এগার

পনর দিনের মধ্যে লিওর রীতিমত সংজ্ঞা হইল না; পনর দিন মেরি তাহার শয্যা ত্যাগ করিল না।

ডাক্তার বলিল, ‘মেরি, অত পরিশ্রম করিলে তুমিও পীড়িত হইয়া পড়িবে।’

মেরি ম্লান হাসিয়া উত্তর দিল, ‘ডাক্তার মহাশয়, এ সময়ে আমি পীড়ার ভয় করি না। এ স্থান ত্যাগ করিলেই আমার পীড়া হইবে।’

ডাক্তার বলিল, ‘আমি ধাত্রী আনাইয়া দিতেছি—দুইজনে পালা করিয়া শুশ্রূষা কর।’

মেরি মুখখানি আরও মলিন করিয়া বলিল, ‘তাহা হইবে না। এ সময়ে আমার কাহাকেও বিশ্বাস হয় না। গোলাপ ফুল বাসী হইয়াছে, রৌদ্রের তাপে বড় নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছে—এতটুকু আঘাতেই হয়ত ঝরিয়া যাইবে,—তখন তুমি কি তাহাকে ফিরাইয়া দিতে পারিবে?’

নিরুত্তরে ডাক্তার চলিয়া গেল।

রোগ বেশি নহে, তথাপি লন্ডন হইতে তিন-চারজন ডাক্তার মেরির বাটীতে এই পনর দিন ধরিয়া বসিয়া আছে। একদিন তাহারা বলিল, ‘অনর্থক আর কেন আমাদিগকে ধরিয়া রাখিয়াছ—রোগ সারিয়া গিয়াছে।’

মেরি তাহাদের হাত ধরিয়া কাতর-কণ্ঠে কহিল, ‘ওগো, তোমরা আমার লিওকে সম্পূর্ণ সুস্থ করিয়া আমার হাতে দিয়া—আমার সর্বস্ব লইয়া যাও—মানা করিব না কিন্তু এখন যাইও না—।’

তিন সপ্তাহ পরে লিওপোল্ড উঠিয়া বসিল। ডাক্তার এবং ঔষধের উপদ্রব আর নাই—। মেরি জানালা খুলিয়া দিল—আকাশে চাঁদ উঠিয়াছিল,—জ্যোৎস্না ঘরে আসিয়া পড়িল—মেরি চাঁদের পানে চাহিয়া সহসা লিওর বুকের উপর আসিয়া পড়িল। নিঃশব্দে অনেকক্ষণ বুকের উপরে অশ্রুসিক্ত করিল, তাহার পর চাঁদের পানে চাহিয়া বলিল, ‘ঐ দেখ, এখনও চাঁদের ভিতর কলঙ্ক বসিয়া আছে,—তোমারও কলঙ্ক তোমার বুকের উপর স্থান পাতিয়া বসিয়াছে,—তাড়াইবে কি করিয়া?’

লিওর চক্ষেও জল আসিল; সংবরণ করিয়া কহিল, ‘কলঙ্কই হউক, শোভাই হউক—বুকের উপর বড় দৃঢ় বসিয়াছে—পরিত্যাগ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।’

তাহার পর একদিন বসন্ত প্রভাতে কোরেল গ্রামের গির্জায় বড় ধুমধামের সহিত ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। সমস্ত গ্রামবাসী বড় জাঁকজমকের সহিত প্রফুল্ল মনে সেই দিকপানে ছুটিয়া চলিয়াছে—।

সেখানে কি হইতেছে তোমরা কেহ জিজ্ঞাসা করিবে কি?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়