আমরা কতদিকেই না নিরুপায়! অনেকে বলেন, বিদেশী রাজশক্তি আমাদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে একেবারে অমানুষ করে রেখেছে। অভিযোগ যে অসত্য তা আমি বলিনে, কিন্তু এই কি সমস্ত সত্য? অস্ত্রশস্ত্র আজই না হয় নেই, কিন্তু হাজার বছর ধরে করেছিলাম কি? তখন ত Arms Act জারি হয়নি! সবচেয়ে বেশী নিরুপায় করেছে—আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আত্মকলহ। তাই বার বার মোগল-পাঠান-ইংরাজের পায়ে আমাদের মাথা মুড়ানো গেছে। পৃথিবীর সমস্ত শক্তিমান জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আত্মকলহ তাদের মধ্যে থাকে না যে তা নয়, কিন্তু বহিঃশত্রুর সম্মুখে সে কলহ তারা স্থগিত রাখতে জানে। শত্রুকে সম্পূর্ণ পরাভূত না করা পর্যন্ত তারা কিছুতেই ঘরোয়া বিবাদে লিপ্ত হয় না। এই তাদের সবচেয়ে বড় জোর। কিন্তু আমাদের? জয়চাঁদ, পৃথ্বিরাজ থেকে শুরু করে সিরাজদ্দৌলা ও মীরজাফরেও এই মজ্জাগত অভিশাপ আর ঘুচল না। বাঙ্গালাদেশ মুসলমানেরা জয় করতে এলো। এদেশে ব্রাত্য-বৌদ্ধেরা খুশী হয়ে তাদের ধর্মদেবতার যশোগান করে ‘ধর্মমঙ্গলে’ লিখলেন —
“ধর্ম্ম হইলা যবনরূপী
মাথায় দিলা কালোটুপী
ধর্ম্মের শত্রু করিতে বিনাশ।”
অর্থাৎ বিদেশী মুসলমানরা যে হিন্দুধর্মাবলম্বী প্রতিবেশী বাঙ্গালী ভায়াদের দুঃখ দিতে লাগল, এতেই তাঁরা পরমানন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলেন। এই ত সেদিনের কথা—নিজেদের মধ্যে লড়াই করতেই অতবড় বিরাট্পুরুষ চিত্তরঞ্জনের সমস্ত আয়ু নিঃশেষ হয়ে গেল। আজও কি তার বিরাম আছে? এই যে যুব-সংঘ, খোঁজ করলেই দেখা যাবে এর মধ্যেও তেরটা দল। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই—এর কতরকমের মতভেদ, কতরকমের মান-অভিমানের অ-বনিবনাও— পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মত অস্থির, কখন গড়িয়ে আলাদা হয়ে গেল বলে। বাইরে থেকে জড়ো করে ভিড় করার নাম কি organisation? Organic দেহবস্তুর মত এর পায়ের নখে ঘা দিলে কি মাথার চুল শিউরে ওঠে? কিন্তু যেদিন উঠবে, সেদিন উপায়হীনতার নালিশও অন্ততঃ বাঙ্গালাদেশে উঠবে না।
ভাবি, সেই ত সনাতন সংস্কার! শত্রু এসে সদর দরজায় ঘা দিচ্ছে, তবু দলাদলি আর মিটল না! অথচ এদের পরেই দেশের আজ সমস্ত আশা-ভরসা! কবে যে এর মীমাংসা হবে, তা জগদীশ্বরই জানেন।
আগেকার দিনে দিগ্বিজয়ের গৌরব অর্জন করার জন্যে প্রধানতঃ রাজারা রাজ্যজয়ে বার হতেন, কিন্তু এখন দিনকাল বদলে গেছে। এখন রাজা নেই, আছে রাজশক্তি। এবং সেই শক্তি আছে জন-কয়েক বড় ব্যবসাদারের হাতে। হয় স্বহস্তে করেন, না হয় লোক দিয়ে করান। বণিক্-বৃত্তিই এখন মুখ্যতঃ রাজনীতি। শোষণের জন্যেই শাসন। নইলে তার বিশেষ কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। দশ-পনের বছর পূর্বে যে জগৎ-ব্যাপী সংগ্রাম হয়ে গেল, তার গোড়াতেও ছিল ঐ এক কথা—ঐ বাজার ও খদ্দের নিয়ে দোকানদারের কাড়াকাড়ি।
প্রবন্ধ : তরুনের বিদ্রোহ Chapter : 1 Page: 6
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 210