একাদশীর গলা বাড়াইয়া দেখিয়া বলিল, দেখি তোর ওদিকের ট্যাঁকটা?

নফর বাঁ-দিকের ট্যাঁকটা দেখাইয়া অভিমানভরে কহিল, দুটো পয়সার জন্যে মিছে কথা কইচি কর্তা? যে শালা পয়সা এনেও তোমাদের ঠকায়, তার মুখে পোকা পড়ুক, এই বলে দিলুম।

একাদশী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া কহিল, তুই চারটে পয়সা ধার করে আনতে পারলি আর দুটো এমনি ধার করতে পারলি নে?

নফর রাগিয়া কহিল, মাইরি দিলাসা করলুম না কর্তা! মুখে পোকা পড়ুক।

অপূর্বর গা জ্বলিয়া যাইতেছিল, সে আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, আচ্ছা লোক তুমি মশায়!

একাদশী একবার চাহিয়া দেখিল মাত্র, কোন কথা কহিল না। পরাণ বাগদী সম্মুখের উঠান দিয়া যাইতেছিল। একাদশী হাত নাড়িয়া ডাকিয়া কহিল, পরাণ, নফ্‌রার কাছাটা একবার খুলে দেখ ত রে, পয়সা দুটো বাঁধা আছে নাকি?

পরাণ উঠিয়া আসিতেই নফর রাগ করিয়া তাহার কাছার খুঁটে বাঁধা পয়সা দুটো খুলিয়া একাদশীর সুমুখে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। একাদশী এই বেয়াদপিতে কিছুমাত্র রাগ করিল না। গম্ভীর মুখে পয়সা ছটা বাক্সে তুলিয়া রাখিয়া গোমস্তাকে কহিল, ঘোষালমশাই, নফ্‌রার নামে সুদ আদায় জমা করে নেন। হাঁ রে, একটা টাকা কি আবার করবি রে?

নফর কহিল, আবশ্যক না হলেই কি এয়েচি মশাই?

একাদশী কহিল, আট আনা নিয়ে যা না! গোটা টাকা নিয়ে গেলেই ত নয়-ছয় করে ফেলবি রে!

তার পরে অনেক ঘষা-মাজা করিয়া নফর মোড়ল বারো আনা পয়সা কর্জ লইয়া প্রস্থান করিল।

বেলা বাড়িয়া উঠিতেছিল। অপূর্বর সঙ্গী অনাথ চাঁদার খাতাটা একাদশীর সম্মুখে নিক্ষেপ করিয়া কহিল, যা দেবেন দিয়ে দিন মশাই, আমরা আর দেরি করতে পারিনে।

একাদশী খাতাটা তুলিয়া লইয়া প্রায় পনর মিনিট ধরিয়া আগাগোড়া তন্ন তন্ন করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া শেষে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া খাতাটা ফিরাইয়া দিয়া বলিল, আমি বুড়োমানুষ, আমার কাছে আবার চাঁদা কেন?

অপূর্ব কোনমতে রাগ সামলাইয়া কহিল, বুড়োমানুষ টাকা দেবে না ত কি ছোট ছেলেতে টাকা দেবে? তারা পাবে কোথায় শুনি?

বুড়ো সে কথার উত্তর না দিয়া কহিল, ইস্কুল ত হয়েচে কুড়ি-পঁচিশ বছর; কৈ, এতদিন ত কেউ লাইব্রেরীর কথা তোলেনি বাপু? তা যাক, এ ত আর মন্দ কাজ নয়, আমাদের ছেলেপুলে বই পড়ুক, আর না পড়ুক, আমার গাঁয়ের ছেলেরাই পড়বে ত! কি বল ঘোষালমশাই? ঘোষাল ঘার নাড়িয়া কি যে বলিল, বোঝা গেল না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়