ফুল চোর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

হারমোনিয়াম সম্পর্কে আমি কতটুকুই বা জানি! তবু এদের বাড়ির পুরনো হারমোনিয়ামটা দেখেই আমার মনে হচ্ছিল, শুধু রিড নয়, এর গায়ের কাঠের কাঠামোটাও নড়বড়ে হয়ে গেছে।

ভদ্রমহিলার বয়স খুব বেশি হবে না। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। রোগা, ফরসা। এবং মুখের হাড় প্রকট হওয়ায় একটু খিটখিটে চেহারার। বললেন, রিডগুলো জার্মান।

পাশের ঘরে একটা বাচ্চা মেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পশুপতি আমাকে কনুইয়ের একটা তো দিল। সম্ভবত কোনও ইশারা। কিন্তু কীসের ইশারা তা আমি ধরতে পারলাম না। এই হারমোনিয়াম নোর ব্যাপারে সে-ই অবশ্য দালালি করছে।

আমি মাদুরের ওপর রাখা হারমোনিয়ামটার সামনেই বসে আছি। আমার সামনে চায়ের কাপ, ডিশে দুটো থিন এরারুট বিস্কুট। আমি ভদ্রমহিলার দিকে চেয়ে বললাম, ও।

কিন্তু আসলে আমি তখন হারমোনিয়ামের রিডের চেয়ে থিন এরারুট বিস্কুট সম্পর্কেই বেশি ভাবছি। হঠাৎ আমার খেয়াল হয়েছে, এরারুট দিয়ে সম্ভবত এই বিস্কুট তৈরি হয় না। যতদুর মনে পড়ে, ছেলেবেলা থেকেই থিন এরারুট বিস্কুট কথাটা শুনে আসছি। অথচ কোনও দিনই থিন কথাটা বা এরারুট ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি। আজ পুরনো হারমোনিয়াম নিতে এসে ভাবতে লাগলাম।

যথেষ্টই আপ্যায়ন করছেন এরা। কেউ পুরনো হারমোনিয়াম কিনতে এলে তাকে হাতপাখার বাতাস বা চা বিস্কুট দেওয়ার নিয়ম আছে কি না তা আমি জানি না। কিন্তু চা বিস্কুট দেওয়াতে আমার কেবলই মনে হচ্ছে আমি কনে দেখতে এসেছি! এক্ষুনি ও-ঘর থেকে পরদা সরিয়ে কনে ঢুকবে। নিয়মমাফিক নমস্কার করবে এবং হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি গাইবে।

ভদ্রমহিলা হারমোনিয়ামটার ওধারে বসে আছেন। মুখ চোখ যথেষ্ট ধূর্ত এবং সচেতন। হাতের পাখাটা জোরে নাড়তে নাড়তে একটু বুকে বললেন, চা ঠান্ডা হচ্ছে যে!

ঠান্ডা হওয়াটাই দরকার ছিল। এবার বড় প্যাঁচপ্যাঁচে গরম পড়েছে। ঘরে ইলেকট্রিক পাখা নেই। হাতপাখায় তেমন জুতও হচ্ছে না। এর মধ্যে গরম চা পেটে গেলে আরও অস্বস্তি।

ভদ্রতাবশে আমি চায়ে চুমুক দিলাম। এবং সেই সময়ে বেটাইমে পশুপতি আমাকে কনুই দিয়ে আর একটা ঠেলা দিল। খুব সাবধানেই দিল। চা চলকায়নি। কিন্তু আমি দ্বিতীয়বারও ইঙ্গিতটা ধরতে না পেরে ভারী অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। পাশের ঘরে কঁদুনে মেয়েটাকে কে এক জন ফিসফিস করে মন-ভোলানো কথা বলছে। গলাটা পুরুষের বলেই মনে হচ্ছিল। অথচ ভদ্রমহিলা বলেছে, তার স্বামী বাড়ি নেই। অবশ্য পাকা ঘর হলে পাশের ঘরের কথা এ-ঘর থেকে শুনতে পাওয়া যায় না। মাঝখানের দরজাটা শক্ত করে আটা রয়েছে। কিন্তু বাঁশের বেড়ার ঘরে গোপনীয়তা রক্ষা করা খুবই মুশকিল।

পাশের ঘরে মেয়েটা বলছে, ছাই দেবে তুমি। কত কিছু তো কিনে দেবে বলে। দাও?

ফিসফিস স্বরে বলে, আস্তে। শুনতে পেলে কী মনে করবে। ডবল রিডের ভাল হারমোনিয়াম দেখে এসেছি। কী আওয়াজ।

চাই না। পুরনোই আমার ভাল।

এটা তো পচা জিনিস ছিল, তাই বেচে দিচ্ছি।

সব জানি। মিথ্যে কথা।

আমাকে কানখাড়া করে শুনতে দেখেই বোধ হয় ভদ্রমহিলা সতর্ক হলেন। খুব জোর দু’ঝাপটা হাওয়া মেরে আমার কান থেকে কথাগুলো তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললেন, কত লোক আসে। দেখেই বলে, এমন জিনিস আজকাল পয়সা দিয়ে পাওয়া যায় না। বেচে দেওয়ার ইচ্ছেও ছিল না, কিন্তু আমার বড় মেয়ে এখন সংগীত প্রভাকর পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে তো, তাই স্কেল চেঞ্জার না হলে ভারী অসুবিধে।

আমি বললাম, ঠিক কথাই তো।

 হারমোনিয়ামের একটা রিডের তলায় একটা দেশলাইয়ের কাঠি গোঁজা দেখে আমি কৌতূহলবশে এবং সম্ভবত কান চুলকোনোর জন্যই আনমনে দু আঙুলে সেটা টেনে আনলাম। সঙ্গে সঙ্গে রিডটা নড়া দাঁতের মতো ডেবে গেল। অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ রকমই হওয়ার কথা।

রিডটার নেমকহারামি লক্ষ করেই কিনা কে জানে, ভদ্রমহিলা তাড়াতাড়ি বললেন, চা-টা কিন্তু সত্যিই জুড়িয়ে যাচ্ছে।

আমি চা খেতে থাকি। কিন্তু কেবলই মন বলছে, কনে কোথায়? কনে কোথায়?

আমাকে দোষ দেওয়া যায় না। গ্রীষ্মের শেষ বেলার আলোটা বেশ মোলায়েম লালচে হয়ে পশ্চিমের জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে। ভারী কিভূত আলো! সামনে হারমোনিয়াম। পরিবেশটা একদম হুবহু কনে দেখার। পরদা সরিয়ে কনে ঘরে এলেই হয়।

এল না। পশুপতি এবার হাঁটু দিয়ে আমার হাঁটুতে চাপ দিল। আমি ধীরে সুস্থে চা শেষ করি।

বিস্কুটটা খেলেন না যে!–ভদ্রমহিলা খুবই আকুল হয়ে বললেন।

ডিশে চা পড়ে বিস্কুটটা ভিজে নেতিয়ে গেছে। ওই ক্যাতক্যাতে বিস্কুট খেতে আমার ভারী ঘেন্না হয়। কিন্তু সে কথা তো বলা যায় না। তাই আমি বললাম, চায়ের সঙ্গে কিছু খাইনা।

পশুপতি এতক্ষণ মৃদু মৃদু হাসছিল! এবার হঠাৎ বলে উঠল, বউদি, আপনার গানের গলা কিন্তু দারুণ ছিল।

আর গলা! –বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা।

আমি যে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড হারমোনিয়াম কিনতে এসেছি সেটা ভুলে গিয়ে কখন যে খোলা দরজার সরে যাওয়া পরদার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে গেছি তা খেয়ালই ছিল না। অদ্ভুত লালচে গাঢ় আলোয় সামনের বাগানটা মাখামাখি। এইমাত্র কয়েকটা বেলকুঁড়ি বুঝি ফুল হয়ে ফুটল। একটা দমকা বাতাসে চেনা দুরন্ত গন্ধটা এসে মাতাল করে দিয়ে গেল ঘর। আমরা নিচু ভিটের মেঝেয় মাদুরে বসা। ঘরের একধারে একটা সরু বেঞ্চির মতো চৌকিতে রং-ওঠা নীল বেডকভারে ঢাকা বিছানা। একটা সস্তা কাঠের আলমারি। একটা পড়ার টেবিল আর লোহার চেয়ার। বেড়ার বাঁখারির ফাঁকে ফাঁকে চিরুনি, কাঠের তাক, নতুন কাপড় থেকে তুলে নেওয়া ছবিওলা লেবেল, সিগারেটের প্যাকেট কেটে তৈরি করা মালা, কাজললতা এবং আরও বহু কিছু গোঁজা রয়েছে। ঘরের কোণে একটা কাঠের মই রয়েছে যা বেয়ে পাটাতনে ওঠা যায়। এ সব তেমন দ্রষ্টব্য বস্তু নয়। তবু ওই বেলফুলের গন্ধ, এক চিলতে বাগান আর লালে লাল আলো পুরো ‘হোলি হায়, হোলি হ্যায়’ ভাব। মন বার বার বিয়ে-পাগলা বরের মতো জিজ্ঞেস করছে, কনে কোথায়? কনে কোথায়?

আমার অন্যমনস্কতার ফাঁকে পশুপতি আর ভদ্রমহিলার মধ্যে বেশ কিছু কথা চালাচালি হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। না হলে হঠাৎ কেনই বা ভদ্রমহিলা হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে পা পা করে বাজাতে থাকবেন, আর কেনই বা মিনিট পাঁচেক খামোকা হারমোনিয়ামে নানা গৎ খেলিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলবেন, এই করেছ ভাল নিঠুর হে…

গান শেষ হলে কিছু বলতে হয় বলে বললাম, বেশ।

ভদ্রমহিলা ঝুঁকে বললেন, ভাল না আওয়াজটা?

আমার দুটো আওয়াজই বেশ স্পষ্ট ও জোরালো লেগেছিল। তাই বললাম, ভালই তো। এখনও আপনার গলা বেশ রেওয়াজি।

সময় কোথায় পাই বলুন! সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে, সেই থেকে সংসার আর সংসার। এখন মেয়েদের শেখানোর জন্য যা একটু বসি টসি মাঝে-মাঝে। আমার উনি একদম গান বাজনা ভালবাসতেন না। ঘরের লোক মুখ ফিরিয়ে থাকলে কি চর্চা রাখা যায় বলুন!

ঠিকই তো।

পশুপতি খুব হাসছিল। হাসি ওর রোগ বিশেষ। তবে হঠাৎ হাসিটা সামলে বলে উঠতে পারল, তা হলে এবার কাজের কথা থোক।

ভদ্রমহিলা ভীষণ গম্ভীর হয়ে মুখ নামিয়ে পাখার উঁচু-নিচু শিরগুলোয় আঙুল বোলাতে-বোলাতে বললেন, আপনারাই বলুন। জার্মান রিড, পুরনো সাবেকি জিনিস। দেখতে তেমন কিছু নয় বটে, কিন্তু এখনও কী রকম সুরেলা আওয়াজ, শুনলেন তো!

এবার সেই বিপজ্জনক দরাদরির ব্যাপারটা এগিয়ে আসছে। আমি তাই প্রাণপণে অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। ফুলের গন্ধ ও কনে দেখা আলোর স্রোতে ভেসে যেতে যেতে মৃদু মৃদু। হাসতে থাকি। তবু দুনিয়ার যত ছিদ্র আমার চোখে পড়বেই। ভদ্রমহিলা হারমোনিয়ামের বেলোটা চেপে বন্ধ করেননি। ফলে আমি স্পষ্ট দেখলাম বেলোর ভিতরে দু’জায়গায় ব্ল্যাক টেপের পট্টি সাঁটা রয়েছে।

দরাদরির সময় পশুপতি কোন পক্ষ নেবে তা বলা মুশকিল। হারমোনিয়ামটা কিনতে সেই আমাকে রাজি করিয়েছে। বলেছে, জিনিসটা ভাল, পরে বেশি দামে বেচে দেওয়া যাবে। আমার টাকা থাকলে আমিই কিনতুম। আর আপনি যদি কেনেন তবে আমি পরে দশ-বিশ টাকা বেশি দিয়ে আপনার কাছ থেকেই নিয়ে নেব। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, পশুপতি বিক্রেতাদের কাছ থেকেই কমিশন পায়, ক্রেতাদের কাছ থেকে বড় একটা নয়। সুতরাং ভদ্রমহিলার পক্ষ নেওয়াই তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবিকই যদি হারমোনিয়ামটা বাগানোই তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে দর কমানোতেই তার স্বার্থ। কিন্তু পশুপতিকে ঠিক মতো আঁচ করা খুবই শক্ত।

ভদ্রমহিলা নতমুখ ফের তুলে আমার দিকে পাগলকরা এক দৃষ্টিতে তাকালেন।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আর একটা গান শুনব।

কথাটা মাথায় আসতে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। দরাদরি জিনিসটা আমি একদম পছন্দ করি না।

গানের কথায় ভদ্রমহিলা একটু খুশিই হলেন কি! মুখটা যেন জ্যোৎস্নায় ভিজে গেল। বললেন, আমার গান আর কী শুনবেন। আমার বড় মেয়ে বাড়িতে থাকলে তার গান শুনিয়ে দিতাম। দারুণ গায়।

আমি নির্লজ্জের মতো জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বড় মেয়ে কোথায়?

রবিবারে ওর গানের ক্লাস থাকে।

পাশের ঘরে কান্না থেমেছে। তবে একটা কচি মেয়ের গলা আর একটা ধেড়ে পুরুষের গলা খুব জোর ফিসফিসিয়ে গল্প করছে। আমার মনে হল, আজ রবিবারে ভদ্রমহিলার স্বামী বোধ হয় বাড়িতেই আছেন। তবে সম্ভবত উনি আমার সেভোকাকার মতোই মেনিমুখো এবং স্ত্রীর অধীন। বাড়িতে পুরনো খবরের কাগজওয়ালা, শিশিবোতলওয়ালা, ছুরি কাঁচি শানওয়ালা, শিলোকোটাওয়ালা, কাপড়ওয়ালা বা শালওয়ালা এলে কাকিমা কক্ষনও কাকাকে তাদের সামনে বেরোতে দেন না। কারণ ভালমানুষ কাকা সকলের সব কথাই বিশ্বাস করে বসেন, দর তুলতে বা নামাতে পারেন না এবং ঝগড়া-টগড়া লাগলে ভীষণভাবে ল্যাজেগোবরে হয়ে যান। এমনকী আমার খুড়তুতো বোনকে যখন পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল তখনও কাকাকে ঠিক এইভাবে পাশের ঘরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, যেমনভাবে এই ভদ্রমহিলার স্বামীকে রাখা হয়েছে। পাত্রপক্ষ যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ কাকা পাশের ঘরে বসে প্লাস পাওয়ারের চশমা এঁটে প্রায় তিন কিলো চালের ধান আর কঁকর বেছে ফেলেছিলেন। এই ভদ্রলোককে তেমন কোনও কাজ দেওয়া হয়েছে কি না কে জানে!

তবে ভদ্রলোকের জন্য আমার বেশ মায়া হচ্ছিল। ওঁর করুণ অবস্থাটা আমি এত স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম যে বেখেয়ালে হঠাৎ বলেই ফেললাম, আপনার স্বামীকেও এই ঘরে ডাকুন না।

ভদ্রমহিলা ফরসা এবং ফ্যাকাসে। প্রথমে মনে হয়েছিল, বুঝি রক্তাল্পতায় ভুগছেন। কিন্তু আমার কথা শুনে হঠাৎ এমন রাঙা হয়ে উঠলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম আমার ধারণা ভুল। ওঁর রক্তাল্পতা থাকতেই পারে না।

উনি ফের মুখ নত করলেন এবং আবার মুখ তুলে বললেন, উনি তো বাড়িতে নেই। তবে হয়তো ফিরে আসতেও পারেন। লাজুক মানুষ লোকজ দেখে হয়তো পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছেন। ও ঘরে কথাও শুনছি বেশ।

বলতে বলতে ভদ্রমহিলা উঠে গেলেন। মাঝখানের দরজা এতক্ষণ দমবন্ধ করে এঁটে ছিল। এবার হঠাৎ খুলে যাওয়ায় অবারিত স্বাসবায়ুতে সারা বাড়িটা খোলামেলা, হাসিখুশি হয়ে গেল হঠাৎ। আর ঘরে কনে-দেখা আলোয় ভদ্রমহিলা অবিকল কনের মতোই লুঙ্গি পরা আদুড়ে গায়ের মাঝবয়সি মজবুত চেহারার লাজুক স্বামীটিকে ধরে ধরে এনে দাঁড় করাল। খুব হেসে বললেন, ঠিকই ধরেছিলাম। দেখুন, চুপি চুপি এসে পাশের ঘরে মেয়ের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। মেয়ে অন্ত প্রাণ একেবারে।

ভদ্রলোক মাথা চুলকোতে চুলকোতে খুব বিনয় ও লজ্জার সঙ্গে হাসছেন। জীবনে অসফল ভদ্রলোকেরা ঠিক এইভাবেই হাসেন এবং নিজেকে নিয়ে অস্বস্তি বোধ করেন। অবিকল আমার সেজোকাকা।

বসুন। আমি বললাম।

 মাদুরে আর জায়গা ছিল না। উনি অবশ্য মাদুর-টাদুরের তোয়াক্কা করেন বলে মনে হল না। খুব অভ্যস্ত ভঙ্গিতে মেঝেয় বাবু হয়ে বসে পড়লেন।

এই সময়ে পশুপতি খুব আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আমাকে ঠেলা দিয়ে বলে, কাজের কথাটা তুলুন না।

কনে কই? আমার মন তার দাবি আবার পেশ করল। আমি বললাম, মেয়েদেরও ডাকুন।

পরদার ফাঁক দিয়ে একটা কচিমুখ উঁকি দিয়েই ছিল, সে-ই জবাব দিল, দিদি সুধাদির বাড়িতে আছে। ডেকে আনব?

ভদ্রমহিলার রক্তাল্পতা কেটে গিয়ে রক্তাধিক্যই দেখা যাচ্ছে এখন। কিন্তু তুখোড় চালাক বলে পলকে হেসে ফেলে বললেন, ওমা। তাই বুঝি! আমাকে তো বলে গেল গানের ক্লাসে যাচ্ছে। তা আন না ডেকে।

মেয়েটা ঘরের ভিতর দিয়েই এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল! পশুপতি ঘাম মুছছে। ভদ্রমহিলা করুণ চোখে চেয়ে বললেন, দেরি হয়ে গেছে বলে বোধ হয় আজ আর গানের ক্লাসে যায়নি।

পশুপতি ঘামভেজা রুমালটা শুকোনোর জন্য মাদুরের ওপর পেতে দিয়ে বলল, এবার কাজের কথাটা হয়ে যাক।

আপনারাই বলুন। ভদ্রমহিলা বললেন, জিনিসটা ঘরের বার করার ইচ্ছে কারও নেই। মেয়েরা তো সারাক্ষণ কিটমিট করছে। কিন্তু আমি বলি, স্কেল চেঞ্জার যখন কেনা হচ্ছেই তখন আর একটা হারমোনিয়াম ঘরে রেখে জঞ্জাল বাড়ানো কেন।

এ সবই দরের ইংগিত। কিন্তু পুরনো বা নতুন কোনও হারমোনিয়ামের দর সম্পর্কেই আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে পশুপতি বলেছিল, প্রথমে পঞ্চাশ বলবেন। ধীরে ধীরে পঁচাত্তর অবধি উঠে একদম থেমে যানে।

কিন্তু হারমোনিয়ামটার দিকে না তাকিয়ে কেবল ঘরদোর এবং লোকজনের দিকে চেয়েই পঞ্চাশ টাকা বলতে আমার কেমন বাধোবাধো ঠেকছে।

এ সময়ে ভদ্রমহিলা ডুবন্ত মানুষের দিকে একটা লাঠি এগিয়ে দিয়ে বললেন, পাঁচশো টাকায় কেনা জিনিস।

দরাদরিতে দালালের কথা বলার নিয়ম নেই। তা হলে তার পক্ষপাত প্রকাশ পাবে। পশুপতি শুধু শ্বাস নেওয়া আর ছাড়াটা বন্ধ করে ছিল। ফলে ঘরে একটা গর্ভিনী নিস্তব্ধতার সৃষ্টি হল। প্রচণ্ড টেনশন। দামের কথাটা এখন কে তুলবে?

নিস্তব্ধতা ভেঙে আমি হঠাৎ বললাম, আমি গান জানি না।

 ভদ্রমহিলা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। কথাটার অর্থ বুঝলেন না বোধ হয়।

আমি তাই মৃদু হেসে বললাম, গান না জানলেও হারমোনিয়াম ঘরে রাখার নিশ্চয়ই কিছু-কিছু উপকারিতা আছে।

ভদ্রমহিলা তুখোড় হলেও এ ধরনের কথাবার্তা শুনতে অভ্যস্ত নন। কনে দেখতে এসে কেউ যদি বলে, আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই, তবে যেমনটা হয় আর কি!

উনি তাই বললেন, গান না জানলে হারমোনিয়াম দিয়ে কী করবেন? কিন্তু তা হলে কিনছেনই, বা কেন?

যদি শিখি?

ভদ্রমহিলা একটু নড়ে চড়ে বসে বললেন, সে তো খুব ভাল কথা। শিখতে গেলে হারমোনিয়াম ছাড়া কিছুতেই হবে না।

কিন্তু কে শেখাবে সেইটেই সমস্যা। আমি মুখ চুন করে বলি, একদম বিগিনারকে শেখানোর তো অনেক ঝামেলা। তা ছাড়া আমার কোনও সুরজ্ঞান নেই।

ভদ্রমহিলা ডগমগ হয়ে বলেন, ও নিয়ে আপনাকে মোটেই ভাবতে হবে না। আমিই শেখাব।

 আপনি? আপনার তো সংসার করে বাড়তি সময়ই নেই।

সপ্তাহে এক দিন বা দু’ দিন শেখালেই যথেষ্ট। বাদ বাকি দিনগুলোয় আপনি বাসায় বসে প্র্যাকটিস করবেন!

বাইরের দরজার পরদা সরিয়ে এ সময়ে স্নানমুখী একটি মেয়ে ঢুকল। আর সে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরটার যা কিছু খাকতি ছিল, তার পূরণ হয়ে গেল। কনে-দেখা আলো, পুষ্পগন্ধ, রঙ্গমঞ্চের সব সাজ এবং একা ও দুঃখী হারমোনিয়াম সবই সজীব ও অর্থবহ হয়ে উঠল। মন বলল, এইজন্যই তো এতক্ষণ বসে থাকা। অবশেষে কনে এল।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়