দেবদাস মুখ ফিরাইয়া অশ্রু মুছিল; বলিল, না ধর্মদাস, মাকে এ মুখ দেখাতে ইচ্ছা হয় না,—আমার এখনো বোধ করি সে সময় আসেনি।
বৃদ্ধ ধর্মদাস হাউহাউ করিয়া কাঁদিয়া কহিল, দাদা, এখনো যে মা বেঁচে আছেন!
কথাটায় কতখানি যে প্রকাশ করিল, তাহা অন্তরে উভয়েই অনুভব করিল। দেবদাসের অবস্থা অত্যন্ত মন্দ হইয়াছে। সমস্ত পেট প্লীহা—লিভারে পরিপূর্ণ ; তাহার উপর জ্বর, কাশি। রঙ গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ, দেহ অস্থিচর্মসার। চোখ একেবারে ঢুকিয়া গিয়াছে, শুধু একটা অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় চকচক করিতেছে। মাথায় চুল রুক্ষ ও ঋজু—চেষ্টা করিলে বোধ হয় গুনিতে পারা যায়।হাতের আঙ্গুলগুলার পানে চাহিলে ঘৃণা বোধ হয়— একে শীর্ণ, তাহাতে আবার কুৎসিত ব্যাধির দাগে দুষ্ট। স্টেশনে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথাকার টিকিট কিনব দেব্তা?
দেবদাস ভাবিয়া চিন্তিয়া কহিল, চল বাড়ি যাই—তার পর সব হবে।
গাড়ির সময় হইলে তাহারা হুগলির টিকিট কিনিয়া চাপিয়া বসিল।
ধর্মদাস দেবদাসের নিকটেই রহিল। সন্ধ্যার পূর্বে দেবদাসের চোখ জ্বালা করিয়া আবার জ্বর আসিল। ধর্মদাসকে ডাকিয়া কহিল, ধর্মদাস, আজ মনে হচ্চে, বাড়ি পৌঁছানও হয়ত কঠিন হবে।
ধর্মদাস সভয়ে কহিল, কেন দাদা?
দেবদাস হাসিবার চেষ্টা করিয়া শুধু বলিল, আবার যে জ্বর হল ধর্মদাস।
কাশীর পথ যখন পার হইয়া গেল, দেবদাস তখন জ্বরে অচেতন। পাটনার কাছাকাছি তাহার হুঁশ হইল, কহিল, তাইত ধর্মদাস, মায়ের কাছে যাওয়া সত্যিই আর ঘটল না।
ধর্মদাস কহিল, চল, দাদা, আমরা পাটনায় নেমে গিয়ে ডাক্তার দেখাই—
উত্তরে দেবদাস বলিল, না থাক, আমরা বাড়ি যাই চল।
গাড়ি যখন পাণ্ডুয়া স্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন ভোর হইতেছে। সারারাত্রি বৃষ্টি হইয়াছিল, এখন থামিয়াছে। দেবদাস উঠিয়া দাঁড়াইল। নীচে ধর্মদাস নিদ্রিত। ধীরে ধীরে একবার তাহার ললাট স্পর্শ করিল, লজ্জায় তাহাকে জাগাইতে পারিল না। তার পর দ্বার খুলিয়া আস্তে আস্তে বাহির হইয়া পড়িল। গাড়ি সুপ্ত ধর্মদাসকে লইয়া চলিয়া গেল। কাঁপিতে কাঁপিতে দেবদাস স্টেশনের বাহিরে আসিল। একজন ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানকে ডাকিয়া বলিল, বাপু, হাতীপোতায় নিয়ে যেতে পারবে?
উপন্যাস : দেবদাস Chapter : 16 Page: 85
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 184