আমি বলিনে, বাছা, তুমি স্ত্রীলোক, তোমার এ করতে নেই, বলতে নেই, ওখানে যেতে নেই,—তুমি তোমার ভাল বোঝ না—এস আমি তোমার হিতের জন্যে তোমার মুখে পর্দা এবং পায়ে দড়ি বেঁধে রাখি। ডোমকেও ডেকে বলিনে, বাপু, তুমি যখন ডোম তখন এর বেশী চলাফেরা তোমার মঙ্গলকর নয়, অতএব এই ডিঙোলেই তোমার পা ভেঙ্গে দেব। দীর্ঘদিন বর্মাদেশে থেকে এটা আমার বেশ করে শেখা যে, মানুষের অধিকার নিয়ে গায়ে পড়ে মেলাই তার হিত করবার আবশ্যক নেই।

আমি বলি যার যা দাবী সে ষোল আনা নিক। আর ভুল-করা যদি মানুষের কাজেরই একটা অংশ হয়, ত সে যদি ভুল করে ত বিস্ময়েরই বা কি আছে, রাগ করবারই কি আছে। দুটো সুপরামর্শ দিতে পারি—কিন্তু মেরেধরে হাত-পা খোঁড়া করে ভাল তার করতেই হবে, এত বড় দায়িত্ব আমার নেই। অতখানি অধ্যবসায়ও নিজের মধ্যে খুঁজে পাইনে। বরঞ্চ মনে হয়, বাস্তবিক, আমার মত কুঁড়ে লোকের মত মানুষে মানুষের হিতাকাঙ্খাটা যদি জগতে একটু কম করে কোরত ত তারাও আরামে থাকত, এদেরও সত্যকার কল্যাণ হয়ত একটু-আধটু হবারও জায়গা পেত। দেশের কাজ, দেশের মঙ্গল করতে গিয়ে, এই কথাটা আমার তোমরা ভুলো না।

আজ তোমাদের কাছে আমার আরও অনেক কথা বলবার ছিল। সকল দিক দিয়ে কি করে সমস্ত বাঙ্গালা জীর্ণ হয়ে আসছে,—দেশের যারা মেরুমজ্জা সেই ভদ্র গৃহস্থ পরিবার কি করে কোথায় ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে আসছে, সে আনন্দ নেই, সে প্রাণ নেই, সে ধর্ম নেই, সে খাওয়া-পরা নেই; সমৃদ্ধ প্রাচীন গ্রামগুলা প্রায় জনশূন্য,—বিরাট প্রাসাদতুল্য আবাসে শিয়াল-কুকুর বাস করে; পীড়িত, নিরুপায় মৃতকল্প লোকগুলো যারা আজও সেখানে পড়ে আছে, খাদ্যাভাবে, জলাভাবে কি তাদের অবস্থা,—এইসব সহস্র দুঃখের কাহিনী তোমাদের তরুণ প্রাণের সামনে হাজির করবার আমার সাধ ছিল, কিন্তু এবার আমার সময় হলো না। তোমরা ফিরে এস, তোমাদের অধ্যাপক যদি আমাকে ভুলে না যান ত আর একদিন তোমাদের শোনাব। আজ আমাকে তোমরা ক্ষমা কর (১৩২৮ সালে পূজার ছুটির পূর্বে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ছাত্রদের সভায় পঠিত অভিভাষণ )।

শিক্ষার বিরোধ

এতদিন এদেশে শিক্ষার ধারা একটা নির্বিঘ্ন নিরুপদ্রব পথে চলে আসছিল। সেটা ভাল কি মন্দ, এ বিষয়ে কারও কোন উদ্বেগ ছিল না। আমার বাবা যা পড়ে গেছেন, তা আমিও পড়ব। এর থেকে তিনি যখন দু’পয়সা করে গেছেন, সাহেব-সুবোর দরবারে চেয়ারে বসতে পেয়েছেন, হ্যাণ্ডশেক করতে পেয়েছেন, তখন আমিই বা কেন না পারবো? মোটামুটি এই ছিল দেশের চিন্তার পদ্ধতি। হঠাৎ একটা ভীষণ ঝড় এল। কিছুদিন ধরে সমস্ত শিক্ষাবিধানটাই বনিয়াদ সমেত এমনি টলমল করতে লাগল যে, একদল বললেন পড়ে যাবে। অন্যদল সভয়ে মাথা নেড়ে বললেন, না, ভয় নেই—পড়বে না। পড়লও না। এই নিয়ে প্রতিপক্ষকে তাঁরা কটু কথায় জর্জরিত করে দিলেন। তার হেতু ছিল। মানুষের শক্তি যত কমে আসে, মুখের বিষ তত উগ্র হয়ে ওঠে। বাইরে গাল তাঁরা ঢের দিলেন, কিন্তু অন্তরে ভরসা বিশেষ পেলেন না। ভয় তাঁদের মনের মধ্যেই রয়ে গেল, দৈবাৎ বাতাসে যদি আবার কোনদিন জোর ধরে ত এই গোড়া-হেলা নড়বড়ে অতিকায়টা হুমড়ি খেয়ে পড়তে মুহূর্ত বিলম্ব করবে না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়