কমলা বলিল, ‘তা করলেই বা। তারা যে পায়রা, লক্ষ্মীর বাহন, আর এরা যে দাঁড়কাক।’

কেশব ক্ষণকাল হাসিমুখে নিরুত্তর থাকিয়া বলিলেন, ‘তবুও, আমার বিশ্বাস হয় না মা।’

কমলা ক্ষুণ্ণ হইল। মুখখানি অপ্রসন্ন করিয়া সেইখানে হাঁটু গড়িয়া বসিয়া জ্যাঠামশায়ের জানুর উপর হাতের ভর দিয়া মুখ তুলিয়া বলিল, ‘কেন বিশ্বাস হয় না তোমার?’

কেশব বলিলেন, ‘আরো অনেক পাখির গলা চিকচিক করে মা, সেইজন্যই হয় না।’

কমলা কিছুক্ষণ স্থির হইয়া চিন্তা করিয়া অবিশ্বাসের স্বরে বলিল, ‘তা করুক জ্যাঠামশাই, কিন্তু, তারা ডাকবার সময় অমন ন্যাজ নিচু করে না—এরা ন্যাজ নিচু করে।’

কেশব বলিলেন, ‘ফিঙে পাখিও ন্যাজ নিচু করে।’

‘করে? কিন্তু, তাও যদি করে, তারা ত ছাতে বসে বাড়ি চিনিয়ে দেয় না। আর তারা ডাকলে ভয় করে না, কিন্তু এরা ডাকলে যে ভয় করে! আচ্ছা, তোমার করে না?

কেশব এ অকাট্য যুক্তি আর খণ্ডন করিতে পারিলেন না। ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ‘করে বৈ কি মা, আমারও ভয় করে।’

কমলা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘আমার বড্ড করে। আচ্ছা, জ্যাঠাইমা আমার ভাল হয়ে উঠচেন না কেন? একটা দাঁড়কাক কালও ডেকেচে। আজও একবার সকালে ডেকেচে—তাই, বৌদি বলছিলেন’—বলিয়াই সে সহসা থামিয়া গেল। এতক্ষণে কেশব বুঝিলেন, কেন কমলা দাঁড়কাকের বিরুদ্ধে নালিশ করিতে আসিয়াছে। তাঁহার স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরী প্রায় এক বৎসর হইতে পীড়িত হইয়া আছেন, কিছুতেই আরোগ্য হইতে পারিতেছিলেন না। বরং মাস-খানেক হইতে আরও যেন বৃদ্ধি পাইয়াছে। কাল সমস্ত দিন শয্যাত্যাগ করিতেও পারেন নাই। ছয় বৎসর পূর্বে সিদ্ধেশ্বরীর ছোটছেলের মৃত্যু হয়। তখন হইতেই তাঁহার দেহ ধীরে ধীরে ভাঙ্গিতেছিল। এই পাঁচ বৎসর ভাল-মন্দে কোনমতে কাটাইয়া গত বৎসর হইতে রীতিমত পীড়িত হইয়া পড়িয়া ছিলেন। কেশব যথাসাধ্য চিকিৎসার ত্রুটি করেন নাই, কিন্তু ফল হয় নাই। তাই ইদানীং তাঁহার আশঙ্কা হইতেছিল, বুঝিবা, সত্যই তাঁহার পরকালের ডাক পড়িয়াছে। এখন কমলার কথায় তাঁহার চোখ-দুটি ছলছল করিয়া উঠিল। কমলা তাহা লক্ষ্য করিয়াই তাঁহার জানুদ্বয়ের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল। কেশব জামার হাতায় চোখ মুছিয়া ফেলিয়া ভারী গলায় আস্তে আস্তে বলিলেন,—‘কাঁদিস নে মা, ভাল হয়ে যাবে।’

কমলা মুখ না তুলিয়াই প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘তবে, কেন ওরা অমন করে বলে?’

‘কে কি বলে মা?’

কমলা তেমনি করিয়াই জবাব দিল, ‘মা আর বৌদি। তারা ফিসফিস করে কি বলছিল—আমি যেতেই চুপ করলে, আমাকে শুনতে দিলে না।’

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়