সাগর। স্বয়ং হুজুরের মুখেই।

ষোড়শী। তা হলে এ-সকল তাঁরই মতলব?

সাগর। (চিন্তা করিয়া) কি জানি মা, কিন্তু মনে হয় রায়মশায়ও আছেন।

ষোড়শী। এ ত গেল তাদের কথা সাগর। কিন্তু আমি ত একা। জমিদার ইচ্ছে করলে ত আমারও প্রতি অত্যাচার করতে পারেন?

সাগর। তা জানিনে মা, শুধু জানি তুমি একা নও। (ক্ষণকাল নিঃশব্দে থাকিয়া) মা, আমাদের নিজের পরিচয় নিজে দিতে নেই, গুরুর নিষেধ আছে (বংশদণ্ড সজোরে মুষ্টিবদ্ধ করিয়া)—হরিহর সর্দারের ভাইপো সাগরের নাম দশ-বিশ ক্রোশের লোকে জানে—তোমার উপর অত্যাচার করবার মানুষ ত মা পঞ্চাশখানা গ্রামে কেউ খুঁজে পাবে না।

ষোড়শী। (দুই চক্ষু অকস্মাৎ জ্বলিয়া উঠিল) সাগর, এ কি সত্যি?

সাগর। (তৎক্ষণাৎ হেঁট হইয়া হাতের লাঠি ষোড়শীর পায়ের কাছে রাখিয়া) বেশ ত মা, সেই আশীর্বাদই কর না, যেন কথা আমার মিথ্যে না হয়।

ষোড়শী। (চোখের দৃষ্টি একবার একটুখানি কোমল হইয়া আবার তেমনি জ্বলিতে লাগিল) আচ্ছা সাগর, আমি ত শুনেচি তোদের প্রাণের ভয় করতে নেই?

সাগর। (সহাস্যে) মিথ্যে শুনেচ তাও ত আমি বলচি নে মা।

ষোড়শী। কেবল প্রাণ দিতেই পারিস, আর নিতে পারিস নে?

সাগর। পারিনে? এই আদেশের জন্য কত ভিক্ষেই না চাইলাম, কিন্তু কিছুতেই যে হুকুমটুকু তোমার মুখ থেকে বার করতে পারলাম না মা।

ষোড়শী। না সাগর, না। অমন কথা তোরা মুখেও আনিস নে বাবা।

সাগর। কিন্তু মন থেকে যে কথাটা তাড়াতে পারচি নে মা!

[পূজারী প্রবেশ করিল]
পূজারী। মন্দিরের দোর বন্ধ করে এলাম মা।

ষোড়শী। চাবি?

পূজারী। এই যে মা। (চাবির গোছা হাতে দিয়া) রাত হলো এখন তা হলে আসি?

ষোড়শী। এস, বাবা।

[পূজারীর প্রস্থান

ষোড়শী। সাগর, ফকিরসাহেব চলে গেছেন। তিনি কোথায় আছেন, খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাতে পারিস বাবা?

সাগর। কেন মা?

ষোড়শী। তাঁকে আমার বড় প্রয়োজন। তোরা ছাড়া তাঁর চেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী আমার কেউ নেই।

সাগর। কিন্তু তোমার কাছেই ত কতবার শুনেছি তিনি সাধুপুরুষ। যেখানেই থাকুন তাঁকে যথার্থ মন দিয়ে ডাকলেই এসে উপস্থিত হন।

ষোড়শী। (চমকিয়া) তাই ত সাগর, এতবড় কথাটা আমি কি করে ভুলেছিলাম! আর আমার চিন্তা নেই, আমার এতবড় দুঃসময়ে তিনি না এসে কিছুতেই পারবেন না।

সাগর। আমারও বিশ্বাস তাই। কিন্তু কথায় কথায় রাত্রি অনেক হলো মা, তুমি বিশ্রাম কর, আসি?

ষোড়শী। এসো।

সাগর। (ঈষৎ হাসিয়া) ভয় নেই মা, সাগর তোমাকে একলা রেখে কোথাও বেশীক্ষণ থাকবে না।

[প্রস্থান

[তখন পর্যন্ত ষোড়শীর আহ্নিক প্রভৃতি নিত্যকার্য সমাধা হয় নাই, সে এই আয়োজনে ব্যাপৃত থাকিয়া]

ষোড়শী। সাগর আমাকে কতবড় কথাই না স্মরণ করিয়ে দিলে। ফকির-সাহেব! যেখানে থাকুন, এ বিপদে আপনার দেখা আমি পাবোই পাব।

নেপথ্যে। আসতে পারি কি?

ষোড়শী। (সচকিত উঠিয়া দাঁড়াইয়া ব্যাকুল-কণ্ঠে) আসুন, আসুন—আমি যে সমস্ত মন দিয়ে শুধু আপনাকেই ডাকছিলাম!

[জীবানন্দ প্রবেশ করিলেন]

জীবানন্দ। এতবড় পতিভক্তি কলিকালে দুর্লভ। আমার পাদ্য অর্ঘ্য আসনাদি কৈ?

ষোড়শী। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া, সভয়ে) আপনি? আপনি এসেছেন কেন?

জীবানন্দ। তোমাকে দেখতে। একটু ভয় পেয়েছ বোধ হচ্ছে। পাবারই কথা। কিন্তু চেঁচিও না। সঙ্গে পিস্তল আছে, তোমার ডাকাতের দল শুধু মারাই পড়বে, আর বিশেষ কিছু করতে পারবে না।

[ষোড়শী নির্বাক হইয়া রহিল]

জীবানন্দ। তবু, দোরটা বন্ধ করে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যাক। কি বল?

[এই বলিয়া জীবানন্দ অগ্রসর হইয়া দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া দিলেন]

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়