তিন
পথিক যেমন গাছতলায় রাঁধিয়া খাইয়া হাঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যায় এবং তখন যেমন চাহিয়া দেখে না হাঁড়িটা ভাঙ্গিল কি বাঁচিল, সংসারে শতকরা নব্বই জন লোক ঠিক এমনি করিয়াই সরস্বতীর কাছ হইতে কাজ আদায় করিয়া মা-লক্ষীর রাজপথের ধারে নির্মমভাবে তাঁহাকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দেয়—একবার ফিরিয়াও দেখে না, তিনি ভাঙ্গিলেন কি বাঁচিলেন। গুণেন্দ্র সেইরূপ করে নাই। সে চিরদিন যেভাবে শ্রদ্ধা করিয়া সেবা করিয়া আসিয়াছিল, উকিল হইয়াও ঠিক তেমনি করিয়াই সরস্বতীর সেবা করিতে লাগিল। তাহার পড়িবার ঘর পুস্তকে ভরিয়া উঠিয়াছিল; সেই ঘরের মধ্যে হেমনলিনী ভারী আশ্রয় পাইল। গুণেন্দ্র গুছান প্রকৃতির লোক ছিল না বলিয়া তাহার যে পুস্তক একবার আলমারির বাহিরে আসিত, তাহা শীঘ্র আর ভিতরে প্রবেশ করিতে পাইত না। টেবিল, চেয়ার, অবশেষে নীচের গালিচার উপর পড়িয়া সুদীর্ঘকাল পরে যদি কোনগতিকে নন্দার সাহায্যে ভিতরে প্রবেশ করিত, আবশ্যক হইলে আর বাহির হইত না—এমনি মিশিয়া যাইত। একটা পুস্তকের তালিকাও তাহার ছিল বটে, কিন্তু সেটাকে কাজে লাগাইবার কিছুমাত্র উপায় ছিল না।
হেম এই বিশৃঙ্খলা দুই-চারদিনের মধ্যেই ঠিক করিয়া ফেলিল। একদিন একটা আলমারি খালি করিয়া সমস্ত বই নীচে নামাইয়াছে, এমন সময়ে গুণেন্দ্র ঘরে ঢুকিল। তাহাকে দেখিয়া হেম বলিল, গুণীদাদা, এই বইগুলো ওই আলমারিতে, আর ওই বইগুলো এই আলমারিতে রাখলে ভারি সুবিধে হয়।
গুণেন্দ্র চাহিয়া দেখিয়া বলিল, কি সুবিধে হয়?
হেম বলিল, বাঃ, সুবিধে হবে না? দেখচ না, এই বইগুলো এইটাতে রাখলে কেমন—
গুণেন্দ্র গম্ভীর হইয়া বলিল, দেখতে পাচ্চি বটে, খুব সুবিধে হবে।
হেম একটা চৌকির উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, যাও—করব না, তোমার ভাল করতে নেই।
গুণেন্দ্র একখানা বই তুলিয়া হাসিয়া বাহিরে চলিয়া গেল।
এই ঘরটিতে হেমনলিনী দিবারাত্র থাকিত বলিয়া, গুণেন্দ্র আজকাল তাহার শোবার ঘরে বসিয়াই পড়াশুনা করিত। একদিন রবিবারের দুপুরবেলা হেম বাহির হইতে ডাকিয়া বলিল, গুণীদা, আসব?
গুণী ভিতর হইতে বলিল, এস।
হেম ঘরে ঢুকিয়াই বলিল, তুমি সব সময়ে এই শোবার ঘরে বসেই বই পড় কেন?
দোষ কি? এ ঘরে কি বিদ্যে কম হয়?
তোমার পড়বার ঘরেই কি এতদিন কম হয়েছিল?
গুণেন্দ্র বলিল, কম হয়নি বটে, কিন্তু কাঁচা হয়েছিল—এই ঘরে সেগুলো পাকছে।
হেম প্রথমে হাসিয়া উঠিল, কিন্তু কথাটা বুঝিতে না পারিয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, তোমার কেবল তামাশা। একটা কথাও কি তুমি সোজা করে বলতে জান না?
গুণী নিঃশব্দে হাসিতে লাগিল, জবাব দিল না।
হেম বলিল, আমি কিন্তু জানি। ও ঘরে আমি থাকি বলেই তুমি যাও না। আমাকে তুমি লজ্জা কর। আমি কিন্তু তোমাকে একটুকুও লজ্জা করিনে।
গল্প : পথ-নির্দেশ Chapter : 3 Page: 6
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 238