এখন বাংলাদেশে কত বাড়ির কত হাঁড়িতে ভাত ফুটছে না,
এখন বাংলাদেশের কত উনুন হাঁ-করা কবরের মতো
শূন্যতাকে লালন করছে,
এখন বাংলাদেশে কত শীর্ণ হাত রুটি থেকে কতটা দূরে,
আমি জানি না,
আমি জানি না।
এই সুউচ্চ ভবনে কেউ খুন হয়েছে বলে আমি শুনিনি,
তবুও এর প্রতিটি সিঁড়ি খুব পুরনো রক্তের দাগ
বুকে নিয়ে নিশ্চুপ। ইতিহাসের চুলে বিলি কাটছে
বয়স্ক অন্ধকার।
আমি সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে বেয়ে এই দুর্গপ্রতিম ভবনের
শীর্ষ কোঠায় পৌছে দেখি, একটা কঙ্কাল দুলছে
কাকতাড়ুয়ার মতো আর কীটদষ্ট মখমলের
আলখাল্লার ওপর
চামচিকা নড়ছে, যেন কোনো হেঁপো রোগীর ফুসফুস!

আমি সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে বেয়ে আবার নেমে এলাম
খোলা পথে,
বুক ভরে নিলাম সতেজ বাতাস।
কতবার এমন ওঠানামা করবো, কতবার? কই, স্থবিরতার
চুক্তিপত্রে আমি তো সই করিনি, আমি
কোকিলের গানের মতো চির নতুন আর সজীব থাকতে চাই।

আমার মগজের ডাকবাক্সে জমা হচ্ছে অজস্র চিঠি,
বিলি করতে ভুলে যাই।
মুখমণ্ডলে একটা শ্মশান নিয়ে ঘুরে বেড়াই
সারাদিনমান;
দেখি সানগ্লাসের স্নিগ্ধতা শুষে নেয় এক জোড়া চোখ,
বুঝি অমনই ধকধকে হয় অনাহারী দৃষ্টি।
কিছু দৃশ্যের স্মৃতি ছাড়া আমার কোনো সঞ্চয় নেই,
প্রবল জুয়ায় খুইয়ে ফেলেছি কত রাত্রিদিন।
গোলাপ তুলতে গিয়ে প্রতিবার আমি দুঃখ তুলে আনি।
কবিতার পতাকা ছাড়া অন্য কোনো নিশান
উত্তোলিত হয়নি আমার হাতে,
কোনো প্রতিপক্ষের ভূভাগ
করিনি তছতছ, তবু আমাকে বিদ্রোহী বলে শনাক্ত করে ওরা
আমাকে কেউ জেরা করছে না, তবু আমি নিজেকে দেখছি
কাঠগড়ায়।
কী যেন বলছি বিড় সর্বক্ষণ, ভাষা নিজের
কাছেই ব্রাহ্মীলিপি।
আমার পেছনে কেউ নেই, মানে কোনো ফেউ-টেউ,
অথচ আমি চমকে উঠছি বারবার-মনে হয়,
কে যেন আমাকে অনুসরণ করছে অষ্টপ্রহর, নিজেকে
ভীষণ প্রেতায়িত লাগে।
আমার ডানে-বামে কোনো সশস্ত্র প্রহরী নেই,
আমার হাতে নেই হাতকড়া, অথচ আমি নিজেকে দেখছি
বন্দি অন্ধকার সেলে একা, কথা বলছি দেয়ালে সাঁটা
লোকটার সঙ্গে, চুপ মেরে যাচ্ছি কখনও-বা।
আমার বুক বিদ্ধ হয়নি বুলেটে, কেউ আমূল ছোরা
বসিয়ে দেয়নি পাঁজরে, তবু আমার বুক থেকে
ফিনকি দিয়ে
রক্ত ঝরছে আমার পূর্বপুরুষের
ক্রোধাগ্নিত মতো নির্জন রক্ত ঝরছে অবিরত।

Shamsur Rahman।। শামসুর রাহমান