আর্দ্র তীব্র পূর্ববায়ু বহিতেছে বেগে,
       ঢেকেছে উদয়পথ ঘননীল মেঘে।
       দূরে গঙ্গা, নৌকা নাই, বালু উড়ে যায়,
       বসে বসে ভাবিতেছি— আজি কে কোথায়! 
 
       শুষ্ক পাতা উড়ে পড়ে জনহীন পথে,
       বনের উতল রোল আসে দূর হতে।
       নীরব প্রভাত-পাখি, কম্পিত কুলায়,
       মনে জাগিতেছে সদা— আজি সে কোথায়! 
 
       কত কাল ছিল কাছে, বলি নি তো কিছু,
       দিবস চলিয়া গেছে দিবসের পিছু।
       কত হাস্যপরিহাস, বাক্য-হানাহানি,
       তার মাঝে রয়ে গেছে হৃদয়ের বাণী। 
 
       মনে হয় আজ যদি পাইতাম কাছে,
       বলিতাম হৃদয়ের যত কথা আছে।
       বচনে পড়িত নীল জলদের ছায়,
       ধ্বনিতে ধ্বনিত আর্দ্র উতরোল বায়। 
 
       ঘনাইত নিস্তব্ধতা দূর ঝটিকার,
       নদীতীরে মেঘে বনে হত একাকার।
       এলোকেশ মুখে তার পড়িত নামিয়া,
       নয়নে সজল বাষ্প রহিত থামিয়া। 
 
       জীবনমরণময় সুগম্ভীর কথা,
       অরণ্যমর্মরসম মর্মব্যাকুলতা,
       ইহপরকালব্যাপী সুমহান প্রাণ,
       উচ্ছ্বসিত উচ্চ আশা, মহত্ত্বের গান, 
       বৃহৎ বিষাদ ছায়া-বিরহ গভীর,
       প্রচ্ছন্ন হৃদয়রুদ্ধ আকাঙ্ক্ষা অধীর,
       বর্ণন-অতীত যত অস্ফুট বচন—
       নির্জন ফেলিত ছেয়ে মেঘের মতন। 
 
       যথা দিবা-অবসানে নিশীথনিলয়ে
       বিশ্ব দেখা দেয় তার গ্রহতারা লয়ে,
       হাস্যপরিহাসমুক্ত হৃদয়ে আমার
       দেখিত সে অন্তহীন জগৎ-বিস্তার। 
 
       নিম্নে শুধু কোলাহল খেলাধুলা হাস,
       উপরে নির্লিপ্ত শান্ত অন্তর-আকাশ।
       আলোকেতে দেখো শুধু ক্ষণিকের খেলা,
       অন্ধকারে আছি আমি অসীম একেলা। 
 
       কতটুকু ক্ষুদ্র মোরে দেখে গেছে চলে,
       কত ক্ষুদ্র সে বিদায় তুচ্ছ কথা ব’লে!
       কল্পনার সত্যরাজ্য দেখাই নি তারে,
       বসাই নি এ নির্জন আত্মার আঁধারে। 
 
       এ নিভৃতে, এ নিস্তব্ধে, এ মহত্ত্ব-মাঝে
       দুটি চিত্ত চিরনিশি যদি রে বিরাজে—
       হাসিহীন শব্দশূন্য ব্যোম দিশাহারা,
       প্রেমপূর্ণ চারি চক্ষু জাগে চারি তারা। 
 
       শ্রান্তি নাই, তৃপ্তি নাই, বাধা নাই পথে,
       জীবন ব্যাপিয়া যায় জগতে জগতে—
       দুটি প্রাণতন্ত্রী হতে পূর্ণ একতানে
       উঠে গান অসীমের সিংহাসন-পানে। 
<

Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর