১০.

বাড়িতে ঢুকেই কালু বুঝতে পেরেছিল, জায়গাটা গরম আছে। তার মতো লোকের ঘরে ঢুকে মস্তানরা যখন হুটোপাটি করে গেছে তখন বুঝতে হবে কেস খারাপ।

মা প্রথম দিকে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছিল, একটু বাদে দম ফুরিয়ে ঘ্যাজর-ঘ্যাজর করতে লাগল।

সেদিকে মোটে কানই দিল না কালু। বলল, ফালতু বাত ছেড়ে কাজের কথাটা বলে লে দিকি। কী হয়েছে কী?

তোকে যমে নেয় না কেন বলবি?

অরুচি বলে নেয় না। কারা এসে হান্নাক করে গেছে?

সে গিয়ে তোর পেয়ারের লোকদের জিজ্ঞেস কর গে। আমি কি সবাইকে চিনে রেখেছি? নাহক হাবুকে আর ভুতুকে ধরে এই মার কি সেই মার! কেবল জিজ্ঞেস করে, কালু কোথা বল। আমি ঠেকাতে গেলাম তো আমাকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। কনুই ছড়ে এখনও রক্ত পড়ছে।

হাবু ভুতু কই?

তারা থানায় গেছে।

কালুর মাথাটা ঠিক নেই। বড্ড ঘোট পাকাচ্ছে চার দিকে। বলল, কাউকে চিনতে পারিসনি?

হাবু বলছিল একজন নাকি বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। সে সুরেন খাঁড়া না কে যেন!

 কালু সময় নষ্ট করল না। সোজা উঠোনে গিয়ে কচুগাছের গোড়ার মাটি খামচে তুলে ফেলল। তলায় একটা প্লাস্টিকের খামে তার টাকা। সেটা তুলে পকেটে পুরে সে গিয়ে মাকে বলে, আমি পাতলা হচ্ছি। খুঁজিস না। বাড়িতে থাকলে শালারা আবার আসবে।

কী করেছিস বল! নইলে কুরুক্ষেত্র করব।

 চেঁচাস না। জানাজানি হলে আমিও যাব, তুইও যাবি।

ভয় পেয়ে মা চুপ করে যায়।

 কালু অপথ কুপথ ঘুরে স্টেশনে চলে আসে। বিশে গনগনে আঁচে বেগুনি ভাজছে। কালু গিয়ে সোজা সেখানে বসে পড়ে বলে, গাড়ায় পড়ে গেলাম।

বিশে এক খদ্দেরকে বিদেয় করে বলে, আজ মাল খাওয়াবি বলেছিলি।

 মাইরি খাওয়াব। আমাকে দু-একদিন থাকতে দিবি?

বিশে হেসে বলে, থাকার জন্য স্টেশন আছে।

কালু মাথা নেড়ে বলে, তা ঠিক।

 গাড্ডা কী?

 বাড়িতে হামলা করছে শালারা।

কারা?

আছে।

 রামরতন রিকশাওয়ালা চপ কিনতে এসে কালুকে দেখে হাটুর গুতো দিয়ে বলে, অ্যাই শালা! তোকে নাকি স্বশুরবাড়ি ঘুরিয়েছে?

কালুর মেজাজ ভাল নেই। উঠে সটাং করে এক চড় কষাল রামরতনের গালে। বলল, জল ভরে দেব শালা। গেলবারে গুপ্তর দোকানের মাল সরিয়ে তুমি শ্বশুরবাড়ি ঘোরোনি?

রামরতন বেশি ঘাটাল না। কালু একা নয়, বিশে আছে। বিশে মহা মারকুট্টা ছোকরা। স্টেশল্পে ভিখিরিদের দঙ্গলটা দরকার মতো বিশের পক্ষ নেয়। বিশে ওদের ভাজা বেসনের কুঁড়ো আর নিংড়ানো মুড়ি দিয়ে হাতে রাখে। তাই রামরতন গালে হাত বুলিয়ে বলল, খচছিস কেন?আমিশালা ভাল কথা বলতে গেলাম।

কালু আর বসল না। বিশেকে বলল, আমি সাঁজের পর আসব।

 বিশে মাথা নাড়ে।

কালু স্টেশন রোড ধরে সোজা হাঁটা দেয়।

ঘুরে-ফিরে কোথাও যাওয়ার নেই দেখে সন্তুদের বাড়ির কাছে চলে আসে কালু। এসে দেখে নরেশবাবুদের বাড়ির সামনে জটলা হচ্ছে। দোতলা থেকে নরেশের মোটা গিন্নির চেঁচানি আসছে, সব জানি, সব জানি। ঢাক পিটিয়ে সবাইকে বলব তোমার চরিত্রের কথা।

সন্তু নীচের তলায় ছিল। কালুর এক ডাকে বেরিয়ে এসে বলল, চল। তোর সঙ্গে কথা আছে।

দুজনে সিংহীদের বাগানে ঢুকে পড়ে।

সবেদা গাছটা ন্যাড়া করে ফল ছিঁড়ে নিয়ে গেছে পাড়ার ছেলেরা। সেই গাছের তলায় বসেস গম্ভীর মুখে বলে, তুই এ রকম ডে-লাইটে ঘুরে বেড়াচ্ছিস?

তাতে তোর বাবার কী?

 মুখ খারাপ করিস না কালু।

কালু হেসে বলে, রং লিস না সন্তু। আমি কাউকে ভয় খাই না।

সন্তু কালুর দিকে ভ্রু কুঁচকে একটু চেয়ে থেকে বলে, যখন প্যাদানি খাবি তখন বুঝবি।

কালু বলল, ছোড় বে।

সন্ত চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, ঠিক আছে। তোর ভালর জন্যই বলছিলাম।

আমার ভাল নিয়ে তোর মতো ভদ্রলোকদের ভাবতে হবে না। আগে বল কী বলতে চেয়েছিলি।

সন্তু অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে। তুই পুলিশকে গগনদার নাম বলেছিস?

 আমি বলব কেন?

 তবে কে বলেছে?

 তার আমি কী জানি? গগনদাকে ফাঁসিয়ে আমার কী লাভ?

কিন্তু সবাই জানে তুই গগনদার নাম বলেছিস। গগনদা কাল পালিয়ে গেছে।

কালু এটা জানত না। একটু থমকে গিয়ে একগাল হেসে বলে, লাগ ভেলকি লাগ। খুব জমে গেল মাইরি।

সন্তু একদৃষ্টে চেয়ে ছিল।

হঠাৎ কালু মুখ গম্ভীর করে বলল, সুরেন শালাকে আমার বাড়ি চোল কে বল তো?

তার আমি কী জানি!

জানিস না?

আমি জানব কী করে?

 আমার বাড়িতে সুরেন গিয়ে হামলা করেছে কেন তা জানিস?

সন্তু স্পষ্টই অস্বস্তি বোধ করছিল। তবু খুব তেজের গলায় বলে, ও সব আমার জানার কথা নয়।

সুরেন আমার কাছে কী চায় তাও জানিস না?

না।

এর আগেও সুরেন আমাকে একবার মেরেছে। শালা জানে না, কালু রিকশাওয়ালা হলেও মেড়া নয়। শালার দিন ঘনিয়ে এসেছে।

ও সব আমাকে বলছিস কেন?

আমার সন্দেহ হচ্ছে, কেউ সুরেনকে আমার বাড়ির পাত্তা লাগিয়েছে। নইলে আমার বাড়ি নোর কথা ওর নয়।

আমি ঠিকানা দিইনি।

কালু খুব হীন চোখে সন্তুর দিকে চেয়ে বলে, কাল তুই আমাকে ছোরা চমকেছিলি, মনে আছে?

সন্তু জবাব দেয় না। অন্য দিকে চেয়ে থাকে।

কালু বলে, আমি কিছু ভুলি না।

সে তোকে মারার জন্য নয়। ভয় দেখানোর জন্য!

কালু হাত বাড়িয়ে বলে, ছুরিটা দেখি।

কাছে নেই।

কালু এক্কেবারে আচমকা লাফিয়ে উঠে পটাং করে একটা লাথি লাগাল সন্তুর থুতনিতে। লাথিটা তেমন জোরালো হল না। কালুর শরীরে এখন আর তত তেজ বল নেই। সন্তু শালা ভাল খায়-দায়, গগনের কাছে ব্যায়াম শেখে। শক্ত জান, তবু আচমকা লাথি খেয়ে মুখ চেপে মাটি ধরে নিল।

কালু সময় নষ্ট করে না। পড়ে-থাকা সন্তুর প্যান্টের পকেটে হাত চালিয়ে মালটা বের করে ফেলে। বিলিতি ছুরি, কল টিপলে ছ ইঞ্চি ইস্পাত বেরিয়ে আসে পটাং করে।

সন্তু যখন উঠল তখন কার হাতে ফলাটা জমে গেছে। চকচক করছে রোদে। কালু বলল, দেখ শালা, আমার জানের পরোয়া নেই। দরকার হলে আমি লাশ ফেলব। ঠিক করে বল, সুরেনকে কে আমার বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে।

দাত বসে গিয়ে সন্তুর ঠোঁট ফেটে হাঁ হয়ে আছে। অঝোর রক্ত। হাতের পিঠে ক্ষতস্থান মুছে নিজের রক্ত দেখল সত্ত্ব। তারপর খুব ঠান্ডা চোখে চাইল কালুর দিকে!

কাল কখনও ছুরি চালায়নি, সন্তু জানে। এও জানে, কালুর শরীরে কিছু নেই। তবে রোখ আছে।

হিসেব করতে কয়েক পলক সময় নিল সন্তু। গগনের কাছে সে বিস্তর পাঁচ শিখেছে।

সন্তু কী করল তা চোখে ভাল দেখতেও পেল না কালু। কিন্তু হঠাৎ টের পেল তার ছুরির হাতটা মুচড়ে ধরে সন্তু তাকে উপুড় করে ফেলেছে। পিঠে হাঁটু চেপে বসিয়ে মাথাটা ঠুকবার তাল করছে মাটিতে।

কালুর লাগে না। মারধর সে বিস্তর খেয়েছে। প্রায়ই খায়। মুহূর্তে সে হাঁটুতে ভর দিয়ে পটাং করে শরীরটা ছুঁড়ে দিল উলটোবাগে। সন্তু ছিটকে গেল।

দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। তারপর প্রচণ্ড আক্রোশে ছুটে আসে পরস্পরের দিকে। কালুর হাতে আধলা ইট, সন্তুর হাতে ছুরি।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়