( ১ )
ভারতে কালের ভেরী বাজিল আবার |----
অই শুন ঘোর ভীম নাদ তার !
ছুটিছে তুমুল রঙ্গে         আকুল অধীর বঙ্গে ;
   উঠিছে পূরিয়া দিক্ প্রাণী-হাহাকার !—

   বাজিল অকাল ভেরী---বাজিল আবার |

             
                ( ২ )
চলেছে প্রাণীর কুল হের চারিধার ;
চলে যেন পঙ্গপাল করিয়া আধার—
স্থবির বালক নারী         হা অন্ন, হা অন্ন বারি
    বলিতে বলিতে ধায়, চক্ষে নীরধার ;
    ধরাতলে চলে ধীরে কালীর আকার !

                ( ৩ )
দেখ রে চলেছে আহা শিশু কত জন,
শীর্ণদেহ চাহি আছে জননী বদন ;
আকুল জননী তার        মুখ চাহি বারবার
   অনিবার বারিধারা করে বরিষণ—
    ভ্রমে যেন উন্মাদিনী অন্নের কারণ !

            ( ৪ )
হের দেখ পথিধারে বসিয়া ওখানে
পতির চরণে লুটি আকুল পরাণে,
বলিছে কামিনী কেহ,   “কই নাথ অন্ন দেহ
   কালি আর চাহিব না রাখ আজ প্রাণে”---
   বলিয়া ত্যজিল প্রাণ চাহি পতিপানে |

                  ( ৫ )
ছুটেছে যুবতী কন্যা ফেলিয়া পিতায় ;
মা বলি ডাকিছে বৃদ্ধ সকলি বৃথায় ১
কেবা কন্যা, কেবা পিতা, কে জননী, কেবা মিতা,---
   অন্নদাতা, পিতা মাতা, আজি বাঙ্গালায়---
   হের হেন কত জন আজি এ দশায় |

                  ( ৬ )
হের কত জন আহা উদর-জ্বালায়
জননী ফেলিয়া শিশু ছুটিয়া পলায়—
তুলিয়া যুগল পাণি শিশু ডাকে ‘মা’  ‘মা’  বাণী,
   ক্ষুধায় জননী তার ফিরিয়া না চায়---
   একাকী  পড়িয়া শিশু পরাণে শুকায় !

                ( ৭ )
চলেছে প্রাণীর কুল এরূপে আকুল,
নৃত্য করে অনশন, মুক্ত করি চুল—
নৃত্য করে ভেরী নাদে, কঙ্কাল তুলিয়া কাঁধে,
   খপূর ধরিয়া করে করিছে ভ্রমণ—
   দেখ বঙ্গবাসি, দেখ মূর্ত্তি কি ভীষণ !

                ( ৮ )
ছুটিছে নয়নে বহ্নি স্ফুলিঙ্গ সমান ;
ফিরিছে উন্মত্ত ভাব উল্কার প্রমাণ ;
দন্ত ঘরষণে শব্দ           ভারতভুবন স্তব্ধ,
  করাল বিকট গ্রাস মুখের ব্যাদান—
  আকাশে উঠিছে সঙ্গে কালের নিশান !

             ( ৯ )
কতই উত্সবপূর্ণ গৃহস্থ আলয়,
নন্দিনী নন্দন রূপ, সুখপুষ্পময়,
আজি পূর্ণ কলরবে             অচিরে নীরব হবে,
   শকুনি বায়স কিম্বা পেচক আশ্রয় –
   ধরিবে শ্মশান বেশ মৃত অস্থিময় |

                ( ১০ )
কত সে জনতাপূর্ণ পণ্যবীথি হায়,
এ রাক্ষস অনাচারে হবে মরু প্রায় –
ভীষণ গহন সাজ,         ধরিবে পুরীর মাঝ
  পূরিবে বনের গুল্ম পাদপ লতায় |
   ভ্রমিবে শার্দ্দূল শিবা আনন্দে সেথায় |

    
                ( ১১ )
আজি হাসিভরা মুখে প্রফুল্ল যে সব,
আজি সুখপূর্ণ বুক আশার পল্লব,
কালি আর নাহি রবে        শবদেহ হবে সবে,
   শৃগাল কুক্কুরে করিবে উত্সব—
কর্ণমূলে গৃধ্র বসি শুনাইবে রব !

                ( ১২ )
কেমনে হে বঙ্গবাসি, নিদ্রা যাও সুখে ?
ভাবিয়া এ ভাব, চিত্ত ভরে না কি দুখে ?
নিজ সুত পরিবার       না জানিছে অনাহার,
    ভাবিয়ে, না চাহ কি হে অভুক্তের মুখে—
স্বজাতি-শোকের শেল বিন্ধে না কি বুকে ?

            ( ১৩ )
প্রিয়ে বলি গৃহে আসি ধর যবে কর,
হয় না উদয় কি রে হৃদয়-ভিতর---
কত সতী অনাথিনী        পথে পথে কাঙ্গালিনী
   ভ্রমিবে হতাশ হয়ে ত্যজি শূন্য ঘর—
   নাহি লজ্জা কুলমান, ক্ষুধায় কাতর !

                    ( ১৪ )
ক্রোড়ে ধরি হের যবে কন্যা পুত্রগণ,
ভাবিয়া জগৎ মাঝে অমূল্য রতন—
কভু কি পড়ে না মনে      সেই সব শিশুগণে
    অন্য বিনে মরে যারা করিয়া রোদন ?
    তাহার ও অইরূপ নয়ন-রঞ্জন

                  ( ১৫ )
হে বঙ্গ কুল কামিনী আর্য্যা যতজন,
জান যারা পতি পুত্র পিতা সে কেমন –
ভাব দেখি একবার        বদন সে সবাকার
   ঘরে যারা প্রাতঃসন্ধ্যা করে দরশন
   নিরন্ন বিষণ্ণ পতি, জনক, নন্দন !

                ( ১৬ )
একদিন অনশনে দিন যদি যায়,
জান না কি বঙ্গবাসী কি যাতনা তায় !
আজি সেই অনশনে         দারুণ হতাশ মনে
   লক্ষ নরনারী শিশু করে হায়, হায়—
   তবুও চেতনা কি হে নাহি হয় তায় !

                    ( ১৭ )
ভাব, অহে বঙ্গবাসী,  ভাব একবার
কি কাল রাক্ষস আসি ঘেরিয়াছে দ্বার—
নাশিতে সে দুরাচার            বৃটনের হুহুঙ্কার
   বৃটিশ কেশরীনাদ শুন একবার---
    ঘুমাইও না বঙ্গবাসী, ঘুমাইও না আর ;
    ভারতে কালের ভেরী বাজিল আবার ;
                                                                     

hemchandra bandyopadhyay ।। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়