এ-সব কথা আমিও জানি। দাতাকর্ণ মস্ত কাজ করিয়াছিলেন, বণিকও মস্ত কাজ করিয়াছে! কিন্তু কথা সে নয়। প্রাণটা তোমার নিজের, ইচ্ছা হয়, সেটা না হয় দিতে পার, কিন্তু এই যে ধারণা,—স্ত্রী তোমার সম্পত্তি, তুমি স্বামী বলিয়া ইচ্ছা করিলে এবং প্রয়োজন বোধ করিলে তাহার নারী-ধর্মের উপরও অত্যাচার করিতে পার, তাহাকে রাখিতেও পার, মারিতেও পার, বিলাইয়া দিতেও পার, তোমার এই অনধিকার, এই স্বেচ্ছাচার তোমাকে এবং তোমার পুরুষজাতিকে হীন করিয়াছে, এবং তোমার সতী স্ত্রীকে এবং সেই সঙ্গে সমস্ত নারীজাতিকে অপমান করিয়াছে! অতিথিসেবা খুব মস্ত ধর্ম হইতে পারে, কিন্তু সেজন্য যেমন চুরি-ডাকাতি করিতে পার না, এটাও ঠিক তেমনি পার না। ইহুদীরা যখন পশুর মত ছিল, তখন তাহারা সম্পত্তির সঙ্গে স্ত্রীর বখরা করিত। এখন অনেক অসভ্য জাতি বাড়ি-ঘর জমি-জমা গরু-বাছুরের সঙ্গে বাড়ির স্ত্রীগুলিকেও ভায়ে ভায়ে ভাগ করিয়া লয়। স্ত্রী-জাতি সম্বন্ধে বণিকের ধারণাও প্রায় এমনি। আর অতিথি-সৎকার যদি এতবড় ধর্মই হয়, যার কাছে সতী স্ত্রীর সর্বস্ব নষ্ট করিয়া ফেলাও ধর্মপালন, তবে এখনো যাহারা এই ধর্ম রাখিয়া চলে তাহাদের নীচ বলা শোভা পায় না।
আমেরিকার অসভ্য ছিনুক জাতির সম্বন্ধে কাপ্তেন লুইস্ বলিয়াছেন, ইহারা অতিথির শয্যায় বাটীর শ্রেষ্ঠ কন্যাটিকে, না হয়, স্ত্রীকে পাঠাইয়া দেওয়া অতি উচ্চ অঙ্গের ধর্মপালন বলিয়া মনে করে। এশিয়ার চুক্চি জাতি সম্বন্ধে অর্ম্যান সাহেব লিখিয়াছেন,—“The Chuckchi offer to travellers, who chance to visit them, their wives, and also what we should call their daughters, honour.” কাপ্তেন লায়ন এবং স্যার জন লবক, এসকুইমো, কামস্কট্কানিবাসী ও কালমুখ্দের সম্বন্ধেও ঠিক এমনি অতিথিসেবার ইতিহাস লিখিয়া গিয়াছেন। হারবার্ট স্পেন্সর তাঁহার Descriptive Sociology গ্রন্থে এমনি বহুতর দয়ার কাহিনী প্লস্ ও প্যালাস সাহেবদের ভ্রমণবৃত্তান্ত হইতে সংগ্রহ করিয়া গিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করি, ইহাদের সহিত আমাদের ধার্মিক বণিকটির প্রভেদ কোন্খানে? সে-দেশের পুরুষেরাও যাহা কর্তব্য এবং ধর্ম বলিয়া মনে করিয়াছে, তাহাই পালন করিয়াছে—ইনিও তাই; অতিথিকে সন্তুষ্ট করিবার ইচ্ছা উভয়েরই সমান, উভয়েই মনে করিয়াছে, অতিথি সন্তুষ্ট না হইলে আমার পাপ হইবে, আমি কষ্ট পাইব। কথাটাকে যেমন ইচ্ছা এবং যত ইচ্ছা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিলেও ওই একটা ‘আমি’ ছাড়া আর কিছুই পাইবার জো নাই। ওই ‘আমি’টার মধ্যেই নারীর প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা যে কোথায় ডুবিয়া গিয়াছে, তাহার কোন চিহ্নই পাওয়া যায় না।
ভগবান শঙ্করাচার্য স্পষ্ট করিয়া বলিয়া গিয়াছেন, নরকের দ্বার নারী। বাইবেল বলিয়াছেন, root of all evil অর্থাৎ সমস্ত অহিতের মূল।
প্রবন্ধ : নারীর মূল্য Chapter : 1 Page: 9
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 199