কোন বিড়ালটা বল ত? সাদাটা?

সেইটেই বোধ হয়, বলিয়া অনুরাধা হাত দিয়া তাহার মাথায় এলোমেলো চুলগুলি সোজা করিয়া দিতে লাগিল।

বিজয় কহিল, উৎপাত ত দেখচি ক্রমশঃ জুলুমে গিয়ে ঠেকেচে।

কুমার বলিল, খাবার জল কৈ?

ঐ যাঃ, ভুলে গেছি বাবা, এনে দিচ্চি।

তুমি সবই ভুলে যাও মাসীমা। তোমার কিচ্ছু মনে থাকে না।

বিজয় বলিল, আপনার বকুনি খাওয়াই উচিত। ত্রুটি পদে পদে।

হাঁ, বলিয়া অনুরাধা হাসিয়া ফেলিল। অসতর্কতাবশত: এ-হাসি বিজয়ের চোখে পড়িল। পুত্রের অবৈধ আচরণের ক্ষমাভিক্ষা করা আর হইল না, পাছে তাহার ভদ্রবাক্য অভদ্র ব্যঙ্গের মত শুনায়, পাছে এই মেয়েটির মনে হয় তাহার দৈন্য ও দুর্দশাকে সে কটাক্ষ করিতেছে।

পরদিন দুপুরবেলা অনুরাধা কুমার ও সন্তোষকে ভাত বাড়িয়া দিয়া তরকারি পরিবেশন করিতেছে, তাহার মাথার কাপড় খোলা, গায়ের বস্ত্র অসংবৃত, অকস্মাৎ দ্বারপ্রান্তে মানুষের ছায়া পড়িতে অনুরাধা ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল, ছোটবাবু। শশব্যস্তে মাথায় আঁচল তুলিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

বিজয় বলিল, একটা অত্যন্ত জরুরি পরামর্শের জন্য আপনার কাছে এলুম। বিনোদ ঘোষ গ্রামের লোক, অনেকদিন দেখচেন, ও কি-রকম লোক বলতে পারেন? ওকে গণেশপুরের নতুন গোমস্তা বাহাল করেচি, সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যায় কিনা—আপনার কি মনে হয়?

বিনোদ এক সপ্তাহের অধিক কাজ করিতেছে, যথাসাধ্য ভালো কাজই করিতেছে, কোন গোলযোগ ঘটায় নাই, সহসা হন্তদন্ত হইয়া তাহার চরিত্রের খোঁজতল্লাশ করিবার এখনই কি প্রয়োজন হইল অনুরাধা ভাবিয়া পাইল না; মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, বিনোদদা কি কিছু করেছেন?

এখনো কিছু করেনি, কিন্তু সতর্ক হওয়া ত প্রয়োজন।

তাঁকে ভালো লোক বলেই ত জানি।

সত্যি জানেন, না নিন্দে করবেন না বলেই ভালো বলচেন?

আমার ভাল-মন্দ বলার কি কিছু দাম আছে?

আছে বৈ কি। সে যে আপনাকেই প্রামাণ্য সাক্ষী মেনে বসেছে।

অনুরাধা একটু ভাবিয়া বলিল, উনি ভালো লোকই বটে। শুধু একটু চোখ রাখবেন। নিজের অবহেলায় ভালো লোকও মন্দ হয়ে ওঠা অসম্ভব নয়।

বিজয় কহিল, সত্যিই তাই। কারণ, অপরাধের হেতু খুঁজতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই অবাক হতে হয়।

ছেলেকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, তোর ভাগ্য ভালো যে হঠাৎ এক মাসীমা পেয়ে গেছিস, নইলে এই বন-বাদাড়ের দেশে অর্ধেক দিন না খেয়ে কাটাতে হ’তো।

অনুরাধা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার কি এখানে খাবার কষ্ট হচ্চে?

বিজয় হাসিয়া বলিল, না, এমনিই বললুম। চিরকাল বিদেশে বিদেশে কাটিয়েছি, খাবার কষ্ট বড় গ্রাহ্য করিনে। বলিয়া চলিয়া গেল। অনুরাধা জানালার ফাঁক দিয়া দেখিল তাহার স্নান পর্যন্ত এখনো হয় নাই।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়