কাটুসোনা

সকালে কাক ডাকল কা, অমনি ফটকের কাছে ভিখিরিও ডাকল, মা!

বলতে কী সকাল থেকেই আমাদের বাড়িতে ভিখিরির আনাগোনা। প্রথম আসে রামশংকর। আমার জন্মের আগে থেকে আজ পর্যন্ত সে সপ্তাহে ক্যালেন্ডার ধরে তিন দিন আসবেই। সে এলেই বুঝতে পারি, আজ হয় সোম, নয়তো বুধ, না হয়তো শনিবার। রামশংকরকে সবাই চেনে হাঁটুভাঙা রামা বলে। দিব্যি স্বাস্থ্য। দোষের মধ্যে তার হাঁটু সোজা হয় না। বাঁকা হাঁটু নিয়ে খানিক নিলডাউন হয়ে সে হাটে। বেশ জোরেই। রামার আবার তাড়া থাকে। একবার-দুবার ডাকবে, মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে ভিক্ষে না পেলে সে ভারী রাগারাগি শুরু করে দেয়, আরে, এইসন হোলে আমার চলবে? আমারও তো পাঁচঠো বাড়ি যেতে হোবে, তার পোরে তো পেট ভোরবে! এ হো দিদি, ও মাইজি, এ বুডটা মাইজি, আরে ও খোকাবাবু…

ভিক্ষের চাল আলাদা একটা লোহার ড্রামে থাকে। তাতে জারমান সিলভারের একটা কৌটো। ভরভরন্ত এক কৌটো চাল পেয়ে রামশংকর গেল তো এল অন্নদা বুড়ি। তার নাম অবশ্য অন্নদা নয়। ম্যাট্রিকুলেশন বেঙ্গলি সিলেকশনে ভারতচন্দ্রের একটা কবিতা ছিল, অন্নদার জরতী বেশে ব্যাস ছলনা। অন্নদা যে বুড়ির বেশ ধরে ব্যাসদেবকে ছলনা করে নতুন কাশীকে ব্যাসকাশী বানিয়েছিলেন এই বুড়ি হুবহু সেইরকম। ফটকের কাছে বসে মাথার উকুন চুলকোবে, ঘ্যানর ঘ্যানর করে সংসারের দুঃখের কথা বলবে, ভিক্ষেটা বড় কথা নয় তার কাছে, কথা বলতে পারলে বাঁচে। ভৈরবকাকা তার নাম দিয়েছেন অন্নদা বুড়ি।

বোবা মুকুন্দ আসে রোববার আর ছুটির দিনে। লোকে বলে সে ফাঁসিদেওয়ায় এক ইস্কুলে দফতরির কাজ করে। ছুটিতে ভিক্ষে করতে বেরোয়। সেও এক কৌটো চাল নেয়। আর আসে ছেলে কোলে নিয়ে মানময়ী। বলতে কী মানময়ীও তার নাম নয়। বছরের পর বছর সে একটা বছরখানেক বয়সের ছেলে কোলে নিয়ে আসছে দেখে একদিন ঠাকুমার সন্দেহ হয়। ঠাকুমা সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল, বলি ও মেয়ে, তোমার কোলের বাচ্চাটি কি সেই আগেরটাই? না কি একে আবার নতুন জোগাড় করেছে? এই শুনে মানময়ী কেঁদে আকুল, আমার পুয়ে পাওয়া বাচ্চাটাকে নিয়ে এত কথা কীসের তোমাদের? না হয় ভিক্ষেই দেবে, তা বলে কি আমাদের মান নেই? সেই থেকে মানময়ী। তবে আমরাও জানি মানময়ীর কোলের বাচ্চার বয়স বাড়ে না। একজন একটু বড় হয় তো ঠিক সেই বয়সী আর একটাকে কোত্থেকে জোগাড় করে আনে। কিন্তু সে কথা বলবে এত বুকের পাটা কার?

বাঁধা ভিখিরি দশ বারোজন। তাছাড়া উটকো ছুটকো আরও জনা বিশেক। কেউ শুধু হাতে ফিরবে না, মায়ের আর ঠাকুমার এই নিয়ম। পপি বেঁচে থাকতে সেও ভিখিরি দেখলে ঘেউ-ঘেউ করত না, বরং দৌড়ে এসে ভিতরবাড়ির খবর দিত।

ভিখিরি নানারকমের আছে। কেউ ফটকের ওপাশ থেকে হাত বাড়ায়, কেউ বা ভিতরবাড়িতেও আসে ভিখিরিপানা করতে। আমি বয়সে পা দিতে না দিতেই এরকম কয়েকজন ভিখিরির আনাগোনা শুরু হয়ে গেল।

একবার আমাদের পুরনো রেডিয়োটা খারাপ হওয়াতে হিলকার্ট রোড থেকে দাদা পন্টুদাকে নিয়ে এল।

পদা রেডিয়ো দেখবে কী, আমাকে দেখে আর চোখই সরাতে চায় না। সেদিনই মা’র সঙ্গে মাসিমা পাতিয়ে বাবাকে মেশো ডেকে ভিত তৈরি করে রেখে গেল। তারপর প্রায়ই সাইকেলে চলে আসে। পন্টুদার রেডিয়ো সারাই ছাড়া আর তেমন কোনও গুণ আছে বলে কেউ জানে না। বেশ মোটা থলথলে চেহারা। কথা বলার সময় শ্বসের জোরালো শব্দ হয়। হাসিয়ে দিলে হেসে বেদম হয়ে পড়ে।

আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পন্টুদা বিস্তর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বেচারা! কী দিয়ে চোখ টানবে তা বুঝতে না পেরে তার যে আর একটা মাত্র বাহাদুরি ছিল সেইটেই আমাকে দেখাতে চাইত। সেই বাহাদুরিটা হল খাওয়া। বকরাক্ষসের মতো এমন খেতে আমি আর কাউকে দেখিনি। মা আর ঠাকুমা লোককে খাওয়াতে ভালবাসে। পন্টুদা রোজ খাওয়ার গল্প ফাঁদে দেখে একদিন তাকে নেমন্তন্ন করা হল। দেড় সের মাংস আর সেরটাক চালের ভাত ঘপাৎ ঘপাৎ করে খেল পন্টুদা, আগাগোড়া আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে আর মৃদু মৃদু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে। খাওয়ার শেষে আমাকেই বলল, দেখলে তো কাটু, পারবে আজকালকার ছেলেরা এরকম? পঁচিশ খানা রুটি আর দুটো মুরগি আমি রোজ রাতে খাই।

মেয়েরা যে খাওয়ার ব্যাপারটা পছন্দ করে না এটা পন্টুদাকে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি। তাই এর পর থেকে পন্টুদা প্রায়ই বাইরে থেকে পাঁচ দশ টাকার তেলেভাজা কি পঞ্চাশটা চপ কিংবা পাঁচ সের রসগোল্লা নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসত। এ বাড়ির কেউ তেমন খাউন্তি নয়। দু’চারখানা সবাই মিলে হয়তো খেল, বাকিটা পন্টুদা। খেয়ে উদগার তুলে বলত, এখনও যতটা খেয়েছি ততটা আরও পারি। বুঝলে কাটু! খাওয়াটা একটা আর্ট!

পুরুষগুলো কী বোকা। কী বোকা! এরকম খেয়ে খেয়ে বছর দুইয়ের মধ্যে পন্টুদার প্রেসার। বেড়ে দুশো ছাড়াল। রক্তে ধরা পড়ল ডায়াবেটিসের লক্ষণ। মাথার চুল পড়ে পাতলা হয়ে গেল। গায়ের মাংস দুল-দুল করে ঝুলতে লাগল। মুখে বয়সের ছাপ পড়ে গেল। ডাক্তারের বারণে খাওয়া। দাওয়া একদম বাঁধাবাঁধি হল।

যখন আমি ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি তখন হঠাৎ একদিন অবনী রায় এসে হাজির। অবনীবাবু এ শহরের নামকরা পণ্ডিত লোক, ভাল কবিতা লেখেন, নিরীহ রোগা চেহারা। বয়স খুব বেশি নয়, তবে নিশ্চয়ই পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। উদাস এবং অন্যমনস্ক মানুষ। চোখদুটো স্বপ্নে ভরা। এসে বাবার সঙ্গে বসে অনেক কথাটথা বললেন। তারপর আমাকে আর চিনিকে ডাকিয়ে নিয়ে পড়াশুনোর কথা জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করলেন। নিজে থেকেই আমাদের পড়ার ঘরে ঢুকলেন, বইপত্র ঘাঁটলেন, দু’-চারটে পড়া জিজ্ঞেস করলেন। তারপর বাবাকে বললেন, আপনার মেয়েরা ইংরিজিতে কাঁচা। ঠিক আছে, কাল থেকে আমি ওদের পড়াব।

বলতে কী সেই প্রস্তাবে বাড়ির লোক হাতে চাঁদ পেল। অবনী রায় প্রাইভেট টিউশানি খুব অল্পই করেন। কারণ তাঁর পয়সার অভাব নেই। ওঁর বাবা শহরের মস্ত টিম্বার মার্চেন্ট। তবু মাঝে মধ্যে লোকে ধরলে উনি ছেলেমেয়েদের পড়ান। কিন্তু যাদের পড়ান তারা দুর্দান্ত রেজাল্ট করবেই। এই জন্য অবনী রায়ের চাহিদা ভীষণ। মারোয়াড়িরা দুশো আড়াইশো টাকা পর্যন্ত দিতে চায় ছেলেমেয়েদের জন্য ওঁকে প্রাইভেট টিউটর রাখতে।

বাড়ির সবাই এই প্রস্তাবে খুশি হলেও আমি আড়ালে আপন মনে জ্বালাভরা হাসি হেসে ঠোঁট কামড়েছি। অবনী রায় আমার দিকে এক আধ ঝলকের বেশি তাকাননি। কিন্তু আমি তো কিশোরী মেয়ে। আমি পুরুষের দৃষ্টি বুঝতে পারি।

তখনও ফ্ৰকই পরি। কখনও-সখনও শাড়ি। অবনী রায় এসে সকালবেলা অনেকক্ষণ পড়াতেন। কখনও কোনও বেচাল কথা বলেননি, চোখের ইশারা করেননি বা প্রয়োজনের চেয়ে এক পলকও বেশি তাকাননি মুখের দিকে। কিন্তু আমার বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে বগড়ি পাখি ডাকত। টের পেতাম।

মাসের শেষে টাকার কথা তুলল বাবা। অবনী রায় মৃদু হেসে বললেন, হি হি! কাটু আর চিনিকে টাকার জন্য পড়াই নাকি?

অবনী রায়ের সঙ্গে এ নিয়ে আর কথা চলে না। অমন সম্মানিত লোককে টাকার কথা বলাটাও অন্যায়।

এইট থেকে আমি সেকেন্ড হয়ে নাইনে উঠলাম। চিনি তার ক্লাসে ফার্স্ট হল। জগদীশবাবু তখনও বিকেলে আমাদের পড়ানো খুব দেমাক করে বলে বেড়ালেন, দেখলে তো! গাধা পিটিয়ে কেমন ঘোড়া করেছি। কিন্তু আমরা সবাই বুঝলাম কার জন্য আমাদের এত ভাল রেজাল্ট। জীবনে কখনও সেকেন্ড থার্ড হইনি আমি। সেই প্রথম।

ফাইনাল পর্যন্ত অবনী রায় আমাকে টানা পড়ালেন। আমি ফার্স্ট ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পেরোলাম। বাড়িতে উৎসব পড়ে গেল। বাবা একটা খুব দামি শাল কিনে এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন, অবনীর বাড়িতে গিয়ে এটা দিয়ে প্রণাম করে আয়।

সেই সন্ধেটা বেশ মনে আছে। অনীবাবু তার ঘরে ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন। সব সময় বই-ই পড়তেন। শালটা পায়ের ওপর রেখে প্রণাম করে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালাম। বরাবরই আমি একটু ফিচে। বললাম, আমি নয়, আপনিই ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করেছেন।

অবনীবাবু হাসিমুখে বললেন, কথাটার মানে কী দাঁড়াল?

আমি বললাম, আমার তো এত গুণ ছিল না। আপনিই করিয়েছে।

অবনীবাবু হাসছিলেন মৃদু মৃদু। নিজের র চুল টানার একটা মুদ্রাদোষ ছিল। দু’আঙুলে ডান দিকের ঘন দ্রু-র চুল টানতে টানতে বললেন, তা হলে তোমার আর আমার মিলিত প্রচেষ্টারই এই ফল।

নিশ্চয়ই।

এই প্রথম অবনী রায় প্রয়োজনের চেয়ে কিছু বেশি সময় আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, এই মিলিত প্রচেষ্টা যদি বজায় রাখতে চাই তাহলে কি তুমি রাজি হবে?

আমি তো প্রথম দিনই টের পেয়েছিলাম। দু-আড়াই বছর ধরে ওঁর কাছে পড়বার সময় মাঝে মাঝে সংশয় দেখা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মন বলত অন্য কোনও ব্যাপার আছে। কাজেই অবাক হইনি। তবু মুখটা বোকার মতো করে বললাম, কলেজের পড়াও পড়াবেন? খুব ভাল হয় তা হলে।

আমি সে কথা বলিনি। আমি তোমাকে পোব না। কিন্তু পড়ানো ছাড়াও কি অন্য সম্পর্ক হতে নেই? আরও ঘনিষ্ঠ কোনও আত্মীয়তা!

এ কথার জবাব হয় না। আমি তখন সতেরো বছরের যুবতী। উনি চল্লিশ ছুঁইছুঁই। বিয়ে করেননি বটে, তা বলে তো আর খোকাটি নন। আমি কথা না বলে আর একবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসি।

পরদিন সকালেই শহরের একজন বিশিষ্ট প্রবীণ ভদ্রলোক মন্মথবাবু এসে হাজির। বাবার সঙ্গে হরেক কথা ফেঁদে বসলেন। তারপর বললেন, অবনী কাটুকে পড়াত। তা বলতে নেই, কাটু একরকম অবনীরই সৃষ্টি। পাত্রও চমৎকার। এমন পাত্র পাওয়া বিরাট ভাগ্য। আপনার ভাগ্য খুবই ভাল যে, অবনী এত মেয়ে থাকতে কাটুকেই পছন্দ করেছে। কাটুরও বোধ হয় অপছন্দ নয়। এখন আপনাদের মত হলেই শুভকাজ হয়ে যেতে পারে।

এই প্রস্তাবে বাড়ির সবাই একটু অবাক হল বটে, কিন্তু কথাটা মিথ্যে নয় যে অবনী রায়ের মতো পাত্র পাওয়া ভাগ্যের কথাই। শোনা যাচ্ছে, অবনী অক্সফোর্ডে রিসার্চ করতে যাচ্ছেন, বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবেন। বাড়িতে সেই রাত্রে আলোচনা সভা বসল। অবনী রায়ের বয়স নিয়ে একটু খুঁতখুঁতুনি থাকলেও প্রস্তাবটা কারও অপছন্দ হল না। বয়সটাই তো বড় কথা নয়, অমন গুণের ছেলে কটা আছে?

বাড়ির সকলের মত হলেও আমি রাজি নই। যতবার অবনী রায়কে স্বামী হিসেবে ভাবতে চেষ্টা করেছি ততবার নে যেন গা চিড়বিড়িয়ে উঠেছে। মনটা আক্রোশে ভরে গেছে। কেন লোকটা আমাকে বিয়ে করতে চায়? কেনই বা লোভের বশে আমাকে বিনা পয়সায় পড়াতে এসেছিল? দু’-আড়াই বছরের ঘটনা যত ভাবলাম ততই মনটা বিরুদ্ধে দাঁড়াল। গা ঘিন ঘিন করল।

আমি স্পষ্ট করেই বাড়ির লোককে বলে দিলাম, না।

আমার বাবা মা কেউই আমার মতের ওপর মত চাপাল না। বাবা পরের দিন মন্মথবাবুকে একটু নরম সরম করে, প্রলেপ মাখিয়ে জানিয়ে দিলেন, আমাদের অমত ছিল না, কিন্তু কাটুরও তো একটা মত আছে। ও এত শিগগির বিয়েতে রাজি নয়। সবে তো ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। তা ছাড়া পড়াশুনোরও ইচ্ছে খুব।

মন্মথবাবু বাবার কথাকে পাত্তাই দিলেন না। বললেন, আরে ওটুকু মেয়ের আবার মতামত কী? এ সুযোগ কি আবার আসবে? অবনীরও তো আর আইবুড়ো থাকা চলে না। পড়াশুনো করবে বেশ ভাল কথা। সে তো অবনীও চায়। বিলেতে গিয়ে পড়াবেই তো। ঠেকছে কোথায় তা হলে?

বাবা এ কথায় খুব ফাঁপড়ে পড়ে গেলেন। কিছু বলার ছিল না। কয়েকদিন বাদে অনী রায়ের মা বাবা আমাকে দেখতেও এলেন। দুজনেই কিছু গম্ভীর। আমি সামনে যেতে চাইনি, কিন্তু বাড়ির সম্মান এবং ওঁদের প্রভাব প্রতিপত্তির কথা ভেবে যেতে হল। সামনে গিয়ে বুঝলাম, অবনী রায়ের মা বাবাও এই সম্বন্ধ তেমন পছন্দ করছেন না। ভদ্রলোক চুপ করেই রইলেন, ভদ্রমহিলা দু’-চারটে কাটা ছাঁটা কথা বললেন, অবনীর তো কত ভাল সম্বন্ধ এসেছিল। আমাদের বাড়িতে বউ হয়ে সব মেয়েই তো যেতে চায়। ছেলের মতিগতি কিছু বুঝতে পারি না বাবা..ইত্যাদি। একটু ফাঁকাভাবে উনি আমাকেই জানিয়েই দিচ্ছিলেন যে, অবনী রায়ের মাথা খেয়ে কাজটা আমি ভাল করিনি।

অবনী অবশ্য আর কখনও আমাদের বাড়িতে আসলে না। আমার সঙ্গে দেখা করারও কোনও চেষ্টা করতেন না, সেদিক দিয়ে খুব ভদ্রলোক ছিলেন। কিন্তু মন্মথবাবু রোজ আসতেন তাগাদা দিতে, বলতেন, কই মশাই, আপনারা এমন নিস্তেজ হয়ে থাকলে চলবে কেন? উদযোগ নেই কেন? পাকা কথার দিন স্থির করুন। আশীর্বাদ হয়ে যাক।

আমি বাড়ির লোককে আবার বললাম, না।

অবশেষে বাবা মন্মথবাবুকে বলতে বাধ্য হলেন, কাটু রাজি নয়। তবে আমাদের অমত নেই। আপনারা কাইকে রাজি করাতে পারলে আমরাও রাজি। মেয়ের অমতে কিছু করতে পারব না।

সেই থেকে শুরু হল মন্মথবাবুর আমাকে রাজি করানোর প্রাণপণ চেষ্টা। সেই সঙ্গে আরও কয়েকজন প্রবীণ মানুষও এসে জুটলেন। কলেজে, পাড়ায় গোটা শহরেই রটে গিয়েছিল, অনী রায়ের সঙ্গে আমার বিয়ে। রাগে, আক্রোশে আমার হাত-পা নিশপিশ করত। কারা রটিয়েছিল জানি না, কিন্তু তাদের মতলব ছিল। সেই সময় অবনী মন্মথবাবুর হাত দিয়ে আমাকে প্রথম একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটা না পড়েই আমি মন্মথবাবুর চোখের সামনে ছিঁড়ে ফেলে দিই।

অবনী বুঝলেন, আমি সত্যিই রাজি নই। চিঠি ছিঁড়ে ফেলার এক মাসের মধ্যেই অনী বিয়ে করলেন গার্লস স্কুলের একজন শিক্ষয়িত্রী অমিতাদিকে। যেমন কালো, তেমনি মোটা। তার ওপর দাঁত উঁচু, ঠোঁট পুরু এবং যথেষ্ট বয়স্কা। অমিতাদিকে বেছে বের করে অবনী বিয়ে করেছিলেন বোধ হয় আমার ওপর প্রতিশোধ নিতেই। নইলে ওরকম কুচ্ছিত মেয়েকে বিয়ে করার অন্য কোনও মানেই হয় না।

বিয়ের নেমন্তন্নে আমরা বাড়িসুদ্ধ সবাই গিয়েছিলাম। অবনীবাবু আমাকে ভিতরের একটা ঘরে ডেকে নিয়ে একগোছা রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললেন, কার সঙ্গে আমার বিয়ে হল জানো তো।

জানি। অমিতাদি।

অবনীবাবু হাসছিলেন। সেই মৃদু অদ্ভুত হাসি। বললেন, মোটেই নয়! বাড়ি গিয়ে ভেবে দেখো।

 ভেবে দেখার কিছু ছিল না। ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বিরক্ত হয়েছিলাম মাত্র।

অবনীবাবু অমিতাদিকে নিয়ে বিলেত যাননি। কালিম্পং-এ একটা মিশনারি স্কুলে দু’জন চাকরি করেন।

এইরকম ভিখিরির হাত বার বার আমাকে চেয়েছে। সব কথা বলতে নেই। বলা যায় না। কারণ আমি তো সব ভিখিরিকেই ফিরিয়ে দিইনি। এক একটা ডাকাত ভিখিরি আসে। হম্বিতম্বি করে কেড়ে নিয়ে যায়।

বাইরে থেকে আমাকে যতই সুখী আর শান্ত দেখাক, ভিতরে ভিতরে আমার অসহ্য ছটফটানি। যতই ভিতরের উতরোল সেই ঢেউ চেপে রাখি ততই আমি বদমেজাজি হতে থাকি, মন তত খিঁচড়ে থাকে। এই ছটফটানি কোনও কাম নয়, প্রেমও নয়। শুধু এই বাঁধানো সুন্দর জীবন থেকে একটু বাইরে যাওয়া, একটু বেনিয়মে পা দেওয়ার ইচ্ছে।

আমার ভিতরে এক বদ্ধ পাগলির বাস। সারাদিন হোঃ হোঃ করে হাসতে চায়, হাউমাউ করে কাঁদতে চায়। তার ইচ্ছে একদিন রাস্তার ধুলো খামচে তুলে সারা গায়ে মাখে। মাঝে মাঝে সে ভাবে, যাই গিয়ে নাপিতের কাছে বসে ন্যাড়া হয়ে আসি। রাস্তার ওই যে নাক উঁচু একটা লোক যাচ্ছে দৌড়ে গিয়ে ওর নাকটা একটু ঘেঁটে দিলে কেমন হয়? নিজের গায়ে চিমটি দিলে খুব লাগে? দিয়ে দেখি তো একটু উঃ বাবা! জ্বলে গেল! মদ খেয়ে যদি মাতাল হই একবার! যদি সাতজন বা-জোয়ান মিলিটারি আমাকে তাদের ব্যারাকে টেনে নিয়ে যায়!

এইসব নিয়মভাঙা কথা সেই পাগলি সব সময়ে ভাবছে। যত ভাবে তত গা নিশপিশ করে, হাত-পা গুলশুল করে, মন গলায় দড়ি বাঁধা হনুমানের মতো নাচতে থাকে।

মল্লিকবাড়ি থেকে সকালে যে একরাশ ফুল চুরি করে এনেছিলাম তা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই ছিঁড়েছি, ছিটিয়েছি। চুরির কোনও মানেই হয় না।

পাগলা দাশু একদম স্মার্ট নয়, কে বলবে কলকাতার ছেলে! জলজ্যান্ত আমাকে সামনে দেখে একদম ঘাবড়ে গিয়েছিল! পুরুষের চোখ আমার ভীষণ চেনা, ওর নজর দেখেই বুঝে গেছি ও আর একটা ভিখিরি। পাগলা দাশু জানে না যে, ও আমার ভাবী দেওর। জানলে হয়তো আজ সকালে একটা প্রমাণই পেয়ে যেতাম।

আমাদের বাড়িতে এতকাল প্রেশার কুকার ছিল না। মা আর ঠাকুমা দু’জনেরই ওসব আধুনিক জিনিস অপছন্দ। তারা সাবেকি ঠাটেই বেশি স্বস্তি পায়। তবু কাল রাতে বাবা একটা বিরাট প্রেশার কুকার কিনে এনে বলল, সকলেই বলছে, এ হল একটা স্ট্যাটাস সিম্বল। রান্নাও নাকি চমৎকার হয়, খাদ্যগুণ বজায় থাকে, সময় কম লাগে।

শুনে ভৈরবকাকা চেঁচিয়ে উঠলেন, সব জোচ্চোর। তোমাকে যাচ্ছেতাই বুঝিয়ে, কৃত্রিম অভাববোধ তৈরি করেছে। এটাই হল এখনকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি। মনোহারী বিপণিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি রোজ দেখি, গাড়ল মানুষগুলো এসে যত আননেসেসারি জিনিস কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আফটার শেভ লোশন, টুথপিক, মাস্টার্ড, কর্নফ্লেক্স, আইব্রো পেনসিল, লিপস্টিক, লোমনাশক, শ্যাম্পু, মাথা-মুন্ডু। পকেটের পয়সা উড়িয়ে দিচ্ছে হাওয়ায়। ফিটকিরি দিয়ে যে কাজ হয়ে যায়, তার জন্য গুচ্ছের টাকা দিয়ে গাড়ল ছাড়া আর কেউ আফটার শেভ কেনে? সোজা কথা তোমার প্রয়োজন থাক বা না থাক তোমার প্রয়োজনের বোধটা জাগিয়ে দিতে পারলে ইউ বিকাম এ পারফেক্ট গাড়ল।

ভৈরবকাকা আমাদের কাকা নয়, আত্মীয়ও নয়, বাবার চেয়ে বয়সে অন্তত দশ বছরের বড়। তবে অনাশ্রিত ভালমানুস ভৈরবকাকা বহুকাল আমাদের সংসারে আছেন। আমাদের আপন কাকাদের চেয়ে ভৈরবকাকা কম আপন নন। যশোরে কিছু জমিজমা ছিল। সম্পত্তি বদল করে আমবাড়ি ফালাকাটায় বেশ অনেকটা চাষের জমি পেয়েছেন। খানিকটা বাস্তুভিটেও। সেই আয়ে তার চলে, আমাদের সংসারেও অনেক দেন। বিয়ে-টিয়ে কোনওকালে করেননি। এক জমিদারের মেয়েকে সে আমলে ভালবেসে ফেলেছিলেন কিন্তু বিয়ে না হওয়ায় সতেরোবার দেবদাস পড়ে মদ খাওয়া ধরলেন। মদ সহ্য হল না, আমাশা হয়ে গেল। তারপর নামলেন দেশের কাজে। বিস্তর বেগার খেটে কখনও মোনাশিনী ক্লাব, কখনও কখনও কচুরিপানা উদ্ধার সমিতি, কখনও ম্যালেরিয়া অভিযান সংঘ, কখনও সর্বধর্ম সৎকার সমিতি বা কখনও নিখিল ভারত শীতলপাটি শিল্পী মহাসংঘ তৈরি করেছেন। কোনওটাই টিকে নেই। তবে অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করেন। তার ভয়ে এখনও এ বাড়ির কেউ টুথপেস্ট বা টুথব্রাশ ব্যবহার করে না। দান বা ঘুঁটের ছাই দিয়ে আমরা দাঁত মাজি। লিপস্টিক পারতপক্ষে মাখি না। তবে লুকনো একটা থাকে, বিয়েবাড়ি-টাড়ি যেতে পোপনে লাগিয়ে যাই।

আজ সকাল থেকে ভৈরবকাকা আবার প্রেশার কুকারের পিছনে লেগেছেন। তার অবশ্য কারণও আছে। প্রেশার কুকারে রান্না হবে বলে বাবা আজ বাজার থেকে দুই কেজি খাসির মাংস এনেছে। অত মাংস আমরা দু’দিনেও খেয়ে ফুরোতে পারব না। মাংসের পরিমাণ দেখে মাও চেঁচামেচি করছে। বাবা কিছু অপ্রতিভ।

ভৈরবকাকা বললেন, ওই যে গল্প আছে, এক সাধু লেংটি বাঁচাতে বেড়াল পুল, বেড়াল খাওয়াতে পোর কিনল, আর ওই করতে করতে ঘোর সংসারী হল! এ হল সেই প্রস্তাব। প্রেশার কুকার কিনলে তো মাংস আনতে হল। এই কাড়ি মাংস বাঁচাতে এরপর না আবার তুমি ফ্রিজ কিনতে ছোটো!

বাবা বিরক্ত হয়ে বলে, ফ্যাদরা প্যাচাল পেড়ো না তো ভৈরবদা। প্রেশার কুকারটা বেশ বড় বলেই আমি একটু বেশি মাংস কিনে ফেলেছি। না হয় নিজেরা আজ একটু বেশি করেই খাব। বেয়াই বাড়িতেও পাঠানো যাবে।

ভৈরবকাকা চটে উঠে বললেন, তোমার খুব টাকা হয়েছে, না? তাই ওড়াচ্ছো? কেন প্রেশার কুকার ছাড়া এতদিন কি আধসেদ্ধ ডাল আর আধকাঁচা মাংস খেয়ে এসেছ!

এসব কথায় মা ঠাকুমা ভৈরবাকার পক্ষে।

 বাবাকে একা দেখে আমি তার পক্ষ নিয়ে বললাম, মানুষের শখ বলেও তো একটা জিনিস আছে! টেকনোলজি যত ডেভেলপ করবে তত আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন চাই।

হু।- ভৈরবকাকা রাগে গরগর করতে করতে বলে, ওসব হচ্ছে বিজ্ঞাপনের শেখানো কথা। আরও কত কথা আছে! বলে কিনা, প্রেশার কুকার হল নারীদের রান্নাঘর থেকে মুক্তি। ফ্রিজ মানে জিনিসের সাশ্রয়। এসব হচ্ছে অটোসাজেন। মানুষের মগজে কথাগুলো ক্রমে ক্রমে সেট করে দেওয়া। উন্মাদের মতো কাখ খুলে মানুষ জিনিসও কিনছে বাপ!

প্রেশার কুকার হুইসিল দিতেই মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। বলল, ও বাবা, এ আবার ফেটে-ফুটে না যায়। কাটু তুই বরং দ্যাখ। আমার অভ্যেস নেই।

মাংস রাঁধতে গিয়ে কী করে যে মনটা আবার ভাল হয়ে গেল কে জানে!

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়