১১.

টাকার ব্যাপারে আমার কাউকে তেমন বিশ্বাস হয় না। না ব্যাঙ্ক, না পোস্ট অফিস। আমার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হল মাসি।

মধু গুপ্ত লেন-এর বাড়ির সামনে দুটো রকে আজ বড় তরফ বা ছোট তরফের কেউ ছিল না। কিন্তু ছোট তরফের রকে গুটি চারেক ছোকরা ছেলে বসে আছে।

বড় তরফের সদরে ঢুকবার মুখে ছেলেগুলোর একজন আমাকে ডাকল, এই যে মোসাই, শুনুন।

 নানা চিন্তায় মাথাটা অন্য রকম। ডাকটাও কেমন যেন। শরীরটা কেঁপে গেল।

দু পা এগিয়ে বললাম, কী?

যে ছেলেটা ডেকেছিল তার মুখখানার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারি, এ ছোকরা বিস্তর পাপ করেছে। মুখে কাটাকুটির অনেক দাগ, শক্ত ধরনের চেহারা, চোখ দুটোয় একটা অস্বাভাবিক উজ্জ্বল দৃষ্টি। তার বাঁ হাতটার বুড়ো আঙুল বাদে আর চারটে আঙুল নিশ্চিহ্ন। আঙুলহীন হাতের চেটোটা খুন্তির ডগার মতো দেখাচ্ছে। সেই আঙুলহারা হাতের চেটোয় খুব কর্তৃত্বের একটু হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল।

কাছে যেতেই বলল, কোথায় যাচ্ছিলেন?

 গিরিবাবুর বাড়িতে।

গিরিবাবু কে হয় আপনার?

আত্মীয়।

কীরকম আত্মীয়?

ভড়কে গিয়েছিলাম। আত্মীয়তাটা মনে করতে একটু সময় লাগল। তারপর বললাম, সম্পর্কে মামা।

অন্য একটা ছেলে ওপাশ থেকে বলল, ছেড়ে দে সমীর। আসে মাঝে মাঝে। রিলেটিভিটি আছে। যান দাদা, ঢুকে পড়ুন।

কিছু বুঝতে পারলাম না। কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই হঠাৎ কপাটের আড়াল থেকে গামছা-পরা খালি গায়ে গিরিবাবু বেরিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে ভিতরবাগে টেনে নিয়ে যেতে যেতে চাপা গলায় বললেন, কী বলল ওরা বলো তো?

আমি কে জিজ্ঞেস করছিল। অবাক হয়ে বলি, কী হয়েছে মামা?

আর বলো কেন উপল ভাগনে, আমাদের বড় বিপদ চলছে। বাড়ির বাইরে বেরোনোই এখন মুশকিল। কেউ এলে তারও বিপদ।

এই বলে গিরিবাবু আবার কলঘরে ঢুকে যান।

বাড়িটা থমথম করছে। বড়গিন্নি সিঁড়ির মাঝ বরাবর পর্যন্ত নেমে এসেছিলেন, আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, কে? কে? ও উপল বুঝি?

দেখি, বড়গিন্নি বেশ রোগা হয়ে গেছেন। মুখ থমথমে। মাঝসিঁড়ি থেকেই আবার কী ভেবে উপরে উঠে গেলেন।

মাসি আমাকে দেখে একটা চোখে বড় করে চাইল। মুখখানায় নরম কয়েকটা ঢেউ খেলে গেল যেন।

আয়।

এমনভাবে বলল যেন এতক্ষণ আমার জন্যই বসে ছিল মাসি। যেন আমার জন্যই সব সময়ে বসে থাকে।

জলচৌকিতে বসে বললাম, কী ব্যাপার গো মাসি?

মাসি শ্বাস ছেড়ে বলল, মানুষ কি আর মানুষ আছে! সেই গুন্ডা ছেলেটা জ্বালিয়ে খাচ্ছে বাবা। ভাবগতিক যা দেখছি, শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচবার জন্য কর্তা-গিন্নি মিলে কেতকীকে না ওই গুন্ডাটার হাতেই তুলে দেয়। ওরা তো রকেই বসে থাকে, তোকে ধরেনি?

ধরেছিল।

সবাইকে ধরছে। পাছে মেয়ে পাচার করে দেওয়া হয় সেইজন্য পাহারা দিচ্ছে। ছোট তরফ ওদের পক্ষে। দুই তরফে দিনরাত ঝগড়া হচ্ছে।

কেতকী কোথায়?

তাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেওয়া হয় না। একদম ঘরবন্দি। দিনরাত কান্নাকাটি। মাসি এই বলে একটু শ্বাস ছাড়ে। তারপর একটা চোখে আমার দিকে অভিমানের দৃষ্টি দিয়ে বলে, তুই যদি একটু মানুষের মতো হতিস।

হেসে বলি, দুনিয়ায় মানুষের অভাব কী! আমার জন্য তুমি আর অত ভেবো না মাসি।

তোর কথা ছাড়া আর যে কোনও ভাবনা আসে না মাথায়। মাসি মুখ করুণ করে বলল, তোর কথা ভাবতে ভাবতেই সারা দুনিয়ার কথা ভাবি। মনে হয়, পৃথিবীটা যদি আর-একটু ভাল জায়গা হত, অভাব-টভাব যদি না থাকত, মানুষ যদি আর-একটু দয়ালু হত, তবে আমার উপলটার এত দুর্দশা হত না। তোর যে খিদে পায় সে যদি সবাই বুঝত!

অবাক হয়ে বলি, উরে বাবা, কত ভাবো তুমি।

কত ভাবি। এই যে কাক, কুকুর, বেড়ালদের ভূত-ভোজন করাই তাও তোর কথা ভেবে। ভাবি কী, ওরা যদি আশীর্বাদ করে তবে আমার উপলের একটা গতি হবে হয়তো।

খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকি।

মাসি বলে, বড় ভাল ছিল মেয়েটা। তোর সঙ্গে মানাতও খুব।

 গুন্ডাটা কি ওকে বিয়ে করতে চায় মাসি?

তাই তো শুনি, আমার মনে হয়, ছোট তরফের টাকা খেয়ে এ সব করছে।

বাজে কথায় সময় নষ্ট। আমি টাকাটা বের করে হাতের চেটোর আড়ালে মাসির কোলে ফেলে দিয়ে বললাম, সাবধানে রেখো।

মাসির একটা চোখই পটাং করে এত বড় হয়ে গেল। বলল, ও মা! তোর কি তা হলে কিছু হল? ও উপল, কোথায় পেলি?

বিরক্ত হয়ে বলি, অত জেরা করো কেন বলো তো?

মাসি গলা নামিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, ভাল টাকা তো! চুরি ছ্যাঁচড়ামি করিসনি তো বাপঠাকুর!

এই কি আমার ওপর তোমার বিশ্বাস?

মাসি আঁচলের আড়ালে টাকা লুকিয়ে নিয়ে রেখে এল। এসে ফিসফিস করে বলল, কেতকী তোকে ডাকছে।

কেন?

যা না। সিঁড়ির নীচেকার ঘরে আছে। একটু বসে যা, বড় কর্তা কলঘর থেকে বেরিয়ে কাপড় মেলছে, ও ওপরে যাক।

একটু বাদে সিঁড়িতে কম্প তুলে গিরিবাবু ওপরে উঠে গেলেন। মাসি ভাত বাড়তে বসল। আমি সুট করে বেরিয়ে সিঁড়ির আড়ালে সরে যাই।

এ ঘরটায় মাসি থাকে। পরদা সরাতেই কেতকীকে দেখলাম। খাটের ওপর উপুড় হয়ে শোওয়া, চুলগুলি ঝেঁপে আছে ওর মুখ আর মাথা। ডাকতে হল না, কী করে যেন টের পেয়ে ও উঠে বসল। তখন দেখি, ওর চেহারাটা খুব ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে গেছে। মোটা গরাদ দেওয়া ছোট জানালা দিয়ে একটুখানি আলোর যে আভা আসছে ঘরে তাতে দেখা যায়, কেতকী অনেক কাল হয়ে গেছে বুঝি। সমস্ত মুখ ফুলে আছে অবিরল কান্নার ফলে।

কোনও ভূমিকা না করেই কেতকী ভাঙা স্বরে বলল, আমি যাব।

 অবাক হয়ে বলি, কোথায়?

যেখানেই হোক। এ বাড়ির বাইরে।

আমি কৃশকায় মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকি। কত বাধা ওকে ঘিরেছে আজ! বললাম, তোমার যাওয়ার কোনও জায়গা ঠিক করা আছে?

ও মাথা নেড়ে বলল, না।

তা হলে?– আমি দ্বিধায় পড়ে বলি।

কেতকীর চোখে ফের জল এল। তীব্র সেই চোখে চেয়ে বলল, আজ মা কী বলেছে জানেন? বলেছে, তোকে নিয়ে যখন এত অশান্তি তখন তুই ওই গুণ্ডাটাকেই বিয়ে কর। অথচ মা ক’দিন  আগেই মিথ্যে সন্দেহ করে আমাকে মেরেছিল। আমি এ বাড়িতে থাকব না। আমাকে কোথাও নিয়ে যাবেন?

বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা খাই। আশা জাগে, লোভ জাগে, ইচ্ছের নানা রঙের বর্ণালী খেলা করে। কিন্তু আমি কোথায় নিয়ে যাব ওকে? আমার তো কোনও জায়গা নেই।

আমি মাথা নিচু করে বলি, সেটা কি হয়?

কেন হয় না উপলদা? আমার লজ্জা করার সময় নেই, নইলে এত সহজে কথাটা বলতে পারতাম না। শুনুন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।

এত চমকে গিয়েছিলাম যে, মাথাটা চক্কর মারল। খাটের স্ট্যান্ড ধরে সামলে নিলাম। একটু সময় নিয়ে বললাম, কেন আমাকে বিয়ে করবে কেতকী?

এ প্রশ্নটা সবচেয়ে জরুরি, সবচেয়ে জটিল।

কেতকী বলল, করব। ইচ্ছে। আপনি রাজি নন?

 আমি মৃদুস্বরে বলি, শুনে লজ্জা পাই কেতকী। আমি বড় সামান্য মানুষ।

কেতকীর মুখ উদাস হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বসে রইল শূন্যের দিকে চেয়ে। তারপর আস্তে বলল, পিসি বলেছিল, আপনি রাজি হবেন।

বিপদের মধ্যে পড়ে তুমি উলটোপালটা ভাবছ। বিপদ কেটে গেলে দেখবে, এ এক মস্ত ভুল।

কেতকী মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, এরকম কথা জীবনে এই প্রথম বললাম উপলদা। বেহায়ার মতো। আর কাউকে বলিনি কখনও।

বলে উপুড় হয়ে পড়ল বালিশে। কাঁদতে লাগল।

আমি কখনও ব্যায়াম-ট্যায়াম করিনি। গায়ে জোর নেই। তেমন কিছু সাহসও আমি রাখি না। কোনওক্রমে বেঁচে আছি পৃথিবীতে, এই ঢের। কেতকীর জন্য আমি কী করতে পারি?

ঘর থেকে বেরোবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই বিবেকের সঙ্গে দেখা। সেই কালো জোব্বা পরা কেশো বুড়ো, হাতে বাদ্যযন্ত্র। কাশতে কাশতে বলল, কাজটা কি ঠিক হল উপলচন্দের?

তার আমি কী জানি বিবেকবাবা? দুনিয়ার মানুষ অধিকাংশ কাজই করে ভাল-মন্দ না ভেবে। তারা তো সবটা দেখতে পায় না।

তবু ভেবে দেখো আর একবার।

বলো কী বিবেকবাবা, শেষে গুন্ডার হাতে ঠ্যাঙানি খেয়ে প্রাণটা যাবে। যদি প্রাণ বাঁচাতে পারিও তা হলেও বা বউ নিয়ে খাওয়াব কী? আবার মেয়ে ভাগানোর জন্য ঝামেলাও কি কম হবে?

এই সময়টায় আমার বিবেকের একটা জোর কাশির দমক এল। সেই সুযোগে আমি পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসি।

সদরের বাইরে পা দিতেই দেখি, ছোট তরফের রকে ছেলে-ছোকরাগুলো কেউ নেই। ছোট কর্তা রাঙা নতুন গামছা পরে দাঁড়িয়ে। ভারী হাসি-হাসি আহ্লাদি মুখ। আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে বললেন, আরে উপল ভায়া যে! তোমার তো দেখাই একদম পাই না। ভোল পালটে গেছে, অ্যাঁ! ভাল জামাকাপড়, চেহারাও দিব্যি ফনফন করছে! পেশকারি পেয়োচ নাকি, অ্যাঁ!

খুব হাসলেন। সম্পর্কে মামা হন, তবু বরাবরই ছোট তরফ ভায়া বলে ডাকেন আদর করে।

 বললাম, ছোট মামা, ভাল আছেন তো!

বেশ আছি, বেশ আছি!

 বলে এই গরমকালে নাইকুণ্ডলীতে আঙুল দিয়ে তেল ঠাসতে ঠাসতে অন্য হাতে আমাকে কাছে ডেকে গলা নামিয়ে বললেন, ও বাড়ির কী সব গণ্ডগোল শুনছি হ্যাঁ! ব্যাপারখানা কী জানো কিছু?

একটু গাড়ল সেজে বললাম, আমিও শুনছি। কে একটা মাস্তান ছেলে নাকি কেতকীকে বিয়ে করতে চাইছে।

ছোট কর্তা খুব গম্ভীর মুখে শুনে মাথা নেড়ে বললেন, আমিও পাড়ায় কানাঘুষো শুনছি। কী কেলেঙ্কারি বলো তো! তা দাদা বলছে-টলছে কী?

খুব ঘাবড়ে গেছেন।

ছোট কর্তা আহ্লাদের ভাবটা চেপে রাখতে পারলেন না। প্রায় হেসেই ফেললেন বলা যায়। মুখটা নামিয়ে বললেন, কেতকীর ভাবগতিক কিছু বুঝলে?

না।

ছোটবাবু একটা দুঃখের শ্বাস ফেলে বললেন, এ সব ব্যাপার কি আর ঠেকানো যায়! আজকালকার ছোঁড়াছুঁড়িদের কারবার সব। আমি বলি কি উদ্যোগ-আয়োজন করে বিয়ে দিয়ে দিলেই হয়! আজকাল আর বংশ-টংশ জাত-ফাত কে-ই বা মানছে। আমেরিকা ইউরোপে তো শুনি হরির লুট পড়ে গেছে। নিগ্রোয়, চিনেম্যানে, সাহেবে, হিন্দুতে একেবারে বিয়ের খিচুড়ি। এ দেশেও হাওয়া এসে গেছে। দাদাকে বুঝিয়ে বোলো, বংশ-টংশর মর্যাদা আঁকড়ে থাকলে আর চলবে না। ছেলেটাকে আমি মোটামুটি চিনি। খারাপ তেমন কিছুই নয়, একটু হাত-ফাত চালায় আর কী!

আমি বললাম, বলব।

ছোটবাবু একটু হেসে বললেন, তোমার তা হলে ভালই চলছে বলো! পোশাক-আশাক চেহারা দেখে এক ঝটকায় চিনতেই পারিনি। মানুষের উন্নতি দেখলে বড় আনন্দ হয়। করছ-টরছ কী আজকাল?

ওই টুকটাক।

খুব ভাল, খুব ভাল। দেখছ তো চারদিকে কেমন বেকারের বন্যা এসেছে! এই রকটাই এখন নিজের দখলে থাকে না, পাড়ার ছেলেছোকরা সব এসে বসে। তাড়াতেও পারি না। তাড়ালে যাবে কোথায়! তা এই বেকারের যুগে তোমার কিছু হয়েছে দেখে বড় খুশি হলুম ভায়া।

দু-চারটে কথা বলে কেটে আসি। বুঝতে পারি, ছোট তরফ লোক ভাল নয়, বড় তরফকে বেইজ্জত করতে কোমর বেঁধে নেমেছে। এ পাড়ায় ছোট তরফেরই হাঁকডাক বেশি, তাঁর নিজের একটা ক্লাবও আছে।

কিন্তু ছোট তরফের দোষ দিয়ে কী হবে! আমিও কি লোক ভাল? তার চেয়ে দুনিয়ার ভাল-মন্দের ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়াই কাজের কাজ। ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে হাঁটছি। বুকের মধ্যে একটা বড় কষ্ট ঘনিয়ে উঠছে। কেতকীর কথাগুলো ট্রেসার বুলেটের মতো ছুটে আসছে বার বার। ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে যাচ্ছে আমাকে। আজ আমার বড় আনন্দের দিন হতে পারত। হল না। হয় না।

গলির তেমাথায় আঙুলহারা সমীরের সেই স্যাঙাত দাঁড়িয়ে ছিল। রোগা শুটকো চেহারা, লম্বা চুলে তেলহীন রুক্ষতা, মস্ত মোচ চিনেদের মতো ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে ঝুলে পড়েছে। আমার দিকে ভ্রুক্ষেপও করল না।

আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। বললাম, একটা কথা বলব?

ছেলেটা কানকি মেরে চেয়ে বলল, বলুন।

 বললাম, বিয়ে-টিয়ের অনেক ঝামেলা। মেয়েটাও রাজি হচ্ছে না। তার চেয়ে ব্যাপারটা অন্যভাবে মিটিয়ে ফেললে হয় না?

ছেলেটা অন্য দিকে চেয়ে বলল, বিয়ে কে চাইছে মসাই? ক্যাস ছাড়তে বলুন, সব মিটিয়ে নিচ্ছি।

নেবেন?

আলবত নেব। ক্যাস ছাড়লে আমরা কেতকীর বিয়েতে পিঁড়ি ঘুরিয়ে দিয়ে আসব। ওর বাপকে রাজি করান।

আমার সর্বাঙ্গ উত্তেজনায় কাঁপছে। মাথার মধ্যে টিক টিক শব্দ। বললাম, সমীরবাবু ছাড়তে রাজি হবেন?

ছেলেটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, সমীরের কি মেয়েছেলের অভাব পড়েছে নাকি! সামনে হাড়কাটা গলি থাকতে! ও সব ভড়কি দিচ্ছে। তবে আমরা দু’চারদিন ফুর্তি-টুর্তি করব, মাল-ফাল খাব, ফাংশান করব, তার জন্য দু’হাজার ছাড়তে বলুন। যদি রাজি না হয় তবে কেস সিরিয়াস হয়ে যাবে। আপনার সঙ্গে তো খুব রিলেটিভিটি আছে। দেখুন বলে।

আপনারা কি গিরিবাবুর কাছে টাকা চেয়েছিলেন?

না। টাকা চাইব কেন? গিরিবাবু আমাদের পুলিশের ভয় দেখিয়েছিল, তাই সমীরের জেদ চেপে গেছে, এসবার-ওসপার করে দেবে। আমরা কেলো করতে চাই না। ও সব ভদ্রঘরের, শিক্ষিতা মেয়ে বিয়ে করে সমীর বরং আরও ফেঁসে যাবে, ওর ক্লাস এইট-এর বিদ্যে। অনেক বুঝিয়েছি সমীরকে। রাজি হচ্ছে না। কিন্তু আমরা জানি, ক্যাস পেলে ও কে ছেড়ে দেবে।

মাথার ভিতরটায় টাকড়ুমাড়ুম বাজছে। এক বার অস্ফুট দাঁড়ান বলে দৌড়ে ফিরে আসি। সদরে বড়বাবুর সঙ্গে দেখা। বেরোচ্ছেন। খুব সাবধানে উঁকি দিয়ে রাস্তাঘাট দেখে নিচ্ছেন, চৌকাঠের বাইরে পা দেওয়ার আগে।

আমাকে দেখে বললেন, ফিরে এলে যে!

একটা জিনিস ফেলে গেছি।

উনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, অ৷ তা এসো নিয়ে, তোমার সঙ্গে বাসরাস্তা পর্যন্ত যাবখন।

মাসিকে গিয়ে বললাম, কেতকীকে বাঁচাতে চাও তো পাঁচশোটা টাকা গুনে এনে দাও। আমার গুনবারও সময় নেই।

মাসি মুহূর্তের মধ্যে এনে দিল। আমি পাখনা মেলে উড়ে বেরিয়ে এলাম। গিরিবাবু সঙ্গ নিলেন বটে, কিন্তু আমার দৌড়-হাঁটার সঙ্গে তাল দিতে না-পেরে পিছনে পড়ে রইলেন।

ছেলেটা অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে ছিল। তার বুক পকেটে ঝট করে টাকাটা ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম, বাকিটা সামনের সপ্তাহে।

ছেলেটা বিশ্বাস করতে পারছে না। আস্তে বলল, কত আছে?

পাঁচশো।

পলকের মধ্যে ছেলেটা ভীষণ বিনয়ি হয়ে বলল, গিরিবাবু দিলেন?

মানুষ চরিয়ে খাই। পলকের মধ্যে বুঝলাম, এক্ষুনি ঘটনার লাগাম নিজের হাতে ধরে ফেলতে হবে। গিরিবাবু টাকা দিয়েছে এমন কথা মিথ্যে করে বললে ওরা বড়বাবুকে পেয়ে বসবে। ফের টাকার দরকার হলে আবার ঝামেলা করবে। গম্ভীর হয়ে বললাম, না। আমিই দিচ্ছি। কিন্তু আর কোনও ঝামেলা হলে বাকি টাকাটা তো দেবই না, উলটে অন্য রকম ঝামেলা হয়ে যাবে।

ছেলেটা সদ্য টাকা খেয়েছে। যারা টাকা খায় তাদের ব্যক্তিত্ব থাকে না। ভাল-মন্দের জ্ঞান নষ্ট হয়ে যায়। এ ছেলেটাও মাস্তানি ঝেড়ে ফেলে একটু খোশামুদে হাসি হেসে বলল, ঝামেলা হবে কেন? সমীর সালাকে আমরা টাইট দিচ্ছি। আপনি ডেফিনিট থাকুন।

গিরিবাবু পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন খুব তাড়াতাড়ি। ছেলেটা সেদিকে তাকালও না।

ছেলেটার আরও কয়েকজন সাঙাত এসে চারধারে দাঁড়িয়ে গেল। টাকার ব্যাপারটা আড়াল থেকে লক্ষ করে থাকবে। টাকার গন্ধ গোলাপ ফুলের মতো, যারা গন্ধ নিতে জানে তারা ঠিক গন্ধ পায়।

ছেলেটা সঙ্গীদের দিকে চোখ মেরে আমাকে বলল, তা হলে ফের সামনের সপ্তাহে, কেমন?

হ্যাঁ। কিন্তু ছোটবাবু কী হবে?

 ছেলেটা মাথাটা সোজা রেখেই বলল, ছোটবাবু ফোতো কাপ্তান। দশ-বিশ চাক্কি ঝাঁক দিতেই আমাদের দম বেরিয়ে যায়। ওর মামলায় আমরা আর নেই। তবে ওর ছেলে সন্তু আমাদের দোস্ত, কিন্তু তাকে টাইট দেওয়ার ভার আমার। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যান।

নিশ্চিন্ত হয়েই আমি বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকি। নিজের ভিতরটা বড্ড ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। টাকাটা চলে গেল হাত থেকে। সামনের সপ্তাহে আরও যাবে। যেন এই যাওয়ার জন্যই হুড়মুড় করে টাকাটা এসেছিল।

বাসরাস্তায় ভীষণ উদ্বিগ্ন মুখে বড়বাবু দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই প্রায় ছুটে এসে বললেন, চেনো নাকি ওদের?

চেনা হল। আপনি আর ভাববেন না বড় মামা, সব ঝামেলা মিটিয়ে দিয়ে এসেছি। আর কেউ হুজ্জত করবে না।

মিটে গেল মানে? কী করে মেটালে?

একটু মহৎ হতে ইচ্ছে করল। অনেককাল মহৎ হইনি। বললাম, সে শুনে আপনার কী হবে? তবে নিশ্চিন্ত থাকুন, আর কেউ কিছু করতে সাহস পাবে না।

বড়বাবু অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে আছেন। এ কয়দিনে তার বয়স বহু বেড়ে গেছে, আয়ুক্ষয় হয়েছে অনেক। একটা বহুদিনকার চেপে রাখা শ্বাস হুস করে ছেড়ে বললেন, সত্যি বলছ উপল ভাগ্নে! তুমি কি হিপনোটিজম জানো?

জানি বড়মামা। হিমনোটিজম সবাই জানে। যাক গে, কেতকীর বিয়ের আর দেরি করবেন না। এই বেলা দিয়ে দিন।

কার সঙ্গে দেব? ওই হাতকাটা সমীরের সঙ্গে?

আরে না না।— হেসে ফেলে বলি, কলকবজা নেড়ে দিয়ে এসেছি বড়মামা, এখন আপনারা বিয়ে দিতে চাইলেও সমীর উলটো দৌড়ে পালাবে। তার কথা বলিনি। ভাল পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে দিন।

কিন্তু ছোট তরফ?

 রা কাড়বে না।

 ঠিক বলছ?

তিন সত্যি।

বড়বাবুর মন থেকে সন্দেহটা শতকরা আশিভাগ চলে গিয়েও বিশভাগ রইল। সেই তলানি সন্দেহটা মুখে ভাসিয়ে তুলে বললেন, ইঞ্জিনিয়ার ছেলে একটা হাতেই রয়েছে। বড্ড খাঁই তাদের। তা এখন আর সে সব ভেবে দেরি করলে হবে না দেখছি।

লাগিয়ে দিন।

যদি ভরসা দাও তো এ মাসেই লাগাব। কলকাতায় দুই দিনে বিয়ের জোগাড় হয়।

অন্যমনস্ক ও উদাস স্বরে ‘তাই করুন বড়মামা’ বলে বিনা ভূমিকায় হাঁটতে থাকি। টের পাই, বড়বাবুর চোখ আমাকে বহু দূর পর্যন্ত প্রচণ্ড বিস্ময়ে দেখতে থাকে।

অনেক দিন বাদে নিজেকে বেশ মহৎ লাগছে।

.

১২.

একটু আগে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গেছে। লেকের জলের ধারে ঘাসের ওপর বর্ষাতি পেতে চুপ করে বসে আছি। মেঘ ভেঙে অল্প রাঙা শেষবেলার রোদ উঠল ওই। ফ্যাকাসে গাছপালা যেন রূপকথার রাজ্যে জেগে উঠল হঠাৎ। জল উঠল ঝিলমিলিয়ে। জীবন এ রকম। কখনও মেঘ, কখনও রোদ।

ক্ষণা আসবে। আমার আর ক্ষণার মধ্যে এখন গোপনীয়তা তৈরি হয়েছে। যেন পাতালের নদী। বাড়ির বাইরে আমরা আজকাল লুকিয়ে দেখা করি।

ক্ষণার ভিতরে আজকাল আর-এক ক্ষণা জন্ম নিচ্ছে। সে অন্য এক রকম চোখে নিজেকেও দেখে আয়নায়। বেরোবার সময়ে ক্ষণা বলে দিয়েছিল, লেকে থেকো। আমি সিনেমার নাম করে বেরোব। পৌনে ছ’টায় দেখা হবে।

আমি জলে একটা ঢিল ছুড়ি। ঢেউ ভাঙে। কিছু ভাবি না। কিছু মনে পড়ে না। শুধু জানি, ক্ষণা আসবে। বর্ষাতির পকেটে লুকোনো টেপ-রেকর্ডার উন্মুখ হয়ে আছে।

ঘড়িতে পাঁচটা চল্লিশ। পিচের রাস্তাটা দ্রুত পায়ে পার হয়ে ক্ষণা ঘাসে পা দিয়েই হাসিমুখে ডাকল, এই।

পলকে মুখে হাসির মুখোশ পরে তাকিয়ে বলি, এসে গেছ?

 দেরি করেছি? বলো!

না। একটুও না। বলে বর্ষাতিটা বড় করে পাতি। টেপ-রেকর্ডার চালু হয়।

ক্ষণা কাছ ঘেঁষে বসল। গায়ে গা ছোঁয়-ছোঁয়। বলল, ঠিক বেরোবার আধ ঘণ্টা আগে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি দেখে আমার যা কান্না পাচ্ছিল না! কখন থেকে তুমি এসে বসে আছ। আর আমি যদি বেরোতে না পারি!

খুব না-ভেবেই বলি, ঝড় বৃষ্টিতে কি কিছু আটকাত ক্ষণা? তোমাকে আসতেই হত।

ক্ষণা পাশমুখে আমার দিকে তাকায়। বড় প্রকট হয়ে আছে ওর আজকের সাজ। চোখের পাতায় আউটার আই ক্রিম লাগানো, কাজল, ম্যাসকারা, মুখে মেক-আপ, কপালে মস্ত টিপ, কানে ঝুমকো, চুল ফাঁপিয়ে আঁচড়ান, রেশমি বুটির দামি শাড়ি পরেছে কচি কলাপাতা রঙের। ঠোঁটে রক্ত-গাঢ় রং। আধবোজা মদির এক রকম চোখের দৃষ্টি খানিকক্ষণ ঢলে রইল আমার দিকে।

তারপর বলল, তুমি কী করে বুঝলে?

তারপর একটা ছোট্ট শাস ফেলে বলল, ঠিক। আমাকে আসতেই হত। কেন আসতে হত বলো তো!

কেন ক্ষণা?

ক্ষণা অকপটে চেয়ে থেকে বলল, তোমাকে ভালবাসি বলে।

সত্যিই ভালবাসো ক্ষণা?

কী করে বোঝাব বলো? সারা দিন কেবল তোমার কথা মনে আসে। সারা দিন। ঘুমিয়েও তোমার কথা ভাবি। ঘুম থেকে যেই চোখ মেলি অমনি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে। বিশ্বাস করো।

আমার অবস্থা তোমার চেয়ে ভাল নয় ক্ষণা। আমার সমস্ত মাথা জুড়ে তুমি। শুধু তুমি।

শোনো।

উ!

ক্ষণা খুব কাছে ঘেঁষে আসে। ও বেহেড। সম্মোহিত। ওর চেতনা নেই যে, এখনও দিনের আলো ফটফট করছে। যে-কেউ, চেনা বা আধচেনা লোক আমাদের দেখে ফেলতে পারে। অবশ্য দেখে ফেললে ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশি। যত স্ক্যান্ডাল, তত পাবলিসিটি। যত পাবলিসিটি তত সুবিনয়ের সুবিধে। আমি এও জানি, আজ লেকে সুবিনয় সাক্ষী হিসেবে কয়েকজনকে হাজির রেখেছে। তারা কে আমি চিনি না। কিন্তু আছে আশেপাশে। দেখছে। আমাকে আজ খুব ভাল অভিনয় করতে হবে।

ক্ষণা আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, তুমি ছাড়া আর কেউ কখনও আমাকে এত সুন্দর দেখেনি। কখনও বলেনি, তুমি বড় সুন্দর।

তুমি সুন্দর ক্ষণা। বলে ক্ষণার কোমরের দিকে হাতটা আলতোভাবে জড়াই। বলি, সকলের কি সৌন্দর্য দেখবার চোখ থাকে?

ক্ষণা অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল একটু। তারপর বলল, তোমার বন্ধু কখনও আমাকে সুন্দর দেখে না। ও আমাকে দেখলই না ভাল করে, নিলও না। বিয়ের পর থেকেই দেখছি, ও বড় কাজের মানুষ। আমরা হানিমুনে যাইনি, এমনকী সিনেমা থিয়েটার বেড়ানো কিছু নয়। এই সেদিন প্রথম সিনেমায় নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজে এল না, তোমাকে পাঠাল। চিড়িয়াখানাতেও তাই। ও কেন এ রকম বলো তো!

গম্ভীর থেকে বলি, মহৎ মানুষরা ও রকমই হয় বোধহয়। আমি সে তুলনায় কত সামান্য।

ক্ষণা মাথা নেড়ে বলল, না। তুমি সামান্য নও। যদি তাই হতে তো তোমাকে এত ভালবাসলাম কী করে? তোমার ভিতর একটা কী যেন আছে, ঠিক বোঝা যায় না, কিন্তু সুন্দর কী যেন আছে। তুমি নিজে বোঝো না?

অবাক হয়ে বলি, না তো!

ক্ষণা মাথা নেড়ে বলল, আছে।

ফের একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, কিন্তু আমি অত কাজের মানুষ, মহৎ মানুষকে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম কেন বলো তো! শুনি, ওর নাকি পৃথিবীজোড়া নাম। শুনে ভয় পাই। আমার তো অত বড় মানুষের বউ হওয়ার যোগ্যতা ছিল না! আমি আরও অনেক বেশি সাধারণ কারও বউ হলে কত ভাল হত বলো তো!

কথায় কথায় বেলা যায়। অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে থাকে। আজ বৃষ্টি বাদলা গেছে। লেক তাই বেশ নির্জন। আর এই ঘনায়মান অন্ধকার ও নির্জনতায় আমি ঠিকই টের পাই, আমাদের চারধারে ছায়া ছায়া কিছু মানুষ ঘোরাফেরা করছে। নজর রাখছে আমাদের দিকে। কারও হাতে কি ফ্ল্যাশগান লাগানো ক্যামেরা আছে? কথা ছিল, থাকবে।

ঝিরঝির একটু বৃষ্টি হেঁটে গেল চারপাশে। গাছের পাতায় পাতায় সঞ্চিত জলের বড় বড় ফোঁটা নামল। গ্রাহ্য করলাম না। ঘাস ছেড়ে একটা ফাঁকা বেঞ্চে উঠে বসেছি দু’জনে, বর্ষাতিটা দু’জনের গায়ের ওপর বিছানো। বর্ষাতির নীচে আমাদের শরীর ভেপে উঠছে, ঘামছে।

ক্ষণা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওর তো দিল্লি থেকে ফেরার সময় হল।

আমিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, কী করবে ক্ষণা?

কী আর করব? যত যাই হোক, ওর ঘরই তো আমাকে করতে হবে!

 শিউরে উঠে বলি, তা কেন ক্ষণা? আমি তোমাকে নিয়ে যাব এখান থেকে।

ক্ষণা মাথা নেড়ে বলে, তা কি হয়?

কেন হবে না?

আমার ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে যে!

তাতে কী! নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করবে? সুবিনয়ও দেখো একদিন বিদেশে বড় চাকরি পেয়ে চলে যাবে। আর আসবে না, খোঁজও করবে না। সেদিনের জন্য তৈরি থাকা ভাল ক্ষণা।

ক্ষণা আমার হাত ধরেই ছিল। সেই ধরা হাতটা একটু শক্ত হয়ে উঠল শুধু। ও বলল, তুমি কিছু শুনছ নাকি?

শুনেছি।

ক্ষণা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আমারও কখনও কখনও ও রকম মনে হয়। মনে হয়, ও যেন বিদেশের মানুষ। মনে হয়, ও একদিন খুব দূরে সরে যাবে।

সময় থাকতে তুমি কেন সাবধান হচ্ছ না ক্ষণা? আমি— আমি তোমাকে ভালবাসি।

বলতে বলতেও আমার উৎকর্ণে কোনও একটা অস্পষ্ট কাশির শব্দ পৌঁছয়। সংকেত। আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমার অভ্যন্তরে ক্ষণার জন্য একটুকু ভালবাসা নেই। তৈরি হয়নি। তবু কাজটা আমাকে করতেই হবে।

বুকের কাছে ঘনিষ্ঠ ক্ষণা। আমি ভাল এক্সপোজারের জন্য বর্ষাতিটা গা থেকে ফেলে দিই। তারপর গাছের ছায়ায় গভীর অন্ধকার নির্জনে ওকে জড়িয়ে ধরি। বাধা দেওয়ার কথা নয়। দিলও না ক্ষণা। আমার বিবেক এই অবস্থায় সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু আড়াল থেকে তার ঘন ঘন কাশির আওয়াজ শুনতে পাই। আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য সে কয়েক বার তার বাদ্যযন্ত্রটা বাজাল। আমি পাত্তা দিলাম না। আমি ক্ষণাকে যথেষ্ট, যত দূর সম্ভব আবেগে চুমু খাই। কষ্টকর, ভয়ের চুমু। আমি তো জানি আমরা একা নই। জানি, ক্ষণার স্বামীও দৃশ্যটা দেখছে। বড় বিস্বাদ চুমু। তবু ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে অপেক্ষা করছি ফ্ল্যাশগানের ঝলকটার জন্য। অপেক্ষা করছি। অনন্ত সময় বয়ে যাচ্ছে।

চমকাল। ফ্ল্যাশের আলো নীল বিদ্যুতের মতো ঝলসে দিয়ে গেল আমাদের। পর পর দুবার।

 ক্ষণা চমকে চোখ চেয়ে বলে, কী গো?

 বিদ্যুৎ।

ও।

 আবার সংলগ্ন হই। দক্ষ লোকদের হাতে ক্যামেরা আরও একটু পর পর চমকে চমকে উঠল।

তটস্থ ক্ষণা সোজা হয়ে বসে বলে, কে টর্চ ফেলছে?

টর্চ নয় ক্ষণা। আকাশে মেঘ চমকাল।

ক্ষণা আমার দিকে চেয়ে অন্ধকারে একটু চুপ করে বসে থাকে। হঠাৎ বলে, শোনো, মনে হচ্ছে কারা যেন লুকিয়ে থেকে দেখছে আমাদের।

আমার টেপরেকর্ডারের ক্যাসেট শেষ হয়ে আসছে। আমি হঠাৎ ওকে কাছে টেনে বলি, কেউ নয়। লেক হচ্ছে মুক্ত অঞ্চল, সবাই প্রেম করতে আসে। কে কাকে দেখবে? শোনো ক্ষণা, তুমি সুবিনয়কে ডিভোর্স করবে?

ক্ষণা নিজের চুল ঠিক করছিল। একটু চনমনে হয়ে চার দিকে তাকাচ্ছে। বিপদ। আমি ওকে টেনে নিই কাছে। ও বাধা দেয় না। বরং চোখ বুজে থাকে। অস্ফুট গলায় বলে, আমাকে বহুকাল কেউ আদর করে না উপল। একটু আদরের জন্য আমার ভিতরটা মরুভূমি হয়ে থাকে।

আমার রেকর্ডারের ফিতে ফুরিয়ে আসছে। সময় নেই।

বলি, বলো ক্ষণা, সুবিনয়কে ডিভোর্স করবে?

 তেমনি অস্ফুট গলায় ও বলে, তুমি কি আমাকে একেবারে চাও?

চাই।

 ভালবাসবে আমাকে চিরকাল?

 বাসব ক্ষণা। বললা, ডিভোর্স করবে?

ও যদি বাধা দেয়! যদি মারে তোমাকে?

মারবে না ক্ষণা। ও আমাকে ভয় পায়। বাধা ও দেবে না।

ঠিক জানো?

হ্যাঁ।

আমার ছেলেমেয়ে কার কাছে থাকবে?

আমাদের কাছে।

তা হলে করব ডিভোর্স।

কথা দিলে?

দিলাম।

আদরের ছলে আমি ওকে ফের চুমু খেতে খেতে শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসি। অন্য হাতে ওর চোখ চেপে রেখে বলি, দেখো না। আমাকে দেখো না।

সামনে থেকে, পিছন থেকে, পাশ থেকে আরও তিন বার ক্যামেরার আলো ঝলসায়। অন্ধকারে ছায়া-ছায়া মূর্তি ঝোপের আড়ালে সরে যায়। আবার অন্য দুটো ছায়া দৌড়ে এক ধার থেকে অন্য ধারে সরে গেল। ফ্ল্যাশ চমকাল ফের। ক্ষণার শরীরের ঠিক কোথায় আমার হাত রয়েছে তার নির্ভুল ছবি তুলে নিল।

ক্ষণা বলল, চোখ ছাড়ো। কী করছ?

 আমার সর্বাঙ্গে ঘাম। বুকের ভিতরে অসম্ভব দাপাদাপি। হাত-পা অবসাদে খিল ধরে আসে। বর্ষাতির পকেটে টেপ-রেকর্ডার থেমে গেছে। ক্যাসেট শেষ।

আমি দাঁড়িয়ে বললাম, চলো ক্ষণা।

 বোসো আর-একটু। আমার তো সিনেমার শো ভাঙার পরে ফিরলেও চলবে। কী সুন্দর দিন ছিল আজ, ফুরিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে না।

লজ্জা, ভয়, ক্লান্তি ও অনিচ্ছায় আমার মাথাটা বেভুল লাগে। আর বসে থাকার মানে হয় না। ক্লান্তির বোঝা বাড়বে কেবল।

তবু অনিচ্ছায় বসে থাকতে হয়।

ক্ষণা বলল, তুমি আমাকে খুব ভালবাসো। আমাকে, দোলনাকে, ঘুপটুকে। ওরা তো অবোধ।

আমার ভিতরকার অনিচ্ছার ভাবটা ঠেলে আসে গলায়। বমির মতো। আমি যতটুকু করার করেছি। টেপ শেষ হয়ে গেছে। ক্যামেরা নিয়ে সরে গেছে লোকজন। এখন আর প্রেমের কথা আসে না। ফাঁকা লাগে, নিরর্থক লাগে।

.

রাত্রে সুবিনয় টেপ শুনছিল। তেমনি আধখানা ছায়া, আধখানা আলোয় পাথুরে মুখ দেখা যাচ্ছে। তবে ওর মুখে আজকাল অনেকগুলি নতুন গভীর রেখা পড়েছে। টেপ শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ঘাড় এলিয়ে দিচ্ছে। আবার সোজা হয়ে বসছে কখনও। অস্থির। সিগারেট খানিক খেয়েই প্রায় আস্ত গুজে দিচ্ছে আশট্রেতে।

আস্তে আস্তে ঘুরে টেপ শেষ হয়। সুবিনয় নিঃশব্দে উঠে ওয়াল ক্যাবিনেট খুলে নীট হুইস্কি ঢক ঢক করে জলের মতো তিন-চার ঢোক খেয়ে একটা হেঁচকি তুলল।

খুব আস্তে মড়ার মতো একখানা মুখ ফেরাল আমার দিকে। দু’চোখে একটা অনিশ্চয়তার ভাব। যেন বা ভয়।

খুব আস্তে করে বলল, ইউ নো সামথিং বাডি? ইউ আর এ বর্ন লেডি-কিলার। এ ডেমন! এ ড্রাগন!

চুপ করে থাকি। সুবিনয়ের দিক থেকে একটা মস্ত মোটা আর ভারী নোটের বান্ডিল উড়ে এসে কোলে পড়ল।

ফাইভ থাউজ্যান্ড। ইউ হ্যাভ আর্নড ইট।

এ কথা যখন বলছিল সুবিনয় তখন ওর গলায় কোনও আত্মবিশ্বাস ছিল না। ভয় পাওয়া মানুষের মতো গলা।

মাথা নিচু করে টাকাটার দিকে চেয়ে থাকি। অনেক টাকা। দারিদ্র্যের মুক্তিপণ।

সুবিনয় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে ছিল। আমার দিকে চাইছে না। সেইভাবেই থেকে বলল, আই ডোন্ট বিলিভ ইট। ইয়েট দি ইম্পসিবল হ্যাজ হ্যাপেনড বাডি।

আমি টাকা থেকে মুখ তুললাম।

সুবিনয় এসে সোফায় তার প্রিয় চিতপাত ভঙ্গিতে বসল। নিজের সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে আচ্ছন্ন করে ফেলে বলল, আমার ধারণা ছিল, ক্ষণা আমার সঙ্গে পুলটিশের মতো সেঁটে গেছে। কখনও ওকে সরানো যাবে না। অ্যাডামেন্ট ওয়াইফ।

হুইস্কির আধ গেলাস টেনে নিয়ে তীব্র অ্যালকোহলের যন্ত্রণায় গলা চেপে বুম হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর আলোছায়াময় মুখ তুলে অদ্ভুত হেসে বলল, ইউ হ্যাভ ডান ইট বাডি। কংগ্রাচুলেশনস।

আমি উঠতে যাচ্ছিলাম। যখন দরজার কাছ বরাবর পৌঁছে গেছি তখন ও ডেকে বলল, ইউ নো সামথিং বাডি, ইউ আর ইন লাভ উইথ হার। গোয়িং টু ম্যারি হার বাডি, হোয়েন আ’ল বি অ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার?

আমি চুপ করে রইলাম। তারপর মাথা নাড়ালাম। না।

 লাভ হার বাডি। প্লিজ।

আমি ওর দিকে তাকালাম। স্পষ্ট টের পাই, আমার চোখ বাঘের মতো জ্বলছে। সমস্ত গায়ে শিরশির করে উঠছে রাগ। কিন্তু মাতাল সুবিনয় আমাকে লক্ষই করল না। বলল, আই অ্যাম গোয়িং হোম টুনাইট। ওয়েট বাডি, আই ক্যান টেক ইউ হোম।

.

রাতে আমি ফের বারান্দায় শুয়েছি। প্যাকিং বাক্সগুলি একটু নড়বড় করে বিছানাটা বড্ড শক্ত আর স্যাঁতস্যাঁতে ঠেকে। এ সবই ক’দিন সুবিনয়ের পুরু গভীর বিছানায় শোওয়ার অভ্যাসের ফল। শুয়ে জেগে থাকি। সুবিনয়ের ঘর থেকে কোনও শব্দ আসে না। ওরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

কাত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখি। ক্ষয়া একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। বড় ভাল লাগে। চেয়ে থাকি। ভিতরটা বিস্বাদে ভরে আছে। চাঁদ বড় ভাল লাগে। চাঁদ কোনও কাজে লাগে না, ব্যবহার হয় না। শুধু অকারণে আকাশে ঝুলে থাকে। চাঁদ তাই বড় ভাল।

বুড়ো বিবেক আমার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, পাপ হল লঙ্কার মতো। যেমন ঝাল তেমনি স্বাদ। না উপল?

হ্যাঁ বিবেকবাবা।

কাঁদছ নাকি?

না বিবেকবাবা। চেষ্টা করে দেখেছি, আজকাল কান্না আসে না।

বিবেক শ্বাস ফেলে বলে, কাঁদলে ভাল লাগত।

জানি। কিন্তু সব সময়ে কি আসে?

 বিবেক শ্বাস ফেলে বলে, পেটে অম্বল জমলে যেমন বমি করলে আরাম হয়, কান্নাও তেমনি। তোমার কোনও দুঃখের কথা মনে পড়ে না? কিছু একটা মনে করে দেখো। কান্না এসে যাবেখন।

আসে না। আমি মাথা নেড়ে বলি, অনেক দিন বাদে এই প্রথম একটা কাজ আমি শেষ করেছি বিবেকবাবা। মেলা ঝামেলা কোরো না। তুমি যাও।

বিবেক চলে যায়।

সে যেতে না যেতেই ছুঁচোর চিড়িক ডাক আসে অন্ধকার বারান্দার কোথা থেকে যেন। চমকে উঠে বসি। বহুকাল কি ছুঁচোটা আসেনি? না কি আমিই লক্ষ করিনি ওকে, নিজের অন্যমনস্কতায় ড়ুবেছিলাম বলে ওর ডাক কানে আসেনি?

চকিতে মনে পড়ল, বিষ আনতে বার বার ভুল হয় বলে ক্ষণা আজ নিজেই কিনে এনেছে। শোওয়ার আগে আটার গুলিতে বিষ মাখিয়ে বারান্দায় আর বাথরুমে ছড়াচ্ছিল। আর তখন একবার আমার খুব কাছে এসে চাপা স্বরে বলেছিল, ও এসেছে। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে কী করে যে আর একটা রাতও থাকব! পারছি না, একদম পারছি না। তুমি আমার কী করলে বলো তো! আমি কি নষ্ট হয়ে গেলাম? এ কি ভাল হল?

আমি উঠে বাতি জ্বালি। মুখ ধোওয়ার বেসিনের নীচে এঁটো বাসনের ওপর ছুঁচোটা তুরতুর করছে। আমাকে দেখে মুখ তুলল। দুটো চোখ আলোয় আলোময়। ওর অল্প দূরেই সেই বিষ মাখানো আটার গুলি। আমি নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিই।

লোভে আমার পায়ের কাছে ছুটে আসে ছুঁচোটা। করুণ মুখ তুলে যেন বলে, দাও। বড় খিদে।

আমি তাকে পাত্তা দিই না। তড়িৎগতিতে আমি বারান্দা আর বাথরুম থেকে আটার গুলি তুলে নিতে থাকি। ছুঁচোটা আমাকে আর ভয় পায় না। পায়ে পায়ে ঘোরে আর ডাকে। চিড়িক স্বরে যেন বলে, দাও। আমার বড় খিদে। আমাদের দর্শন-বিজ্ঞান নেই, সুখ-দুঃখ নেই, প্রেম-ভালবাসা নেই। আছে শুধু খিদে দাও।

আমি হাঁটু গেড়ে তার মুখোমুখি বসে বলি, আমিও কি নই তোমাদের মতো? সব কিছু খেতে নেই। আমারও চারধারে কত বিষ মাখানো খাবার ছড়িয়ে রেখেছে কে যেন। মাঝে মাঝে খেয়ে ফেলি। বড় জ্বালা।

.

১৩.

সুবিনয় অফিসে গেল। ক্ষণা গেল মার্কেটিং-এ। সুবিনয়ের মা কুসুমকে নিয়ে কালীঘাটে।

আমি বাথরুমে বসে নিবিষ্ট মনে গেঞ্জি কাচছিলাম। আজকাল ক্ষণা কাচাকাচি করতে দেখলে রাগ করে বলে, তুমি কাচবে কেন? কুসুম দেবে’খন। না হয় তো আমি দেব। পুরুষ মানুষের কাজ নাকি এ সব!

গেঞ্জি কাচা আমার খুব পছন্দের কাজ নয়। কিন্তু ভাবি, সারা জীবন আমাকেই তো কাচতে হবে। আমার তো কোনও দিন বউ হবে না। মধু গুপ্ত লেনের রুস্তমদের টাকা আমি মিটিয়ে দেব। কেতকীর বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। সেই ইঞ্জিনিয়ার। তাই ভাবি, এত কাল পর কেন এই আদরটুকু নিই? আমার এমনিই যাবে।

বাথরুমের দরজায় কে এসে দাঁড়াল। প্রথমে তাকাইনি। কিন্তু নিথর এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে টের পেয়ে চোখ তুলেই চমকে উঠি।

প্রীতি — আমার গলার স্বর কেঁপে যায়।

সাদা খোলের চওড়া জরিপেড়ে একটা ভীষণ দামি শাড়ি পরনে। ওর মুখও সাদা। ঠোঁট ফ্যাকাসে। খুব বিষন্ন দেখাচ্ছিল।

ও চৌকাঠের কাছে এগিয়ে এসে বলল, আমি আপনার কাছেই এসেছি।

আমার কাছে?

উপলবাবু, ক্ষণাদিকে নষ্ট করলেন?

আমি মাথা নিচু করে বলি, না তো। আমি ওকে ভালবাসি।

প্রীতি জলময় নোংরা চৌকাঠের ওপর সাদা শাড়ির কথা ভুলে গিয়ে বসে পড়ল ঝুপ করে। ঠিক আমার চোখে চোখ রেখে চেয়ে রইল।

কী হল?–আমি অবাক হয়ে বলি।

আমি সব জানি উপলবাবু।

আমি মাথা নিচু করে বললাম, মাইরি।

বেচারা! প্রীতি হেসে বলে, না, ক্ষণাদিকে নয়, আপনি বড় বেশি টাকা ভালবাসেন।

আমি মাথা নেড়ে বলি, না। আমি টাকা ভালবাসি না। আমি শুধু চেয়েছিলাম টাকা সহজলভ্য হোক! বৃষ্টির মতো, জলপ্রপাতের মতো টাকা ঝরে পড়ুক। হ্যান্ডবিলের মতো টাকা বিলি হোক রাস্তায় রাস্তায়।

তাই টাকার জন্য আমার দিদিকে নষ্ট করলেন?

নষ্ট?

বলে আমি অবাক হয়ে তাকাই। তারপর প্রীতির কাছে হামাগুড়ি দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বলি, দেখুন। আমার মুখের মধ্যে দেখুন।

এই বলে হাঁ করে থাকি।

 প্রীতি আমাকে পাগল ভেবে উঠে দাঁড়ায়। বলে, কী দেখব?

দেখলেন না আমার মুখের মধ্যে?

কী?

বিশ্বরূপ। শ্রীকৃষ্ণ দেখিয়েছিলেন অর্জুনকে। আপনিও ভাল করে দেখলে দেখতে পেতেন, আমি কাউকে নষ্ট করিনি। যে যার কর্মফলে নষ্ট হয়ে আছে। আমি নিমিত্ত মাত্র।

লোকে যেমন রাস্তার পাশে পচা ইঁদুর দেখে তেমনি একরকম ঘেন্নার চোখে আমাকে দেখছিল প্রীতি। অনেকক্ষণ দেখে বলল, আপনি অন্য কোথাও যেতে চান না উপলবাবু?

গেঞ্জিটা ধুয়ে নিংড়ে আমি উঠে আসি। হেসে বলি, যাব। আমাকে তো যেতেই হবে। প্রীতি, জীবনে এই প্রথম একটা কাজ আমি সম্পূর্ণ করেছি। এই আনন্দটা আমাকে কিছুক্ষণ উপভোগ করতে দিন।

কী কাজ?

ক্ষণাকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছি। এবার আপনারা আমেরিকা চলে যেতে পারবেন।

বেচারা!– প্রীতির দীর্ঘশ্বাস ফাঁকা বাড়িতে বড় করে শোনাল। বলল, আপনি কি ভাবেন, যে লোকটা তার বউকে স্ক্যান্ডালে জড়ানোর জন্য এত কাণ্ড করছে তাকে আমি বিশ্বাস করব? ক্ষণাদিকে আমরা ছেলেবেলা থেকে জানি। চিরকাল ওর ঘর-সংসারের দিকে ঝোঁক। এমন গুছিয়ে পুতুল খেলত যে সবাই বলত, ও খুব সংসার-গোছানি মেয়ে হবে। তাই হয়েছিল ক্ষণাদি। স্বামী, শাশুড়ি, বাচ্চা সংসার নিয়ে কেমন জড়িয়ে গিয়েছিল। অমন ভাল বউকে কেউ এত নীচে টেনে নামায়?

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই।

প্রীতি আমার একটা হাতে হাত রেখে বলল, কেন করলেন এমন? কী দিয়ে ভোলালেন ক্ষণাদিকে?

উদাস স্বরে বলি, আমি নিমিত্ত মাত্র। যা হওয়ার তা হয়েই ছিল।

প্রীতি আরও এক পা কাছে সরে এসে বলল, কিছু হয়নি উপলবাবু। জামাইবাবুকে আমি নিইনি মনের মধ্যে। কখনও হয়তো কোনও দুর্বলতা এসেছিল, এখন নেই। আপনি দিদিকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

কোথায় প্রীতি?

আপনাকে আমার ভীষণ দরকার।

 কেন প্রীতি?

বলব। আপনি আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন।

 গোছানোর মতো কিছু নেই।

তা হলে চলুন।

আমি পোশাক পরে নিই। টাকার মস্ত বান্ডিলটা পকেটে পুরি।

প্রীতি আড়চোখে দেখে বলল, কত টাকা!

 অনেক।

 প্রীতি চেয়ে রইল আমার দিকে। করুণাঘন চোখ।

ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিল প্রীতি। উঠতে গিয়েই চমকে উঠে দেখি, রুমা বসে আছে। পিছনের সিটে হেলে বসে নিজের বাঁ হাতের নখগুলো দেখছিল। আমার দিকে খরচোখে একবার তাকাল। প্রীতিকে বলল, ওঁকে সব বলেছ প্রীতি?

না। তুমি বলো।

বলছি।

বলে রুমা সিটের মাঝখানে সরে এসে বসল। এক ধারে প্রীতি, অন্য ধারে আমি।

ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। পাঞ্জাবি ট্যাক্সিওয়ালা ধীরগতিতে গাড়ি চালায়। হয়তো তাকে ও রকমই নির্দেশ দেওয়া আছে।

রুমা পাশে বসতেই আমার শরীরে একটা কাঠের মতো শক্ত ভাব দেখা দিল। বুকে ভয়। নার্ভাস লাগছে।

রুমা আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, শুনুন রোমিও, প্রীতি অবশেষে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।

আমি অনেকখানি বাতাস গিলে ফেলি।

 আমাকে?

 আপনাকে। কেন, আপনি রাজি নন?

উদভ্রান্তের মতো বলি, কী বলছেন? আমি কি ঠিক শুনছি?

 ঠিকই শুনছেন। প্রীতি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে। আজই এক্ষুনি। অনেক স্যুটারের ভিতর থেকে প্রীতি আপনাকেই বেছে নিয়েছে। আপনি ভাগ্যবান।

মাথাটা ঘুলিয়ে ওঠে। কিছু বুঝতে পারি না। পাঞ্জাবি ট্যাক্সি ড্রাইভারের সবুজ পাগড়ির দিকে চেয়ে থাকি। আমার শরীরের কোথায় যেন একটা বৈদ্যুতিক তার ছুঁয়ে আছে। মৃদু শিহরনে শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। নতুন এক চোখে প্রীতির দিকে পাশ ফিরে চাইলাম।

প্রীতি আমার দিকে চেয়ে ছিল, চোখ চোখ পড়তেই মুখখানা ঘুরিয়ে নিল বাইরের দিকে।

গোলপার্কে ওদের ফ্ল্যাটে এসে রুমা বলল, আমি পাশের ঘরে আছি প্রীতি। তোমরা কথা বলে নাও।

রুমা তার ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকানি দিয়ে দিল। তারপর ও ঘর থেকে সেই ট্যাংগো নাচের বাজনা আসতে লাগল।

তার সেই ঘোরানো চেয়ারে প্রীতি মাথা নত করে বসে আছে। কার্ল করা খাটো চুলের রাশি থোপা থোপা কালো আঙুরের মতো ঘিরে আছে মুখখানা।

গদি-আঁটা টুলের ওপর হতভম্ব মাথা নিয়ে বসে আছি। কথা আসছে না।

অনেকক্ষণ বাদে প্রতি তার সুন্দর কিন্তু ফ্যাকাসে মুখখানা তুলে আমার দিকে ফেরাল। নরম আদরের গলায় ডাকল, উপল!

উ।

আমাকে বিয়ে করবে না উপল?

মাথা নেড়ে বললাম, আমি কি স্বপ্ন দেখছি প্রীতি?

না।–প্রীতি মাথা নেড়ে বলল, শোনো উপল, তোমাকে ছাড়া আমার উপায় নেই।

 চোখের জল মুছে নিয়ে বললাম, আমাকে কেউ ভালবাসে না প্রীতি।

প্রীতি আবার কালো আঙুরের থোপায় মুখ ঢেকে মাথা নত করে মৃদু স্বরে বলল, আমি বাসি।

কবে থেকে প্রীতি?

যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম। জামাইবাবুর পাগলামির চিঠি নিয়ে এসেছিলে। আমি তোমার ওপর বিরক্ত হয়েছিলাম উপল। কিন্তু তখন থেকেই তোমাকে ভুলতে পারি না। কেন ভুলতে পারি না তা অনেক বার ভেবে দেখেছি, বিরক্ত হয়েছি নিজের ওপর। পরে বুঝতে পেরেছি, তোমাকে আমি কবে থেকে যেন ভালবেসে ফেলেছি! বুঝে নিজের ওপর রেগে গেছি। কিন্তু ভালবাসার ওপর কি কারও হাত থাকে, বলো!

প্রীতি, আমি সামান্য মানুষ।

কে বলল উপল? তুমি সামান্য নও। তোমার ভিতরে কী আছে তা তুমি কোনও দিন বুঝতে পারোনি।

কী আছে প্রীতি?

 নতমুখী প্রীতি বলে, তুমি বড় ভাল লোক। তুমি খুব ভাল।

আমি মাথা নেড়ে বলি, না প্রীতি। আমি ভাল নই। আমার যখন খিদে পায় তখন আমার মাথার ঠিক থাকে না। তখন মানুষ আমাকে যা করতে বলে তাই করি। বরাবর মানুষ আমাকে নিমিত্তের ভাগী করেছে প্রীতি। কিন্তু যদি খিদে না পেত–

সজল, বিশাল দুখানা চোখে প্রীতি আমার দিকে তাকায়। তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। কথা ফোটে না প্রথমে। তারপর খুব অন্য রকম এক গলায় আস্তে করে বলে, আমি তোমাকে খাওয়াব উপল। আমি তোমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাব। দুজনে মিলে খাটব, খাব। খিদের কথা বোলো না। আমার বড় কষ্ট হয়।

অবাক হয়ে বলি, আমেরিকায় নিয়ে যাবে?

ও মাথা নেড়ে বলল, নিয়ে যাব। আমি সামনের রবিবারে চলে যাচ্ছি। গিয়েই তোমার যাওয়ার সব ব্যবস্থা করব। ভেবো না, সে দেশে কখনও খাবারের অভাব হয় না।

নিয়ে যাবে! আমার রক্তে রক্তে ট্যাংগো নাচের বাজনা ঢুকে যায়। আমার ভিতরে যেন এক নাচঘর তৈরি হয়ে গেল। সেই ঘরে জোড়া জোড়া পা ফেলে সাহেব-মেম নেচে বেড়াচ্ছে।

প্রীতি!

 প্রীতি উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শুনবার চেষ্টা করছিল। জবাব দিল, উ!

কবে আমাদের বিয়ে হবে?

আজ। বেলা তিনটের সময় ম্যারেজ রেজিস্ট্রার আসবেন, সাক্ষীরা আসবেন।

আমি হাসলাম। বহুকাল এমন গাড়লের মতো হাসিনি।

 প্রীতি, শোনো। বিয়ের পর আমরা জোড়ে মাসির কাছে যাব।

 প্রীতি অবাক হয়ে বলে, মাসি কে?

আমার এক মাসি আছে। মাসি ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ নেই। বড় খুশি হবে মাসি। কত আদর করবে তোমাকে, দেখো। যাবে তো!

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাব উপল।

তুমি মাসিকে প্রণাম করবে তো প্রীতি?

করব, নিশ্চয়ই করব।

কটা বাজে প্রীতি?

প্রীতি মৃদু হেসে বলে, তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিট। তুমি ঘাবড়ে যাওনি তো উপল?

অবাক হয়ে বলি, না তো! ঘাবড়াব কেন? আমার অসম্ভব, অসহ্য এক আনন্দ হচ্ছে। প্রীতি, তুমি বিয়ের পর সিঁদুর পরবে তো?

প্রীতি করুণ মুখখানা তুলে বলে, পরতে তো হবেই।

 শাঁখা?

তাও।-বলে প্রীতি হাসল। বড় সুন্দর হাসি।

তুমি কি রাঁধতে পারো প্রীতিসোনা?

প্রীতি ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ। আমি অনেক রকম রান্না জানি। দেশি, বিলিতি। আমেরিকায় তো আমাকেই রাঁধতে হবে তোমার জন্য।

কেন প্রীতি? আমরা রান্নার লোক রাখব।

ওদের দেশে ভীষণ টাকা লাগে লোক রাখতে।

লাগুক। তোমাকে আমি তা বলে রাঁধতে দেব না।

 আচ্ছা। বলে প্রীতি চোখে চোখে একটু হাসে।

 সিঁড়ি দিয়ে পায়ের শব্দ উঠে আসছে। উত্তেজনায় কেঁপে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।

প্রীতিও উঠে দাঁড়ায়। ম্লান মুখ করে বলে, ওরা আসছে।

আমি আজ দাড়ি কামাইনি প্রীতি।–গালে হাত বুলিয়ে বলি।

তাতে কিছু হবে না উপল। সারা জীবন তো কামাবেই।

সাজিনি।

তোমাকে অনেক পোশাক করে দেব।

তিনজন লোক ঘরে এসে দাঁড়ায়। একজনের হাতে খাতাপত্র। প্রথমে উত্তেজনার বশে আমি তাদের মুখ ভাল করে দেখতে পাই না। তারপর হঠাৎ খেয়াল হয়, তিনজনের মধ্যে একজন প্রীতির সেই প্রেমিক।

প্রীতি আমার কাছে ঘেঁষে এসেছিল। ওর একটা হাত কখন আমার হাতের মুঠোয় এসে গেছে। আমি ফিস ফিস করে বলি, ও কে প্রীতি? ও কেন এখানে?

প্রীতি মৃদু স্বরে বলে, ও আমার কেউ না উপল। ও শুধু সাক্ষী দিতে এসেছে।

পাশের ঘরে ট্যাংগো থামল, দরজা খুলে বেরিয়ে এল রুমা। খাতা হাতে লোকটা চেয়ার টেবিলে গিয়ে বসল। প্রীতির প্রাক্তন প্রেমিক আর একজন অচেনা লোক গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকল।

থমথম করছে ঘর। কেউ কোনও আনন্দ করছে না। এই শোকের ছায়ার মধ্যে কী করে বিয়ে হবে?

প্রীতি আমার হাত চেপে ধরে বলল, এসো উপল।

আমি বললাম, কেউ উলু দিল না প্রীতি, শাঁখ বাজল না।

প্রীতি আমাকে টেবিলের সামনে নিয়ে গেল। ম্যারেজ রেজিস্টার আঙুল দিয়ে ফর্মে একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এইখানে সই করুন।

একদম সময় লাগল না। আমি আর প্রীতি সই করার পর রুমা, প্রীতির ভূতপূর্ব প্রেমিক আর অচেনা লোকটা সই করল। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার তার খাতাপত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠল। চলে গেল।

প্রীতি তার ঘোরানো চেয়ারে বসে আছে। নতমুখ। কালো আঙুরের থোপায় ঘিরে আছে মুখখানা। হঠাৎ ও একটু কেঁপে উঠল। চাপা কান্নার একটা অস্ফুট শব্দ কানে এল। ঘরের মাঝখান থেকে আমি ছুটে ওর কাছে যাওয়ার জন্য এগোতেই মাঝখানে রুমা এসে দাঁড়াল।

উপলবাবু! ওকে এখন আর ডিস্টার্ব করবেন না।

 ডিস্টার্ব!–আমি ভীষণ অবাক হয়ে বলি, ডিস্টার্ব মানে? ও আমার বউ। আমার বউ কাঁদছে কেন সেটা আমার জানা দরকার।

রুমার দু’পাশে প্রীতির প্রাক্তন প্রেমিক আর অচেনা লোকটাও এসে দাঁড়াল। করুণ চোখে আমার দিকে চেয়ে প্রেমিকটি বলল, সে তো ঠিকই উপলবাবু। ও তো চিরকালের মতোই আপনার হয়ে গেল। এখন ওকে একটু রেস্ট নিতে দিন।

তীব্র আকুলতায় আমি বললাম, আমাকে ওর কাছে যেতে দিন। আমার বউ কাঁদছে।

রুমা অত্যন্ত উদাস গলায় বলল, উপলবাবু, এখনও ও কেবলমাত্র কাগজের বউ। সেটাই আপনার পক্ষে যথেষ্ট হওয়া উচিত।

ভীষণ অবাক হয়ে বলি, কাগজের বউ! তার মানে?

 কাগজে সই করা বউ। রুমা নিষ্ঠুর গলায় বলে, তার বেশি নয়।

আমি গাড়লের মতো তাকিয়ে থাকি। তিনজন মানুষ আমার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওপাশে প্রীতি তার টেবিলে মাথা রেখে কাঁদে অঝোরে।

প্রীতি!– আমি প্রাণপণে ডাকি।

প্রীতি উত্তর দেয় না। কাঁদতে থাকে।

প্রেমিক আমার হাত ধরে বলে, ইমোশনাল হবেন না উপলবাবু। এখন আপনার অনেক দায়িত্ব।

আমি মাথা নেড়ে বলি, ঠিকই তো। আমি বিয়ে করেছি, দায়িত্ব হওয়ারই কথা।

প্রাক্তন প্রেমিক মাথা নেড়ে বলে, সেইজন্যই তো বলছি। দেয়ার আর মাচ টু বি ডান। এখন আপনার প্রথম কাজ সুবিনয়বাবুকে খবরটা পৌছে দেওয়া। ওকে জানিয়ে দেবেন, প্রীতির সঙ্গে আপনার বিয়ে হয়ে গেছে। এ কাজটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট উপলবাবু।

আমি বুঝতে পারি না। সব ধোঁয়াটে লাগে। তবু মাথা ঝাঁকাই। চিরকাল লোকে আমাকে এটা-সেটা ভালমন্দ কাজ করতে বলেছে। আমি করে গেছি।

প্রাক্তন প্রেমিক বলল, কেন ইম্পর্ট্যান্ট জানেন? সুবিনয়বাবুর পাগলামি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠে গেছে। উনি সব সময়ে প্রীতিকে গার্ড দিচ্ছেন। অথচ পরশুদিন প্রীতিকে ফ্লাই করতেই হবে।

পরশুদিন!–আমি চমকে উঠে বলি।

পরশুদিন রবিবার। প্রীতির প্যাসেজ বুকড হয়ে আছে।

আমি অবাক হয়ে বলি, আজ কী বার?

শুক্রবার – উপলবাবু, শুনুন, সুবিনয়বাবুকে বলবেন, প্রীতির সঙ্গে কোনও রকম ঝামেলা করলে আমরা পুলিশের প্রোটেকশন নেব। প্রীতি এখন একজনের লিগাল ওয়াইফ।

একজনের নয়। আমি মাথা নাড়ি। একজন কথাটা আমার পছন্দ হয় না। আমি দৃঢ় কণ্ঠে বলি, প্রীতি আমার বউ।

পেপার ওয়াইফ।–রুমা তীব্র গলায় বলল।

না না।–প্রেমিক বলে ওঠে, উপলবাবু ঠিকই বলছেন। প্রীতি এখন উপলবাবুরই স্ত্রী।

 প্রীতি টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছে। অঝোর কান্না। আমার বুকের মধ্যে ঢেউ দুলে ওঠে। আমার সামনে তিনজন মানুষ দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে।

আমি বলি, একবার আপনারা আমাকে ওর কাছে যেতে দিন। ও আমার বউ। আমার বউ কাঁদছে।

প্রাক্তন প্রেমিক বলে, ওকে কাঁদতে দিন। ও আনন্দে কাঁদছে। এবার কাজের কথা শুনুন উপলবাবু, সুবিনয়কে আপনি এই ম্যারেজ সার্টিফিকেটখানা দেখাবেন। ফেস হিম লাইক এ হিরো। মনে রাখবেন, আপনি আপনার স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য লড়ছেন।

আমি বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলি, বুঝেছি। সুবিনয় কিছু করবে না। ও আমাকে ভয় পায়।

বলে আমি হাসতে থাকি।

প্রাক্তন প্রেমিক বলে, সেটা আমরা জানি উপলবাবু। সুবিনয় আপনাকে ভয় পায়। কারণ, আপনি ওর অনেক গোপন কথা জানেন। আর ঠিক সেই কারণেই আপনাকে এ কাজের জন্য চুজ করা হয়েছে।

চুজ করা হয়েছে। আমি বাতাস গিলে বলি, তার মানে?

স্লিপ অফ টাং মাই ডিয়ার। প্রাক্তন প্রেমিক একটু হেসে বলল, ডোন্ট মাইন্ড। কাজের কথাটা শুনে নিন। আপনি সুবিনয়কে আরও বলবেন যে, প্রীতি পরশু দিন আমেরিকা যাচ্ছে না। তার বদলে আপনি কাল প্রীতিকে নিয়ে হানিমুনে যাচ্ছেন। কুলু ভ্যালিতে।

কুলু ভ্যালি?

কুলু ভ্যালি। সুবিনয়কে মিসলিড করবেন। ও আপনাকে ফলো করার চেষ্টা করবে। যদি করে তো আপনি কলকাতা থেকে দূরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। প্রীতির রওনা হওয়ার আগে পর্যন্ত সুবিনয়ের কলকাতায় থাকাটা নিরাপদ নয়। হি ইজ ডেঞ্জারাস।

আমি মাথা নাড়লাম। প্রাক্তন প্রেমিক এক বান্ডিল নোট বের করে আমার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল, ফর দি এক্সপেনসেস, ফাইভ থাউজেন্ড।

অবাক হয়ে বলি, টাকা! টাকা কেন? আমি আমার স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য কাজ করব, আপনি টাকা দেবেন কেন?

কাগজের বউ। রুমা বলল।

না না। প্রেমিক বাধা দিয়ে বলে, আপনার বউ তো ঠিকই। কিন্তু টাকার তো দরকার হতে পারে। কিপ ইট অ্যাজ এ গিফট।

ইতস্তত করি। টাকা! কত টাকা! টাকা কি দুনিয়ায় সত্যিই সস্তা হয়ে গেল? আজকাল আমি পাশ ফিরলেও টাকা আসে। গোছ গোছা হ্যান্ডবিলের মতো টাকা।

প্রাক্তন প্রেমিক আমার পিঠে হাত রেখে দরজার দিকে নিয়ে যেতে থাকে। আমি জেদির মতো দাঁড়াই।

প্রীতি মুখ তুলছে। চোখ মুছল। তারপর তাকাল আমার দিকে। দুই চোখ লাল। মুখখানা রুদ্ধ আবেগে ফেটে পড়ছে। ওর ঠোঁট নড়ল। কিছু বলল কি? কিছু শোনা গেল না। কিন্তু বুঝতে পারি, ও বলল, বেচারা!

প্রাক্তন প্রেমিকের হাত ছাড়িয়ে আমি প্রীতির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, প্রীতিসোনা, আমি তোমার জন্য সব করব। ভেবো না।

আমি প্রীতির দিকে এগিয়ে যাই। প্রীতি বিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি বলি, প্রীতি, বউ আমার!

চকিত পায়ে রুমা রাস্তা আটকে দাঁড়ায়। কঠিন গলায় বলে, উপলবাবু, প্রীতিকে একা থাকতে দিন।

অসম্ভব রাগে আমার শরীর স্টার্ট নেওয়া মোটরগাড়ির মতো গর্জন করতে থাকে। আমি বলি, সরে যান!

রুমা তার স্ম্যাশ করার প্রিয় ভঙ্গিতে হাতখানা ওপরে তোলে। বলে, নট এ স্টেপ ফারদার।

অভিজ্ঞতা বলে আমি কুঁকড়ে যাই। ডালমিয়া পার্কের সেই স্মৃতি দগদগ করে ওঠে পুরনো ব্যথার মতো। প্রাক্তন প্রেমিক এসে আমার হাত ধরে সান্ত্বনার গলায় বলে, আগে কাজ তারপর সব কিছু। প্রীতি আপনারই রইল। এখন ওকে বিপদ থেকে বাঁচানোটা আগে দরকার।

আমি মাথা নাড়ি। তারপর প্রাক্তন প্রেমিকের কানে কানে বলি, এর আগে আমার কখনও বিয়ে হয়নি, জানেন! আমার অদ্ভুত ভাল লাগছে।

প্রাক্তন প্রেমিক আমাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। বলে, জানি। আপনি বড় ভাল লোক। পৃথিবীর শেষ কয়েকটা ভাল লোকের মধ্যে আপনি একজন।

.

১৪.

সুবিনয় মুখ তুলে আমাকে দেখল। নিজের সিগারেটের ধোঁয়ায় ও আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সারা ঘরে বিদেহী আত্মার মতো অ্যালকোহলের গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘরটা আবছা, অস্পষ্ট।

আমি কাঁপা গলায় ডাকি, সুবিনয়।

ইয়াপ বাডি।— বলে সুবিনয় হেঁচকি তোলে।

আমার কিছু কথা আছে।

 কলকল করে গেলাসে মদ ঢালবার শব্দ হয়। খস করে ওঠে দেশলাই। একটু আলো জ্বলে নিবে যায়।

সুবিনয় বলে, উপল, আমার কিছুতেই নেশা হচ্ছে না। সকাল থেকে একটানা খাচ্ছি। তবু কেন নেশা হচ্ছে না বল তো!

সুবিনয়, আমার কথাটা খুব জরুরি।

কী কথা?

আমি প্রীতিকে বিয়ে করেছি।

সুবিনয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাত্র। তার সিগারেটের আগুন তেজি হয়ে মিইয়ে যায়। গেলাস টেবিলে রাখার শব্দ হয়।

সুবিনয় বলে, কংগ্রাচুলেশনস।

 ঠাট্টা নয় সুবিনয়, প্রীতি আমার বউ। মাই লিগাল ওয়াইফ। এই দ্যাখ সার্টিফিকেট।

সুবিনয় হাত বাড়িয়ে কাগজখানা নেয়। দেখে। তারপর সামনের টেবিলে ফেলে দিয়ে বলে, ড্যাম ফুল।

কে?

সুবিনয় আবছায়ার ভিতর দিয়ে আমার দিকে তাকাল। গাঢ় স্বরে বলল, ইউ নো সামথিং বাডি? ইউ আর ফ্রেমড।

তার মানে?

সুবিনয় মাথা নেড়ে একটু হাসে। বলে, ইটস এ পেপার ম্যারেজ বাডি। এ পেপার ম্যারেজ। অ্যান্ড ইউ আর দ্য স্কেপগোট।

মাথাটা ঝিম করে ওঠে। তবু আমি যথাসাধ্য দৃঢ় গলায় বলি, না সুবিনয়, প্রীতি আমাকে ভালবাসে। ও সিঁদুর পরবে, শাঁখা পরবে। আমাকে আমেরিকা নিয়ে যাবে।

জলপ্রপাতের মতো সুবিনয়ের হাসি ঝরে পড়তে থাকে। ম্যারেজ সার্টিফিকেটখানা তুলে নিয়ে দলা পাকিয়ে আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলে, যা, এটাকে বাঁধিয়ে রাখিস।

আমি পাকানো কাগজটা খুলে সমান করতে করতে বলি, প্রীতি এখন আমার বউ সুবিনয়, তুই ডিস্টার্ব করবি না।

সোফায় চিতপাত হয়ে শুয়ে সুবিনয় বলে, করব না উপল। বোস।

 আমি বসি।

সুবিনয় উদাস গলায় বলে, প্রীতি পরশুদিন যাচ্ছে তা হলে?

না না। আমরা কাল হানিমুনে যাচ্ছি। কুলু ভ্যালিতে। মুখস্থ বলে যাই।

 ও হাসে, বলে, আই ক্যান স্মেল দ্য ট্রুথ বাডি। ডোন্ট টেল লাইজ।

আমি ভয় পাই। আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। ঘামতে থাকি।

সুবিনয় উঠে বসে। বলে, উপল, এ সব ছেলেমানুষি চালাকি ও করছে কেন? কোনও লাভ নেই। আমি ইচ্ছে করলেই ওর যাওয়া আটকে দিতে পারি। ওর প্রেমিককে ছমাসের জন্য হাসপাতালে পাঠাতে পারি।

আমার শরীরে একটা মোটরগাড়ি হঠাৎ স্টার্ট নেয়। গরগর করে গর্জন করতে থাকে রাগ।

চাপা গলায় বলি, সুবিনয়! সাবধান।

সুবিনয় বলে, কেউ ঠেকাতে পারবে না।

আমার সব স্বাভাবিক বোধ লুপ্ত হয়ে যায়। আমি এক পা দু’পা করে এগিয়ে যাই। বলি, প্রীতি সম্পর্কে আমি কোনও কথা শুনতে চাই না আর। শি ইজ মাই ওয়াইফ।

সুবিনয় একটা হেঁচকি তুলে হেসে ওঠে।

আমি বিনা দ্বিধায় ওর মুখের দিকে লাথি চালিয়ে বলি, স্কাউড্রেল।

লাথি লাগল জুতোসুদ্ধ। সুবিনয় একটা ওঁক শব্দ করে দু’হাতে থুতনি চেপে ধরল। দ্বিতীয় লাথিটা লাগল ওর মাথায়। টলে সোফায় পড়ে গেল সুবিনয়। আমি বাঘের মতো লাফিয়ে গিয়ে দু’ হাতের থাবায় ওর গলার নলি আঁকড়ে ধরে বলি, মেরে ফেলব কুকুর। মেরে ফেলব।

আমার দাঁতে দাঁতে এত জোর ঘষা লাগে যে, গম পেষাইয়ের শব্দ হতে থাকে।

 সুবিনয় চোখ চেয়ে খুব অবাক হয়ে আমাকে দেখল।

আমি আমার সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ওর গলায় আঙুল বসিয়ে দিচ্ছি। মস্ত মোটা গর্দান, প্রচণ্ড মাংসপেশি। তবু আমার তো কিছু করতে হবে। প্রাণপণে ওর গলা টিপে বলি, মরে যা! মরে যা! মরে যা।

সুবিনয় বাধা দিল না। শুধু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল।

 আমি কার্পেটের ওপর হড়াস করে পড়ে গেলাম।

আমার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সুবিনয় তার মদের গেলাস তুলে নিয়ে বলল, তুই কত বোকা উপল। তুই বুঝিসনি, ওরা তোকে আমার হাতে ঠ্যাঙানি খাওয়ার জন্য পাঠিয়েছে।

আস্তে আস্তে আমি উঠে বসি। মাথাটা ঘুরছে। আমি অনেকক্ষণ কিছু খাইনি।

সুবিনয় আমাকে দেখল। মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু প্রীতির জন্য তোকে আমি মারব না উপল। প্রীতি ইজ নট মাই প্রবলেম। আমি জানতে চাই, তুই ক্ষণাকে কী করেছিস।

আমি কষ্টে মুখোমুখি সোফায় উঠে বসি। শরীরে রাগ ছেড়ে যাওয়ার পর গভীর অবসাদ। মাথাটা চেপে ধরে বললাম, আমি কিছু করিনি সুবিনয়। তুই যা করতে বলেছিস।

সুবিনয় গেলাসে মদ ঢালে। ফের সিগারেট ধরায়।

 উপল।

 উ।

 ক্ষণা নষ্ট হয়ে গেছে। থরোলি স্পয়েল্ট।

বলে সুবিনয় আমার দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইল। দৃষ্টিতে ভয়, ঘৃণা, বিস্ময়। অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে আর-একটু তীব্র স্বরে বলল, ডেমন! শয়তান! ক্ষণাকে তুই কী করেছিস?

আমার সমস্ত শরীর সেই স্বরে কেঁপে ওঠে। মুখে জবাব আসে না।

সুবিনয় তার বিশাল চেহারা নিয়ে, আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। ওকে বড় ভয়ংকর দেখাতে থাকে। আমি কুঁকড়ে বসে সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকি।

ক্ষণা সম্পূর্ণভাবে আমার ছিল। আমি যা চাইতাম ও তাই করত। যেমনভাবে চলতে বলতাম তেমনি চলত। কখনও এতটুকু অবাধ্য ছিল না। আমার দিকে যখন তাকাত তখন ওর চোখে একটা আলো দেখা দিত। বড় সুন্দর আলো। পৃথিবীতে আমি ছাড়া কোনও পুরুষকে ও কোনও দিন ভাল করে লক্ষও করেনি। কিন্তু কাল রাতে ও আমাকে দেখে ভয়ে আতঙ্কে নীলবর্ণ হয়ে গেল। কাছে এল না। চোখে চোখ রাখল না। বার বার আমার চোখ থেকে সরে সরে যাচ্ছিল। কী করেছিস উপল?

আমি মার ঠেকানোর জন্য দুটো হাত তুলে বলি, সুবিনয়, দ্যাখ।

সুবিনয় এক পা এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বলে, কী দেখব?

আমি হাঁ করে আমার মুখের ভিতরটা দেখতে ওকে ইঙ্গিত করি। ও দেখে, তারপর বলে, কী?

 দেখলি না?

না। কী দেখাচ্ছিস হাঁ করে?

শ্বাস ফেলে বলি, বিশ্বরূপ। অর্জুন দেখেছিল। তুইও দেখলে দেখতে পেতিস, যা হওয়ার তা হয়ে আছে। আমি নিমিত্তমাত্র।

সুবিনয় দুই হাতের চাপে মদের গেলাসটা ভেঙে ফেলল। তীব্র বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আমাকে বলল, তুই ক্ষণাকে কীরকম বিশ্বরূপ দেখিয়েছিস উপল? ওকে কী করে নষ্ট করলি?

আমি কী করব সুবিনয়? আমাকে দিয়ে করিয়েছিস তুই।

সুবিনয় মাথা নাড়ল, ক্ষণা কী করে নষ্ট হতে পারে? কী করে আমাকে ছেড়ে ও তোকে ভালবাসে উপল? ইজ ইট পসিবল?

কাছে এগিয়ে এসে সুবিনয় আমার বুকের জামাটা ধরে টেনে তোলে আমাকে। তারপর হেঁচড়ে নিয়ে যায় আলোর কাছে। ভাল করে দেখে আমাকে। মৃদু সাপের মতো হিসহিসে স্বরে বলে, কী আছে তোর মধ্যে? কী দেখেছিল ক্ষণা? টেল মি বাস্টার্ড, হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান টু হার?

আমার জামার কলার এঁটে বসে গেছে। দম নেওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করি। সুবিনয় আমার চোখের ভিতর দিয়ে আমার ভিতরটা দেখবার চেষ্টা করে। বলে, কী করেছিস তুই আমার ক্ষণাকে? কেন ক্ষণা আর আমাকে ভালবাসে না? বল। বল।

আমাকে মুহূর্তের জন্য ছেড়ে দেয় সুবিনয়। আমি দাঁড়াই। ঠিক তৎক্ষণাৎ সুবিনয়ের ঘুসি এসে লাগে আমার মুখে।

সমস্ত চেতনায় ঝিঁঝি ডেকে ওঠে। অতল অন্ধকারে পড়ে যেতে থাকি। শুনতে পাই এক ঘ্যাঙানে ভিখিরির স্বরে সুবিনয় বলছে, ফিরিয়ে দে। ফিরিয়ে দে ক্ষণাকে।

.

সারা শরীর ব্যথা-বেদনার ড়ুবজলে ড়ুবে আছে। মাথাটা ফাঁকা, ভার। কঁকিয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করি। হাত বাড়িয়ে একটা রেলিং-এর থাম হাতে পাই। ধরি। চোখে ভাল ঠাহর হয় না। ঝাপসা বুঝতে পারি, দোতলার সিঁড়ি উঠে গেছে অনেক ওপরে। ওখান থেকে গড়িয়ে পড়েছি এত দূরে।

সিঁড়িটা আমার দিকে চেয়ে আছে। করুণ চোখে বলে দিচ্ছে, যা দিয়ে নামা যায় তা-ই দিয়েই ওঠা যায়। কিন্তু তুমি আর সিঁড়ি বেয়ে উঠো না উপলভায়া। এই আশ্রয়টাও তুমি হারালে।

সিঁড়ির দিকে চেয়ে আমি মাথা নাড়ি। বুঝেছি।

কাঁকালটা চেপে ধরে অষ্টাবক্রের মতো বেরিয়ে আসি রাস্তায়। ফাঁকা আকাশ, খোলা হাওয়া। এখন এ ছাড়া আমার আর কী রইল? বড় ভাল লাগল দুনিয়াটাকে।

কিন্তু বিবেকশালা কি ছাড়ে? পিছু থেকে এসে কানে কানে বলে দেয়, আছে হে। এখনও অনেক আছে।

পকেটে হাত দিই। ট্যাঁকে হাত দিই। হাজার হাজার টাকা খচমচ করে ওঠে।

বিবেক বলে, একটা ট্যাক্সি করো হে উপলচন্দোর। ওড়াও।

জিভটা কেটে দু’আধখানা হয়ে গেছে প্রায়। জমাট রক্ত থুঃ করে ফেলি। কপালের দু’ধারে দুটো আলু উঠেছে। চোখ ফুলে ঢোল। পাঁজরায় খিচ ধরে আছে। ঘাড় শক্ত। হাতের পায়ের জোড়ে সাড় নেই।

কাটা জিভটা নেড়ে বড় কষ্টে বলি, সবাই বড় মারে বিবেকবাবা।

 সামনে একটা ট্যাক্সি থামে। উঠে পড়ি। ট্যাক্সিওলা সন্দেহের চোখে এক বার, দু’ বার তাকায় আমার দিকে। ভয়ে সিঁটিয়ে বসে থাকি। যদি এই মার খাওয়া চেহারা দেখে নিতে না চায়।

পরমুহূর্তেই মনে পড়ে, আমার পকেটে অফুরন্ত টাকা আছে। অনেক টাকা। ব্যক্তিত্ব এসে যায়। আত্মবিশ্বাস আসতে থাকে। গম্ভীর মুখ করে বলি, মধু গুপ্ত লেন চলুন।

মধু গুপ্ত লেন-এর সমীর আর তার সাঙাতরা দিনরাত আমার পথ চেয়ে আছে। ওরা আশায় আশায় পথে পায়চারি করছিল। ট্যাক্সি থামতেই ছুটে এল রুস্তমরা।

আমি টাকা মুঠো করে জানালার বাইরে হাত বাড়াই। কাটা জিভে বড় কষ্টে বলি, কেতকীকে ছেড়ে দেবেন।

এক রুস্তম জানালায় ঝুঁকে পড়ে বলে, আপনি কেতকীকে নেবেন? বলুন, তুলে এনে গাড়িতে ভরে দিই।

আমি মাথা নাড়ি, না। আমার বউ আছে। আমি বউয়ের কাছে যাব।

আগের দিনের সেই ছেলেটা গাড়ির মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে বলে, কোন বাঞ্চোত আপনার গায়ে হাত তুলেছে বলুন তো? শুধু ঠিকানা বলে দিন, খবর হয়ে যাবে।

আমি মাথা নাড়ি, না। আমি সবাইকে ক্ষমা করেছি। আমি আমার বউয়ের কাছে যাব এখন। আমার ব্যথার জায়গাগুলোয় সে হাত বুলিয়ে দেবে। আমি ঘুমিয়ে পড়ব। অনেকক্ষণ ধরে একনাগাড়ে ঘুমোব।

ট্যাক্সির মুখ ঘুরিয়ে ফিরে আমি বড় রাস্তায় চলে আসি। চার দিকে রাত আটটার কলকাতা ডগমগ করছে। বড় ভাল লাগে। যেন এক অনন্ত উৎসব চলেছে। সুখী মানুষরা জড়ো হয়েছে দোকানে দোকানে, সিনেমায়, রাস্তায়।

কাটা জিভ নেড়ে বলি, মানুষকে আরও সুখী করতে চাই আমি বিবেকবাবা। আজ রাতে আমি আমার বউয়ের কাছে যাব তো! আজ সবাই সুখী হোক। আশীর্বাদ করুক।

আমার বিবেক তার বাদ্যযন্ত্রে একটা পিড়িং শব্দ তুলে বলে, এখনও অনেক টাকা রয়ে গেল তোমার উপলচন্দোর। তুমি যে হ্যান্ডবিলের মতো টাকা ওড়াতে চেয়েছিলে।

ঠিক। ঠিক। আমি মাথা নাড়ি।

এক মুঠো টাকা বান্ডিল থেকে খুলে এনে জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিই বাইরে। ঠিক অবিকল হ্যান্ডবিলের মতো বাতাসের ঝটকায় টাকা উড়ে যায়। ঘুড়ির মতো লাট খায় শূন্যে। তারপর আলোকিত রাস্তা-ঘাট আর মানুষজনের ওপর নেমে আসে।

পিছনের কাচ দিয়ে আমি ঘুরে দেখি। মানুষজন হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে দু’হাত বাড়িয়ে দৌড়োচ্ছ টাকার দিকে। চলন্ত ট্রামবাস থেকে নেমে পড়ছে রাশি রাশি মানুষ। একটা লোক চলন্ত গাড়ির নীচে চলে গেল টাকা কুড়াতে গিয়ে।

আর-এক মুঠো উড়িয়ে দিই। দেখি। দোকান ছেড়ে নেমে আসছে দোকানি। হাড়কাটা গলির ভাড়াটে মেয়েরা খদ্দের ভুলে পিল পিল করে রঙিন মুখ আর তেল-সিঁদুরের ছোপ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। একটা ঠ্যাং-ভাঙা লোক টানা রিকশায় বসে মেডিকেল কলেজে যাচ্ছিল, সে হঠাৎ দু পায়ে লাফ মারল রাস্তায়।

বউবাজারের মোড় পেরিয়ে আর-এক মুঠো ওড়াই।

ট্যাক্সিওলা ট্যাক্সি থামিয়ে বলে, কী হচ্ছে বলুন তো পিছনে?

কিছু না। আপনি চলুন।

ট্যাক্সিওলা আবার গাড়ি ছাড়ে। আমি টাকা ওড়াতে থাকি। আমার পিছু পিছু কলকাতা পাগল হতে থাকে। ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি ভুলে লাফিয়ে পড়ে রাস্তায়। সিনেমা ভেঙে যায়। দোকানেবাজারে ঝাঁপ পড়তে থাকে। দাঙ্গা লেগে যায়। ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি হতে থাকে। একটা কালো পুলিশের গাড়ি ধেয়ে আসতে থাকে আমার দিকে। আমি পাত্তা দিই না। চৌরঙ্গির মোড়ে আমি মহানন্দে টাকা ছড়াই।

টাকা ওড়ে। লাট খায়। পড়ে।

আমি মুগ্ধ চোখে দেখি। ঠিক এইরকম ভাবে আমি টাকাকে দেখতে চেয়েছি বরাবর। সস্তা, সহজ, প্রচুর। দেখতে দেখতে এত মোহিত হয়ে যাই যে, আমার কিছু খেয়াল থাকে না। ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে কখন। পুলিশের গাড়ি এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।

সিপাইজিরা যখন ধরাধরি করে গাড়িতে তুলছিল তখন কেবল আমি প্রাণপণে চেঁচিয়ে বলছিলাম, ছেড়ে দাও আমাকে। আমার বউ বসে আছে আমার জন্য। আমি তার কাছে যাব।

পিস্তলওলা এক পুলিশ সাহেব বলল, এত কালো টাকা আমি কখনও দেখিনি।

.

আমার ক’মাসের মেয়াদ হয়েছিল আমি জানি না। যখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব রায় পড়ছিলেন তখন আমি অন্য কথা ভাবছিলাম।

কম্বলে শুয়ে আমার গায়ে বড় চুলকুনি হয়েছে, তাই খুব চুলকোচ্ছিলামও। রায় পড়া হয়ে গেলে পুলিশ আমাকে জেলে আটকে রাখল।

তারপর ছেড়েও দিল একদিন।

কোনও মানে হয় না। খামোকা এই আটকে রাখা আর ছেড়ে দেওয়া।

বেরিয়ে এসে পৃথিবীর রাস্তাঘাট কিছু অচেনা ঠেকছিল, আর-একটা লোকও ছাড়া পেয়ে সঙ্গে নিয়েছিল। পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, শালারা বোকা।

কারা?

ওই যারা আমাকে জেলে পাঠিয়েছিল। বুঝলে! আসলে খুনটা আমিই করেছিলাম। বদ্যিনাথ নয়। তা বদ্যিনাথের যাবজ্জীবন হল, আমার ছ’ মাস।

বলে খুব হাসল লোটা। বলল, কালীমায়ের থানে একটা পুজো দিই গে। তারপর গঙ্গাস্নান করে সোজা বাড়ি। তুমি কোন দিকে?

বেঁটে, কালো, মজবুত চেহারার লোকটার দিকে চেয়ে থাকি। তারপর বলি, আমার রাস্তাঘাট সব গুলিয়ে গেছে। ঠিক চিনতে পারছি না। আমি আমার বউয়ের কাছে যাব।

তা আর ভাবনা কী। চলো একসঙ্গে যাই। একদিন না একদিন ঠিক বউ এসে জুটবে তোমার।

আমি মাথা নেড়ে তার সঙ্গ ধরলাম।

লোকটা পুজো দিল, গঙ্গাস্নান করল। তারপর আমাকে নিয়ে কালীঘাট স্টেশন থেকে ট্রেন ধরল। ফের শিয়ালদায় এসে ট্রেন পালটে আর-এক ট্রেন। লোকটা যায়। আমিও যাই। বরাবরই দেখেছি একবার বেরিয়ে পড়লে কেউ-কেউ জুটে যাবেই।

পলাশি স্টেশনে নেমে অনেকখানি মাঠঘাট, খানাখন্দ পেরিয়ে হাঁটতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে বলি, ওহে বাপু, বড় যে নিয়ে যাচ্ছ, খুব খাটাবে নাকি?

লোকটা ভালমানুষি ঝেড়ে ফেলে বলে, তার মানে? কালীঘাটে খাওয়ালুম, এতগুলো গাড়িভাড়া গুনলুম, সে কি এমনি এমনি নাকি? মুখ দেখব বলে তো নয়। একটু ছিটেল লোক আছ তা বুঝতে পারছি। কিন্তু বসে খাওয়া আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। গতরখাস হয়ে বসে থাকলে ঠ্যাঙানি খাবে।

এরকমই সব হওয়ার কথা। একটা শ্বাস ফেলি। ভাবি, একদিন রাস্তাঘাট যখন সব ভেসে উঠবে চোখের সামনে, সেদিন দুনিয়ার সুন্দর একটা সহজ রাস্তা ধরে আমি যাব আমার বউয়ের কাছে। তত দিন একটু অপেক্ষা। মাথাটা পরিষ্কার হোক।

লোকটার কাজ বড় কম ছিল না। দু’বিঘে একটা চাষের জমি কুয়ো থেকে জল তুলে তুলে ভেজাতে হয়। বড় কষ্ট। আগাছা সাফ করি। উঠোন ঝাটাই। গোরুর জাবনা দিই। সারা দিন আর সময় হয়ে ওঠে না–

রাত্রিবেলা সব দিন ঘুম আসে না। বিছানা ছেড়ে উঠে চলে আসি খোলা হাওয়ায়, মাঠের মধ্যে। চার দিকে মস্ত আকাশ, পায়ের নীচে মস্ত মাটি। এই আকাশ গোটা দুনিয়াকে ঘিরে রেখেছে। এই মাটি চলে গেছে বরাবর সব মানুষের পায়ের নীচ দিয়ে। যোগ রেখেছে সকলের সঙ্গে সকলের। ভাবতে বড় ভাল লাগে।

এক-একদিন বুড়ো বিবেক এসে পাশে বসে। বলে, উপলচন্দোর, তোমাকে একটু দুঃখের গান শোনাতে ইচ্ছে করছে।

শোনাও।

কিন্তু গান গাইতে গেলেই বিবেকের বড় কাশি উঠে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আর শোনাতে পারে না। হাঁপিয়ে উঠে বলে, কী কাণ্ড! ওঃ, কেতকীর বিয়েতে খুব খাইয়েছিল হে উপলচন্দোর। খুব। কুমড়োর একটা ছক্কা যা করেছিল!

কেতকী কি কেঁদেছিল বিবেকবাবা?

তা কাঁদবে না? মেয়েরা শ্বশুরঘরে যাওয়ার সময়ে কত কাঁদে।

কিন্তু আমার জন্যও তার কাঁদবার কথা ছিল যে!

বিবেক বলে, তা সে এক কান্নার মধ্যেই মানুষের কত কান্না মিলেমিশে থাকে। আলাদা করে কি বোঝা যায় কার জন্য কোন হিক্কাটা তুলল। তবে তোমার মাসিকে একবার বলেছিল বটে, পিসি, উপলদা এল না। তার জন্যই আমার এত ভাল বিয়ে হচ্ছে। সে কথা থাক উপলচন্দোর। তোমাকে বরং কুমড়োর ছক্কাটার কথা বলি, কী ভুরভুরে ঘিয়ের বাস, গরম মশলার সে যে কী প্রাণকাড়া গন্ধ, কাবলি ছোলা দিয়েছিল তার মধ্যে আবার।

সুবিনয় কি ক্ষণার সঙ্গে ঘর করে বিবেকবাবা?

 বিবেক ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, খুব করে, খুব করে। সে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তারা এখন খুব সিনেমা-থিয়েটারে যায়। আর সময় পেলেই তোমার খুব নিন্দে করে বসে বসে।

বিবেকবাবা, প্রীতির কথা কিছু জানো?

সে আর জানা শক্ত কী! আমেরিকায় গিয়ে তোমার নামে ডিভোর্সের মামলা দায়ের করল। তুমি তখন জেলে। একতরফা ডিক্রি পেয়ে তার সেই ভাবের লোকের সঙ্গে বিয়ে বসেছে। পাঁচ হাজার টাকা কি তোমাকে এমনি এমনি দিয়েছিল বাপু? তবে মাঝে মাঝে বলে বটে, উপলটা বড্ড বেচারা!

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।

বিবেক আমার দিকে চায়। বলে, আরও খবর চাও নাকি? সেই যে পৈলেন ট্রেন থেকে পড়ে গেল। মনে আছে? সে কিন্তু মরেনি। এক ঠ্যাং কাটা গেছে, সে এখন ন্যাকড়ার পুতুল তৈরি করে বেচে। হাজু আর কদম এখনও ছ্যাঁচড়ামি করে বেড়াচ্ছে। সেই মানিক সাহা সুন্দরবনে একা থাকে, এক নৌকোয় চাকরি পেয়েছে। বড় আনন্দে আছে। আরও শুনবে?

মাথা নেড়ে বলি, না বিবেকবাবা।

বিবেক বলে, আমিও তাই বলি। শুনে কাজ কী উপলচন্দোর? ও সব তো তোমার সমস্যা নয়। তোমার সমস্যা তুমি নিজেই। তাই বরং তোমাকে কুমড়োর ছক্কার গল্পটা বলি, আচ্ছা, না হয় কেতকীর বিয়েতে যে রসকদম্ব খাইয়েছিল সেটার কথা শোনো। সে রসকদম্বের কোনও জুড়ি নেই–

আমি ঘুমিয়ে পড়ি শুনতে শুনতে। বিবেক বিরক্ত হয়ে উঠে যায়।

আর তখন সেই অন্ধকার, একা মাঠের মধ্যে হঠাৎ চিড়িক করে ডেকে ওঠে মেঠো ছুঁচো, ইঁদুর, কীটপতঙ্গেরা, চার দিকে তাদের ডাক বেজে ওঠে। পরস্পরকে ডেকে জাগিয়ে তোলে তারা।

আমিও জাগি। বসে থাকি চুপ করে। আস্তে আস্তে আমার পেটের মধ্যে জেগে ওঠে ভূতের মতো খিদে। ক্যানসারের মতো, কুষ্ঠের মতো দুরারোগ্য খিদে। জেগে টের পাই, পৃথিবী জুড়ে খিদে জাগে, ঘুম ভেঙে যায় ইঁদুরের, মানুষের, কীট ও পতঙ্গের।

শেষরাতে চাঁদ উঠে আসে আকাশে। চেয়ে থাকি। ইঁদুরেরাও চায়। বলি, বড় খিদে পায়।

বিদ্যুৎবেগে আমার সেই কথা চলে যায় দিকবিদিকে। সারা দেশ ও বিদেশ জুড়ে পশু পাখি ও মানুষের অনেক স্বর বলে ওঠে, আমাদের হৃদয়ের কোনও সমস্যা নেই। দর্শন, বিজ্ঞান, প্রেমভালবাসা নেই। শুধু খিদে পায়। বড় খিদে পায়।

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়