অরুণ অবাক হয়ে তার পানে চেয়ে রইল, প্রশ্নটা যেন সে বুঝতেই পারলে না।

ক্ষিতীশ পুনরায় বললে, কে জানে আর হয়ত আমাদের দেখাই হবে না,—আমিও আজ দুপুরের গাড়িতে পশ্চিমে চললুম ভাই।

অরুণ এ কথারও কোন জবাব দিতে পারলে না, কিন্তু বালক হলেও সে এটুকু বুঝতে পারল যে, ক্ষিতীশদার কণ্ঠস্বর কান্নার জলে যেন একেবারে মাখামাখি হয়ে গেছে।

ক্ষিতীশ প্রত্যুত্তরে আশা না করেই বললে, তুমি ছেলেমানুষ, তোমার ওপর যে কত বড় ভার পড়ল এ হয়তো তুমি জানোও না, কিন্তু ভগবানের কাছে আমি কায়মনে প্রার্থনা করি, তোমাদের আজকের যাত্রাটা যেন তিনি সকল প্রকারে নির্বিঘ্ন কোরে দেন।

এই বলে সে তার বালিশের তলা থেকে একখানা খাম বার করে অরুণের হাতে গুঁজে দিতে গেল। অরুণ হাতটা সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে, এ কি ক্ষিতীশদা?

সামান্য গোটা-কয়েক টাকা আছে অরুণ।

কিন্তু ভাড়ার টাকা ত আমার কাছে আছে ক্ষিতীশদা।

তা থাক। তবু ছোট ভাইদের যাবার সময় কিছু হাতে দিতে হয়। এই বোলে সে অরুণের কোঁচার খুঁটটা টেনে নিয়ে তাতে বাঁধতে বাঁধতে বললে, তোমার ত কেউ বড় ভাই নেই অরুণ, তাই জানো না, নইলে তিনিও এমনি করেই বেঁধে দিতেন, দাদার স্নেহের উপহার বলে নিতে কিছু লজ্জা কোরো না ভাই! তোমার দিদি কখনো যদি জানতে পেরে জিজ্জাসা করেন, তাঁকেও এই কথাটাই বোলো।—এই বলে সে সেটা যথাস্থানে পুনরায় গুঁজে দিয়ে হাত ধরে তাকে বাইরে এনে বললে, আর সময় নেই অরুণ, তুমি যাও ভাই, সাড়ে-চারটে বেজে গেছে। ওঁরা বোধ করি বড্ড ব্যস্ত হচ্ছেন—এই বলে সে একরকম তাকে জোর করে বিদায় কোরে দিলে।

অরুণ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলে, আপনি কতদিন পশ্চিমে থাকবেন ক্ষিতীশদা?

সে কথা আজ কি কোরে বলব ভাই?

মিনিট-খানেক পরে অরুণ গিয়ে যখন গাড়িতে উঠে বোসলো, তখন তাকে একাকী দেখে কমলা কোন প্রশ্নই করলে না, কিন্তু হরেন জিজ্ঞাসা করলে, ক্ষিতীশ এলো না অরুণ—

তার জবাবটা ক্ষিতীশ নিজেই দিলে। সে উপরের বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বললে, শরীরটা আমার ভাল নেই হরেন, আর ঠাণ্ডা লাগাবো না।

হরেন একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললে, ভাল নেই? তাহলে হিমে আর দাঁড়িয়ো না ক্ষিতীশ, ঘরে যাও, আমি এদের পৌঁছে দিয়ে এসে তোমাকে জানাবো।

মোটর ছেড়ে দিলে। হরেনের উপদেশ তার কানে গেল কিনা কে জানে, কিন্তু গাড়ি যখন বহুক্ষণ তার চোখের বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল, তখনও সে তেমনি সেই দিকে চেয়ে তেমনি স্তব্ধ হয়েই দাঁড়িয়ে রইল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়