অনেক ক’রে বাসতে ভালো পারিনি মা তখন যারে, আজ অবেলায় তারেই মনে পড়ছে কেন বারে বারে।। আজ মনে হয় রোজ রাতে সে ঘুম পাড়াত নয়ন চুমে, চুমুর পরে চুম দিয়ে ফের হান্তে আঘাত ভোরের ঘুমে। ভাব্তুম তখন এ কোন্ বালাই! কর্ত এ প্রাণ পালাই পালাই। আজ সে কথা মনে হ’য়ে ভাসি অঝোর নয়ন-ঝরে। অভাগিনীর সে গরব আজ ধূলায় লুটায় ব্যথার ভারে।। তরুণ তাহার ভরাট বুকের উপ্চে-পড়া আদর সোহাগ হেলায় দু’পায় দ’লেছি মা, আজ কেন হায় তার অনুরাগ? এই চরণ সে বক্ষে চেপে চুমেছে, আর দু’চোখ ছেপে জল ঝ’রেছে, তখনো মা কইনি কথা অহঙ্কারে, এম্নি দারুণ হতাদরে ক’রেছি মা, বিদায় তারে।। দেখেওছিলাম বুক-ভরা তার অনাদরের আঘাত-কাঁটা, দ্বার হ’তে সে গেছে দ্বারে খেয়ে সবার লাথি-ঝাটা। ভেবেছিলাম আমার কাছে তার দরদের শানি- আছে, আমিও গো মা ফিরিয়ে দিলাম চিন্তে নেরে দেবতারে। ভিক্ষুবেশে এসেছিল রাজাধিরাজ দাসীর দ্বারে।। পথ ভুলে সে এসেছিল সে মোর সাধের রাজ-ভিখারী, মাগো আমি ভিখারিনী, আমি কি তাঁয় চিন্তে পারি? তাই মাগো তাঁর পূজার ডালা নিইনি, নিইনি মণির মালা, দেব্তা আমার নিজে আমায় পূজল ষোড়শ-উপচারে। পূজারীকে চিন্লাম না মা পূজা-ধূমের অন্ধকারে।। আমায় চাওয়াই শেষ চাওয়া তার মাগো আমি তা কি জানি? ধরায় শুধু রইল ধরা রাজ-অতিথির বিদায়-বাণী। ওরে আমার ভালোবাসা! কোথায় বেঁধেছিলি বাসা যখন আমার রাজা এসে দাঁড়িয়েছিল এই দুয়ারে? নিঃশ্বসিয়া উঠছে ধরা, ‘নেই রে সে নেই, খুঁজিস কারে!’ সে যে পথের চির-পথিক, তার কি সহে ঘরের মায়া? দূর হ’তে মা দূরন-রে ডাকে তাকে পথের ছায়া। মাঠের পারে বনের মাঝে চপল তাহার নূপুর বাজে, ফুলের সাথে ফুটে বেড়ায়, মেঘের সাথে যায় পাহাড়ে, ধরা দিয়েও দেয় না ধরা জানি না সে চায় কাহারে? মাগো আমায় শক্তি কোথায় পথ-পাগলে ধ’রে রাখার? তার তরে নয় ভালোবাসা সন্ধ্যা-প্রদীপ ঘরে ডাকার। তাই মা আমার বুকের কবাট খুলতে নারল তার করাঘাত, এ মন তখন কেমন যেন বাসত ভালো আর কাহারে, আমিই দূরে ঠেলে দিলাম অভিমানী ঘর-হারারে।। সোহাগে সে ধ’রতে যেত নিবিড় ক’রে বক্ষে চেপে, হতভাগী পারিয়ে যেতাম ভয়ে এ বুক উঠ্ত কেঁপে। রাজ ভিখারীর আঁখির কালো, দূরে থেকেই লাগ্ত ভালো, আসলে কাছে ক্ষুধিত তার দীঘল চাওয়া অশ্র”-ভারে। ব্যথায় কেমন মুষড়ে যেতাম, সুর হারাতাম মনে তরে।। আজ কেন মা তারই মতন আমারো এই বুকের ক্ষুধা চায় শুধু সেই হেলায় হারা আদর-সোহাগ পরশ-সুধা, আজ মনে হয় তাঁর সে বুকে এ মুখ চেপে নিবিড় সুখে গভীর দুখের কাঁদন কেঁদে শেষ ক’রে দিই এ আমারে! যায় না কি মা আমার কাঁদন তাঁহার দেশের কানন-পারে? আজ বুঝেছি এ-জনমের আমার নিখিল শানি–আরাম চুরি ক’রে পালিয়ে গেছে চোরের রাজা সেই প্রাণারাম। হে বসনে-র রাজা আমার! নাও এসে মোর হার-মানা-হারা! আজ যে আমার বুক ফেটে যায় আর্তনাদের হাহাকারে, দেখে যাও আজ সেই পাষাণী কেমন ক’রে কাঁদতে পারে! তোমার কথাই সত্য হ’ল পাষাণ ফেটেও রক্ত বহে, দাবাললের দার”ণ দাহ তুষার-গিরি আজকে দহে। জাগল বুকে ভীষণ জোয়ার, ভাঙল আগল ভাঙল দুয়ার মূকের বুকে দেব্তা এলেন মুখর মুখে ভীম পাথারে। বুক ফেটেছে মুখ ফুটেছে-মাগো মানা ক’র্ছ কারে? স্বর্গ আমার গেছে পুড়ে তারই চ’লে যাওয়ার সাথে, এখন আমার একার বাসার দোসরহীন এই দুঃখ-রাতে। ঘুম ভাঙাতে আস্বে না সে ভোর না হ’তেই শিয়র-পাশে, আস্বে না আর গভীর রাতে চুম-চুরির অভিসারে, কাঁদাবে ফিরে তাঁহার সাথী ঝড়ের রাতি বনের পারে। আজ পেলে তাঁয় হুম্ড়ি খেয়ে প’ড়তুম মাগো যুগল পদে, বুকে ধ’রে পদ-কোকনদ স্নান করাতাম আঁখির হ্রদে। ব’সতে দিতাম আধেক আঁচল, সজল চোখের চোখ-ভরা জল- ভেজা কাজল মুছতাম তার চোখে মুখে অধর-ধারে, আকুল কেশে পা মুছাতাম বেঁধে বাহুর কারাগারে। দেখ্তে মাগো তখন তোমার রাক্ষুসী এই সর্বনাশী, মুখ থুয়ে তাঁর উদার বুকে ব’লত,‘ আমি ভালোবাসি!’ ব’ল্তে গিয়ে সুখ-শরমে লাল হ’য়ে গাল উঠত ঘেমে, বুক হ’তে মুখ আস্ত নেমে লুটিয়ে যখন কোল-কিনারে, দেখ্তুম মাগো তখন কেমন মান ক’রে সে থাক্তে পারে! এম্নি এখন কতই আমা ভালোবাসার তৃষ্ণা জাগে তাঁর ওপর মা অভিমানে, ব্যাথায়, রাগে, অনুরাগে। চোখের জলের ঋণী ক’রে, সে গেছে কোন্ দ্বীপান-রে? সে বুঝি মা সাত সমুদ্দুর তের নদীর সুদূরপারে? ঝড়ের হাওয়া সেও বুঝি মা সে দূর-দেশে যেতে নারে? তারে আমি ভালোবাসি সে যদি তা পায় মা খবর, চৌচির হ’য়ে প’ড়বে ফেটে আনন্দে মা তাহার কবর। চীৎকারে তার উঠবে কেঁপে ধরার সাগর অশ্রু ছেপে, উঠবে ক্ষেপে অগ্নি-গিরি সেই পাগলের হুহুঙ্কারে, ভূধর সাগর আকাশ বাতাস ঘুর্ণি নেচে ঘিরবে তারে। ছি, মা! তুমি ডুকরে কেন উঠছ কেঁদে অমন ক’রে? তার চেয়ে মা তারই কোনো শোনা-কথা শুনাও মোরে! শুনতে শুনতে তোমার কোলে ঘুমিয়ে পড়ি। - ও কে খোলে দুয়ার ওমা? ঝড় বুঝি মা তারই মতো ধাক্কা মারে? ঝোড়ো হওয়া! ঝোড়ো হাওয়া! বন্ধু তোমার সাগর পারে! সে কি হেথায় আসতে পারে আমি যেথায় আছি বেঁচে, যে দেশে নেই আমার ছায়া এবার সে সেই দেশে গেছে! তবু কেন থাকি’ থাকি’, ইচ্ছা করে তারেই ডাকি! যে কথা মোর রইল বাকী হায় সে কথা শুনাই কারে? মাগো আমার প্রাণের কাঁদন আছড়ে মরে বুকের দ্বারে! যাই তবে মা! দেখা হ’লে আমার কথা ব’লো তারে- রাজার পূজা-সে কি কভু ভিখারিনী ঠেলতে পারে? মাগো আমি জানি জানি, আসবে আবার অভিমানী খুঁজতে আমায় গভীর রাতে এই আমাদের কুটীর-দ্বারে, ব’লো তখন খুঁজতে তারেই হারিয়ে গেছি অন্ধকারে!