দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

ষোড়শীর কুটীর

[সন্ধ্যা এইমাত্র উত্তীর্ণ হইয়াছে। গৃহের অভ্যন্তরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। বাহিরে ষোড়শী উপবিষ্ট। এমনি সময়ে নির্মল ও হৈম প্রবেশ করিল। পিছনে ভৃত্য]

ষোড়শী। এস, এস, কিন্তু এ কি কাণ্ড! তোমাদের যে আজ দুপুরের গাড়িতে যাবার কথা ছিল?

[নির্মল ও হৈম নিকটে উপবেশন করিল]

হৈম। কথা ছিল, কিন্তু যাইনি। এঁকেও যেতে দিইনি। দিদির এই নতুন ঘরখানি চোখে দেখে না গেলে দুঃখ করতে হতো।

নির্মল। চোখে দেখে গিয়েও দুঃখ কম করতে হবে মনে হয় না।

হৈম। সে ঠিক। হয়ত চোখে না দেখলেই ছিল ভালো। এ ঘরের আর যা দোষ থাক, অপব্যয়ের অপবাদ শিরোমণিমশায় কেন, বোধ হয় আমার বাবাও দিতে পারেন না। কিন্তু এ পাগলামি কেন করতে গেলে দিদি, এ ঘরে ত তুমি থাকতে পারবে না!

ষোড়শী। এর চেয়েও কত খারাপ ঘরে কত মানুষকে ত থাকতে হয় ভাই।

হৈম। তা হলে সত্যিই কি তুমি সব ছেড়ে দেবে?

নির্মল। তা ছাড়া কি উপায় আছে বলতে পার? সমস্ত গ্রামের সঙ্গে ত একজন অসহায় স্ত্রীলোক দিবানিশি বিবাদ করে টিকতে পারে না।

হৈম। আমরা সমস্তই শুনেছি। তুমি সন্ন্যাসিনী, সবই তোমার সইবে, কিন্তু এর সঙ্গে যে মিথ্যে দুর্নাম লেগে রইল সেও কি সইবে দিদি?

ষোড়শী। দুর্নাম যদি মিথ্যেই হয় সইবে না কেন? হৈম, সংসারে মিথ্যে কথার অভাব নেই, কিন্তু সেই মিথ্যে কথার সঙ্গে ঝগড়া করে মিথ্যে কাজের সৃষ্টি করতে আমার লজ্জা করে বোন।

হৈম। দিদি, তুমি সন্ন্যাসিনী, তোমার সব কথা আমরা বুঝতে পারিনে, কিন্তু তোমাকে দেখে কি আমার মনে হয় জানো? আমার শ্বশুরকে কোন্‌ এক রাজা একখানি তলোয়ার খিলাত দিয়েছিলেন। খাপখানা তার ধূলো-বালিতে মলিন হয়ে গেছে, কিন্তু আসল জিনিসে কোথাও এতটুকু ময়লা ধরেনি। সে যেমন সোজা, তেমন খাঁটি, তেমনি কঠিন। তার কথা আমার তোমার পানে চাইলেই মনে পড়ে। মনে হয় দেশসুদ্ধ লোকে সবাই ভুল করেছে, আসল কথা কেউ কিছুই জানে না।

ষোড়শী। (হৈমর হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া) আজ তোমাদের কেন যাওয়া হলো না হৈম? বোধ হয় কাল যাওয়া হবে, না?

হৈম। আমার ছেলের কথা তুললেই রাগ কর, সে আর বলব না, কিন্তু ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতে আমার এই অন্ধ মানুষটিকে যিনি হাতে ধরে নদী পার করে এনে নিঃশব্দে দিয়ে গেছেন, তাঁর পায়ের ধূলো না নিয়েই বা আমরা যাই কি করে? কিন্তু যাবার আগে এই কথাটি আজ দাও দিদি, আপনার লোকের যদি কখনো দরকার হয়, এই প্রবাসী বোনটিকে তখন ভুলো না।

হৈম। (ষোড়শীকে নীরব দেখিয়া) কথা দিতে বুঝি চাও না দিদি?

ষোড়শী। কথা দিলাম, ভুলব না। ভুলিওনি হৈম। আঘাত পেয়ে আজই তোমাকে একখানা চিঠি লিখছিলাম, ভেবেছিলাম, তুমি চলে গেলে সেখানা তোমাকে ডাকে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু শেষ করতে পারলাম না, হঠাৎ মনে পড়ল এর জন্যে হয়ত তোমার বাবার সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত বিবাদ বেধে যাবে।

হৈম। যেতেও পারে। কিন্তু আরও যে একটা মস্ত কথা আছে দিদি। আমার এই অন্ধ মানুষটিকে তুমি রক্ষে করেছ, তার চেয়ে বড় সংসারে ত আমার কিছুই নেই।

ষোড়শী। সত্যিই কিছু নেই হৈম?

হৈম। না, নেই। আর এই সত্যি কথাটিই বলে যাব বলে আজ যেতে পারিনি।

ষোড়শী। (হাসিয়া) কিন্তু এই ছোট্ট কথাটুকুর জন্যে ত একজনই যথেষ্ট ছিল ভাই, নির্মলবাবুকে ত অনায়াসে যেতে দিতে পারতে?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়