ধীরে ধীরে ঘুম কমে যাচ্ছে বিশ্বদেবের। আটান্ন বছর বয়সে তার স্বাস্থ্য রীতিমতো পেটানো। মেদের বাহুল্য নেই। তেমন কোনো রোগ নেই। অসুখ-বিসুখ নেই। তবে হ্যাঁ, চিন্তা আর টেনশন যথেষ্ট আছে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশ্বদেব রীতিমতো যোগব্যায়াম করে, সকালে নিয়ম করে হাঁটে, নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে সিটিং দেয় এবং দীক্ষা নেওয়ার কথাও সিরিয়াসলি ভাবছে। তার বউ রুচিরা একটু উন্নাসিক মহিলা। আর্ট, কালচার, মার্গসংগীত ইত্যাদি তার প্রিয় বিষয়। এ-শহরে তার একটা কালচারাল সেন্টার আছে। সেখানে আর্ট এগজিবিশন, পেইন্টিংয়ের এগজিবিশন, ফ্লাওয়ার শো, বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার ইত্যাদি হয়ে থাকে। মফস্সল শহরে অবশ্য এগুলো তেমন ঢেউ তোলে না। তবে রুচিরা হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয়, ব্যবসায়ী এবং ধনী স্বামীটির চেয়ে সেরিব্রাল ব্যাপারে বা রুচিতে সে অনেক ওপরে। বিশ্বদেব স্ত্রীর এই অহংকারটুকু মেনে নেয়। সস্নেহ প্রশ্রয়ই দিয়ে থাকে। সত্যি কথাটা হল, রুচিরাকে আর তার প্রয়োজনই হয় না। রুচিরা তার মতো আছে থাকুক। বিশ্বদেব ভালোই জানে, তার বিপুল বৈভব রুচিরাকে যে শক্ত জমিটি দিয়েছে তার ওপর দাঁড়িয়েই ওর যত কালচার-গোঁড়ামি।

কাল রাতে ঘুম না হওয়ার কারণ হল রাখী। রাখী কেন মরতে চায় বা কে ওকে মারতে চায়, এটা নিয়ে অনেক রাত অবধি ভেবেছে সে। তবে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তা ছাড়া কাল রাতেই সে আবছাভাবে বুঝতে পেরেছে, তার ছোটো ছেলে বাবলুর সঙ্গে রাখীর একটা ভাব-ভালোবাসার সম্পর্ক রচিত হয়েছে। সেটা যে কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না, এটাও তার দুশ্চিন্তার বিষয়। কাজেই আজ সকালে বেশ ক্লান্ত বোধ করছে বিশ্বদেব।

আজ সকালের অবসাদ তাকে মর্নিং ওয়াকে পর্যন্ত যেতে উৎসাহিত করেনি। সকালে সামনের চওড়া বারান্দায় শীতের রোদে বেতের সোফায় বসেছিল সে। সামনে চমৎকার বাগান। গাড়ি-বারান্দাটি অর্ধচন্দ্রাকার, মোরামের রাস্তা চলে গেছে সামনের ফটক অবধি।

ফটক দিয়ে একটা লম্বা চেহারার ছেলে ঢুকল। পরনে জিনসের প্যান্ট, গায়ে শার্টের ওপর জিনসেরই একটা জ্যাকেট। গালে ঘন দাড়ি আর গোঁফ আছে। এ-বাড়িতে লোকের অবারিত দ্বার। কারণ বিশ্বদেবের কাছে সারাদিন নানা কাজে নানা লোক আসে। ফটকে দারোয়ান মোতায়েন আছে বটে, কিন্তু কাউকে আটকানোর হুকুম নেই। শুধু ভিখিরিদের ঢুকতে দেওয়া হয় না, ফটক থেকেই তাদের পয়সা দিয়ে বিদেয় করে দেওয়া হয়। ছেলেটার ডান কাঁধে একটা ঝোলা, শান্তিনিকেতনি ব্যাগ, যার স্ট্র্যাপ ডান হাতের মুঠোয় চেপে রেখেছে সে, বেশ বড়ো বড়ো সতেজ পদক্ষেপে ছেলেটা হেঁটে এসে বারান্দায় উঠল।

আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

 বিশ্বদেব সামনের বেতের চেয়ারটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলল, বসুন।

ছেলেটার বয়স সাতাশ-আটাশ। মুখটা দেখে মনে হয়, খুব রোদে জলে ঘোরে। শরীরটা ছিপছিপে, শক্তপোক্ত, মাথায় অবিন্যস্ত লম্বা চুল। একনজরে দেখে ছেলেটার প্রতি বিরাগ অনুভব করল না বিশ্বদেব। বলল, বলুন।

আপনি আমাকে কতক্ষণ সময় দিতে পারবেন?

কেন, আপনার কি লম্বা কোনো কথা আছে?

 হ্যাঁ, আসলে কথাটা শুধু আমার নয়। পৃথিবীর সব মানুষের।

 বলেন কী? পৃথিবীর সব মানুষের কথা আপনি একা বলবেন?

 ছেলেটা হাসল, তার দাঁতগুলোর সেটিং ভারি চমৎকার।

হাসিটি অতি সরল, বলল ভূমিকাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, মাপ করবেন। আসলে আমার বিষয় হচ্ছে জল।

জল। মাই গুডনেস? জল সম্পর্কে আমার কাছে কেন? যদি আপনার তেষ্টা পেয়ে থাকে, তাহলে অন্য কথা।

আমাকে একটু বুঝিয়ে বলতে দিন। আপনি নিশ্চিত জানেন যে, ধীরে ধীরে পৃথিবীর আবহাওয়া গরম হচ্ছে। গ্রিনহাউস এফেক্টের ফলে গ্লোব ওয়ার্মিং সম্পর্কে আজকাল পৃথিবী জুড়েই কথা হচ্ছে, দক্ষিণ মেরুর ওপরে ওজোন স্তরের ফুটো থেকেই আমাদের পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিত।

হ্যাঁ জানি, সেজন্যে আমরা সবাই চিন্তিত।

 বটেই তো। সবাই চিন্তিত, আর সেইজন্যেই আমি ঘুরে ঘুরে আমাদের জলের প্রাকৃতিক উৎসগুলি দেখছি। উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর বরফ গলতে শুরু করলে সমুদ্রের জলস্তর ওপরে উঠবে, পৃথিবীর অনেক স্থলভূমি ডুবে যাবে, অনেক দেশ হয়ে যাবে নিশ্চিহ্ন, তেমনি বিপদ আমাদেরও। হিমালয় এবং অন্যান্য পর্বতমালার হিমবাহগুলি আমাদের বেশির ভাগ নদীর উৎস। হিমবাহগুলি গলে গেলে আমাদের নদীগুলিতে ভয়ংকর প্লাবন দেখা দেবে। একটা নদীর বদলে হাজারটা জলধারা সমভূমিকে প্লাবিত করে সমুদ্রে গিয়ে মিশবে। বিস্তর মানুষ মারা পড়বে। শহরগুলি ভেসে যাবে। কিন্তু তারপর আরও একটা ভয়ংকর বিপদ হবে।

সেটা কী?

 হিমবাহ গলে প্রাথমিক প্লাবনের পর নদীগুলোর উৎস বলে আর কিছু থাকবে না। নদীর খাত যাবে শুকিয়ে। দেখা দেবে সাংঘাতিক জলসংকট। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী কুড়ি ত্রিশ বছরের মধ্যেই এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। হিমালয়ে বরফ বলে যদি কিছুই না থাকে, তবে কী হবে, তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন।

পারছি। কিন্তু আপনি কী করতে চাইছেন?

সময় থাকতেই যাতে কতগুলি ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেইজন্যেই আমি বিভিন্ন মানুষের কাছে যাচ্ছি। ভবিষ্যতের ভয়ংকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমার কিছু প্রজেক্ট আছে। একটা হল যতটা সম্ভব সোর্সের কাছাকাছি বাঁধ দিয়ে হিমবাহের জল আটক করা। দ্বিতীয় প্রজেক্ট হল কয়েকটা নিকাশি খাল বের করা, আর হাইডেল তৈরি করা।

এসব নিয়ে পৃথিবীর বিশেষজ্ঞরা কি ভাবছেন না?

হ্যাঁ, অবশ্যই ভাবছেন, ধরে নিন আমার ভাবনাও তাঁদের প্রতিধ্বনি।

 আপনি কি একজন বিশেষজ্ঞ? টেকনিক্যাল ম্যান?

না। আমি টেকনিক্যাল ম্যান বা অথোরাইজড পারসোনাল নই। তবে আমি একটি কোম্পানিতে চাকরি করি। কনসালটেন্সি ফার্ম, তাদের কাজই হল ডিজাস্টার অ্যান্টিসিপেট করে আগাম ব্যবস্থাপত্র তৈরি করা।

এসব বিগ প্রজেক্টের ব্যাপার, আমি কী করতে পারি বলুন। আমি একটা ছোট্টো শহরের মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান মাত্র।

সেটাও কম কথা নয়। আপনার শহরের ধার দিয়ে আর মাঝখান দিয়ে দুটো ছোট্ট নদী বয়ে গেছে। এদের সোর্স পাহাড়ে। এই সোর্স আমি দেখে এসেছি। আমার মনে হয়েছে, সোর্সের দিকে মাইল দশেক ভেতরে একটা বড়ো ভ্যালি আছে। দু-দিকে পাহাড়, জলটা এখানে আটকাতে পারলে একটা বিশাল ন্যাচারাল বেসিন তৈরি করা যাবে, হাইডেল প্রজেক্টের পক্ষেও চমৎকার জায়গা।

ওটা আমার এলাকা নয়।

 তাও জানি। আমি শুধু বলতে চাইছি, এই এলাকা আপনি খুব ভালো চেনেন। এই প্রোপোজালের এগেনস্টে কোথাও অবজেকশন উঠতে পারে কিনা, সেটা জানতেই আপনার কাছে আসা।

আপনার কোম্পানির নাম কী?

 গ্লোবাল ফ্রেণ্ড ইনকরপোরেটেড।

নামটা চেনা ঠেকছে না।

নামটা শুনে প্রভাবিত হওয়ার মতো বড়ো কোম্পানিও নয়। তবে সরকার এদের অ্যাপয়েন্ট করেছে।

অ্যাপয়েন্ট করেছে মানে কি কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়ে গেছে?

না। আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমাদের কোম্পানি কিছু সাজেশন দেয়। সেটা অ্যাকসেপ্ট করা বা না-করা সরকারের মর্জি, সরকারি বাজেটেরও প্রশ্ন আছে।

আপনারা বাঁধ দেওয়ার কথা বলছেন, ভালো কথা, কিন্তু হাইডেল তো অনেক টাকার ব্যাপার।

বড়ো প্রজেক্টের জন্যে অনেক টাকা দরকার বটে, কিন্তু ছোটো মিনি হাইডেল অনেক কম খরচে করা যায়। আমরা জল সংরক্ষণের সঙ্গে হাইডেলটা সবসময়েই জুড়ে দিই। তার কারণ, ভবিষ্যতে পৃথিবীতে যখন ফুয়েল ক্রাইসিস দেখা দেবে, তখন এই হাইডেলগুলোর গুরুত্ব অনেকগুণ বেড়ে যাবে। উঁচু জায়গা থেকে যে জল নীচে নামবে, তা তো আর আপনা থেকে সোর্সে ফিরে যাবে না। আর তা না গেলে সেইসব সোর্সও শুকিয়ে যাবে। এইসব হাইডেল পাওয়ারের সাহায্যে বাষ্প করে জল আবার সোর্সে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, ভবিষ্যতে এই ওয়াটার সাইকেল ভীষণ প্রয়োজন হবে। ইন ফ্যাক্ট সারাদেশেই আমরা এরকম প্রজেক্টের প্রস্তাব সরকারকে দিচ্ছি।

আপনি টেকনিক্যাল হ্যাণ্ড নন?

না। সেই অর্থে নই।

তাহলে আপনার কোম্পানি আপনাকে এ-কাজে পাঠালো কেন?

ছেলেটি একটু হেসে বলল, বিকজ আই অ্যাম প্যাশনেটলি ইন লাভ উইথ ওয়াটার, জলের চরিত্র বোঝবার জন্য আমি বিস্তর মাথা ঘামিয়েছি। জলের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়েও আমি পত্র-পত্রিকায় কিছু লিখেছি। কোম্পানি আমাকে সেইজন্যই চাকরি দিয়েছে, তবে আমার রিপোর্ট ফেভারেবল হলে কোম্পানির বিশেষজ্ঞ আর আমিনরাও আসবে।

আপনার নাম?

অলোক চক্রবর্তী।

ক্রেডেনশিয়ালস দেখাতে পারেন?

কেন পারব না? বলে অলোক তার ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা ল্যামিনেট করা আইডেনটিটি কার্ড বের করে বিশ্বদেবের হাতে দিল।

বিশ্বদেব ভ্রূ কুঁচকে কার্ডটার দিকে চেয়ে বলল, আপনার ডেজিগনেশন এগজিকিউটিভ। এ শব্দটা খুব ধোঁয়াটে। কোম্পানিতে আপনার পজিশনটা ঠিক বোঝা গেল না।

ওটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আমি সামান্য বেতনভুক লো-লেভেল কর্মচারী মাত্র।

সরকার যখন আপনার কোম্পানিকে অ্যাপয়েন্ট করেছে, তখন ধরে নিতে হবে আপনার কোম্পানি এলেবেলে নয়। এখন বলুন, আপনি এখানে ঘুরে কী অ্যাসেসমেন্ট করলেন। ফেভারেবল?

হ্যাঁ, খুবই ফেভারেবল। তবে উপত্যকায় কিছু পাহাড়ি মতো গ্রাম আছে, জলাধার হলে সেগুলো ডুবে যাবে। ওই লোকগুলোর পুনর্বাসন দরকার হবে। অবশ্য প্রজেক্ট হলে লোকে কাজও পাবে।

সরকার প্রজেক্ট করার কথা ভাবে ঠিকই, কিন্তু টাকায় কুলিয়ে উঠতে পারে না।

ঠিকই তো। তা ছাড়া এদেশে জোনাল সেন্টিমেন্ট এবং পক্ষপাত আছে, মন্ত্রীরা যে যার নিজের রাজ্য বা এলাকার ডেভেলপমেন্ট করতে চায়। বাধা আছে। তবে তা নিয়ে সরকার মাথা ঘামাবে।

আপনি কতদিন হল এ-শহরে এসেছেন?

প্রায় একমাস।

এতদিন খবর দেননি কেন?

খবর তৈরি হলে অবশ্যই দিতাম। স্পটগুলো ঘুরে দেখে তবেই আপনার কাছে এসেছি।

কোথায় উঠেছেন?

প্রথমে রূপকথা হোটেলে উঠেছিলাম। তারপর পাহাড়ে চলে যাই, শাওন নামে একটা গাঁয়ে এক চাষি পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন কাটাই। তারপর হায়ার অলটিচুডে তাঁবুতে থাকতে হয়। গতকাল আমার কাজ একরকম শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে দিল্লি থেকে আমার দু-জন সহকারীও এসে গেছেন। ফলে আমরা পেরেরা সাহেবের বাড়িটা ভাড়া নিয়েছি।

পেরেরার বাংলো?

হ্যাঁ।

তিনজনের জন্যে অত বড় বাড়ি নিয়ে কী করবেন? ভাড়াও তো অনেক।

 আমাদের কোম্পানির টেকনিক্যাল হ্যাণ্ডরাও এসে পড়বেন।

বুঝতে পারছি আপনি এক মাসের মধ্যে অনেক কাজ করে ফেলেছেন। কিন্তু আমি কেন জানতে পারলাম না সেটাই ভাবছি।

আমার কাজ ছিল বাইরে, গাঁয়ে, জঙ্গলে আর পাহাড়ে। তাই খবরটা আপনার কাছে আসেনি। তবে হয়তো আমারই উচিত ছিল সব কথা আপনাকে জানানো।

বেটার লেট দ্যান নেভার। এ শহরের যারা এমিনেন্ট পারসোনালিটিজ খবরটা তাদেরও জানানো দরকার। তাই না? ধরুন আপনারা চেষ্টা করলেন, সরকার প্রস্তাবটা মানতে চাইল না। সেক্ষেত্রে এই শহরের মানুষ একজোট হয়ে, আণ্ডার প্রপার লিডারশিপ, সরকারের ওপর প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারে। প্রজেক্ট যদি সত্যিই হয় তাহলে আমাদের শহরটার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে।

অলোক একটু হাসল, কিছু বলল না।

বিশ্বদেব বলে, তাই নয় কি?

অলোক একটু উদাস গলায় বলে, মুশকিল কী জানেন, সবাই নিজের লোকালিটিস নিয়ে ভাবে। গোটা দেশটা নিয়ে ভাববার লোক ক্রমে কমে যাচ্ছে।

আরে মশাই, আপনি তো আচ্ছা লোক। আপনিই তো বললেন যে, এই জায়গাটা আপনার প্রজেক্টের পক্ষে খুবই সুইটেবল। তাহলে এখন আবার অন্যরকম বলছেন কেন?

অলোক একটু গম্ভীর হয়ে বলে, ভারতবর্ষে নদীর অভাব নেই। সব নদীকেই ঠিকমতো ব্যবহার করলে এবং জলকে কাজে লাগালে গোটা দেশটারই চেহারা পালটে ফেলা সম্ভব। এই প্রজেক্টটা হলে শুধু আপনার শহর নয়, অনেকটা এলাকা জুড়ে একটা পরিবর্তন ঘটবে। হ্যাঁ, আপনার প্রস্তাবটা আমি মানছি। শহরের ইমপর্টেন্ট লোকদের ব্যাপারটা জানানো উচিত এবং প্রয়োজন। আমি বহিরাগত এবং এখানকার বাসিন্দা নই। আমার কথা লোকে শুনবে না বা উলটো বুঝবে। যদি দয়া করে আপনি এটা করেন তাহলে ভালো হয়।

সেটা সহজ কাজ। একটা মিটিং কল করলেই হবে। কিন্তু তার আগে প্রজেক্টের একটা ব্লু প্রিন্ট বা সারভে রিপোর্টের অফিসিয়াল কপি আমার হাতে আসা চাই।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি জানি, আপনি নিজের সোর্স থেকেও খবর পেয়ে যাবেন। তবে আপনাকে এটুকু বলতে পারি যে, কোম্পানি আমার রিপোর্ট অ্যাপ্রুভ করেছে। তাদের সুপারিশ দিল্লির সরকারি দফতরে জমাও পড়ে গেছে। কাজ অনেকটা এগিয়েছে বলেই আমি আপনার কাছে এসেছি।

বুঝেছি। একটু বসুন, চা খান।

না না, ফর্মালিটির দরকার নেই। আপনি আমাকে অনেকটা সময় দিয়েছেন। ধন্যবাদ।

আরে মশাই। বসুন তো। কথা আছে।

অলোক উঠতে গিয়েও একটু হেসে বসে পড়ল।

আপনি পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরেছেন। আমার কাছে খবর আছে যে, ওখানে একস্ট্রিমিস্টরা ডেরা বেঁধেছে। আপনি বিপদে পড়েননি?

অলোক ফের হাসল। বলল, দু-তিনবার বিপদ হয়েছে বটে, তবে একস্ট্রিমিস্টরা গোঁয়ার বা হ্যাঁবিচুয়াল খুনি নয়। তারা আমাকে দুবার ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের ডেরায়। চোখ বেঁধে এবং পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে। ভাগ্য ভালো যে তাদের আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পেরেছি।

আপনার প্রোটেকশন নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। যে সাহসটা দেখিয়েছেন তাতে খুন হয়ে যেতে পারতেন।

আমাকে অন্যান্য জায়গাতেও এই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। খানিকটা অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয়, এরা কেউ সাইকোপ্যাথ কিলার নয়। প্রয়োজনে খুন করে ঠিকই, কিন্তু লোক বুঝে। আর প্রোটেকশন কে দেবে বলুন, এদের কাছে পুলিসও অসহায়। পাহাড় জঙ্গল ওরা নিজের করতলের মতো চেনে, পুলিশ চেনেনা। আমাকে মাঝে মাঝে এটুকু রিস্ক নিতেই হয়।

বিশ্বদেব হাসল, বলল, আপনার মতো বয়সে আমিও রিস্ক নিতে ভালোবাসতাম। কিন্তু আজকাল কেন যেন ভয় জিনিসটা বেড়ে গেছে। একটু আধটু রাজনীতি করি, সেটাই বোধহয় কাল হয়েছে। একটু চা খান। চা, না কফি?

যেকোনোটা। আমার নেশা নেই, চয়েসও না।

 রিমোট কলিংবেল টিপে চায়ের সংকেত ভিতর বাড়িতে পাঠিয়ে দিল বিশ্বদেব। তারপর

বলল, আগামীকাল একবার আসতে পারবেন?

কখন বলুন।

 সন্ধ্যের পর। ধরুন সাতটা বা সাড়ে সাতটা।

পারব।

আপনার কাগজপত্রও আনবেন। দেখি যদি ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতে পারি।

ভাববেন, অবশ্যই ভাববেন। পৃথিবীর যে সংকট ঘনিয়ে আসছে তা নিয়ে সিরিয়াসলি আমাদের ভাবা উচিত। কয়লা, ডিজেল পোড়ানো, এসি চালানো, কলকারখানার অত্যধিক বিস্তার, গ্রিনহাউস গ্যাসের যত এমিশন হবে তত বাড়বে ওয়ার্মিং, তত বাড়বে পলিউশন, প্লিজ একটু ভাববেন।

বিশ্বদেব মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যই।

চা নিয়ে এল বলরাম, এ-বাড়ির কাজের লোক, ট্রে টেবিলে রেখে বলল, মা একটু ডাকছেন আপনাকে।

বিশ্বদেব অলোকের দিকে চেয়ে বলল, আপনি চা খান, আমি এখনই আসছি।

বাইরের ঘরেই অপেক্ষা করছিল রুচিরা। বলল, ছেলেটা কে বল তো। কী চায়?

কেন? একটা কাজে এসেছে।

চেনো?

চিনতাম না, তবে চেনা হল।

হুটহাট অচেনা ছেলেছোকরার সঙ্গে দেখা করার দরকার কী? গুণ্ডার মতো চেহারা।

 গুণ্ডা। কী যে বল। গুণ্ডার মতো হবে কেন?

কী জানি বাপু, স্বস্তি ঘুরে গিয়ে বলল, মা, দেখোগে যাও, বাবার সঙ্গে একটা গুণ্ডার মতো ছেলে দেখা করতে এসেছে।

দুর। ও একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে। কিছু খারাপ নয়। আমি তো লোক চরিয়েই খাই, নাকি?

দেখো বাপু, দিনকাল ভালো নয় কিন্তু।

হঠাৎ ওকে দেখে স্বস্তি ভয় পেল কেন? ছেলেটাকে তো আমার বেশ ভালোই লাগছে, শিক্ষিত ছেলে, ভাবনাচিন্তা করে।

চেহারাটা দেখে অবশ্য খারাপ বলে মনে হচ্ছে না আমারও। স্বস্তি কী ভেবে বলল কে জানে।

রুচিরা ভিতরে চলে যাওয়ার পর বিশ্বদেব বারান্দায় এসে দেখে অলোক একইভাবে বসে আছে। চা ছোঁয়নি। গভীরভাবে অন্যমনস্ক।

চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে মশাই, খেয়ে নিন।

অলোক একটু চমকে উঠে বলল, হ্যাঁ, নিই।

আপনাকে কোনো সাহায্য করার দরকার হলে বলবেন, সাধ্যমতো চেষ্টা করব।

তা জানি, এখানে সকলে আপনার প্রশংসাই করে। আপনি এ শহরের জন্য অনেক কিছু করেছেন।

কী আর করলাম বলুন। টাকা নেই, কো-অপারেশন নেই, কো-অর্ডিনেশন নেই, প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টে করাপশন। ইচ্ছে থাকলেও ভালো কিছু করা প্রায় অসম্ভব। কনডিশন ফেভারেবল হলে এ শহরের ভোল আমি পালটে দিতে পারতাম।

চায়ের কাপটা রেখে অলোক বলল, এবার আমি আসি?

বিশেষ তাড়া আছে নাকি?

একটু আছে। নার্সিং হোমে একজনকে দেখতে যাব।

কোন নার্সিং হোম?

 অলোক হেসে বলে, আপনার নার্সিং হোম।

 ওঃ, কে বলুন তো?

হেডমিস্ট্রেস মৃন্ময়ী ভট্টাচার্যের মেয়ে রাখী।

বিশ্বদেব একটা ঢোঁক গিলে বলে, আপনি ওঁদের চেনেন?

 সামান্য আলাপ আছে। দিদিমণি আমাকে কয়েকটা ব্যাপারে সাহায্য করেছেন।

ও, আচ্ছা আসুন।

কাল আমি সন্ধ্যেবেলা কাগজপত্র নিয়ে আসব।

 হ্যাঁ, আসবেন।

 অলোক চলে যাওয়ার পর বিশ্বদেব খানিকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়