আমাকে?

হাঁ, বলিয়াই সে প্রস্থান করিল।

অনুরাধার রান্নাঘরে খাবার ঠাঁই করা। বিজয় আসনে বসিয়া বলিল, রাত্রিটা অনায়াসে কেটে যেত, কেন আবার কষ্ট করলেন?

অনুরাধা অনতিদূরে দাঁড়াইয়া ছিল, চুপ করিয়া রহিল।

ভোজ্যবস্তুর বাহুল্য নাই, কিন্তু যত্নের পরিচয় প্রত্যেকটি জিনিসে। কি পরিপাটি করিয়াই না খাবারগুলি সাজানো। আহারে বসিয়া বিজয় জিজ্ঞাসা করিল, কুমার কি খেলে?

সাগু খেয়ে সে ঘুমিয়েছে।

ঝগড়া করেনি আজ?

অনুরাধা হাসিয়া ফেলিল, বলিল, আমার কাছে শোবে বলে আজ ও ভারী শান্ত। মোটে ঝগড়া করেনি।

বিজয় বলিল, ওকে নিয়ে আপনার ঝঞ্ঝাট বেড়েচে কিন্তু আমার দোষে নয়। ও নিজেই কি করে যে আপনার সংসারের মধ্যে নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল তাই আমি ভাবি।

আমিও ঠিক তাই ভাবি।

মনে হয়, ও বাড়ি চলে গেলে আপনার কষ্ট হবে।

অনুরাধা চুপ করিয়া রহিল, পরে বলিল, নিয়ে যাবার আগে কিন্তু আপনাকে একটি কথা দিয়ে যেতে হবে। আপনাকে চোখ রাখতে হবে ও যেন কষ্ট না পায়।

কিন্তু আমি ত থাকি বাইরে নানা কাজে ব্যস্ত, কথা রাখতে পারব বলে ভরসা হয় না।

তা হলে আমার কাছে ওকে দিয়ে যেতে হবে।

আপনি ভুলে যাচ্চেন যে সে আরও অসম্ভব। এই বলিয়া বিজয় হাসিয়া খাওয়ায় মন দিল। একসময়ে বলিল, আমার বৌদিদিদের আসার কথা ছিল, কিন্তু তাঁরা বোধ করি আর এলেন না।

কেন?

যে খেয়ালে বলেছিলেন সম্ভবত: সেটা কেটে গেছে। শহরের লোক পাড়াগাঁয়ে সহজে পা বাড়াতে চান না। একপ্রকার ভালই হয়েছে। একা আমিই ত আপনার যথেষ্ট অসুবিধে ঘটিয়েছি, তাঁরা এলে সেটা বাড়ত।

অনুরাধা এ কথার প্রতিবাদ করিয়া বলিল, এ বলা আপনার অন্যায়। বাড়ি আমার নয়, আপনাদের। তবু আমিই সমস্ত জায়গা জুড়ে বসে থাকব, তাঁরা এলে রাগ করব, এর চেয়ে অন্যায় হতেই পারে না। আমার সম্বন্ধে এমন কথা ভাবা আমার প্রতি সত্যিই আপনার অবিচার। যত দয়া আমাকে করেছেন আমার দিক থেকে এই কি তার প্রতিদান?

এত কথা এমন করিয়া সে কখনো বলে নাই। জবাব শুনিয়া বিজয় আশ্চর্য হইয়া গেল,—যতটা অশিক্ষিত এই পাড়াগাঁয়ের মেয়েটিকে সে ভাবিয়াছিল তাহা নয়। একটুখানি স্থির থাকিয়া আপন অপরাধ স্বীকার করিয়া কহিল, সত্যই এ কথা বলা আমার উচিত হয়নি। যাদের সম্বন্ধে এ কথা খাটে আপনি তাদের চেয়ে অনেক বড়। কিন্তু দু–তিনদিন পরেই আমি বাড়ি চলে যাব, এখানে এসে প্রথমে আপনার প্রতি নানা দুর্ব্যবহার করেচি, কিন্তু সে না-জানার জন্যে। অথচ, সংসারে এমনিই হয়, এমনিই ঘটে। তবু, যাবার আগে আমি গভীর লজ্জার সঙ্গে আপনার ক্ষমা ভিক্ষা করি।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়