আর কাউকে শোনাও গে, আমার দরকার নেই।
কে বললে নেই? সবচেয়ে দরকার তোমারই। যে মেয়ের দেহের রূপ আছে, বাপের টাকা আছে, তাকে বাইরে থেকে যাচাই করে নেবার লোকের অভাব হয় না। কিন্তু সম্পদ যার অন্তরে লুকানো, তার আমার মতো একজন অকপট ভক্ত নইলে চলেই না। কিন্তু সে কি ওই জলধি? বুঝেছি, ওর তোমাকে ভাল লেগেচে। কেন জানো? ও ভেবেছে, ও যে তোমাকে পছন্দ করে সে ওর নিজেরই মহত্ত্ব। তোমার নিজের গুণে নয়, ওর স্বকীয় ঔদার্যে।
কিন্তু তুমি পছন্দ করেছ কার গুণে শুনি?
রমেন গম্ভীর হয়ে বললে, নেহাত মিথ্যে বলনি মণি। খুব সম্ভব তাই বটে। ওটা আমার নিজেরই বৃহত্ত্ব। নইলে তোমাকে হয়ত চিনতেই পারতাম না। কিংবা কি জানো মণি, নদীর স্রোতে যেখানটায় ঘূর্ণিপাকে ঘোরে, কুটোকাটা না বুঝেও সেই দিকে ছোটে। ঘুরে ঘুরে আবর্তে ডুব মারে, তার পরে কোথায় যায় কে জানে। ছিলাম ইউরোপে, ছেলেবেলায় সেইটুকু পরিচয়, কতকাল পরে কি ভেবে হঠাৎ চিঠি লিখে খোঁজ নিলে, মন অমনি চঞ্চল হয়ে উঠলো। চাকরি ছেড়ে দিলাম, যা কিছু সম্বল ছিল বিক্রি করে ভাড়া যোগাড় করে তোমার কাছে ছুটে এসে উপস্থিত হলাম। এর কি নিগূঢ় অর্থ নেই ভাবো? ঘূর্ণাবর্তের উপমাটা একটু চিন্তা করে দেখো। আর রূপের কথা যদি তোলো, একটু চেয়ে দেখলেই টের পাবে তুমি আমার পায়ের কড়ে আঙুলেও লাগো না। ইউরোপের গল্প নিজের মুখে আর করতে চাইনে, কিন্তু তোমাদের এই খাঁচা-বোঁচা বেঁটে দেশের কত রূপসী মেয়ের মাথা ঘুরে যায় এমন চেহারা কি আমার নয়? সত্যি বলো!
মণি হেসে ফেলে বললে, কি বিনয়! প্রভুপাদ গোস্বামীরাও পর্যন্ত হার মানে। আচ্ছা রমেন, তোমার প্রণয়-নিবেদনের ভাষাটা কি তুমি মুখস্থ করে রেখেছ? রোজই ঠিক একই রকম বলো কি করে? কোথাও একটা কমা সেমিকোলন পর্যন্ত বাদ পড়ে না, হুবহু একই কথা প্রত্যহ বলতে তোমার লজ্জা করে না?
নিশ্চয় করে।
তবে বল কেন?
বলবার হেতু আছে মণি। দেবতাদের প্রসন্ন করার দুটো ধারা আছে। এক স্তব, আর এক মন্ত্র। স্তব মনের আবেগে যথা-ইচ্ছা বানানো যায়, তার একদিনের বাক্য আর একদিনের সঙ্গে মেলার দরকার নেই। শুনে দেবতা খুশী হয়ে বর দিতেও পারেন, না-ও পারেন। তাঁর অনুগ্রহ, ভক্তের জোর নেই। কিন্তু মন্ত্র তা নয়, ইচ্ছামত বানানো যায় না, মুখস্থ করে আবৃত্তি করতে হয়। উচ্চারণ নির্ভুল হলে দেবতার না বলবার জো নেই, চুলের ঝুঁটি ধরে বর আদায় হয়। একেই বলে সিদ্ধমন্ত্র। সাহেবরা বলে ম্যাজিক। বুনোদের মধ্যে এই মন্ত্রে যারা সিদ্ধিলাভ করেচে, সমাজের ভিতর তাদের প্রতিষ্ঠা ও প্রতাপের অবধি নেই—লোকে থরথর করে কাঁপে।
মণি বললে, বুনোদের মন্ত্র তুমিও জানো না, আমিও না। নিশ্চয় তার গভীর অর্থ আছে, কিন্তু তুমি যা আমার কাছে আবৃত্তি করো তার বারো আনার মানে হয় না।
পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা : আগামীকাল Chapter : 2 Page: 8
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 220