তৃতীয় দৃশ্য

[রমার শয়নকক্ষ। পীড়িত রমা শয্যায় শায়িত। সম্মুখে প্রাতঃসূর্যালোক খোলা জানালার ভিতর দিয়া মেঝের উপর ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বিশ্বেশ্বরী প্রবেশ করিলেন]

বিশ্বেশ্বরী। (অশ্রুভরা কণ্ঠে) আজ কেমন আছিস মা, রমা?

রমা। (একটুখানি হাসিয়া) ভাল আছি জ্যাঠাইমা!

বিশ্বেশ্বরী। রাত্রে জ্বরটা কি ছেড়েছিল?

রমা। না। কিন্তু বোধ হয় শিগগির একদিন ছেড়ে যাবে।

বিশ্বেশ্বরী। কাশিটা?

রমা। কাশিটা বোধ করি তেমনি আছে।

বিশ্বেশ্বরী। তবু বলিস ভাল আছিস মা! (রমা নিঃশব্দে হাসিল, বিশ্বেশ্বরী তাহার শিয়রে গিয়া বসিলেন এবং মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে কহিলেন) তোর হাসি দেখলে মনে হয় মা, যেন গাছ থেকে ছেঁড়াফুল দেবতার পায়ের কাছে পড়ে হাসছে! রমা?

রমা। কেন জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। আমি ত তোর মায়ের মত রমা—

রমা। মত কেন জ্যাঠাইমা, তুমিই ত আমার মা।

বিশ্বেশ্বরী। (হেঁট হইয়া রমার ললাট চুম্বন করিলেন) তবে সত্যি করে বল দেখি মা, তোর কি হয়েছে?

রমা। অসুখ করেচে জ্যাঠাইমা।

বিশ্বেশ্বরী। (রমার রুক্ষ চুলগুলিতে হাত বুলাইয়া কহিলেন) সে ত এই দুটো চামড়ার চোখেই দেখতে পাই মা। যা এতে ধরা যায় না তেমনি যদি কিছু থাকে মায়ের কাছে লুকোস নে রমা। লুকোলে ত অসুখ সারবে না মা!

রমা। (কিছুক্ষণ জানালার বাহিরে নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া) বড়দা কেমন আছেন জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। মাথার ঘা সারতে দেরি হবে বটে, কিন্তু হাসপাতাল থেকে পাঁচ—ছয় দিনেই বাড়ি আসতে পারবে।—দুঃখ কোরো না মা, এই তার প্রয়োজন ছিল। এতে তার ভালই হবে। ভাবচো, মা হয়ে সন্তানের এতবড় দুর্ঘটনায় এ কথা বলচি কি কোরে? কিন্তু তোমাকে সত্যি বলচি রমা, এতে আমি ব্যথা বেশি পেয়েচি কি আনন্দ বেশি পেয়েচি বলতে পারিনে। অধর্মকে যারা ভয় করে না, লজ্জা যাদের নেই, প্রাণের ভয়টা যদি না তাদের তেমনি বেশি থাকে মা, সংসার ছারখার হয়ে যায়। তাই কেবলই মনে হয়, এই চাষার ছেলে বেণীর যে মঙ্গল করে দিয়ে গেল পৃথিবীতে কোন আত্মীয়বন্ধুই তার সে ভাল করতে পারতো না। কয়লাকে ধুয়ে তার রং বদলানো যায় না মা, তাকে আগুনে পোড়াতে হয়।

রমা। কিন্তু এমনধারা ত আগে ছিল না জ্যাঠাইমা! কে দেশের চাষাদের এ-রকম কোরে দিলে?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়