পথিক। মনে মনে বললাম, আর কেন? ভাঙ্গা কুঁড়েখানি বিধবা ভাইঝিকে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম—বাবু, আমার চেয়ে দুঃখী আর সংসারে নেই।
জীবানন্দ। ওরে ভাই, সংসারটা ঢের বড় জায়গা, এর কোথায় কে কিভাবে আছে বলবার জো নেই।
পথিক। কিন্তু আমার মত—
জীবানন্দ। দুঃখী? কিন্তু দুঃখীদেরও কোন আলাদা জাত নেই দাদা, দুঃখেরও কোন বাঁধানো রাস্তা নেই। তা হলে সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে পারত। হুড়মুড় করে যখন ঘাড়ে এসে পড়ে তখনই কেবল মানুষ টের পায়। আমার সব কথা তুমি বুঝবে না ভাই, কিন্তু সংসারে তুমি একলা নও। অন্ততঃ একজন সাথী তোমার বড় কাছেই আছে, তাকে তুমি চিনতেও পারোনি। কিন্তু তুমি মায়ের নাম করছিলে—
[সহসা সাগর ও হরিহর দ্রুতপদে প্রবেশ করিয়া মন্দিরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। জীবানন্দ উৎকর্ণ হইয়া শুনিতে লাগিল]
হরিহর। আমাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেছে তার সর্বনাশ না করে আমরা কিছুতেই ছাড়ব না।
সাগর। মায়ের চৌকাঠ ছুঁয়ে দিব্যি করলাম খুড়ো, ফাঁসি যেতে হয় তাও যাব।
হরিহর। হঃ—আমাদের আবার জেল, আমাদের আবার ফাঁসি! মা আগে যাক—
হরিহর ও সাগর। জয় মা চণ্ডী!
[উভয়ের প্রস্থান
জীবানন্দ। বাস্তবিক, ঠাকুর-দেবতার মত এমন সহৃদয় শ্রোতা আর নেই। হোক না মিথ্যা দম্ভ, তবু তার দাম আছে। দুর্বলের ব্যর্থ পৌরুষ তবু একটু গৌরবের স্বাদ পায়।
পথিক। কি বললেন বাবু?
জীবানন্দ। কিছু না ভাই, মায়ের নাম করছিলে আমি বাধা দিলাম। আবার শুরু কর, আমি চললাম। কাল এমনি সময়ে হয়ত আবার দেখা পাবে।
পথিক। আর ত দেখা হবে না বাবু, আমি পাঁচদিন আছি, কালই সকালে চলে যেতে হবে।
জীবানন্দ। চলে যেতে হবে? কিন্তু এই যে বললে তোমার পা এখনো সারেনি, তুমি হাঁটতে পার না?
পথিক। মায়ের মন্দির এখন রাজাবাবুর। হুজুরের হুকুম তিনদিনের বেশি আর কেউ থাকতে পারবে না।
জীবানন্দ। (হাসিয়া) ভৈরবী এখনও যায়নি, এরই মধ্যে হুজুরের হুকুম জারি হয়ে গেছে? মা-চণ্ডীর কপাল ভালো! আচ্ছা, আজ অতিথিদের সেবা হলো কিরকম? কি খেলে ভাই?
পথিক। যাদের তিনদিনের বেশি হয়নি তারা মায়ের প্রসাদ সবাই পেলে।
জীবানন্দ। আর তুমি? তোমার ত তিনদিনের বেশি হয়ে গেছে?
পথিক। ঠাকুরমশাই কি করবেন, রাজাবাবুর হুকুম নেই কিনা।
জীবানন্দ। তাই হবে। (এই বলিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করিল)
জীবানন্দ। কাল আমি আবার আসব, কিন্তু ভাই, চুপিচুপি চলে যেতে পাবে না।
পথিক। ঠাকুরমশাই যদি কিছু বলে?
জীবানন্দ। বললেই বা। এত দুঃখ সইতে পারলে, আর বামুনের একটা কথা সইতে পারবে না? রাত হলো এখন যাই, কিন্তু মনে থাকে যেন।
[এমনি সময়ে ষোড়শী প্রদীপ-হস্তে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া মন্দিরের দ্বারের অভিমুখে অগ্রসর হইতেছিল, জীবানন্দ পিছন হইতে ডাক দিল]
জীবানন্দ। অলকা?
ষোড়শী। (চমকিয়া) আপনি? এত রাত্রে আপনি এখানে কেন?
জীবানন্দ। কি জানি, এমনি এসেছিলাম। তুমি যাত্রার আগে ঠাকুর-প্রণাম করতে যাচ্ছ, না? চল, আমি তোমার সঙ্গে যাই।
ষোড়শী। আমার সঙ্গে যাবার বিপদ আছে সে ত আপনি জানেন!
জীবানন্দ। বিপদ? জানি। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে একেবারেই নেই। আজ আমি একা এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। এ জীবনে আর যাই কেন না স্বীকার করি, আমার শত্রু আছে এ আমি একটা দিনও আর মানব না।
ষোড়শী। কিন্তু কি হবে আমার সঙ্গে গিয়ে?
নাটক : ষোড়শী Chapter : 3 Page: 43
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 625