কানাই সিং। চলিয়ে হুজুর।

[রাসবিহারী ও কানাই সিং-এর প্রস্থান

বিলাস। তুমি স্বচ্ছন্দে চুপ করে থাকতে পার, কিন্তু আমি পারিনে। আমার দায়িত্ববোধ আছে। একটা বিরাট কার্যভার ঘাড়ে নিয়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারিনে। আমাদের মন্দির-প্রতিষ্ঠা এই বড়দিনের ছুটিতেই হবে। সমস্ত স্থির হয়ে গেল। এমন কি নিমন্ত্রণ করা পর্যন্ত বাকী রেখে আসিনি। উঃ—কাল সকাল থেকে কি ঘোরাটাই না আমাকে ঘুরতে হয়েছে। যাক, ওদিকের সম্বন্ধে একরকম নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, কারা কারা আসবেন তাও নোট করে এনেছি, পড়ে দ্যাখো অনেককেই চিনতে পারবে।
[সে ব্যাগ খুলিয়া হাতড়াইয়া, কাগজখানা বাহির করিয়া ধরিল। বিজয়া গ্রহণ করিল বটে, কিন্তু তার মুখ দেখিয়া মনে হইল বিতৃষ্ণার সীমা নাই]

বিলাস। ব্যাপার কি? এমন চুপচাপ যে?

বিজয়া। আমি ভাবছি, আপনি যে তাঁদের নিমন্ত্রণ করে এলেন এখন তাঁদের কি বলা যায়?

বিলাস। তার মানে?

বিজয়া। মন্দির-প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে আমি এখনও কিছু স্থির করে উঠতে পারিনি।

বিলাস। (সুতীব্র বিস্ময়ে ও ততোধিক ক্রোধে বিলাসের মুখ ভীষণ হইয়া উঠিল। কিন্তু কণ্ঠস্বর তাহার পক্ষে যতটা সম্ভব সংযত করিয়া কহিল) তার মানে কি? তুমি কি ভেবেচ আসছে ছুটির মধ্যে না করতে পারলে আর কখনো করা যাবে? তারা ত কেউ তোমার—ইয়ে নন যে তোমার যখন সুবিধে হবে তখনই তাঁরা ছুটে এসে হাজির হবেন। মন স্থির হয়নি তার অর্থ কি শুনি?

বিজয়া। (মৃদুকণ্ঠে) এখানে ব্রহ্মমন্দির-প্রতিষ্ঠার কোন সার্থকতা নেই। সে হবে না।

বিলাস। (কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থাকিয়া) আমি জানতে চাই তুমি যথার্থই ব্রাহ্মমহিলা কিনা।

বিজয়া। (তাহার মুখের দিকে নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া) আপনি বাড়ি থেকে শান্ত হয়ে ফিরে না এলে আপনার সঙ্গে আলোচনা হতে পারবে না। এ কথা এখন থাক।

বিলাস। আমরা তোমার সংস্রব পরিত্যাগ করতে পারি জানো?

বিজয়া। সে আলোচনা আমি কাকাবাবুর সঙ্গে করব, আপনার সঙ্গে নয়।

বিলাস। আমরা তোমার সংস্পর্শ ত্যাগ করলে কি হয় জানো?

বিজয়া। না, কিন্তু আপনার দায়িত্ববোধ যখন এত বেশি তখন আমার অনিচ্ছায় যাঁদের নিমন্ত্রণ করে অপদস্থ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাঁদের ভার নিজেই বহন করুন। আমাকে অংশ নিতে অনুরোধ করবেন না।

বিলাস। আমি কাজের লোক, কাজই ভালবাসি, খেলা ভালবাসি নে তা মনে রেখো বিজয়া।

বিজয়া। (শান্তস্বরে) আচ্ছা আমি ভুলবো না।

বিলাস। (প্রায় চীৎকার করিয়া) হাঁ—যাতে না ভোলো সে আমি দেখব।

[বিজয়া কোন কথা না বলিয়া যাইবার উদ্যোগ করিল]

বিলাস। আচ্ছা, এত বড় বাড়ি তবে কি কাজে লাগবে শুনি? এ ত আর শুধু শুধু ফেলে রাখা যেতে পারবে না?

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া দৃঢ়ভাবে) কিন্তু এ বাড়ি যে নিতেই হবে সে ত এখনও স্থির হয়নি!

বিলাস। (রাগিয়া সজোরে মাটিতে পা ঠুকিয়া) হয়েছে একশো বার স্থির হয়েছে। আমি সমাজের মান্য ব্যক্তিদের আহ্বান করে এনে অপমান করতে পারব না। এ বাড়ি আমাদের চাই-ই, এ আমি করে তবে ছাড়ব। এই তোমাকে আমি জানিয়ে দিলুম।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়