ব্রহ্মাণ্ডে আছে কি? আছে আমার চৈতন্য এবং তদ্বিষয়ীভূত যাবতীয় পদার্থ। অন্তর্জগৎ এবং বাহ্যজগৎ। উভয়ে কি সম্বন্ধ এবং সে সম্বন্ধ সত্য কিংবা অলীক, সে আলাদা কথা। কিন্তু এই যে পরিচয় গ্রহণ, একের উপরে অপরের কার্য, ইহাই মানবের ভাব এবং চিন্তা। এবং এই পদার্থ নিশ্চয়ই মানবের চিন্তার বিষয়। এমনি করিয়াই সমস্ত স্থূল বিশ্ব একে একে মানবের ভাব-রাজ্যের আয়ত্ত হইয়া পড়ে। ঘর-বাড়ি, সমাজ, দেশ প্রভৃতি যাবতীয় পদার্থ এক-একটি চিন্তার জন্মদান করিয়া ইহারাই মানব-চিত্তে এক-একটি ভাব উৎপন্ন করে। অন্তর্জগৎ ও বাহ্যজগৎ উভয়েই বিচিত্র তথ্য ও ঘটনায় ভরিয়া উঠে। উভয় জগতের এইসব তথ্য ও ঘটনা ছাড়া মানুষ ভাবিতেই পারে না। অর্থাৎ ইহাদের দ্বারাই মানবচিত্ত আন্দোলিত হইয়া ইহাতেই পরিপূর্ণ হইয়া যায়। এক কথায় ইহারা ভাব ও ধারণার কারণও বটে, ইহারা তাহার বিষয়ও বটে।

এইবার মনের মধ্যে পদার্থের পরীক্ষা হইতে থকে। ভাব ও চিন্তার কাছে তাহাদের প্রকৃতি ও স্বরূপ ধরা পড়ে, ধর্ম ও গুণের হিসাবে নানা লক্ষণবিশিষ্ট হইয়া বাহ্যজগৎ এইবার ধীরে ধীরে সীমাবদ্ধ ও নির্দিষ্ট হইতে থাকে।

মানবের ভাব ও চিন্তাই যাবতীয় পদার্থে গুণের আরোপ করে। সে কি, আর একটার সহিত তাহার কি প্রভেদ স্থির করিয়া দেয়। তারপর পদার্থের সহিত পদার্থের তুলনা করিয়া সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া লক্ষণ নির্ণয় করিয়া ধর্মবিশিষ্ট করিয়া আমরা তাহাদের ধারণা-কার্য সম্পূর্ণ করি।

বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন সময়ের মানব-চিন্তা-প্রণালী পর্যালোচনা করিলে স্পষ্ট দেখা যায়, এই চিন্তা-প্রণালী কয়েকটা সাধারণ নিয়মের অন্তর্গত। একই নিয়মে মানবের চিন্তারাশি পরিপক্ক ও সম্পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।

যেমন বাহ্যজগতে দেখা যায়, কোন দুটি বস্তু একই সময়ে একই স্থান অধিকার করিতে পারে না অন্তর্জগতেও ঠিক তাই। সেখানেও কোন দুটি বস্তু এক সঙ্গেই চিত্ত অধিকার করিতে পারে না। সেই জন্যই আমরা কোনমতেই এক সঙ্গে একই আয়াসে দুটি বস্তুর পরিচয়-লাভ কিংবা একটি বস্তুর দুটি গুণনির্ণয় করিতে পারি না। আমরা বিষয় ভাগ করিয়া একটি একটি করিয়া লক্ষণ স্থির করি। অর্থাৎ চিন্তার কার্য ক্রমশঃ নিষ্পন্ন হয়। অন্তর্জগতে মন যেমন দুটি বস্তু বা দুটি গুণ এক সঙ্গে গ্রাহ্য করে না, বাহ্যজগতে পদার্থও তেমনি তাহার সব-কটা গুণই একই সময়ে মানব-চিত্তের কাছে প্রকাশ করে না। যুবতী রমণীর রূপ শিশুচিত্তের কাছে ধরা দেয় না। সে রূপের মূল্য উপলব্ধি করিবার জন্য শিশুচিত্তকে একটা নির্দিষ্ট বয়সের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতে হয়।

এই জন্য ভাবের ক্রমিক বিকাশ, বয়োবৃদ্ধি ও ধারণা-শক্তির বিকাশের উপর নির্ভর করে। এবং তাহার উপর ভাব ও চিন্তার সংখ্যাবৃদ্ধি হয়।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়