১০. অলকা

মেঘৈর্মেদুরম্বরম। কাল রাত থেকে বৃষ্টি ছাড়েনি। যেমন ভয়ঙ্কর তেজে কাল রাত নটায় বৃষ্টি এল প্রায় ঠিক তেমনি তেজে সারা রাত ধরে বৃষ্টি পড়ল। ঘুমের মধ্যেই মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, কলকাতা ভেসে যাবে।

একটা গোটা ফ্লাটে সম্পূর্ণ একা থাকতে আমার যে ভয়-ভয় করে তা মিথ্যে নয়। শোয়ার আগে বারবার দরজা জানালার ছিটকিনি দেখি, খাটের তলা, আলমারির পেছনে এবং আর যে সব জায়গায় চোরবদমাশ লুকিয়ে থাকতে পারে তা ভাল করে না দেখে শুই না। ভূতের ভয় ছেলেবেলা থেকেই ছিল না, তবে বড় হওয়ার পর কখনও কখনও কী যেন একটা ভূত-ভূত ভয়ের ভাব হয়। বিশেষ করে যেদিন বৃষ্টি নামে। কাল সারা রাতের অঝোর বৃষ্টিতে বারবার জানালার শার্সিতে টোকা পড়েছে বৃষ্টির আঙুলে, দরজা ঠেলেছে উন্মত্ত বাতাস। ঝোড়ো বৃষ্টিতে কলকাতার ট্রামবাস ডুবে গেল বুঝি! শহরটা বোধহয় একতলা সমান জলের তলায় নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এমন বাদলা বহুকাল দেখিনি।

ঘুম ভেঙে একবার উঠে দেখি, রাত দুটো। শীত-শীত করছিল। বাথরুমে গিয়ে হঠাৎ কেন গা ছমছম করল! একটু শিউরে উঠে প্রায় দৌড়ে এসে বাতি না নিভিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। বাতি জ্বালানো থাকায় ভয়-ভয় ভাবটা কমল বটে, কিন্তু ঘুম আসে না। কোনওখানে মানুষের জেগে থাকার কোনও শব্দ হচ্ছে না। কুকুরের ডাক, বেড়ালের আওয়াজ কিছু নেই। ঘনঘোর মেঘ ডেকে ওঠে কেবল, বৃষ্টির জোর বেড়ে যায়, চারিদিক লণ্ডভণ্ড হতে থাকে। শুয়ে থেকে বুঝতে পারছিলাম, পৃথিবীতে একা হওয়ার মধ্যে কোনও সুখ নেই। একা মানুষ বড় নিস্তেজ, মিয়োনো।

নরম বালিশ বারবার মাথার তাপে গরম হয়ে যাচ্ছে। আমি বালিশ উল্টে দিচ্ছি বারবার। বর্ষাকালের সোঁদা স্যাঁতা এক গন্ধ উঠেছে বিছানা থেকে। কিছুতেই রাত কাটছে না।

এইভাবে রাত আড়াইটেয় বড় অসহ্য হয়ে উঠে বসলাম। বুকের ভিতরটা ফাঁকা লাগছে। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল কারও সঙ্গে একটু কথা বলতে, কারও কথা শুনতে। কিন্তু আমার তো তেমন কেউ নেই।

জানালার ধারে এসে দাঁড়ালাম। ব্যালকনির দিকে জানালার শার্সির পাল্লা আছে, অন্যগুলোয় কাঠের পাল্লা। শার্সিতে চোখ রেখে দেখি ভূতের দেশের অন্ধকার চারদিক। নীচের রাস্তায় পরপর আলোগুলোর মধ্যে দুটো মাত্র জ্বলছে এখনও। সেই আলোয় দেখা গেল, রাস্তায় হাঁটুজল। জলে প্রবল বৃষ্টির টগবগানি। আকাশ একবার দুবার চমকায়, গম্ভীর মেঘধ্বনি হয়। বড় একা লাগে।

আমার পরনে নিতান্তই সংক্ষিপ্ত পোশাক। গায়ে কেবল ব্লাউজ, পরনে সায়া। রাতে এত বেশি গায়ে রাখতে পারি না। ঘরের বাতি জ্বালা রেখে এ পোশাকে জানালায় দাঁড়ানো বিপজ্জনক। কিন্তু ওই নিশুত রাতে কে আর দেখবে। আর নটাও বড় অস্থির তখন। ঠাণ্ডা শার্সিতে গাল চেপে ধরে বিবশার মতো বাইরে তাকিয়ে থেকে থেকে আস্তে আস্তে জগৎসংসারের ওপর এক গভীর অভিমান জেগে উঠল। কেবল মনে হতে লাগল–তোমাদের কাছে আমার আদর পাওনা ছিল। কেন তোমরা কেউ কখনও আমাকে ভালবাসলে না? বলল কেন…?

কখনও কেঁদেছি আপনভোলা হয়ে। কাঁদছি আর কাঁদছি। আর কাকে উদ্দেশ করে যেন বিড়বিড় করে বলছি–এবার একদিন বিষ খেয়ে মরব, দেখো।

এ কথা বিশেষ কারও উদ্দেশ করে বলা তা সঠিক আমিও জানি না। তবে এই প্রচণ্ড বৃষ্টির রাতে যখন চারদিকে সব নাগরিকতা মুছে গিয়ে অভ্যন্তরের বন্যতা বেরিয়ে আসে, যখন মনে হয় এইসব ঝড়বৃষ্টির মতো কোনও অঘটনের ভিতর দিয়েই আমাকে সৃষ্টি করেছিল কেউ, তখন আর কাউকে নয়, কেবল এই জন্মের ওপরেই বড় অভিমান হয়।

একা, বড় একা।

শার্সির কাছ থেকে ঘরের মধ্যে ফিরে আসি। সাজানো ঘর-দোর ফেলে অসীমদা কেন বিদেশে চলে গেছে তার পরিবার নিয়ে। হয়তো ফিরবে, হয়তো কোনওদিনই ফিরবে না। এই যে আলমারি, খাটপালঙ্ক, রেডিয়োগ্রাম, নষ্ট ফ্রিজ, টেলিফোন, এরা কারও অপেক্ষায় নেই, এরা কারও নয়। তবু মানুষ কত যত্নে এইসব জমিয়ে তোলে। কান্না পাচ্ছিল। টেলিফোনের সামনে বসে বিড়বিড় করে বললাম কোনও মানুষকে জাগানো দরকার, আমাকে ভূতে পেয়েছে আজ রাতে, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে, আমি বড় একা।

টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকি। কোনও বিশেষ নম্বর ধরে নয়, এমনি আবোল-তাবোল যে নম্বর মনে আসছে সেই ঘরে আঙুল দিয়ে ডিল ঘুরিয়ে দিচ্ছিলাম। প্রথমবার অনেকক্ষণ ধরে রিং হল, কেউ ধরল না। আমার ভয় করছিল শেষ পর্যন্ত কেউ কি ফোন ধরবে না?

তৃতীয়বার রিং হতে দু মিনিট বাদে একটি মেয়ের ধুম-গলা ভেসে এল

–আমি অলকা।

–অলকা। কোন অলকা? এটা ফোর সিক্স ডবল থ্রি…

আমি বললাম–শুনুন, রং নাম্বার হয়নি, আমি আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।

অবাক মেয়েটি বলল কী কথা?

 আমি বললাম আপনার কে কে আছে? স্বামী।

–আমার বিয়ে হয়নি।

–মা? বাবা? ভাইবোন?

বাবা আছেন। এক ভাই। কিন্তু কী ব্যাপার বলুন তো! এত রাতে এসব কী প্রশ্ন?

 –আমার বড় একা লাগছে। ভয় করছে। আমার নাম কী?

ওপাশের মেয়েটি অবশ্যই খুব ভাল স্বভাবের মেয়ে। অন্য কেউ হলে ফোন রেখে দিত। এ কিন্তু জবাব দিল। বলল–আমার নাম মায়া দাস।

কী করেন?

 কলেজে পড়াই। কিন্তু আমার এখন খুব টায়ার্ড লাগছে। আপনি কে বলুন তো!

–আমি অলকা। আমি একটা ফ্ল্যাটে একা থাকি। আজ রাতে বড় ঝড় বাদল, আমার ভাল লাগছে না।

–সেই জন্য? আমার ফোন নম্বর আপনি জানলেন কী করে?

–জানি না তো এখনও জানি না। আন্দাজে ছটা নম্বর ডায়াল করছিলাম, নম্বরগুলো মনেই নেই। এখন। আপনি রাগ করলেন?

-না, রাগ নয়। আমাকে অনেক খাতা দেখতে হচ্ছে। ভীষণ টায়ার্ড।

–তা হলে ঘুমোন।

–শুনুন, আপনি আমার চেনা কেউ নন তো? ফোনে মজা করার জন্য পরিচয় গোপন রেখে…

না না। সেসব নয়। আমি আসলে চাইছি, কিছু লোক আমার মতোই জেগে থাকুক আজকের রাতে। আমার কেবল মনে হচ্ছে আমি ছাড়া সারা কলকাতায় বুঝি আর কেউ জেগে নেই।

ওপাশে বোধহয় মেয়েটির বাবা জেগে গেছেন। এক গম্ভীর পুরুষের স্বর শুনতে পেলাম–কে রে মায়া? কোনও অ্যাকসিডেন্ট নাকি?

মায়া বোধহয় মাউথপিসে হাত চাপা দিল। কিছুক্ষণ সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তারপর মায়া বলল–আপনার নাম-ঠিকনা কিছু বলবেন?

-কেন?

বাবা বলছেন, আপনার কোনও বিপদ ঘটে থাকলে আমরা হেয় করার চেষ্টা করতে পারি।

–অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার বিপদ কিছু নেই। শুধু ভয় আছে। ঘুম ভাঙালাম বলে কিছু মনে করবেন না।

–আমার বাবা ডি এস পি। কোনও ভয় করবেন না।

ঠিক এই সময়ে মায়ার বাবা ফোন তুলে নিয়ে বললেন–হ্যালো, আপনি কোথা থেকে ফোন করছেন?

-পার্ক সার্কাস। খুব অসহায় গলায় বললাম।

বাড়িতে একা আছেন?

–হ্যাঁ।

–কেন, বাড়ির লোকজন কোথায় গেল?

একটু চুপ করে থেকে বললাম–আমি একাই থাকি।

মায়ার বাবা একটু গলা ঝেড়ে বললেন-ও। বয়স কত?

-বেশি নয়। একুশ-বাইশ।

কী করেন।

–একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি।

–ঠিকানাটা বলুন।

 একটু দ্বিধায় পড়ে যাই। নাভাসও লাগছে খুব। এতটা নাটক না করলেও হত। ঠিকানা দিলে ডি এস পি সাহেব হয়তো থানায় ফোন করে দেবেন, পুলিশ খোঁজ নিতে আসবে। কত কী হতে পারে।

ঝুঁকি না নিয়ে বললাম কাকাবাবু, মাপ করবেন। অনেক বিরক্ত করেছি।

উনি বললেন–শুনুন, আমার মনে হচ্ছে আপনি কোনও বিপদে পড়েছেন, কিন্তু বলতে সংকোচ করছেন। আমি অ্যাকটিভ পুলিশের লোক, নিঃসংকোচে বলতে পারেন। আপনার প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করতে পারি।

ওঁর এই সহৃদয়তা আমার ভাল লাগছিল। কিন্তু কী করব, আমার যে পুলিশের কোনও দরকার নেই। এই বৃষ্টিবাদলার রাতে আমি মানুষের জেগে-থাকার শব্দ শুনতে চেয়েছিলাম মাত্র। হয়তো এটা ভীষণ ছেলেমানুষি। এইভাবে ফোন করে লোককে উদ্বিগ্ন ও বিরক্ত করা ঠিক হয়নি। তবু আর তো কোনও উপায় ছিল না।

ভদ্রলোক বারবার হ্যালো হ্যালো করছেন সাড়া না পেয়ে। আমার কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। আস্তে আস্তে বলতে হলনা কাকাবাবু, কোনও বিপদ নয়। কেবল ভয়। এখন ভয়টা কেটে গেছে। তারপর ফোনটা নামিয়ে রাখলাম।

বাকি রাতটা আধো-জাগা আধো-ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে দিতে দিতে বারবার ডি এস পি ভদ্রলোকের সাহায্য করা, প্রোটেক্ট করার কথাটা মনে পড়ছিল। আমাকে কেউ রক্ষা করুক, ত্রাণ করুক এ আমার অসহ্য। আমি কি অসহায়, অবলা?

ঠিক এই কারণেই প্রভাসরঞ্জন বাবুকে আমি পছন্দ করতে পারি না। যেমন অপহদ আমার সুকুমারকে। এমনকী উপরওয়ালার ভূমিকা নেওয়ার একটা অস্পষ্ট চেষ্টা করেছিল বলেই বোধহয় জয়দেবকেও আমি নিতে পারিনি স্বামী হিসেবে। জয়দেবের অবশ্য আরও অনেকগুলো খাঁকতি ছিল।

সকালেও বৃষ্টি ছাড়েনি। এ বৃষ্টিতে ঝি আসবে না জানি। কাজেই সকালে উঠে ঘরদোর সারতে হল নিজেকেই। এক অসম্ভব একটানা প্রবল বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। আমার ফ্ল্যাট থেকে রাস্তার কোনও গাড়িঘোড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে, নীচের হাঁটুজলে কিছু গরিব ঘরের ছেলে চেঁচাদে আর বল খেলছে। কয়েকবার রিকশার ঘণ্টির শব্দ হল। কাদের ঘর থেকে উনুনের ধোঁয়া আসছে ঘরে।

চালে-ডালে খিচুড়ি চাপিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে জানালার ধারে বসি। আকাশের মেঘ পাতলা হয়ে আসছে। বৃষ্টির তেজ এইমাত্র খানিকটা কমে গেল। ধরবে। অফিসে যাওয়াটা কি আজ ঠিক হবে? না গেলেও ভাল লাগে না। একা ঘরে সারাদিন। কী করি?

বেলা নটায় উঠে স্নান সেরে নিলাম। ভেজা চুল আজ আর শুকাবে না। কিন্তু রাতে ঘুম হয়নি, স্নান না করলে সারাদিন ঘুমঘুম ভাব থাকত। কিন্তু মান করেই বুঝলাম, হুট করে ঠাণ্ডা লেগে গেল। গলাটা ভার, চোখে জল আসছে, নাকে সুড়সুড়, তালুটা শুকনো-শুকনো। ছাতা হাতে অফিসে বেরোলাম তবু শেষ পর্যন্ত।

সিঁড়ির নীচেই প্রভাসরঞ্জন দাঁড়িয়ে বাইরের রাস্তার জল দেখছিলেন। আমাকে দেখে হেসে বললেন-যাবেন কী করে? যা জল!

–যেতে হবে যেমন করে হোক।

ট্রামবাসও পাবেন না। দুটো-একটা যা চলছে তাতে অসম্ভব ভিড়। আমি একটু আগে বেরিয়ে দেখে এসেছি।

একটু ইতস্তত করছিলাম। রাস্তায় বেরিয়ে যদি ফিরে আসতে হয় তো যাওয়াও হল না, জল ভেঙে ঠাণ্ডাও লেগে গেল হয়তো।

প্রভাসরঞ্জন বললেন–খুব জরুরি কাজ নাকি?

–জরুরি। একটা ফাইল ক্যাবিনেটের চাবি আমার কাছে রয়ে গেছে।

–রেনি ডে-তে কি আর অফিসের কাজকর্ম হবে?

হবে।

এই বলে রাস্তাঘাট একটু দেখে নিয়ে সত্যিই বেরিয়ে পড়ি। রাস্তায় পা দিতে-না-দিতেই একটা পাতলা মেঘের আস্তরণ কাটিয়ে বোদ দেখা দিল। কী মিষ্টি রোদ! গোড়ালিডুবু জল ভেঙে, শাড়ি সামলে কষ্টে এগোতে থাকি। ঠাণ্ডা জলে পা দিতেই শরীর একটা শীতের কাঁপনি দিচ্ছে। দিক। গোটা দুই ট্যাবলেট খেয়ে নেব। ট্যাবলেট ক্যাপসুলের যুগে অত ভয়ের কিছু নেই।

ভাগ্য ভাল, ডিপোর কাছ বরাবর যেতে-না-যেতেই লেডিজ স্পেশাল পেয়ে পেলাম।

অফিসে এসেই বেয়ারাকে দিয়েই গোটা দশেক ট্যাবলেট আনিয়ে দুটো খেয়ে ফেললাম। তারপর চা। শরীরটা খারাপই লাগছে। সর্দি হবে।

গামবুট আর বর্ষাতিতে সেজে সুকুমার আজ বেশ দেরিতে অফিসে এল। ও আবার ম্যানেজমেন্টকে বড় একটা তোয়াক্কা করে না। অফিসে ঢুকেই ধরাচূড়া ছেড়ে সোজা আমার টেবিলের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে বললদুটো সিনেমার টিকিট আছে। যাবে? ইংরিজি ছবি।

আমি ওর বিশাল স্বাস্থ্যের চেহারাটা দেখলাম খানিক। এর আগে ওর সঙ্গে কয়েকবারই সিনেমায় গেছি। তখন সংকোচ ছিল না। সেদিন আমার ফ্ল্যাটে সেই কাণ্ড ঘটানোর পর থেকে ও আর বড় একটা কাছে ঘেঁষেনি এতদিন। লজ্জায় লজ্জায় দূরে দূরে থাকত। আজ আবার মুখোমুখি হল।

বললাম–আজ শরীর ভাল নেই।

কী হয়েছে?

–সর্দি।

 –ওতে কিছু হবে না। চলো, ঠেসে মাংস খেয়ে নেবে। মাংস খেলে সর্দি জব্দ হয়ে যায়।

হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেললাম–আর সুকুমার জব্দ হবে কীসে?

সুকুমার দু পলক আমাকে দেখে নিয়ে অত্যন্ত নির্লজ গলায় বলল–মাংসে। যদি সেই সঙ্গে হৃদয় পাওয়া যায় তো আরও ভাল।

একবার আক্রান্ত হওয়ার পর আমার সাহস কিছু বেড়েছে। বললাম–এত দাবিদাওয়া কীসের বলো তো! বেশ তো আছি। তুমি তোমার মতো, আমি আমার মতো।

–আমি আমার মতো নেই।

এটা অফিস, এসবকথাও বিপজ্জনক। তাই মুখ নিচু করে বললাম–এসব কথা থাক সুকুমার।

-থাক। তবে এসব কথা আবার উঠবে, মনে রেখো।

আমি ওর দিকে চেয়ে একটু হাসলাম। পুরুষেরা অসম্ভব দখলদার এক জাত।

দুটো সিনেমার লাল টিকিট বের করে সুকুমার আমার সামনেই ছিঁড়ল কুটিকুটি করে। আমার টেবলের উপর ছেঁড়া টিকিটের টুকরো কাগজ জড়ো করে রেখে বলল জানতাম তুমি যেতে চাইবে না। কিন্তু আমারও তো একটা সুযোগ দরকার।

অফিসে আজ কাজকর্মের মন্দা। লোকজন বেশি আসেনি। বেশ বেলা করে দু-চারজন এসেছে বটে, আবু বড় ফাঁকা ঠেকছে অফিস। নিরিবিলিতে বসে কথা বলতে বাধা নেই। সত্যি বলতে কী, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল।

বললাম-সুযোগ মানে কিন্তু দখল করা নয়। আমি কারও সম্পত্তি হতে পারিনি, কোনওদিন পারবও না।

তা হলে আমাকেই তোমার সম্পত্তি করে নাও না। চিরকাল তোমার হুকুমমতো চললেই তো হল।

হাসলাম। ছেলেমানুষ!

বললাম–ওরকম নেতানো নির্জীব পুরুষও মেয়েদের পছন্দ নয়।

তা হলে কী হবে?

কিছু হবে না।

কীসের বাধা অলকা? তোমার স্বামীর কথা ভাবছ?

 মাথা নেড়ে বললামনা। তবে সেটাও ভাবা উচিত। এখনও তার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়নি।

করে নাও।

বড় করে একটা শ্বাস ফেলে বললাম-সে অনেক ঝামেলা, দরকারও দেখি না। কিছুদিন গেলেই সে নিজেই মামলা করবে। আমি কোর্টে যাব না, এক্সপার্টি হয়ে ওকে ডিক্রি করে দেব।

-সেটা অনিশ্চিত ব্যবস্থা অলকা। উনি যদি মামলা না করেন?

বয়ে গেল।

সুকুমার মাথা নেড়ে বলে–তুমি অত আলগা থেকো না। কেন নিজেকে নষ্ট করছ? আমি যে শেষ হয়ে যাচ্ছি।

কী থেকে কী হয়ে গেল মনের মধ্যে।

মেঘভাঙা অপরূপ রোদের ঝরনা য়ে যাচ্ছে চারদিকে। অফিসঘরে গনগন করছে আলোর আভা। দুদিন মনমরা বৃষ্টির পর কী ভাল এই রোদ্র! কাল রাতের সেই একা থাকা ভয়ংকর ছবি মিথ্যে মনে হয়। আবার সেই বাসায় আজকেও আমাকে একা ফিরে যেতে হবে। যদি রাতে বৃষ্টি আসে ফের, রাতে আবার ঘুম ভেঙে ভূতে-পাওয়া মাথা নিয়ে বসে থাকতে হবে।

হ্যাঁ, ঠিক। প্রোটেক্টার না হোক, আমার একজন সঙ্গী চাই। কাউকে না হলে বাঁচব কী করে?

সুকুমার দেখতে বেশ। তা ছাড়া বড় সরল, সোজা ছেলে! কখনও ওকে খারাপ লাগেনি। আজ অপরাহের আলোয় অফিসঘরে বসে মুখোমুখি ওর দিকে চেয়ে হঠাৎ কী হয়ে গেল। ভাবলামকী হবে এত বাছবিচার করে। নিজেকে নিয়ে আর কত বেঁচে থাকা!

বললাম–শোনো সুকুমার, আমি ডিভোর্স চাই।

চাও? ও লাফিয়ে ওঠে। চাই।

আমার স্বামীও চায়। হয়তো ডিভোর্স পেতে কিছু সময় লাগবে।

তারপর কী করবে অলকা?

 তারপর করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে সুকুমার। এক দুরন্ত অধৈর্য অনুভব করে বলি।

–অলকা, যদি আমরা এক্ষুনি বিয়ে করি, তা হলে?

আমি ক্ষণকাল চুপ করে থাকি। বুকের মধ্যে নানা ভয়, দ্বিধা, সংস্কার ছায়া ফেলে যায়।

তারপর বলিকয়েকটা দিন সময় দাও।

–দিলাম। কতদিন বলো তো

–দেখি।

একরকম কথা দেওয়াই হয়ে গেল সুকুমারকে! একটু হয়তো কিন্তু রইল, দ্বিধা রইল, তবু ওটুকু কিছু নয়। সেসব দ্বিধা, ভয় ভেঙে সুকুমার ঠিক সাঁতরে আসবে কাছে।

রাতটা মাসির বাড়িতে গিয়ে কাটালাম। জ্বর এল রাতে। তিনটে দিন বাড়ির বার হওয়া গেল না। অল্প জ্বরেই কত যে ভুল বকলাম ঘোরের মধ্যে!

চারদিনের দিন ফের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। মাসি আজকাল আর আটকে রাখে না, যেতে চাইলে এককথায় ছেড়ে দেয়। ঢিসে বলগা মেয়েকে সকলেরই ভয়।

দোতলার ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা জানালা হাট করে খুলে বন্ধ বাতাস তাড়াই। ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করি। রবিবার। তাড়া নেই।

চায়ের জল চাপিয়ে এলোচুলের জট ছাড়াতে একটু ব্যালকনিতে দাঁড়াই।

 কলিং বেল বাজল। এ সময়ে কেউ আসেনা। একমাত্র সুকুমার আসতে পারে। তার তর সইছে না।

 কাঁপা বুক নিয়ে গিয়ে দরজা খুলেও সাপ দেখে পিছিয়ে আসার অবস্থা। চৌকাঠের ওপারে জয়দেব দাঁড়িয়ে।

কিক্ষণ কথা ফোটে না কারও মুখে। জয়দেবের চেহারা রোদে পোড়া, তামাটে, কিছু রোগা হয়েছে। মাথার চুল এত হোট যেন মনে হয় কদিন আগে ন্যাড়া হয়েছে। পরনে ধুতি আর ক্রিমরঙা সুতির শার্ট। কিন্তু ধুতিটা এমনভাবে পরেছে যে মনে হয় পাশের ফ্ল্যাট থেকে এল। বাইরে বেরোবার পোশাক নয়।

চৌকাঠের বাইরে থেকে জয়দেব এক পাও ভিতরে আসার চেষ্টা করল না। দাঁড়িয়ে থেকে বলল তুমি এখানে থাকো সে খবর সদ্য পেয়েছি।

কী চাও?

খুব সাধারণ আলাপচারির গলায় জয়দেব বলল কিছু চাই না অলকা। তোমার কাছে ডিভোর্সে মত দিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলাম, তার কোনও উত্তর দাওনি। তোমার কি মত আছে?

একটু গম্ভীর হয়ে বলি-দরজার বাইরে থেকে অত জোরে ওসব কথা বলছ কেন? ভিতরে এসো।

জয়দেব এল। কোনওদিকে তাকাল না, ঘরের আসবাবপত্র লক্ষ করল না। খুবই কুণ্ঠিত পায়ে এসে একটা চেয়ারে বসে বলল–আমি নীচের তলায় প্রভাসবাবুর বাসায় উঠেছি কাল এসো।

প্রভাসের সঙ্গে জয়দেবের চেনা আছে জানতাম। তাই চমকালাম না। দরজা বন্ধ করে এসে জয়দেবের মুখোমুখি বসে বললাম–আমি খুব তাড়াতাড়ি ডির্ভোস চাই।

জয়দেব মুখখানা করুণ করে বলল–তাড়াতাড়ি চাইলেই তো হয় না। কোর্ট থেকে এ সব কেসে বড় দেরি করে। তাড়াতাড়ি চাইলে আরও আগে জানালে না কেন? কবে কেস ফাইল করা যেত!

আমি মাথা নিচু করে বলি-শোনো, ডিভোর্স পেতে দেরি হোক বা না হোক, আমরা তো একটা এগ্রিমেন্টে আসতে পারি।

কী এগ্রিমেন্ট?

বো, আমরা কাউকে কোনও অবস্থাতেই দাবি করব না। পরস্পরের কোনও ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাব না।

–তার জন্য এগ্রিমেন্ট লাগে না অলকা। জয়দেব বলল–আমরা সেই রকমই আছি। কথার স্বর শুনেই বোঝা যায়, জয়দেবের মন এখন অনেক গম্ভীর হয়েছে। জীবনে কোনও একটা সত্য বস্তুর সন্ধান

পেলে মানুষ এত গভীর থেকে কথা বলতে পারে না। তাই আমি ওর মুখের দিকে কয়েকবার তাকালাম। ও আমাকে দেখছিল না। চোখ তুলে দেওয়ালের মাঝারি উচ্চতায় চেয়েছিল। সেই অবস্থায় চেয়ে থেকেই বলল–তুমি একটি ছেলেকে পছন্দ করো শুনেছি। তাকে বিয়ে করার জন্যই কি এত তাড়া?

সত্যিকারের অবাক হয়ে বলি না তো। আমি কাউকেই পছন্দ করি না।

-সুকুমার না কী যেন নাম, শুনছিলাম। তোমার অফিসের।

-ওঃ। বাস্তবিক আমার সুকুমারের মুখটা এখন মনে পড়ল। বললাম–পছন্দ নয়। তবে ওই একরকম।

–ভাল।

–তুমি ডিভোর্স চাইছ কেন? বিয়ে করবে? বললাম।

 ও অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল–বিয়ে আর না। মুক্তি চাইছি, নইলে বড় কষ্ট হয়।

কষ্ট কীসের?

-ওই একটা অধিকারবোধ থাকে তো পুরুষের। সেইটে মাঝে মাঝে চাড়া দেয়। ডিভোর্স হয়ে গেলে একরকম শান্তি।

ও।

-আচ্ছা–বলে জয়দেব কুণ্ঠিত পায়ে উঠল। উকিলের চিঠি দেব। তুমি কি অ্যালিম চাও?

–সেটা কী?

খোরপোষ।

 না, না। চমকে উঠে বলি।

আচ্ছা তা হলে

–আচ্ছা। বললাম।

 দরজা খুলে জয়দেব চলে গেল।

সিঁড়ি বেয়ে ওর পায়ের শব্দ যখন নামছে তখন আমি ঘরের মধ্যে চুলের জটে আঙুল ডুবিয়ে বসে আছি। কত ভাবনা! সে যেন এক আলো-আঁধারের মধ্যে ডুবে বসে থাকা। উঠলাম না, রাঁধলাম না, খেলাম না। শুধু বসে রইলাম।

হঠাৎ এক ভয়ের আঙুল হৃৎপিণ্ডে টোকা মারল। নড়ে উঠল বুকের বাতাস। সচেতন ভীতগ্রস্ততায় টের পাই–আমি কাউকেই ভালবাসি না। কাউকে নয়। কেবলমাত্র নিজেকে। আমি কোনওদিন কাউকে ভালবাসতে পারব না।

কী করে বেঁচে থাকব আমি?

পৃথিবীতে কত দুর্যোগের বর্ষা নামবে কতবার! কত একা কাটবে দিন! কাউকে ভাল না বেসে আমি থাকব কী করে?

বিকেল কাটল। নীচের তলা থেকে অহঙ্কারী জয়দেব একবারও এল না খোঁজ করতে। সুকুমার টেলিফোনও করল না। বড় অভিমানে ভরে গেল বুক। সারাদিন খাইনি, স্নান করিনি, কে তার খোঁজ রাখে!

সন্ধে হল, রাত গড়িয়ে গেল গভীরের দিকে।

শরীর দুর্বল। মাথা ফাঁকা। মনটায় তদগত একটা আচ্ছন্নতা। ভূতে পেয়েছে আমাকে। উঠে গিয়ে ছারপোকা মারবার অমোঘ ওষুধের শিশিটা হাতে নিয়ে টেবিলে বসলাম। চিরকুটে লিখে রাখলাম আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।

লিখে বিছানায় শুয়ে আস্তে শিশির মুখ খুলে ঠোঁটের কাছে এনে পৃথিবীকে বললাম–ভালবাসা ছাড়া কী করে বাঁচি বলো! বাঁচা যায়? ক্ষমা করো।

ঠিক এ সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল মৃদু সেতারের মতো। উঠলাম না। শিশিটা উপুড় করে দিলাম গলার মধে।

হায়! ফাঁকা শিশি প্রেমহীন হৃদয়ের মতো চেয়ে রইল আমার শূন্য হৃদয়ের দিকে। এক ফোঁটা বিষও ঢালতে পারল না সে। অমৃতও না। উঠে টেলিফোনটা যখন ধরছি তখন কেন যেন খুব ইচ্ছে করছিল, টেলিফোনে যেন জয়দেবের গলার স্বর শুনতে পাই।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়