০৬.

কাল থেকে শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছে বৈশম্পায়ন। ডাক্তার বলেছে, রেস্ট নিন। কিন্তু মনে অস্থিরতা থাকলে কী করে মানুষ বিশ্রাম করবে কে জানে।

কালীঝোরার ডাকবাংলো থেকে সেই কবে তিস্তার উপত্যকা দেখেছিল বৈশম্পায়ন! সেই উপত্যকা আর নদী কী করে আস্তে আস্তে হয়ে গেল মৃত্যুর উপত্যকা, মৃত্যু নদী। এত সুন্দর একটি নিসর্গ দৃশ্যকে মৃত্যুর রং মাখিয়েছে কে? সে নিজেই কি? নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে বৈশম্পায়ন।

আলিপুরদুয়ার কোর্টে সে বেশ মনের সুখে রাজত্ব করছিল। বাঁশবনে শেয়াল রাজা, বখেরা বাঁধল মানুষের ভাল করতে গিয়েই। বছুরে বন্যার পর সেবার গাঁ গঞ্জে যখন ভীষণ অসুখ বিসুখ দেখা দিল তখন সরকারি ডাক্তারদের অনেক বলে কয়েও সে গ্রামে যেতে রাজি করাতে পারেনি। নতুন চাকরিতে তখন উৎসাহ আর উদ্দীপনায় সে টগবগ করছে। একটা সৎ দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্যই সে ডাক্তারদের গ্রেফতারের আদেশ দিয়েছিল। প্রথম রাউন্ডে জিতেই গিয়েছিল সে। ডাক্তাররা গ্রেফতার হল, জামিন পেল, তাদের বিরুদ্ধে কেস তৈরি করতে লাগল পুলিশ। কিন্তু এই ঘটনায় হুলস্থুল পড়ে গেল কলকাতায়। কাগজে খবর বেরোল। প্রতিক্রিয়াটা হল বিশাল রকমের। আলিপুরদুয়ারের ডাক্তাররা এই ঘটনার প্রতিবাদে রুগি দেখা বন্ধ করে দিল। সে এক বিশাল হই-চই। পুরো ব্যাপারটাই তার হাতের বাইরে চলে গেল, যখন একটি বড় রাজনৈতিক দল লেগে গেল পিছনে। ঢোজই অর অফিসে আর বাড়িতে মিছিল আসতে লাগল। গদি ছাড়ো, গাব্যাক ইত্যাদি ধ্বনি দিত তারা। দু দফায় আটচল্লিশ ঘটা করে ঘেরাও থাবল সে।চিতু নামে একটা ছোকরা প্রায়দিনই মিছিলে বক্তৃতা দিতে উঠে যা খুশি বলত তার উদ্দেশে। তখন বৈশম্পায়নের পাশে পুলিশ নেই, প্রশাসন নেই, একটা লোকও তার পক্ষে নয়। কলকাতা থেকে বড় অফিসার তদন্তে এসে খুব সন্তোষ দেখালেন না বৈশম্পায়নের প্রতি। বৈশম্পায়ন একবার তার নিরাপত্তার কথা তুলেছিল। অফিসার বললেন, পুলিশ প্রোটেকশন তো আছে।

এ অবস্থায় পুলিশ কী করবে? ওরা কো-অপারেট করছেনা।

 তা হলে কলকাতা চলে যান। ছুটি নিন।

 তে-এঁটে, গেঁতো বৈশম্পায়ন তবু ছিল। তখন ডুশকি হবে, তাই শর্মিষ্ঠা ছিল কলকাতায় কাপের বাড়িতে। হঠাৎ টেলিগ্রাম গিয়ে হাজির, শর্মিষ্ঠা সিরিয়াস। কাম শার্প।

বৈশম্পায়ন টেলিগ্রাম পেয়ে পাগলের মতো কলকাতায় রওনা হচ্ছিল। বাধা পেল ঘেরাওরে।

চিতু মধ্যমণি। বৈশম্পায়ন টেলিগ্রামটা তাকে দেখিয়ে মিনতি করল; বড় বিপদ আমার। এ সময়টায় যদি কনসিডার করেন।

চিতু মৃদু হেসে বলল, এটা পুরো ফলস টেলিগ্রাম। চালাকি করবেন না। এসব কায়দা অনেক পুরনো।

তখন শর্মিষ্ঠা ছিল ভীষণ প্রিয়, অকল্পণীয় আপন। সেই শর্মিষ্ঠা বাঁচে কি মরে ঠিক নেই, আর কতগুলো ইদুর তাকে আটকে রাখবে? বৈশম্পায়ন মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। লাফিয়ে গিয়ে টুটি টিপে ধরেছিল চিতুর; তোকে আজ খুন করে ফেলব শুয়োরের বাচ্চা।

হাসপাতালে যখন সংজ্ঞাহীন থেকে আধো চেতনায় ফিরে আসছিল বৈশম্পায়ন তখনই সে জীবনে প্রথম শুনেছিল মৃত্যু-নদীর গান। চারদিকে হিম সাদাঁ অনড় পাথর, নির্জন উপত্যকা আর উৎস ও মোহনাহীন এক নদী। সেই থেকে নদী সঙ্গে আছে। দপ করে চেতনা জুড়ে জেগে ওঠে। তখন সংসারের সব কিছুই অর্থ হারিয়ে ফেলে।

চিতু মিথ্যে বলেলি। টেলিগ্রামটা ফলসই ছিল বটে। সে যখন আলিপুরদুয়ারের হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, তখন কলকাতার এক নারসিং হোমে নিরাপদে শর্মিষ্ঠা আট পাউন্ডের স্বাস্থ্যবান একটি ছেলে প্রসব করেছে। ডুমকির জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই এল বৈশম্পায়নের জীবনে পরিবর্তন। ডুমকি লক্ষ্মীমন্ত ছেলে।

রাতে দুটো কামপোজ খেয়েছিল বৈশম্পায়ন। তবু যে, খুব ভাল ঘুম হয়েছে এমন নয়। শরীরে গভীর ক্লান্তি, মনে হাজার বছরের স্মৃতির ভার। ডাক্তার বলেছে ওভারওয়ার্ক, টেনশন, প্রেশার একটু কম।

কিন্তু আসলে তা তো নয়।

শর্মিষ্ঠা আজও বেরোচ্ছে পুজোর বাজার করতে কলাত্র এক তরঙ্গ সুবিধে করতে পারেনি। বুবুম থাকবে বাচ্চা বি সাবিত্রীর কাছে। বৈশম্পায়নও একটু একা হতে চাইছে জীবনে একার জন্য একটু সময় করে নেওয়া যে কত প্রয়োজন।

শোওয়ার ঘরে কাপড় বদলাতে এসে শর্মিষ্ঠা বলে, আজ আর একদম সিগারেট খাবে না।

হু। বালিশে মুখ ঢুকিয়ে রেখে বৈশম্পায়ন জবাব দেয়।

হু নয়, একদম খাবে না।

 আচ্ছা।

আমার যদি দেরি হয় তবে সাবিত্রী তোমাকে খেতে দেবে। খেয়ে নিয়ো।

আচ্ছা।

শর্মিষ্ঠা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখের প্রসাধন সেরে নিল। এবার শাড়ি পরবে। স্টিলের আলমারির দরজা ঘড়াম করে খুলে শাড়ি বাছতে বাছতে বলল, ঝিনুক একটু অন্যরকম। আমাদের মতো নয়। না?

বৈশম্পায়ন জবাব দেয় না।

কাল অতক্ষণ ওদের বাড়িতে বসে থাকলাম ও কিন্তু একদম পাত্তা দিতে চাইছিল না! অথচ এক একদিন দেখলে এমন করে যেন হারানিধি ফিরে পেয়েছে।

বৈশম্পায়ন এবারও জবাব দেয় না।

শর্মিষ্ঠা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ওদের সম্পর্ক কেমন গো?

কাদের?

ঝিনুক আর মাধববাবুর?

খুব ভাল। দুজন দুজনকে চোখে হারায়।

 শর্মিষ্ঠা মাথা নেড়ে বলে, আমার মনে হয় না।

 নাই বা হল, তাতে ওদের কিছু যায় আসে না।

তুমি তো সব ভাল দেখো। আমার মনে হয় ওদের সম্পর্কটা খুব কোল্ড।

 তুমি জানো না।

ওরা স্বামী স্ত্রী আলাদা খাটে শোয়। জানো?

 জানি! ওটাই আজকালকার ফ্যাশন।

একসঙ্গে না শুলে আবার স্বামী স্ত্রীর ভালবাসা কী? আমি তা কিছুতেই পারব না।

একসঙ্গে শোওয়াটাই কি ভালবাসা?

তা নয়। তবে ভালবাসা থাকলে আলাদা শোওয়ার কথা ভাবাই যায় না।

তোমার সব অদ্ভুত যুক্তি। বৈশম্পায়ন একটু হাসে, খাট আলাদা বলেই কি মনও আলাদা?

শর্মিষ্ঠা রেগে গিয়ে বলে, তোমরা পুরুষরা কিছু বোঝে না। কেবল তত্ত্ব দিয়ে সব জিনিসকে বিচার করো। মানুষ তো থিয়োরি নয়। তার অনেক ব্যাপার আছে। আমি কাল পুনমের সঙ্গে কথা বলেও বুঝলাম, ওদের সম্পর্ক তেমন ভাল নয়।

গোয়েন্দাগিরি করছিলে?

একে গোয়েন্দাগিরি বলে না। ওদের ফ্ল্যাটটা অত সুন্দর, অত সাজানো, ওদের অত টাকা, দেখলে মনে হয় ভাগ্য যেন ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু বেশি ভাল তো ভাল নয়। তাই ভাবছিলাম কোথাও একটু গোলমাল আছেই।

তাই ঝিয়ের কাছে খোঁজ নিচ্ছিলে?

 খোঁজ আবার কী? কথা বলছিলাম। বলতে বলতে অনেক কথা ফাঁস হয়ে গেল।

কী কথা ফাঁস হল?

 মাধববাবু নাকি আজকাল খুব মদ খায়।

 বরাবরই খেত।

 আজকাল বেশি খায়।

না, বরং ঝিনুকের শাসনে আজকাল কমিয়েছে।

তুমি জানো না।

আমি তোমার চেয়ে বেশি জানি।

শর্মিষ্ঠা আপস করে বলল, আচ্ছ সে না হয় মানলাম। কিন্তু ঝিনুক নাকি একদম বাসায় থাকতে চায় না। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

তাতে কী?

বোঝো না কেন? অত সুন্দর ফ্ল্যাটেও ওর মন বসে না কেন এটা তো ভাববে?

 ও বরাবরই উড়নচণ্ডী।

আচ্ছা বাবা। তুমি যে বিনকের পক্ষ নেবে তা জানতাম। যা ড্যাব ড্যাব করে দেখছিলে ওকে।

 বৈশম্পায়ন একটা ধমক দেয়, বাজে বোকো না। কাল আমার যা শরীরের অবস্থা ছিল তাতে মেরিলিন মনরোর দিকেও তাকানোর মেজাজ ছিল না।

শর্মিষ্ঠা সাবিত্রীকে কাজ-টাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

একা হয়ে বৈশম্পায়ন উঠল। স্টিলের আলমারির মাথায় একটা অব্যবহৃত অ্যাটাটি কেস আছে তার। সব সময়ে চাবি দেওয়া থাকে। সেইটে নামিয়ে খুলল বৈশম্পায়ন। একটা পুরনো মনিব্যাগের খোপ থেকে সোয়া দুই ইঞ্চি বর্গ মাপের ফটোটা বের করে।

ঝিনুক! কী সুন্দর!

যে ভইগল্যান্ডার ক্যামেরায় ছবিটা তোলা সেটাও বহুকাল আগে চুরি হয়ে গেছে। ঝিনুক পরস্ত্রী।

ছবিটা তবু কত জীবন্ত! সাদা ফ্রক পরা ঝিনুক ডান হাত তুলে কোমরের বেল্টটা ঠিক করছে। বা ধারে ঝুলছে বইয়ের ব্যাগ। বব করা চুলে রিবন বাবা। পিছনে লায় বাড়ির দেয়ালে ইটের খাঁজে খাঁজে সালে রোদ আর ছায়ার চৌখুপি। একটা জব চারা। এই তত যেন গত কালকের কথা।

মেজদা!

একটু চমকে বৈশম্পায়ন তাকিয়ে দেখে, ঘরের দরজায় জয়। ভারী লজ্জা পেয়ে ছবিটা বালিশের নীচে লুকিয়ে ফেলতে গিয়ে আরও ধরা পড়ে যায় সে। জয় অবাক হয়ে তাকিয়ে তার বটুকু অপকর্ম লক করল। তবে কোনও প্রশ্ন করল না।

কী খবর? আজ অফিসে যাসনি?

 তুমিও তো যাওনি।

আমার শরীরটা ভাল নেই।

 পাজামা আর গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা জয় ঘরে ঢুকে একটা মোড়ায় বসে বলে, কাল মদনদা এসেছে।

জানি।

 কাল থেকে মদনদার সঙ্গে ঘুরছি। ওঃ, কত মিটিং, কত কনফারেন্স, আর কী সব লোক! জয়ের চোখে একটা সম্মোহিত ভাব!

জয় যে মদনের একজন চামচা তা বৈশম্পয়ান জানে এবং মোটেই ভাল চোখে দেখে না। একটু বিরক্ত হয়েই বলে, ওর পিছনে ঘুরছিস কেন?

মদনদাই বলল, জয় আমার সঙ্গে একটু থাক!

 তাই থাকলি? তোর কাজকর্ম নেই?

কাজকর্ম আবার কী? অফিস তো? তা সেই অফিসের চাকরিও তো মদনদাই করে দিয়েছে। ও চাকরি যাবে না। মদনদার সঙ্গে ঘুরলে খুব তাড়াতাড়ি ফিড ক্রিয়েট হয়।

বৈশম্পায়ন একটু অবাক হয়ে বলে, কীসের ফিল্ড?

পলিটিক্যাল ফিন্ড! গতকাল স্টেট সেক্রেটারির সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা হল। ওয়েস্ট বেঙ্গলে আমাদের পার্টি আবার কেশ শক্ত হয়ে উঠছে। অবশ্য অপোজিশনও আছে। নিত্য ঘোষ মদনদার লিডারশিপ মানতে চাইছে না।

জয় হয়তো ভবিষ্যতে এম পি বা মিনিস্টার হতে চায়। ভেবে বৈশম্পায়ন একটু দীর্ঘশ্বাস ফেল। ভাইদের মধ্যে এই জয়টাই সবচেয়ে গবেট। মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে, বুদ্ধিশুওি তেমন নয়। সু ওই হয়তো একদিন মীটী হয়ে বসবে। কিছুই অসম্ভব নয়। বৈশায়ন কিছু বলার খুঁজে না পেয়ে গম্ভীর মুখে ভ্রূ কুঁচকে বলল, ভাল।

তোমাকে বলতে এলাম, মদনা তোমার সঙ্গে একটু দেখাতে চেয়েছে।

কেন?

বলল, কী দরকার আছে। বহুকাল দেখা হয় না। আজ বিকেলে কেয়াতলায় মাধবদার বাড়িতে রাত্রে তোমার খাওয়ার নেমন্তন্ন। ওখানে মদনদাও আসবে।

মাধবের বাড়িতে! বলে আবার ভ্রূ কোঁচকায় বৈশম্পায়ন। কিন্তু তার বুকের মধ্যে ধক ধক করে ধাক্কা লাগে। ঝিনুক! কী সুন্দর।

একটা খবর শুনেছ মেজদা?

কী খবর?

নব হাটি জেল থেকে পালিয়েছে

সামান্য চমকে উঠে বৈশম্পায়ন বলে, সেই ডেঞ্জারাস ছেলেটা না? যে নীলুকে খুন করেছিল?

হ্যাঁ, একসময় মদনদার হয়ে খুর খাটত। পরে বিট্রে করে।

কী করে পালাল?

জেলখানার লোকদের হাত করেছিল বোধ হয়। মামলার সময় কোর্টেই বলেছিল, জেল থেকে বেরিয়ে প্রত্যেককে দেখে নেবে।

কাকে দেখে নেবে?

যারা ওকে খুনের মামলায় ফাঁসিয়েছে। বলে জয় একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়ে বলে, কেউ-কেউ বলে বটে যে, নব খুনটা করেনি। তবে আমি জানি, করেছিল।

তুই কী করে জানলি?

মদনদা বলেছে।

মামলার সময় তুই কোর্টে যেতিস?

 রোজ। সব সওয়াল জবাব মনে আছে।

নব দোষ কবুল করেছিল?

না। বার বার শুধু বলত, দোস্তকে দোন্ত কখনও খুন করতে পারে? নীলু আমার জিগির রোস্ত

বৈশম্পায়ন মুখ বিকৃত করে বলে, এ খুনটা না করলেও নব আরও বহু খুন করেছে। সে সবের জন্য ওর সাত বার ফাঁসি হওয়া উচিত।

জয় মাথা নেড়ে বলে, সে ঠিক কথা। কিন্তু নীলুর কেসটায় ওর খুব প্রেস্টিজে লেগেছিল। জজকে বলেছিল, আমার হাতে অনেক লাশ পড়েছে। সে সব কেসে আমাকে জেলে দিন, ফাঁসি দিন, কোই বাত নেহি। কিন্তু নীলুর কেসে আমাকে ঝোলাবেন না। আমি আমার দোস্তকে খুন করিনি।

এখন নব জেল থেকে বেরিয়ে কি সোধ তুলবে নাকি?

 জয়ের মুখটা একটু বিবর্ণ দেখায়। তবে গলায় জোর এনে বলে, অতটা কি করবে? কে জানে। তবে নব ক্ষেপে গেলে অনেক কিছু করতে পারে। আজ সকালে খবরটা শোনার পর থেকে মদনদাও একটু ভাবনায় পড়েছে। আর মজা দেখো, গতকালই নবর মা এসেছিল নবর বউয়ের জন্য মদনদার কাছে চাকরি চাইতে।

 মদন কি চাকরি দেবে?

মদনদা তো কাউকে না বলে না। চেষ্টা করবে বলে বুড়িকে কাটিয়ে দিয়েছে। পরে আমাকে বলেছে নবর বউকে চাকরি দিলে পলিটিকাল রি অ্যাকশন খারাপ হবে। কিন্তু আজ সকালে খবরটা পাওয়ার পর মদনদা ডিসিসন চেঞ্জ করেছে।

 চাকরি দেবে?  

চেষ্টা করবে।

রাতারাতি মত পাল্টে ফেলল?

 পাল্টানোই ভাল। নব বেরিয়েছে। কখন কী করে বসে ঠিক নেই। জানের পরোয়া নেই তো।

মদন তা হলে ভয় পেয়েছে?

না না। মদনদা অত ডরায় না। কত খুন জখম পার হয়ে এসেছে।

বৈশম্পায়ন মৃদু স্বরে বলল, হ্যাঁ কিন্তু তখন তো এমপি ছিল না।

জয় কথাটার অর্থ ধরতে পারল না। বলল, তা ছাড়া মদনদার নাগাল, পাওয়া কি সোজা? শ্রীমন্তদা আছে, আমরা কাছি, ভি আই পি বোলএ কথা। চাইলেই পুলিশ এসে যাবে। দুদিন বাদেই যাচ্ছে দিল্লি হয়ে অস্ট্রেলিয়া। নব মদনদাকে পাবে কোথায়?

বৈশম্পায়ন চিন্তিত মুখে বলে, শুধু মদনই তো নয়, আরও অনেকের ওপর নবর রাগ আছে।

সবচেয়ে বেশি রাগ মাধবদার ও। মাধরম্বার চোখের সামনেই তা খুটা হয় নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে তো মধবুদা স্মিথ্যে স্বাক্ষী দেবে না।

বৈশম্পায়ন মাধব আর নীলর সম্পা জানে। কিন্তু সে কিছু বলল না। ব্যাপারটা মাধর চাপা রাখতে চায়। বাইরের কেউ তেমন জানে না। বৈশম্পায়ন জিজ্ঞেস করে মামলায় দুই ছিলি না?

না। আমি কোর্টে যেতায়।

নব তোকে চিনে রাখেনি তো?

জয় হাসে নব আমাকে এমনিতেই চেনে। তবে নীলু হাজরার ব্যাপারে নয়।

তবু সাবধানে থাকিস।

আমার কোনও ভয় নেই। আজ উঠি। তুমি কিন্তু বিকেল-বিকেল মাধবদার রাড়ি চলে যেয়ো।

জয় চলে গেলে বৈশম্পায়ন কিছুক্ষণ নব হাটি মাধব আর মূদনের কথা ভাবৰুর চেষ্টা করল। কিন্তু বাঁধ ভাঙা ঢেউয়ের মতো এল একটাই চিন্তা আজ আবার ঝিনকের সঙ্গে দেখা হবে।

.

০৭.

একজন এম পির উচিত খুব ভোরবেলা উঠে সূর্যোদয় দেখা। একজন এম পির উচিত কিছুক্ষণ পাখির গান শোনা। একজন এম পির উচিত ভোরবেলা কিছুক্ষণ নিরুদ্বেগ চিত্তে বেড়ানো। গুনগুন করে একটু গানও তার করা উচিত। আর উচিত দিনের মধ্যে কিছুটা সময় একা একা থাকা এ সেই সময় যতটা সম্ভব রেখে ঢেকে একটু আত্ম-বিশ্লেষণ করা। একজন এম পির পক্ষে যদি সম্ভব হয় তবে কিছুক্ষণ তার ভুলে যাওয়া উচিত যে, সে একজন এম পি। যদি সে তা পারে তবে একজন এম পির উচিত সুযোগ পেলেই বাচ্চাদের মুখ ভেঙানো।

মদন সাধারণত সকালে উঠতে পারে না। অনেক রাত জেগ্নে কিছু লেখাপড়া করা তার স্বভাব। বস্তুত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একমাত্র রাত বারোটার পর ছাড়া সে এসব করার সময় পায় না। ফলে ভোরবেলা উঠতে প্রায়ই দেরি হয়ে যায় খুব।

আজ ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙল তখনও বেশ অন্ধকার রয়েছে। ঘুম ভেঙেই মদন একেবারে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে। রোজ ঘুম ভাঙার দেড় দুই মিনিটের মধ্যেই তার মনে পড়ে যায় যে, সে একজন এম পি। আজ তা পড়ল না। দিদির রাইরের ঘরের জানালা দিয়ে জাের একটু তাস আসছিল। কাছে পিঠে রুগণ কিছু গাছপালা এখনও আছে। বাতাসে তারই নির্ভুল গন্ধ। রাতে কোনও সময়ে একটু বৃষ্টিও হয়ে গিয়ে থাকবে। ভেজা ভাবটা বাতাসে এখনও রয়ে গেছে। ফলে ভোরবেলাটি খুবই চমৎকার মনে হচ্ছিল মদনের।

সে উঠে টক করে বেসিনে গিয়ে চোখে জলের ঝাপটা মারল কিছুক্ষণ। চোখ কট করে উঠল জ্বালায়। এখনও শরীরে যথেষ্ট ঘুম দরকার। পায়ের দিকে সোফার ওপর কাকের ছেড়ে রাখা ধুতি আর পাঞ্জাবি অভ্যস্ত হাতে এক মিনিটে পরে নেয় মদন। সময় নেই। এই ভোরবেট বৃথা যেতে দেওয়া যায় না।

দিদি, বলে একটা ডাক দিতেই চিরু ঘড়া দেয়, কী রে? বেরোচ্ছিস নাকি?

পার্ক থেকে আসছি একটু ঘুরে। দরজাটা দিয়ে দাও।

 বলেই আর দাঁড়ায় না মদন। বেরিয়ে হন হন করে কালীঘাট পার্কের দিকে হাঁটতে থাকে।

আকাশে বাদলার মেঘ কেটে যাচ্ছে। ওই শুকতারা। মদন একটু চেয়ে দেখল। এঝর দেরিতে বড় বেশি বৃষ্টি হচ্ছে উত্তরে আর পুবে। ভেসে যাচ্ছে, সব ভেসে যাচ্ছে। প্রতিবারই ভাসে এবং তার জন্য কেউ কিছু করে না।

আমি একজন এম পি, এ কথাটা এতক্ষণে মনে পড়ল মদনের। নির্জন রাস্তায় সে একটু শব্দ করেই বলে ওঠে, দ্যাখ শালা মদনাকে দ্যাখ। শালা নাকি এম পি! হেঃ হেঃ!

সতীশ মুখার্জি রোডের পুরনো মসজিদের হাতায় গাছে গাছে পাখি ডাকছে। কে রে পাখি, না ছাড়ে বাসা-খনার বচন না? বাকিটা মনে নেই মদনের। তবে এইটুকু মনে আছে, ডাকে রে পাখি, নাছাড়ে বাসা।

হ্যাঁ বৃষ্টি। খুব বৃষ্টি হচ্ছে এবার। কিন্তু বৃষ্টি হলে আমি কী করতে পারি? মদনা তো ভগবান নয় বাপ, একজন বুরবক এম পি মাত্র। যা, মানছি এম পিরা অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু তা বলে বানভাসি দেশে ডাঙামি বের করার মতো এলেম তার নেই। তবে মদনা ফিল করে বাপ। ফিল করে। পাখিরা ৪ ডাকছে। মদন একবার পুরনো মসজিদটার দিকে তাকিয়ে বলে, দেখে নে শালারা এক আস্ত এম পিকে। তেরা হতভাগারা জামাকাপড় পরতে শিখলি না, পার্লামেন্ট বানাতে পারলি না, হেল লাইফ কেঞ্চল কিচমিচ!

মদন গুনগুন করে উ হু হু উ হ হ করে গাইতে লাগল। তার গলায় সুর নেই। তার জন্য পরোয়া করে না সে। উহহ, উহহ করেই যেতে থাকে।

ডান দিকে পার্ক। কতে গিয়ে মদন একটু দাঁড়ায়। শালারা গাছগুলো কেটেছে। বাচ্চাদের জন্য দোলনা ছিল, স্লিপ ছিল, সেগুলো লোপাট করেছে। ঘাসজমিতে টা ফেলেছে। খানিক জায়গা কেটে নিয়ে রঙ্গশালা বানিয়েছে। কারও কিছু করার নেই। ভেসে যাক, ব ভেসে যাক।

মদন পার্কে ঢুকে পড়ে। ভোর  েহয়ে এসেছে। পার্কে কিছু ভূতুড়ে রের বা কে মর্নিং ওয়াক সেরে নিচ্ছে। মদন তাদের কক্ষপথে নিজেকে ভিড়িয়ে দেয়। উ হু হু গানটাও চলতে থাকে। এই ভেলো পার্কে বেড়াতে আর কে আনন্দ হচ্ছে। যা, খুব আনন্দ হচ্ছে। আনন্দ। নিজেকে এমপি বলে একেবারেই মনে হচ্ছে না তার।

কিন্তু মনে না পড়ে উপায় আছে? ব্যাটারা পড়িয়ে ছাড়ে। ক্যাংলা চেহারার টেকো একটা লোক গাদি খেলার মতো পথ আটকে একগাল হেসে বলল, দাদা মর্নিং ওয়াক-এ বেরিয়েছেন বুবি?

মদন চিনল। তবে নামটা মনে পড়ল না। বলল, এই একটু। তা কী খবর?

আমাকে চিনতে পারছেন তো! আমি হরি গোঁসাই।

হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে। কী খবর?

আজ্ঞে কালকে স্টেশনে যে সেই কথাটা বলেছিলাম, মনে আছে?

কোন কথাটা?

 আমার বিশুকে যদি একটু মেডিকেলে চান্স করে দেন।

মদন টেকো হরি গোঁসাইয়ের মাথার ওপর দিয়ে উদাস চোখে পুবের আকাশের দিকে চেয়ে বলে, কী সুন্দর দেখেছে?

ব্যস্ত হয়ে হরি গোঁসাই বলে, আজ্ঞে কোনটার কথা বলছেন?

 এই ভোরবেলাটা।

 আজ্ঞে তা আর বলতে! খুব সুন্দর।

এই ভোরবেলায় আপনার মনটা উদাস হয়ে যায় না?

খুব যায়। খুব যায়। আমাদের ওকিটা তো প্রায় গ্রামের মতোই। সেখানে যা একখানা করে ভোর হয় না রোজ, কী বলব দার! মনটাকে একদম বৈরাগী বানিয়ে ছেড়ে দেয়। ফাষ্ট বাস ধরে আসতে আসতে আজও খুব উদাস লাগছিল।

মদন বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলে, তু দেখুন বিশুরা আমাদের পিছু ছাড়ে না। উদাস হওয়ার ক্ষেপ থাকলেও কেউ আর উদাস হচ্ছি না, বৈরাগীও না।

হরি গোঁসাই মাথা চুলকে বলে, পিসুকথাটা ঠিক বুঝলাম না দাদা। পিসু পোকা না কি?

না, না। পিসু মানে পিছু। বিতর সঙ্গে মিলে যায় বলে পিসু কথাটা বেরিয়ে গেল।

হরি গোঁসাই চিমটিটা ধরল না। গদগদ হয়ে বলল, আপনার পিসু ছাড়লে আমারে চলবে কেন আমরা হচ্ছি এমোরে আনরিকগনাইজড জনসাধারণ। আমার কথাই ধরুন না। সারা জীবনে একজন মাত্র ভি আই পির কাছে কিছুটা ঘেঁষতে পেরেছি। সেই ভি আই পি হলেন আপনি। আত্মীয় স্বজনের কাছে বড় করে আপনার কথা কত বলি। অফিসেও একটু আধটু খা িপাই।

এই পার্কে আমাকে ধরলেন কী করে?

বাসায় গিয়েছিলাম। দিদি বলল, পার্কে এসেছেন।

মদন ধৈর্যশীল লোকটার মুখের দিকে চেয়ে ভোরের স্বচ্ছ হয়ে আসা আলোয় জনসাধারণকেই দেখতে পায়। এই সেই জনসাধারণ যাদের নিয়ে তার বহু কালের কারবার। এই সেই বিশুর বাব যাদের পিছু পিছু একদিন সে ঘুরেছে, আর যারা এখন তার পিছু পিছু ঘোরে।

মদন একটা শ্বাস ফেলে বলে, শীমন্তর কাছে একটা ডায়েরি আছে। তাতে—

 তাতে লেখানো হয়ে গেছে। হেঁ হেঁ।

ঠিক আছে, দেখবখন।

দেখবেন। সারা জীবন বড় দুঃখে কষ্টে কেটেছে। বিশুটা যদি ডাক্তার হয় তবে শেষ জীবনটা—

 মদন হাসে। বাপদের ছেলেপুলে নিয়ে কত আশাই থাকে! গম্ভীর হয়ে বলে, ও আশা না করাই ভাল।

হরি গোঁসাই হঠাৎ নিভে গেল। মদন উদাস ভাবে চারদিকে চেয়ে হাঁটছে। পিছনে হরি গোঁসাই। বলে, সে কথাটা বশ্য ঠিক।

মদন প্রসঙ্গটা ভুলে গেছে। ভাল মানুষের মতো বলে, কোন কথাটা?

ধন্য আশা কুহকিনী।

ও। হ্যাঁ–

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ! মদন হরি গোঁসাইকে ভুলে গিয়ে উদাস পায়ে হাঁটতে থাকে। এখন আর খুব একটা আনন্দ হচ্ছে না তার। তবে ভালই লাগছে।

পিছন থেকে হরি গোঁসাই গলা খাকারি দিয়ে জানান দিল যে, সে আছে।

দাদার সঙ্গে যে আজ বড় শ্ৰীমন্ত নেই!

পাখিরা অনেকক্ষণ বাসা ছেড়েছে। এখন ঝোপে ঝাড়ে চিড়িক মিড়িক করে ঘুরছে তারা। সূর্য মসজিদ ছাড়িয়ে উঠে পড়ল প্রায়। কলকাতার সব স্নান কুশ্রীতা প্রকট হল। দেখতে দেখতে মদন আনমনে জিজ্ঞেস করে, কে শ্ৰীমন্ত?

আপনার বডিগার্ডের কথা বলছিলাম। দিনকাল তো ভাল না। কালকের খবর শুনেছেন তো?

কীসের খবর? মদনের গলায় এখনও অন্যমনস্কতা।

 নব হাটি জেল থেকে পালিয়েছে?

মদন এবার সচেতন হয়। কিন্তু ইচ্ছে করেই অন্যমনস্কতার মুখোশটা পরে থেকে বলে, কে নব যটি?

দাদা সব ভুলে গেছেন। নব হটি মানে যে লোকটা নীলুকে খুন করল। আর যার মা এসেছিল কাল আপনার কাছে ছেলের বউয়ের জন্য চাকরি চাইতে।

ও! হ্যাঁ।

এ সময়টায় শ্রীমত্তকে একটু কাছে কাছে রাখবেন। নব লোক ভাল নয়। অবিশ্যি—

 মদন উদাস গলায় জিজ্ঞেস করে, অবিশ্যি–

অবিশ্যি নবর এখন আর সেই তেজ নেই নিশ্চয়ই। পুলিশের তাড়া খেয়ে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে। এখন চাচা আপন প্রাণ বাঁচা অবস্থা। তবু…

তবু?

তবু সাবধান থাকা ভাল। আমি কি আর একটু সঙ্গে থাকব দাদা?

 নব যদি এসময়ে আসে তবে ঠেকাতে পারবেন?

টেকো হরি গোঁসাই অপ্রতিভ হেসে বলে, আরে আমি ওসব লাইনের লোক তো নই। তবে চেঁচাতে পারব। খুব চেঁচাব–

পারবেন। তবে একটু চেঁচিয়ে শোন তো! দেখি কেমন পারেন।

লজ্জা পেয়ে হরি গোঁসাই বলে, দাদা কী যে বলেন!

তা হলে কী করে বুঝব যে, চেঁচাতে পারেন?

হরি গোঁসাই মাথা নিচু করে লজ্জার গলায় বলে, পারি কিন্তু।

দেখি কেমন পারেন। চেঁচান, খুব জোরে চেঁচিয়ে বলুন, নব আসছে! ওই নব আসছে! খুন, খুন, খুন করে ফেললে! চেঁচান, চেঁচান।–বলে মদন এক পা পিছিয়ে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে উৎসাহ দিতে লাগল হরি গোঁসাইকে।

হরি গোঁসাই বলল, তা হলে বিশুর মেডিকেলে ভর্তি ব্যাপারটা হবে তো!

 হবে, হবে। ওর বাপ হবে। নইলে কি আর বিশু আমার পিসু ছাড়বে? এখন চেঁচান দেখি!

হরি গোঁসাই থমকে দাঁড়িয়ে গেল! চোখ বুজে মাথায় আর বুকে বার কয়েক হাত ঠেকিয়ে কোনও দেব-দেবীকে প্রণাম করে নিল। তারপর বুক ভরে দম নিয়ে হঠাৎ আকাশ-ফাটানো গলায় চেঁচাতে লাগল, নব আসছে! ওই নব আসছে! খুন, খুন করে ফেললে-এ-এ-এ-এ-এ

মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কাক ডাকতে লাগল, পাখিরা ঝোপ ছেড়ে প্রাণভয়ে উড়ল, প্রাতঃভ্রমণকারীরা সটাসট দৌড়ে গিয়ে রেলিং টপকাতে লাগল, সামনের এক বাড়িতে দড়াম করে জানালা বন্ধ হয়ে গেল। হরি গোঁসাইয়ের যে এত আওয়াজ তা দেখলে বোঝাই যায় না।

মদন অবাক হয়ে বলল, বাঃ। আপনার গলা তো অ্যাসেট।

 বিনীত হাসি হেসে হরি গোঁসাই বলে, আজ্ঞে খুব জোর আওয়াজ হয়। একবার ভিড়ের ট্রেনে শুধু চেঁচিয়ে জায়গা করে নিয়েছিলাম।

হু। মদন গম্ভীর হয়ে বলে।

আর কি চেঁচাতে হবে দাদা?

মদন মাথা নেড়ে বলে, না। এখন তাড়াতাড়ি সরে পড়া দরকার। যা চেঁচিয়েছেন।

আমি তা হলে আসি?

আসুন। একটু পা চালিয়েই আসুন গিয়ে।

 বিশুর তা হলে?

পিস পিসু থাকবে।

বলে মদনও একটু পা চালিযেই পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। কারণ, প্রথম ভয়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে চারদিক থেকে লোক ছুটে আসছে ব্যাপারটা কী তা দেখতে। মদনকে একজন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে দাদা? খুন নাকি? মদন এমনভাবে মাথা নাড়ল যাতে হা’ও হয়, নাও হয়।

একটু বাদে যখন সে জামাইবাবুর মুখোমুখি বসে চা খাচ্ছিল তখন আর তার মুখে উদাসীনতা ছিলনা। জামাইবাবু মণীশ অখণ্ড মনোেযোগে খবরের কাগজ পড়ছে।

জামাইবাবু।

বলো ব্রাদার।

 আপনার চেয়ে খবরের কাগজটা দেখা আমার বেশি দরকার। এবার ছাড়ুন।

তুমি তো এখন পায়খানায় যাবে।

তা গেলেই বা খবরের কাগজ নিয়ে যাব।

যেয়ো। তার আগে যতটা পারি দেখে দিচ্ছি। তোমার ওটা ভারী ব্যাড হ্যাবিট।

কোনটা? খবরের কাগজ পড়াটা?

না, এই খবরের কাগজ নিয়ে পায়খানায় যাওয়াটা।

ব্যাড হ্যাবিট কেন হবে? আমি বরাবর যাই। খবরের কাগজ না হলে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয় না।

দো ইউ আর অ্যান এম পি এবং তোমার সময়ও কম, তবু বলি এটা খুবই ব্যাড হ্যাবিট।

 তা হোক। এবার ছাড়ুন।

 ছাড়ছি। চা-টা খাও না।

চা ফিনিশ।

তবে চিরু না হয় আর এক কাপ করে দিক। ও চিরু! শুনেছ।

 কী অত মন দিয়ে পড়ছেন?

পড়ার কিছু নেই ব্রাদার। সব ছাতমাথায় ভর্তি কাগজ। সেই ছাতমাথাই দেখছি।

আমার প্রেস কনফারেন্সটা দিয়েছে?

 দিয়েছে একটুখানি। পাঁচের পাতার তলার দিকে।

হেডিং কী করেছে?

মালদহের অবস্থা ভয়াবহ। তারপর কোলন দিয়ে তোমার নাম।

 দুর! পলিটিক্যাল ব্যাপারগুলো দেয়নি তা হলো আপনি যে কেন এত কিপটে!

কেন বলল তো! ত্রিশ টাকা কিলোর চা খাওয়াচ্ছি।

 লোকে আরও দামি চা আমাকে খাওয়ায়। চায়ের খোটা দেবেন না। বলছি, মোটে একটা খবরের কাগজ রাখেন কেন?

একটাই পড়ার সময় পাই না।

 তা ছাড়া সেই একটাও আবার বাংলা। বাংলা কাগজে খবর কম থাকে জানেন না?

 তোমার দিদিও একটু পড়ে যে। ও তো ইংরিজি বোঝে না।

এবার থেকে দুটো করে রাখবেন। ইংরিজিটার দাম আমি প্রতি মাসে মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দেব।

এম পি-দের প্রতিশ্রুতির দাম নেই, সবাই জানে। রিস্ক নেওয়াটা কি ঠিক হবে?

চিবু চা নিয়ে এসে মণীশের দিকে চেয়ে বলে, বড় গলায় চায়ের হুকুম দেওয়ার দরকার ছিল না। আমি তো চা করছিলামই।

মণীশ এক গাল হেসে বলে, তা জানতাম। তবু শালার কাছে নিজেকে উদার প্রমাণ করার জন্যই ওটুকু করতে হল।

মদন মুখ গম্ভীর করে বলে, এই বয়সে আর কি নতুন করে আপনার সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টাতে পারবেন? আমি যে প্রথম থেকে জানি আপনি ক্রনিক মাইজার।

অথচ দেখো পাড়াপ্রতিবেশিরা সবাই আলোচনা করে, মণীশবাবু টাকা জমাতে জানেন না। কেবল খরচ করেন, কাছা খুলে খরচ করেন।

আপনার পাড়াপ্রতিবেশীরা স্বপ্ন দেখে। এবার খবরের কাগজটা ছাড়ুন।

বড় জ্বালাচ্ছ হে। যাও না, বাইরের ঘরে সেই কাকভোরে এসে সব বসে আছে, গিয়ে তাদের। সঙ্গে দুটো কথা বলে এসো না। ততক্ষণে…

ওরা বসে থাকার জন্যই এসেছে। তাড়া নেই।

 তোমরা লিডাররা বাপু বড্ড গেরামভারি।

আমি গেরামভারি?

নয়তো কী? লোকেরা বশংবদ হয়ে বসে থাকে, আর তোমরা পায়খানায় বসে খবরের কাগজ পড়ো।

লিডারদের নিয়মই তাই।

এই নাও ব্রাদার! বলে মণীশ খবরের কাগজটা ভাঁজ করে এগিয়ে দেয়, যতক্ষণ না দিচ্ছি ততক্ষণ শান্তিতে চা-টুকু খেতে পারব না।

মদন খবরের কাগজটা খুলতে খুলতে বলে, জামাইবাবু।

উ।

আমি যদি মরে যাই তা হলে কী হবে বলুন তো?

 কেউ বিধবা হবে না।

আর কী হবে?

আমার টেলিফোনটাও হবে না।

আঃ, কী হবে না তা জিজ্ঞেস করিনি। কী হবে তাই জানতে চাইছি।

আসলে তুমি মরবে না।

 কী করে বুঝলেন?

তোমারই বা মরার কথা মনে হচ্ছে কেন? কোনওকালে তো এসব বলোনি! আমরা জানি তুমি হচ্ছে পজিটিভ লোক। এম পিরা এমনিতেই একটু বেশিরকম আশাবাদী হয়। আজহঠাৎ তোমার হল কী?

মদন খবরের কাগজটা খুলতে খুলতে মৃদু হেসে বলে, মৃত্যুর একটা রোমান্টিক দিক আছে, তাই আজকাল মাঝে মাঝে ভাবি মরলে কেমন হয়?

কিছুই হয় না হে।–মণীশ মাথা নাড়ে, মরার মধ্যে রোমান্টিক কিছু নেই, মহৎ কিছু নেই। একেবারে মোটা দাগের ক্যাবলা একটা ব্যাপার। আমাদের দেশে গবা পাগলা বলে একটা লোক ছিল। সে গাইত, মনু রে, বাপের খবর রাখলা না, হ্যায় যে মইরা ভ্যাটকাইয়া রইছে পাছায় পড়ছেজোছনা।

অশ্লীল! অশ্লীল!

মোটেই নয়।—মণীশ মাথা নাড়ে, একদম অশ্লীল নয়। পাছায় জোছনা পড়ার ব্যাপারটা বরং খুবই করুণ। মরা-টরার কথা হলেই আমার গানটা মনে পড়ে।

আপনি যা একখানা জিনিস না জামাইবাবু!

মণীশ উঠতে উঠতে বলে, তুমি পেপার দেখো, আমি বরং ততক্ষণে বাথরুমের দখল নিই গে। তুমি পত্রিকা হাতে ঢুকলে তো পাক্কা দেড় ঘণ্টা।

মণীশ বাথরুমে গেলে কিছুক্ষণ একা বসে আপন মনে ফুটুক ফুড়ক করে হাসল মদন। দিনটা আজ ভালই যাবে। সকালে একটা চেঁচামেচি শুনেছে। বউনিটা ভালই বলতে হবে। তারপর এই জোছনার ব্যাপারটা। দুপুরে আজ রাইটার্সে দু’জন মিনিস্টারের সঙ্গে মিটিং আছে। তখন যদি কথাটা মনে পড়ে যায় তা হলে ঠিক ফুড়ক করে হেসে ফেলবে সে। বিকেলে আছে পাটির গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। তখনও কি মনে পড়বে?

পত্রিকায় কয়েদি পালানোর কোনও খবর নেই। বাংলা কাগজে এমনিতেই খবর কম থাকে, তার ওপর এসব খবরের এমনিতেই তেমন গুরুত্ব নেই। তবে যারা নবকে জানে তারাই বুঝবে খবরটা কতখানি গুরুতর।

বাইরের ঘর থেকে পরদা সরিয়ে ভিতরের বারান্দায় উকি দিল শ্ৰীমন্ত, দাদা, আপনার বন্ধু এসেছে।

আমি জগবন্ধু। কে এসেছে? নামটা কী?

মাধব হাজরা। ওই যে গোলপার্কের কাছে

আর বলতে হবে না। মাধব দুনিয়ায় একটাই হয়। আসতে বলো।

 মাধব বোধহয় বাইরের ঘরে ফিতে বাঁধা জুতো খুলতে খানিক সময় নিল। তারপর ভিতরের বারান্দায় আসতেই তার মুখে উদভ্রান্তিটা প্রথম লক্ষ করে মদন।

তবু মদন সব সময়ে নিজে খোশ থাকতে এবং অন্যকে খোশ রাখতে চেষ্টা করে। হালকা গলায় বলল, মুরগা পেয়েছিস?

কীসের মুরগা?

 তোর বাসায় আজ রাতে একটা আস্ত এম পি-র নেমন্তন্ন যে।

 ওঃ! আচ্ছা, মুরগি হবে। কিন্তু খবর শুনেছিস?

 খবর শোনাই আমার কাজ। নব হাটি পালিয়েছে, এই খবর তো? তা অত ঘাবড়ানোর কী আছে? বোস।

মণীশের পরিত্যক্ত চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে মাধব। তারপর হাঁফ ধরা গলায় বলে, এটা ইয়ারকির ব্যাপার নয়।

এ কথায় সকালের হাসিখুশি ভাবটা মদনের মুখ থেকে মুছে গেল বটে, কিন্তু তার মুখে কোনও ভয় বা ভাবনা ফুটল না। মুখটা আস্তে আস্তে গম্ভীর ও নিষ্ঠুর হয়ে গেল। সে শুধু বলল, হুঁ।

মাধবের চেহারাখানা সুন্দর। দারুণ ফরসা, জোড়া, খুব লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান। সুন্দর ছেলেদের সুন্দর বউ জোটে না, সুন্দর মেয়েদের জোটে না সুন্দর বর। মাধবের বউ ঝিনুক কিন্তু সুন্দর। দু’জনেই সুন্দর, দু’জনের সংসার সুন্দর, ফ্ল্যাট সুন্দর। কিন্তু তবুও কোথায় যে ওদের খিচ তা আজও মদন বুঝতে পারল না।

মাধবের চেহারায় আজ তেমন জলুস নেই। সকালে দাড়ি কামায়নি, লম্বা চুলগুলো পাট করা নেই, মুখে বেশ উত্তেজিত ভাব, উৎকণ্ঠা। ডান হাতের মধ্যমায় গোমেদের আংটিটা বারবার ব্যস্ত আঙুলে ঘোরাচ্ছে। বলল, ইউ মাস্ট ড়ু সামথিং।

মদন ধীরে-সুস্থে কাগজের শেষ পাতাটা উলটে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, চা খাবি?

চা!—যেন প্রস্তাবটায় কিছু অস্বাভাবিকতা আছে এমনভাবে বিস্ময় প্রকাশ করল মাধব। তারপর হঠাৎ সচেতন হয়ে বলল, হঁা খাব। দিদি কই?

ঘরে। ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করে দিচ্ছে।

 মাধব কিছুক্ষণ চুপ করে বসে একবার আংটি ঘোরায়, একবার চুলে আঙুল চালায়। হঠাৎ একটু ঝুঁকে বলল, পেপারে কিছু দিয়েছে?

মদন চোখ তুলে বলে, কী দেবে?

নবর ব্যাপারটা?

মদন মাথা নেড়ে পত্রিকাটা ভাঁজ করে রেখে দিয়ে বলে, একজন তৃতীয় শ্রেণির কয়েদির পালানোর খবর তেমন কিছু গুরুতর নয়।

মাধব পিছন দিকে হেলে বসে কয়েক পলক চোখ বুজে থাকে। তারপর বলে, তা বটে। বাট ইট ইজ এ সিরিয়াস নিউজ ফর আস।

মদন মৃদু স্বরে বলে, আস নয়, বল মি। তুইই ভয় খেয়েছিস, আমি নয়।

মাধব চোখ খুলে মদনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলে, তোকে কি নব স্পেয়ার করবে?

 মদন মৃদু হেসে বলে, তার চেয়ে বরং জিজ্ঞেস করা ভাল, হোয়েদার আই উইল স্পেয়ার হিম।

মাধবের স্বাভাবিক চোখা চালাক ভাবটা আজ ছুটি নিয়েছে। তবু সে বলল, আমি তোর মতো হিরো নই। অ্যান্টিহিরো।

মদনের মুখে কথা ফুটল না। কিন্তু চাপা নিষ্ঠুরতাটা জ্বলজ্বল করতে লাগল। মাধব জানে, মদনের মধ্যে একটা কিছু আছে। কিন্তু সেটা কী তা এত বছরেও বুঝতে পারল না। ছেলেবেলায় আসানসোলে কলিয়ারির এলাকায় তারা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছিল। লোকে বলত, মদনমাধব। এত গলাগলি ছিল, তবু মদনের মধ্যে প্রকৃতিদত্ত একস্ট্রা ফাউ জিনিসটার জোরেই না ব্যাটা এম পি। আর সেই ফাউ জিনিসটা যা মাধবের নেই, সেটা এখন মদনের মুখে চোখে ঢেউ দিচ্ছে।

মাধব তার খড়খড়ে দাড়িওলা গাল চুলকোল। তারপর একটু মিয়োনো গলায় বলল, তুই কলকাতায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নব জেল ভেঙে পালাল, এর মধ্যে একটু অদ্ভুত যোগাযোগআছে না? ব্যাপারটা ভেবে দেখেছিস?

মদন মাথা নাড়ে, না। অত ভাববার সময় নেই। ভেবে লাভও নেই। গোটা দুই মুরগা কিনে নিয়ে বাড়ি যা। ঝিনুককে ভাল করে রাঁধতে বলিস।

ঝিনুক গত বছর পাঁচেক রান্নাবান্না করেনি।

বলিস কী?

ঝিনুক না রাঁধলেও আমরা না খেয়ে থাকি না। রান্নার লোক আছে, চিন্তা নেই।

তবে মুরগা কিনে বাড়ি যা। একটু বেশি করে বান্না করতে বলিস। আমি তোদের না জানিয়েই। বৈশম্পায়নকেও নেমন্তন্ন করে দিয়েছি।

বৈশম্পায়ন! বলে একটু হাসে মাধব, কিন্তু কোনও মন্তব্য করে না।

 মদন অবশ্য তীক্ষ্ণ চোখে হাসিটা দেখল। বলল, হাসলি কেন? এনিথিং রং?

না, নাথিং রং!

ওকে নেমন্তন্ন করায় তোরা অসুবিধেয় পড়বি না তো!

মাধব মাথা নেড়ে বলে, অসুবিধে তো তোকে নিয়ে! ঝিনুক বলে দিয়েছে ড্রিংক করলে বাড়ি থাকবে না।

হোঃ হোঃ করে হাসে মদন। তারপর গলা নামিয়ে বলে, ড্রিংকস কি বাদ যাচ্ছে নাকি?

না। তবে ছোট করে হবে।

ঝিনুক বাড়ি থাকবে?

মাধব এবার খুব অদ্ভুত ধরনের একটা হাসি হেসে বলে, বোধহয় থাকবে। বৈশম্পায়ন আসছে জানলে থাকবেই মনে হয়।

তীক্ষ্ণধার চোখে মাধবের মুখটা দেখে নিচ্ছিল মদন। ঝুঁকে আস্তে করে বলল, ইজ দেয়ার এনি অ্যাফেয়ার?

সিরিয়াস কিছু নয়। দু’জনেই দুজনের প্রতি একটু সফট। ব্যাপারটা আমি খুব এনজয় করি।

মদন হতাশার গলায় বলে, তোরা একেবারে হোপললস। বউ অন্যের সঙ্গে প্রেম করলেও সেটা তোরা এনজয় করিস কী করে?

আস্তে মদনা, আস্তে।—মাধব গলা আর-এক পরদা নামিয়ে বলে, দুনিয়াটাই তো রঙ্গশালা। কে কার বউ? কে কার প্রেমিকা? আমি পজেসিভ নেচারের লোক নই। আমি শুধু দেখি, শেষযৌবনা এক মহিলা মধ্যবয়স্ক একজনের প্রেমে পড়ে কেমন বয়ঃসন্ধির ছুকরি হয়ে যাচ্ছে। ঘ্যাম নাটক মাইরি।

সেই নাটকে তোর ভূমিকা কী? পরদা টানা?

না। আমার ভূমিকা ছিল ভিলেনের। কিন্তু আমি মাইরি ফিলজফার হয়ে গেছি। তবে রেফারির মতো নজরও রাখছি। বাড়াবাড়ি দেখলেই ফাউল বা অফসাইড বলে চেঁচিয়ে বাঁশি বাজাব।

এই সময়ে শোওয়ার ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে চিরু আসে। মাধবের দিকে চেয়ে বলে, বন্ধু এসেছে বলে তোর টিকি দেখা গেল। নইলে দিদি মরল কি বাঁচল সে খবরও তো নিস না।

মাধব এক গাল হেসে বলে, তোমার মরার কী? দিব্যি গায়ে-গতরে হয়েছ।

মোটা হয়েছি বলছিস?

মোটা নয়, মোটা নয়। পরিপূর্ণ হয়েছ।

ফাজিল। চা খাবি?

মদন একটু ধমক দিয়ে বলে, আরে তুই দুনিয়াসুদ্ধ লোককে চা খাওয়াতে গিয়ে যে পতিদেবতাটিকে ভাত খাইয়ে অফিসে পাঠাতে পারবি না।

না। না খেয়ে যাবে না, ডাল ভাত নেমে গেছে। সেই ভোর রাতে তুই যখন বেরলি তখনই উঠে সব সেরে ফেলেছি।

মাধব একটা শ্বাস ফেলে বলে, তা হলে চিরুদি, গরিব ভাইকে একটু চা খাওয়াও।

তুই গরিব? কেয়াতলায় ফ্ল্যাট কিনেছিস, তুই যদি গরিব তো আমরা কী?

তোমরা সবাই শুধু আমার ফ্ল্যাটটাই দেখলে! আর আমি যে দিনকে-দিন শুকিয়ে যাচ্ছি।

তুই আবার শুকোলি কোথায়?—চিরু অবাক হয়ে বলে, বেশ তো চেহারাটা দেখাচ্ছে। একটু এলোমেলো অবশ্য। রাতে ঘুমোসনি নাকি?

না, সেসব নয়। মাঞ্জা দেওয়ার সময় পাইনি।

ঝিনুক কেমন? বেশি মোটা হয়ে যায়নি তো?

না, না। রেগুলার যোগাসন করে, কম খায়, সারাদিন শরীরের যত্ন করে, কাজকর্ম নেই, মোটা হবে কেন? ভাল আছে।

বউয়ের কথা উঠলেই তোরা অমন বেঁকিয়ে কথা বলিস কেন বল তো? বউগুলো কি মানুষ নয় নাকি?

বেঁকিয়ে বললাম কোথায়?—মাধব অবাক হওয়ার ভান করে।

 ওই যে বললি, সারাদিন শরীরের যত্ন করে, কাজ করে না, আরও সব কী যেন।

 তোমার মনটাই বাঁকা। একজন মহিলা নিজের শরীরের যত্ন নেয় এটা তো প্রশংসার কথাই। তুমি যে নাও না, তার জন্য আড়ালে আমরা তোমার নিন্দে করি।

চিরু হেসে ফেলে বলে, ইয়ারবাজ। বোস, চা করি আনি।

হ্যাঁ, যাও। রান্নাঘর ছাড়া তোমাকে কোথাও মানায় না।

সেটা তোর জামাইবাবুও খুব ভাল বুঝেছে।

এতক্ষণ মদন একটাও কথা বলেনি। কোনও কথা তার কানেও যায়নি। নিজের নখগুলোর দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবছিল।

মণীশ বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল, যাও ব্রাদার, খবরের কাগজ নিয়ে আধবেলার জন্য ঢুকে পড়ো।

কোঁচকানো সটান হল, একটু হেসে মদন বলে, অত সময় যদি হাতে থাকত জামাইবাবু। এক্ষুনি রাইটার্সে যেতে হবে।

মণীশ মাধবকে দেখে খুশি হয়ে বলে, এই যে ব্রাদার! মদন না এলে মাধবের দেখা পাওয়া যায় না, আমাদের হয়েছে বিপদ। তোমার ফোন নম্বরটা চিরুকে দিয়ে যেয়ো তো।

যাব, কিন্তু আপনি জন্মেও ফোন করবেন না, জানি।

আহা, কখন কী দরকার হয় তার কি ঠিক আছে? তবে পয়সা দিয়ে করতে একটু গায়ে লাগে আজকাল। ফোনের চার্জ যা বেড়েছে।

কেন, অফিস থেকে করবেন!

মণীশ ম্লান একটু হাসে, অফিস থেকে। অফিস থেকে প্রাইভেট ফোন করতে একটু কিন্তু কিন্তু লাগে।

মদন মাথা নেড়ে মাধবকে বলে, জামাইবাবু একটা হোপলেস কেস, বুঝলি মাধব? হি ইজ হেলপলেসলি অনেস্ট। এ রোগের চিকিৎসা নেই।

মাধব হা করে একটু চেয়ে থেকে বলল, জামাইবাবুর অনেস্টি সম্পর্কে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা যে শুচিবায়ু হয়ে দাঁড়াচ্ছে!

মণীশ খুব দুর্বলভাবে একটু হাসে।

.

০৮.

তুই ভয় পেয়েছিস?—মদন জিজ্ঞেস করে।

শ্ৰীমন্তর মুখ করুণ গম্ভীর। কোনও বিপদ বা ঝামেলা পাকালে শ্ৰীমন্তর মুখ ওইরকম হয়ে যায়। তাকাতে ভয় করে। সে মদনের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে বলে, না। তবে কেয়ারফুল থাকা ভাল।

মদন আত্মবিশ্বাসের হাসি হাসল। বলল, তা থাক। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

শ্ৰীমন্ত মুখে কিছু বলল না। তবে মনে মনে বোধহয় মদনকে একটা খিস্তি দিল। তার কারণ নব জেল থেকে বেরিয়েও মদনের নাগাল পাবে না। তার আগেই চিড়িয়া ভেগে যাবে দিল্লি। তারপর বিদেশে। কলকাতার ঘুণচক্করে নবর পাল্লা টানতে পড়ে থাকবে শ্ৰীমন্ত আর তার সাকরেদরা। কাজটা খুব সহজ নয়। যারা নবকে চেনে তারাই জানে।

কথা হচ্ছিল একটা অ্যামবাসাড়ার গাড়িতে বসে। সকালবেলা। গাড়ি যাদবপুর পেরিয়ে বাঘাযতীনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সেই বোড়াল।

দিল্লিতে আমার জন্য একটা চেষ্টা করবে বলেছিলে মদনদা।

 হবে।–মদন অন্যমনস্ক ভাবে বলে, এখানেও তো বেশ আছিস!

একে থাকা বললা! ভদ্রলোকের মতো থাকতে গেলে কলকাতায় কিছু হবে না। দিল্লিতে একটা ব্যবস্থা করে দাও।

কী করবি?

 যা হোক। একটা দোকান, না হয় বাস বা ট্যাক্সির পারমিট।

ওখানে পারবি না। শক্ত কাজ। তবু যদি যেতে চাস তো চেষ্টা করব।

করো।

তুই একটু ভয় খেয়েছিস শ্ৰীমন্ত।

শ্ৰীমন্ত জানে, মদনদা এই যে দিল্লি যাবে, গিয়েই ভুলে মেরে দেবে তার কথা। ভি আই পি-রা সব একরকম। মদনের ওপর নানা কারণেই একটু চটে আছে সো লোকটা কথা দিয়ে কথা রাখে না। তার ওপর ভয়ের খোঁটা দেওয়া হচ্ছে। শ্ৰীমন্ত ঠান্ডা গলাতেই পালটি দিল, ভয় একটু তুমিও খেয়েছ মদনদা। নইলে এই সাতসকালে জরুরি কাজ ফেলে বোড়াল রওনা হতে না।

মদন হাসে। একটু অপ্রতিভ বোধ করে না। বলে, কাল নবর মাকে কথা দিয়েছিলাম। কানোয়ারকে সকালে ফোন করতেই রাজি হয়ে গেল। খবরটা দিয়ে আসা কি খারাপ?

খারাপ বলছি না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, নবর মাকে তুমি কাটিয়ে দেওয়ার জন্য ওকথা বলেছ।

মদন একটু চুপ করে থেকে বলে, শত হলেও এক সময়ে নব আমার জন্য অনেক করেছে।

শ্ৰীমন্ত কথা বাড়াল না। কিছুদিন যাবৎ মদনদার সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছে না এটা সে নিজেই টের পাচ্ছে। মদনদাও কি আর টের পাচ্ছে না?

মদন একটা সিনেমা হলের হোর্ডিং দেখল ঘাড় ঘুরিয়ে। মুখ ফিরিয়ে বলল, এ কথাটা যেন চাপা থাকে।

নবর বউয়ের চাকরি তো? ও নিয়ে ভেবো না।

দিল্লি সত্যিই যেতে চাস?

 চাই। কলকাতায় কী হবে বলল। হুজ্জতি করা আমার রক্তে নেই। ওসব মেলা হয়েছে। এইবার সেটল করতে চাই।

তুই বি কম পাশ না?

টুকে মুকে। ওসব বিদ্যে ধোররা না। ধ্যাড়াব!

না, তোকে দিয়ে চাকরি হবে না সে আমি জানি!

 চাকরিটাও রক্তে নেই কিনা। আমার বাপ পুরুত ছিল। মেলা যজমান। আমিও নাকি অনেকের কুলগুরু। রাস্তাঘাটে মাঝে মাঝে বেশ বুড়ো বয়স্ক মানুষও দুম করে পেন্নাম ঠুকে দেয়। কতক বাড়ি আছে যেখানে গেলে আমার জামাই আদর।

মদন হাসে, লাইনটা তো ভালই।

হ্যাঁ, ভাল না হলে আমার বাবা চিরকাল ও কাজ করবে কেন? চাকরি আমাদের বংশে কম লোকই করেছে।

নিষ্ঠাবান বামুনের ছেলে হয়ে তুই খুনখারাপি করিস কী করে?

মাইরি মদনদা, ঠুকো না। খুনখারাপি আমার সয় না। একটু হাঁকডাকের লোক ছিলাম বটে বরাবর। কিন্তু এতটা হয়ে যাব ভাবিনি।

মদন শ্ৰীমন্তর হাতটায় একটু চাপ দিয়ে বলল, তুই একটু নরম আছিস।

আছি মদনদা। স্বীকার করছি।

নবর মতো তুই কেঠো মানুষ নোস।

 তাও নই।

নবর সঙ্গে যদি পাল্লা টানতে হয়, পারবি?

শ্ৰীমন্ত একগাল হাসে, পারব। তাতে আটকাবে না। তবে আমি ওর মতো নীচে নামতে পারি না। তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছ তো?

পারছি। আমার লোক নিয়েই কারবার। তোর মুশকিল হল, তুই যে ভদ্রলোক তা ভুলতে পারিস না। আর, কিছু লোক যে তোকে দেখলে প্রণাম করে সেটাও ততাকে কাছা ধরে টানে মাঝে মাঝে।

শ্ৰীমন্ত হাসল। বলল, সবই তো বোঝো দাদা।

 আমি তোরটা বুঝি। কিন্তু তুই আমারটা বুঝিস না।

কেন বলছ ওকথা?

এই যে বললি, ভয় পেয়েছি বলেই নাকি আমি নবর বউয়ের চাকরি করে দিচ্ছি।

 ওটা একটা ফালতু কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

মদন চুপ করে রইল। কিন্তু তার মুখের দিকে চেয়ে শ্ৰীমন্তরও বুকটা একটু গুড় গুড় করে ওঠে। তার গায়ে জোর আছে, পকেটে লোডেড রিভলভার আছে, সাহসও আছে, তবু সে জানে মদনদার মতো লোক তার মতো হাজারজনাকে নাচিয়ে বেড়াতে পারে। বে-খেয়ালে বেচাল বলে ফেলেছে।

শ্ৰীমন্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, মদনদা, রেগে আছ মাইরি?

মদন জবাব দিল না। ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।

বোড়ালে বড় রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে মদন নামল। শ্ৰীমন্ত নামতে যাচ্ছিল, মদন হাত তুলে বলে, না। তুই থাক।

শ্ৰীমন্ত অবাক হয়ে বলল, একা যাবে?

একাই যেতে হবে।

তোমার কাছে আর্মস নেই!

তাতে কী? আমি কোনওকালে আর্মস নিয়ে চলি না। ভয় নেই, আর্মস ছাড়াও আমার অন্য কিছু আছে সেটা তুই বুঝবি না।

কাজটা ঠিক করছ না মদনদা। নব এখন ফ্রি ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাড়িতে একবার ঢুঁ দেবেই।

দুর বোকা!নব তোর চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখে। ও জানে,পুলিশ ওর বাড়ির চারদিকে জাল পেতে আছে।

তা অবশ্য ঠিক।

শ্ৰীমন্ত মাথা চুলকায়। একটু কেমন লাগে শ্ৰীমন্তর। মদনদা তাকে সঙ্গে নিচ্ছে না। মদনদা গম্ভীর। কোথাও একটা তাল কেটে যাচ্ছে।

ভয় নেই।বলে মদন একটা ভাঙাচোরা মেটে রাস্তা ধরে এগোতে থাকে।

এদিকে অনেক নিবিড় গাছপালা, পুকুর, কঁকা জমি। একেবারেই হদ্দ গ্রাম। বেশির ভাগ নিম্নমধ্যবিত্তদের বাস বলে বাড়িঘরগুলোর তেমন বাহায় নেই। ম্যাড়ম্যাড়ে, শ্রীহীন। মদনের খুব খারাপ লাগছিল না। সে একবার ঘুড়ি দেখল। প্রায় এগারোটা। বেলা একটায় রাইটাসে মিটিং। সময় আছে। তবু সে একটু পা চালিয়ে হাঁটে।

আধ মাইলের মতো হেঁটে একটা শ্রীহীন, ভারী গরিব চেহারার চালাঘরের সামনে উঠোনে পা দেয় মদন। নব টাকা কামাই করেছিল মন্দ নয়, কিন্তু ঘর-সংসারের পিছনে কিছুই ঢালেনি। কেবল অন্য সব ফুর্তিতে উড়িয়ে দিয়েছে। এই কাঠা তিনেক জমিও ওকে পয়সা দিয়ে কিনতে হয়নি। ঝোপজঙ্গলে ভরা এই তিন কাঠা এক মুসলমানকে ভোগা দিয়ে দখল করেছিল সে। সেই জমি আর চালাঘরটাই এখন নবর আত্মীয়দের একমাত্র আশ্রয়।

মদন উঠোনে পা দিয়ে একবার ফিরে চাইল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা ঘাড়েগদানে চেহারার লোক তাকে দেখছে। গায়ে হাফ-হাতা নীল রঙা একটা শার্ট, পরনে ময়লা ধুতি। সাদা পোশাকের পুলিশকে চিনতে এক লহমাও লাগে না মদনের। সে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে। তারপর অনুচ্চ স্বরে ডাকে, গৌরী! গৌরী!

এত ভদ্র গলায় বোধহয় বহুকাল কেউ গৌরীকে ডাকেনি। খোলা দরজায় গৌরী এসে অবাক চোখে তাকায়।

গৌরী ফরসা নয়। তবে ভারী মিঠে মোলায়েম একটা শ্যামলা রং ছিল তার। ছিল অফুরন্ত স্বাস্থ্যের শরীর। ছিল অকূল দু’খানা চোখ। মুখে উপচে পড়ত শ্ৰী।

এখন তার কিছুই প্রায় নেই। শরীর শুকিয়ে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। রং কালো হয়ে গেছে। এখনও শুধু চোখ দুখানা আছে। তাকালে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে আজও।

আমি মদনদা। চিনতে পারছ?

গৌরীর শুকনো হাড্ডিসার মুখে একটু হাসি ফুটল। খুব অবিশ্বাসের হাসি। প্রথমটায় বুঝি কথা সরল না। তারপর মৃদু লাজুক স্বরে বলল, এলেন তা হলে! আসুন।

বেশিক্ষণ বসার সময় নেই।

গৗরী হারিয়ে গিয়েছিল, এই কথায় হঠাৎ যেন ঝলসে উঠল পুরনো গৌরী। বলল, একটু বসে না গেলে লোককে কী করে বিশ্বাস করাব যে, একজন এম পি আমাদের বাড়িতে এসেছিল?

মদন মৃদু হেসে নামমাত্র দাওয়ায় উঠে চটি ছেড়ে রাখে। বলে, ঘরে নয়। এইখানেই একটা মাদুর-টাদুর পেতে দাও।

গৌরী বলে, না। এখানে আব্লু নেই। ঘরে আসুন। গরম লাগবে একটু, তা আমি পাখার বাতাস দেব’খন।

অগত্যা মদন ঘরে ঢোকে। যেমনটি আশা করা যায়, ঘরটি ঠিক তেমনিই। বেড়ার গায়ে গুটি তিনেক ছোট জানলা বসান। রোদে তাতা টিনের গরমে ভেপসে আছে ভিতরটা। দু ধারে দুটো সস্তা চৌকিতে অত্যন্ত নোংরা বিছানা। কয়েকটা ফুটপাথে কেনা র্যাকে রাজ্যের কৌটো-টোটো রাখা। তবে একটা ট্রানজিস্টার রেডিয়ো আছে, লক্ষ করে মদন।

তোমার শাশুড়ি কই?

উনি একটা বিড়ির কারখানায় যান।

ছেলেমেয়ে?

গৌরী একটা শ্বাস ফেলে বলে, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছে।

লেখাপড়া করে না?

নাম লেখানো আছে ইস্কুলে। যায় বলে তো মনে হয় না।

 দু’জন। বড়টা ছেলে। ছোটটা মেয়ে। তোমার কটি?

 গৌরীর হাতপাখাটা নড়বড়ে। মচাৎ মচাৎ শব্দ হচ্ছে। মদন বলল, থাক গে। পাখা রেখে দাও।

গৌরী রাখল না। বলল, কেমন আছেন?

ভাল নেই গৌরী।

 আপনি ভাল নেই? তবে আমরা কোথায় যাব!

তোমার শাশুড়ি গতকাল আমার কাছে গিয়েছিল।

 জানি। আমি বারণ করেছিলাম, শোনেনি।

বারণ করেছিলে কেন?

 গৌরী একটু উদাস হয়ে বলে, কী হবে গিয়ে? আমার জীবনে তো আর ভাল কিছু হবে না।

 মদন একটু চুপ করে থেকে বলে, তোমার চাকরিটা হয়ে গেছে।

কোথায়?

 নবর কারখানায়।

খবরটা শুনে গৌরী গা করল না। বলল, ও।

কারখানায় ওদের অফিসও আছে। সেই অফিসে।

গৌরী জবাব দিল না। হাতপাখার মচাৎ মচাৎ শব্দ হতে লাগল।

মদন একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, নবর কারখানায় কি তুমি চাকরি করতে চাও না?

গৌরী মৃদু স্বরে বলল, এই প্রশ্নটাই আপনার আগে করা উচিত ছিল মদনদা।

মদন বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলল, কাল তোমার শাশুড়ি গিয়ে নবর কারখানায় তোমাকে একটা চাকরি দেওয়ার কথা বলল, তখনও ভেবে দেখিনি যে, তোমার কাছে চাকরিটা কতখানি অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াবে।

গৌরী একটা শ্বাস ফেলে বলল, যাক আপনার বুদ্ধি এখনও লোপ পায়নি দেখছি। একটু দেরিতে হলে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।

মদন মাথা নেড়ে বলে, বুদ্ধির ধার কমেও যাচ্ছে। আগের চেয়ে মাথা এখন অনেক কম। খেলে।

গৌরী একটু ক্লান্ত স্বরে বলল, নবর মাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে,ওর কারখানায় আমার কাজ করা বিপজ্জনক। ওর শত্রু অনেক। তার ওপর ওর উল্টো ইউনিয়ন এখন কারখানা দখল করেছে। ওখানে চাকরি করা কি সম্ভব! কিন্তু নবর মা তা মানতে চায় না।

কী বলে?

অনেক কিছু বলে। সব তো আপনাকে বলা যায় না। এমনকী বেশ্যাগিরি করেও টাকা আনতে বলে। আর শুনবেন?

মদন একটু গম্ভীর হয়ে যায়। তারপর বলে, বুড়ি তার উপযুক্ত কথাই বলে। তাতে উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।

আমি উত্তেজিত হই না তো!

নবর সঙ্গে কি জেলখানায় মাঝে মাঝে দেখা করতে যাও?

না। ওর মা যায়। ছেলেমেয়েও কখনও-সখনও যায়।

 তুমি যাও না কেন?

কেন যাব?

 মদন একটু হাসল, রাগটা কি নবর ওপর? না আমার ওপর?

আপনার ওপর রাগ করব! ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন!

 ঠাট্টা করছ?

আপনি ঠাট্টা-ইয়ার্কির অতীত হয়ে গেছেন মদনদা।

শোনো, তোমার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করা খুব শক্ত হবে না। ট্রেড ইউনিয়ন তো কম করিনি। কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলে যাই, এখানে আর থেকো না।

গৌরী অবাক হয়ে বলে, থাকব না? কেন?

কারণ আছে! তোমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই?

গৌরী বিহুল মুখে মাথা নেড়ে বলে, না। কোথায় যাব?

 বাপের বাড়ি এখনও কি ম্যানেজ হয়নি?

না! কোনওকালে হবেও না।

তাহলে?

আমার যে কোনও জায়গা নেই, সে তো আপনি জানেন!

 চিন্তিত মুখে মদন একটা হুঁ দিল। তারপর আরও খানিকক্ষণ ভেবে বলে, দূরে যেতে হলে পারবে?

কোথায়?

ধরো যদি দিল্লি যেতে হয়?

আমার জন্য আপনি এত ভাবছেন কেন? আমি বেশ আছি। এর চেয়ে বেশি বিপদ আর কী হবে?

একটু দ্বিধা করে মদন বলে, কাল নব জেল থেকে পালিয়েছে। জানো?

এতক্ষণ ভাঙা পাখার মচাৎ মচাৎ শব্দে কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল মদনের। এখন হঠাৎ পাখার শব্দটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিস্তব্ধতাটা খুব বড় করে শোনা গেল।

অবশ্য কয়েক সেকেন্ড বাদেই আবার পাখার মচাৎ মচাৎ শব্দ দ্বিগুণ জোরে হতে লাগল। গৌরী বলল, আপনি ঘরে ভীষণ ঘেমে যাচ্ছেন। দাওয়াটাতেও রোদ পড়েছে।

আমার জন্যে ভেবো না। আমি এক্ষুনি চলে যাব। হাতে অনেক কাজ।

 সে তো জানি। এত বড় দেশের দণ্ডমুণ্ডের একজন কর্তা তো আপনিও।

 তোমার মুখে এসব কথা শুনতে ভাল লাগে না গৌরী।

কেন মদনদা? আমি কি আলাদা কিছু?

আলাদাই তো ছিলে। এখন কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেছ। কেবল কি ঠেস দিয়ে কথা বলতে হয়?

আমার আজকাল স্বাভাবিক কথা আসতে চায় না। মনটা খুব সংকীর্ণ হয়ে গেছে বোধ হয়। হওয়ারই কথা।

না গৌরী, আমাকে দেখলেই তোমার প্রতিহিংসা জেগে ওঠে।

প্রতিহিংসা কেন হবে? কী যে বলেন।-বলে গৌরী হঠাৎ হাতপাখাটা থামিয়ে উৎকর্ণ হয়ে কী শুনল, তারপর বলল, নবর মা আসছে।

মদন মৃদু একটু হেসে বলে, বুড়ি খুব খান্ডার না?

গৌরীও হাসে, নবর মা তো, একটু তেজি তো হবেই।

তোমার সঙ্গে খুব লাগে?

গৌরী মাথা নাড়ে, লাগে, তবে একতরফা। আমি জবাব দিই না।

সে কী! মদন অবাক হয়ে বলে, জবাব দাও না কেন? এক সময়ে তো তুমি দারুণ ভাল ঝগড়াটি ছিলে! যাকে তাকে ক্যাট ক্যাট করে কথা শোনাতে।

গৌরী অবসন্ন মুখে বলে, আপনি তো আমার দোষ ছাড়া গুণ কখনও দেখেননি।

 হাত নেড়ে মদন বলে, ওসব কথা রাখো। আমি তোমাকে ভাল চিনি। কথা হচ্ছে শাশুড়ির সঙ্গে একটু ঝগড়া-টগড়া করো না কেন? তাতে তো সময়টাও ভাল কাটে।

কী যে বলেন মদনদা।—গৌরী বিরক্ত মুখে জবাব দেয়।

 কেন, ঝগড়া কি খারাপ?

সে আপনিই জানেন। আমার ভাল লাগে না।

বুড়ির মুখ কেমন? খুব খারাপ কথা বলে?

গৌরী হেসে ফেলে। বলে, কেমন আবার! আঁস্তাকুড়।

 তাহলে তো তোফা।

 আপনি আবার ঝগড়া-প্রিয় হলেন কবে থেকে?

আহা, পার্লামেন্টে তো আমরা ঝগড়াই করি। দারুণ ঝগড়া। তবে সেখানে গালাগাল চলে না, পয়েন্টে পয়েন্টে ল্যাঙ্গালেঙ্গি হয়। আমার অবশ্য ওরকম বাবু-ঝগড়া ভাল লাগে না। বহুকাল বস্তিমার্কা ঝগড়া শুনিনি, একটু শোনাবে?

গৌরী ভ্রুকুটি করে তেতো গলায় বলে, আমি কি বস্তির মেয়ে?

আরে না। তুমি আবার ঘুরিয়ে ধরলো আমি নবর মা’র কথা বলছিলাম। একটু খুঁচিয়ে দিলে একেবারে ভাগীরথীর উৎস খুলে যাবে। দাও না একটু খুঁচিয়ে।

গৌরী উদাস হয়ে বলে, আপনি খোঁচান গিয়ে। আমি নিত্যি শুনছি। ওই আসছে। উল্টোদিকের বাড়ির বউয়ের সঙ্গে কথা বলছিল এতক্ষণ। কথা থেমেছে।

বুড়িকে খবরটা দেবে নাকি?

কোন খবর?

 নব যে পালিয়েছে।

উদাস মুখে গৌরী বলে, আপনিই দিন।

তুমি এত উদাস ভাব দেখাচ্ছ কেন বলল তো!নবকে খুঁজতে পুলিশ সব দিকে ঘুরছে। এ বাড়িও তাদের নজরবন্দি। নবকে ধরার জন্য দরকার হলে গুলিও চলবে। আমার নিজের ধারণা, নব মরতেও পারে।

তার আমি কী করব?

নব মরলে তুমি বিধবা হবে, জানো না?

 খুব জানি। তবে আমার বিধবা হওয়ার আর বাকি কী? বিয়ের দিন থেকেই তো আমি বিধবা।

নবর ওপর তোমার খুব রাগ।

 রাগের স্টেজ পার হয়ে গেছে। এখন শুধু ঘেন্না।

তুমি যা পষ্টাপষ্টি কথা বলল। কিন্তু নবর সঙ্গে তো তোমাকে কেউ ঝোলায়নি। তুমি নিজেই ঝুলেছ।

গৌরী একটু থতমত খেয়ে বলে, আমি বুলব কেন? আমি নবকে কোনওকালে চাইনি তো।

মদন গম্ভীর হয়ে বলে, আমি তখন লিডার ছিলাম না গৌরী। এ-পাড়ায় সে-পাড়ায় একটু-আধটু সোশ্যাল ওয়ার্ক করতাম। নবর মতো ফেরোসাস গুন্ডা বা নীলুর মতো ভাল ওয়ার্কারকে তখন আমার খুব দবকার হত। যদিও আমরা তিনজন ছিলাম তিনরকম, কিন্তু কাজ করতাম একসঙ্গে। আর একটি জায়গায় আমাদের মিল ছিল। আমরা তিনজনই তোমাকে পছন্দ করতাম।

গৌরীর মুখ সাদা দেখাচ্ছিল।

মদন একটু চোখের ইশারা করে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, বুড়ি কদুর? এল নাকি?

 গৌরী মাথা নেড়ে বলে, পুকুরে হাত-পা ধুতে গেছে। এক্ষুনি আসবে।

 মদন বলে, হ্যাঁ, আমরা তিনজনই তোমাকে পছন্দ করতাম। তাই না?

নীলুর কথা থাক। তবে আপনারা দু’জন করতেন। মানছি।

 কিন্তু তুমি নবকেই দেহ-মন দিয়েছিলে, আমাদের পাত্তা দাওনি।

নবকে আমি মন দিইনি।খুব ক্ষীণ গলায় গৌরী বলল।

 শুধু দেহ?

সেটাও ও জোর করে নিত।

আর মনটা? সেটা কাকে দিয়েছিলে? আমাকে, না নীলুকে?

তা জেনে কী হবে? আপনি তো আগে কখনও জানতে চাননি।

তা ঠিক। তবে জানতে চাইতে হবে কেন বলো তো। মন দিলে তো এমনিতেও টের পাওয়ার কথা।

বহু মেয়েই আপনাকে মন দিয়েছিল, তাদের দিকে তাকানোর সময় আপনার ছিল না।

সময় ছিল না ঠিকই, কিন্তু তাই বলে টেরও পেতাম না ভেবেছ? শুধু তোমারটাই টের পাইনি। কোনওদিন। তবে নীলু টের পেত কি না জানি না।

কান্নার আগে যেমন মুখ হয়, গৌরীর মুখ এমন ঠিক সেইরকম। চোখ স্থির, লাল, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আবেগটাকে ঠেকাচ্ছে। পাখাটা রেখে ঘর থেকে বেরুতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময় দবজায় নবর মা উঠে দাঁড়াল।

ঘরের মধ্যে আবছায়াতেও বুড়ির নজর মদনকে চিনে ফেলেছে। চোখে ভারী অবাক ভাব। মুখখানা হা করা।

মদন মৃদু একটু হেসে বলে, এই যে মাসি! আপনার বউমার চাকরির একটা খবর আছে। তাই দিতে এলাম।

নিজে এলে! কী ভাগ্যি! আমি ভাবছিলাম, বড় মানুষ, বোধহয় গরিবের কথা ভুলেই গেছ।

 বুড়ির গলাটা টনটনে। স্বাভাবিক স্বরটাও সাতবাড়িতে শোনা যায়।

 মদন বলল, নব আমার সাকরেদ ছিল। তার জন্য এটুকু করা কিছু না।

তা ঠিক।–নবর মা একগাল হেসে বলে, তা কাল থেকেই কি যাবে বউমা?

 মদন মাথা নেড়ে বলে, না মাসি। চাকরি এখানে নয়, দিল্লিতে।

 দিল্লি? ও বাবা, তা হলে এখানে কী হবে?

এখানে আপনি তো রইলেন।

 বুড়ি গলাজলে আঁকুপাকু খেতে থাকে। কথা ফোটে না মুখে। এই সময়ে বুড়ির পাশ কাটিয়ে গৌরী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মদন চোখ টিপে বলে, চাকরি তো এখানেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নবর বউ করতে চাইছে না। বলে, নবব কারখানায় চাকরি করতে নাকি ঘেন্না করে।

বলল?–বুড়ির গলা সাত বাড়ি ছেড়ে সাতটা গাঁয়ে পৌছে যায়।

মদন উঠে পড়ে। ভাগীরথীর মুখ খুলে গেছে। এবার খেউড়ের বেনোজল নেমে আসবে। খুব ইচ্ছে ছিল মদনের, বসে থেকে শুনে যায়। কিন্তু ঘড়ি ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে। বাইটার্সে মিটিং। বিকেলে পার্টির জরুরি সভা।

মদন দাঁড়িয়ে বলল, আমি দিল্লি গিয়েই ব্যবস্থা করছি। নবর বউ যেন তাড়াতাড়ি চলে যায়। সম্ভব হলে আজই।

গিয়ে কোথায় উঠবে?

সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চলি।

 বলে মদন বেরিয়ে আসে। রাস্তায় পড়ে কয়েক কদম গিয়ে একটু দাঁড়ায়। ওই শোনা যাচ্ছে সারা এলাকা মাত করে নবর মায়ের গলা চৌদুনে পৌছল, গেছো মাগি… অমুকভাতারি… তমুকভাতারি ..

মদন আর দাঁড়াল না। মৃদু একটু হেসে হাঁটতে লাগল। লাগ ভেলকি লাগ! নারদ নারদ!

.

০৯.

সময়ের একটু আগেই পৌছে গেল বৈশম্পায়ন। ভারী লজ্জা লজ্জা করছিল তার। রাতে খাওয়ার নেমন্তন্ন, কিন্তু এখনও ভাল করে দিনের আলোটাও মরেনি।

কিন্তু না পৌছে উপায়ই বা কী? কাল থেকে ঘরে শুয়ে শুয়ে শরীরে জড়তা এসে গেছে। আর মনটা পাগল-পাগল করছে কেয়াতলার এই বাড়িটার কথা ভেবে। উদ্দাম এক হাওয়া এসে পালে লাগছে বার বার। বন্দর ছাড়তে বলছে। ভেসে পড়ো। ভেসে পড়ো। সামনে অকুল দরিয়া। মৃত্যুশাসিত এই পৃথিবীতে মানুষের সময় বড় কম। লাভালাভ, ভোগ-উপভোগ সব সেরে নাও বেলাবেলি।

আজও দরজা খুলল কিশোরী ঝি পুনম। বাইরের ঘর আজ আরও পরিপাটি সাজানো। চন্দনের গন্ধওয়ালা ধূপকাঠি জ্বলছে। অন্তত চার ডজন রজনীগন্ধা। ঘরে কেউ নেই।

ইতস্তত করে বৈশম্পায়ন জিজ্ঞেস করে, মাধব আসেনি?

না, মামাবাবুর তো অফিস।

 এ কথায় আরও লজ্জা পায় বৈশম্পায়ন।

বড্ড বেশি আগে আগে চলে এসেছে। এখন কিছু করার নেই। সে সোফার এক কোণে বসে সিগারেট ধরাল। ভিতরে ভিতরে একটা কামনা শেয়ালের মতো ছোঁক ছোঁক করছে, উঁকি মারছে এদিক-সেদিক।

কিন্তু এই নিরিবিলি ঘরটিতে বসে, ঠুলি পরানো আলোয় কিছুক্ষণ চারদিকের ভৌতিককে অনুভব করতে করতেই দূর, বহু দুর থেকে মৃত্যুদীর করুণ গান ভেসে এল। সাদা পাথর, বিশাল উপত্যকা, অন্তহীন নদী, অবিরল তার গান।

জ্বলন্ত সিগারেটটা পড়ে গেল আঙুল থেকে। নিচু হয়ে তুলবার সময় সে দুর্দান্ত সুগন্ধটা পেল বাতাসে। এইসব সুবাস মাখে একজন। মাত্র একজনই। সে ঘরে এসেছে নিঃশব্দে। সিগারেটটা কুড়োতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় নিল বৈশম্পায়ন।

সামনে সোফায় ততক্ষণে মুখোমুখি স্থির হয়ে বসেছে ঝিনুক।

বৈশম্পায়ন মুখ তুলে বলল, কী খবর?

 ঝিনুকের পরনে বেরোনোর পোশাক। হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ, পায়ে চটি, চোখে ভ্রুকুটি।

ঝিনুক মৃদু কিন্তু রাগের গলায় বলে, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি।

বৈশম্পায়ন একটু অবাক হয়ে বলে, সে কী? কেন?

কেন তা আপনাদের বোঝা উচিত।

বৈশম্পায়ন ঝিনুকের অসহনীয় সৌন্দর্যের দিকে চেয়ে মনে মনে ভীষণ হতাশা বোধ করে। এত রূপ যার সে কি কখনও সহজলভ্য হতে পারে? বড় দূর, বড় দুর্লভ ঝিনুক।

সে বলল, আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার জন্যেই নাকি?

আপনার জন্য! ও মা, কী কথা বলে লোকটা! আপনার জন্য বাড়ি থেকে পালাব কেন?

বৈশম্পায়ন আবার লজ্জা পেয়ে বলে, তা হলে?

বাড়ি থেকে পালাচ্ছি আপনার বন্ধুর জন্য। কাউকে খেতে বললেই কি সঙ্গে একটা ককটেলেরও অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হবে? এত বিরক্তিকর। দেখবেন আয়োজনটা?

বলে ঝিনুক উঠে লিভিংরুমে চলে যায়। একটু বাদে দু হাতে গোটা চারেক বড় বোতল নিয়ে আসে। বলে, শুধু এতেই শেষ নয়। আরও ছ’টা বিয়ারের বোতলও আছে। ফ্রিজে সব ঠান্ডা হচ্ছে। কার না মাথা গরম হয় বলুন তো?

বৈশম্পায়ন স্কচ দেখে এবং বিয়ারের কথা শুনে শুকনো জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, ঠিকই তো।

ঝিনুক ঝংকার দিয়ে বলে, আর ভাল মানুষ সাজতে হবে না। মদ দেখলেই আজকাল পুরুষগুলো এমন হ্যাংলামি করে। এতে আপনারা কী আনন্দ পান বলুন তো!

আনন্দ! ওঃ, না ঠিক আনন্দ নয় বটে।

ঝিনুক ভীষণ জোর ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, একটুও আনন্দ নেই। মদ খেয়ে ভুল বকে, আনবিকামিং বিহেভ করে, তারপর বমি আছে, হুল্লোড় আছে। কী বিশ্রী ব্যাপার বলুন তো। তবু গুচ্ছের পয়সা খরচ করে সেই অস্বাভাবিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া চাই।

সেই জন্যই আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন?

ঝিনুক পুনমকে ডেকে বোতলগুলো আবার ফ্রিজে পাঠিয়ে দিয়ে বলল, বোতলের গা থেকে মেঝেয় জল পড়েছে, মুছে নিয়ে যা তো!

ঘর মুছে পুনম চলে যাওয়ার পর ঝিনুক বলল, আমার কথার একটুও দাম দেয় না। এম পি বন্ধু এসেছে তো কী হয়েছে? তাই বলে বাড়িটাকে শুঁড়িখানা বানাতে হবে? আর আজকালকার এম পিরাই বা কীরকম? যখন তখন তারা মদ খাবে কেন?

মদের সপক্ষে কেউ বলার নেই দেখে বৈশম্পায়ন খানিক ভেবে এবং খানিক সাহস সঞ্চয় করে মৃদু করে বলল, ঠিক মদ খাওয়া নয়। স্টিমুল্যান্ট হিসেবে একটু খাওয়া খারাপ নয়। অনেক বড় বড় লিডারও খেতেন।

স্টিমুল্যান্ট! বলে ঝিনুক ব্যঙ্গের হাসি হাসল। বলল, তা হলে তো বলার কিছুই ছিল না। আমি আপনার বন্ধুকেও চিনি, মদনকেও চিনি। মদ পেলে এমন হামলে পড়বে যে, দেখলে মনে হয় এটা ছাড়া দুনিয়ায় আর কোনও ইমপরট্যান্ট জিনিস নেই। হোটেল থেকে এক কাড়ি দামি খাবার নিয়ে আসবে, তার কিছুই শেষ পর্যন্ত খেতে পারবে না। বহুবার এরকম ঘটেছে।

তা হলে তো–বলে বৈশম্পায়ন সংশয় প্রকাশ করে।

সেই জন্যেই আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। মাতালদের আমি দু চোখে দেখতে পারি না।

সব কথা যে বৈশম্পায়ন শুনতে পাচ্ছে বা বুঝতে পারছে তা নয়। সে চেয়ে আছে, বুঝবার চেষ্টাও করছে, কিন্তু ঝিনুকের সৌন্দর্য থেকে একটা সম্মােহন ওর গায়ের সুগন্ধের মতোই বার বার উড়ে এসে আচ্ছন্ন করছে তাকে। ঝিনুক! কী সুন্দর!

বৈশম্পায়ন সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে গুজে রেখে বলল, আপনি যদি বেরিয়ে যান তা হলে আমারও খালি বাড়িতে বসে থাকার মানে হয় না।

এই বলে বৈশম্পায়ন উঠতে যাচ্ছিল, ঝিনুক ভারী নরম মায়াবী গলায় বলল, আপনি তো ওদের মতো একন্ট্রোভারট নন, তবে আপনি খান কেন বলুন তো! যারা সিরিয়াস মানুষ, যাদের মনের গভীরতা আছে তারা কেন এসব বাজে ফুর্তি করবে, আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না।

বৈশম্পায়ন অপরাধী মুখ করে লাজুক গলায় বলে, আমার মনে কোনও নেশা নেই, তবে প্রেজুডিসও নেই।

নেশা মাধবেরও নেই। কিন্তু কোনও অকেশন পেলেই মদের চৌবাচ্চায় লাফিয়ে পড়বে। আজকাল লোকে এত মদ খায় কেন তা আমি একদম বুঝতে পারি না।

বৈশম্পায়ন সম্মােহনের আর একটা ঘোর কাটাল।ঝিনুক! কী সুন্দর!

মৃত্যুনদীর কলরোল কানে ভেসে আসছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে আয়ু। জীবনে সময় বড় কম। বড় কম। তুমি কি জাননা, ঝিনুক, কিশোরী বয়স থেকে আমি তোমার প্রেমিক।

বৈশম্পায়ন যে হাসিটা হাসল তা সম্মােহিতের হাসি। বলল, কেন যে খায় তা আমিও জানি না। মদের দামও আজকাল ভীষণ, তবু তো খাচ্ছে।

ঝিনুক ভ্রু কুঁচকে বলল, মদের দাম কি খুবই বেশি?

খুব বেশি। প্রতি বছর বাজেটে ট্যাকস বসে আর দাম ওঠে।

 ওই বোতলগুলোর দাম কত হবে জানেন?

মাথা নেড়ে বৈশম্পায়ন বলে, আমার ঠিক আইডিয়া নেই। তবে পঞ্চাশ-ষাট টাকা বা তারও বেশি।

চোখ কপালে তুলে ঝিনুক বলে, একেকটা বোতলের অত দাম?

 খুব কম করে ধরেও।

ইসস। বলে ঝিনুক তার চমৎকার হাতখানা হোট কপালে রেখে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ।

মদ খুবই একসপেনসিভ নেশা। বৈশম্পায়ন মৃদুস্বরে বলে, আপনি কি জানতেন না?

 ঝিনুক কুটি করে বৈশম্পায়নের দিকে চেয়ে বলে, আমার মদের দাম জানার কথা নাকি?

 বৈশম্পায়ন ঢোক গিলে বলে, ঠিক তা মিন করিনি। তবে আজকাল সবাই সব খবর রাখে।

ঝিনুক বিরক্ত গলায় বলে, আমি সকলের মতো নই।

বৈশম্পায়নের ভিতর থেকে কে যেন সঙ্গে সঙ্গে পো ধরে, তা ঠিক। আপনি অন্যরকম।

ঝিনুক আবার ভ্রুকুটি করতে গিয়ে হেসে ফেলে বলে, আমি কীরকম বলুন তো?

বৈশম্পায়নের ঠোঁটের কথা ঠোঁটেই মরে যায়। আর একটা সম্মােহনের ঢেউ এসে আচ্ছন্ন করে তাকে। ঝিনুক! কী সুন্দর! তুমি যেখান দিয়ে হেঁটে যাও সেই পথে সোনার গুঁড়ো ছড়িয়ে থাকে। যেদিকে তাকাও, আলো হয়ে যায়। তোমার জন্যই সেতু বন্ধন। তোমার জন্যই ট্রয়ের যুদ্ধ। তোমার জন্যই বেঁচে থাকা মরে যাওয়া। তুমি কীরকম তা কি বলে শেষ করা যায়? কথার অত ক্ষমতা নেই ঝিনুক।

ঝিনুক এই অসহায় লোকটিকে রেহাই দিয়ে একটা খাস ফেলে বলল, আমি ভীষণ খারাপ, জানি।

না, না।-বৈশম্পায়ন প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে।

ঝিনুক উঠে দাঁড়ায়। বলে, আপনার বন্ধুর ফিরতে দেরি হবে। অফিস থেকে বেরিয়ে কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যাবে খাবার আনতে।আপনি কি ততক্ষণ একা বসে থাকতে চান?

না।—বৈশম্পায়ন উঠে দাঁড়িয়ে বলে, বরং একটু ঘুরে আসি।

কোথায় যাবেন?

বিশেষ কোথাও না।

ঝিনুক মৃদু একটু হাসে। বলে, তা হলে আমার সঙ্গে চলুন।

কোথায়?

আমার বোন থাকে কাছেই, গোলপার্কের ওদিকটায়। ওর জন্য একটা ঝি ঠিক করেছি, বলে আসি।

বৈশম্পায়ন এত সৌভাগ্যের কল্পনা করেনি। একটু অবিশ্বাসী চোখে চেয়ে থেকে বলল, চলুন।

.

১০.

গড়িয়া স্টেশনের খানিকটা আগেই চলন্ত ইলেকট্রিক ট্রেনের কামরা থেকে একটা লোক লাইনের ধারে লাফিয়ে নামল। কাজটা খুব সহজ নয়। ইলেকট্রিক ট্রেনের কামরায় নামবার সিড়ি নেই, পাটাতনও বেশ উঁচু আর লাইনের ধারে অতি সংকীর্ণ জায়গায় নুড়ি পাথর ছড়ানো, যমদূতের মতো গা-ঘেঁষা লোহার পোস্ট। কিন্তু লোকটা নামল অনায়াসে, যেন প্রতিদিন এইভাবে নামা তার অভ্যাস। কামরার কিছু লোক তাকে বহুক্ষণ লক্ষ করছিল, এখন তারা মুখ বের করে তাকে চলন্ত ট্রেন থেকে দেখছে। কেউ অবশ্য কিছু বলল না। তার চেহারাটাই এমন যে, লোকে কিছু বলতে সাহস পায় না, কাছে এগোতে চায় না।

ট্রেনটা এগিয়ে গিয়ে থামল। কয়েকশো গজ দূরেই স্টেশন। স্পষ্ট বিকেলের আলোয় সব দেখা যাচ্ছে। বহু লোক। গিজগিজে ভিড়। সে এখন যতদূর সম্ভব ভিড় এড়াতে চায়।

নামবার সময় উপুড় হয়ে মাটিতে হাতের ভর দিয়েছিল সে। এখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাতে ঘষাঘষি করে ধুলো ময়লা ঝেড়ে ফেলল।

চারিদিকে শরতের ভারী সুন্দর এক বিকেল। বাঁয়ে গড়িয়ার বাজারে বোধহয় আজ হাট বসেছে। খালে একমাথা ভর ভরন্ত জল। আকাশে হেঁড়া হেঁড়া মেঘ। গাছপালা গভীর সবুজ। মেঠো গন্ধ। অবারিত মুক্ত মাঠঘাটে অগাধ বাতাস। গরম না, ঠান্ডাও না। লোকটা অবশ্য প্রকৃতির এই সাজগোজ লক্ষ করল না। তার সতর্ক তীক্ষ্ণ চোখ চারিদিকে ঝেটিয়ে পরিস্থিতিটা দেখে নিচ্ছিল। যা দেখল তাতে নিশ্চিন্ত হল সে।অবশ্য এই নিশ্চিন্ত অবস্থাটা বেশিক্ষণের জন্য নয়। বহু চোখ তাকে খুঁজছে। খুঁজে পেলে যে আবার ধরে জেলে পুরবে, তা নাও হতে পারে। বেকায়দা দেখলেই গুলি চালাবে। তার অবস্থাটা খুব সুখের নয়। সুখে সে কোনওকালে ছিলও না। একটা রাতও নিশ্চিন্তে ঘুমোয়নি বড় হওয়ার পর থেকে। কোনও পথেই সাবধান না হয়ে হাঁটেনি কখনও। খুব ঘনিষ্ঠ লোককেও আগাপাশতলা বিশ্বাস করেনি।

ইশারা ছিল অনেক আগে থেকেই। দিন পনেরো আগে একজন পলিটিক্যাল আড়কাঠি জেলখানায় তার সঙ্গে দেখা করে যায়। বেশি ধানাই-পানাই করেনি, সোজা বলেছে, আমাদের হয়ে কাজ করবে?

সে বরাবরই এ দলের বা সে দলের হয়ে কাজ করেছে। সুতরাং এ প্রশ্নের জবাব দিতে ভাবতে হয়নি, করব।

ব্যস, কথা ওইটুকুই। কিন্তু তার মধ্যেই ইশারাটা ছিল। পরশু বিকেলে একজন কয়েদির মারাত্মক পেট ব্যথা। তাকে পুলিশের গাড়িতে হাসপাতালে নেওয়ার সময় তার ডাক পড়ল স্ট্রেচার ধরতে। হাসপাতাল পর্যন্ত রুগির সঙ্গে ছিল সে। বেড়ে তুলে দিল। আর তারপরই দেখল, পালানোর জন্য কসরতের দরকার নেই। শুধু ইচ্ছে। অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সে পেচ্ছাপখানা হয়ে পিছনের সিড়ি দিয়ে নেমে গেল। কয়েদির পোশাকটাই ছিল সবচেয়ে বেখাপ্পা জিনিস, কিন্তু কলকাতার লোক আজকাল এতরকম বিচিত্র পোশাক পরে যে, লোকে তেমন মাথা ঘামায় না।

লোকটার বুদ্ধি তেমন বেশি নয়, লোটার মনে খুব একটা জটিলতা নেই, দুনিয়া সম্পর্কে তার ধারণা খুবই স্পষ্ট এবং মোটা দাগের। তার বেশির ভাগ অনুভূতিই শারীরিক। যেমন যৌনতা এবং ক্ষুধাবোধ। তবে শরীরের ব্যথা-বেদনার বোধ তার খুবই কম। তার মানসিক অনুভূতি এক আঙুলে গোনা যায়। কোনও ফালতু দুঃখ-টুঃখ আর তার নেই। শুধু আছে একটা প্রচণ্ড একরোখা আগুনে। রাগ, আছে ভয়ংকর রকমের টাকার লোভ, দুনিয়ায় প্রায় কারও প্রতিই তার কোনও গভীর ভালবাসা নেই, মানুষকে খুন করতে তার দুঃখ হয় না বটে, কিন্তু খুন করার পর সে বহুক্ষণ খুব অস্থির থাকে, তার একটা পশুসুলভ ভয়ও আছে, কিন্তু সেটা খুব কমই সে টের পায়। তবে একটা অনুভূতি তার প্রখর, সে আগে থেকেই বিপদের গন্ধ পায়।

পরশু রাতে কলকাতার ভিড়ে ছাড়া পেয়ে তার প্রথম জেগেছিল এক হিংস্র প্রচণ্ড কাম। সেই। তাড়নায় তার হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। আজকাল দুনিয়া খুব তাড়াতাড়ি পাল্টায়, দোস্তরা রং বদলে ফেলে, দল ভেঙে যায়। সে জেলখানায় থাকতে কী কী হয়ে গেছে তা না জানলে সে লাইনটা ধরতে পারবে না। লাইন ধরতে না পারলে বেরিয়েও লাভ নেই। খাবি খেয়ে মরতে হবে। তাই কোনও ঝুঁকি নেওয়া তার উচিত ছিল না। কিন্তু সেই কাম তাকে তাড়া করে আনল কসবা পর্যন্ত। নীতু বরাবর তার বাধ্য ছিল, বাঁধাও ছিল। সে নীলু হাজরার ফুকো খুনের মামলায় ঘানি টানতে যাওয়ার পর নীতু বিয়ে করেছে। বেশিদিন নয়, মাত্রই। নীতুকে নিয়ে মাঝে মাঝে থাকবে বলে সে রথতলার দিকে বস্তির যে ঘরটা ভাড়া নিয়ে রেখেছিল সেই ঘরেই সংসার পেতে বসেছে।

সেই সদ্য-পাতা সংসারে সে রাত ন’টায় হানা দিল।

 কী রে নীতু! জমিয়ে নিয়েছিস?

যে নীতু তাকে দেখলে গলে পড়ত সে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল। অদ্ভুত এক নাকিসুরে বলে উঠল, তুমি পালিয়েছ! আঁ!

কেন, তাতে তোর অসুবিধে হল?

বিয়ের জল পড়ে নীতুর রুক্ষ চেহারাটা কিছু ফিরেছে। বেড়ার সঙ্গে সিটিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ও এইমাত্র ম্যাচিস কিনতে মোড়ে গেল, এক্ষুনি আসবে।

লোকটা কে?

তুমি চিনবে না।

কী করে?

আটা চাকি আছে।

তা তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? কিছু খেতে-মেতে দিবি?

নীতু রুটি সেঁকছিল জনতা স্টোভে। ঘরময় কেরোসিনের গন্ধ। এ কথায় একটু সহজ হয়ে বলল, দিচ্ছি। বোসো। এই পোশাকে এলে, লোকে দেখেনি?

দেখেছে।

পুলিশও দেখেছে তা হলে!

দেখলে দেখেছে। ভয় পাচ্ছিস?

 নীতু একটু হাসল। একেবারে মড়ার হাসি। মৃদুস্বরে বলল, পুলিশ এলে তো মুশকিল।

তোর মুশকিল কী? মুশকিল তো আমার!

তোমার কথাই ভাবছি।

 তোর লোকটার জামা প্যান্ট আছে কিছু?

 নীতু মুখ নিচু করে বলল, আছে, তবে তোমার গায়ে হবে না।

 দেখি। বের কর।

 নীতু খুব দ্বিধা আর অনিচ্ছের সঙ্গে ঘরের একধারে রাখা একটা সস্তা আলনা থেকে একটা প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট নিয়ে আসে। লোকটা দেখে, দিব্যি ফিট করবে তাকে। কোমরটা একটু ঢিলে হতে পারে, ঝুল একটু বেশি। তা হোক, এই অবস্থায় ওটুকু কিছু না।

জামা প্যান্ট পাশে রেখে লোকটা মাটি ওঠা ঠান্ডা মেঝের ওপর বসে বলল, দে।

নীতু খুব আস্তে ধীরে এবং অনিচ্ছের সঙ্গে একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় রুটি আর কুমড়োর তরকারি বেড়ে দিয়ে বলে, ডাল আছে।

কাঁচা লঙ্কা দে, আর পেঁয়াজ থাকে তো পেঁয়াজ। হাতটা কোনওরকমে গ্লাসের জলে একটু ধুয়ে সে দিকবিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রথম কয়েক গ্রাস খাওয়ার পরই সচেতন হল। দরজার দিকে মুখ করেই বসেছিল, কিন্তু পাতের দিকে নজর থাকায় খেয়াল করেনি। দরজা খুলে একটা লোক ভিতরে ঢুকতে গিয়ে থমকে চেয়ে আছে।

চোখ তুলে সে লঘু স্বরে বলে, এসো নটবর। দরজাটা বন্ধ করে দাও।

লোকটার চেহারা দেখলেই মালুম হয়, একে নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। চুলগুলো ছোেট করে ঘঁটা, ঘাড়টা একটু তুলে কামাননা, রোগা, তামাটে রং, মুখটা ভালমানুষের মতো। খেটে খাওয়া লোকের মতো মজবুত চেহারা। বয়স চল্লিশের কিছুনীচে হবে। সে চোখ পাকিয়ে তাকালে পেচ্ছাপ করে দেবে। লোকটা তাকে একটুক্ষণ দেখেই বুঝে গেছে। ঘরে ঢুকে সাবধানে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর কোনও কথা না বলে নিঃশব্দে বিছানায় গিয়ে বসল। নীতু টু শব্দটি করল না।

কয়েক চোপাটে রুটি উড়িয়ে ভরপেট জল খেয়ে লোকটা উঠল। এবার আর একটা কাজ। নীতুকে চাই।

চাই বটে কিন্তু সমস্যা এই ফালতু লোকটাকে নিয়ে মুখ দেখলেই বোঝা যায়, এ লোকটা ভিতু, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদি ঘর থেকে একে বের করে দেওয়া যায় তবে বাইরে গিয়ে বস্তি আর পাড়ার লোক জুটিয়ে আনতে পারে। আর ঘরে থাকলে নীতুর অসুবিধে। শত হলেও এর সঙ্গেই ততা সে ঘর করছে।

তবে এসব সমস্যা নিয়ে ফালতু মাথা ঘামাতেও সে রাজি নয়। এতকাল সে নীতুকে যেমন ইচ্ছে কাজে লাগিয়েছে। দু’দিন চোখের আড়াল হয়েছিল, সেই ফঁাকে এই ট্রেচারি। সুতরাং নীতুর যদি কিছু অসুবিধে হয় তবে সেটা ওর পাওনা।

লোকটা তার হাফপ্যান্টে হাত মুছে বলল, তারপর কাপ্তান! কী খবর? নীতু তোমার দেখভাল ঠিকমতো করছে তো?

লোকটা হাঁ করে চেয়েছিল। হাতে একটা বিড়ির বান্ডিল আর একটা দেশলাই তখনও ধরা। কথার জবাব দিতে গিয়ে দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, হ্যাঁ।

জেলখানার কামিজটা গা থেকে খুলে ফেলে সেইটে ঘুরিয়েই লোকটা একটু হাওয়া খেয়ে পরিস্থিতিটা ঠিকমতো বুঝে নিল। নীতু তাকে জানে, সুতরাং নীতু ঝামেলা করবে না। কিন্তু এই লোকটা করতে পারে। আর কিছু না হোক, ভয়ে চেঁচাতে পারে। এই ঘরটার সুবিধে যে, এটা কোনার ঘর। উত্তর দিকে আর ঘর নেই, উঠোন। কিন্তু দক্ষিণের ঘরে লোকজনের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বস্তি জুড়েই নানারকম কথাবার্তা, চেঁচানি, চঁা ভা, চেঁচানোমাত্রই লোক জুটে যাবে।

লোকটা খুব ঠান্ডা গলায় নীতুর মানুষকে বলল, তুমি যাকে নিয়ে ঘর করছ সে আমার রাখা মেয়েমানুষ, তা জানো কাপ্তান?

লোকটা আবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, একটু-আধটু শুনেছিলাম।

নীতু আসলে আমার মেয়েমানুষ। তুমি ফালতু লোক। তাই না?

লোকটা চোখ সরিয়ে নিয়ে ভয় খাওয়া গলায় বলে, আমি ঝামেলায় যেতে চাইনি। কিন্তু নীতু বলল-লোকটা থেমে যায়।

কী বলল?—সে ধমক দেয়।

বলল আপনার অনেকদিনের মেয়াদ। ওকেও দেখাশোনার কেউ নেই। তাই

কথা বাড়িয়ে লাভ নেই কাপ্তান। আমার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন নীতুকে আমি ফেরত চাই। তুমি কী করবে?

আমি!—বলে লোকটা অগাধ জলে পড়ে চারদিকে তাকাল।

এতক্ষণ নীতু কথা বলেনি। কিন্তু এইবার আটা মাখা হাত শব্দ করে ঝেড়ে বলল, নবদা, আমি ওকে বিয়ে করেছি। তুমি এখন ওসব কথা বোলো না।

তোরও বিয়ে হয় নীতু? ঘাঁটাপড়া মেয়েমানুষের বিয়ে? ওপরের ওই বাঁশ দেখছিস? ওর সঙ্গে তোর চুল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখব। বলে সে নীতুর দিকে চেয়ে থাকে।

নীতু চোখ নামায় বটে, কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার ফেঁপানির শব্দ পাওয়া যায়।

 নব নীতুর মানুষটার দিকে চেয়ে বলে, কী করবে কাপ্তান? যাবে? না থাকবে?

লোকটা নীতুর দিকে চেয়ে শুকনো মুখে একটা খাস ছেড়ে বলে, নীতু ছাড়া কি আপনার চলবে না? আমরা অনেক ভেবেচিন্তে গুছিয়ে সংসার পেতেছিলাম।

ওসব বাত ছাড়ো। আজ রাতের মতো নীতুকে আমার চাই। তুমি বসে বসে দেখবে? না যাবে?

লোকটা জিব দিয়ে ঠোঁট চাটল। প্রাণের ভয় বড় ভয়। তবে তলানি সাহসটুকু উপুড় করে ঢেলে সে বলল, নীতুকে আমার খুব পছন্দ ছিল। ওকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে দাদা। বলতে বলতে তার চোখে টলটল করে জল ভরে এল।

নীতু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, তোমারও তো বউ আছে নবদা? গৌরীদিকে জিজ্ঞেস কোরো তো, পারে কিনা তোমাকে ছাড়া আর কাউকে

এ কথায় নব আর একটু গরম হল। চাপা হিংস্র গলায় বলল, মুখ ভেঙে দেব বেশি কথা বললে। লোকটার সাহসের তলানি আরও কয়েক ফোঁটা অবশিষ্ট আছে দেখা গেল। সে বিড়ি আর দেশলাই বারবার এ হাত ও হাত করতে করতে বলল, নীতুকে কি আপনি বরাবরের জন্য চান দাদা? না কি আজ রাতটা হলেই চলে?

লোকটা ব্যবসা জানে। নব কামিজটা দুরের আলনার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, অত সব ভেবে দেখিনি। এখন চাই, এটুকু বলতে পারি। লোকটা শুকনো মুখে বলল, আমাদের একটা সিস্টেম না। কী যেন বলে তাই তৈরি হয়ে গেছে তো! তাই বলছিলাম

কী বলছিলে কাপ্তান?

বলছিলাম নীতুকে ছাড়া যদি আপনার না চলে তা হলে আজ রাতের মতো আমি বরং আমার এক পিসি আছে বাঘাযতীনে, তার কাছে গিয়ে থেকে আসি। কাল পরশু আমরা অন্য জায়গায় উঠে যাব।

এই সময় নীতু হঠাৎ ফুঁসে ওঠে, না, তুমি যাবে না। কিছুতেই যাবেনা! বলে উঠতে যাচ্ছিল নীতু।

নব তখন মারল। বেশি জোরে নয়, ডান পা সামান্য তুলে মাজার একটু ওপরে। নীতু আবার বসে পড়ল। কিন্তু চেঁচাল না। প্রাণের ভয়।

লোকটা তাড়াতাড়ি উঠে বলল, মারবেন না। আমি যাচ্ছি নীতু। কাল বেলাবেলি চলে আসব। ভেবো না।

নীতু বিহ্বল মুখে বসে শূন্য চোখে চেয়ে ছিল। লোকটার কথায় একটু নড়ল। তারপর ধীরে আটা মাখার কানা উঁচু কলাই করা বাটিটা সরিয়ে রাখল।

নব লোকটার দিকে চেয়ে বলে, বাইরে গিয়ে কোনওরকম গোলমাল করবে না তো?

লোকটা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলে, না। আমি তেমন মানুষ নই। আর নীতু তো আপনার হাতেই রইল।

লোকটা নিঃশব্দে চলে গেলে নব গিয়ে দরজা দিল। তারপর এক ঝটকায় নীতুকে তুলে আনল বিছানায়।

তবে এরকম কাঠের মতো শক্ত, বিস্বাদ মেয়েমানুষ সে জীবনে ভোগ করেনি।

রাতে বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আরও দু’বার নীতুর গায়ে হাত তুলতে হয়েছিল নবকে। তবে খবর বিশেষ কিছু পেল না। হয় নীতু খবর চেপে যাচ্ছিল, নয়তো জানেই না।

পরদিন বেলা দশটা নাগাদ লোকটা আবার এল। মুখ শুকননা, চোখ লাল, বারবার ঢোক গিলছে। নীতু নবর জন্য স্টোব জ্বেলে দ্বিতীয় দফা চা করছিল। শক্ত মুখে একবার তাকাল লোকটার দিকে। কিছু বলল না। লোকটাও না।

শুধু নব খুব আদর দেখিয়ে বলল, কী খবর কাপ্তান? সারা রাত নীতুর কথা ভেবে মেয়েমানুষের মতো কান্নাকাটি করেছ নাকি? তুমি সতী বটে হে?

লোকটা তার দিকে চাইল না। মাথা নিচু করে উবু হয়ে ঘরের মাঝখানটায় বসে রইল।

লোকটার ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কামাল নব, লোকটার তোলা জলে স্নান করল, লোকটার পয়সায় কেনা চালের ভাত খেল, তারপর লোকটার জামা আর প্যান্ট পরে এবং লোকটার কাছ থেকেই গোটা ত্রিশেক টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। নীতুটা অন্যের হয়ে গেছে। ওকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না ভেবে একটু গা জ্বালা করল তার। কিন্তু এসব গায়ে মাখার মতো সময় নেই। নীতু আর কাপ্তান আজই এ জায়গার পাট ওঠাবে ভেবে রওনা দেবার আগে বলে গেল, ঘরটা আমার নামে নেওয়া আছে হে কাপ্তান, বাড়িওলাকে আবার ছেড়ে দিয়ে যেয়ো না। একটা তালা লাগিয়ে মোড়ে মান্তুর দোকানে আমার নাম করে চাবিটা রেখে যেয়ো।

পালালেই যে মুক্তি পাওয়া যাবে না তা জানে নব। কিছুদিন আগে যে পলিটিক্সওয়ালা দেখা করতে এসেছিল তার সঙ্গে পরশু দিনের ঘটনাটা দুইয়ে দুইয়ে চার হয়। সকলের নাকের ডগার উপর দিয়ে সে খুনের আসামি নইলে বেরিয়ে এল কী করে? পিছনে একটা মতলব কাজ করছে। সেই মতলবটা বুঝতে লাইন ধরতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। একবার বেরিয়ে আসতে দিয়েছে বলেই যে পুলিশ জামাই-আদর করবে তা নয়। বিস্তর পুলিশ মতলবটার খবর জানে না।

দিনের বেলা লোকালয়ে তাই একটু গা ছমছম করছিল নবর। তবু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে সেই পলিটিক্সওয়ালার সঙ্গে মোলাকাত করতে হবে। কিন্তু লাইনটা জানে না নব। লাইনটা জানতে সে দু-চার জায়গায় ফুঁ দিল। খুব সুবিধে হল না। তবে বিকেলের দিকে বালিগঞ্জে এক পাঞ্জাবির দোকানে রুটি তড়কা খেতে খেতে ক্ষীণভাবে মনে পড়ল, ওই পলিটিক্সওয়ালা যে পার্টির লোক সেই পার্টির একটা ছোকরাকে সে চেনে। নাম জয়দ্ৰথ। তার দাদা এক ব্যাঙ্কের অফিসার, তারও একটা শক্ত যেন কী নাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ওই একই গ্রুপের লোক মদনদাও। আর কে না জানে মদন ফোর টুয়েন্টি তাকে পুরো ফল্স কেসে ঘানি গাছে জুড়ে দিয়েছিল!

লাইন থেকে নেমে ডান হাতে পিচ রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে নবর গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল রাগে।

জয়ের বাড়িটা খুঁজে বের করতে খুব সময় লাগল না নবর। জয় বাড়িতে নেই, তার মা বলল।

 কখন আসবে জানেন?

কী জানি বাবা। এম পি মদন কলকাতায় এসেছে, তার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে সারাদিন।

 মদন এসেছে! নবর গায়ের রোঁয়া আর একবার দাঁড়াল। গা-জ্বালা করল তার।

দুনিয়ার রং এ বেলা ও বেলা পালটে যায়। যারা তার পালানোর পথ করে দিয়েছে তাদের রং পালটাবে। কিন্তু একসময়ে যার হয়ে সে খুনখারাপি মারদাঙ্গা করেছে, বিস্তর ঝামেলা থেকে তাকে নিজের জান দিয়ে বাঁচিয়েছে তার বেইমানির শোধ নেওয়ার মওকা আর পাবে না।

নব বড় রাস্তার কাছাকাছি একটা তেমাথায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে জয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়