ঈশ্বর-জানিত পল ঠাকুরের উক্তি কি সুন্দর! নারীর মুক্তির কি সোজা পথ! এবং এই পথের পরিচয় বিলাতের যে-কোন ধর্মগ্রন্থ খুলিলেই চোখে পড়ে। আমাদের শাস্ত্রে সন্তানের জন্যই নারী মহাভাগা, এবং পুত্রের জন্যই ভার্যাগ্রহণের ব্যবস্থা আছে। এবং সংসারের যে-কোন দেশের ইতিহাস, ধর্মগ্রন্থ আলোচনা করিয়া দেখিলে কম-বেশি এই-রকমের ব্যবস্থাই দেখিতে পাওয়া যায়।

নারীর সম্মান তাহার নিজের জন্য নহে, তাহার সম্মান নির্ভর করে পুত্র-প্রসবের উপর। পুরুষের কাছে এই যদি তাহার নারী-জীবনের একটিমাত্র উদ্দেশ্য হইয়া থাকে, ইহা কোনমতেই তাহার গৌরবের বিষয় হইতে পারে না। কিন্তু সত্যই তাই। এ-ছাড়া তাহার কাছে সংসার আর কিছুই আশা করে না, এবং সে যতকিছু সম্মান দিয়া আসিয়াছে তাহা এই জন্যই। আমাদের শাস্ত্রে ক্ষেত্রজ সন্তানের বিধি আছে। কুন্তীকে পঞ্চপাণ্ডবের, অম্বিকা-অম্বালিকাকে পাণ্ডু-ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম দিতে হইয়াছিল। সতী নারীর পক্ষে ইহা শ্লাঘার কথা নহে। প্রাচীন ইহুদী সমাজে অপুত্রক বিধবা ভ্রাতৃজায়াকে সন্তান-কামনায় দেবরের উপপত্নী হইয়া থাকিতে হইত। নারীর জন্য যে-সকল শাস্ত্রীয় বিধি-ব্যবস্থা ডুটরনমির পঁচিশ অধ্যায়ের গোড়ার দিকে লিপিবদ্ধ করা আছে, পড়িলে ঘৃণা জন্মিয়া যায়। মনে হয়, সন্তান-কামনায় ইহাদের সমাজে নারীকে কি না করিতে হইত। এমনি আফ্রিকাতেও সন্তানের জন্য নারীকে বাধ্য হইয়া অসাধ্য সাধন করিতে হইত। হারবার্ট স্পেন্সর লিখিয়াছেন, “Dahoman like all other semi-barbarians considers a numerous family the highest blessing.” আফ্রিকার পূর্ব অঞ্চলে “it is no disgrace for an unmarried woman to become the mother of numerous family; woman’s irregularities are easily forgiven if she bears many children.” ওটিয়াক্‌সদিগের মধ্যে “it is honourable for a girl to have children. She then gets a wealtheir husband and her father is paid a higher halym for her.” ওল্ড টেস্টামেন্ট বাইবেলের মতে স্ত্রীর সন্তান না হওয়া মহাপাপ। নারীর মূল্য কি দিয়া যে ধার্য হয় সে-কথা বুঝাইবার জন্য আর বেশি নজির তুলিয়া গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি করিতে ইচ্ছা করি না। পুরুষের এই স্বার্থের জন্যই যে তার মান, এই জন্যই যে তার মর্যাদা, আবশ্যক হইলে এ-সত্য আরও সহস্র প্রকারে প্রমাণ করা যায়, কিন্তু সে প্রয়োজন বোধ করি নাই। কিন্তু স্বার্থের জন্যই যে পুরুষ তাহাকে চিরদিন নির্যাতন এবং অপমান করিয়া আসিয়াছে, এ-সম্বন্ধে আরো কিছু বলা আবশ্যক। কেন না, এ কথা পুরুষে বুঝিলেও স্ত্রীলোক বুঝে না, বোধ করি বুঝিতেও চাহে না। সংসারে ছোটখাটো সুখ-শান্তির মধ্যে থাকিয়া স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া কি করিয়া সে মনে করিবে, এই স্বামী তাহার আন্তরিক মঙ্গল কামনা করে না! পিতার কাছে দাঁড়াইয়া কি করিয়া সে ভাবিবে, এই পিতা তাহার মিত্র নহে।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়