তারপরে সাহিত্য। আমার মনে হয়, সর্বত্র এবং সকল সময়েই ভাষা ও সাহিত্য অচ্ছেদ্য বন্ধনে গ্রথিত। যেন পদার্থ ও তাহার ছায়া। অবশ্য প্রমাণ করিতে পারি না যে, পশুদের ভাষা আছে বলিয়া সাহিত্যও আছে। যাঁহারা ‘নাই’ বলেন, তাঁহাদের অস্বীকার খণ্ডন করিবার যুক্তি আমার নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না যে, ভাষা আছে কিন্তু সাহিত্য নাই।

ভাষা-বিজ্ঞানবিদেরা বলেন, মানবের কোন্‌ অবস্থায় তাহার প্রথম সাহিত্য-সৃষ্টি তাহা বলিবার জো নাই, খুব সম্ভব, যেদিন হইতে তাহার ভাষা, সেই দিন হইতে তাহার সাহিত্য। যেদিন হইতে সে তাহার হত দলপতির বীরত্ব-কাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিয়া বলিয়াছিল, যেদিন হইতে প্রণয়ীর মন পাইবার অভিপ্রায়ে সে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করিয়াছিল, সেই দিন হইতেই তাহার সাহিত্য।

তাই যদি হয়, কে জোর করিয়া বলিতে পারে পশু-পক্ষীর ভাষা আছে অথচ সাহিত্য নাই? আমি নিজে অনেক রকমের পাখি পুষিয়াছি, অনেক বার দেখিয়াছি তাহারা প্রয়োজনের বেশি কথা কহে, গান গাহে। সে কথা, সে গান আর একটা পাখি মন দিয়া শুনে। আমার অনেক সময় মনে হইয়াছে, উভয়েই এমন করিয়া তৃপ্তির আস্বাদ উপভোগ করে, যাহা ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তির অতিরিক্ত আর কিছু। তখন, কেমন করিয়া নিঃসংশয়ে বলিতে পারি ইহাদের ভাষা আছে, গান আছে কিন্তু সাহিত্য নাই? কথাটা হয়ত হাসির উদ্রেক করিতে পারে, পশু-পক্ষীর সাহিত্য! কিন্তু সেদিন পর্যন্ত কে ভাবিতে পারিয়াছিল গাছপালা সুখদুঃখ অনুভব করে? শুধু তাই নয়, সেটা প্রকাশও করে। তেমনি হয়ত, আমার কল্পনাটাও একদিন প্রমাণ হইয়া যাইতেও পারে।

যাক ও কথা। আমার বলিবার বিষয় শুধু এই যে, ভাষা থাকিলেই সাহিত্য থাকা সম্ভব; তা সে যাহারই হোক এবং যেখানেই হোক। অনুভূতির পরিণতি যেমন ভাব ও চিন্তা, ভাষার পরিণতিও তেমনি সাহিত্য। ভাব প্রকাশ করিবার উপায় যেমন ভাষা, চিন্তা প্রকাশ করিবার উপায়ও তেমনি সাহিত্য। জাতির সাহিত্যই শুধু জানাইয়া দিতে সক্ষম সে জাতির চিন্তাধারা কোন্‌ দিকে কোথায় এবং কতদূরে গিয়া পৌঁছিয়াছে। দর্শন, বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ, এমন কি যুদ্ধবিদ্যার জ্ঞান ও চিন্তাও দেশের সাহিত্যই প্রকাশ করে।

একবার বলিয়াছি, ভাষা ছাড়া চিন্তা করা যায় না। তাই জগতে যাঁহারা চিন্তাশীল বলিয়া খ্যাত,তা সে চিন্তার যে-কোন দিকই হউক, মাতৃভাষায় দেশের সাহিত্যে তাঁহারা ব্যুৎপন্ন এ কথা বোধ করি অসংশয়ে বলা যায়।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকদের প্রতি চোখ ফিরাইলে এই সত্য অতি সহজেই সপ্রমাণ হয়। তাঁহারা দর্শন বা বিজ্ঞান লইয়াই থাকেন, লোকে তাঁহাদের চিন্তার ঐ দিকটার পরিচয় পায়, কিন্তু, দৈবাৎ কোন প্রকাশ পাইলে, বৈজ্ঞানিকের অসাধারণ সাহিত্য-ব্যুৎপত্তি দেখিয়া লোকে বিস্ময়ে অবাক হইয়া যায়। বিলাতের হক্‌সলি, টিন্‌ডল, লজ, ওয়ালেশ, হেল্‌ম হোজ, হেকেল প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকেরা খুব বড় সাহিত্যিক। আমাদের জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্রও কোন খ্যাত সাহিত্যিক অপেক্ষা ছোট নহেন।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়