এককড়ি। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হতে পারে। আর রূপের কথা যদি বলেন হুজুর ত সে যেন এক কাটখোট্টা সিপাই! না আছে মেয়েলি ছিরি, না আছে মেয়েলি ছাঁদ। যেন চূয়াড়, যেন হাতিয়ার বেঁধে লড়াই করতে চলেছে। তাতেই ত দেশের ছোটলোকগুলো মনে করে গড়ের উনিই হচ্চেন সাক্ষাৎ চণ্ডী।
জীবানন্দ। (উৎসাহ ও কৌতূহলে সোজা উঠিয়া বসিয়া) বল কি এককড়ি? ভৈরবীর ব্যাপারটা কি খুলে বল ত শুনি?
এককড়ি। ভৈরবী ত কারু নাম নয় হুজুর। গড়চণ্ডীর প্রধান সেবিকাদের ওই হলো উপাধি। বর্তমান ভৈরবীর নাম ষোড়শী, এর আগে যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল মাতঙ্গিনী। মার আদেশে তাঁর সেবায়েত কখনো পুরুষ হতে পারে না, চিরদিন মেয়েরাই হয়ে আসছে।
জীবানন্দ। তাই নাকি? এ ত কখনো শুনিনি।
এককড়ি। মায়ের আদেশে বিয়ের তেরাত্রি পরে স্বামীকে আর ভৈরবীর স্পর্শ করবারও জো নেই। তাই দূরদেশ থেকে দুঃখী গরীবদের একটা ছেলে ধরে এনে বিয়ে দিয়ে পরের দিনই টাকাকড়ি দিয়ে সেই যে বিদায় করা হয়, আর কখনো কেউ তার ছায়াও দেখতে পায় না। এই নিয়ম, এই-ই চিরকাল ধরে হয়ে আসচে।
জীবানন্দ। (সহাস্যে) বল কি এককড়ি, একেবারে দেশান্তর? ভৈরবী মানুষ, রাত্রে নিরিবিলি একপাত্র সুধা ঢেলে দেওয়া—গরমমশলা দিয়ে চারটি মহাপ্রসাদ রেঁধে খাওয়ানো—একেবারে কিছুই করতে পায় না?
এককড়ি। (মাথা নাড়িয়া) না হুজুর, মায়ের ভৈরবীকে স্বামী স্পর্শ করতে নেই, কিন্তু তাই বলে কি স্বামী ছাড়া গাঁয়ে আর পুরুষ নেই? মাতু ভৈরবীকেও দেখেচি, ষোড়শী ভৈরবীকেও দেখছি। লোকগুলো কি আর খামকা—তার সাক্ষী দেখুন না—কথায় কথায় হুজুরের সঙ্গে মামলা-মকর্দমা বাধিয়ে দেয়!
জীবানন্দ। মেয়ে-মোহন্ত আর কি! তাতে দোষ নেই। এককড়ি আলোটা জ্বালো ত।
এক কড়ি। (আলো জ্বালিয়া) এখন আসি হুজুর।
জীবানন্দ। আচ্ছা যাও। বইখানা দিয়ে যাও ত।
[বই দিয়া প্রণাম করিয়া এককড়ি প্রস্থান করিল
[জীবানন্দ শুইয়া পুস্তকে মনোনিবেশ করিলেন। একটু পরে বাহিরে কাহার পায়ের শব্দ হইল।]
জীবানন্দ। কে?
সর্দার। (ষোড়শীকে লইয়া প্রবেশ করিয়া কহিল) শালা তারাদাস ভাগ্ গিয়া। হুজুর, উস্কো বেটীকো পাকড় লায়া।
জীবানন্দ। (বই ফেলিয়া ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বিস্মিতভাবে) কাকে? ভৈরবীকে? (কিছুক্ষণ পরে) ঠিক হয়েছে। আচ্ছা যা।
[সর্দার অনুচর পাইকদের লইয়া প্রস্থান করিল
জীবানন্দ। তোমাদের আজ টাকা দেবার কথা। টাকা এনেচ? (ষোড়শীর কণ্ঠস্বর ফুটিল না) আনো নি জানি। কিন্তু কেন?
ষোড়শী। আমাদের নেই।
জীবানন্দ। না থাকলে সমস্ত রাত্রি তোমাকে পাইকদের ঘরে আটকে থাকতে হবে। তার মানে জানো।
[ষোড়শী দ্বারের চৌকাঠটা দুই হাতে সবলে চাপিয়া ধরিয়া চোখ বুজিয়া মূর্ছা হইতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতে লাগিল; এই ভয়ানক বিবর্ণ মুখের চেহারা জীবানন্দের চোখে পড়িল, মিনিট-খানেক সে কেমন যেন আচ্ছন্নের ন্যায় বসিয়া রহিল। তারপরে বাতির আলোটা হঠাৎ হাতে তুলিয়া লইয়া ষোড়শীর কাছে গেল। আলোটা তাহার মুখের সম্মুখে ধরিয়া একদৃষ্টে ষোড়শীর গৈরিক বস্ত্র, তাহার এলায়িত রুক্ষ কেশভার, তাহার পাণ্ডুর ওষ্ঠাধর, তাহার সবল সুস্থ ঋজু দেহ, সমস্তই সে যেন দুই বিস্ফারিত চক্ষু দিয়া নিঃশব্দে গিলিতে লাগিল। এই ভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়া গেলে পর]
জীবানন্দ। (ফিরিয়া গিয়া আলোটা রাখিয়া দিয়া মদের বোতল হইতে কয়েক পাত্র উপর্যুপরি পান করিয়া) তোমার নাম ষোড়শী, না? (ষোড়শী নীরব) তোমার বয়স কত? (কোন উত্তর না পাইয়া কঠিন-স্বরে) চুপ করে থেকে বিশেষ কোন লাভ হবে না, জবাব দাও।
ষোড়শী। (মৃদু-স্বরে) আমার বয়স আটাশ।
নাটক : ষোড়শী Chapter : 1 Page: 5
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 271