॥ সাত ॥

পৌনে সাতটা বাজেনি এখনও। বাজছে প্রায়। সাততলার ঘরের শার্সি দিয়ে দেখা যায়, কলকাতার ওপরকার আকাশটা মস্ত বড়। আকাশে তারা ফুটছে। শহরটা অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, আলোয় আলোয় তিলোত্তমা।

বসবার ঘরটা অন্ধকার। কিংবা ঠিক অন্ধকার নয়। একটা রঙিন কাচের ঢাকনার ভিতরে শূন্য শক্তির আলো জ্বলছে। জানলার পর্দা সরানো। বাইরে চাঁদ। ঘরের ভিতরে জ্যোৎস্নার চৌকো চাঁপা রঙের আলো পড়ে আছে। আর ঝড়ের মতো বাতাস।

দেবাশিস একা ভূতের মতো বসে আছে। তার পরনে বাইরে যাওয়ার পোশাক। সামনে দুটো ঠ্যাং ছড়ানো, সোফার কাঁধে হেলানো মাথা। ছাদের দিকে মুখ। দুটো হাত অসহায়ভাবে দুদিকে পড়ে আছে। সে তৃণার কথা ভাবছে। জলস্রোত উলটোপালটা, পালে পাগলা বাতাস, তবু বিপরীতগামী দুটি নৌকো একটা অন্যটার সঙ্গে জুড়ে গেল। বাঃ। বেশ।

তৃণা ও ঘরে সাজছে। তারা বেড়াতে যাবে। তৃণা যেতে চায়নি। শরীরটা আজ ভাল নেই। দেবাশিস বলেছে, বেড়ালে মনটা একটু হালকা হয়। তোমার তো শেকড়ের প্রবলেম আছে।

তৃণা বেড়াতে ভালবাসে না। তার প্রিয় অভ্যাস ঘরের কোণে একা থাকা। ছবি আঁকবে, কবিতা লিখবে,বই পড়বে, গান শুনবে। কেউ কথাটথা বলতে এলে বিরক্ত হয়। রোগে ভুগে ভুগে ছেলেবেলা থেকে ওর ওই অভ্যাস হয়ে গেছে।

ফোনটা বাজছে। দেবাশিস হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিল।

হেল্লো।

মহিলাকণ্ঠে কে বলল, দেবাশিস দাশগুপ্ত আছেন?

বলছি।

ওঃ। দাদা…

ফুলি। ফুলির গলা টেলিফোনে কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে। ভীষণ ভয় খেয়ে গেল দেবাশিস। শরীরটা ঝিম ঝিম করে উঠল বিদ্যুৎ স্পর্শে। রবির কোনও কিছু হয়নি তো!

ফুলি! কী হয়েছে?

তুমি ফিরেছ! বাঁচা গেল। রবি সেই থেকে বাবাবাবা করছে। দু’বার ফোন করেছিল।

কী হয়েছে?

কিছু না। কী হবে? অত ভেবো না তো। রবি আছে আমার কাছে আর আমি অনেক ছেলেপুলের মা।

দেবাশিস বিরক্ত হয়ে বলে, কী ব্যাপার বলবি তো!

রবি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। বলছে বাবা কেন দেরি করছে ফিরতে।

মন খারাপ নাকি!

না না। দস্যিপনা করছে সব সময়ে। বেশ আছে।

ওকে ফোনটা দে।

একটু পরেই রবির গলা শোনা গেল–বাবা।

বলল। ভারী স্নিগ্ধ হয়ে গেল দেবাশিসের গলা।

আমরা বেড়াচ্ছি।

কোথায়?

ট্যাক্সি করে বেরিয়েছি। এখন আছি শ্যামবাজারে।

সঙ্গে কে আছে?

মণিমা, পিসেমশাই, নিন্‌কু…

এনজয় ম্যান।

বাবা, আমার বই, জামা, প্যান্ট খেলনা, সব কবে পাঠাবে?

কাল প্রীতম দিয়ে আসবে।

এখান থেকেই স্কুলে যাব তো?

যেয়ো।

আর দিদি আমার কাছেই থাকবে তো বাবা? দিদি গল্প না বললে আমার খাওয়া হয় না। মণিমা বলেছে, চাঁপা থাকুক।

থাকুক।

তুমি রাগ করোনি তো বাবা?

রাগ? না রাগ করব কেন?

আমি যে মণিমার কাছে চলে এলাম।

তা বলে রাগ করব কেন?

তুমি যে আমাকে ছাড়া থাকতে পারো না।

দেবাশিস একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, পারি বাবা। পারতে তো হবেই।

নিন্‌কু বলছিল–তোর বাবা তোকে ছাড়া একা একা ভয় পাবে দেখিস। আমাদের বাড়িতে কি ভূত আছে বাবা?

ভূত? কে তোমাকে ভূতের কথা শেখাচ্ছে? ভূত-টুত আবার কী?

থাপি বলছিল।

কী বলছিল?

রবি বোধ হয় একটু লজ্জা পায়। একটু থেমে বলে, বাবা মানুষ মরে গেলে তো ভূত হয়। তাই—

তাই কী?

থাপি বলেছে। আমি না।

কী বলেছে?

বলেছে মা মরে গিয়ে নাকি ভূত হয়ে আছে ও বাড়িতে।

ও সব বাজে কথা রবি। ও সব বিশ্বাস করতে নেই।

বুড়োদাও বলেছে— ও বাড়িতে আর যাসনে রবি। গেলে তোর মা ঠিক তোর ঘাড় মটকে দেবে। ভূতেরা নাকি যাদের ভালবাসে তাদের মেরে নিজের কাছে নিয়ে যায়।

ছিঃ রবি। এ সব কথা শিখলে তোমাকে আমি ওখান থেকে নিয়ে আসব।

দিদিও আমাকে কত ভূতের গল্প বলে।

আমি চাঁপাকে বারণ করে দেব। ও সব গল্প শুনো না!

আচ্ছা। কিন্তু বাবা—

বলল। দেবাশিসের গলাটা গম্ভীর।

আমি যখন আফটারনুনে ফোন করেছিলাম তখন—

তখন কী?

আমার মনে হয়েছিল আমাদের বাড়িতে মা ফোন ধরেছে।

কী যা তা বলছ?

না না, ওটা রং নাম্বার ছিল। কিন্তু যে লেডি ফোনটা ধরেছিলেন তার গলা শুনে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল মার ভূত ঠিক ফোন ধরেছে?

এ রকম ভাবতে নেই। আর ভেবো না।

বাবা, কাল আমি ইস্কুলে যাব না।

কেন?

আমি তো স্কুল ড্রেস আনিনি, বই খাতাও নয়।

দেবাশিস একটু ভেবে বলল, ঠিক আছে। পরশু থেকে যেয়ো। স্কুলে চিঠি লিখে দেব, বাস এবার ওখানে যাবে।

কাল তা হলে ছুটি বাবা?

ছুটি।

তা হলে কোথায় বেড়াতে যাবে বলো তো!

কোথায়?

রবি ফোনে হাসল। কী মিন্ধ কৌতুকের হাসি। বলে, মণিমা বলেছে কাল আমরা তোমার ফ্ল্যাটে বেড়াতে যাব।

দেবাশিস উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, এখানে। এখানে কাল এসে কী করবে? আমি তো থাকব না।

মণিমা বলছে কাল নিজে আমাকে নিয়ে যাবে, আমার সব জিনিস গুছিয়ে আনবে, আর আমাদের ফ্ল্যাটটা সাজিয়ে দিয়ে আসবে।

না, না তার দরকার নেই।

যাব না?

দরকার কী রবি? আমিই পাঠিয়ে দেব।

দাঁড়াও তা হলে, মণিমাকে বলি।

ফোনের মাউথপিসে হাতচাপা দিয়ে রবি ফুলির সঙ্গে পরামর্শ করছে দৃশ্যটা স্পষ্টই দেখতে পায় দেবাশিস। খুবই উদ্বিগ্ন বোধ করে। আর সেটুকু সময়ের মধ্যেই সে ভেবে দেখল তার মহিলা ভাগ্য ভাল নয়। প্রথমবার বিয়ে করেছিল চন্দনাকে। পেটে বাচ্চা সমেত। দ্বিতীয়বার যাকে আনছে তারও বড় বড় ছেলেমেয়ে, স্বামী, সংসার সব থেকে ছিঁড়ে আনতে হবে। কোনওবারই তার সহজ সরল বিয়ে হল না। যেন চুপি চুপি পাপ কাজ সারছে।

রবি বলল, হ্যালো?

বলো।

আমরা কাল যাব না।

আচ্ছা।

রবিবারে যাব।

দেবাশিস হেসে বলে, রবিবারে আমিই যাব।

তা হলে?

তা হলে কি রবি?

আমি আমাদের ফ্ল্যাটে বেড়াতে যাব কবে?

আসবে। বেড়াতে আসবে কেন, এ তো তোমার নিজেরই ফ্ল্যাট। যখন খুশি আসতে পারবে। তবে এ সপ্তাহে নয়।

কাল তা হলে আমরা ট্যাক্সিতে কবে দক্ষিণেশ্বরে যাব।

যেয়ো।

ছাড়ছি বাবা। গুডনাইট।

নাইট।

ফোন রেখে দিল দেবাশিস! ভ্রূ কোঁচকানো মুখটায় চিন্তার লেখা।

অন্ধকার ঘরে, পাশের ঘর থেকে আলো এসে লম্বা হয়ে পড়েছে। সেই আলো পিছনে নিয়ে ছায়ামূর্তির মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে তৃণা।

দেবাশিস অস্ফুট একটা যন্ত্রণার শব্দ করল। যন্ত্রণাটা কোথায় তা বুঝতে পারছিল না।

বলল, রেডি তৃণা?

হুঁ। কিন্তু আমার শরীরটা ভাল নেই।

কী হয়েছে?

কী করে বলব! আজ বড্ড টায়ার্ড।

গাড়িতে তো বসেই থাকবে। খোলা হাওয়ায় দেখো, ভাল লাগবে।

তোমার ফ্ল্যাটে খোলা বাতাসের অভাব নেই।

না, না। চলো প্লিজ। এই ফ্ল্যাটটায় আমার একদম ভাল লাগে না।

কেন, বেশ সুন্দর তো?

কী জানি কেন। বেশিক্ষণ ভাল লাগে না।

তৃণা একটু হাসির শব্দ করে বলে, আমারও কি খারাপ লাগবে দেব?

না। তোমার লাগবে না। আমার তো কতগুলো রিফ্লেক্স আছে। সবই তো তুমি জানো। দেয়ার আর বিটার মেমোরিজ, লোনলিনেস…সব মিলিয়ে একটা সাফোকেশনের মতো হয় মাঝে মাঝে। রবিটারও হত।

রবি ফোনে তোমাকে ভূতের কথা কী বলছিল দেব?

ছেলেমানুষ তো। কে যেন ভয় দেখিয়েছে, ওর মা নাকি ভূত হয়ে আছে এখানে।

তৃণা একটু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হঠাৎ বলল, যখন দুপুরের পরে ফোন করেছিল তখন রবি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল—তুমি কে? মা?

তুমি কী বললে?

কী বলব! মিথ্যে করে বললাম রং নাম্বার।

ঠিকই করেছ।

ও কি ভেবেছিল ওর মায়ের ভূত কথা বলছে?

শব্দ করে হাসল দেবাশিস। বলল, হ্যাঁ। আচ্ছা পাগল আমার ছেলেটা।

শোনো।

কী?

আর-একটু পরে বেরোও। আমি একটু বসি। হঠাৎ মাথাটা কেমন ঝিম করে উঠল।

দেবাশিস এগিয়ে তৃণার হাত ধরে এনে সোফায় বসায় যত্ন করে। নিজে তার পাশে বসে। হাতখানা। ধরে থেকে বলে, তোমার নাড়ি বেশ দুর্বল।

তৃণা ঘাড় এলিয়ে রেখে বলল, আজকের দিনটা কেমন যেন ভাল নয়। বিশ্রী দিন।

উদ্বেগে দেবাশিস ঝুঁকে বলে, কেন তৃণা?

দেবাশিসের কাছে আসা মুখখানা হাত তুলে আটকায় তৃণা। বলে, এক একটা দিন আসে সকাল থেকেই কেবল সব কাজ ভুল হতে থাকে। যেন ভূতে পায় মানুষটাকে।

কীরকম?

দেখ না, কোনও দিনই তো আজকাল রেবার বা মনুর ঘরে যাই না! আজ যেন ভূতে পেল। গেলাম। রেবা হঠাৎ এসে পড়ল, চোরের মতো ধরা পড়ে গেলাম; কী বিশ্রী রকমের ব্যবহার যে করল ও।

তুমি রেবাকে বড্ড ভালবাসো তৃণা।

ভীষণ ভালবাসি। সেইজন্যই তো ও আমার বুক ভেঙে দেয়।

সাতটা কিন্তু বেজে গেছে তৃণা।

দাঁড়াও না। আজ কি একটা সাধারণ দিন। সকাল থেকেই সব অনিয়ম চলছে। অদ্ভুত দিনটি আজ। ঘড়ি-টড়ি দেখো না।

দেখব না। বলো।

তারপর মনু। ওকে বলেছিলাম, ঘরে পৌঁছে দে, শরীরটা ভাল না। তো ছেলে আমাকে জাপটে কোলে তুলে নিল। এমনিতে কথাও বলে না। তবে কেন আজ…? তারপর শচীনবাবু। সেও আজ অন্যরকম। রুমাল কুড়িয়ে দিল…অনেক কথা বলল…

শোনো তৃণা, শচীনকে ফোনটা কিন্তু করা হয়নি।

পরে কোরো।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা তোমার খোঁজ করছে। ওদের কেন অযথা ভাবতে দিচ্ছ?

ভাবুক। একটু ভাবুক। কোনওদিন তো ভাবে না।

না তৃণা। তুমি ভুল করছ। যা করছ তা আরও বলিষ্ঠভাবে করো। চুরি তো করোনি।

তৃণা দেবাশিসের হাতটা ধরে বলল, আঃ! তোমার কেবল ভয়। শোনো না।

দেবাশিস শ্বাস ছেড়ে বলল, বলো।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই আমাকে আজ ভূতে পেল।

সে কী রকম?

ভুল রাস্তায় চলে গেলাম। ঠিক যেন নিশি-পাওয়া মানুষের মতো একটা ছেলে মোটরসাইকেল চালিয়ে গেল, সেই শব্দে চেতনা হয়। তারপরও ফের ভুল। একটা ট্যাক্সিওলা নিয়ে গেল দেশপ্রিয় পার্কে। তাকে ডিরেকশন দিতে মনে ছিল না, রাস্তাটাও খেয়াল করিনি। তাই মনে হচ্ছে, আজকের দিনটা খুব অদ্ভুত।

কী বলতে চাও তৃণা?

তৃণা অন্ধকারেই মুখ ফেরাল তার দিকে। বলল, এক একটা দিন আসে, ভুল দিয়ে শুরু হয়। ভুলে শেষ হয়। ভুতুড়ে দিন।

তৃণা, ভুল দিয়ে শেষ হচ্ছে না। তুমি বড্ড সেকেলে।

দেব। শোনো, আমি শুধু একটাই ঠিক কাজ করেছি আজ।

কী?

শচীনকে বলে আসিনি।

বলে আসা উচিত ছিল। এটাই ভুল করেছ।

তৃণা মাথা নেড়ে বলে, না। বলে আসলেই ভুল করতাম।

দেবাশিস অধৈর্যের গলায় বলে, আমি এক্ষুনি ফের শচীনকে ফোন করছি।

বলেই বাধা না মেনে উঠে গেল দেবাশিস। ফোনের ওপর ঝুঁকে পড়ে অল্প আলোয় ঠাহর করে করে আস্তে আস্তে ডায়াল ঘোরাতে থাকে।

ফোনটা কানে তুলে অপেক্ষা করছে। তৃণা উঠে এল কাছে, ফোনটা নিয়ে নিল হাত থেকে। রেখে দিতে যাচ্ছিল, শুনল ওপাশ থেকে একটা মেয়ের গলার স্বর বলে উঠল, হ্যালো।

রেবা বোধ হয়! তৃণা তাই ফোনটা কানে লাগায়।

 ওপাশে চঞ্চল ও ধৈর্যহীন গলায় রেবা বলছে, কে? হ্যালো! কে?

উত্তর দিতে সাহস হল না তৃণার। কেবল খানিকক্ষণ শুনল!

রেবা চেঁচিয়ে তার বাবাকে ডাকছে, বাপি, দেখো, ফোনটা বাজল, কেউ সাড়া দিচ্ছে না এখন।

 পরমুহূর্তেই শচীনের গলা–হ্যালো।

তৃণা মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে রাখল।

শচীন রেবাকে ডেকে বলল, গোস্ট কল। আজকাল টেলিফোনে যত গোলমাল।

বলেই আবার, শেষবারের মতো বলল, হ্যালো! কে?

কেউ না। আমি কেউ না। এ কথা মনে মনে বলে তৃণা।

দেবাশিস কানের কাছে মুখ নামিয়ে নরম গলায় বলে, তৃণা, বলতে পারলে না?

শচীন ফোন রেখে দিল।

তৃণা মাথা নেড়ে বলল, না। আজকের দিনটা থাক। দিনটা ভাল নয় দেব।

খুব ভাল দিন তৃণা।

না দেব, আজ কোনও ডিসিশন নেওয়া ঠিক হবে না।

তা হলে কী করবে তৃণা?

তা হলে…

তৃণা ভ্রূ কুঁচকে ভাবতে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে ভাবে।

দেবাশিস অপেক্ষা করে উগ্র আগ্রহে।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়