কিন্তু জাত-সাপুড়ের কল্যাণ-কামনায় যদি উপদেশ করো তাকে গোখরো-কেউটে ছেড়ে হেলে আর ঢোঁড়া সাপ নিয়ে খেলাতে, তবে বরঞ্চ পেশা ছেড়ে দেব, কিন্তু আত্মমর্যাদা নষ্ট করবো না। মরণ আছে জেনেও।

আমি বুঝি গোখরো কেউটে, আর তুমি জাত-সাপুড়ে?

আমি নয় ত কি ঐ জলধিটা? যে কেবল তোমার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করছে আর নানা ছলে পাহারা দিয়ে ফিরচে—সে?

তাই সে ফিরুক, কিন্তু তুমি আর আমাকে জ্বালাতন করতে পাবে না তোমাকে বলে দিলাম।

ওগো মণি, কাঁদবে তুমি কাঁদবে। এখন মস্ত বাহাদুরি হচ্ছে, কিন্তু একদিন বুঝবে জ্বালাতন করবার যার কেউ নেই তার চেয়ে দুর্ভাগা মেয়েও আর জগতে নেই।

তোমার চিন্তা নেই রমেন, সম্প্রতি জলধিবাবু আছেন, তিনি একাই যথেষ্ট। যখন তিনিও থাকবেন না তখন তোমাকে চিঠি লিখে জানাবো।

তাই জানিয়ো। কিন্তু আমার যে বিশ্বাস হতে চায় না, তুমি সত্যই আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাও।

এতক্ষণে তার পরিহাসের হালকা কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এলো দেখে মণির মুখের ’পরেও একটা ব্যথার ছায়া পড়লো। হয়ত ভাবলে কি জবাব দেবে, কিন্তু দেবার পূর্বেই নীচে সদর রাস্তায় একটা মোটর এসে দাঁড়ালো এবং পরক্ষণেই এককড়ির গলা শোনা গেল—মণি মণি, তুমি কোন্‌ ঘরটায় থাকো?

কে একজন বলে দিলে তেতলায় উঠে বাঁ-দিকের ফ্ল্যাটটা।

মণি ব্যস্ত হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসে সাড়া দিলে—আসুন এককড়িদা, এই আমার ঘর।

মিনিট-খানেক পরে এককড়ি এসে ঢুকলো, যে চাকরটা চিনিয়ে দিতে তাঁর সঙ্গে এসেছিল, সে বারান্দার একধারে দাঁড়িয়ে রইলো।

এককড়ি আসন গ্রহণ করে চারিদিকটা একবার চেয়ে নিয়ে বললে, বাঃ—দিব্যি সাজানো-গোছানো ঘরটি ত!

মণি শুধু একটু হাসলে। কিন্তু পিছনের থেকে রমেন এ কথার জবাব দিয়ে বললে, তার কারণ আছে এককড়িদা। এ হলো লক্ষ্মীর বাসস্থল, গাছতলা হলেও এর পারিপাট্যটুকু আপনার চোখে পড়তই। আপনার বাড়ি কখনো দেখিনি, কিন্তু জোর করে বলতে পারি সে-ও এত সুন্দর নয়। আপনি ভাবচেন, না দেখেই লোকটা বলে কি করে? বলি এইজন্যে যে, জানি বৌ-ঠাকরুন স্বর্গীয় হয়েচেন, বেঁচে থাকলে এমন কথা মুখে আনতেও পারতাম না।

কথাগুলো এককড়ির ভালই লাগলো, তথাপি এই অপরিচিত যুবকের গায়েপড়া আলাপ ও আত্মীয় সম্বোধনে সে বিরক্ত-মুখে ফিরে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কে আপনি?

আমি রমেন, দাদা। মণির ছেলেবেলার বন্ধু। কিন্তু আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না। কেবল বয়সে নয়, সকল দিকেই আপনার ঢের ছোট। আমাকে ‘তুমি’ বলতে হবে।

যাকে চিনিনে, কোনদিন আলাপ-পরিচয় নেই, তাকে কি হঠাৎ ‘তুমি’ বলা সাজে?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়