পাগলা দাশু

দুনিয়ার কোনও কাজই বড় সহজ নয়। গান শেখা, সাইকেলে চড়া বা পাহাড়ে ওঠা। সহজ সুরের রামপ্রসাদী আমায় দাও মা তবিলদারি গানটা কতবার গলায় খেলানোর চেষ্টা করলাম। কিছুতেই হল না। অথচ সুরটা কানে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। সহজ, অতি সহজ গান। কিন্তু আমার কান শুনলেও গলা সেই সুর মোটেই শুনতে পাচ্ছে না। যে সুরটা কানে বাজছে কিন্তু গলায় আসছে না তাকে গলায় আনতে গেলে কী করা দরকার তা জানবার জন্য আমি সিভিল হাসপাতালের ই এন টি স্পেশালিস্টের কাছে একদিন হানা দিলাম।

খুবই ভিড় ছিল আউটডোরে। ঘণ্টা দেড়েকের চেষ্টায় অবশেষে তার চেম্বারে ঢুকতে পেরেছি। নমস্কার ডাক্তারবাবু।

নমস্কার। বলুন তো কী হয়েছে?

 আমার কানের সঙ্গে গলার কোনও সমঝোতা হচ্ছে না।

তার মানে কী?

 অর্থাৎ কানে যে গানটা শুনতে পাচ্ছি, কিছুতেই সেটা গলায় তুলতে পারছি না।

আপনি কি গায়ক?

না, তবে চেষ্টা করছি।

হাঁ করুন।

করলাম হাঁ। মস্ত হাঁ। ডাক্তার গলা দেখলেন, কপালে আটা গোল একটা আয়না থেকে আলো ফেলে নাক এবং কানও তদন্ত করলেন। তারপর মস্ত একটা খাস ছেড়ে বললেন, হুঁ।

ডিফেক্টটা ধরতে পারলেন?

ডান কানে একটা তেকোনা হাড় উঁচু হয়ে আছে। নাকের চ্যানেলে ভাঙা হাড় আর পলিপাস। গলায় ফ্যারিনজাইটিস। সব ক’টারই ট্রিটমেন্ট দরকার। নাক আর কান দুটোই অপারেশন করালে ভাল হয়।

আমি অবাক হয়ে বললাম, এত কিছুর পর গান গলায় আসবে?

আশা তো করি। বলে ডাক্তার মৃদু হাসলেন। চাপা স্বরে বললেন, এ সব কি হাসপাতালে হয়? বিকেলের দিকে আমার হাকিমপাড়ার বাসায় যে চেম্বার আছে সেখানে চলে আসবেন।

আমি চলে আসি।

.

আমার গলায় যে সুর খেলছে না সেটা আমাকে প্রথম ধরে দেয় পশুপতি। লিচুর মা কিন্তু রোজই ভরসা দিচ্ছেন যে, একটু-একটু করে আমার হচ্ছে। একদিন মা লাগাতে পারছি অন্যদিন রে-ও লাগছে।

পশুপতি আমার ওপর খুবই রেগে ছিল। হারমোনিয়াম কেনার পর দু দিন আমার সঙ্গে দেখা করেনি। তিন দিনের দিন এসে ফালতু কথা ছেড়ে সহজ ভাষায় বলল, আপনার মতো আহাম্মক দেখিনি। ওই গদা মালের জন্য কেউ দুশো টাকা দেয়? টাকা কি ফ্যালনা নাকি?

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, পশুপতি, কোন জিনিসের আসলে কী দাম তা তুমিও জানোনা আমিও জানি না। ঠকেছি না জিতেছি সে বিচারও বড় সহজ নয়।

আর আমি যে একশো টাকার খদ্দের ঠিক করে রেখেছি তার কী হবে? সে রোজ তাগাদা দিচ্ছে। আমি তো আপনাকে পইপই করে বলে রেখেছিলাম পঁচাত্তর টাকার ওপরে উঠবেন না। আপনি মাল না চিনলেও আমি তো চিনি।

এ কথার কোনও জবাব হয় না। পশুপতিকে কী করে বোঝানো যাবে যে, লিচুদের বাড়িতে সেদিন এক মোহময় বিকেল এসেছিল। ছিল কনে দেখা আলো, ফুলের গন্ধ, হারমোনিয়ামের একাকিত্ব। মন বলছিল, কনে কই? কনে কই? সেই সময়ে কেউ টাকার কথা বলতে পারে? আমি তবু দুশো টাকা বলেছিলাম। এবং বলেই মনে হয়েছিল খুব কম বলা হয়ে গেল। লিচু, লিচুর মা বাবা বোন অবশ্য খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল। হতভম্ব হয়ে গেল পশুপতিও। কিন্তু ওই দামের নীচে সেদিন যে হারমোনিয়ামটা কেনা ঠিক হত না তা কেউ বুঝবে না।

পশুপতি হঠাৎ খুব গরম হয়ে বলল, ওটা তো আপনার কোনও কাজেই আসত না। আমাকে একশো টাকায় দিয়ে দিন।

আমি বললাম, আমি একটু-আধটু গানের চর্চা করছি পশুপতি। এটা দেওয়া যাবে না।

পশুপতি ধৈর্য হারাল না। সে দিন চলে গেল বটে কিন্তু ফের একদিন এল। আমার গলা সাধা শুনল। বলল, এ জন্মে আপনার গান হবে না কানুবাবু। আপনার গলায় সুরের স-ও নেই।

অথচ সপ্তাহে দু দিন সন্ধেবেলা আমি রিকশায় হারমোনিয়াম চাপিয়ে লিচুদের বাড়ি গিয়ে হাজির হই। লিচুর মা শত কাজ থাকলেও সব ফেলে রেখে আমাকে গান শেখাতে বসেন, কাছে লিচুও বসে থাকে। আমার সা রে গা মা শুনে কেউ হাসে না, এবং উৎসাহ দেয়। গান শিখবার জন্য আমি লিচুর মাকে মাসে-মাসে পঁচিশ টাকা করে দেব বলেছি।

সকালের দিকে বাঘাযতীন পার্কে আমি সাইকেলে চড়া প্র্যাকটিস করি। দুটো সরু চাকার ওপর সাইকেলে কী ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং কী ভাবেই বা চলে তা নিয়ে আমার মনে বহুকাল ধরে প্রশ্ন রয়ে গেছে। আমি আগাগোড়া মধ্য কলকাতায় মানুষ। সেখানে সাইকেল আরোহীর সংখ্যা বেশি নয়, তা ছাড়া অঢেল ট্রাম বাস থাকায় সাইকেল চড়ারও দরকার পড়েনি। এই উত্তরবাংলার শহরে এসে দেখি, প্রচুর সাইকেলবাজ লোক চারদিকে। কাকার বাড়িতে তিন-তিনটে সাইকেল। একটা কাকা চালান, আর দুটো সাইকেল পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। কাকা বললেন, আমোক রোজ অফিস যেতে আসতে রিকশা-ভাড়া দিস কেন? সাইকেলে যাবি আসবি। দুটো পয়সা বাঁচাতে পারলে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।

সেই থেকে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি কিন্তু সাইকেল কিছুতেই আমাকে সমেত খাড়া থাকতে চায় না। আসলে সাইকেলটা পড়ে যাবে আশংকা করে আমি নিজেও ডান বা বাঁদিকে একটু কেতরে থাকি। ফলে সাইকেল আরও তাড়াতাড়ি পড়ে যায়।

পশুপতি এই সব লক্ষ করে একদিন বলল, সাইকেল হল গরিবদের গাড়ি। আসল বাবুরা চলাফেরা করে রিকশা বা মোটরে। বীরেনবাবুকে কত বার বলেছি, আপনাদের তিন-তিনটে সাইকেল তার গোটা দুই আমাকে বেচে দিন। কিছুতেই রাজি হয় না। একবার বলে দেখবেন নাকি আপনার কাকাকে? ভাল দর দেব।

পশুপতি এ সব কথা ছাড়া দ্বিতীয় কথা জানে না। হয় কেনার কথা বলে, নয়তো বেচার কথা। হারমোনিয়ামটার আশা সে এখনও ছাড়েনি। আমি গানের আশা ছাড়লেই সে হারমোনিয়ামটা অর্ধেক দরে কিনতে পারবে বলে আশা করে আছে। সাইকেলের আশাও তার আছে।

কিন্তু আমি সাইকেল বা গান কোনওটার আশাই ছাড়িনি, আমার জীবনের মূলমন্ত্রই হল, চেষ্টা।

একদিন বিকেলে হঠাৎ লিচু এল।

 তার চেহারাটা বেশ লাবণ্যে ভরা। একটু চাপা রং, চোখ দুটো বড় বড়, মুখখানা একটু লম্বাটে, থুতনির খাজটি বেশ গভীর। খুব লম্বা নয় লিচু, তবে হালকা গড়ন বলে বেঁটেও মনে হয় না। বেশ একটা ছায়া-ছায়া ভাব আছে শরীরে।

বলল, আপনি কি সত্যিই গান শিখবেন? নাকি ইয়ার্কি করছেন?

আমি অবাক হয়ে বলি, তার মানে?

 লিচু আমার নির্জন ঘরে বেশ সপ্রতিভ ভাবেই চৌকির বিছানায় বসে বলল, আমরা খুব লজ্জায় পড়ে গেছি।

কেন, কী হয়েছে?

শুনছি, আমরা নাকি আপনাকে বোকা পেয়ে ঠকিয়ে হারমোনিয়ামটা বেশি দামে বেচেছি।

আমি মাথা নেড়ে বলি, তা কেন? দাম তো তোমরা বলোনি। আমি বলেছি।

সে কথা লোকে বিশ্বাস করলে তো? আপনি হারমোনিয়ামটা আমাদের ফেরত দিন, আপনার টাকা আমরা দিয়ে দেব।

কথাগুলো আমার একদম ভাল লাগছিল না। কলকাতায় হলে কে কার হারমোনিয়াম কত টাকায় কিনল এ নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা থাকত না। কিন্তু মফসসল শহরগুলোয় ব্যক্তিস্বাধীনতা খুবই কম।

আমি লিচুকে বললাম, ফেরত দেওয়ার জন্য তো কিনিনি। আমি সিরিয়াসলি গান শেখার চেষ্টা করছি।

গান আপনার হবে না।

কে বলল?

আমি গলা চিনি, তা ছাড়া গান শেখার আগ্রহ আপনার নেই।

কে বলল?

আমিই বলছি। আমার মনে হয় আপনি ইচ্ছে করেই হারমোনিয়ামটা বেশি দামে কিনেছেন।

 লোকে কি ইচ্ছে করে ঠকতে চায়?

আপনি হয়তো আমাদের গরিব দেখে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। কথাটা কেউ বুঝবে না, কেন আমি হারমোনিয়ামটার দুশো টাকা দাম বলেছিলাম। আমার তো মনে হয়, দুশো টাকাও বেশ কমই বলা হয়েছিল। কোন জিনিসের কত দাম তা আজও ঠিক-ঠিক কেউ বলতে পারে না।

আমি মৃদুস্বরে বললাম, তা নয়। তোমরা তো তত গরিব নও।

আমরা খুবই গরিব। উদাস স্বরে লিচু বলে, এতটাই গরিব যে, আমাদের কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।

আমি যদি সকলের কাছে স্বীকার করি যে হারমোনিয়ামটার দর আমিই দিয়েছিলাম।

তাতেও লাভ নেই এখন। লোকে অন্যরকম সন্দেহ করবে। ভাববে, পুরনো জিনিস বেশি দামে কেনার পিছনে আপনার অন্য মতলব আছে।

কথাটা মিথ্যে নয়। আমার অন্য কোনও মতলবই হয়তো ছিল। কিন্তু সেটা খারাপ কিছু নয়।

লিচু অবাক হয়ে বলে, কী মতলব?

আমি মৃদু হেসে বললাম, সেদিন আমার মনে হয়েছিল, এই হারমোনিয়ামটা হাতছাড়া করতে তোমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমার বোন কাঁদছিল, তুমিও বাড়ি থেকে বোধ হয় রাগ করেই চলে গিয়ে অন্য বাড়িতে বসে ছিলে। এই হারমোনিয়ামটার ওপর তোমাদের মায়া মমতা দেখে আমার মনে হল, শুধু জিনিসটার দাম যাই হোক, এটার ওপর তোমাদের টান ভালবাসারও তো একটা আলাদা দাম আছে। শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পটার কথা ভেবে দ্যাখো। যে কসাইটা মহেশকে কিনতে এসেছিল তার কাছে শুধু চামড়াটুকুর যা দাম, কিন্তু গফুরের কাছে তো তা নয়। শোনো লিচু, আমি কসাই নই। আমি ভালবাসার দাম বুঝি।

শুনে লিচু কেমন কেঁপে উঠল একটু। চোখে জল ভরে এল বুঝি। মাথা নিচু করে রইল খানিকক্ষণ। তারপর মুখ তুলে ধরা গলায় বলল, আমাদের বাড়িতে তেমন কোনও আনন্দের ব্যাপার হয় না, জানেন। বাবার একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকান আছে, তেমন চলে না। অভাবের সংসারে সুখ আর কী বলুন। তবু ওই হারমোনিয়ামটা ছিল, আমরা ওটাকে আঁকড়ে ধরেই বড় হয়েছি। যখন মন খারাপ হত, খিদে পেত কি রাগ হত তখন হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে গান গাইতে বসে যেতাম। আমাদের কাছে ওটা যে কতখানি ছিল কেউ বুঝবে না।

তা হলে বিক্রি করলে কেন?

কী করব? বাবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় আমাদের অনেক ধার হয়ে গিয়েছিল। মা আমাদের অনেক বুঝিয়েছিল, হারমোনিয়ামটা বিক্রি করে এখন ধার কিছু শোধ করা হবে, পরে অবস্থা ফিরলে আমরা একটা স্কেল চেঞ্জার কিনবই। তখনই আমরা দুই বোন বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের একমাত্র আনন্দের জিনিসটাও আর থাকছে না। বাড়িটা একদম ভূতের বাড়ি হয়ে যাবে এরপর।

তোমরা কত দাম আশা করেছিলে?

একশো টাকার বেশি কিছুতেই নয়। পশুপতিবাবুকে তো আমরা চিনি। উনিই আমাদের বাড়ির বাসন কোসন, গয়না, পুরনো আসবাবপত্র সবই কিনেছেন বা বন্ধক রেখেছেন, এমনকী বাবার সাইকেলের দোকানটা পর্যন্ত ওঁর কাছে বাঁধা আছে। উনি কখনও বেশি দাম দেন না। তবে অভাব অনটন বা দরকারের সময় উনিই যে-কোনও জিনিস বাঁধা রেখে টাকা দেন বা পুরনো জিনিস কিনে নেন। আপনি দুশো টাকা দাম বলায় আমরা সবাই ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। পশুপতিবাবু অত বেশি দাম হাঁকার লোক নন।

আমাকে বোকা ভেবেছিলে বোধ হয়?

 লিচু মাথা নেড়ে বলল, অনেকটা তাই। তবে আমার মনে হয়েছিল আপনি একটু পাগলাটে, ভাল মানুষ আর টাকাওয়ালা লোক।

আমি গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলি, কথাটা ঠিক নয় লিচু। আমার কখনও মনে হয়নি যে, হারমোনিয়ামটা কিনে আমি ঠকে গেছি।

লিচু খুব অদ্ভুত অবাক-চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আপনি সত্যিই ঠকেছেন। খুব ঠকেছেন। আমাদের খুব নিন্দে হচ্ছে। আপনার পায়ে পড়ি, হারমোনিয়ামটা আমাদের ফিরিয়ে দিন। বাবা আপনার টাকা শোধ করে দেবে।

আমি তা জানি লিচু। তবু আমাকে কয়েকদিন ভেবে দেখতে দাও।

লিচু যখন চলে যাওয়ার জন্য উঠল তখন জানালা দিয়ে কিছু রোদ ওর মুখে এসে পড়েছিল কি না ঠিক বলতে পারছি না, তবে মুখখানায় হঠাৎ এক ঝলক আলো দেখা গিয়েছিল।

রাত হলে রোজই আমি খাওয়ার আগে একটু সামনের বাগানে বেড়াই। আজ পূর্ণিমার ভর ভরন্ত চাঁদ যেন উদ্বৃত্ত জ্যোৎস্নায় ফেটে পড়েছে। গবগ করে নেমে আসছে জ্যোৎস্না। মাঠ ঘাট রাস্তা ভাসিয়ে ড্রেন বেয়ে যাচ্ছে। ছাদ থেকে রেনপাইপ বেয়ে নেমে আসছে। তেমন গরম নেই। বেলফুল ফুটেছে, তার মাতাল গন্ধে বাতাস মন্থর এবং ভারী। এত গন্ধে মাথা ধরে যায়। শ্বাসকষ্ট হয়। বুক কেমন করে। কলকাতায় আমি কখনও এতটা জায়গা পাইনি। এমন বিনা পয়সায় ফুলের গন্ধের হরির লুট ঘটে না সেখানে। চাঁদের আলো যে এত তীব্র হতে পারে তাও কলকাতায় কখনও খেয়াল করিনি। এ সবই আমার কাছে ভয়ংকর বাড়াবাড়ি। এত বেশি আমার পছন্দ নয়। কিছুই।

খোলা রাস্তায় জ্যোৎস্নায় তাড়া খেয়ে একজন মানুষ মাথা বাঁচাতে দ্রুতপায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে কোলকুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কে ও? কর্ণবাবু নাকি?

জগদীশ মাস্টারমশাইকে এই জ্যোৎস্নায় একদম অন্যরকম লাগে। মুখের বুড়োটে খাজগুলোয় চোখের ঘোলাটে মণিতে কাঁচাপাকা দাড়িতে জ্যোৎস্নার ফোঁটা পড়েছে। নবীন যুবকের মতো তাজা কবি হয়ে গেছে মুখখানা। পরনে ধুতি, গায়ে হাফ হাতা শার্ট, হাতে ছাতা।

বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, কোথায় যাচ্ছেন?

এই পথেই রোজ টিউশানি সেরে ফিরি। যাতায়াতের সময় রোজই শুনতে পাই আপনি গান করছেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে। বেশ লাগে। দাঁড়িয়ে দু’দণ্ড গান শুনতেও ইচ্ছে করে। তবে সময় হয় না। রোজই ভাবি একদিন সামনে বসে শুনে যাব।

লজ্জা পেয়ে বলি, গান করছি বললে ভুল হবে। শিখছি।

ভেরি গুড, শেখা জিনিসটা আমার খুব ভাল লাগে। কোয়ালিফিকেশন যত বাড়ানো যায় ততই ভাল। দুনিয়ায় কোয়ালিফিকেশনের মতো জিনিস হয় না। যত কোয়ালিফিকেশন তত অপরচুনিটি, যত অপরচুনিটি তত ফ্রিডম, যত ফ্রিডম তত মর্যাল কারেজ। কোয়ালিফিকেশন আরও বাড়াতে থাকুন। ছবি আঁকুন আর্টিকেল লিখুন, ল পড়ুন। কোয়ালিফিকেশনের অভাবেই দেখুন না, মোটে পাঁচটা টিউশানি করছি মেরে কেটে। সায়েন্স জানলে ডজনখানেক করতাম।

তা ঠিক। আমি বলি।

জগদীশ মাস্টারমশাই এই জ্যোৎস্নায় কিছু মাতাল হয়েছেন। কোনওদিন এত কথা বলেন না। আজ ফটকের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, অবশ্য এখানে এই এঁদো। জায়গায় কোয়ালিফিকেশন বাড়ানো খুবই কঠিন। আমার এক ছাত্রী শান্তিনিকেতনে নাচ শিখত। এখন তার খুব নামডাক।

জগদীশ মাস্টারমশাই কখনও ছাত্রীকে মাত্রা ছাড়া বললেন না। ছাত্রী শব্দটা নাকি ব্যাকরণ মতে শুদ্ধ নয়। আমি বললাম, তাই নাকি? খুব ভাল।

তার ওপর এম এ পাশ, গান জানে, ইংরিজিতে কথা বলতে পারে। রং কালো হলে কী হয়, শুনছি খুব বড় ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে তার বিয়ে। স্রেফ কোয়ালিফিকেশনের জোরে। এই জোরটা যে কত বড় তা অনেকেই বুঝতে চায় না। বললে ভাবে জগদীশ মাস্টার মাথা পাগলা লোক, আগড়ম বাগড়ম বকে।

বলতে কী জগদীশ মাস্টারমশাইয়ের কথাকে আমি মোটেই আগডুম বাগড়ম মনে করছিলাম না, আমার মনে হচ্ছিল, কথাগুলো বেশ ভেবে দেখার মতো।

আমি ছাত্রদের নিচু ক্লাসেই শিখিয়ে দিই, কখনও কাম হিয়ার বলবে না, কাম একটা চলিষ্ণু শব্দ, হিয়ার একটা স্থান শব্দ। এই দুইয়ে মিল খায় না। তাই কাম হিয়ার বলতে নেই, বলতে হয় কাম হিদার। আমার এক ছাত্র নাইনটিন ফিফটিতে এক সাহেব কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিল কাম হিদার কথাটা বলে।

আমি বেশ মন দিয়ে শুনি এবং অকৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গে বলি, তাই নাকি? দুঃখের সঙ্গে জগদীশবাবু বলেন, দিনকাল আর আগের মতো নেই। ছেলেমেয়েরা আজকাল মাস্টারমশাইয়ের কথা গ্রাহ্য করে কই? এখানকার ফার্স্ট বয়ের খাতাতেও দেখবেন নিখুঁত বাঁধা উত্তর। উদ্ভাবনা নেই, মাথা খাটানো নেই, চিন্তাশীলতা নেই, নাইনটিন ফটিনাইনে কিংবা কাছাকাছি কোনও বছরে ম্যাট্রিক রচনা এসেছিল–কোনও এক মহাপুরুষের জীবনী, মেদিনীপুরের এক ছাত্র সেই রচনায় নিজের বাবার কথা লিখেছিল। লিখেছিল-দীনদরিদ্র পাঠশালার অল্প বেতনের পণ্ডিত আমার বাবা। কোন ভোর থাকতে উঠে উনি পুজোপাঠ সেরে বাড়ির সামনে তেঁতুলের ছায়ায় শতরঞ্চি পেতে বসেন। তার ছাত্ররা আসে, পুত্রবৎ স্নেহের সঙ্গে তাদের বিবিধ বিদ্যা শেখান তিনি। বিদ্যা বিক্রয় পাপ বলে কারও কাছ থেকে কোনও টাকা নেন না। ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে পরেন, কিন্তু আমাদের সর্বদাই তিনি চরিত্রবান হতে বলেন। বড়ই অভাবের সংসার আমাদের, তবু আমার বাবাকে আমি কখনও উদ্বিগ্ন হতে দেখি না। তিনি শান্ত, নিরুদ্বেগ আত্মবিশ্বাসী। ক্লাসে যেতে কখনও এক মিনিটও দেরি হয় না তার। আমাদের বাড়িতে কোনও ঘড়ি নেই, তবু বাবাকে দেখি সর্বদাই সময়নিষ্ঠ। সাহায্যের জন্য কেউ এসে দাঁড়ালে কখনও তাকে বিমুখ করেন না। কোথায় কোন মানুষের কী বিপদ ঘটল তাই খুঁজে খুঁজে বেড়ান। পরোপকার কথাটা তার পছন্দ নয়। তিনি বলেন, পৃথিবীতে পর বলে কেউ নেই। এইরকমভাবে নিজের বাবার কথা লিখে গেছে আগাগোড়া। শেষ করে বলেছে, আমার জীবনে দেখা এত বড় মহাপুরুষ আর নেই। রচনাটা পড়তে পড়তে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ির লোক আর পাড়াপড়শিকে ডেকে ডেকে পড়িয়েছি, চেঁচিয়ে বলেছি, আমার সোনার ছেলে রে। আমার গোপাল রে। পঁচিশের মধ্যে তাকে চব্বিশ দিয়েছিলাম, মনে আছে। সেই সব ছেলেরা কোথায় গেল বলুন তো!

বলে জগদীশ মাস্টারমশাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তার দেখাদেখি আমিও। জগদীশবাবুর দুঃখ হতেই পারে। কারণ তার একমাত্র সন্তান পশুপতি তাকে দ্যাখে না। একই বাড়িতে ছেলে আর ছেলের বউয়ের আলাদা সংসার, ভিন্ন হাঁড়ি। ছেলের প্রসঙ্গ উঠলে জগদীশবাবু শ্বাস ছেড়ে শুধু বলেন, কুপুত্র। কুপুত্র। যতদূর মনে হয়, পশুপতিকে কোনও মহাপুরুষের জীবনী লিখতে দিলে সে কোনওকালেই জগদীশবাবুর কথা লিখবে না।

হঠাৎ জগদীশবাবু গলার স্বরটা নিচু করে বললেন, দামড়াটা আপনার কাছে খুব আনাগোনা করে বলে শুনেছি।

আমি ভাল মানুষের মতো মুখ করে বলি, আসেন টাসেন, মাঝে মাঝে।

জগদীশবাবু ষড়যন্ত্রকারীর মতো ফিসফিসিয়ে বলেন, খুব সাবধান। একদম বিশ্বাস করবেন না। নিজের ছেলে, তাও বলছি।

আমি পশুপতির হয়ে একটু ওকালতি করে বলি, কেন? এমনিতে লোক তো খারাপ নন।

জগদীশবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, লোক খারাপ নয়! বলেন কী? কত লোকের যে সর্বনাশ করেছে। দামড়াটার জন্য সমাজে আমার মুখ দেখানোর উপায় নেই, সর্বদা তাই সঙ্গে ছাতা রাখি।

আমি আনমনে বললাম, ছাতা অনেক কাজে লাগে।

যথার্থই বলেছেন। ছাতার কাজ হয়, লাঠির কাজ হয়, আমি অনেক সময় বাজারের থলি না থাকলে ছাতায় ভরে আনাজপাতিও আনি, কিন্তু মুখ লুকোবার জন্য যে জগদীশমাস্টারকে একদিন ছাতার আশ্রয় নিতে হবে তা কখনও কল্পনা করিনি। কুপুত্র! কুপুত্র! ওর সংস্পর্শে আমার পর্যন্ত মর্যালিটি নষ্ট হয়ে গেছে, তা জানেন? ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় আমিই তো ওর হলে গার্ড ছিলাম। আমার চোখের সামনে দামড়াটা বই খুলে টুকছিল। দেখেও দেখলাম না। ধরলে আর-এ হয়ে যাবে। নিজের বিদ্যের জোরে পাশ করার মুরোদ নেই। শত হলেও নিজের ছেলে তো! দুর্বল হয়ে পড়লাম। এমনকী বাংলা পরীক্ষার দিন ব্যাকরণে মধ্যপদলোপীকে মধ্যপদলোভী লিখেছিল বলে সেটা পর্যন্ত কারেক্ট করে দিয়েছিলাম মনে আছে। তারপর থেকে আমি চাকরিতে মাস্টার হলেও জাতে আর মাস্টার নেই।

আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ছেলেপুলের জন্য বাপ-মায়েদের অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয় বলে শুনেছি।

হ্যাঁ, চরিত্র পর্যন্ত। জগদীশবাবু বিষাক্ত গলায় বললেন, তবু কি হারামজাদার মন পেয়েছি নাকি? পাঁচটা পয়সা পর্যন্ত হাতে ধরে দেয় না কখনও। নাকের ডগায় বসে রোজ মাছ মাংস আর ভাল ভাল সব পদ বউ ছেলেপুলে নিয়ে খায়, কোনওদিন বাবা-মাকে একটু দিয়ে পর্যন্ত খায় না। সারাটা জীবন মাস্টারির আয়ে সংসার চালিয়েছি, ভালমন্দ তো বড় একটা জোটেনি। এই বয়সে একটু খেতে-টেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু খাব তার জো কী? গতকাল ডালনা খাব বলে এক জোড়া হাঁসের ডিম এনেছিলাম। আমার গিন্নি সে-দুটো সেদ্ধ করে খোলা ছাড়িয়ে রেখেছেন ডালনা রাঁধবেন। এমন সময় বউমা বোধ হয় আবডালে থেকে ছোট নাতনিটাকে লেলিয়ে দিল। সে হটি হটি পায়ে এসে ঠাকুমার সামনেই থাবিয়ে ডিমদুটো খেয়ে চলে গেল। কিছু বলার নেই। নাতনি খেয়েছে। বুড়োবুড়ি রাতে ডাল আর ডাটা চচ্চড়ি দিয়ে ভাত গিলোম শুকনো মুখে। বড় ছেলে তাকিয়ে সবই দেখল, তবু একটা আহা উঁহু পর্যন্ত করল না। রোজই এমন হয়। ভালমন্দ বেঁধে খেতেই পারি না। নাতি নাতনিদের লেলিয়ে দেয়।

জগদীশবাবু খুব সন্তর্পণে ছাতাটা একটু ফাঁক করে দেখালেন, ভিতরে কাগজে মোড়া বড় মাছের দুটো টুকরো রয়েছে। বললেন,কালবোশ খুব তেলালো মাছ। গিন্নিকে বলা আছে মশলা-টশলা করে রাখবে। একটু বেশি রাত হলে নাতি নাতনিরা যখন অঘোরে ঘুমোবে তখন বেঁধে দুজনে খাব।

বলে মৃদু মৃদু হাসলেন জগদীশবাবু। জ্যোৎস্নায় তার চোখে ভারী স্বপ্নের মতো একটা আচ্ছন্নতা দেখা গেল। মাছের কথা বলার পরই দাঁড়ালেন না, বিদায় না জানিয়েই কেমন যেন সম্মোহিতের মতো হেঁটে চলে গেলেন।

রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে নিজের একটেরে নির্জন ঘরটায় বসে বসে বাইরের প্রবল জ্যোৎস্নার বাড়াবাড়ি কাণ্ড দেখতে দেখতে আমি অনেকক্ষণ কোয়ালিফিকেশনের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলাম।

কখন শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি তা খেয়াল নেই। গভীর রাতে সিচুদের হারমোনিয়ামটা যেন নিজে নিজেই বেজে উঠল। খুব করুণ একটা গৎ ঘুরেফিরে বাজছে। মাঝে-মাঝে ফুটো বেলো দিয়ে হাফির টানের মতো ভুসভুসে হাওয়া বেরিয়ে যাচ্ছে বটে, তেমন মিঠে আওয়াজও হচ্ছে না। তবু সুরটা যে করুণ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

ঘুমের মধ্যেই আমি বললাম, কিছু বলছ?

আমি যে গান গেয়েছিলেম।

 তাতে কী? সব হারমোনিয়ামই গান গায়। আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান তার বদলে তুমি….

প্রতিদান? তাও দিয়েছি তো! দুশো টাকা। অর্ধেক ধরা দিয়েছি গো, অর্ধেক আছে বাকি..হারমোনিয়াম গাইতে লাগল।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়