমার কোমল মুখশ্রী তুলে বলে–আরে মনোরম!

মনোরম হাসেকী খবর?

–তোমার খবর কী?

–একরকম।

–বোসো। চা খাও।

না। আমি কাজে আছি।

–বোসো, একটু কথা আছে।

কী?

–সীতার সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়েছে।

–কীসের?

–তুমি তো জানই যে ও বিয়ে করছে।

আন্দাজ করেছিলাম। মানসকে?

–মানসকে। সীতা চাইছে তোমার বিজনেস-টিজনেস যা আছে ওর নামে, সব তোমাকে ফিরিয়ে দেয়।

–ফিরিয়ে দেবে? তবে নিল কেন?

–মানুষ তো ভুল করেই। ও বলছিল, এ সব যতদিন না ফেরত দিচ্ছে, ততদিন ও তোমাকে ভুলতে পারছে না। কাজেই তোমাকে ও অনুরোধ জানাচ্ছে, তুমি নাও। অভিমান কোরো না।

মাথাটা নিচু হয়ে আসে মনোরমের। সে কাঁচের নীচে সেই ছবিটা দেখতে পায়। নভূমি, তাতে শেষবেলার রাঙা রোদ, উপুড় হয়ে পড়ে আছে কয়েকটা গোরুর গাড়ি। আদিবাসী পুরুষ ও রমণীরা রাখছে।

সে মুখ তুলে বলল–এ সব জায়গায় আমি অনেকবার গেছি।

–কোন জায়গার কথা বলছ?

–এই যে ছবিতে। সাঁওতাল পরগনা, বিহার, উড়িষ্যায় এরকম সব অদ্ভুত বনে-জঙ্গলে আমি একসময়ে খুব ঘুরে বেড়াতাম।

সমীর করুণ চোখে চেয়ে থাকে।

-বিয়েটা কবে?

–ওরা খুব দেরি করবে না। মানস বোধহয় বদলি হয়ে যাচ্ছে আদ্রায়। বিয়ের পরেই সেখানে চলে যাবে। আমি সীতাকে কী বলব মনোরম? তুমি তো জানো, আমি কোনও ব্যাপারে নিজেকে জড়াই না। কিন্তু এ ব্যাপারটা নিয়ে সীতা এত কান্নাকাটি করেছিল যে, আমি কথা দিয়েছি তোমাকে কমিউনিকেট করব। তুমি না এলে আমিই যেতাম।

–কিছু ভাবিনি এখনও। দেখি।

–ও খুব শান্তিতে নেই।

মনোরম মনে মনে বলে যতদিন পৃথিবীতে কনভূমি থাকবে,নদীর জলে শব্দ হবে, তত দিন ভুলবে না। জ্বলবে।

বিদায় না নিয়েই একটু অন্যমনস্কভাবে বেরিয়ে এল মনোরম।

ট্রাম কোম্পানির বুথ থেকে টেলিফোন করল সীতার বাড়িতে। রিং-এর শব্দ হচ্ছে। খাসকষ্ট হতে থাকে মনোরমের। সীতা কি কথা বলবে তার সঙ্গে? এরকম ঘটনা ঘটবে কি?

মেয়েলি মিষ্টি গলায় ভেসে আসে হ্যালো।

সীতা! দম বন্ধ হয়ে আসে মনোরমের। বুকে উতরোল ঢেউ।

ধরুন, ডেকে দিচ্ছি।

একটু পরে সীতা বলল-হ্যালো।

মনোরম কিছু বলতে পারে না প্রথমে।

 সীতার গলাটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে–কে?

 মনোরম চোখ বুজে, আস্তে আস্তে বলে যায়–মেরিলি র্যাং দ্য বেল, অ্যান্ড দে ওয়্যার ওয়েড…

কে? চিৎকার করে ওঠে সীতা!

মনোরম ফোন রেখে দেয়।

ডিভোর্সের পর এক বছর পূর্ণ হয়ে গেছে কবে! সময় কত তাড়াতাড়ি যায়।

.

সীতা সব ফিরিয়ে দিচ্ছে। খুশি হবারই কথা মনোরমের। মামার গাড়িটা নিয়ে বীরুকে তাড়া করতে করতে এক সময়ে ক্লান্তি লাগে তার। পিছু-নেওয়া ছেড়ে সে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় অন্য রাস্তায়। আপনমনে ঘুরে বেড়ায়।

ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে এল চাঁদনি চকে। তার দোকানটা এখানেই। নেমে সে দোকানঘরে উঠে এল। মনোরমের আমলে সাকুল্যে চারজন কর্মচারী ছিল। এখন বেড়েছে। পুরনোর কেউ নেই। চমৎকার সানমাইকা লাগানো কাউন্টার, দেয়াল ডিসটেম্পার করা, ডিসপ্লে বোর্ড, কাঁচের আলমারি। সীতার দাদা ব্যবসা ভালই বোঝে। অনেকটা বড় হয়েছে দোকান। রমরম্ করে চলছে। ভাল জামাকাপড় পরা একজন অল্পবয়সি ছোকরা কাউন্টারের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনোরমকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললবলুন।

মনোরম গ্রাহ্য করল না। চারদিকে চেয়ে দোকানঘরটা দেখল। দোকানের নাম এখনও এস ব্যানার্জি প্রাইভেট লিমিটেড। সীতা এখনও ব্যানার্জি নামে সই করে। আপনমনে একটু হাসে মনোরম। কাউন্টারের ছেলেরা চেয়ে থাকে।

বাইরে একটা টেম্পো থেমেছে। কুলিরা মাল তুলে দিয়ে যাচ্ছে দোকানে। ছেলেটা ওপাশটায় গেল।

একা দাঁড়িয়ে থাকে মনোরম। এই দোকান-টোকান সবই সে উপহার দিয়েছিল সীতাকে। কিছু আয়কর ফাঁকি দিয়েছিল বটে, তবু তার ব্যবসাটা ছিল পরিষ্কার, দাগহীন এবং সৎ। এ সব আবার তাকে ফিরিয়ে দিলে সীতা তাকে ভুলে যেতে পারবে। পারবে কি?

কেন ভুলতে দেবে মনোরম? দেবে না। সে ফিরিয়ে নেবে না কিছুই। বিছানায় যখন মানস বুকে পড়বে সীতার ওপর, একদিন চুপি চুপি ঠিক মানসের শরীরে ভর করবে মনোরম। ভূতের মতো। থাক। মনোরম কিছুই ফিরিয়ে নেবে না। তার চেয়ে সে বিশ্বাসের অন্ধকার, বিপজ্জনক ব্যবসায় নেমে যাবে।

একটু দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বেরিয়ে এসে গাড়ি ছাড়ে সে। মনটা হঠাৎ ভাল লাগে। আজ সে সম্পূর্ণ দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিতে পারল।

সমীরকে ফোন করল সে।

-শুনুন, আমি বিজনেস ফেরত নেব না। কিছুই নেব না।

–কেন মনোরম?

-শুনুন, আপনি হয়তো ঠিক বুঝবেন না ব্যাপারটা। তবু বলছি। সীতা ব্যবসা কেড়ে নিয়ে আমার ক্ষতিই করতে চেয়েছিল। ম্যানেজারি থেকে বরখাস্ত করেছিল আমাকে। কিন্তু তাতে ক্ষতি কিছু হয়নি। আমি মরে যাইনি। সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা মানুষের হয় তা টাকাপয়সার নয়, বিষয়-সম্পত্তিরও নয়। মানুষ হারায় তার সময়।

-কী বলছ, বুঝতে পারছি না।

–আমার হারিয়েছে, ক্ষতি হয়েছে কেবলমাত্র সময়ের। সীতা আমার বিজনেস ফিরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু হারানো সময়টা কে ফিরিয়ে দেবে? এক বছরে আমার বয়স বেড়ে গেছে ঢের। কিছু শুরু করব আবার, তা হয় না। আমি পারব না। ওকে বলে দেবেন।

–তুমি আর একবার ভেবে দেখো।

–একবার কেন? আমি আরও বহুবার ভাবব, সারাজীবন ধরে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। আমি আমার এক বন্ধুর ব্যবসায়ে নামছি। ব্যবসা বন্ধুর, আমি সেখানে চাকরি করব। অ্যান্ড দ্যাটস অল।

ফোনটা করে খুবই শান্তি পায় মনোরম।

.

–তুই আমাকে ছেড়ে যেতে চাস ঝুমু? মামা একদিন ক্লান্ত বিষণ্ণ গলায় বলে। মামার রোগা চেহারাটা আরও একটু ভেঙে গেছে। চোখের নীচে মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম কালো রেখা সব ফুটে উঠেছে। সম্ভবত শিগগিরই আবার স্ট্রোক হবে মামার।

বীরুর সঙ্গে পাল্লা দিতে আমি কি পারি মামা? ওর কত কম বয়েস, কত স্পিড ওরা কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে বরু! আমি কি পারি পাল্লা দিতে? আমার বয়সও হল।

কিন্তু তুই-ই বীরুকে ফেরাতে পারিস। আমি দেখেছি ও তোর সঙ্গে কথাটথা বলে, হাসে, ঠাট্টা করে। অবিশ্বাস্য। ও যে কারও সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে পারে তা জানতামই না। আমার বড় আশা ছিল, তুই কিছু একটা পারবি।

মনোরম একটু ভেবেচিন্তে বলে–মামা, বীরুর পিছু-নেওয়ার চাকরি একদিন তো শেষ হবেই। একদিন বীরু ঠিকই ব্যবসা-ট্যবসা বুঝে নেবে। তখন আমার চাকরিও শেষ হয়ে যাবে।

-না। তোকে আমি ম্যানেজার করব।

–কেন করবে? আমি যে কাঠের কিছুই জানি না। কিছুই শিখলাম না। বীরু মালিক হলে যে আমাকে রাখবে তারও কিছু ঠিক নেই। বয়সও হয়ে যাবে ততদিনে। পথ বন্ধ হয়ে যাবে সব। তার চেয়ে এখনই আমাকে ছেড়ে দাও।

–যেখানে যাচ্ছিস সেখানেও তো চাকরিই করবি।

–প্রথমে তাই কথা ছিল। পরে আমি কষাকষি করে আমাকে ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে নিতে রাজি করিয়েছি। কমিশন পাব।

-কীরকম ব্যবসা?

–ব্ল্যাক। ভীষণ কালো। জাল-জোচ্চুরি-স্মাগলিং সবই আছে।

যাবি?

 যাব না কেন? আমার এ বয়সে আর ভাল বা খারাপ কিছু হওয়ার নেই।

–যাবিই? বীরুর একটা কিছু ব্যবস্থা করে যা। ওকে ফেরা।

–কোথায় ফেরাব মামা? আমার তো ওকে কিছু শেখানোর নেই। ও আমার চেয়ে দশগুণ বেশি পড়াশুনো করেছে। অনেক বেশি বুদ্ধিমান। ভয়ংকর আত্মবিশ্বাসী। ওকে আমি কোথায় ফেরাব? ও আমাকে উড়িয়ে বেরিয়ে যাবে। বরং ও-ই আমাকে টেনে নিচ্ছে ওর দিকে। দেখো, এই বয়সে আমি লম্বা চুল আর জুলফি রাখছি, পরছি বেলবটমের সঙ্গে পাঞ্জাবি। আর কিছুদিন বীরুর পিছু নিলে আমিই বীরু হয়ে যাব।

–আর কিছুদিন থাক ঝুমু। আমার জন্যই থাক।

–আমার বাড়িভাড়াটা এখনও বাকি পড়ে আছে মামা।

–আজই নিয়ে যাস। ভূপতিকে বলে রাখছি। থাকবি? কিছুদিন?

–দেখি। বিশ্বাসকে একটা খবর দিয়ে দিতে হবে। ওরও স্ট্রোক, খুব ভেঙে পড়েছে। সময় দিতে চাইছে না।

–ওই বিপদের ব্যবসাতে কেন যাবি ঝুমু?

–কিছু তো করতেই হবে মামা। ওপনিং কোথায়? বাজার তো দেখছ! তা ছাড়া বিপদই বা কী, সবাই করছে।

মামা খুব গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আস্তে করে বলে–তোর সঙ্গে তো তেমন সম্পর্ক ছিল না আমার। আজকাল আত্মীয়তার গিট তো আলগা হয়েই যাচ্ছে। কিন্তু এ কদিনে তোর ওপর আমার মায়া পড়ে গেছে ঝুমু। তুই চলে যাবি ভাবলে বুকটা কেমন করে। আমি কেবল তোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করলাম। তোর দিকটা ভাবিনি। ঝুমু, তোর জন্য কী করব বল তো?

কী করবে? আমার খুব অসময়ে তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল।

–স্ট্রোক-ফোক হলে ওই সেন্টিমেন্টটা খুব বেড়ে যায়, জানিস? ভীষণ বেড়ে যায়। স্ট্রোক হচ্ছে গাড়ি ছাড়বার ফাস্ট ওয়ার্নিং, তখনই মানুষ গাড়ির জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বেশি করে আত্মীয়দের মুখ দেখে নেয়।

-চুপ করো। বিরক্ত হয়ে মনোরম উঠে যায়। কাঠগোলার পিছনে একটু পরিষ্কার জায়গায় গিয়ে সিগারেট ধরায়। করাতকলের মিষ্টি ঘসটানো শব্দটা আসে।

.

বর্ষা যায়। শরৎ যায়। শীত আসি-আসি করে। বিশ্বাস ফোনে তার ফিসফিস স্বরে বলে–ব্যানার্জি, আর কত সময় নেবেন? আমি আর পারছি না।

আর কটা দিন, বিশ্বাস। মনোরম বলে–আর একটু সময় দিন।

সময় কে কাকে দেয় মশাই! সময়ের কি ট্রানজাকশন হয়? সময় ফুরোয়। ব্যানার্জি, একটা ফাইনাল কিছু বলুন। অন্য লোক নিতে ভরসা হয় না। এ ব্যবসাতে ফেইথফুল তোক না হলে..আমি আর কত অপেক্ষা করব ব্যানার্জি? টেল সামথিং।

একটু, আর একটু…

.

আজকাল প্রায় একটা জিনিস লক্ষ করে মনোরম। বীরু মাঝে মাঝে তার ফিয়াট দাঁড় করায় ওষুধের দোকানের সামনে। কী যেন কিনে আনে, তারপর আবার গাড়ি ছাড়ে। প্রায় দিনই, প্রতিদিনই বীরু আজকাল কাটা করে।

কী কেনে ও? ঘুমের ওষুধ নয় তো!

মনোরম সতর্ক হতে থাকে। একদিন বীরু ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়ি ছাড়ল। মনোরম গাড়ি থেকে নেমে ঢুকল দোকানটায়।

একটু আগে যে লম্বা ছেলেটা এসেছিল, ও কিছু কিনল?

কাউন্টারের আধবুড়ো লোকটা কাগজ পড়ছিল। মুখ তুলে একটু বিস্ময়ভরে বলে।

কী?

–অনেকগুলো ট্রাংকুলাইজার, কয়েকটা ঘুমের ওষুধ, নিউরোসিসের জন্য কয়েক রকমের বড়ি।

প্রেসক্রিপশন?

 –ছিল না। এ সব কিনতে আজকাল আর প্রেসক্রিপশন লাগে না। সবাই নিজের নিজের ডাক্তার।

অসুখটা কী?

 লোকটা মাথা নাড়ল–কে জানে মশাই! জিজ্ঞেস করছেন কেন?

কারণ আছে। ও একটু ডিসব্যালান্সড।

লোকটা নিজের নাকটা মুঠোয় ধরে বলল–এ সব ড্রাগই আজকাল মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে। রোগটা বোধহয় পাগলামি। দেশে পাগল বাড়ছে।

মনোরম বেরিয়ে আসে। আকাশ ভরা রোদ। এখন হেমন্তকাল। কলকাতা এখন পাখির বুকের মতো কবোষ্ণ। গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে তার কাঁধে ব্যথা, কোমর ধরে আছে, মাথা ভার। হেমন্তের সুন্দর আলোতে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় একটু হেঁটে বেড়াতে পারলে বেশ হত। কিন্তু জগদ্দল গাড়িটা রয়েছে সঙ্গে আর সামনে উধাও বীরু।

ক্লান্তভাবে আবার গাড়িতে ওঠে সে। ছাড়ে। ক্লান্তিহীন বীরু কি ধরা পড়ল বয়সের হাতে? নাকি অসুখ? কিংবা কর্মফল? ওষুধ কিনছে। পাগলামির ওষুধ, নার্ভের ওষুধ, ঘুমের ওষুধ! বড় অবাক কাণ্ড। মনোরমের ভ্রূ কুঁচকে যায়। চিন্তিতভাবে সে চেয়ে থাকে সামনের রাস্তায়। চলন্ত গাড়িটা গিলে ফেলছে রাস্তাকে।

.

রাতে খুব জ্যোৎস্না ফুটেছে আজ। সেটা টের পাওয়ার কথা নয়। বীরুর পিছু পিছু অনেক রাত পর্যন্ত ধাওয়া করে করে অবশেষে প্রায় রাত সাড়ে বারোটায় বীরুর গাড়ি ঢুকল রিচি রোডে। তখন লোডশেডিং। সেই অন্ধকারে হঠাৎ বানডাকা জ্যোৎস্না দেখতে পেল মনোরম।

অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বীরু গাড়ি দাঁড় করাল না আজ। একটু এগিয়ে গেল। বাঁ ধারে একটা মস্ত ফাঁকা পার্ক। হিম পড়েছে। কেউ কোথাও নেই। বীরু নামল। দুধের মতো সাদা পোশাক পরেছে বীরু। সাদা ঢিলে বুশশার্ট, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো। জ্যোৎস্নায় ওর লম্বা, সাদা অবয়বটা অপ্রাকৃত দেখায়।

গাড়ি ফেলে রেখে বীরু লম্বা পায়ে রেলিং ডিঙিয়ে পার্কে ঢুকল। খুব ধীরে হাঁটছে। মাঠের মাঝখানে চলে গেল। দাঁড়াল। আড়মোড়া ভাঙছে। স্লো-মোশন ছবির মতো নড়াচড়া করছে। জ্যোৎস্নায় এবং কুয়াশায় একটু আবছা। গাড়ির অন্ধকারে বসে মনোরম দেখতে থাকে। বীরু এক-পা এক-পা করে দৌড়ে ক্রিকেটের বোলারের মতো হাত ঘোরাল। ব্যাটসম্যানের মতো মারল বল। দু পায়ে একটি জটিল দ্রুত নাচ নেচেই থেমে যায়। ডিসকাস ছোঁড়ার ভঙ্গি করে। তারপর ধীরে, খুব ধীরে হাঁটে, ঠিক যেমন চাঁদের মাটিতে নীল আর্মস্ট্রং হেঁটেছিল। ঘুরে দাঁড়ায় আবার। স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু মনে হয় যেন চেয়ে আছে মনোরমের গাড়ির দিকেই। দেখছে।

মনোরম গাড়ির দরজা খুলে নামল। গরম জামা পরেনি, একটু শীত করে। রেলিংটা টপকায় মনোরম। হাঁটতে থাকে। কী জ্যোৎস্না, কী জ্যোৎস্না! নীলাভ হলুদ কুয়াশায় মাখা স্বপ্নের আলো। সেই আলোতে ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা অপরিচিত মানুষের মতো লম্বা সাদা অবয়ব বীরুর। স্থির দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে মহাকাশের সাদা পোশাক।

বীরু।

–এসো। ভাবছিলাম, তোমাকে ডাকব।

–তুই জানিস যে আমি তোর পিছু নিই?

আগে জানতাম না। কদিন হয় জানি। জেনেও প্রথম ভেবেছিলাম অচেনা কেউ চেজ করছে। তাই একটু চমকে গিয়েছিলাম। তারপর লক্ষ করলাম, তুমি।

–আমার দোষ নেই। মামার অর্ডার।

–বাবা কিছু জানতে চায়?

চায়।

আমাকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতাম। এত কষ্ট করতে হত না তোমাকে।

 কষ্ট কী? এটাই আমার চাকরি।

বুঝতে পারছি। তোমার জন্য কষ্ট হয়।

মামা যেদিন তোর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবে, সেদিন আমার এ চাকরিটা শেষ হবে। তখন হয়তো আমি কাঠগোলার ম্যানেজারি পাব। নয়তো একটা বাজে, বিপজ্জনক অসৎ ব্যবসাতে নেমে যাব। ও দুটো চাকরির চেয়ে এটা বোধ হয় একটু বেটার ছিল। তবে ক্লান্তিকর। তুই বড্ড স্পিডি।

বীরু তেমনি ধীর ভঙ্গিতে একটু হাঁটছে এদিক ওদিক। অদ্ভুত প্রাকৃতিক আলোতে ও হাঁটছে বলে মনে হয় না। যেন একটু জমাট, লম্বাটে একটা কুয়াশায় তৈরি ভৌতিক মূর্তি দুলে দুলে যাচ্ছে।

বাবা কোনওদিনই আমার সব জানতে পারবে না।

–সেটা মামা স্বীকার করে না। কিন্তু বোঝে। তাই আমাকে লাগিয়েছে মামা। তার বিশ্বাস, আমি তোমাকে বুঝব। তোর পিছু নিয়ে নিয়ে আমি এখন পাক্কা জেমস বন্ড হয়ে গেছি।

বীরু হাসল। মসৃণ কামানো গালে জ্যোৎস্না ঝিকিয়ে ওঠে একটু।

–তুমি কী বুঝলে? শান্ত স্বরে জিগ্যেস করে বীরু।

–কিছু না।

–কী বুঝতে চাও?

–তুই ওষুধ কিনছিস কেন? ও সব ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া খাওয়া খুব ডেঞ্জারাস।

আজকাল সব ওষুধের পোটেন্সি এত কমিয়ে দেয় ওরা যে কাজ হয় না।

 ধীরে ধীরে হেঁটে বীরু একটু দুরে যায়। আবার দুলে দুলে কাছে আসে। মনোরমের ভয় হয়, বুঝি বীরু জ্যোৎস্না আর কুয়াশায় হঠাৎ মিলিয়ে যাবে।

বিয়ে করবি না বীরু?

—করব হয়তো কখনও।

–গৌরীকে করিস।

বীরু হাসল। বলল–তুমিই গৌরীর প্রেমে পড়ে গেছ।

-বোধহয়। তুই বলেছিলি কষ্ট হওয়াকেই ভালবাসা বলে। আমারও কষ্ট হয় ওই মেয়েটার জন্য।

–বিয়ে করে কী হবে?

–আমি তোর অনেক কিছু নকল করেছি বীরু। পোশাক, চুল, জুলফি, গাড়ির স্পিড। তোর পিছু নিয়ে নিয়ে তোর কাছে শিখেছি অনেক। কেবল তোর জুয়েলটিটা শিখতে পারছি না। তুই এ মেয়েটাকে ভাল না বেসে পারিস কী করে?

টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশে তাকিয়ে থাকে বীরু। প্যান্টের পকেটে দুই হাত। একটুক্ষণ স্থির থাকে।

–আমি খুব নিষ্ঠুর?

 –মনে হয়।

–ইদানীং আমি খুব নেশা করছি। গাঁজা, আফিং, এল-এস-ডি, কিছু বাকি নেই। কিছু হয় না তাতে।

–কেন করছিস?

টু ফরগেট সামথিং।

–কী?

 –তুমি আমাকে নিষ্ঠুর বলছ? কেন? তুমি আমার কতটুকু জানো?

–কিছুই না। বীরু, আমার মনে হচ্ছে দিনে দিনে তুই আমার আরও অচেনা হয়ে যাচ্ছিস। এখনই তোকে আমার পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, যেন বা তুই অন্য গ্রহের লোক। আমি তোর মতো হার্টলেস হতে চাই। আমাকে শিখিয়ে দে।

বীরু হাসে। যথারীতি কোমল জ্যোৎস্নার লাবণ্য ওর কেঠো মসৃণ গালে এক ফোঁটা মোমের মত ঝরে পড়ল। বলল-কেন হার্টলেস হতে চাও?

মনোরম বলে–আমরা কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে পাগল হতাম। এখনও দ্যাখ, বউয়ের দুঃখ ভুলতে পারি না। তুই কত মেয়েকে ভুলে যাস, আমি একজনকেই পারি না।

–আমি একটা জিনিস ভুলতে পারছি না।

–কী?

যাদবপুর রেল স্টেশনে এক বান্ধবীকে তুলতে গিয়েছিলাম গাড়িতে, ট্রেনের দেরি ছিল, কথা বলছিলাম দুজনে। ভালবাসার কথা। নকল কথা সব। লাইক কসমেটিকস। ঘুরতে ঘুরতে স্টেশনের একদিকে শেড-এর তলায় গেছি, বান্ধবীটি হঠাৎ দুপা সরে এসে বলল-মাগো, ওটা কী? দেখলাম, একটা বাচ্চা ছেলে শুয়ে আছে ভিখিরিদের বিছানায়। এত রোগা যে ভাল করে না নজর করলে দেখাই। যায় না। ঠিক কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো দুখানা হাত নোংরা কাঁথার তূপ থেকে শূন্যে উঠে একটু নড়ছে, অবিকল সেইরকমই দুখানা পা। এত নির্জীব যে খুব ধীরে ধীরে একটু একটু নড়ে, আবার কাঁথায় লুকোয়। তার গায়ের চামড়া আশি-নব্বই বছরের বুড়োর মতো কোঁচকানো, দুলদুল করছে। হিউম্যান ফর্ম, কিন্তু কী করে বেঁচে আছে বোঝা মুশকিল। চমকে যাই যখন দেখি, তার উরুর ফাঁকে রয়েছে। পিউবিক হেয়ার, পুরুষাঙ্গ। বাচ্চা ছেলের তো পিউবিক হেয়ার থাকার কথা নয়। একটা উলোঙ্কুলো বুড়ি বসে উকুন মারছিল, সে নিজে থেকেই ডেকে বলল–ষোলোবছর বয়স বাবু, রোগে ভুগে ওই দশা। ছেলেবেলা থেকেই বাড়ন নেই।–কিছুই না ব্যাপারটা, কিন্তু সেই থেকে ভুলতে পারি না।

–কেন বীরু?

-কী জানি! কলকাতায় ভিখিরি-টিকিরি তো কত দেখেছি! কত কুঠে, আধমরা, ডিফর্মড। কিন্তু এটা কিছুতেই ভুলতে পারি না। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, চমকে উঠি। পিউবিক হেয়ার সমেত একটা বাচ্চা তার কাঁকড়ার মতো হাত পা নাড়ছে। ভীষণ ভয় করে। যত দিন যাচ্ছে, তত সেঁটে বসে যাচ্ছে ছবিটা মনের মধ্যে। কী যে করি!

মনোরম কী বলবে! চুপ করে থাকে।

বীরু মহাকাশচারীর মতোই চাঁদের মাটিতে হাঁটে। ভ্রূ কুঁচকে বলে–বুদ্ধদেব যেন কী কী দেখেছিল? বার্ধক্য, রোগ, মৃত্যু আর সন্ন্যাস, না?

–বোধহয়।

 –পিউবিক হেয়ার সমেত বাচ্চা ছেলের ফর্ম দেখলে বুদ্ধদেব কী করত বলো তো?

কী জানি!

–পাগল হয়ে যেত। কিন্তু আমি কী করি? কী করি বলো তো?

–কী করবি?

–ভাবছি। আস্তে আস্তে অপ্রাকৃত চাঁদের আলোয় ঘুরে বেড়ায় সাদা দীর্ঘ অবয়ব। আস্তে করে বলে–নিষ্ঠুর নই, বুঝেছ? বাড়ি যাও।

-কেন?

–আমি একটু একা থাকি।

পকেটে হাত, চিন্তিত মুখটা নোয়ানো, বীরু আস্তে আস্তে কুয়াশার শরীর নিয়ে ঘোরে। গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার সময়ে দূর থেকে দৃশ্যটা অস্পষ্ট দেখে মনোরম।

০৫.

ঝুমু, তুই বাসাটা ছেড়ে দে। আমার বাড়িতে চলে আয়। যা বাকি বকেয়া পড়েছে তা আমি দিয়ে দেব।

-কেন?

ওয়াচ হিম। ওয়াচ হিজ স্টেপস।

–কোনও লাভ নেই।

কেন?

 –ওর ভিতরে কিছু সাহেবি ব্যাপার ঢুকে গেছে।

 –সেটা কী?

–সব বুঝবার তোমার দরকার কী?

আমার ছেলে, আর আমার বুঝবার দরকার নেই?

–জেনারেশন গ্যাপ বোঝো?

বুঝব না কেন? বুঝি কিন্তু মানি না। ও সব বানানো কথা।

হবে।

 ঝুমু, আমার কেবলই মনে হয় ও শিগগিরই নিজেকে শেষ করবে।

 মনোরম চুপ করে থাকে।

তুই সব সময়ে আমার আর ওর কাছাকাছি থাক ঝুমু।

–মানুষ তো আমি একটা, দুজনের কাছে থাকব কী করে?

সময় ভাগ করে নে। না, বরং তুই ওর কাছে কাছেই থাক। ওরই বিপদ বেশি।

–এ কথা বলছ কেন? কীসের বিপদ?

ও তো কিছু বলে না, কিন্তু মনে হয়, ও একটা প্রবলেমের মধ্যে আছে।

 –প্রবলেমের মধ্যে সবাই থাকে।

-কিন্তু বীরুর তো প্রবলেমের কোনও কারণ নেই। ভেবে পাই না, ওর প্রবলেমের কী থাকতে পারে। তাই মনে হয়, ওর বড় বিপদ।

বিপদ? না কিছুই খুঁজে পায় না, ভেবে পায় না মনোরম। ও খারাপ মেয়েমানুষের কাছে যায় না যে রোগ নিয়ে আসবে। ওর মেয়েবন্ধুরা অভিজাত পরিবারের। অবৈধ সন্তানের ভয় নেই, খোলা বাজারে বিক্রি হয় কন্ট্রাসেপটিভ। ওর প্রেমের কোনও ঝামেলা নেই, কারণ ঘুমের সময়ে ওর কারও মুখ মনে পড়ে না। জুয়ায় অনেক টাকা হেরে গেলেও ওর অনেক থাকবে।

প্রবলেমটা খুঁজে পায় না বটে মনোরম, কিন্তু খুঁজে ফেরে। দিশি গাড়িটা নিয়ে সে ক্লান্তিহীন ছোটে বীর পিছনে। বীরু মুহুর্মুহু পোশাক কেনে, কেনে গ্রামোফোনের উত্তেজক ডিস্ক, ভাল হোটেলে খায়, নাচে, খেলে বেড়ায় বড় ছোট ক্লাবে, সাঁতরায়, মেয়েদের নিয়ে যায় অ্যাপার্টমেন্টে, মনোরম সারা কলকাতা বীরুর ফিয়াটটাকে তাড়া করে ফেরে। বীরু বিতর্কসভায় বক্তৃতা করে, ভিয়েতনামে মার্কিন বোমারু বিমানের কাণ্ডকারখানার হুবহু বর্ণনা দেয়, লাইফ ম্যাগাজিনের পাতা খুলে জনসাধারণকে দেখায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মর্মন্তুদ ছবি। কিন্তু কোথাও থেমে নেই বীরু। চলছে। চলবে।

অনেক রাতে যখন বাসায় ফেরে মনোরম, তখন ক্লান্ত লাগে। বড় ক্লান্ত লাগে। রাতে সে প্রায় কিছুই খায় না। দুধে পাউরুটি ভিজিয়ে বিস্বাদ দলাগুলি গিলে ফেলে। দু ঘরেই জ্বেলে দেয় টিউবলাইটগুলি। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়। মাঝে মাঝে ওপরের দিকে চেয়ে দেখে।

কী দেখে মনোরম? দেখে নীলচে স্বপ্নের আলো। জানালার বুটিদার পর্দাগুলি উড়ছে বাতাসে। ঠিক মনে হয়, ঘরের ভিতরে রয়েছে তার প্রিয় মেয়েমানুষটি। সে কে? রিনা? চপলা? না কি এক প্রাণহীন মেমসাহেব-পুতুল প্রাণ পেয়ে ঘুরছে তার শূন্য ঘরে? সীতা নয় তো?

রক্তমাংসময় একজনকেই পেয়েছিল মনোরম। সীতা। যতক্ষণ সিগারেট না শেষ হয়, ততক্ষণ রাস্তায় পায়চারি করে সে। কখনও দুটো-তিনটে সিগারেট ফুরিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে মনোরম। কাল্পনিক কথা, এক কাল্পনিক স্ত্রীর সঙ্গে। মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়। কল্পনাটা এমনই সত্যের মতো জোরালো হয়ে ওঠে যে তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। গভীর রাতে নির্জন পূর্ণদাস রোডে কেউ তার সেই মূকাভিনয় দেখে না। দেখলে তারা দেখত, একজন প্রেমিক কেমন তার শূন্যনির্মিত নায়িকার সঙ্গে অবিকল আসল মানুষের মতো প্রেম করে।

রাত গম্ভীর হলে সে তার ছয় বাই সাত খাটে গিয়ে শোয়। মস্ত খাট। বিছানাটা একটু স্যাঁতসেঁতে। ফুটপাথ থেকে দুটাকা জমা রেখে আট আনা ভাড়ায় আনা ডিটেকটিভ বই খুলে বসে। হাই ওঠে। জল। খায়। টেবিল ল্যাম্প নেবায়। শেষ সিগারেটটাকে পিষে মারে মেঝের ওপর। তারপর ঘুমোবার জন্য চোখ বোজে।

অমনি কল্পনায় ভিন্ন পৃথিবী জেগে উঠতে থাকে। শরীরের ভিতরে নিকষ কালো অন্ধকারে জ্বলে ওঠে নীল লাল স্বপ্নের আলো। অবিকল এক জনহীন প্রেক্ষাগৃহ। আসবাব টানাটানি করে কারা পর্দার ওপাশে মঞ্চে দৃশ্যপট সাজাচ্ছে। পরদা সরে যায়। দীর্ঘ পৈঠার মতো ইস্কুলবাড়ির কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তাতে তিনশো ছেলে দাঁড়িয়ে গায়-জয় জগদীশ হরে…

শূন্য বিছানায় তার প্রসারিত হাতখানা পড়ে থাকে। কিছুই স্পর্শ করে না।

সকাল দশটা থেকে কাঠগোলা। মাঝখানে একটু লাঞ্চ ব্রেক। মামাবাড়ি থেকে ভাত আসে। মামা-ভাগ্নে খায়। খেতে খেতে মামা বলে-ঝুমু, ওয়াচ হিম।

আজকাল বাঙালির কথা মামা ভুলে যাচ্ছে। নেতাজির কথাও। নিরুদ্দেশ সেই মানুষটির জন্য আর অপেক্ষা করতে ভয় পায় মামা। ফার্স্ট স্ট্রোক হয়ে গেছে। বীরু থেকে যাচ্ছে বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে।

ফিস ফিস্ করে একটা লোক কানের কাছে বলে ব্যানার্জি না?

তখন বীরু তার গাড়িটা রেখে দ্রুতবেগে ঢুকে যাচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জে। অনুসরণ করতে করতে বাধা পেয়ে মনোরম থেমে ফিরে তাকায়। চিনতে পারে না। মস্ত একটা কাঠামোয় নড়বড় করে দুলেদুলে মাংস আর চামড়ায়। চোখের নীচে কালি। ক্লান্ত মানুষ একটা।

টেলিফোনে যেমন শোনা যায় মানুষের গলা, তেমনি, ফিসফিসিয়ে বলে–বিসোয়াস্ হিয়ার।

–বিশ্বাস! কী হয়েছে, চেনা যায় না?

বলছি। খুব ব্যস্ত?

মনোরম মুখটা একটু বাঁকা করে হাসে–না। জাস্ট একজনকে চেজ করছিলাম।

–চেজ?

–অলমোস্ট ডিটেকশন জব। জিরো জিরো সেভেন।

কাকে?

–এক বড়লোকের লক্কা ছেলেকে।

বিশ্বাস ক্ষীণ একটু হাসল-চা খাবেন?

চা? বিশ্বাস, চায়ের কথা বলছেন? আপনাকে দেখেই একটা তেষ্টা পেয়েছিল, উবে গেল। অফ অল থিংস গরমের দুপুরে চা কেন?

 –দি ওয়ার্ল্ড ইজ লস্ট ব্যানার্জি।

কী হয়েছে?

স্ট্রোক।

 বিশ্বাস জোর করে চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। বসল দুজন।

স্ট্রোক? মনোরম বলে।

স্ট্রোক।

 ব্যাপারটা কী রকম হয় বিশ্বাস?

স্ট্যাবিং-এর মতো। বুকে। বিশ্বাস করবেন না। মনে হয় এতগুলো স্ট্যাবিং যদি বুকে হচ্ছেই, তবে মরছি না কেন?

হু?

–বিশ্বাস করবেন না। মৃত্যুযন্ত্রণা তবু মৃত্যু নয়। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। তার ওপর ডায়েবেটিসটাও ধরে ফেলল এই বয়সে। হাঁটাচলা ছিল না তো, কেবল গাড়ি দাবড়াতাম। ব্যানার্জি, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

-শুনছি।

–আপনি একটা ওপেনিং চেয়েছিলেন। ম্যানেজারি করবেন?

ম্যানেজারি, বিশ্বাস? এ নিয়ে গোটা দুই করেছি, কোনওটাতেই সুবিধে করতে পারিনি। আপনারটা থার্ড অফার।

আমার ম্যানেজারিতে পারবেন। আমি বদ হলেও, কথা দিলে কথা রাখি।

 টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন?

–জানেন তো ব্যানার্জি, আমার বিজনেস খুব ক্লিন নয়। কিছু গোস্ট মানি খেলা করে। কাজেই

কী?

–ওয়াচ ইয়োর স্টেপস।

 –সেই রসিদের বিজনেসটাও কি এর মধ্যে?

এভরিথিং। আমার ব্যবসাগুলো ছোট, প্রত্যেকটার জন্য আলাদা ম্যানেজার রাখব কী করে? তবে টাকা দেব, ওভার অল প্রায় সাতশ। কিন্তু খুব সাবধানে হ্যাঁন্ডেল করবেন। কী, রাজি?

–দেখি।

 –দেখি-টেখি নয়। আমি লোক খুঁজছি কতদিন ধরে। আজই কথা দিয়ে দিন।

বিশ্বাস, এখন আমি যে চাকরিটা করছি তাতে আমি টায়ার্ড, একটা অল্পবয়সি ছেলেকে দিনরাত চেজ করা, ওর মতো স্পিড আমার নেই, হাঁফিয়ে পড়ি।

–চেজ করেন কেন?

–ওয়াচ করার জন্য, যাতে সে বিপদে না পড়ে। বিপদ কিছু নেই, তবু তার বাবার ধারণা সে বিপদে পড়বেই। তাই।

–খুব ফাস্ট লাইফ লিড করে?

–খুব। আমার এমপ্লয়ারের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।

–আচ্ছা, কবে আসছেন?

 –শিগগিরই।

–কিন্তু মনে রাখবেন, আমার ম্যানেজারি কিন্তু অন্ধকার জগতে। এভরিথিং ব্ল্যাক।

-জানি বিশ্বাস। চলি।

—শিগগিরই আসছেন?

হু।

মনোরম বিদায় নেয়।

.

আবার একদিন বীরুর পিছু নিয়ে সে এসে পড়ে সমীরের অফিসের সামনে। জোহানসন অ্যান্ড রোর সাদা সম্ভ্রান্ত অফিস বাড়িটা। বীরুকে কলকাতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে দিয়ে মনোরম গাড়ি পার্ক করে। নামে। আঙুলে গাড়ির চাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে ঢুকে যায় ভিতরে।

সমীর ঠিক সেদিনের মতোই সুকুমার কোমল মুখশ্রী তুলে বলে–আরে মনোরম!

মনোরম হাসেকী খবর?

–তোমার খবর কী?

–একরকম।

–বোসো। চা খাও।

না। আমি কাজে আছি।

–বোসো, একটু কথা আছে।

কী?

–সীতার সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়েছে।

–কীসের?

–তুমি তো জানই যে ও বিয়ে করছে।

আন্দাজ করেছিলাম। মানসকে?

–মানসকে। সীতা চাইছে তোমার বিজনেস-টিজনেস যা আছে ওর নামে, সব তোমাকে ফিরিয়ে দেয়।

–ফিরিয়ে দেবে? তবে নিল কেন?

–মানুষ তো ভুল করেই। ও বলছিল, এ সব যতদিন না ফেরত দিচ্ছে, ততদিন ও তোমাকে ভুলতে পারছে না। কাজেই তোমাকে ও অনুরোধ জানাচ্ছে, তুমি নাও। অভিমান কোরো না।

মাথাটা নিচু হয়ে আসে মনোরমের। সে কাঁচের নীচে সেই ছবিটা দেখতে পায়। নভূমি, তাতে শেষবেলার রাঙা রোদ, উপুড় হয়ে পড়ে আছে কয়েকটা গোরুর গাড়ি। আদিবাসী পুরুষ ও রমণীরা রাখছে।

সে মুখ তুলে বলল–এ সব জায়গায় আমি অনেকবার গেছি।

–কোন জায়গার কথা বলছ?

–এই যে ছবিতে। সাঁওতাল পরগনা, বিহার, উড়িষ্যায় এরকম সব অদ্ভুত বনে-জঙ্গলে আমি একসময়ে খুব ঘুরে বেড়াতাম।

সমীর করুণ চোখে চেয়ে থাকে।

-বিয়েটা কবে?

–ওরা খুব দেরি করবে না। মানস বোধহয় বদলি হয়ে যাচ্ছে আদ্রায়। বিয়ের পরেই সেখানে চলে যাবে। আমি সীতাকে কী বলব মনোরম? তুমি তো জানো, আমি কোনও ব্যাপারে নিজেকে জড়াই না। কিন্তু এ ব্যাপারটা নিয়ে সীতা এত কান্নাকাটি করেছিল যে, আমি কথা দিয়েছি তোমাকে কমিউনিকেট করব। তুমি না এলে আমিই যেতাম।

–কিছু ভাবিনি এখনও। দেখি।

–ও খুব শান্তিতে নেই।

মনোরম মনে মনে বলে যতদিন পৃথিবীতে কনভূমি থাকবে,নদীর জলে শব্দ হবে, তত দিন ভুলবে না। জ্বলবে।

বিদায় না নিয়েই একটু অন্যমনস্কভাবে বেরিয়ে এল মনোরম।

ট্রাম কোম্পানির বুথ থেকে টেলিফোন করল সীতার বাড়িতে। রিং-এর শব্দ হচ্ছে। খাসকষ্ট হতে থাকে মনোরমের। সীতা কি কথা বলবে তার সঙ্গে? এরকম ঘটনা ঘটবে কি?

মেয়েলি মিষ্টি গলায় ভেসে আসে হ্যালো।

সীতা! দম বন্ধ হয়ে আসে মনোরমের। বুকে উতরোল ঢেউ।

ধরুন, ডেকে দিচ্ছি।

একটু পরে সীতা বলল-হ্যালো।

মনোরম কিছু বলতে পারে না প্রথমে।

 সীতার গলাটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে–কে?

 মনোরম চোখ বুজে, আস্তে আস্তে বলে যায়–মেরিলি র্যাং দ্য বেল, অ্যান্ড দে ওয়্যার ওয়েড…

কে? চিৎকার করে ওঠে সীতা!

মনোরম ফোন রেখে দেয়।

ডিভোর্সের পর এক বছর পূর্ণ হয়ে গেছে কবে! সময় কত তাড়াতাড়ি যায়।

.

সীতা সব ফিরিয়ে দিচ্ছে। খুশি হবারই কথা মনোরমের। মামার গাড়িটা নিয়ে বীরুকে তাড়া করতে করতে এক সময়ে ক্লান্তি লাগে তার। পিছু-নেওয়া ছেড়ে সে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় অন্য রাস্তায়। আপনমনে ঘুরে বেড়ায়।

ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে এল চাঁদনি চকে। তার দোকানটা এখানেই। নেমে সে দোকানঘরে উঠে এল। মনোরমের আমলে সাকুল্যে চারজন কর্মচারী ছিল। এখন বেড়েছে। পুরনোর কেউ নেই। চমৎকার সানমাইকা লাগানো কাউন্টার, দেয়াল ডিসটেম্পার করা, ডিসপ্লে বোর্ড, কাঁচের আলমারি। সীতার দাদা ব্যবসা ভালই বোঝে। অনেকটা বড় হয়েছে দোকান। রমরম্ করে চলছে। ভাল জামাকাপড় পরা একজন অল্পবয়সি ছোকরা কাউন্টারের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনোরমকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললবলুন।

মনোরম গ্রাহ্য করল না। চারদিকে চেয়ে দোকানঘরটা দেখল। দোকানের নাম এখনও এস ব্যানার্জি প্রাইভেট লিমিটেড। সীতা এখনও ব্যানার্জি নামে সই করে। আপনমনে একটু হাসে মনোরম। কাউন্টারের ছেলেরা চেয়ে থাকে।

বাইরে একটা টেম্পো থেমেছে। কুলিরা মাল তুলে দিয়ে যাচ্ছে দোকানে। ছেলেটা ওপাশটায় গেল।

একা দাঁড়িয়ে থাকে মনোরম। এই দোকান-টোকান সবই সে উপহার দিয়েছিল সীতাকে। কিছু আয়কর ফাঁকি দিয়েছিল বটে, তবু তার ব্যবসাটা ছিল পরিষ্কার, দাগহীন এবং সৎ। এ সব আবার তাকে ফিরিয়ে দিলে সীতা তাকে ভুলে যেতে পারবে। পারবে কি?

কেন ভুলতে দেবে মনোরম? দেবে না। সে ফিরিয়ে নেবে না কিছুই। বিছানায় যখন মানস বুকে পড়বে সীতার ওপর, একদিন চুপি চুপি ঠিক মানসের শরীরে ভর করবে মনোরম। ভূতের মতো। থাক। মনোরম কিছুই ফিরিয়ে নেবে না। তার চেয়ে সে বিশ্বাসের অন্ধকার, বিপজ্জনক ব্যবসায় নেমে যাবে।

একটু দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বেরিয়ে এসে গাড়ি ছাড়ে সে। মনটা হঠাৎ ভাল লাগে। আজ সে সম্পূর্ণ দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিতে পারল।

সমীরকে ফোন করল সে।

-শুনুন, আমি বিজনেস ফেরত নেব না। কিছুই নেব না।

–কেন মনোরম?

-শুনুন, আপনি হয়তো ঠিক বুঝবেন না ব্যাপারটা। তবু বলছি। সীতা ব্যবসা কেড়ে নিয়ে আমার ক্ষতিই করতে চেয়েছিল। ম্যানেজারি থেকে বরখাস্ত করেছিল আমাকে। কিন্তু তাতে ক্ষতি কিছু হয়নি। আমি মরে যাইনি। সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা মানুষের হয় তা টাকাপয়সার নয়, বিষয়-সম্পত্তিরও নয়। মানুষ হারায় তার সময়।

-কী বলছ, বুঝতে পারছি না।

–আমার হারিয়েছে, ক্ষতি হয়েছে কেবলমাত্র সময়ের। সীতা আমার বিজনেস ফিরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু হারানো সময়টা কে ফিরিয়ে দেবে? এক বছরে আমার বয়স বেড়ে গেছে ঢের। কিছু শুরু করব আবার, তা হয় না। আমি পারব না। ওকে বলে দেবেন।

–তুমি আর একবার ভেবে দেখো।

–একবার কেন? আমি আরও বহুবার ভাবব, সারাজীবন ধরে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। আমি আমার এক বন্ধুর ব্যবসায়ে নামছি। ব্যবসা বন্ধুর, আমি সেখানে চাকরি করব। অ্যান্ড দ্যাটস অল।

ফোনটা করে খুবই শান্তি পায় মনোরম।

.

–তুই আমাকে ছেড়ে যেতে চাস ঝুমু? মামা একদিন ক্লান্ত বিষণ্ণ গলায় বলে। মামার রোগা চেহারাটা আরও একটু ভেঙে গেছে। চোখের নীচে মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম কালো রেখা সব ফুটে উঠেছে। সম্ভবত শিগগিরই আবার স্ট্রোক হবে মামার।

বীরুর সঙ্গে পাল্লা দিতে আমি কি পারি মামা? ওর কত কম বয়েস, কত স্পিড ওরা কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে বরু! আমি কি পারি পাল্লা দিতে? আমার বয়সও হল।

কিন্তু তুই-ই বীরুকে ফেরাতে পারিস। আমি দেখেছি ও তোর সঙ্গে কথাটথা বলে, হাসে, ঠাট্টা করে। অবিশ্বাস্য। ও যে কারও সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে পারে তা জানতামই না। আমার বড় আশা ছিল, তুই কিছু একটা পারবি।

মনোরম একটু ভেবেচিন্তে বলে–মামা, বীরুর পিছু-নেওয়ার চাকরি একদিন তো শেষ হবেই। একদিন বীরু ঠিকই ব্যবসা-ট্যবসা বুঝে নেবে। তখন আমার চাকরিও শেষ হয়ে যাবে।

-না। তোকে আমি ম্যানেজার করব।

–কেন করবে? আমি যে কাঠের কিছুই জানি না। কিছুই শিখলাম না। বীরু মালিক হলে যে আমাকে রাখবে তারও কিছু ঠিক নেই। বয়সও হয়ে যাবে ততদিনে। পথ বন্ধ হয়ে যাবে সব। তার চেয়ে এখনই আমাকে ছেড়ে দাও।

–যেখানে যাচ্ছিস সেখানেও তো চাকরিই করবি।

–প্রথমে তাই কথা ছিল। পরে আমি কষাকষি করে আমাকে ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে নিতে রাজি করিয়েছি। কমিশন পাব।

-কীরকম ব্যবসা?

–ব্ল্যাক। ভীষণ কালো। জাল-জোচ্চুরি-স্মাগলিং সবই আছে।

যাবি?

 যাব না কেন? আমার এ বয়সে আর ভাল বা খারাপ কিছু হওয়ার নেই।

–যাবিই? বীরুর একটা কিছু ব্যবস্থা করে যা। ওকে ফেরা।

–কোথায় ফেরাব মামা? আমার তো ওকে কিছু শেখানোর নেই। ও আমার চেয়ে দশগুণ বেশি পড়াশুনো করেছে। অনেক বেশি বুদ্ধিমান। ভয়ংকর আত্মবিশ্বাসী। ওকে আমি কোথায় ফেরাব? ও আমাকে উড়িয়ে বেরিয়ে যাবে। বরং ও-ই আমাকে টেনে নিচ্ছে ওর দিকে। দেখো, এই বয়সে আমি লম্বা চুল আর জুলফি রাখছি, পরছি বেলবটমের সঙ্গে পাঞ্জাবি। আর কিছুদিন বীরুর পিছু নিলে আমিই বীরু হয়ে যাব।

–আর কিছুদিন থাক ঝুমু। আমার জন্যই থাক।

–আমার বাড়িভাড়াটা এখনও বাকি পড়ে আছে মামা।

–আজই নিয়ে যাস। ভূপতিকে বলে রাখছি। থাকবি? কিছুদিন?

–দেখি। বিশ্বাসকে একটা খবর দিয়ে দিতে হবে। ওরও স্ট্রোক, খুব ভেঙে পড়েছে। সময় দিতে চাইছে না।

–ওই বিপদের ব্যবসাতে কেন যাবি ঝুমু?

–কিছু তো করতেই হবে মামা। ওপনিং কোথায়? বাজার তো দেখছ! তা ছাড়া বিপদই বা কী, সবাই করছে।

মামা খুব গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আস্তে করে বলে–তোর সঙ্গে তো তেমন সম্পর্ক ছিল না আমার। আজকাল আত্মীয়তার গিট তো আলগা হয়েই যাচ্ছে। কিন্তু এ কদিনে তোর ওপর আমার মায়া পড়ে গেছে ঝুমু। তুই চলে যাবি ভাবলে বুকটা কেমন করে। আমি কেবল তোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করলাম। তোর দিকটা ভাবিনি। ঝুমু, তোর জন্য কী করব বল তো?

কী করবে? আমার খুব অসময়ে তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল।

–স্ট্রোক-ফোক হলে ওই সেন্টিমেন্টটা খুব বেড়ে যায়, জানিস? ভীষণ বেড়ে যায়। স্ট্রোক হচ্ছে গাড়ি ছাড়বার ফাস্ট ওয়ার্নিং, তখনই মানুষ গাড়ির জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বেশি করে আত্মীয়দের মুখ দেখে নেয়।

-চুপ করো। বিরক্ত হয়ে মনোরম উঠে যায়। কাঠগোলার পিছনে একটু পরিষ্কার জায়গায় গিয়ে সিগারেট ধরায়। করাতকলের মিষ্টি ঘসটানো শব্দটা আসে।

.

বর্ষা যায়। শরৎ যায়। শীত আসি-আসি করে। বিশ্বাস ফোনে তার ফিসফিস স্বরে বলে–ব্যানার্জি, আর কত সময় নেবেন? আমি আর পারছি না।

আর কটা দিন, বিশ্বাস। মনোরম বলে–আর একটু সময় দিন।

সময় কে কাকে দেয় মশাই! সময়ের কি ট্রানজাকশন হয়? সময় ফুরোয়। ব্যানার্জি, একটা ফাইনাল কিছু বলুন। অন্য লোক নিতে ভরসা হয় না। এ ব্যবসাতে ফেইথফুল তোক না হলে..আমি আর কত অপেক্ষা করব ব্যানার্জি? টেল সামথিং।

একটু, আর একটু…

.

আজকাল প্রায় একটা জিনিস লক্ষ করে মনোরম। বীরু মাঝে মাঝে তার ফিয়াট দাঁড় করায় ওষুধের দোকানের সামনে। কী যেন কিনে আনে, তারপর আবার গাড়ি ছাড়ে। প্রায় দিনই, প্রতিদিনই বীরু আজকাল কাটা করে।

কী কেনে ও? ঘুমের ওষুধ নয় তো!

মনোরম সতর্ক হতে থাকে। একদিন বীরু ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়ি ছাড়ল। মনোরম গাড়ি থেকে নেমে ঢুকল দোকানটায়।

একটু আগে যে লম্বা ছেলেটা এসেছিল, ও কিছু কিনল?

কাউন্টারের আধবুড়ো লোকটা কাগজ পড়ছিল। মুখ তুলে একটু বিস্ময়ভরে বলে।

কী?

–অনেকগুলো ট্রাংকুলাইজার, কয়েকটা ঘুমের ওষুধ, নিউরোসিসের জন্য কয়েক রকমের বড়ি।

প্রেসক্রিপশন?

 –ছিল না। এ সব কিনতে আজকাল আর প্রেসক্রিপশন লাগে না। সবাই নিজের নিজের ডাক্তার।

অসুখটা কী?

 লোকটা মাথা নাড়ল–কে জানে মশাই! জিজ্ঞেস করছেন কেন?

কারণ আছে। ও একটু ডিসব্যালান্সড।

লোকটা নিজের নাকটা মুঠোয় ধরে বলল–এ সব ড্রাগই আজকাল মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে। রোগটা বোধহয় পাগলামি। দেশে পাগল বাড়ছে।

মনোরম বেরিয়ে আসে। আকাশ ভরা রোদ। এখন হেমন্তকাল। কলকাতা এখন পাখির বুকের মতো কবোষ্ণ। গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে তার কাঁধে ব্যথা, কোমর ধরে আছে, মাথা ভার। হেমন্তের সুন্দর আলোতে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় একটু হেঁটে বেড়াতে পারলে বেশ হত। কিন্তু জগদ্দল গাড়িটা রয়েছে সঙ্গে আর সামনে উধাও বীরু।

ক্লান্তভাবে আবার গাড়িতে ওঠে সে। ছাড়ে। ক্লান্তিহীন বীরু কি ধরা পড়ল বয়সের হাতে? নাকি অসুখ? কিংবা কর্মফল? ওষুধ কিনছে। পাগলামির ওষুধ, নার্ভের ওষুধ, ঘুমের ওষুধ! বড় অবাক কাণ্ড। মনোরমের ভ্রূ কুঁচকে যায়। চিন্তিতভাবে সে চেয়ে থাকে সামনের রাস্তায়। চলন্ত গাড়িটা গিলে ফেলছে রাস্তাকে।

.

রাতে খুব জ্যোৎস্না ফুটেছে আজ। সেটা টের পাওয়ার কথা নয়। বীরুর পিছু পিছু অনেক রাত পর্যন্ত ধাওয়া করে করে অবশেষে প্রায় রাত সাড়ে বারোটায় বীরুর গাড়ি ঢুকল রিচি রোডে। তখন লোডশেডিং। সেই অন্ধকারে হঠাৎ বানডাকা জ্যোৎস্না দেখতে পেল মনোরম।

অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বীরু গাড়ি দাঁড় করাল না আজ। একটু এগিয়ে গেল। বাঁ ধারে একটা মস্ত ফাঁকা পার্ক। হিম পড়েছে। কেউ কোথাও নেই। বীরু নামল। দুধের মতো সাদা পোশাক পরেছে বীরু। সাদা ঢিলে বুশশার্ট, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো। জ্যোৎস্নায় ওর লম্বা, সাদা অবয়বটা অপ্রাকৃত দেখায়।

গাড়ি ফেলে রেখে বীরু লম্বা পায়ে রেলিং ডিঙিয়ে পার্কে ঢুকল। খুব ধীরে হাঁটছে। মাঠের মাঝখানে চলে গেল। দাঁড়াল। আড়মোড়া ভাঙছে। স্লো-মোশন ছবির মতো নড়াচড়া করছে। জ্যোৎস্নায় এবং কুয়াশায় একটু আবছা। গাড়ির অন্ধকারে বসে মনোরম দেখতে থাকে। বীরু এক-পা এক-পা করে দৌড়ে ক্রিকেটের বোলারের মতো হাত ঘোরাল। ব্যাটসম্যানের মতো মারল বল। দু পায়ে একটি জটিল দ্রুত নাচ নেচেই থেমে যায়। ডিসকাস ছোঁড়ার ভঙ্গি করে। তারপর ধীরে, খুব ধীরে হাঁটে, ঠিক যেমন চাঁদের মাটিতে নীল আর্মস্ট্রং হেঁটেছিল। ঘুরে দাঁড়ায় আবার। স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু মনে হয় যেন চেয়ে আছে মনোরমের গাড়ির দিকেই। দেখছে।

মনোরম গাড়ির দরজা খুলে নামল। গরম জামা পরেনি, একটু শীত করে। রেলিংটা টপকায় মনোরম। হাঁটতে থাকে। কী জ্যোৎস্না, কী জ্যোৎস্না! নীলাভ হলুদ কুয়াশায় মাখা স্বপ্নের আলো। সেই আলোতে ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা অপরিচিত মানুষের মতো লম্বা সাদা অবয়ব বীরুর। স্থির দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে মহাকাশের সাদা পোশাক।

বীরু।

–এসো। ভাবছিলাম, তোমাকে ডাকব।

–তুই জানিস যে আমি তোর পিছু নিই?

আগে জানতাম না। কদিন হয় জানি। জেনেও প্রথম ভেবেছিলাম অচেনা কেউ চেজ করছে। তাই একটু চমকে গিয়েছিলাম। তারপর লক্ষ করলাম, তুমি।

–আমার দোষ নেই। মামার অর্ডার।

–বাবা কিছু জানতে চায়?

চায়।

আমাকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতাম। এত কষ্ট করতে হত না তোমাকে।

 কষ্ট কী? এটাই আমার চাকরি।

বুঝতে পারছি। তোমার জন্য কষ্ট হয়।

মামা যেদিন তোর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবে, সেদিন আমার এ চাকরিটা শেষ হবে। তখন হয়তো আমি কাঠগোলার ম্যানেজারি পাব। নয়তো একটা বাজে, বিপজ্জনক অসৎ ব্যবসাতে নেমে যাব। ও দুটো চাকরির চেয়ে এটা বোধ হয় একটু বেটার ছিল। তবে ক্লান্তিকর। তুই বড্ড স্পিডি।

বীরু তেমনি ধীর ভঙ্গিতে একটু হাঁটছে এদিক ওদিক। অদ্ভুত প্রাকৃতিক আলোতে ও হাঁটছে বলে মনে হয় না। যেন একটু জমাট, লম্বাটে একটা কুয়াশায় তৈরি ভৌতিক মূর্তি দুলে দুলে যাচ্ছে।

বাবা কোনওদিনই আমার সব জানতে পারবে না।

–সেটা মামা স্বীকার করে না। কিন্তু বোঝে। তাই আমাকে লাগিয়েছে মামা। তার বিশ্বাস, আমি তোমাকে বুঝব। তোর পিছু নিয়ে নিয়ে আমি এখন পাক্কা জেমস বন্ড হয়ে গেছি।

বীরু হাসল। মসৃণ কামানো গালে জ্যোৎস্না ঝিকিয়ে ওঠে একটু।

–তুমি কী বুঝলে? শান্ত স্বরে জিগ্যেস করে বীরু।

–কিছু না।

–কী বুঝতে চাও?

–তুই ওষুধ কিনছিস কেন? ও সব ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া খাওয়া খুব ডেঞ্জারাস।

আজকাল সব ওষুধের পোটেন্সি এত কমিয়ে দেয় ওরা যে কাজ হয় না।

 ধীরে ধীরে হেঁটে বীরু একটু দুরে যায়। আবার দুলে দুলে কাছে আসে। মনোরমের ভয় হয়, বুঝি বীরু জ্যোৎস্না আর কুয়াশায় হঠাৎ মিলিয়ে যাবে।

বিয়ে করবি না বীরু?

—করব হয়তো কখনও।

–গৌরীকে করিস।

বীরু হাসল। বলল–তুমিই গৌরীর প্রেমে পড়ে গেছ।

-বোধহয়। তুই বলেছিলি কষ্ট হওয়াকেই ভালবাসা বলে। আমারও কষ্ট হয় ওই মেয়েটার জন্য।

–বিয়ে করে কী হবে?

–আমি তোর অনেক কিছু নকল করেছি বীরু। পোশাক, চুল, জুলফি, গাড়ির স্পিড। তোর পিছু নিয়ে নিয়ে তোর কাছে শিখেছি অনেক। কেবল তোর জুয়েলটিটা শিখতে পারছি না। তুই এ মেয়েটাকে ভাল না বেসে পারিস কী করে?

টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশে তাকিয়ে থাকে বীরু। প্যান্টের পকেটে দুই হাত। একটুক্ষণ স্থির থাকে।

–আমি খুব নিষ্ঠুর?

 –মনে হয়।

–ইদানীং আমি খুব নেশা করছি। গাঁজা, আফিং, এল-এস-ডি, কিছু বাকি নেই। কিছু হয় না তাতে।

–কেন করছিস?

টু ফরগেট সামথিং।

–কী?

 –তুমি আমাকে নিষ্ঠুর বলছ? কেন? তুমি আমার কতটুকু জানো?

–কিছুই না। বীরু, আমার মনে হচ্ছে দিনে দিনে তুই আমার আরও অচেনা হয়ে যাচ্ছিস। এখনই তোকে আমার পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, যেন বা তুই অন্য গ্রহের লোক। আমি তোর মতো হার্টলেস হতে চাই। আমাকে শিখিয়ে দে।

বীরু হাসে। যথারীতি কোমল জ্যোৎস্নার লাবণ্য ওর কেঠো মসৃণ গালে এক ফোঁটা মোমের মত ঝরে পড়ল। বলল-কেন হার্টলেস হতে চাও?

মনোরম বলে–আমরা কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে পাগল হতাম। এখনও দ্যাখ, বউয়ের দুঃখ ভুলতে পারি না। তুই কত মেয়েকে ভুলে যাস, আমি একজনকেই পারি না।

–আমি একটা জিনিস ভুলতে পারছি না।

–কী?

যাদবপুর রেল স্টেশনে এক বান্ধবীকে তুলতে গিয়েছিলাম গাড়িতে, ট্রেনের দেরি ছিল, কথা বলছিলাম দুজনে। ভালবাসার কথা। নকল কথা সব। লাইক কসমেটিকস। ঘুরতে ঘুরতে স্টেশনের একদিকে শেড-এর তলায় গেছি, বান্ধবীটি হঠাৎ দুপা সরে এসে বলল-মাগো, ওটা কী? দেখলাম, একটা বাচ্চা ছেলে শুয়ে আছে ভিখিরিদের বিছানায়। এত রোগা যে ভাল করে না নজর করলে দেখাই। যায় না। ঠিক কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো দুখানা হাত নোংরা কাঁথার তূপ থেকে শূন্যে উঠে একটু নড়ছে, অবিকল সেইরকমই দুখানা পা। এত নির্জীব যে খুব ধীরে ধীরে একটু একটু নড়ে, আবার কাঁথায় লুকোয়। তার গায়ের চামড়া আশি-নব্বই বছরের বুড়োর মতো কোঁচকানো, দুলদুল করছে। হিউম্যান ফর্ম, কিন্তু কী করে বেঁচে আছে বোঝা মুশকিল। চমকে যাই যখন দেখি, তার উরুর ফাঁকে রয়েছে। পিউবিক হেয়ার, পুরুষাঙ্গ। বাচ্চা ছেলের তো পিউবিক হেয়ার থাকার কথা নয়। একটা উলোঙ্কুলো বুড়ি বসে উকুন মারছিল, সে নিজে থেকেই ডেকে বলল–ষোলোবছর বয়স বাবু, রোগে ভুগে ওই দশা। ছেলেবেলা থেকেই বাড়ন নেই।–কিছুই না ব্যাপারটা, কিন্তু সেই থেকে ভুলতে পারি না।

–কেন বীরু?

-কী জানি! কলকাতায় ভিখিরি-টিকিরি তো কত দেখেছি! কত কুঠে, আধমরা, ডিফর্মড। কিন্তু এটা কিছুতেই ভুলতে পারি না। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, চমকে উঠি। পিউবিক হেয়ার সমেত একটা বাচ্চা তার কাঁকড়ার মতো হাত পা নাড়ছে। ভীষণ ভয় করে। যত দিন যাচ্ছে, তত সেঁটে বসে যাচ্ছে ছবিটা মনের মধ্যে। কী যে করি!

মনোরম কী বলবে! চুপ করে থাকে।

বীরু মহাকাশচারীর মতোই চাঁদের মাটিতে হাঁটে। ভ্রূ কুঁচকে বলে–বুদ্ধদেব যেন কী কী দেখেছিল? বার্ধক্য, রোগ, মৃত্যু আর সন্ন্যাস, না?

–বোধহয়।

 –পিউবিক হেয়ার সমেত বাচ্চা ছেলের ফর্ম দেখলে বুদ্ধদেব কী করত বলো তো?

কী জানি!

–পাগল হয়ে যেত। কিন্তু আমি কী করি? কী করি বলো তো?

–কী করবি?

–ভাবছি। আস্তে আস্তে অপ্রাকৃত চাঁদের আলোয় ঘুরে বেড়ায় সাদা দীর্ঘ অবয়ব। আস্তে করে বলে–নিষ্ঠুর নই, বুঝেছ? বাড়ি যাও।

-কেন?

–আমি একটু একা থাকি।

পকেটে হাত, চিন্তিত মুখটা নোয়ানো, বীরু আস্তে আস্তে কুয়াশার শরীর নিয়ে ঘোরে। গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার সময়ে দূর থেকে দৃশ্যটা অস্পষ্ট দেখে মনোরম।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়